ফেইরিটেল পর্ব-২০+২১

0
964
ফেইরিটেল
গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Par–20

সূর্যের রোদে তখন ঘর আলোময়। এমনই এক শুভ্র রোদে কাউকে এতোখানি মিষ্টি দেখতে লাগবে তা ইমান কল্পনাও করতে পারেনি৷ সে অপলক নয়নে চেয়ে আছে সামনের দিকে৷

কিছুক্ষণ আগে পিচ্চি মেয়েটার কথায় সে হতভম্ব হয়েছিল। আপাতত সে বিছানায় বসে পড়েছে। হাতে এখনো সিগারেট জ্বলছে, তবে সুখটান দেওয়া হয়নি। ” আজকের পর রুমে যেন সিগারেট খেতে না দেখি” কথাটা লোহার আঘাতের ন্যায় বাজছে তার কানে। মিরা তাকে থ্রেট দিলো? সিগারেটের ছাই গলে গলে মেঝেতে পরছে তার সেদিকে খেয়াল নেই। সে চোরাচোখ দিয়ে আয়নায় তাকালো৷ মিরার চোখে কাজল দেওয়া শেষ। সে আপাতত লিপস্টিক পরছে। লিপস্টিপ পরা শেষ হতেই আয়নার মধ্য দিয়েই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। এতে বিব্রতবোধ করে ইমান। সে মাথা চুলকানোর ভঙ্গিমা করতে লাগলো। এতে মিরার ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠে। যেন সে ইমানের চুরি ধরে নিয়েছে। ইমান ইশারায় ইশারায় জিজ্ঞাসা করে, সমস্যা কী, হাসছো কেন?

মিরা উত্তর দিল না। সে কানের দুল পরায় ব্যস্ত হয়ে গেল৷ তবে ইমান খেয়াল করে, মিরার পিঠের দিকটা ভিজে গেছে চুলের পানিতে। ঠিকঠাক ভাবে চুল মুছেনি জন্য পানি চুইয়ে পড়ছে৷ সে মনে মনে ভাবলো, যে মেয়ে সামান্য চুল ঠিকমতো মুছতে জানে না, সে তাকে শাসানি দিচ্ছে!

এতে সে যেন মনে মনে বিষ্ফোরিত হলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছা করেই মিরাকে দেখিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো৷ মিরা দেখেও কিছু না বলে, অন্য কানে দুল পরতে লাগে। ইমান বুঝতে পারছে না, মিরা কেন এতো সাজ-গোছ করছে৷ তাকে আকর্ষণ করতে চাইছে? আকর্ষণ করে লাভ কী?ইলেকশন শেষ, এখন চা-বিস্কুট খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই৷

সে নানান চিন্তা মাথায় রেখে যেই সিগারেট ধরাবে ওমনি মিরা পিঠ বেয়ে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সামনের দিকে এনে কাঁধের উপর রাখলো। এতে তার পিঠ যেন উম্মুক্ত হলো৷ ইমান লক্ষ করে মিরা তার ব্লাউজের উপরিংশের ফিতা লাগায়নি৷ সে না চাইতেও বারবার সেদিকে তাকাচ্ছে। ফর্সার পিঠের বা’পাশে ছোট্ট তিলও আছে। মেয়েটার সব জায়গায় তিল আছে মনে হচ্ছে! তার নাম আজ থেকে তিলবতী এরপর নিজেই শুধলো, তিলোত্তমা!

সিগারেটে এবারো টান দেওয়া হলো না বিধায় সিগারেট আগুনের তাপে গলে ছাই হয় ফ্লোরে পরতে থাকে৷ ইমান উঠে দাড়ালো এবং বলল, ” ব্লাউজ পরতে না জানলে পরবে না। সিম্পেল! অর্ধেক পরে থেকে ব্লাউজের অপমান না করলেও পারো৷”

মিরা উৎসুক জনতার ন্যায় একবার ঘার ঘুরিয়ে তার পানে তাকালো। সে সম্ভবত ইমানের পিঞ্চ আর বলার ধরনে কিছুই বুঝেনি।

সে ঠোঁটে বাকা হাসি ঝুলিয়ে ইশারায় দেখালো। এতেও মিরা বুঝল না৷ অতঃপর সে বলে উঠে, “মুখ শুধু খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়না। কথা বলার জন্য ও মুখ কাজে লাগাতে হয়৷”

ইমান নির্বিকারভাবে বলে উঠে, “চোখের কাজও শুরু জল ফেলা না বরং চোখ দিয়ে আশপাশে, নিজের পিছনের খোলা অংশও দেখতে হয়৷”

