#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২২
বনলতা,
সামান্য একটা আইসক্রিমের বক্স হারিয়েছ বলে তোমার মন খারাপ হচ্ছে। অথচ নিজের মানুষটাকে অন্য কারো হাতে হাত রেখে হাঁটতে দেখতে আমার কেমন লেগেছে, তা কি ভেবে দেখেছ? তুমি না হয় রাগে গাল ফুলাতে পেরেছ, কিন্তু আমি? আমার তো গাল ফুলানো মানায় না। তোমার রাগ ভাঙানোর জন্য আমি আছি, কিন্তু আমার? আমার জন্য কেউ নেই। তুমি তো বুঝবেই না আমি গাল ফুলিয়েছি রাগে, না অভিমানে। তোমাকে নিয়ে বড্ড ভয় হয় আমার। সবসময় মনে হয়, এই বুঝি হারিয়ে ফেললাম। গত কয়েকদিনে ভয়টা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেছে। তোমার সংস্পর্শে আসার অধিকার আমি পৃথিবীর কাউকে দিব না, হোক সে আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু। তুমি শুধু আমার বনের লতাগুল্ম, একান্তই আমার। আমি চাই এরপর থেকে তুমি যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। আমার হারানোর ভয় বাড়াবে না, কমানোর চেষ্টা করবে।
চিরকুট পড়ে আমি আইসক্রিমের বক্সের দিকে তাকালাম। আজ আবার শিয়রের পাশে একটা চিরকুট আর একটা আইসক্রিমের বক্স পেয়েছি। তবে আজ ঘুম থেকে উঠেই এটা খেয়াল করিনি। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে খেয়াল করেছি। চিরকুটটা বারকয়েক পড়ে আমি ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করলাম। আজকের চিরকুটটার লেখাগুলো অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন সন্দেহজনক। আমি কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে আনহাকে ফোন করলাম। পর পর তিনবার কল করার পর আনহা ফোন রিসিভ করে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,“ওই বান্দর মাইয়া, সকাল সকাল ঘুমের বারোটা বাজাইলি ক্যান?”
আমি সিরিয়াসভাবে বললাম,“সকাল হয়েছে আরও অনেক আগে। শোন, একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে তোর সাথে কথা বলতে ফোন করেছি।”
আনহা শব্দ করে হেসে বলল,“তোর জীবনে আবার সিরিয়াস ব্যাপার কী রে? বল বল, শুনি।”
“আজ আবার একটা চিঠি পেয়েছি, সাথে আইসক্রিমের বক্স।”
“ওয়াহ্! তারপর? আজকেরটায় কী লেখা?”
আমি গলা ঝেড়ে চিরকুটটা একদমে পড়ে শুনালাম। আনহা অবাক কন্ঠে বলল,“ওরে রোমিও রে! এ তো পুরো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে খাওয়ার মতো। এখনও বলবি, তাজ ভাই আর আমি জাস্ট ইম্পসিবল?”
শেষের কথাটা আনহা মুখ ভেঙিয়ে বলল। আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“সব কেমন গোলমেলে লাগছে রে। ঠিক আছে এটা না হয় মানলাম উনি আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু এর মধ্যে শ্রেয়ান ভাইয়াকে কেন টানছেন? লোকটা সবসময় আমাকে কনফিউজড করে দেয়।”
“আরে গাধি। জেলাস, জেলাস। বন্ধু তোর হাত ধরেছে বলে জেলাস ফিল করছে। ঐ যে বলল না তোকে হারানোর ভয় পায়? মানে হলো, উনি চান না কোনোভাবে তোকে অন্য কেউ ভালোবেসে ফেলুক।”
“তাই বলে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে জেলাস করবে?”
“ভালোবাসা এমনই, বুঝলি?”
আমি মাথা চুলকে বললাম,“এখন আমার কী হবে?”
আনহা ধমকের সুরে বলল,“তোর যক্ষ্মা হবে, গাধি। এখন ওই চিরকুট আর আইসক্রিম নিয়ে সোজা ভাইয়ার রুমে যাবি। গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করবি, ভালোবাসলে এমন লুকোচুরি খেলছেন কেন?”
আমি চোখ দুটো ছানাবড়া করে বললাম,“কী? আমি পারব না এসব বলতে।”
আনহা হামি তুলে বলল,“করা না করা তোর ইচ্ছা। আমি শুধু সাজেশন দিলাম। ওক্কে, গুড নাইট।”
আনহা ফোন কেটে দিলো। গুড নাইট বলেছে মানে এই মেয়ে এখন আবার ঘুমাবে। তারপর উঠে তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে খাবার নাকেমুখে গুঁজে ক্লাসে লেট করবে। আমি আবার ভাবতে বসলাম। কিছুক্ষণ আকাশ-কুসুম চিন্তা করে হঠাৎ করেই চিরকুট আর আইসক্রিম নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে সোজা তাজ ভাইয়ের রুমে ঢুকে গেলাম। কাজটা এতটা দ্রুত করলাম যে রুমের বাইরে থেকে একবার উঁকি মেরে দেখার কথাও ভাবলাম না, সোজা রুমে ঢুকে গেলাম। রুমে ঢুকে দেখলাম তাজ ভাই ব্যায়াম করছেন। উদোম শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। পরনে একটা ট্রাউজার আর গলায় সাদা তোয়ালে। আমাকে দেখে উনি ব্যায়াম থামিয়ে দিলেন। আমি কিছুটা থমকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। এলোমেলো দৃষ্টিতে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলাম উনি তোয়ালে দিয়ে গলার ঘাম মুছতে মুছতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম। খুব সাহস নিয়ে রুমে ঢুকে গেলেও এখন ভয় লাগছে। তাজ ভাই আমার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর আবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,“কী পিচ্চি? আবার নক না করে ঢুকেছিস? আসলে তোর মতলব কী বল তো?”
আমি ওনার কথায় কান দিলাম না। বড়ো একটা দম নিয়ে যথাসম্ভব সাহস জুগিয়ে হাতের চিরকুটটা উঁচিয়ে ধরে বললাম,“এসব কী?”
উনি ভ্রুকুটি করে বললেন,“কাগজ।”
“কাগজে এসব কী লেখা?”
