#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৪
দিন এগিয়ে চলেছিলো, ক্রমশই একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছিলেন পারুল বালা, করুণা কে সারাদিনের জন্য তাঁর সেবায় রেখে দেওয়ায়, অন্য কাজের ছুতোয় খুব বেশি এদিক ওদিক চলে যাওয়ার সুযোগ তার কমে এসেছিলো। তাকে আটকে রাখতে পেরে মনে মনেই শান্তি পাচ্ছিলো মৃণালিনী, আলোকের শুকনো মুখ তার নজর এড়িয়ে যাচ্ছিলো না।
প্রায় মাস খানেক পরের কথা, সৌম্য যথারীতি শনিবার রাতে বাড়ি ফিরে এসেছিলো, সে বাড়িতে ফিরলেই বাড়িতে অন্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়, অন্যান্য দিনের থেকে খাওয়া দাওয়া মিটতে রাত হয় সেদিনটায়। ফলে রবিবার দিন সকালে সব ব্যাপারেই একটু গড়িমসি চলছিলো, জলখাবার এর পর্ব মিটতে যথেষ্টই দেরি হলো, সেসব পর্ব মিটতে না মিটতেই সুরেশ তার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সেই সময় শ্যাম সুন্দর বৈঠক খানার পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন, সুরেশ কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
কাকাবাবু কে জানিয়েছ আলোকদার কথা?
শ্যাম সুন্দর কে দেখে সৌম্য কে জিজ্ঞেস করলো সুরেশ, সৌম্য বিপাকে পড়লো। সে যে ইচ্ছে করেই এই মুহূর্তে বাবা কে কোনো প্রমাণ ছাড়া আলোকদার কথা জানাতে চায় না এটা সুরেশ কে বলার আগেই শ্যাম সুন্দর ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
আমি আলোকদার কথা বলতে বলেছিলাম আপনাকে কাকাবাবু, সৌম্য বোধহয় বলার সুযোগ করে উঠতে পারেনি এখনও,
সৌম্য কে নিরুত্তর দেখে সুরেশ নিজেই বলে উঠলো, অবাক দৃষ্টিতে একবার সুরেশ আর একবার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন শ্যাম সুন্দর।
সুরেশ আসলে আমাকে বেশ কিছুদিন আগেই জানিয়েছিল। আমি আপনাকে বলবো বলেই ভেবেছিলাম বাবা, সরমার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এতদিন আর বলা হয়ে ওঠেনি।
খানিকটা কৈফিয়তের সুরে বললো সৌম্য, শ্যাম সুন্দর বিরক্ত হলেন।
আহ্! কি এমন দরকারি কথা তুমি বলে উঠতে পারোনি সময় করে, শুনি একটু! তোমার তো সব কিছুতেই আঠেরো মাসে বছর!
আর চেপে রাখার কোনো উপায় নেই দেখেই সৌম্য মাথা নিচু করে সম্পূর্ন ঘটনাই বলে ফেললো।
সুরেশ লজ্জিত হলো, সৌম্য যে কথাগুলো বাবা কে জানায়নি এটা বুঝে সে এবার কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছিলো, কিন্তু পেশায় উকিল শ্যাম সুন্দর কে বোঝানো অতো সহজ নয়! মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেও বাইরের লোকের উপস্থিতিতে ছেলে কে কিছু বলা শ্যাম সুন্দর ঠিক মনে করলেন না। তিনি মনের রাগ মনেই চেপে রেখে কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই বৌদির কড়া গলা তাঁর কানে এলো।
দূর করে দাও তাকে, আর কোনো দিনও যেনো এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায় না সে! দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেচি গো!
অনেকক্ষন আগেই চা দিয়ে বৈঠক খানা ঘরে পাঠিয়েছিলেন করুণা কে পারুল বালা, এতক্ষনেও সে ফিরে না আসায়, নিজেই উঠে এসেছিলেন দেখতে। করুণা চা নিয়ে ভেতরে না ঢুকে লুকিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আলোকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুনছিল, পেছন থেকে আসা পারুল বালার গলা শুনে চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালো। তার হাতে ধরা কাঁসার থালায় রাখা চায়ের কাপ কেঁপে উঠে চা ছলকে পড়লো।
তুই চা না দে একেনে দাঁড়িয়ে আচিস কেনো? তোর এসব কতায় কাজ কি!