এবারে মিরার টনক নড়ে। সে হাতড়ে নিজের পিঠে হাত নিয়ে গেলে বুঝতে পারল, ফিতা খুলে গেছে। বাথরুম থেকে লাগিয়েই এসেছিল সে। সম্ভবত চুল মুছতে গিয়ে খুলে গেছে আর সে টের পায়নি৷

সে হন্তদন্ত ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে দু’হাত দিয়ে ফিতা লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছে৷ কিন্তু অতিরিক্ত চেষ্টা কেন যেন বিফলে যাচ্ছে বারবার। তবুও সে ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না।আবার ট্রাই করছে। তাকে ফিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখে ইমান অপমানসূচক হাসি হাসল। এতে মিরার রাগ হলো।
সে আরেকদফা ট্রাই করল, কিন্তু কাজ হলোনা। অগত্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেই দেখল, ইমান তার দিকেই হেঁটে আসছে। মিরা থমকে গেল। সে একেবার মিরার পেছনে এসে দাঁড়ালো৷ এবং নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিল। মিরা ভাবিওনি কালকে তার সঙ্গে এতো রুড বিহেইভ করেও ইমান তাকে হেল্প করবে! সে সামান্য লজ্জাও পাচ্ছে। ইমান আরো কিছুটা হাত বাড়ালো। মিরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তার শ্বাস ঘণ হচ্ছে। সে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। তাকে অবাক করে গিয়ে ইমান সামনে থাকা সকেটটা ডান হাত দিয়ে অন করে, বাম হাত দিয়ে নিজের ফোন চার্জে লাগিয়ে দিল। এবারে মিরা প্রচুর খেপে যায়। সে ঠিক করে নিল, লাস্ট ট্রাই করবে, তাও বাঁধতে না পারলে, শাড়ি চেঞ্জ করে কামিজ পরবে৷ শেষবার চেষ্টাও বিফলে গেলে,সে চোখ-মুখ থমথমে করে আলমারি থেকে একটা কামিজ বের করে৷

এরুমের ড্রেসিংটেবিলের পাশেই বাথরুম। তাই বাথরুম যেতে হলে ইমানকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। সে হেঁটে এগিয়ে এসে, তাকে পাশ কাটিয়ে বাথরুমে ঢুকতে গেলে, আচমকা নিজের আঁচলে টান অনুভব করে সে। মুহুর্তে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে আঁচল শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে ঘার ঘুরালো। এবং কটমট করে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” কারো আঁচল ধরে টান দেওয়া খুবই বিশ্রি কাজ।”

ইমান দু’কদম সামনে এসে তার কা্ধ ধরে, তাকে ওমুখো করে, নিজ হাত পিঠে পরে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। মিরা ততোক্ষণে জমে যাচ্ছে যেন। ডুবন্ত অনুভূতিগুচ্ছ যেন ভেসে উঠতে চাইছে। ইমানের হাতের স্পর্শে সে কম্পিত হচ্ছে অন্তর থেকে। শুকনো ঢোক গিলে কয়েকবার।

ইমান খুব শক্ত করে তার ফিতা লাগিয়ে দিল৷ দু’জনেই চুপ ছিল। ফিতা লাগিয়ে দিয়েই ইমান তার বুকে হাত দিয়ে ফোঁস করে একটা দম ফেলে।

আচমকা মিরা নড়েচড়ে উঠে বলে, “আমি বাইরে যাচ্ছি৷ আপনি আপনার সিগারেটের ছাই পরিষ্কার করে বের হবেন রুম থেকে। রুম নোংরা করা আমার একদম পছন্দ না৷ ”

–“, আদেশ দিলে?”

–” জি জনাব৷”

ইমান কি যেন ভেবে তার ফিতায় পুনরায় টান দিল। কিন্তু শক্ত করে বাঁধার কারণে তা টান লাগার পরেও খুললো না, বরঙ গিট বেঁধে গেল৷

মিরা হেসে ফেলে বলে,! অতি চালাকের গলায় দঁড়ি৷!

ইমান চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালো। মিরা সরে এসে বলে, “পারলে বিছানা গুছিয়ে নাস্তা খেতে আসবেন৷”

ইমা হতভম্ব হয়ে গেল এবং বলে উঠে, “আমি কী রাতে বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম যে আমি গুছাব?”