উনি আমার হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে নিলেন। ভাঁজ খুলে চিরকুটে চোখ বুলিয়েই চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে বললেন,“ওরে পিচ্চি, তলে তলে আর কী কী চলে?”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,“নাটক করবেন না তো তাজ ভাই। এটা যে আপনি লিখেছেন তা আপনিও জানেন, আমিও জানি। কিন্তু এসব কী লিখেছেন? আগেরবার এড়িয়ে গেছেন, এবার উত্তর দিতে হবে। এসব কেন লেখেন আপনি? আর শ্রেয়ান ভাইয়াকে কেন টানছেন?”
তাজ ভাই ঠোঁট জোড়া গোলাকার করে শিষ বাজাতে বাজাতে আমার সামনে থেকে সরে গেলেন। কাবার্ড খুলে জামা-কাপড় বের করতে ব্যস্ত হলেন। উনি এবারও আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন দেখে আমি হাতের চিরকুট আর আইসক্রিমের বক্সটা পাশের টেবিলে রেখে দৌড়ে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। তারপর বললাম,“উত্তর না দিলে আমি আইসক্রিম খাব না।”
উনি হাতের জামা-কাপড় পাশের ডিভানে ছুঁড়ে মেরে দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,“কী জানার আছে?”
আমি ওনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললাম,“এসব কেন করছেন?”
উনি না বুঝার ভান করে প্রশ্ন করলেন,“কোনসব?”
আমি বললাম,“জানেন না?”
উনি এবার আমার দিকে দু’পা এগিয়ে এলেন। ওনাকে এগোতে দেখে আমি শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত পিছিয়ে যেতেই পেছনের কাবার্ডের সাথে ধাক্কা খেলাম। পেছনে আর জায়গা না পেয়ে সরে যেতে নিতেই উনি আমার দুপাশে দুহাত রাখলেন। ওনার নিঃশ্বাস আমার মুখে পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। এলোমেলো দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকাতেই ওনার লোমশ বুকটা চোখে পড়ল। উনি বাঁকা হেসে বললেন,“স্পষ্ট করে বল কী জানতে চাস?”
আমি বারবার ঢোক গিলে অস্ফুট স্বরে বললাম,“আপনার ফিলিংস।”
উনি স্মিত হেসে বললেন,“আমার ফিলিংস? জানা নেই তাই বলতে পারলাম না।”
আমি জানতাম উনি এভাবেই এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু আমি আজ কিছুতেই ওনাকে এড়িয়ে যেতে দিব না। যে করেই হোক ওনার মুখ থেকে কথা বের করবই করব। উনি এতটা কাছে দাঁড়ানোয় আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম,“আমি নেহালকে ভালোবাসি।”
কথাটা বলেই আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকেন তাহলে অবশ্যই এই কথাটা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। আমি খুব উৎসুক দৃষ্টিতে ওনার প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু আমার অপেক্ষার প্রহরে ভাঙন ধরিয়ে উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,“ওই বান্দা তার আলুর সাথে মিলেমিশে নিরামিষ হয়ে গেছে।”
আমার মুখটা চুপসে গেল। দ্রুত ভাবতে লাগলাম আর কী বলা যায়, যা শুনলে উনি সত্যি কথা বলে দিবেন। হুট করে আমার মাথায় একটা কথা এসেও গেল। আমি কিছু না ভেবেই বলে বসলাম,“শ্রেয়ান ভাইয়া যদি আমাকে পছন্দ করেন তাহলে ওনাকে লাইফ পার্টনার বানাব। উনি আমার জন্য পারফেক্ট, তাই না?”
আবার ওনার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা। এবার উনি সত্যিই প্রতিক্রিয়া দেখালেন। আমার হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে কাবার্ডের সাথে চেপে ধরলেন। আমি চমকে উঠলাম। ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ওনার রাগত মুখের দিকে তাকালাম। উনি আমার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“পিচ্চি পিচ্চির মতো থাক। নইলে একদম শুট করে দিব।”
আমি মৃদু কেঁপে উঠলাম। চোখ পিটপিট করে ওনার থেকে দৃষ্টি সরালাম। লোকটা আমাকে জব্দ করার খুব ভালো একটা পদ্ধতি পেয়েছেন। কথায় কথায় শুট। তাজ ভাই আমার হাত ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে বললেন,“চা নিয়ে আয়।”
আমি ভীতু দৃষ্টিতে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে এক পা দু’পা করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। দরজা পর্যন্ত যেতেই উনি পিছু ডেকে বললেন,“দাঁড়া। ওগুলো নিবে কে?”
আমি আবার ভেতরে ঢুকে চিরকুট আর আইসক্রিমের বক্সটা নিয়ে এক ছুটে ওনার রুম থেকে নিজের রুমে চলে এলাম। রুমে ঢুকেই ধপ করে বিছানায় বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। ইতোমধ্যেই হৃদপিন্ডে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে। হাতুড়ির ঠুকঠুক শব্দ আমার মস্তিষ্কে একটা কথাই আঘাত হানল, তাজ ভাই সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন। এখন আমি কী করব? আমার কী করা উচিত? ওনার মতো মাফিয়াকে ভালোবাসার কথা ভাবলেও আমার পিলে চমকে ওঠে। না না, ওনাকে আর এগোতে দেয়া যাবে না। ওনার থেকে আমাকে দূরে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু কীভাবে? উনি তো সারাক্ষণ আমার পেছনে ফেভিকল আঠার মতো লেগে থাকেন। তাহলে উপায়? এসব ভাবতে ভাবতে মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আমি দুহাতে মাথা চেপে ধরে চুপচাপ থম মেরে বসে রইলাম। তখনই আবার তাজ ভাইয়ের ডাক পড়ল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই চায়ের জন্য ডাকছেন। অথচ বাড়িতে মারজিয়া খালা আছেন, নতুন দুজন মেয়ে রাখা হয়েছে তারা আছে। কিন্তু মহাশয় আমাকেই খাটিয়ে মারবেন। বিরক্ত হয়ে আইসক্রিমের বক্সটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। আসার সময় দেখলাম তাজ ভাই আর বাবা ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে খবর দেখছেন। মারজিয়া খালা আর মিতা সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। রিতাকে রান্নাঘরে দেখলাম না। হয়তো অন্য কাজ করছে। মিতা আর রিতা দুই বোন। মিতা বড়ো, সে আমার সমবয়সী। আর রিতা মিতার দুই বছরের ছোটো। ওদের নতুন রাখা হয়েছে। কাজটা অবশ্য তাজ ভাইয়ের। সবসময় আমার খেয়াল রাখার জন্য ওদের রাখা হলেও, কাজটা ওদের খুব একটা করতে হয় না। করবে কী করে? যমরাজ নিজেই তো চব্বিশ ঘন্টা আমার পেছনে লেগে থাকেন। মারজিয়া খালার অবশ্য একটু উপকার হয়েছে। মিতা-রিতা ওনাকে সব কাজে সাহায্য করে। আমি রান্নাঘরে ঢুকতেই মিতা মিষ্টি হেসে বলল,“চা করবেন না-কি আপু?”