কড়া গলায় করুণার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন তিনি, দরজার বাইরে থেকেই সমস্ত আলোচনা তাঁর কানে এসেছিলো। এ সংসারের মঙ্গলই তাঁর কাছে শেষ কথা, তার জন্যে দরকার হলে নিজের ভাইপোকেও তিনি রেয়াত করবেন না।
বড়ো মার কথায় কিছুটা হলেও সৌম্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, বড়ো মা কি ভাববেন এই ভেবেই আরও সে এতদিন কথাটা চেপে রেখেছিলো। সৌম্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে করুণার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, সে প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে চায়ের কাপ রেখে দিয়েই পারুল বালা আর কোনো কথা বলার আগেই ওখান থেকে ছুটে চলে গেলো।
শুধু কথা জানার দেরি টুকু ছিলো, এরপরেই বাড়িতে প্রায় দক্ষ যজ্ঞ বাধিয়ে দিলেন পারুল বালা। হারুর মা কে দিয়ে আলোকের সমস্ত জিনিস ঘরের বাইরের উঠোনে এনে ফেলে দিলেন, ঘরে গোবর জলের ছড়া দিয়ে ঘর কে শুদ্ধ করে ফেললেন। কুমুদ তাঁকে বলতে গিয়েছিলেন একটু,
দিদি, একেবারে তাড়িয়ে দেবে! একটু বুঝিয়ে বললে হতো নে? সেই কবে তে এই বাড়িতে আচে! কোথায় যাবে ছেলেটা!
এক ধমকে তাঁকে থামিয়ে দিলেন পারুল বালা,
বড্ড দরদ তোর! সব নে পথে বসিয়ে গেলে, তবে তোর হুঁশ হবে? সংসার কে সব্বনাশ থেকে বাঁচাতে চাস তো এই বেলা তাকে ভালোয় ভালোয় বিদেয় কর!
হৈ চৈ শুনে মৃণালও দোতলা থেকে নেমে এসে ওখানে দাঁড়িয়েছিলো, আজ কেউই পারুল বালার কথার প্রতিবাদ করলো না, মুখে কথা না বললেও মনে মনে প্রত্যেকেই তাঁকে সমর্থন করলো।
খ্যমতা থাকে তো এ বাড়িতে একবার পা দে দেকুক সে! ঝাঁটা মেরে যদি তারে বিদেয় না করেচি, তবে আমিও পারুল বালা নই! এই তার বাপ মা কে হাতে ধরে কতা দে এলুম, আর ছেলে আমার মুকে চুন কালি মাকালে!
পারুল বালার চিৎকার শুনেই হোক বা কোনো জায়গায় খবর পেয়েই হোক, আলোক কিন্তু বাড়ি ফিরলো না। তার স্তূপীকৃত জিনিস উঠোনেই পড়ে রইলো, সে সব তুলে গুছিয়ে রাখার সাহস পারুল বালার অনুমতি ছাড়া কারুর ছিলো না।
সুরেশ মাঝখান থেকে বিপদে পড়লো, তার আনা খবরের ভিত্তিতেই যে এতো বড়ো সিদ্ধান্ত সেটা বুঝেই সে একটু কুণ্ঠিত হয়ে রইলো। কিন্তু সে এতো উপকার করেছে এটা পারুল বালা ভুললেন না, তিনি পুকুরে জাল ফেলতে পাঠালেন, দুপুরে সুরেশের এখানেই খেয়ে যাওয়ার হুকুম হলো। অসুস্থ শরীরে তিনি হাঁক ডাক করতে লাগলেন, সব কিছু দেখে শুনে শেষ পর্যন্ত মৃণালিনী বড়ো মার কাছে এসে দাঁড়ালো।
বড়ো মা, আপনার শরীর খারাপ। ডাক্তার বাবু আপনাকে বেশি পরিশ্রম করতে বারণ করেছেন!
এই আমার বিদ্যেধরী এলেন! সব কতাতেই তেনার কতা! মুকে কি এট্টু লাগাম দে রাকতে পার নে মা গো! আমার হলো গিয়ে কই মাছের প্রাণ! তোমাদের মতো ফুলের ঘায়ে মুচ্ছ আমি যাই নে মা!