মিরা যেতে যেতে বলে উঠে,” আপনি ঘুমাননি তো কী হয়েছে? আপনার বউ ঘুমিয়েছে না? এজন্য আপনি বিছানা গুছাবেন৷”

দ্বিতীয় দফায় ইমান হতভম্ব হয়ে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। বাকহারা সে।

______________

জুই জগিং শেষ করে মাত্র বাসায় ফিরলো। রাস্তায় মিস ডায়ানার সাথে দেখা হলো। মিস ডায়ানা তাক্ব দেখেই প্রশ্ন করে, “কী ব্যাপার! কোন কারণে তুমি খুশি?

জুই উত্তর দিতে পারলো না। তবে শুধু মাথা ঝাকালো যার অর্থ সে খুশি৷ বাসায় এসে জাস্ট প্রোটিন শেইক পান করছিলো, ওমন সময় মিষ্টার পিটার নাইট ক্লোথ পরেই কিটচেনে আসলেন৷ জুই তখন গুনগুন করে গান গাচ্ছিল। অনেকদিন পর মেয়েকে এতো খুশি দেখে পিটারের মন ভালো হয়ে যায়। সে এসে জুইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠে, বাহ আজকে তোমাকে বেশ হ্যাপি লাগছে৷ কারণ কী?

বাবার মুখেও সেইম প্রশ্ন শুনে এবারে সে চিন্তিত হলো। আচ্ছা তার চেহারায় কী লেখা আছে যে সে আজ অনেক খুশি? লেখা না থাকলে অন্যরা কীভাবে বুঝে যাচ্ছে৷ এবারে সে বাবাকে সরাসরি প্রশ্ন করে, এই এই তুমি কীভাবে জানলে আমি হ্যাপি?

পিটার রসহ্যময় হাসি হেসে বলে, ” কালকে ইমান কনফার্ম করেছে যে সে খুব দ্রুত ফিরছে। এইজন্য বুঝে গেছি৷”

জুই কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। বাবার সামনে ইমানকে নিয়ে কথা উঠলেই তার ভীষণ লজ্জা লাগে৷ সে চোখ-মুখ লাল করে বলে, ” কালকে ওকে কল দিয়েছিলাম।”

— “তারপর?”

— “অনেকক্ষণ কথা বলেছি আমরা৷ মানে এই প্রথম ও আমার সঙ্গে এতো লং টাইম কনভারসেশন চালিয়েছে। নাহলে অন্য সময় হলে, ওকে রাখছি৷ পরে কথা বলি বলেই কেটে দেয়৷ কাল আমরা পাক্কা চুয়াল্লিশ মিনিট কথা বলেছি৷”

পিটার গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তা করে বলে,” প্রিন্সেস, আমার মনে হয়, দূরে গিয়ে ও তোমাকে মিস করছে৷ কাছে থাকলে তো কদর কম করি আমরা। তোমরা দূরে আছো জন্য সে ফিল করছে কিছু একটা। এজন্য এতোক্ষণ কথা বলেছে৷”

জুই হাল্কা হাসে। এবং মনে মনে ভাবে, কই এই থিউরি তার বেলায় খাটে না। সে তো সবসময়ই মিষ্টার খানকে মিস করে৷ পাশাপাশি বসে প্রজেক্ট একসঙ্গে সামলালেও লাঞ্চ আওয়ারে মিস করে! আর এখন তো তার জন্য জন্ম-জন্মান্তর অপেক্ষা করতে মন চায়। কবে আসবে ও?

পিটার বলে উঠে, “আই থিংক, এবার তোমার ওকে প্রোপোজ করে ফেলা উচিত। ও যে হারে লাজুক প্রকৃতির। তোমাকে প্রোপোজ ও করবে না৷”

— আমি ওর জন্য নারকেল পুলি পিঠা রান্না করা শিখছি। এবার আসলে সারপ্রাইজ দিব৷

— পুলি কী জিনিস? আর পিঠা কী?

–” বাংলাদেশি একটা ডেজার্ট পাপা৷ ওয়ান টাইপ অফ স্ট্রীম কোকোনাট এন্ড ফ্লোউর (Flour) দারুণ মজা খেতে ওদিকে শীতকালে খায় এই কেকটা। । ইমানের নাকী অনেক পছন্দের। বারবার বলে।”

পিটার অভিমান করে বলে, ইমানের জন্য আজগুবি সব রেসিপি বানাও। অথচ বুড়া বাপকে কিছু বানিয়ে খাওয়ায় না৷

জুই তার বাবার কপালে চুমু দিয়ে বলে, ওহো পাপা, কুকিজ বানাবো?

