#মায়া
পর্ব ১১
লেখা- #Alisia_Amber
[কপি করা নিষেধ]
.
অয়নের রুমের বারান্দায় দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি বেশ কিছু সময় ধরে। না সে কিছু বলছে আর না আমাকে সরতে দিচ্ছে। আমি বিরক্ত মাখা চাহনি দিলে সে অন্যদিকে তাকায়।
আমি দুপা পিছিয়ে নিয়ে চলে যাবো এমন সময় বললো, ‘স্টপ’
দাঁড়িয়ে পরলাম। রাগী লোক নিক্ষেপ করে বললাম, ‘পারবো না।’
অয়ন এগিয়ে আসলো। অনেকটা কাছে এসে আমার দুহাত পিছনে নিলো। আমি ফিল করলাম সে আমার হাত বাধছে। আমি বলেই ফেললাম, ‘কি করছেন টা কি আপনি’
অয়ন আমায় থামিয়ে দিলো। ঠোটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললো, ‘এত কথা! কই আগে তো কিছু বললেই চুপ হয়ে যেতে। এখন এত খই ফোটে কেনো?’
আমি মুচকি হাসলাম। বলবো কি এর পুরো ক্রেডিট টাই আপনার অয়ন। কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। অয়ন আমাকে বললো, ‘নিচে তাকাও’
আমি তাকালাম। একি শুদ্ধ। রাস্তার ওপারে বড় গাছটায় শুদ্ধ হ্যালান দিয়ে আছে। নজর সোজা আমার দিকেই। সে এখনো যায় নি? আমার পিছু পিছু এসেছে কেনো?
অয়ন আবারো বললো, ‘কিছু দেখেছো!’
আমি অয়নের দিকে তাকালাম। বললাম, ‘হু শুদ..
আর কিছু বলতে পারলাম না। এতদিনে অয়ন কখনো আমার এতটুকু কাছে আসে নি। কিন্তু আজ! সে এটা কি করলো।
অয়ন আমার কাছে এসে হালকা করে ঠোট ছোয়ালো। তারপর সরে এসে আমার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘শুনো মেয়ে, আমি তোমাকে একটুও পছন্দ করি না’ বলে আবারো এগিয়ে এসে নাকে নাক ঘষলো। তার এক হাত আমার কোমড় পেচিয়ে আছে। আমার দুহাত বাধা। আমি মুখ ঘুড়িয়ে নিচে দেখলাম শুদ্ধ নেই। শুদ্ধকে দেখানোর জন্যই কি অয়ন এসব করেছে? অয়ন আমার হাতের বাধন খুলে দিলো।
আমি ঘুরে দাড়ালাম। বললাম, ‘কাজটা মোটেও ঠিক হলো না।’
অয়ন হাসলো। বললো, ‘ঠিক হয়েছে। আমিও টনিক জানি। তার বোঝা উচিত তুমি মোভ অন করেছো। তাহলে আর অপেক্ষার কিছু নেই’
‘সে সরবে না। হালকা হলেও তার জেদ সম্পর্কে আমার বেশ ধারণা আছে। এসব না করলেও পারতেন’
আমার কথা শুনে অয়ন আমার পাশে এসে দাড়ালো। বলল, ‘মায়া শুনো। জীবনে প্রতিটা সময় থেকে মানুষকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। মরীচিকার পেছনে মানুষ তখন ছুটে যখন সে অসহায়। তার তা চাই। না পেলে সে বাচবে না।
যথেস্ট সাবলম্বী শিক্ষিত মেয়ে হয়ে বোকামির পরিচয় দিও না’
আমি ব্রু কুচকে বললাম, ‘মানে?’
‘মানে খুব সহজ। তোমাকে জীবনের কঠিন এবং মূল্যবান একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবং তাতে অতিরিক্ত সময় ব্যায়ও করা যাবে না। তুমি কি প্রস্তুত?’