মুখে বললেও তাঁর মুখে চোখেই ক্লান্তি প্রকাশ পাচ্ছিলো, তাই বউয়ের কথাতেই হোক বা নিজের কষ্টে, ধীরে ধীরে রান্না ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন পারুল বালা।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া মিটে গেলো, আলোকের জন্যে বসে থেকে থেকে একসময় হেঁসেল তুলে ফেললেন কুমুদ, তাও আলোক বাড়ি এলোনা। ক্রমশ আস্তে আস্তে বাড়ি নির্জন হচ্ছিলো, খেয়ে দেয়ে উঠে বেশ কিছুক্ষন গল্প করার পরে সুরেশ তার বাড়ির দিকে রওনা হলো।
শ্যাম সুন্দর এতক্ষন চুপ করে ছিলেন শুধু সুরেশের যাওয়ার অপেক্ষায়, এবার তিনি নিজের ঘর থেকে নেমে এলেন। সেই সময়ই সুরেশ কে বিদায় দিয়ে সৌম্য বাড়িতে ঢুকছিলো একবারে বারান্দায় ঢুকতেই বাবার মুখোমুখি হলো সে।
আর কতো কাল এই রকম গা ছাড়া হয়ে থাকবে! নিজেও কিছু দেখবে না, কেউ খবর দিলেও জানাবে না? আমি আর কদ্দিন! তারপরে যে এসব পাঁচ ভূতে লুটে পুটে খাবে!
প্রবল চিৎকার করে উঠলেন শ্যাম সুন্দর, বাড়ির সবাই এগিয়ে এসেও তাঁকে থামাতে পারছিলো না। সৌম্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, বাবার চিৎকারে মনে মনে ব্যথিত হলেও তার স্বভাব মতোই মুখে কিছু প্রকাশ সে করলো না।
দুপুর থেকে প্রবল চিৎকার চেঁচামেচির পর কিছুটা ঠান্ডা হয়ে ঘরে বসেছিলেন শ্যাম সুন্দর, মৃণালিনী চা নিয়ে ঢুকলো। তাকে দেখেই শ্যাম সুন্দর আবার নতুন করে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন,
তুমি জানো বৌমা! আমার পুত্রটি এতটাই গণ্ড মূর্খ যে সুরেশের কাছ থেকে সব জানার পরেও সে চুপ করে বসেছিলো! আজ যদি সুরেশ নিজে এসে না বলতো আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। আজই আমি ওই আলোক কে ঘর থেকে তাড়াবো!
সকাল থেকেই স্বামীর ওপরে শ্বশুরমশাই এর চিৎকার চেঁচামেচি শুনছিল মৃণালিনী, মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও এতক্ষন সে কোনো কথা বলেনি, এখানে ঘরের মধ্যে তাঁকে একা পেয়ে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেললো মৃণাল।
শুধু আপনার ছেলে নয়, আমিও জানতাম বাবা, কিন্তু আপনাকে এই কারণেই জানাই নি যে আমাদের হাতে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য ছিলো না।
এবার ক্ষুব্ধ হলেন শ্যাম সুন্দর,
আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি বউমা, তুমি যথেষ্টই বুদ্ধিমতি বলেই আমার ধারণা ছিলো।
সত্যি করে বলুন তো বাবা, আপনি কি কিছুই জানতেন না? হ্যাঁ, বাবা আমি খানিকটা ইচ্ছে করেই আপনাকে আরো জানাইনি, কারণ আপনি কিন্তু আলোক দার অসততার ব্যাপারে অনেকদিন আগেই জানতেন। আমি নিজেই তো আপনাকে ওনার করা হিসেবের গরমিল দেখিয়ে ছিলাম আগেই, কই আপনি তো কিছু ব্যবস্থা নেননি তখন! তখন তো আপনার কাছে সব প্রমাণ ছিলো, কিন্তু তা সত্বেও আপনি চুপ করে ছিলেন, আর এক্ষেত্রে তো আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ ছিলো না।
আমার কোনো উপায় ছিলো না বউমা, আলোক কে তাড়িয়ে দিলে আমার পক্ষে এসব কাজকর্ম দেখা সম্ভব ছিলো না! আমার ছেলে যদি এসব বিষয়ে একটু মাথা ঘামাতো! সে তো সব কিছু বিলিয়ে দিতেই ইচ্ছুক বেশি!