— লোভ দিও না, দুষ্টু মেয়ে৷

জুই খিলখিল করে হাসতে থাকে৷ পিটার তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে এই মেয়েটার সুখ ও শান্তির জন্য প্রার্থনা করে।

__________________

ইমানকে নাস্তা করতে বসানো হয়েছে। মিরা অবশ্য বসেনি। তার ফোলা চোখের জন্য বারবার সবার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সে এটা-ওটা বলে কাটিয়ে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে তার করনীয় কী সে বুঝে উঠতে পারছে না৷

সোনালী আপু আর সায়েমা আপু খেতে বসেছে। তাদের খাবার সার্ভ করে দিল মিরা৷ অথচ ইমানের প্লেট খালি৷ সে ইচ্ছা করেই ইমানকে খাবার তুলে দেয়নি৷

সায়েমা আপু বলল,” নতুন জামাইয়ের প্লেট খালি কেন? এই মিরু, এক্ষুনি ইমানের প্লেটে পরোটা দে৷”

মিরার হাতে পরোটার প্লেট ছিল। সে প্লেট সরিয়ে রেখে বলে, “পরোটা তো শেষ। নতুন করে ভাজতে হবে৷”

— “সেকি রে! তুই নতুন জামাইকে আগে না দিয়ে আমাদের কেন আগে দিলি? ও খালি প্লেট নিয়ে বসে থাকবে এখন?”

মিরা রান্নাঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বলে, ” আমিও তো নতুন বউ৷ অথচ দেখো, আমি এখনো খেতেই বসিনি। আমি যদি এখনো খেতে না বসে থাকতে পারি, উনিও পারবেন পরোটা ভাজা অব্দি অপেক্ষা করতে।”

সে ডাইনিংরুম থেকে চলে যায়। সোনালী আপু তার এমন কাটকাট জবাবে চিন্তিত হয়৷ ঝগড়া হলো নাকী আবার। সে গিলতে পারছে না খাবার। বিধায় পানি চাইলো। পানির গ্লাস ইমানের পাশে। সে গ্লাস পানির দিকে এগিয়ে দিল।

সোনালী গ্লাস নিতে গিয়ে দেখল, ইমানের হাতের তালু লাল হয়ে আছে। নিজে বিবাহিত হওয়ায় সে বুঝে যায় এটা কীসের দাগ! মুচকি হাসল সে। অযথাই চিন্তা করেছে। এরা দিব্যি সুখে আছে৷

নাস্তা শেষ করে মিরা সবে বসেছে৷ ইমান অবশ্য ওদিকেই বসেছে। তাদের মধ্যে আর কথা হয়নি। কালকে রাতের প্রতিটা ঘটনা দু’জনই চেপে যাচ্ছে৷

আচানক সোনালী আপু আর দাদী আসলো। দাদী বলে উঠে, “বুবু বালাখানা ঠিক মতো রেখেছিস?”

মিরা ঘাবড়ে গেল। মনে আসছে না কই খুলে রেখেছে সে সোনার বালা দুটো৷কাল দাদী বিয়ের সময় পরিয়ে বলেছিল, যত্নে রাখতে!

বালা কই আছে সেটা ভুলে যাওয়ায় সে খানিকটা অপমানিত বোধ করে৷ কথাটা সোনালী আপুকে জানাতেই সে ভীতগ্রস্ত হয়ে বলে, “রুমে চল। একসঙ্গে খুজে বের করি৷”

দুজনে মিলে ইমানের রুমে গেল। রুমে ঢুকেই সোনালী আপু ভিমড়ি খেল৷ বিছানার অবস্থা করুণ। চাদরের ঠিক নাই। বালিশ নিচে পরে আছে। এবং সবচেয়ে লজ্জাজনক বিষয় হলো, মিরার অতিগোপনীয় পোশাক বিছানায় ফেলে রাখা হয়েছে।

তা দৃশ্যমান হতেই মিরা প্রচুর লজ্জা পায়। সে নিজেও অবাক। রুমের অবস্থা মোটেও এমন ছিল না৷ নিশ্চয়ই বিছানা গোছাতে বলায় ইমান এমন ঘর এলোমেলো করে গেছে। ঘর দেখে মনে হচ্ছে ঘরে ঝড় বয়ে গেছে৷ সে মনে মনে ইমানকে গালি দিতে থাকে৷ তাকে বাগে আনতে এমন করেছে৷

