#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–16
বসন্তকে ঋতুর রাণী বলে সম্মোধন করা হয়। কারন এসময় প্রকৃতি হরেক রঙে রঙ্গিন হয়ে মেতে উঠে। এবারের বসন্তে যেন রঙিনের ছাপ দ্বিগুণ। ফুল ফুটেছে মিরাদের বাসার সামনের গাছ দুটোয়। তবে বেজায় গরম পড়ে গেছে। সাধারণত বসন্তে এতো প্রখর তাপ হয় না৷ কিন্তু এবারে সময়ের আগেই যেন গ্রীষ্ম নেমে গেছে। মিরা নিজের রুমে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। দরদর করে ঘামছে সে।নাকের ডগায় ঘামের কণা ঝিলিক মেরে উঠছে৷ সিলিং ফ্যানের হাওয়াও যেন তপ্ত, ভ্যাপসা ভাবটা কমাতে পারছে না৷ দাদী তার পাশে বসে আছেন। একটা সময় তিনি মিরার হাত নিজের হাতে চেপে ধরেন। পুরোরুম জুড়ে আত্মীয়-স্বজনের সমাগম। পা রাখারও জায়গা নেই। কেউ রুম থেকে বের হচ্ছে তো কেউ রুমে প্রবেশ করে তার সঙ্গে দেখা করছে। আজ সে সবার মধ্যমণি। সবাই যেঁচে এসে তার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। অথচ অন্যসময় কাজ ছাড়া তাকে কেউ মনেও রাখে না৷ মিরার হাত ঘামছে। এবার অস্থিরতা এবং ভয়-নার্ভাসনেসে সে কাহিল হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ভালো হয়৷
মিনিট পাঁচ পর তার মা সুপ্তি বেগম আসলেন। কনের মায়ের গুরুত্ব প্রতিটা বিয়ে বাড়িতে অত্যধিক। এজন্য অন্যান্যরা তাকে আলাদা জায়গা করে দিল৷ তিনি মিরার বাম পাশে বসে পড়েন৷ মিরা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসার চেষ্টা করল। এতেই সুপ্তি বেগমের বুক হুহু করে উঠে। যতোই শক্ত আবরণ ধরে রাখুক না কেন তিনি, কিন্তু ভেতরটা তার একদম কাদার মতো নরম। সে মেয়ের সামনেই কেঁদে ফেললেন। মাকে কাঁদতে দেখে মিরা নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সেও হুহু করে কেঁদে ফেলে। মা-মেয়ের বেদনা ভরা কান্নার দৃশ্য দৃষ্টি সম্মুখে আসামাত্র উপস্থিত সকলে নীরব হয়ে যায়। তখন রুমের পরিবেশ ছিল একদম শান্ত৷
পরবর্তীতে সুপ্তি বেগমের শ্বাশুড়ি তথা মিরার দাদী বলে উঠে, “বউমা শান্ত হও তো৷ মেয়ের মা হইছো তুমি। তোমাকে তো শক্ত হইতেই হইব। আমাদের মা আমাকে বিদায় দিল,আমরা সংসার করলাম। এরপর আমি আমার মেয়ে অন্য ঘরে পাঠাইলাম। এখন তোমার পালা বউমা। মেয়েরা পর হয় না। দূরে যাবে কিন্তু পর হবে না। তুমি কাদিও না৷ তুমি ভেঙে গেলে বুবু কষ্ট পাবে আরো।”
সুপ্তি বেগম যথাসম্ভব কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। সে ক্রন্দনরত অবস্থায় মিরাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে, “তুই সবার আগে আমার মেয়ে। এরপর অন্যকারো ঘরের বউ। আমার মেয়ের জন্য এ বাসার দরজা সবসময় খোলা।”
মিরার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। দাদী সুপ্তি বেগমকে নিয়ে প্রস্থান করে। রুমে চুপটি করে বসে সে চোখের পানি মুছতে লাগল। বুকের মধ্যে অজস্র কষ্ট-বেদনাকে মাটিচাপা দিয়ে চলেছে।
আচমকা খেয়াল হলো তার হাতের মেহেদী আরো গাঢ় হয়েছে৷ এবং হাতের তালুতে নকশার মধ্যে ইংলিশ এলফাবেট “আই” শব্দটা জ্বলজ্বল করছে।একটু আগেও সে এই বিষয়টা খেয়াল করেনি। ব্রাইডাল মেহেদী ভরা হাত এবং ইমানের নামের প্রথম অক্ষর বিয়ের বেশে একদম খাপে খাপে মিলে ষোল আনা পূর্ণ করে দিচ্ছে। আচ্ছা সোনালী আপুর বিয়ের দিন কী ইমানই মেহেদী আর্টিস্টকে বলিয়ে তার হাতে ব্রাইডাল মেহেদী পড়িয়ে নিয়েছিল? কে জানে? তার এতো সময় আছে মিরার হাতের মেহেদী পড়া নিয়ে ভাবার? সেই কখন তার সঙ্গে মাত্র একবার কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু জনাব এখনো তার কাছে আসেনি। একটা কলও করেনি। এতো কীসের ব্যস্ততা? সে তার ফোন বের করল। ফোনটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ফোঁস করে একটা দম ফেলে সামনে তাকায়। বাসায় অনেক বাচ্চা-কাচ্চা এসেছে। বাচ্চাদের দল গুলো ছুটাছুটি করছে।কয়েকজন তার ড্রেসিং টেবিলের সরঞ্জাম বের করে সেগুলো নিয়ে খেলছে। দুটো লিপস্টিক এরিমধ্য নষ্ট করা শেষ। অন্যদিন হলে মিরা তার মেক আপ গুলো ওদের কাছ থেকে ছোঁ মেরে নিত৷ কিন্তু আজকে তা সম্ভব হচ্ছে না৷