আমি বিরস মুখে আইসক্রিমের বক্সটা ফ্রিজে রাখতে রাখতে ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালাম। প্রত্যেকদিন সকালে এই চা বানানোর প্যারায় আমি অতিষ্ঠ, তবু করতে হয়। মারজিয়া খালা, মিতা আর রিতা এখন বেশ ভালো করেই জানে তাজ ভাই আমি ছাড়া কারো হাতের চা খান না। তাই সকালে রান্নাঘরে আসার সাথে সাথেই ওরা চা বানানোর জন্য সবকিছু এগিয়ে দেয় আমাকে। আমি চা বানিয়ে ট্রেতে করে দুই কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িং রুমে গিয়ে তাজ ভাই আর বাবার হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলাম। বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে বললেন,“তাজ, একটা কাজ খুব ভালো করেছিস, বুঝলি? এখন প্রত্যেকদিন সকালে আমার আম্মার হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি মেলে। ওর আম্মুও এমন সুন্দর চা বানাত।”
তাজ ভাই মুচকি হেসে বললেন,“মামু, তুমি বোধ হয় জানো না তোমার অকর্মা মেয়ে ম্যাপ আকৃতির রুটিও বানাতে পারে।”
বাবা চোখ দুটো ছানাবড়া করে অবাক হয়ে বলল,“কী? রুটি! কীভাবে? ও তো জীবনে কোনোদিন রুটি বানায়নি।”
তাজ ভাই ভাব নিয়ে বললেন,“আরে তোমার অলরাউন্ডার ভাগ্নে আছে না? শিখিয়ে দিয়েছি।”
“কবে?”
“তুমি গ্রামে থাকাকালীন। আস্তে আস্তে রান্নাও শিখিয়ে দিব।”
বাবা হেসে বলল,“বেশ ভালো তো। আম্মা, তুমি শেখো। শিখে রাখা ভালো। তোমার রান্না করার দরকার নেই। তা, আমার আম্মার হাতের রুটি কবে কপালে জুটবে?”
তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“মামুকে রুটি বানিয়ে খাওয়াস।”
আমি কটমট চাহনিতে ওনার দিকে তাকাতে গিয়েও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে সরে গেলাম। উজবুকটা আমাকে খাটাতে উঠেপড়ে লেগেছে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে ঘটলো এক অঘটন। আমি, বাবা আর তাজ ভাই সবেমাত্রই খাওয়া শুরু করেছি। তখনই জেমি এসে খাওয়ার জন্য চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। অথচ ও ঘুমাচ্ছিল বলে আমি ওকে রুমে রেখে এসেছিলাম। আমি রিতাকে বললাম জেমিকে খাবার দিতে। কিন্তু রিতা খাবার আনার আগেই জেমি এক লাফে টেবিলের ওপর উঠে গেল। আমার প্লেটের ওপর হামলে পড়তে নিতেই আমি ওকে বাঁ হাতে বাঁধা দিলাম। এটাই হলো অঘটনের মূল কারণ। জেমি খেপে গিয়ে আমার ডান হাতে একটা আঁচড় কেটে দিলো। আঁচড়টা এতটাই জোরে দিলো যে আমার হাত ছিলে রক্ত বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভয়ে আর ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলাম। বাবা আর তাজ ভাই খাবার রেখে লাফিয়ে উঠে আমার হাত চেপে ধরল। কিন্তু হাত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখেই আমার মাথা ভার হয়ে গা গুলিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ দুটো মুদে এল। হয়তো আমি জ্ঞান হারাচ্ছি। তারপর যখন চোখ খুললাম তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। ছোটো বেলা থেকে এই ব্যাপারটার সাথে আমি বেশ পরিচিত। রক্ত দেখলেই আমার মাথা ঘুরে যায়। আর জ্ঞান যখন ফিরে তখন থাকি হসপিটালের বেডে। জ্ঞান ফেরার পর সর্বপ্রথম চোখ পড়ল বেডের পাশের চেয়ারে বসা মানুষটার ওপর। তাজ ভাই কপালে দুহাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। আমি নড়েচড়ে উঠতেই অপরপাশ থেকে একজন নারীকন্ঠে বলে উঠল,“এই তো জ্ঞান ফিরেছে।”
সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই মাথা তুলে তাকালেন আর আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি মাথা ঘুরিয়ে নার্সের দিকে তাকাতেই স্বল্প বয়সী মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল,“হাই পিচ্চি। কেমন লাগছে এখন তোমার?”
আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ফেললাম। মেয়েটা নিজেই তো অল্প বয়সী, আমাকে দেখে পিচ্চি মনে হওয়ার মানে কী? মেয়েটা আমার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে আমিও মৃদু হেসে বললাম,“ভালো। কয়টা বাজে?”
“এগারোটা।”
“বাবা কোথায়?”