সোনালী আপু চোখে হাত দিয়ে কিছু না দেখার ভান করে বলে, ” তোদের আরেকটু বড় হওয়ার পর বিয়ে দিতে হত৷ কিছুই তো সামলাতে জানিস না। আমার ভাইয়াটাকে কামড়ে কামড়ে শেষ করে দিলি তুই। এতো চাপ দিস না মিরা। বেচারা লোড নিতে পারবে না৷ ”

চলবে।

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–21

সকলে যখন নাস্তা খাওয়ার পর কাজে ব্যস্ত৷ মিরা সেই সময় এক ফাঁকে ইমানকে ম্যাসেজ দিল। ইমান সঙ্গে সঙ্গে সিন করে৷

সে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে এরুপ, “কাজটা একদম ঠিক করেননি৷ আপনার জন্য আমাকে কতোখানি লজ্জা পেতে হয়েছে সোনালী আপুর সামনে, কোন আইডিয়া আছে?”

ইমানের ম্যাসেজ এলো, “তোমার লজ্জাও আছে? জানতাম না তো!”

টুং করে আওয়াজ হয়ে এই ম্যাসেজের আগমন ঘটে। মিরা মনে মনে রেগে উঠে কটমট করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। ইমানের প্রোফাইল পিকচারটা ছোট করে সো করছে৷ কী সুন্দর হাসি-হাসি মুখটা তার। ছবিতে আরোও হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। মিরা রিপ্লে দিল, ” আই হেইট ইউ।”

ইমান অবশ্য আর কিছু ম্যাসেজ দিল না। সে ফোন হাতে অপেক্ষায় থাকে কখন আবার রিপ্লে পাবে৷ কিন্তু রিপ্লে না পাওয়ায় তার বিরক্ত লাগে। সে ফেসবুক অন করে “ইমান খান” নামক প্রোফাইলে ঢুকে, প্রতিটা ছবিতে হাহা দিতে থাকে। তার আইডির ছবিগুলোতে একে একে হাহা রিয়্যাক্ট দিয়ে শান্ত হলো সে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ এলো, ” কী সমস্যা তোমার?”

কাঙ্খিত ব্যক্তির কাছ থেকে ম্যাসেজ পেয়ে সে হাসি দিল। তার মজা লাগছে বেশ। পাশের রুমে থেকেও চ্যাটিং করার মজা ভিন্ন৷

কিছুক্ষণ আগে ম্যাসেজ সিনও করছিল না আর এখন নিজ থেকে ম্যাসেজ দেয়।হাহ!

সেও সিন করল কিন্তু কিছু রিপ্লে দিল না। আবারো ম্যাসেজ আসলো। “ষ্টুপিড গার্ল” লেখা। এবারে মিরা শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর সেখানেও হাহা দিয়ে ম্যাসেঞ্জার থেকে বেরিয়ে এসে ইউটিউবে ঢুকে ফানি ভিভিও দেখা শুরু করে। সে আপাতত ড্রয়িংরুমে বসে আছে। পা উঠিয়ে বসেছিল সে। দুপুরের রান্নার আয়োজন চলছে।রান্নাঘর থেকে সুস্বাদু খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে। মা আর সোনালী আপু ব্যস্ত খুব।সায়েমা আপু শ্বশুড়বাড়ি চলে গেছেন। আর বড় আব্বুর হুট করে শরীর খারাপ লাগছে জন্য তিনি নিজের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সে সুযোগ ও সন্ধানে আছে। ইমানের এই ভালো সেজে থাকা অভিনয় সবার প্রকাশ্য আনা দরকার। কিন্তু, সে বুঝে পাচ্ছে না, দাদী, মা, বড় আব্বু কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে? দাদী এতোবড় শক সামলাতে পারবে? এমনি দাদী বারো মাসই অসুস্থ থাকেন। হার্টে সমস্যা তার, সেই সাথে প্রেশার। তার উপর কালকেই তাদের বিয়ে হলো। এই বিয়ের পরিনতি কী হবে? সে সকল চিন্তাকে একপাশে রাখলো৷ ভিডিও ওপেন করা থাকলেও তার সেদিকে ধ্যান থাকলো না। নানান দুশ্চিন্তায় সে দ্বিধাগ্রস্থ। ইমানের মনে কি চলছে তাও সে জানে না! এই বিয়ে টিকবে তো? নাকি সমাজে তাকে ডিভোর্সী উপাধি পেতে হবে?