বারান্দার দরজা খোলা ছিল বিধায় হুট করে আরম্ভ হওয়া ঝড়ো বাতাসের আগামন টের পেল সে। বারান্দার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। বাইরে যেন বৃষ্টি নামার সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে৷ শীতল, নরম, আরামদায়ক বাতাসে গা জুড়িয়ে গেল। গরম ভাব কমে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ গর্জে উঠছে মৃদ্যু শব্দ তুলে। বজ্রপাতের আওয়াজে তার মনে অশনি হুক্কাহুয়ার মতো ডেকে উঠে। মেঘে মেঘ ঘর্ষণের ফলে ক্ষণেই বেশ জোরে, বসুন্ধরা কাঁপিয়ে অবেলায় বর্ষা নেমে এলো ধরিত্রীতে৷ ঝমঝম আওয়াজে চারিদিকে যেন হারমোনিয়ামে সুর তোলা হচ্ছে। বৃষ্টি পড়ার শব্দটাও আজ অন্যরকম যেন। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় হুহু বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির গন্ধও রুমে প্রবেশ করছে৷ স্থীর, নড়চড়হীন দেহ নিয়ে বসে থাকে মিরা। সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা খেলে যাচ্ছে। বাইরে থেকে বড় আব্বু আর তার বাবার কথা কাটাকাটির মিহি শব্দ তার অন্তর কাঁপিয়ে দেয়৷ বাবা আচমকা এমন শুভ দিনে তর্কে কেন জড়াচ্ছে৷ মন ক্রমশ অস্থির হতে লাগে। চঞ্চল চোখে আশেপাশে তাকিয়ে সে উঠে দাঁড়াতে চাইলে তার এক আত্মীয় তাকে যেতে বারন করে৷
উনি বলে উঠে, ও কিছু নারে, মা। বিয়ের সময় এমন আধ-একটু ঝামেলা হবেই। তুমি শান্ত হয়ে বস।
সে থমকে যায়। বাইরে ড্রয়িংরুম থেকে এক সময় ঝগড়ার আওয়াজ হারিয়ে যায়। এদিকে প্রকৃতি যেন তাণ্ডবে তুমুল ব্যস্ত। সারা বসুন্ধরা কাঁপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে৷ পুরান ঢাকার অপরিকল্পিত এবং সরু-চিকন রাস্তাগুলো পানিতে টইটুম্বুর। ঁহাটুজল না হলেও হাঁটুর কাছাকাছি পা ডুবে যাবে এই মূহুর্তে রাস্তায় নামলে৷ আস্তে আস্তে পরিবেশ আবারো উৎসব মুখর হতে লাগে। বড়রা তাদের সাংসারিক আলাপ জুড়ে দিল। ছোটরা খেলায় মেতে উঠে। রান্নাঘর থেকে খাবারের গন্ধও ভেসে আসছে। অপরিচিত কয়েকজন পুরুষের কণ্ঠও আসছে। ভারী জিনিস তুলা-নামার শব্দ কানে আসছে৷ নিশ্চয়ই বাসায় অনেককিছুই হচ্ছে৷ কিন্তু রুমের ভেতর থেকে কোনকিছু ঠাওর করার জো নেই৷ রুমটাকে সুরঙ্গ মনে হচ্ছে তার। যে সুরঙ্গের সঙ্গে রাজ্যের কোন যোগাযোগ নেই৷
বৃষ্টি পড়ার মাত্রা মেঘের কান্নার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়লো আরো। মোটা মোটা বৃষ্টির ফোটায় সমস্ত কিছু ভিজে একাকার। এমনই এক সময় সোনালী আপু ফিরে আসল। তার ভ্রু কুচকে আছে। বোঝাই যাচ্ছে সে ভীষণ ব্যস্ত। কাজ ফেলে এসেছে জন্য বিরক্তও বটে৷
আপু বলে উঠে, “বহু কষ্টে তোর দুলাভাই গিয়ে কাজীকে বাসা থেকে তুলে এনেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় পানি জমে খুব খারাপ অবস্থা। গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গেছে। রাত দশটার মধ্যে কাজীকে বিদাই করতে হবে। আব্বু চাচ্ছে বিয়েটা এখনি পড়িয়ে ফেলা হোক। যেহেতু কাজীর তাড়া আছে৷”
মিরা চকিতে উঠে প্রশ্ন করে, “কিন্তু ওর সাথে তো কথাই হয়নি আমার৷”
সোনালী আপুর কিছু মনে পড়ে গেল যেন। সে আফসোস করে বলে, “ইমানের তো নিশ্বাস নেওয়ারও টাইম নাই। ও আর কী কথা বলবে? সব কাজ তো ও একা সামলাচ্ছে৷ আজকে এতো গেস্ট এসেছে যে, চাচী একা রান্না করে কুলাতে পারবে জন্য ইমান বার্বুচি আর ক্যাটারিং হায়ার করে আনলো। বাগানে রান্না বসানো হলো৷ ওমনি বৃষ্টি নামলো। সমস্ত রান্নার জিনিসপত্র আমাদের রান্নাঘরে নিয়ে এসে পুনরায় রান্না বসাতে অনেক সময় লেগেছে। আমরা এতো ব্যস্ত ছিলাম যে তোর কাছে যে ইমানকে পাঠাব মনেই ছিল না। সর্যি রে।”
–ইটস ওকে আপু৷
— “ইমান তো শেরওয়ানী পড়ে ড্রয়িংরুমে বসে গেছে। ওকে ডেকে আনছি৷”
মিরা কী যেন ভেবে বলে, “থাক দরকার নাই৷”
–” সত্যি তো? তোর মত আছে? কোন জরুরি কথা থাকলে সেড়ে নে। লজ্জা পেতে হবে নাহ। ”
মিরা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। আপু মিটমিট করে হাসে শুধু।
বড় আব্বুর বড় কন্যা সায়েমা আপু এতোক্ষণ পর আসল। বৃষ্টির জন্য আটকা পড়ে গিয়েছিল। উনি সঙ্গে করে একটা লাল নেটের ঘোমটা এনেছেন। সে সেট করে দিল মিরার মাথায়। এখন তাকে পরিপূর্ণ কনে লাগছে যেন৷