খানিক টা হতাশার গলায় বললেন শ্যাম সুন্দর, মৃণালিনী তাঁকে থামিয়ে দিলো,
না বাবা! আপনার ছেলে কে দায়িত্ব দিলে সে নিশ্চয়ই দেখতো, কিন্তু আপনিই তাকে কোনোদিনও দায়িত্ব দিতে চান নি। আমার মনে হয়েছে আপনি হয়ত ভাবেন যে সে দায়িত্ব পেলে আপনার সব কিছু বিলিয়ে দেবে, সেই ভয়েই তার থেকে বেশি গুরুত্ব আপনি আলোক দা কে দিয়ে এসেছেন সব সময়। এমনকি আপনি আমার ওপরও কোনো সময় পুরোপুরি দায়িত্ব ছাড়তে পারেন নি শুধু এই জন্যেই, যে পাছে আমি দায়িত্ব পেলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কোনো কাজে মাথা ঘামাই! আপনি সব সময় চেয়েছেন, বাড়ির বউ আপনার কাজে লাগুক, কিন্তু বাইরের কেউ যেনো সেকথা জানতে না পারে!
শ্যাম সুন্দর চুপ করে গেলেন, সেটা যে নিজের কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনায় তা একটুও নয়, বরং তিনি মনে মনেই একটু কুণ্ঠিত হচ্ছিলেন বৌমার কাছে তাঁর স্বরূপ ধরা পড়ে যাওয়ায়। তিনি যে সমস্ত কিছু জানা সত্বেও এতকাল ইচ্ছাকৃত ভাবেই আলোক কে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন সেটা মৃণালিনী তাঁর মুখের ওপর বলার সাহস দেখাতে পারে সেটা তিনি আশা করেন নি।
ইচ্ছা করলে তিনি বউমা বা ছেলের কাছে দায়িত্ব দিতেই পারতেন, কিন্তু ছেলে যে আগের বার তাঁকে অনেকটা বোকা বানিয়েই জমি ইস্কুলের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলো সেটা তিনি আলোকের কাছে আগেই জানতে পেরেছিলেন। সেই থেকেই ছেলের ভরসায় সম্পত্তি ছাড়ার কথা তিনি কখনও ভাবেন নি, বরং আলোকের কাছ থেকে সব তথ্যই যাচাই করে নেন তার পর থেকেই। এই যে ছেলে, বউমা এবং আলোক, সবাইকেই নিজের ওকালতি বুদ্ধিতে তিনি চালিয়ে নিয়ে চলে ছিলেন এতদিন তার খবর যে বৌমার জানা ছিলো, এটা তাঁকে মনে মনে লজ্জিত করছিলো। তাঁর ওকালতি বুদ্ধি কে মাত দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছেলে রাখে তা তিনি ছেলের বিয়ের রাতে, এবং ইস্কুলের ব্যাপারে আগেই টের পেয়েছিলেন, কিন্তু বৌমাও যে তাঁকে ঠিক চিনেও চুপ করে ছিলো এতদিন এটা তিনি আগে বুঝতে পারেন নি।
কুমুদ পাশের ঘরেই শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, ছেলের ওপরে স্বামী কে চোট পাট করতে দেখে যথেষ্টই দুঃখ পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কথার মূল্য কোনোদিনও এ বাড়িতে ছিলো না। তাই অতো কথার পরেও চুপ করেই ছিলেন, এখন বউমার সঙ্গে স্বামীর কথোপকথন শুনে এঘরে ঢুকে এসেছিলেন।
তিনি যখন ঘরে পা দিলেন শ্যাম সুন্দর তখন থমথমে মুখে খাটে বসে ছিলেন। তাঁর মুখের ওপরে কথা বলার সাহস এ বাড়িতে কারোর ছিলো না, এমনকি পারুল বালাও তাঁকে যথেষ্টই সমঝে চলেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ পুত্রবধূর ধৃষ্টতা তাঁকে যথেষ্টই চিন্তায় ফেলেছিলো,কিন্তু তার কথার কোনো যুৎসই জবাব খুঁজে না পেয়ে তিনি মনে মনেই ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন। এই প্রথম বার ছেলের ইচ্ছে কে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষিতা মেয়ে কে বউ করে আনার জন্যে মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করছিলেন শ্যাম সুন্দর, স্ত্রী কে ঘরে ঢুকে আসতে দেখেই বউমার ওপরের রাগ তাঁর স্ত্রীর ওপরে গিয়েই পড়লো।
এই জন্যেই বলে মেয়েছেলের বুদ্ধি! তোমার কথায় বউমা কে হিসেব দেখতে দিয়েই আজ এই দিন দেখতে হলো! তুমি আর তোমার ছেলে, দুজনেই সমান! একজন লেখা পড়া জানা মেয়ে বিয়ে করবেন বলে নেচে উঠলেন আর একজন তাকে লুকিয়ে হিসেবের কাজ দেখানোর জন্য আমাকে ধরে বসলেন! তখন বৌদি আমাকে পই পই করে বারণ করেছিলেন, তাঁর কথা যদি তখন শুনতাম!