‘নাহ। আমার সময় প্রয়োজন’
আমার কথা শুনে অয়ন দেয়ালে একটা ঘুষি মারলো। আমি তৎক্ষনাৎ তার হাতের দিকে তাকালাম। আতংকে। সে হাসলো। বললো, ‘তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছো মায়া। আমায় দ্বিধায় ফেলে দিও না।’
‘আমার সময় প্রয়োজন অয়ন। আমি একই ভুল বার বার করতে প্রস্তুত নই।’
‘অকে! বাট একটা কথা সারাজীবন মনে রাখবে মায়া। জীবনের কঠিন থেকে কঠিন সময়েও এই অয়ন মায়ার পাশে আছে আর থাকবে। এই শুদ্ধ ফুদ্ধ কিছুই করতে পারবে না’
বলেই আমার মুখে একটা ফু দিয়ে দু পা এগিয়ে চলে গিয়ে আবার বললো, ‘শুনো মেয়ে আমি তোমায় ভালো টালো ও বাসি না’
আবার বললো, ”সরি” সে চলে গেলো।
এবারে আমি হাসলাম। খিলখিল করে হাসলাম। আমার হাসিতে দেয়ালের ইট বালু সিমেন্ট গুলোও যেনো হাসলো। প্রকৃতিতে মৃদু মন্দ বাতাস বইতে লাগলো। আজ কি আমি খুশি! খুব বেশি? আমার ভীষণ ভাবে কাউকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রচন্ড খারাপ হতে ইচ্ছে হচ্ছে। আচ্ছা অয়নও কি আমার সাথে খেলছে! শুদ্ধর কাছে এখন তিথি থাকলে কি সে আমার কাছে ফিরতো? কখনোই না। সে একটা স্বার্থপর। তাকে শাস্তি দিবো? উহু মায়া তো কষ্ট পায়। মায়া কষ্ট দেয় না। হুট করেই আমার কান্না পেয়ে গেলো। দুহাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেদে দিলাম। বাতাসের দাপটা এসে বারান্দার দরজায় জোরে এক বাড়ি খেলো।
আমার এখনো মনে আছে আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে পা রেখেছি। আমার সিনিয়র একজন প্রায়ই আমাকে উত্তক্ত করতো। আমি কাউকে কিছু বলি নি। কারো কাছে সহযোগিতাও চাই নি। হুট করেই একদিন সেই ছেলেটা এসে পথ আগলে দাড়ালে কোত্থেকে যেনো অয়ন এসে হুংকার ছেড়ে বলে, ‘মায়া আমার ফিয়ন্সে। আর কখনো যেনো এমন অভদ্রতা না দেখি’ ব্যাস এর পর থেকে গেটের দাড়োয়ান সহ স্যার রাও আমার সাথে সম্মানের সহিত কথা বলেন।
একদিন রিক্সা থেকে নামার সময় জুতায় বেজে পরে গেলাম। একটা নখ উলটে গেলো। চোখ খিচে বন্ধ করার আগেই কেউ এসে আগলে নিলো। সে আর কেউ না অয়ন। মিনিটের মধ্যেই সে আমাকে ফার্মেসি নিয়ে মেডিসিন লাগিয়ে সুস্থ করে দিলো।
আমার একা রাতের বারান্দার কোণায় দাঁড়িয়ে উদাশীন হাওয়ায় দিন রাত কল্পনার রাত্রীতে সেও তার গাড়িতে হ্যালান দিয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।
শপিং মলে গিয়ে এক জোড়া কানের দুল কিনলেও মামা আমাকে ফ্রিতে দিয়ে দিতো।
ক্যান্টিনে একদিনও বিল দিতে হয় নি।
পরীক্ষার আগের রাতের হাজারও সমস্যার সমাধান হয়ে সারারাত বুঝিয়ে দিত তার হাজার ব্যাস্ততার মধ্যে।
মন খারাপের দিনে পার্কের ব্যাঞ্চিতে কোত্থেকে সে এসে সঙ্গ দিতো নিরবতার মাঝে।
বিনা বাক্য ব্যায়ে সব প্রয়োজন মিটিয়ে দিতো ম্যাজিকের মত।