সায়েমা আপু বলে, ” আমাদের বাসায় আজকে চাঁদ উঠেছে৷”
মিরা মৃদ্যু হাসে। তাকে সায়েমা আপু আস্তে ধীরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এসে, ইমানের বিপরীতে বসায়৷ তাদের দুজনের মধ্যে দৃষ্টিবিলাস হলেও ইমান এমন ভান ধরে যেন তার সামনে সবকিছু অদৃশ্য। মিরাকে সে দেখেইনি। মিরা মনে মনে ভেংচি কাটে৷
সে বাবার দিকে তাকালো। তার বাবা পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলছে। তার পাশে কাজী সাহেব বসে আছে। সোনালী আপু এসে ইমানকে অন্য রুমে নিয়ে গেল৷
কাজী সাহেব হাতে খাতা-কলম নিয়ে কী কী সব যেন করলেন। এই মূহুর্তটা মিরার কাছে খুব খুব অদ্ভুত লাগলো। ভয়ে সে একদম মিইয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে৷ পাত্র হিসেবে নিজের একসময় কার ঝগড়া-পাটনার যে কেমন হবে? –সে জানে না। সে স্থীর দৃষ্টিতে বসে থাকে৷ তার অবস্থা এই পলে রুদ্বদ্বার। একসময় কাজী সাহেব কীসব বলা আরম্ভ করে যেগুলো একটাও তার কান অব্দি যায় না, মস্তিষ্ক কিছুই বুঝতে পারছে না। কেবল স্নায়ুগুলো মারাত্মক রকমের শিহরিত হচ্ছে। একসময় উনি বলে উঠে, “মা আপনি এই বিবাহে রাজী থাকলে কবুল বলেন।”
মিরা ঘাবড়ে গেল। নির্বাক হয়ে পড়ে। মাথা ভোভো করতে লাগে। হাত-পা ইতিমধ্যে কাঁপছে তার। ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। মুখে কোন জবান নাই।
কাজী পুনরায় আগের কথা বলে উঠে। সে অসহায় হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। সুপ্তি বেগম তার কাছে এসে তাকে আগলে নিয়ে বলে, “কথা বলো মামনি।”
মিরা খুবই আস্তে বলে উঠে, “কবুল।”
মুহুর্তে তার চোখে অশ্রুর ঢল নামতে শুরু করে। সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে আরেকদফা কেঁদে নিল৷ সামান্য পুতুল হারিয়ে গেলেই সে ছোটবেলায় কেঁদে ভাসাত। আজ তাহলে তার বিয়ের দিন কেঁদে এই বাসায় বন্যার জোয়ার নামার কথা! তালুকদার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগে। ইরা এসে বোনের পাশে গোমড়া ও ছলছল চোখে তাকায়। সে ইরাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
কাজী সাহেব উঠে পাশের রুমে চলে যান৷ মিনিট পনের পর ফিরে আসে উনি। প্রান্ত ভাইয়া খেজুরের প্যাকেট নিয়ে সব আত্মীয়ের মধ্যে বিলিয়ে দিতে লাগে। মাঝে মোনাজাত করাও হয়েছিল। বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে মিরার স্বাক্ষরের দরকার। রেজিষ্ট্রেশনের জন্য। কাজী কাবিননামার পেপার এগিয়ে দেয় তার দিকে। সে এক ঝলক পেপারটায় চোখ বুলিয়ে দেয়৷ পাত্রের জায়গায় ইমানের সিংনেচার দেওয়া। গুটি গুটি অক্ষরে ইংলিশে “ইমান খান” নামটা তার সারা শরীরে প্রচন্ডরকমের শিহরিত করে দিয়ে যায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সে নিজের নাম লিখে দেয় কাবিন নামায়৷
কাজীকে খাওয়ানোর জন্য ডাইনিংরুমে পাঠানো হয়। আরো দশ মিনিট পর একটা আয়না নিয়ে আসে সায়েমা আপু। আয়নাটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো৷
মিরা মাথা নিচু করে ফেলে। ইমান আরো দশ মিনিট পর আসে ওই রুম থেকে। তাকে মিরার পাশে বসার সুযোগ দেওয়া হয়। মেরুন রঙের শেরয়ানীতে তাকে একদম হিরো লাগছে। সে লজ্জার মাথা খেয়ে একপলক সময় নিয়ে ইমানকে দেখে নেয়।
ইমান এসে বসা মাত্রই সোনালী আপু এংগেল করে আয়নাটা ধরলো। যেই এংগেল দিয়ে ইমান মিরার প্রতিবিম্ব দেখবে পাবে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করে, “আয়নায় কী দেখতে পাচ্ছিস ইমান? ”
ইমান ভাবলেশহীন ভাবে বলে, “কিছুই তো দেখি না।”
মিরা বড্ড আশা নিয়ে ছিল তার উত্তর শোনার জন্য। কিন্তু এমন উত্তর শুনে সে রাগবে নাকী কাঁদবে বুঝতে পারছে না৷
সোনালী আপু তার কাঁধে কিল মেরে বলে, “দেখিস না ক্যান রে? তোর চোখে কী সমস্যা? তাইলে চশমা নিয়ে আয় যা।”
সে পুনরায় বলে, “সত্যি কিছু দেখছি না।”
মিরার যেন খুব অভিমান হলো। সে নিজের প্রতিবিম্ব ক্লিয়ারলি দেখতে পারছে৷ অথচ উনি নাকি চোখে দেখে না। তাকে অবহেলা করা হচ্ছে না তো?