পেছনে যে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই তার৷ আনমনে ভেবেই চলেছে৷ ভিডিও শেষ হয়ে গেল। সেই সময় তার ফোনে ইনকামিং কল আসে। রিংটোনের আওয়াজে তার ঘোর কাটে। সে স্ক্রিনের দিকে তাকালো এবং সামান্য হতভম্ব হলো। রাকিবের ফোনকল, তাও এই দুপুরবেলায়। রাকিব মনে হয় তার বিয়ে সম্পর্কে জেনেই কল দিয়েছে। সে যেই না রিসিভ করতে যাবে, ওমনি পেছন থেকে কেউ তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল৷ সে চকিতে উঠে পেছনে তাকায়। ক্ষণেই তার দৃষ্টিবিলাস হয় ইমানের সঙ্গে। তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে রেগে গেল নাকি বিন্দাস মুডে রয়েছে৷ তবে মিরা ভিতরে ভিতরে ভীষণ ভয় পেল। বিয়ের পরের দিন এমন পরিস্থিতিতে পড়লে করণীয় কী? আচ্ছা এখানে তার দোষ কোথায়? বিয়ের পর কী পরপুরুষের ফোনকল আসা দোষের? সেতো আর কল দেয়নি।
খারাপ কোন উদ্দেশ্যও নেই তার মনে।

ইমান ফোনের দিকে এক সেকেন্ডের একটু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ফোন বাজতে বাজতে থেমে গেলে, সে ফোনটাই সুইচ অফ করে দিয়ে, নিজের পকেটে রেখে বলে, “বেশি ফোন ইউস করা শরীর-চোখের জন্য ক্ষতিকরম মনের ও সম্পর্কের জন্যও ক্ষতিকর। ৷”

মিরা এরপর পালটা জবাব দিল না। তার কেন যেন নিজেকে অপরাধী লাগছে। সে সংশয়ভরা চোখে তাকিয়ে রইল। ভেবেছিল সে আরো কঠিন কিছু কথা বলবে কিন্তু ইমান এমন কিছু করলো না। সে রুমে চলে গেল৷ এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসে। আজকে সে সকালবেলা থেকেই ফিটফাট হয়েছিল। এখন তার লুক দেখে মনে হচ্ছে, বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷

ইমান ড্রয়িংরুমে মিরাকে পাশ কাটিয়ে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলে, মিরা প্রশ্ন করে বসে, “বাইরে যাচ্ছেন?”

–“হু।”

— “ফিরবেন কখন?”

এ প্রশ্নে সামান্য রাগান্বিত দেখালো তাকে। সে ভরাট কণ্ঠে বলে, “সবকিছু কী তোমাকে বলে করতে হবে এখন থেকে? তুমি তো আমাকে জানিয়ে কিছু করো না, নিজের মনমতো যেকারো সঙ্গে ফোনালাপ করো! ”

শেষের খোটা মারা কথায় মিরা বেশ অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। চোখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইমান ইচ্ছাকৃত ভাবে বেশ শব্দ করে ঠাস করে গেট ভিজিয়ে দিয়ে প্রস্থান করে। গেট লাগানোর শব্দে মৃদ্যু কেঁপে উঠে সে৷ কিয়ৎক্ষণ পর, যখন রুমে ফিরে আসে, তখন তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে৷ দরজার একদম মুখে মিরার শখের ফোনখানা ভেঙে তিন ভাগ হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। তার ভীষণ আফসোস হলো ফোনটার জন্য। এ জেনারেশনের ছেলে-মেয়েদের কাছে এটা একটা দুঃখজনক দৃশ্য। সে ফোন ছাড়া কীভাবে চলবে? ইমানকে কে অধিকার দিয়েছে তার ফোন ভাঙ্গার? দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালায়৷

দুপুরে মুহুর্তগুলো আরো বিৎঘুটে কাটলো মিরার৷ লাঞ্চ আওয়ারেই ইমান যখন ফিরেনি তখন বাসার পরিবেশ ভয়াবহ। দাদী গজগজ করলেন কিছুক্ষণ। মাও সরাসরি মিরাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলেন।অবশ্য বাবা কিছু বললো না৷ আজ সকাল থেকে মিরা বারবার তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে৷ কিছু কোন প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না। বরং নিজেরই খুব কষ্ট হচ্ছে। কোন সন্তানই নিজের বাবার বিরুদ্ধে কিছু সহ্য করতে পারেনা৷

সোনালী আপু যখন প্রশ্ন করে, “তোদের মধ্যে কোন সমস্যা হচ্ছে? ইমান কেন খাওয়ার সময় এখানে নেই?”

এই প্রশ্নে মিরার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। সে তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনেই নেয়নি৷ অথচ সবাই তার কাছে কেন জবাবদিহিতা চাচ্ছে? ইমান কেন আসেনি এখনো এটা তাকে জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়!