“তোমার বাবা বোধ হয় রিসেপশনে আছেন। আমি এক্ষুনি গিয়ে খবর দিচ্ছি।”
মেয়েটা হাসিমুখেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম কিন্তু শরীরটা দুর্বল লাগছে। তাই হার মেনে আবার বালিশে মাথা রাখলাম। পরক্ষণেই হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। ততক্ষণে তাজ ভাই আমাকে দুহাতে আগলে ধরে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন। আমি ওনার দিকে তাকালাম না। আমি চাই না ওনার সাথে বারবার আমার দৃষ্টি বিনিময় হোক, ওনার অনুভূতি আরও এগিয়ে যাক। কিন্তু তাজ ভাইয়ের কাজে আমি ওনার দিকে তাকাতে বাধ্য হলাম। উনি আমার বাঁ হাতটা ওনার বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরলেন। ওনার স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুততর হৃদস্পন্দন অনুভব করতেই আমি চকিত চাহনিতে তাকালাম। ওনার মলিন মুখ আর চোখের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে লোকটার এই অবস্থা হয়ে গেল! লোকটার ভালোবাসা কি আসলেই সত্যি? আমি ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু কেন জানি গলা দিয়ে শব্দই বের হলো না। তাজ ভাই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে গালে আলতো করে হাত রাখলেন। কাঁপা কাঁপা মৃদু কন্ঠে বললেন,“ঠিক আছিস?”
আমি রোবটের মতো ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালাম। তাজ ভাই এবার আমার হৃদপিন্ডে হাতুড়ি পেটার সূচনা ঘটিয়ে আমার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন। কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে কয়েক সেকেন্ড পর সরে গেলেন। ততক্ষণে আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিও বেড়ে গেছে। এই নিয়ে তিনবার উনি এই কাজ করেছেন। আমাকে তো ওনার থেকে দূরে থাকতে হবে। তাহলে এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিত? ওনার ওপর রাগ দেখানো উচিত। কিন্তু এটা হসপিটাল, তাই চুপচাপ গাল ফুলিয়ে মাথা ঘুরিয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বাবা। বাবাকে দেখে তাজ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। বাবা হাতের প্যাকেটটা বেড সাইড টেবিলে রেখে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,“এখন কেমন আছো আম্মা?”
আমি ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম,“একদম সুস্থ আছি বাবা। চিন্তা কোরো না।”
বাবা আমার সামনে বসে বললেন,“চিন্তা করব না আবার? মাঝে মাঝে যা ভয় পাইয়ে দিস তুই!”
“এসব তো অভ্যাস হয়ে গেছে বাবা। এত ভয় পাওয়ার কী আছে?”
“তুই সামান্য রক্ত দেখেই ভয়ে জ্ঞান হারাস আর আমি আস্ত একটা মেয়ের জন্য ভয় পাব না?”
আমি আবার হেসে ফেললাম। বাবা বেড সাইড টেবিল থেকে প্যাকেটটা এনে খুলতে খুলতে বলল,“খাবার নিয়ে এসেছি। চুপচাপ খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবি।”
বাবা প্যাকেট থেকে খাবার বের করে আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,“তাজ, তুইও খেয়ে নে। সকালের খাবার তো খাওয়া হয়নি।”
তাজ ভাই বললেন,“এখন খেতে ইচ্ছে করছে না মামু। পরে খাব। ওকে খাইয়ে তুমি খেয়ে নাও। আমি ডক্টরের সাথে একটু মিট করে আসি।”
“আচ্ছা যা।”
তাজ ভাই চলে গেলেন। এতদিনে আজ প্রথম চঞ্চল শয়তানের শুকনো মুখ দেখলাম। সবটাই কি আমার জন্য? মাফিয়ারা কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসে? কী জানি! এর উত্তর আমি পাব কি না সন্দেহ আছে।
আমরা বাড়ি ফিরলাম দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে। আমার শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল হয়ে আছে। ডক্টর বলেছিলেন আজকের দিনটা আমাকে হসপিটালে রাখতে। কিন্তু বাবা বা তাজ ভাই কেউই রাজি হননি। তারা বলেছেন বাড়িতে রেখেই কেয়ার করবেন। বাবা আমাকে ধরে ধরে গাড়ি থেকে বাড়ির ভেতর নিয়ে এলেন। আমাকে সোফায় বসাতেই আমি মিতাকে জিজ্ঞেস করলাম,“জেমি কোথায়?”
মিতা বলল,“জেমি তো নেই আপু। ওকে তো ভাইয়া ফেলে দিয়ে এসেছে।”
আমি আর্তনাদ করে বলে উঠলাম,“ফেলে দিয়েছে মানে? কোথায় ফেলে দিয়েছে?”
মিতা শুকনো মুখে মাথা নেড়ে বলল,“জানি না।”
আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শক্ত মুখে বললাম,“জেমিকে কী করেছেন আপনি? ও কোথায়?”