সবার মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল৷ হাসাহাসি করতে লাগলো সবাই৷ আপু আবারো আয়না ইমানের দিকে ধরে বলে, “এবার বল কাকে দেখতে পারছিস? ঠিকঠাক জবাব দিবি। ”
এবারে ইমান একটু ঘার কুচো করে আয়নার দিকে তাকালো, এবং হেসে দিয়ে বলে, “আসলে অতিরিক্ত সুন্দর কিছু দেখলে মানুষের ব্রেইন সেটা নিতে পারেনা। চোখে তখন আঁধার দেখে। আমার অবস্থাও তাই৷ অতিমাত্রায় সুন্দরী রমনীকে দেখে আমার চোখ সব ব্লাংক দেখছে। এখানে আমার দোষ কোথায়? বল? ”
ইমানের দ্বিতীয় উত্তর শুনে মিরা অবাক হয়ে গেল৷
চোখ রসগোল্লার মতো গোল হয়ে যায় তার। ভাইরাসের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে সে দারুণ পুলকিত অনুভব কিরে। সেই সাথে এটাই বুঝি তার স্বামীর মুখে নিজের প্রথম প্রশংসা বাক্য।
চলবে।
#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–17
নিরবে-নিভৃতে মিরা চেয়ে আছে কারুকাজ খচিত আয়নার দিকে। আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে মিরার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষের। তার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে মিরার সকল রাগ, অভিমান, দুঃখ, কষ্ট ঘুঁচে যেতে থাকে। আচমকা আয়নার কাঁচের ভেতর দিয়েই তাদের দু’জোড়া আঁখি একে অপরের দিকে খানিকক্ষণের জন্য আটকে যায়। সেই মুহুর্তটা অকল্পনীয় তার জন্য। হৃদপিন্ড তীব্র গতিতে উঠা-নামা করে। হুট করে ইমান তাকে চোখ মারে। সে হতভম্ব হয়ে যায় তার এহেন কাণ্ডে। মুখ অটোম্যাটিক্যালি হা হয়ে যায় তার। তা দেখে ইমান বাঁকা হেসে ফেলে, উঠে দাঁড়ায়। তার উঠে দাঁড়ানোর ফলে মিরার ঘোর কাটে। এতোক্ষণ যাবত সে ভিন্ন এক জগতে ছিল। মাথা ভার লাগছে। চোখ ঘুরিয়ে চতুর্দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে, ড্রয়িংরুমে আপাতত কেউ নেই। কিছুক্ষণ আগেই না সকলে উপস্থিত ছিল? মুহুর্তে সবাই গায়েব হলো কীভাবে? নাকি অজস্র ভাবনায় সে এতোটাই ডুবন্ত ছিল যে অন্যদের অনুপস্থিতি তাকে বিচলিত করেনি? সে দেয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন রাত দশটা বাজে৷ সে মাথা ঘুরিয়ে ভেতরের দিকে তাকালো। ডাইনিং এ অনেকেই খাচ্ছে। ইমান আর সোনালী আপুকে দেখা যাচ্ছে, কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে তারা। ইমান টেবিল থেকে একটা আলুর চপ হাতে নিয়ে আরাম করে খেল আর গল্প করতে থাকে। মাথা থেকে পাগড়ি খুলে ফেলায় তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না সে বর। মজা করে এটা-সেটা খাওয়া হচ্ছে। এদিকে মিরা সেই কখন থেকে চুপটি মেরে ভীত বিড়ালের মতো বসে আছে।নড়াচড়া করতেও ভয় লাগছে তার। পানির পিপাসা পেয়েছে তবুও পানি খেতে ইচ্ছা করছে না।
একটু পর সোনালী আপু তার কাছে এসে বলে, “খেতে আয়।”
মিরা গোমড়া মুখে বলে, “আমার খেতে ইচ্ছা করছে না। খাব না৷”
— “সেকি রে, এম্নিতেই তোর পায়ে ব্যথা তার উপর খাবি না? ”
— “না খাব না৷ খাওয়ার রুচি নেই।”
— “শরীর খারাপ নাকী তোর?”