মেয়েছেলের বুদ্ধিই যদি বলো, তালে দিদি বুঝি মেয়েছেলে নন? আর তাঁর কথাই বা তুমি কবে নিজের সুবিধে ছাড়া শুনেছ শুনি! হিসেবের কতাই যদি বলো, তাহলে দিদি বারণ করার পরে কে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলো সেটা নিশ্চয়ই ভোলো নি কো? আমার কোন কতা তুমি শুনেছ যে সেদিনের কতা তোমায় শুনতে হলো? আর ছেলে না হয় নেকা পড়া জানা মে বে করতে চেয়েছিলো, তুমি কেনো দিয়েছিলে? আমি তো তকন কিছু কই নি কো! মেয়ের বাপের কলকেতার বাড়ি কি তুমি তোমার স্বপনে দেকোনি? ঘটকের কাছে সেই শুনেই তো লাফিয়ে উঠে মেয়ে দেকে এলে! আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কে বউমা কে দে নিজের কাজ হাসিল করলো? ঠিকই তো কয়েচে বউমা, তুমি তো সব জেনেই চুপ করে ছিলে এতদিন, একন ছেলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজে সাধু সাজছো! সব সময় নিজের দোষ চাপানোর জন্যে একটা ঘাড় খুঁজে নিতে হয় নাকি!
কুমুদ এর ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে বলা কথা গুলো শ্যাম সুন্দর কে থামিয়ে দিলো। সারাজীবন মৌন থেকে চোখের জল ফেলা স্ত্রীর দিকে বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলেন চৌধুরী বাড়ির সর্বেসর্বা শ্যাম সুন্দর। শ্বশুর মশাইয়ের ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মৃণালিনী নিজেও।
ক্রমশ
#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৫
মৃণাল যখন শ্বশুর মশাইয়ের ঘর থেকে নিজের ঘরে ফিরে এলো, সৌম্য তখন ঘরের লাগোয়া বারান্দায় সিগারেট হাতে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবার বকাবকি তে সে যথেষ্টই দুঃখ পেয়েছিলো, মৃণাল কে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় আসতে দেখে তার দিকে ফিরে তাকালো।
কি হলো? মন খারাপ?
সৌম্য মাথা নাড়লো,
নাহ! বাবার কথায় কিছু মনে করি না, ছোটো থেকেই বাবা কে এরকম ভাবে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বাবা সব সময় নিজের কথাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন সব সময়।
তা হয়ত ঠিক! তবে বয়স তো বাড়ে সবারই। যখন ছোটো ছিলে তখন হয়ত প্রতিবাদ করতে পারোনি, কিন্তু এখন তো নিজের কথাটাও বলা উচিত।
তোমার কি মনে হয়, বললেই বাবা শুনবেন?
হয়ত শুনবেন না, কিন্তু তাই বলে ভুল টা কে ভুল বলে বলবে না? চুপ করে থাকলেই কি সমস্যার সমাধান হয় সব সময়? বাবাও তো আলোক দার কথা জানতেন! উনি কেনো সব জেনেও চুপ করে ছিলেন, সেটা জানতে চাওয়া কি অন্যায়?
মৃণাল এর কথায় সম্মতিসূচক মাথা হেলালো সৌম্য,
মানি অন্যায় নয়, কিন্তু আমি বিতর্ক পছন্দ করি না মৃণাল! তার থেকে যদি….