কথাটা বলার সময় আমার চোখে পানি চলে এসেছে, গলাটাও কেঁপে উঠেছে। তাজ ভাই গম্ভীর মুখে বললেন,“ফেলে দিয়েছি। যা দ্বারা ক্ষতি হবে তা পুষে রাখার দরকার নেই।”
আমি এবার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ধমকে উঠে বললাম,“আমার ক্ষতি আপনাকে দেখতে বলেছে কে? আপনি ওকে ফেলে দিয়েছেন কোন সাহসে? কেউ যখন আমার সাথে থাকে না তখন এই একটা প্রাণীই আমাকে সঙ্গ দেয়। আপনাদের কাছে ও ফেলনা হলেও আমার কাছে না। এখনই ওকে ফেরত নিয়ে আসবেন। যেখান থেকে পারেন নিয়ে আসেন, যান। কী হল? যাচ্ছেন না কেন? যান।”
তাজ ভাই চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমি নাকের পানি চোখের পানি এক করে হেঁচকি তুললাম। বাবা আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললেন,“কাঁদে না আম্মা। এত উত্তেজিত হয়ো না, তোমার শরীর দুর্বল।”
আমি ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,“আমার জেমিকে এনে দিতে বলো বাবা।”
বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,“এনে দিবে আম্মা। এখন রুমে চলো তুমি। তোমার বিশ্রাম দরকার।”
বাবা আর রিতা মিলে আমাকে রুমে নিয়ে গেল। রাগে ক্ষোভে আমি দুপুরের খাবারটাও মুখে তুললাম না। বাবা অনেক চেষ্টা করেও আমাকে খাওয়াতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
মুখে একটা স্পর্শ পেয়ে আমার ঘুম ছুটে গেল। কপাল কুঁচকে পিটপিট করে চোখ খুলতেই আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। জেমি আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আমি অসুস্থতা ভুলে উঠে বসলাম। জেমিকে কোলে তুলে নিতেই ও আমার গালের সাথে গাল ঘষে দিলো। আমি হেসে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম। রুমে পদধ্বনি শুনতে পেয়ে ঘাড় কাত করে তাকালাম। তাজ ভাই ট্রে হাতে এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। আমি এক নজর ওনার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গিয়ে মুখটা থমথমে হয়ে গেল। উনি ভাত মেখে আমার মুখের সামনে ধরলেন। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ওনার হাতে কিছুতেই খাব না আমি। তাজ ভাই ভারী গলায় বললেন,“হা কর। মেডিসিন খেতে হবে।”
আমি এমন ভাব করলাম যেন ওনার কথা শুনতেই পাইনি। উনি আবার একই কথা বললেন তবু আমি মুখ ফিরিয়ে রাখলাম। উনি বাঁ হাতে আমার মুখটা ঘুরিয়ে মুখে খাবার তুলে দিতে নিতেই আমি ওনার হাতটা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলাম। ওনার দিকে না তাকিয়েও বুঝলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ একইভাবে তাকিয়ে থেকে উনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলেন। গটগট করে হেঁটে রুম থেকে চলে যেতেই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভাবলাম নিজের হাতেই খাব। যদিও হাতে ব্যান্ডেজ, তবু চেষ্টা করলে খেতে পারব। কিন্তু খাবারের দিকে তাকিয়ে আর খেতে ইচ্ছে করল না। জেমি আমার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে এতক্ষণ কোথায় কোথায় ঘুরেছে কে জানে? দরজা বন্ধ করার শব্দে ফিরে তাকালাম। তাজ ভাইকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করলাম। হঠাৎ দরজা আটকানোর কী হলো? মতলব কী? উনি আবার এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। আমাকে চমকে দিয়ে কোমরের বেল্ট থেকে আস্ত একটা গান বের করে আমার মাথা বরাবর তাক করলেন। আমি আঁতকে উঠে চিৎকার দিতে যেতেই উনি এক হাতে আমার মুখ চেপে ধরলেন। ভয়ে আমার শরীরে কম্পন ধরে গেল। উনি চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠে বললেন,“শুট করে ফাজলামি বের করে দিব। খাবার নিয়ে এত অনিহা কিসের হ্যাঁ? না খেয়ে না খেয়ে খাদ্যনালী শুকিয়ে বসে আছিস তাতে সাধ মিটেনি? থাপ্পড় খাইয়ে সাধ মিটাব মাথামোটা। আজ হসপিটালে না গেলে তো কিছুই জানা হত না।”
আমি গানের ভয় ভুলে অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে নিশ্চুপ দেখে উনি আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়েই রইলাম, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করলাম না। আমি জানি উনি মাইন্ড রিড করে এখনই জেনে যাবেন আমার প্রশ্ন কী। তাজ ভাই বড়ো একটা দম নিয়ে রাগটা কিছুটা দমিয়ে বললেন,“আমি আসার আগ পর্যন্ত তুই খাবারে অনেক অনিয়ম করেছিস। মামু ডেকে খাওয়ালে খেয়েছিস নইলে না। মনে আছে? তার ফলস্বরূপ এখন খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে। হসপিটালে গেলাম এক সমস্যার জন্য, অথচ শুনে এলাম আরও বড়ো সমস্যার খবর। ডক্টর বলেছে টাইমলি খাবার আর মেডিসিন খেতে। কোনো অনিয়ম চলবে না।”
আমি ওনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি। সামান্য কোনো অসুখের কথা শুনলেই আমার মনে হয় এই বুঝি মরে গেলাম। আচ্ছা? এবার যদি সত্যি সত্যিই মরে যাই, তাহলে মোহনার বিয়ে খাব কীভাবে? গতকালই ওর বিয়েটা ঠিক হলো, অথচ আজই যদি আমি মরে যাই তবে বিয়েটা কপালে জুটবে না। আমাকে ছাড়া সবাই বিয়েতে কত্ত মজা করবে। ইশ্! কী দুর্ভাগ্য আমার!
চলবে…………………….🍁
#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে: ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৩
‘খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে’ কথাটা শুনেই আমার হা-হুতাশ শুরু হয়ে গেছে। বান্ধবীদের গ্রুপ কল করে কাঁদো কাঁদো গলায় কথাটা বলতেই সবাই মিলে আমাকে দিলো এক ধমক। ওদের ধমকিতে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। আমার এই দুঃখের দিনে ওরা দুঃখ প্রকাশ না করে উলটো আমাকেই ধমকাচ্ছে! ওদের রাগের কারণ জানতে চাইতেই ঐশী কপাল চাপড়ে বলল,“সাধে কি তোকে তাজ ভাইয়া মাথামোটা বলে? উনি বলল তোর খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে আর তুই বিশ্বাস করে নিলি? আরে গাধি মেয়ে, খাদ্যনালীতে কোনো প্রবলেম হলে তো আগে তার লক্ষণ দেখা যায়। তোর মাঝে এমন কোনো লক্ষণ ছিল, না আছে? ভাইয়া তোকে বোকা বানিয়েছে।”
আমি পুরোপুরি আহাম্মক বনে গেলাম। বোকা বোকা মুখে প্রশ্ন করলাম,“কী লক্ষণ?”
ফারহা বলল,“গুগলে সার্চ দে যাহ্।”
ওদের সাথে কথা শেষ না করেই আমি ফোন কেটে দিলাম। তাড়াতাড়ি গুগলে সার্চ দিলাম ‘খাদ্যনালী শুকিয়ে যাওয়ার লক্ষণ কী কী?’ সঙ্গে সঙ্গে গোটা গোটা অক্ষরে উত্তর এল,‘পেটে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া, পেট শক্ত হয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।’ অথচ এমন কোনো লক্ষণই আমার নেই। বজ্জাত লোকটা তাহলে আমাকে মিথ্যা কথা কেন বলল? আমি হনহন করে হেঁটে সোজা চলে গেলাম তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে। কিন্তু গিয়ে ওনাকে রুমে পেলাম না। তারপর গেলাম বাবার কাছে। বাবা আমাকে কিছু বলার আগেই আমি প্রশ্ন করলাম,“বাবা, আমার কী হয়েছে?”