— “শরীর খারাপ না। এমনিতেই টেনশনে ক্ষুধা নাই হয়ে গেছে৷”
আপু আর কিছু বলল না।আপুর ডাক পড়ে ডাইনিংরুম থেকে। সে দ্রুত বেগে চলে যায়। এরপর প্রায় আধঘন্টার বেশি কেটে যায়৷ একা একা বসে থাকতে থাকতে মিরা বড্ড বিরক্ত হচ্ছে। কারোই তার দিকে নজর নেই। যে যার মতো ব্যস্ত। একটা টাইমে ইমানকে শুধু রোস্ট খেতে দেখা গেল৷ সে অন্য কাজিনগুলোর সঙ্গে গল্প-মজা করায় তুমুল ব্যস্ত। ইরাও তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। মিরার ওদের প্রতি সামান্য অভিমান হলো। ভাবলো, তাকেও আড্ডায় সামিল করুক। এভাবে একা, পরগাছার মত কেন ফেলে রাখছে? একবার ডাক দিয়ে নিয়ে গেলে কী হয়?
যাইহোক আরো মিনিট বিশ পর, প্রান্ত দুলাভাইয়ের তার উপর মায়া হলো। সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে তার দিকে এগিয়ে এসে বসে পরে বলে, “এখন তো আর আমি নতুন জামাই থাকলাম না। তোমার জামাই এখন নতুন। ওর আপ্যায়ন এখনো শেষ হয়নি৷”
মিরা সামান্য হাসল। তার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ইমান আর সে হাসবেন্ড-ওয়াইফ। সে ম্যারেড আজ থেকে! নামের আগে এখন থেকে মিসেস বসবে। ভাবলেই মনের কোনে খাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ভালো লাগা গুলো তিরতির করে মাথা দোলায়।
প্রান্ত ভাইয়া বলে উঠে, “তোমাদের জন্য ছাদে একটা ছোটখাটো ফটোসেশানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আতশবাজি আর ফানুস ওড়ানো হবে৷”
মিরা ভারী অবাক হয়। এমন বৃষ্টিস্নাত রাতে কেউ ছাদে যায়? এসব আজগুবি আইডিয়া নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের? উনি ছাড়া এমন বুদ্ধি আর কারো মাথায় আসার কথাও নয়৷
মিনিটের মধ্যে তার বাকি কাজিনরা হুড়মুড় করে ড্রয়িংরুমে এসে হৈচৈ শুরু করল৷
প্রান্ত ভাই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “উপরে যাও। গিয়ে ক্যাটারিংয়ের লোকদের বলো, লাইটিং অন করে দিতে।”
ইরাসহ বাকি সবাই উপরে উঠে যেতে থাকে। ভাইয়াও উঠে দাড়ালেন, তার সঙ্গে সোনালী আপুও যাওয়ার প্রস্তুতি নিল ৷ যাওয়ার আগে মিরাকেও আসতে বলে ছাদে৷ এবারে মিরার অভিমানের মাত্রা বেড়ে যায়। এতোক্ষণ নিজেকে এটা-ওটা বলে বুঝ দিলেও, এখন তার মনে হচ্ছে, কাজিনের কেউই তাকে একবিন্দু ভালোবাসে না। তার প্রতি কারো মায়া নেই। কেউ তাকে নিয়ে ভাবে না।
সে ভারী শাড়ি আর ঘোমটা সামলাতেই কাহিল। অথচ ওরা ওদিকে একসঙ্গে বসে খেল, গল্প করল৷সে মাত্র একবার বলেছে খাবে না। আপু জোরও করেনি আর। এখন তাকে রেখে ছাদে যাচ্ছে। সবাই জানে সে কালকেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে৷ পায়ের ব্যথা কমেনি। তাও কিনা ছাদে নিয়ে যাবার জন্য কেউ দাঁড়ালো না৷ সে রাগ-ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে দাঁড়ালো। পায়ে ব্যথাও অনুভব করল। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সে এক কদম, দু’কদম আগায়৷ মেইন গেইট অতিক্রম করতেই, পেছন থেকে ভরাট কণ্ঠ ভেসে আসল৷
“তোমার পায়ে না ব্যথা। তারপরও কেন দাঁড়িয়ে? এমুহূর্তে মুভমেন্ট না করাই বেটার।”
মিরা পেছনে ফিরে তাকালো। সামনে তার বর্তমান স্বামী দাঁড়িয়ে আছে, ভাবতেই পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা যেন তার বুকে এসে গেঁথে গেল।
সে উত্তরের আশায় থাকল। কিন্তু মিরা জবাব দেয়নি। তাই পুনরায় বলে,” যাও সোফায় গিয়ে বস।”
মিরা বলে, “ছাদে যাব। ওখানে সবাই আড্ডা দিচ্ছে৷ ভাইয়া নাকি কিসব আয়োজনও করেছে।”
সে একবার মিরাকে মাথা থেকে পা অব্দি পর্যবেক্ষণ করে বলে,” তুমি যেতে পারবে তো?”
কথাটার মধ্যে যেন মিরা কটাক্ষ খুঁজে পায়। সারাদিন খোঁজ নেয়নি,একটাবার কথা বলার টাইম নাই আর এখন এসে ঠেস মেরে বলা হচ্ছে “যেতে পারবে তো”। হুহ!