তার থেকে যদি অন্য কোনো উপায়ে কাজ উদ্ধার করা যায় তাই তো? মানে যা তুমি সব সময় বলো! যুধিষ্ঠিরও প্রয়োজনে মিথ্যে বলেছেন, সেখানে আমরা তো সাধারণ মানুষ! তাই না?
স্বামীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো মৃণালিনী, সৌম্য মাথা নিচু করে নিলো।
বাবা কে কিছু কথা বলে এলাম, হয়ত তুমি শুনলে রাগ করবে কিন্তু আমার মনে হলো কথাগুলো ওনা কে বলা উচিত। আমি জানি তুমি বিতর্ক পছন্দ করো না, তাই সব সমস্যা কে তুমি এড়িয়ে গিয়ে ঘুর পথে তার সমাধানের রাস্তা খোঁজো। কিন্তু সব সময় তোমার এই পলায়নপর মানসিকতা আমার পছন্দ নয়। আজ বাবা তোমার ওপর এতো রাগ দেখালেন কিন্তু তিনিও তো সবটাই জানতেন তাই না? সেটা জানা থাকা সত্বেও তুমি একবারও ওনার কথার প্রতিবাদ করলে না! আমি জানি তুমি বলবে যে এতকাল বড়ো মার কথার প্রতিবাদ আমি করিনি কেনো! কিন্তু বড়ো মা যত টা মুখে কড়া কথা বলেন, মনের দিক থেকে তিনি অতটা কড়া নন। তিনি আসলে সব দিক থেকে একজন হেরে যাওয়া মানুষ যিনি শুধু সবার কাছে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে চান সব সময়। সেটা আমি বুঝি, তাও যখন তিনি অহেতুক কোনো কোনো সময় মা কে অপমান করেছেন আমি তার প্রতিবাদও করেছি। কিন্তু বাবার সব আছে, তা সত্বেও তিনি শুধু নিজের মতামত কে প্রাধান্য দেবার জন্যে অন্য কে ব্যবহার করেছেন সব সময়, আর তুমি সেটা বুঝেও সহ্য করে এসেছো! অন্যায় যে করে আর যে সেটা জেনে শুনে সহ্য করে তারা দুজনেই যে সমান অপরাধী সেটা তুমি মানো নিশ্চয়ই।
সৌম্য চুপ করে থাকলো, মৃণাল কে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর সত্যিই আজ তার কাছে ছিলো না। কিছুক্ষন চুপ থেকে সে বললো,
তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছো, আমার আরও অনেকদিন আগেই সরব হওয়া উচিত ছিলো। আমি পারিনি সেটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু এই মুহূর্তে কি করণীয় সত্যিই সেটা মাথায় আসছে না, ক্লাব টা তৈরি করা আটকানো বোধ হয় সত্যিই মুশকিল।
মৃণাল বেশ চিন্তিত ছিলো, আলোক যথেষ্টই বুদ্ধিমান, গ্রামের ছেলেদের খেপিয়ে তুলে ওই জায়গার দখল নিতে সে চেষ্টা করবেই। বিশেষ করে সে দুপুরে বাড়ি ফেরেনি মানে যে কোনো ভাবেই হোক তার কাছে খবর পৌঁছে গেছে। জমি নিয়ে শরিক দের মধ্যেই যথেষ্ট বিবাদ আছে, সেই সুযোগটাই আলোক নিতে চেষ্টা করবে। এমন কিছু যদি করা যায় যেখানে শরিকরা একজোট থাকবে তাহলেই এই জমি বাঁচানো সম্ভব।
আমার একটা প্রস্তাব ছিলো, তাতে সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না! এখানে এমন কোনো কিছু করতে হবে যাতে সবার সমান উৎসাহ থাকে, প্রত্যেকের স্বার্থ পূরণ হয়, তবেই তাঁরা জমি রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন।
মৃণাল এর কথায় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সৌম্য,
অবনি কাকার স্ত্রী মাঝে মাঝেই বলতেন বিভার পড়াশুনা না জানার জন্যে পাত্রের সমস্যার কথা, এখন অনেকেই বলছেন। বিভা তো আমার কাছে পড়তে শুরুও করেছে। তাই আমি একটা কথা ভেবেছিলাম। ওই জমি যদি মেয়েদের পড়ানোর জন্যে দেওয়ার কথা বলা যায় তাহলে মনে হয় এব্যাপারে কারোরই কোনো আপত্তি থাকবে না, আর জমিটাও আমাদের নিজেদের গন্ডগোলের সুবিধা নিয়ে ক্লাব হতে পারবে না।
সৌম্য একদম অবাক হয়ে গেল! এটা তো খুব ভালো হয়। সত্যিই এখন সবাই তাঁদের মেয়েদের পড়াতে চাইছেন, সেখানে কোনো মেয়ে কে যদি শিক্ষিকা হিসাবে পাওয়া যায়, এর থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারে না! আর ক্লাব তৈরির চেষ্টাও বন্ধ হবে!