বাবা হেসে বলল,“কী হয়েছে মানে?”
“মানে আমার খাবারে অনিয়মের কারণে কী সমস্যা হয়েছে?”
“ডক্টর বলেছে খাবারে অনিয়মের কারণে তোর শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে খাদ্যনালীতে সমস্যা হতে পারে।”
“ওহ্। তাজ ভাই কোথায়?”
“ও তো কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছে। তোর শরীর কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো।”
“খাবার নিয়ে কিন্তু আর হেলাফেলা চলবে না আম্মা। খুব চিন্তায় ফেলেছিস আমাকে।”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। তাজ ভাই না আসা পর্যন্ত আজ এখানেই অপেক্ষা করব। টিভি অন করে রিতাকে ডাকলাম। রিতা খুব চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। ওর সাথে গল্প করতে বেশ ভালো লাগে আমার। রিতার সাথে গল্প করতে করতে টিভি দেখছিলাম। এর মাঝে অনেকটা সময় কেটেছে, কিন্তু মহারাজের আসার নাম নেই। বিরক্ত হয়ে আমি রুমের দরজা পর্যন্ত চলে যেতেই কলিংবেল বেজে উঠল। রিতার আগে আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। তাজ ভাই ভেতরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে গা এলিয়ে দিলেন। আমার দিকে একবার তাকালেনও না। আমি দরজা বন্ধ করে ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি ততক্ষণে চোখ বন্ধ করেছেন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। আমি কিছুটা জোরেই ডাকলাম,“তাজ ভাই, তাজ ভাই।”
উনি চোখ খুললেন। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি শক্ত মুখে বললাম,“আপনি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছেন? আমার না-কি খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে? আমি জেনে গেছি এসব মিথ্যা কথা। এমন কিছুই হয়নি আমার। তাহলে আপনি এসব কেন বললেন?”
তাজ ভাই কপালটা খানিক কুঁচকে পুনরায় চোখ বন্ধ করলেন, যেন আমার কথা ওনার কানেই যায়নি। আমি
বিরক্ত হয়ে আবার বললাম,“আশ্চর্য! এখন চুপ করে আছেন কেন? আপনার মাথায় সবসময় এত বদ বুদ্ধি আসে কোত্থেকে, হ্যাঁ? কখনও কি ভালো কথা মুখে আসে না। মিথ্যা কথার জাহাজ!”
তাজ ভাই এবার চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই সোজা রুমের দিকে হাঁটা দিতে দিতে বললেন,“চা নিয়ে আয়।”
আমি পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলাম,“আনব না। আপনি মিথ্যা কথা কেন বললেন?”
তাজ ভাই আর পেছন ফিরে তাকালেন না। আমি শক্ত মুখে সোফায় বসে পড়লাম। রিতা এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ও এগিয়ে এসে বলল,“আপু, আমার মনে হয় ভাইয়া অসুস্থ।”
আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,“অসুস্থ?”
“হুম।”
“তুই কীভাবে বুঝলি?”
“ভাইয়ার চেহারা দেখেননি? কেমন যেন ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত লাগছিল।”
আমি একটু ভেবে বললাম,“তাই তো!”
পরক্ষণেই আবার মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“তাতে আমার কী?”
রিতা বলল,“ভাইয়া তো চা চাইল আপু। চা নিয়ে যান। হয়তো তার মাথা ব্যথা করছে।”
“পারব না। তুই নিয়ে যা।”
“ভাইয়া তো আমাদের হাতের চা খায় না আপু।”
“তাহলে না খেয়েই থাকুক।”
রিতা আমার দিকে দু’পা এগিয়ে এসে বলল,“ভাইয়ার মাথা ব্যথা বেড়ে গেলে বিষয়টা কি ভালো হবে আপু? চাচা শুনলে যদি আপনাকে বকে?”
রিতার কথাটা ফেলে দেয়ার মতো না। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বৈকি! আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে রান্নাঘরে চলে গেলাম। মারজিয়া খালা বেসিনে থালা-বাসন পরিষ্কার করছিলেন। আমাকে দেখে বললেন,“কী মা? কিছু লাগবে?”
আমি খালার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। গাল ফুলিয়ে চায়ের পানি বসালাম। মারজিয়া খালা আর প্রশ্ন করলেন না। রিতাও চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। চা করে আমি এক কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দ্রুত পায়ে হেঁটে তাজ ভাইয়ের রুমে চলে গেলাম। তাজ ভাই বিছানায় পা ঝুলিয়ে দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে মাথানত করে বসে আছেন। পরনের জামা-কাপড়ও এখনও পালটাননি। আমি বেড সাইড টেবিলে শব্দ করে চায়ের কাপটা রেখে গম্ভীর গলায় বললাম,“আপনার চা।”
তাজ ভাই মাথা তুলে তাকালেন। ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি থমকে গেলাম। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে আর চেহারাটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। ভালোভাবে তাকাতেও পারছেন না। লোকটা কি নেশা-টেশা করেছে না-কি? কী জানি! করতেও পারে। মাফিয়া বলে কথা! এসব তো তাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। আজ হয়তো অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু নেশা করলে তো মানুষ তাল সামলাতে পারে না। অথচ এই লোক তো দিব্যি হেঁটে হেঁটে রুমে চলে এল। আমি ভ্রুকুটি করে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলাম। তাজ ভাই এক হাত এগিয়ে আমার হাতটা মুঠোয় নিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি হুট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। ওনার এহেন কান্ডে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এতদিন শুধু কপালে চুমু দেয়া, কোলে তোলা পর্যন্ত ছিলেন, আর আজ কোলে মাথা রেখেই শুয়ে পড়লেন! আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,“আরে, এসব কেমন আচরণ? সরুন তাড়াতাড়ি। শোয়ার জন্য কি বালিশ নেই? কেউ দেখলে কী ভাববে? সরছেন না কেন? আপনার কানে ঢুকছে না আমার কথা? তাজ ভাই….।”
তাজ ভাই আমার কথাগুলো এড়িয়ে গিয়ে আমার ডান হাতটা ওনার কপালে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলেন। আমি হাতটা সরানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। বাঁ হাতে অনেক ঠেলাঠেলি করার পরও উনি এক চুলও নাড়লেন না। মুখে যে রাগ উপচে ফেলছি তা-ও তিনি কানে নিচ্ছেন না। হতাশ হয়ে আমি অসহায় মুখে বসে রইলাম। তাজ ভাইয়ের নিঃশ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে। নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট আমার কানে আসছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তার শরীরের মৃদু কম্পন আমি অনুভব করছি। উনি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম পাশেই তাজ ভাইয়ের ফোনটা বাজছে। আমি সেদিকে তোয়াক্কা করলাম না। কিন্তু দ্বিতীয়বার পুনরায় বাজতেই ভাবলাম শ্রেয়ান ভাইয়াও হতে পারে। কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে এক হাতে ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। স্ক্রিনে ইংরেজি বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘ভাইয়া।’ মানে রাজ ভাইয়া। আমি ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে সালাম দিলাম। ওপাশ থেকে রাজ ভাইয়া সালামের জবাব দিয়ে বললেন,“কে? ইলু?”