সে উচু আওয়াজে বলে,” একশ একবার পারব৷”
রাগের দলা বুকে পুষে পেছন ঘুরে সিঁড়িতে পা রাখামাত্র ব্যথা পাওয়া পায়ে চোট পেল। এবং ব্যথায় আর্তনাদ করে পিছিয়ে যেতে গেলে, ভারী শাড়ির জন্য টাল সামলাতে না পেরে, পা স্লিপ খেল। এবং সে উল্টে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে চোখ বুজে মনে মনে দোয়া শুরু করে যেন ব্যথা না পায় বেশি৷ কিন্তু তার ভাগ্য সহায় হলো। কিছু একটার সঙ্গে বাধা খেয়ে, সে আর নিচে পড়ে গেল না। তবে বেকায়দায় পায়ে পুনরায় ব্যথা পায়। এবার বেশ জোরেই লাগে জন্য চোখে পানি অব্দি চলে এলো৷
এবারে ইমান কথা বলে উঠে, “বারং শুনতে হয়। আমি না করেছিলাম না? তবুও পাকনামি করার দরকার কী ছিল?”
তার পেছেন ঢাল হয়ে বাঁধা দিয়ে পড়ে যাওয়া থেকে ইমান তাকে রক্ষা করে৷ এজন্য সে মনে মনে কৃতজ্ঞাবোধ করে।
তবে ইমানের রাগী গলায় বলা প্রতিটা শব্দ যেন তীর খোঁচার মতো লাগলো। এর আগে ইমান প্রচুর ঝারি মেরেছে তাকে৷ কিন্তু আজ সামান্য এই কথায় মন বিষিয়ে গেল৷ হাত-পা ছুড়ে কেঁদে দিতে মন চাইলো৷
সে কান্না আটকে রেখে বলে,”জানতেন যখন আমি ইঞ্জুরেড এবং আমার ছাদে যাওয়া বারং এরপরও ছাদে কেন আয়োজন করলেন? আমাকে ছাড়াই সব আনন্দ করতে ভালো লাগে তাই না? ”
ইমান এবারে কিছুটা বিভ্রান্ত হলো যেন। সে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,” সেটা বলিনি কিন্তু।”
–” ছাড়ুন আমাকে। আমি রুমে যাব৷”
সে মেইন গেইট দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখে নিল। এরপর সজোরে দরজা ভিজিয়ে দিয়ে, মিরাকে কোলে তুলে নেয়৷ মিরা হতভম্বের শেষে সীমানায় পৌঁছে যায়। কেউ যদি দেখে ফেলে? লজ্জায় তার গালের দু’পাশের ফোলা অংশ লালাভ আভায় ছেয়ে গেল। সে নির্বাক হয়ে সুদর্শন পুরুষটাকে মন ভরে দেখে নিল। এই ছেলেটা যাই করে সে তাতেই কেন এতো বেশি মুগ্ধ হয়? বেচারা গরমে ঘেমে আছে৷ ইশ! মিরার মন চাচ্ছে নিজের আঁচল দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছে দিতে৷
সে এক কদম, দু’কদম বেয়ে ছাদে উঠতে থাকে। ছাদে এসে মিরাকে বেশ যত্ন নিয়ে নামায় এরপর হুমকি দেওয়ার মতো হুংকার দিয়ে বলে, “একদম লাফালাফি করবা না। এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে৷ যাওয়ার সময় আমি নিয়ে যাব। একা নিচে নামবে না৷”
মিরা শুধু মাথা নাড়ায়। সে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে ছাদের ডেকোরেশনের দিকে। কি সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো। ব্যানারও আছে ছাদের দেয়াল ঘেঁষে। সেখানে লেখা ইমান ওয়েডস মিরা৷ লেখাটা পড়তেই তার গা বেয়ে শিহরণ বয়ে গেল৷
একজন ক্যাটারিংয়ের লোক ইমানের কাছে এসে বলে, ভাইয়া তাহলে আমরা নিচে যাই। রুম সাজানো বাকি।
— আচ্ছা যান। এটুকু বলে সে সামনের দিকে পা বাড়ায়৷
মিরা সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। রুম সাজানোর অর্থ সে ভালোভাবেই জানে। সোনালী আপুর বিয়ের দিন প্রান্ত ভাইয়ার কাজিন আর ফ্রেন্ডরা তাদের রুম সাজিয়ে দিয়ে, সোনালী আপুর টাকা খসিয়ে নিয়েছিল। আজ তাদের জন্যও রুম সাজানো হচ্ছে কিন্তু সে কাউকে টাকা দিতে পারবে না৷
সোনালী আপু তার দিকে আসলে সে বলে , “রুম সাজানোর কোন দরকার নেই আপু। ওদের মানা করে দাও৷”
সোনালী আপু উত্তেজিত হয়ে বলে, “তোর জামাই রুম ফুল দিয়ে সাজানো নাহলে বাসর করবে না৷”
আপুর মুখে এমন কথা শুনে মিরা লজ্জায় সিটিয়ে যায়৷
সে আরোও বলে, ইমান বলছিল,” লবণ ছাড়া তরকারি যেমন অসম্পূর্ণ তেমনই ফুল ছাড়া বাসরঘর অসম্পূর্ণ।ওর নাকি ঘর না সাজালে কোন ফিলই আসবে না যে বাসর হচ্ছে।”
মিরা মাঝেমাঝে অবাক হয়, একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে বোনকে এসব অশ্লীল কথা অবলীলায় বলে! ছিঃ শেষমেশ তার কপালে একটা অসভ্য জুটলো?