ঠিক আছে, আমি কথা বলছি, তুমি খুব ভালো কথা ভেবেছো! তবে দলিল অনুযায়ী জমির বেশি অংশই অবনী কাকার, আমি বাবার সঙ্গে কথা বলার আগে ওনার সঙ্গে কথা বলে আসি। এমনিতেও সুভাষের ব্যাপারে সব খোঁজ খবর নিয়ে এসেছিলাম, ওনার বাড়িতে আমাকে যেতেই হতো সেগুলো বলতে, ভালোই হবে এক কাজে দুই কাজ হয়ে যাবে।
কথাগুলো বলতে বলতেই সৌম্য ব্যাগ খুলে একটা সাদা খাম বার করে ফেললো, সেটা তার হাতে দেখেই মৃণালের অনেকদিন আগের অবনী কাকার হাতে দেখা খামের কথা মনে পড়লো,
তুমি কি বিভার কুষ্টি সুভাষ কে দেখিয়েছো? ওটা এখনও তোমার ব্যাগে কেনো?
সৌম্য অবাক চোখে তাকালো, তারপরেই নিজেই হেসে ফেললো,
আরে! তুমিও ওটা কে কুষ্টি ভেবেছিলে নাকি? ওটা তো অবনী কাকার ছেলের চাকরির আবেদন পত্র, বিমলের এক সওদাগরী অফিসে কিছু চেনা জানা ছিলো, ও একবার এখানে এসে অবনী কাকা কে বলেছিলো। তাই তিনি আমার হাতে ওটা বিমলের কাছে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই চাকরিটা হয়ে গেছে, এটা ওর চাকরিতে যোগ দেওয়ার চিঠি। যাই, এটাও দিয়েই আসি একেবারে।
তুমি ওটা দেখিয়েই তখন বড়ো মা কে বিভার কুষ্টি বলে ছিলে না!
মৃণাল একদম অবাক হয়ে গেলো,
আরে, সেতো সরমার বিয়ের কথা পাড়ার জন্যে, তুমি তারপর থেকে আর কোনোদিনও আমাকে জিজ্ঞেস করো নি, আমারও বলা হয়ে ওঠেনি আর,
হাসতে হাসতে বললো সৌম্য। চিঠি হাতে নিয়ে সৌম্য বেরিয়ে যাওয়ার পরে নিজের ঘরেই বসেছিলো মৃণালিনী, আলোক যদি ফিরে আসে রাতের দিকে তাহলে শ্বশুর মশাই কি করতে পারেন তার এই কথার পরে সেসবই বসে বসে ভাবতে লাগলো।
অবনী কাকা, বাড়ি আছো নাকি!
বলতে বলতেই বিভা দের বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়লো সৌম্য, সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো, বিভার মা তুলসিতলায় সন্ধ্যে প্রদীপ দেখিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, সৌম্য কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সৌম্য যে সুভাষের খবর নিয়ে আসবে সে তাঁর জানা ছিলো, তাই তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তিনি,
আরে, ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো, ভেতরে এসো বাবা! বসো এখানে,
তাড়াতাড়ি একটা পিঁড়ি সৌম্যর দিকে এগিয়ে দিলেন। সৌম্য পিঁড়ি টেনে বসতে বসতেই অবনী কাকা বেরিয়ে এলেন,
বলো বাবা, কি খবর! ছেলে কেমন? সব খবর ভালো তো?
সৌম্য মাথা নাড়লো,
হ্যাঁ, কাকাবাবু সব ভালো, সুভাষ বেশ ভালো ছেলে, বাড়িও যথেষ্টই ভালো, তুমি নিশ্চিন্তে বিভার বিয়ে নিয়ে এগোতে পারো।
অবনী খুশি হলেন, তাড়াতাড়ি দু হাত কপালে ঠেকালেন বিভার মা,
দেখো ঠাকুর, সব কিছু যেনো ঠিক ঠাক হয়ে যায়!