আমি বললাম,“হ্যাঁ ভাইয়া। কেমন আছো?”
“ভালো। তুই কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। ভাবি কেমন আছে?”
“ভালো। তাজ কোথায়?”
“উনি তো ঘুমাচ্ছেন।”
রাজ ভাইয়া একটু অবাক হয়ে বললেন,“এই অসময়ে তো ও কখনও ঘুমায় না। শরীর খারাপ না-কি আবার?”
“তাই তো মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই বাইরে থেকে ফিরল। তখন থেকেই চোখ দুটো লাল হয়ে মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। মনে হয় মাথা ব্যথা।”
রাজ ভাইয়া কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বললেন,“ওহ্ গড! ওর মাইগ্রেনের সমস্যা আছে ইলু। মাঝে মাঝেই ব্যথা ওঠে। কিন্তু ও মুখ বুজে সহ্য করে বলে সবাই স্বাভাবিক মাথা ব্যথা ভেবে নেয়।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,“মাইগ্রেন!”
“হ্যাঁ। ওর একটু খেয়াল রাখিস বোন। আমার ভাইটা বড্ড চাপা স্বভাবের মানুষ। ঘুম ভাঙলে জিজ্ঞেস করিস ব্যথা কমেছে কি না।”
আমি আস্তে করে বললাম,“আচ্ছা।”
“পরে আবার ফোন করব আমি। এখন রাখছি, আল্লাহ্ হাফেজ।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
ওপাশ থেকে রাজ ভাইয়া ফোন কেটে দিলেন। আমি কান থেকে ফোন নামিয়ে বিছানায় রাখলাম। তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। মানুষটা ঘুমে মগ্ন। ওনার হাতটা আলগা হয়ে আসায় আমি ওনার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে নিলাম। ওনার হাতটা সাবধানে ওনার বুকের ওপর রাখলাম। তারপর কী মনে করে ডান হাতের আঙুলে ওনার চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। হঠাৎ করেই যেন আমার ওপর কিছু একটা ভর করল। আমি তাজ ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,“এমন নিষ্পাপ মুখের মানুষটা বাস্তব জীবনে আসলেই কি ভয়ঙ্কর? সত্যিই কি সে মাফিয়া? আমার প্রতি তার অনুভূতিগুলোর আসল নাম কী? ভালোবাসা, না-কি আবেগ? এত কেয়ার কেন করে সে আমার? আমি কি মানুষটাকে চিনতে পারছি না? না-কি চেনার চেষ্টা করছি না? উনি কি ঠিকই বলেন? আমি সত্যিই মাথামোটা?”
পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করলাম,“ধুর ধুর! এই শয়তান লোক তো নিজেই আমাকে সবসময় ধাঁধায় ফেলে দেয়। এত কনফিউশনের মধ্যে থেকে আমি সত্যিটা বুঝব কীভাবে? সাধেই কি বলি, লোকটা বিপজ্জনক?”
টেবিল ঘড়িতে দেখলাম প্রায় আধঘণ্টা ধরে আমি এই রুমে আছি। এখন বেরোনো উচিত। কিন্তু এই বস্তাকে কীভাবে সরাবো? তাজ ভাইয়ের মাথাটা আস্তে করে দুহাতে তুলে ধরে আমি সরে বসে মাথাটা বিছানায় রাখলাম। তারপর অনেক কষ্টে ওনাকে টেনেহিঁচড়ে বিছানার কিনারা থেকে সরিয়ে নিয়ে বালিশে মাথা রেখে শোয়ালাম। মনে মনে ওনাকে হাজারটা বকা দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। রাক্ষসটা কী খেয়ে এত ওজন বাড়িয়েছে আল্লাহ্ জানে। নিজেকে সামলে নিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তাজ ভাইয়ের রুম থেকে চলে এলাম। মিতাকে সামনে পেয়ে ওর হাতে কাপ ধরিয়ে দিতেই ও বলল,“চা তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভাইয়া খায়নি?”
আমি বললাম,“না। এক কাজ করিস। তাজ ভাই ঘুম থেকে উঠলে ওনাকে তুই চা করে দিস।”
“আমার হাতের চা খাবে?”