কিছুক্ষণের মধ্যে ছাদের পরিবেশ পালটে গিয়ে ভীষণ অদ্ভুত, মনোমুগ্ধকর পরিবেশের আবির্ভাব হলো। মাত্র বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু শীতল হাওয়া এখনো বইছে। মেঘ থেকে থেকে মৃদ্যু শব্দ তুলে ডাকছে৷ এমনই এক আদুরে আবহাওয়ায় তার প্রতিটা কাজিন একটা একটা করে ফানুস উড়াতে আরম্ভ করে।ক্ষণেই ফানুস উড়ে আকাশের দিকে যাত্রা শুরু করছে৷ কি চমৎকার দৃশ্য! মিরার মন ভালো হয়ে গেল৷ এতো সুন্দর দৃশ্য উপহার দেওয়ার জন্য মনে মনে ইমানকে থ্যাঙ্কিউ বলে সে।
প্রান্ত ভাইয়া তার হাতে একটা ফানুস ধরিয়ে দিয়ে বলে, “নিউলি ম্যারিড কাপল এবার ফানুস উড়াক।”
মিরা ফানুস হাতে বলদের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে ফানুস উড়তে জানে না। তার উপর শাড়ি পরে থাকায় নড়তে-চড়তেও ঝামেলা। তার একার পক্ষে সম্ভব না ফানুস উড়ানো। সে উশখুশ শুরু করে৷ কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর, ইমান লাইটার নিয়ে আসে তার সামনে। এরপর নিজ তাগিদে ফানুসে আগুন ধরিয়ে দেয়। মিরা সামান্য ভয় পেয়ে পিছিয়ে পড়ে। আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। বাতাসে নিভুনিভু অবস্থা।
তবুও ইমান মিরার হাতের উপর হাত রেখে আস্তে করে বলে, “ফানুস হয়ে তোমার সব দুঃখ ধ্বংস হোক।”
তারা হাত ছেড়ে দেয়।ফানুস বাতাসের মৃদ্যু বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে যায় আকাশের ভেতর দিয়ে। ইমান তবুও তার হাত ছাড়ে না৷ মিরা অদ্ভুত নয়নে চেয়ে থাকে। একবার ইমানের পানে তাকায় তো, আরেকবার উড়ন্ত ফানুসের দিকে। তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। তখনই বিকট শব্দ করে তার কাজিনরা আতশবাজি ফুটাতে থাকে। আওয়াজে তার কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম৷
ফটোগ্রাফার সমানে ক্লিক করেই যাচ্ছেন। সবই ক্যান্ডিট পিকচার তুলে যাচ্ছেন। অবশেষে উনি বলে উঠে, ভাইয়া-ভাবী এবার সুন্দর মতো রোমান্টিক একটা পোজ দেন। ছবি তুলব৷
কথাটা বলামাত্র ইমান তড়িৎ বেগে তার একটা হাত নিজের কাধে স্পর্শ করায় এবং সে নিজে তার দিকে ঘুরে এসে কোমড়ে হাত রেখে, মুখটা তার অনেক নিকটে আনে৷ আজকাল এমন পোজে প্রায় প্রতিটা কাপল ছবি তুলে। তবুও মিরার লজ্জায় মুখ লুকাতে মন চাচ্ছে। সবার সামনে এভাবে দাড়াতে তার অস্বস্তি লাগছে। ক্যামেরাম্যান ফটাফট একটার পর আরেকটা ছবি তুলে। এট দ্যা এন্ড, ইমান তার নাকে নাক ঘঁষে দেয় খুবই সন্তপর্ণে। এরপর আস্তে করে বলে, “আবার দেখা হবে।”
সাবধানতা অবলম্বন করলেও অনেকেই এ সিন দেখে ফেলে এবং তাদের এতো নিকটে রোম্যান্স করতে দেখে, ছাদে উপস্থিত সবাই তালি দিয়ে “ওহওওঅঅ” শব্দ তুলে চিৎকার দেয়। মিরার তখনই দৌড়ে পালিয়ে বাঁচতে মন চাচ্ছিল।
____________________
ছাদ থেকে মিরা সবার সহযোগিতা নিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এসেছে৷ তবুও ইমানের ধারে-কাছে যায়নি। তাকে সোজাসুজি বাসরঘরে ঢুকিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেওয়া হয়। মাঝে অবশ্য একবার তার মা এসে খবর নিয়ে গেছেন৷ রুমটা ক্যান্ডেল আর লাল গোলাপের সাজসজ্জায় মুখরিত। লাইট ছাড়াই মোমবাতির আলোয় রুমটা আলোকিত হয়ে আছে। মিরা মুগ্ধ হয়ে সবটা দেখে নিল৷ তবে কিছুটা অবাক হলো, যখন দেখল, আলমারির কোনে তোষক ভাঁজ করে রাখা। কিন্তু বিছানা থাকতে তোষকের কী দরকার? একটু পরেই চোখ গেল, ছোট টেবিলে একটা পিজ্জার প্যাকেট আর ডোনাট রাখা৷ পাশে চকবার আইসক্রিম। তিনটা খাবারই মিরার প্রিয়।