মিরা সামান্য দুর্ব্যবহার করে ফেলে আপুর সঙ্গে। এরপর নিজের রুমে ফিরে আসতেই মন খারাপ হয়ে যায়। আজকের দিনটা তার জন্য খুবই কুফা। সে নিজেও আর খায়নি। চোখ বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বিবাহ এতো জটিল কেন? আরো এক্সট্রা কমপ্লিকেশন ক্রিয়েট করছে তার হ্যাসবেন্ড৷ তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না, আর সব ধরনের যন্ত্রণা তাকে দেবে। মানসিক যন্ত্রণা ওতো তীব্র যে মিরার সারা শরীর ক্লান্তিতে ভরপুর হয়ে পড়ে। সে বিছানায় শুতে গিয়েও থেমে যায়। কালকে ইমানের ফ্লোরে ঘুমানোতে সে অসম্ভব আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এতোটা কষ্ট এর আগে কোনদিন পায়নি সে৷ এই নিদারুণ কষ্টের কথা কাউকে বলাও যাচ্ছে না। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে তার তন্দ্রা ভাব চলে আসে। দুপুর চারটা নাগাদ বাইরে থেকে সোনালী আপুর হাহাকার মাখা কান্নায় তার ঘুম ভাব ছুটে যায়। সে মিনিট এক স্তব্ধ রইল। আপু কাঁদছেন কেন? রুম থেকে বের হতেই তার চোখের সামনে সোনালী আপু আর মা দৃশ্যমান হলো। বড় আব্বু খালি গায়ে বসে আছেন। শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। অতিরিক্ত ঘামছেন তিনি৷ সোনালী আপু তার পাশে দাঁড়িয়ে ক্রমান্বয়ে কেদে যাচ্ছেন।

মিরা আশেপাশে তাকালো। তার বাবা কোথাও নেই। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, বাবার দুপুরের পর গোডাউন যাওয়ার কথা ছিল। বাবা নিশ্চয়ই এখম গোডাউনে আছেন। বড় আব্বু হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওনাকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। বাসায় কী কারো মাথাতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা আসেনি একবারও?

মিরা নরম গলায় বলে, “আপু প্লিজ শান্ত হও। আমাদের বড় আব্বুকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷”

সোনালী আপু কান্না চেপে রেখে বলে, ইমান তো সিএনজি আনতে গেলো৷

মিরা খানিক ভারমুক্ত হলো। সে বলে উঠে, “গাড়ি নেই?”

— “ড্রাইভার নেই৷ কাজের সময় এদের পাওয়াই যায় না।”

ওই মুহুর্তে ইমান ফিরে আসলো। সে হাপাচ্ছে। হাপাতে হাপাতে বলে, আমি মামাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। তোমরা পরে এসো।”

সে দারোয়ানের সাহায্য নিয়ে বড়মামাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠলো। বাকিরা সবাই নিচে নেমে গিয়েছিল। মা আর সোনালী আপু আরেকটা সিএনজি নিয়ে চলে গেল। সে আর ইরা রয়ে যায় বাসায় দাদীর সঙ্গে।

দাদীকে সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে৷ তার প্রেশার বেড়ে গেল। এই বয়সে দাদী আর কোন কষ্ট বা দুর্ঘটনা নিতে পারেনা। মিরা দাদীকে নিয়ে বাসায় এসে তার মাথায় পানি ঢাললো এবং তেতুলের টক খাওয়ালো। ঘুমের ঔষধ দিয়ে তাকে শুইয়ে রেখে পাশে বসে থাকল। একমনে দোয়া পড়ছে সে। এ কোন বিপদ ধেয়ে আসলো। বড় আব্বুর কিছু যেন না হয় সেই দোয়া করতে থাকে। বিকেলে ইমানের ফোন আসলো দাদীর ফোনে৷ ইরা ফোন ধরলো প্রথমে। ইমান কি যেন বলল তাকে। আর সে ফোনটা তার কানে তুলে দিল। দাদী ঘুমাচ্ছিল জন্য মিরা ভয়েজ নিচু করে,”হ্যালো?”

প্রথমেই যে প্রশ্নটা ইমান তাকে ছুড়লো তাহলোঃ “কাঁদছিলে নাকি?”

–” নাতো।বড় আব্বু কেমন আছে?”

— “দাদীর অবস্থা কী?”

— “ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। বড় আব্বুর কী হয়েছে?”