সৌম্য এবার পকেট থেকে সাদা খাম টা বার করে অবনী কাকার হাতে দিলো,
আনন্দের খবর আরও আছে কাকাবাবু, এই নাও তোমার ছেলের চাকরির চিঠি। বিমল সব কিছু ব্যবস্থা করেই রেখেছে, ওকে সামনের সপ্তাহেই চলে যেতে বোলো, তাহলে সামনের মাস থেকেই যোগ দিতে পারবে চাকরিতে।
পর পর দুটো আনন্দের খবরে বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেলো, অবনী চিৎকার করে তাঁর ছেলেকে ডেকে নিয়ে এলেন। দু হাতে সৌম্যর হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,
সারা জীবন তোমার ঋণী হয়ে থাকবো বাবা, যে কোনো কাজে তোমার দরকার হলে বোলো আমাকে,
সৌম্য এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো, তাড়াতাড়ি অবনী কাকার হাত জড়িয়ে ধরলো,
খুব বেশি কিছু চাইবো না কাকাবাবু, শুধু একটাই অনুরোধ করবো। ওই শরিকি জমিটার গন্ডগোল টা মিটিয়ে নাও, আমরা নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল না মেটালে ও জমি ধরে রাখা যাবে না কাকা। আলোক দা বিভাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওতে ক্লাব তৈরি করতে চেষ্টা করছে।
অবনী চুপ করে রইলেন, গ্রাম্য জটিলতায় তিনিও শ্যাম সুন্দরের থেকে কোনো অংশে কম যান না। জমিতে তাঁর অংশই বেশি তাই মিটমাট করতে গেলে তাঁর ক্ষতির সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি বুঝেই একটু দোনা মনা করতে লাগলেন তিনি, একটু ভেবে বললেন,
ও জমি তো পতিত বাবা, চাষ বাস তো হবে নি আর! ও জমির জট মেটা না মেটা সমান!
হ্যাঁ, কাকাবাবু সেটা জানি বলেই তো বলছি, পতিত জমি বলেই তো ক্লাবের দখলে যাচ্ছে! তাতে তো তোমার ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি তাই না?
কথাটা প্রায় লুফে নিয়ে বললো সৌম্য, এবার একটু থমকে গেলেন অবনী, চিন্তিত মুখে সৌম্যর দিকে তাকালেন,
তালে তুমি কি করতে বলো বাবা?
সৌম্য এর অপেক্ষা তেই ছিলো,
তাই তো বলছিলাম কাকাবাবু, জমি যখন পড়েই নষ্ট হচ্ছে তাহলে অন্তত এমন কিছু হোক, যাতে সবার উপকারেই লাগে, আর ক্লাব হওয়া থেকেও বাঁচানো যায়। এখন তো বিভার সমস্যা তোমার মিটলো কাকা, কিন্তু আরও কতো মেয়েরও তো পড়া শুনা না জানার জন্যে কতো সমস্যা হচ্ছে। আর ধরো না ছেলে তোমার চাকরি পেয়ে গেলো, এবার তো আজ বাদে কাল বিয়ে দেবে, তারও ছেলে মেয়ে হবে, তাই মেয়েদের একটা স্কুল কি তোমারও দরকার পড়বে না কাকা?
অবনী আর বেশি কিছু ভাবার আগেই তাঁর ছেলে আর বউ দৌড়ে এলো,
তুমি আর অতো ভেবো নি দিকি, আর অমত করো নি কো, এতো ভালো কাজ করছে, হ্যাঁ বলে দাও ছেলেটাকে!
তীক্ষ্ণ গলায় স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন বিভার মা, বউ আর ছেলের যৌথ উদ্যোগের কাছে হার মানলেন অবনী। তিনিও অবশ্য যথেষ্টই বুদ্ধি ধরেন, পাছে তাঁর জমি দিতে রাজি না হওয়ায় আবার ছেলের চাকরি বা মেয়ের বিয়ে সবটাই ভেস্তে যায় সেই ভয়ও তাঁকে তাড়া করছিলো বৈকি!
ক্রমশ