“বলবি আমি দিতে বলেছি। আমি এখন পড়তে বসব। এক্সাম আছে।”
“আচ্ছা।”
__________________________
আজ আমার এক্সাম শেষ হয়েছে। এজন্য মনে মনে আল্লাহকে হাজারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এক্সামের এ কদিন তাজ ভাই রীতিমতো আমার টিচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাধ্য হয়ে আমাকে পড়ায় মনোযোগ দিতে হয়েছে। নিজেও রাত জেগেছেন আর আমাকেও গানের ভয় দেখিয়ে সজাগ রেখেছেন। আবার ঘুম কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে চা, কফি করে খাইয়েছেন। বিকালের সময়টাতে কিছুক্ষণ পড়িয়ে আবার টেনেটুনে ছাদে নিয়ে গেছেন। নিজের হাতে চা, নুডলস্ করে খাইয়েছেন। অথচ ওনার নুডলস্ পছন্দ না। অদ্ভুত লোক! বলতে গেলে, এক্সামের পুরো সময়টাতে আমার স্পেশাল কেয়ার চলেছে। কিন্তু ওনার এই এক্সট্রা কেয়ারের কিছু অংশ আমার কাছে বেশ প্যারাময় ছিল। বিশেষ করে শাসন করে পড়ানো। অবশেষে আজ এই প্যারা থেকে মুক্তি পেলাম। এমনিতেই এক্সাম শেষ করে আজকের দিনটায় মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। তার মধ্যে আবার বিকালেই মামা এসে উপস্থিত। এক্সাম শেষ হয়েছে শুনেই সে ছুটে চলে এসেছে আমাকে নিতে। প্রতি মাসেই একবার করে আমি নানু বাড়ি যাই। কিন্তু এবার দেড় মাস হয়ে গেছে, তাই নানু মামাকে পাঠিয়েছে। মামা যখন এসেছে তখন তাজ ভাই বা বাবা কেউই বাড়ি ছিল না। এদিকে মামা বলল সে বিকালের মধ্যেই আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তার না-কি অনেক কাজ পড়ে আছে তাই থাকতে পারবে না। বাধ্য হয়ে আমি বাবাকে ফোন করলাম। মামা বাবার সাথে কথা বলার পর বাবা যেতে বলল। আমিও ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাচতে নাচতে মামার সাথে চলে গেলাম। আর যাই হোক, নানু বাড়িতে তাজ ভাইয়ের প্যারা সহ্য করতে হবে না। আহা কী আনন্দ! ভাবলাম এবার বেশ লম্বা সময় নানু বাড়ি থাকব। নানু বাড়ি যাওয়ার পর আমাকে দেখে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল। নানু তো চোখের পানিই ছেড়ে দিয়েছে। আমিও সবাইকে পেয়ে আনন্দে মেতে উঠেছিলাম। কিন্তু ঐ যে একটা জায়গায় এসে আমাকে থেমে যেতে হয় না? সুখ তো আর আমার জন্য না। আমার আনন্দকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে পরদিন সকালেই তাজ ভাই আমার নানু বাড়ি উপস্থিত হলেন। আমি ওনাকে দেখে বাকহীন হয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। অথচ আমার নানু আর মামি তাজ ভাইকে পেয়ে আমার থেকে বেশি আদর আপ্যায়ন করছে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সবাই পারলে শয়তানটাকে মাথায় তুলে নাচে। ইচ্ছে করছিল লোকটার গলাটা টিপে দিতে। আমার বিস্ময় আর বিরক্তি তখনই রাগে পরিণত হলো যখন শুনলাম তাজ ভাই আমাকে নিতে এসেছেন। তা-ও আবার ওনার দাদু বাড়ি আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। যেখানে আমি ভেবে রেখেছিলাম আমার নানু বাড়ি এবার অনেকদিন থাকব, সেখানে না-কি এখন আমাকে ওনার সাথে ওনার দাদু বাড়ি যেতে হবে! আমি এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিয়েছিলাম কিন্তু তাজ ভাই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন বাবা আমাকে যেতে বলেছে। কারণ তিনদিন বাদে তাজ ভাইয়ের চাচাতো বোনের বিয়ে। বাবা কাজ ফেলে রেখে যেতে পারবে না তাই আমাকে পাঠাবে। ব্যাস, হয়ে গেল আমার আনন্দে পচা জল ঢালা। এবার আর কোনো উপায় নেই, যেতেই হবে তাজ ভাইয়ের সাথে। রাগটাকে ধামাচাপা দিতে আমি আমার মামাতো ভাই রেজার কাছে গিয়ে বললাম,“ভাইয়া, ঘুরতে নিয়ে যাবে?”
রেজা ভাইয়া আজ পর্যন্ত আমার কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেনি। নানু বাড়িতে নানু আর মামার পর সে-ই আমাকে বেশি আদর করে। রেজা ভাইয়া এ বছরই নতুন উকিল হয়েছে। আমার কাছে সে খুব ভালো আর মজার একটা ছেলে। মন খারাপের সময়ও বিভিন্ন মজার কথা বলে এক নিমেষে মন ভালো করতে পারে। নানু বাড়ি এসে আমি রেজা ভাইয়ার সাথে ঘুরঘুর করেই সময় কাটাই। আমি যখনই বলি,“ভাইয়া, ঘুরতে নিয়ে যাবে?” তখনই সে বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যায়। এই যেমন আজ ঘুরতে যাওয়ার কথা বলার সাথে সাথে একগাল হেসে বলল,“কেন নয়? বল কোথায় যেতে চাস।”
আমি বললাম,“বাইরে কোথাও গিয়ে ফুসকা খেয়ে আসব।”
“আচ্ছা যা, রেডি হয়ে আয়।”
আমি চুপচাপ গিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। জেমিকে নানুর কাছে রেখে রেজা ভাইয়ার সাথে বাড়ির বাইরে পা রাখতেই যমরাজ সম্মুখে দন্ডায়মান। রেজা ভাইয়া হেসে বলল,“তাজ, চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
তাজ ভাইও হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন,“চলো।”
শেষ আমার বাইরে ঘোরা। বুঝি না, এই লোক সবসময় কেন আমার আনন্দ মাটি করতে এক পা এগিয়ে থাকেন? কেন? আমার সাথে কিসের এত শত্রুতা? এই লোক আদৌ আমার ফুপির ছেলে কি না, এই নিয়ে তো এখন আমার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। এমন নয় তো? ভুলবশত আমার ফুপি আর অন্য কোনো মহিলার বেবি অদল-বদল হয়ে গেছে? কিংবা ইন্ডিয়ান সিরিয়ালগুলোর মতো কেউ ষড়যন্ত্র করে অদল-বদল করে দিয়েছে? হ্যাঁ এটাই হবে। নইলে যেই পরিবারে আমার ফুপির মতো মা ছিল, ফুপার মতো বাবা ছিল, রাজ ভাইয়ার মতো বড়ো ভাই ছিল, সেই পরিবারের ছোটো ছেলে কীভাবে এমন বিপজ্জনক হলো? আপন কেউ হলে তো পরিবারের কারো না কারো মতো হতই। জটিল ধাঁধা বটে! আজই রাজ ভাইয়াকে এই কথাটা জানাতে হবে।
চলবে………………..🍁