সোনালী আপু বলে,” তোর প্রানপ্রিয় স্বামী তোর সব পছন্দের খাবার আনিয়েছে৷ যখনই শুনল, তোর খেতে ইচ্ছা করছে না, সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার দিয়ে এসব আনালো। এজন্য আমি আর তোকে রাতে খাওয়ার জন্য জোর করিনি৷”
মিরা হতভম্ব হলো দ্বিতীয় দফায়। একটা ভালো লাগা ছেয়ে গেল তার মন জুড়ে। প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে সে।
দরজার ওপাশে ইমানকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। টাকা না দিলে, বাসরঘরে এন্ট্রি করা যাবে না৷ ইমানও কম যায় না, কিছুতেই দশ হাজার টাকা দিয়ে সে, রুমে ঢুকবে না৷
এদিকে সোনালী আপুও ছাড়ার পাত্র নয়। সে কিছুতেই দশের নিচে নামবে না৷
ইমান হাল না ছেড়ে বলে,” দেখ গরমে ঘেমে আমার অবস্থা শেষ। গোসল দিব। ভেতরে ঢুকতে দাও৷ ”
সায়েমা আপুও তাদের সাথে হৈচৈয়ে অংশ নিয়েছে কিন্তু নিরব ভূমিকা পালন করেছিল এখন পর্যন্ত ৷ এবারে সে বলে উঠে, “এখন আর গোসল করিস না৷ একদম ভোরবেলা গোসল করে ঘুমাস। ঘন ঘন গোসল করলে ঠাণ্ডা লাগাবি, অসুস্থ হবি।”
আরেকদফা হৈচৈ শুরু হলো। মিরা লজ্জায় কান চেপে ধরে। নাক দিয়ে তার গরম বাতাস বের হচ্ছে৷ তবে ইমান হাসছে। যেন মজার জোকস শুনেছে সে।
সেও মজা করার ছলে বলে, “আপুরা তোমরা কিন্তু আমার সঙ্গে অন্যায় করছো। মানে ছেলে-মেয়ে বৈষম্য হচ্ছে। বাসর তো আমি একা করব না। তোমাদের বোনও করবে। কিন্তু টাকা একা আমি কেন দিব? আমরা ফিফটি-ফিফটি করে টাকা দিই।”
সবার মধ্যে হাসির রোল পরে গেল।
তার কথায় মিরার কান কাটা যাচ্ছে টাইপ অবস্থা। অবশেষে ইমান পাঁচ হাজার টাকা দিয়েই রুমে প্রবেশ করে।
সবাই একে একে চলে গেলে, সে দরজা আটকে দেয়। এরপর আলমারি থেকে কাপড় বের করে বলে উঠে, “তুমি খাওয়া-দাওয়া করে মেডিসিন নাও৷”
মিরা মাথা নাড়ায়। রুমের মধ্যে তার দম বন্ধ লাগছিল। কিন্তু ক্ষুধাও পেয়েছে বড্ড৷
ইমান বাথরুমে ঢুকলে সে পিজ্জার স্লাইসে কামড় বসায়। খাওয়া শেষ করে আইসক্রিম হাতে নিলে দেখল, আইসক্রিম গলে গেছে। তবুও মিরা লোভ সামলাতে পারল না। তার সবচেয়ে প্রিয় হলো আইসক্রিম। সেই আইসক্রিম পাশে রেখে সে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। তাছাড়া আইসক্রিম স্বয়ং তাকে ডাকছে। আইসক্রিমের ডাক উপেক্ষা করলে “চকবার” মন খারাপ করবে৷ সে প্যাকেট খুলে খাওয়া আরম্ভ করে। আইসক্রিমের রস চুইয়ে চুইয়ে পড়ে তার হাত গলন্ত, তরল আইসক্রিমে ভরে যায়৷ মুখেও সামান্য লেগে যায়। তবুও সে মজা নিয়ে আইসক্রিম খায়৷ এমন ক্লান্তিকর দিনে ঠাণ্ডা আইসক্রিম যেন তার ভেতরটাকেও ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে৷ সে একমনে আইসক্রিম খাচ্ছে আর মোমবাতির আলোর দিকে তাকিয়ে আছে৷
ইমান বাথরুম থেকে বের হয়ে বড় বিষ্ময়কর একটা দৃশ্য দেখে। বধুবেশে একটা মেয়ে মজা করে আইসক্রিম খাচ্ছে। এমিন দৃশ্য খুবই বিরল৷ হলদে মোমের আলোয় তাকে অপ্সরীর চেয়ে কম লাগছে না। ইমান মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। তার মুখের বা’পাশে কিঞ্চিৎ আইসক্রিম লেগে আছে৷ ইমান তা দেখে হাসল। সে টাওয়াল চেয়ারে রেখে মুখ কাঠিন্যে এনে গমগমে আওয়াজে বলে, “তুমি কার পারমিশন নিয়ে বিছানায় বসেছো?”
মিরা খাওয়া রেখে তার দিকে তাকালো। চোখে-মুখে তার অজানা বিষ্ময়।
ইমান খুবই স্বাভাবিকভাবে বলে উঠে,” আমার বিছানায় শুতে পারবে না। ফ্লোরে গিয়ে শোও।”
চলবে।