সে আমায় ভালোবাসে না। একটুও না আমি জানি। কথাটা ভাবতেই আমার কান্নারা আরো বেড়ে গেলো। আজ কেনো যেনো প্রাণ খুলে কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে। মানুষটা এতো ভালো কেনো? কেনো নির্সার্থ ভাবে করে যাচ্ছে। আমি তো তার যোগ্য নই। আমি একদমই যোগ্য নই তার। মায়ারা কখনোই অয়নের যোগ্য হতে পারে না।
হঠাত একটা হাতের স্পর্শ পেলাম মাথায়। চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পারলাম মনিমা। দুহাত বাড়িয়ে উনাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে কেদে গেলাম। সে আমায় আগলে রেখেছে। পরম মমতায় আগলে রেখেছে। আজ চার চারটে বছর ধরে আগলে রেখেছে।
‘আমি কি করবো মনিমা’
‘তোর মনের কথা শুন মা। মন যা বলে তাই কর। কোনো বাধা নেই।’ -মনিমা মাথায় হাত রেখে বললেন।
‘তোমার ছেলে ভীষন খারাপ’
মনিমা হাসলেন বললেন, ‘ভালো বানিয়ে দে’
‘পারবো না।’ আমার কাঠ কাঠ গলা।
মনিমা খাবার বাড়তে গেলেন। আমার চোখ মুছে বললেন, ‘আর কান্না নয় মা’
তখন অয়ন এসে আমার হাত চেপে ধরতেই শুদ্ধ হুংকার দিয়ে বলে হাত ছাড়ার জন্য। অয়ন ছাড়ে না। আমাকে টেনে তার পেছনে এনে শুদ্ধকে আঙ্গুল উচিয়ে শাশিয়ে বলে উঠে, ‘আর একটা শব্দ করলে ভুলে যাবো তুই কে!’
শুদ্ধ হুহা করে হেসে বলে উঠে, ‘আমিও ভুলে যাবো তুই কে! তোর বেইমানি আমি ভুলি নি অয়ন। তুই আমার মায়াকে আমার থেকে সরিয়ে রেখেছিস! সেই আগের জেদ না? আমার সব জিনিসে নজর দিতেই হয়?’
অয়ন শুদ্ধর কর্লার চেপে ধরে বলে, ‘চুপ! একদম চুপ! ভুলে যাস না তুই নিজেই মায়াকে বের করে দিয়েছিলি। তাহলে কেনো সে তোর কথা স্মরণে রাখবে!’
শুদ্ধ হাত তালি দিয়ে বললো, ‘ভালোই খেললি।’
তারপর আমায় বললো, ‘চলো মায়া’
আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই অয়ন আমাকে টেনে এনে গাড়িতে বসিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসলো। মুহুর্তের মাঝেই কত কিছু হয়ে গেলো।
আমি উঠ দাঁড়িয়ে চুপি চুপি বেড়িয়ে গেলাম অয়নদের বাসা থেকে। বেড়ুতেই ঝুম ঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো। মাথায় হাত রাখার আগেই মস্ত বড় এক ছাতা মাথার উপর এসে ঠেকলো। পেছনে তাকাতেই সে বললো, ‘ভেবো বা কেয়ার করছি। আমি তোমাকে পছন্দই করি না।’
হুট করে আমার রাগ হলো। আমি তার ছাতা থেকে বেড়িয়ে গেলাম। রেগে বললাম, ‘আমিও ভালোবাসি না। কাউকে ভালোবাসিনা। এপৃথিবীতে মায়ার কেউ নেই। মায়া একা। মায়াকে একাই বাচতে হবে। ‘
আমার কষ্ট হলো। আমি অয়নের দিকে ফিরে তাকালাম না। দৌড়ালাম। জোড়ে হর্নের শব্দ এসে কানে ঠেকলো। সামনে প্রখর লাইটের আলো আসাতে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললাম। আর এগুতে পারলাম না….
মায়ার সুখে কি কেবল নজর লেগে যায়! চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘মায়া কাউকে ভালোবাসতে চায় না। মায়া কেবলি ভালোবাসা চায়। মায়া বড্ড বেশি স্বার্থপর। মায়ারা পৃথিবীতে সল্প সময়ের জন্য আসে।
চলবে….