ইমান এক মিনিট নীরবতা পালন করে, “মামা স্টোক করেছেন। অবস্থা মোটামুটি ডাক্তার বাহাত্তর ঘন্টা অবজারভেশনে রাখবে৷”

মিরা এ খবর শুনে শক্ত থাকলো।এখন সে কান্নায় ভেঙে পড়লে দাদীকে সামলানো যাবে না৷

ইমান বলে উঠে, “দোয়া কর৷”

সর্বশেষ বাক্যটা বলতে গিয়ে তার গলা খানিক কেঁপে উঠে। এতে মিরা সামান্য অবাক হয়। ইমান কী কাঁদছে নাকী?

______________

সন্ধ্যার দিকে সম্ভবত বড় আব্বুর জ্ঞান এসেছিল। এরপর ইঞ্জেকশন দিয়ে তাকে ঘুমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য প্রান্ত ভাইয়া সোনালী আপুকে জোর করে তাদের বাসায় নিয়ে গেছে৷ আপুর অবস্থা খুব কাহিল৷ মিরার বাবা-মা ও রাতের খাওয়ার জন্য ফিরে আসল। আসেনি শুধু ইমান৷
মিরা আগেই রান্না করে রেখেছে৷ বাবা-মাকে সে খেতে দিল। দাদীকেও খাইয়ে দিয়েছে সে। ইরা অবশ্য খায়নি এখনো। ও একদম চুপচাপ হয়ে গেছে৷ ইরার জন্য মায়াই লাগছে তার৷

মা খেতে বসে বললেন, “ইমান তো আসলো না। ওখানে থাকবে৷ ভাইয়ের সঙ্গে কারো থাকা দরকার। এদিকে সোনালীর সুস্থ নেই। অপরদিকে, ইমান সেই দুপুর থেকে না খাওয়া। করোনার জন্য হাসপাতালের ক্যান্টিনে বিশেষ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না৷”

মিরা বলে উঠে, ” হোটেলে গিয়ে খেতে পারেন উনি।”

সুপ্তি বেগম বহু কষ্টে দুই লোকমা খেয়ে উঠে পড়ে বলে, ” আপন মানুষ অসুস্থ হলে,হোটেলে গিয়ে খাওয়ার রুচি থাকে না৷ ছেলেটা বোধহয় আজ না খেয়েই থাকবে। তোর বাবাকে আমিই থাকতে দিলাম না৷ দুই ভাই-ই হাই প্রেশারেএ রুগী৷ আল্লাহ কী বিপদ দিল আমাদের।”

মিরা সব শুনে বলে উঠে,” ড্রাইভারকে দিয়ে খাবার পাঠাই?”

–” ড্রাইভার আমাদের না জানিয়ে বাড়িতে গেছে।”

মিরা বলে উঠে, তাহলে আমি টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার দিয়ে আসব?

মা আজকে আর তাকে মানা করল না। রাত দশটাও সে বের হতে পারবে। নিজেকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। মিরা সত্যি খাবার নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য হাঁটা দেয়৷ বড় আব্বুকে এক ঝলক দেখার জন্য তার মন আকুপাকু করছে৷

হাসপাতালে পৌঁছে সে সিড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে। কেবিনের দরজার পাশেই সাড়ি সাড়ি বেঞ্চ রাখা। তার মধ্যে একটায় ইমান বসে আছে চুপচাপ। দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ তার৷ মুখটা শুকিয়ে গেছে৷

মিরা আস্তে করে ডাকে তাকে। ইমান চোখ খুলে হতভম্ব হলো। সম্ভবত তার উপস্থিতি আশা করেনি৷

— “বড় আব্বুকে দেখতে এসেছি৷”

ইমান উঠে দাঁড়ালো এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আসো৷”

দু’জনে হেটে কেবিনের দিকে গেল। বড় আব্বুর ক্লান্ত, দুর্বল, মেশিন লাগানো দেহ দেখে তার খারাপ লাগা হুহু করে বেড়ে গেল।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ইমান বলে, “তুমি যাও তাহলে। একা এসেছো?”

মিরা টিফিন ক্যারিয়ার দেখিয়ে বলে, “আপনি খেয়ে নেন।”

–” ক্যান্টিনে বসি?”

— “ঠিক আছে।”

তারা নিচে নেমে এসে ক্যান্টিনে বসে। রুটি আর সবজি এনেছিল মিরা৷ ইমান বহু সময় নিয়ে একটা রুটি খেল।

এরপর বলে উঠে, “আমার মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে। মেডিসিন নিব৷”

— আচ্ছা৷

–” তুমি বস। আমি আসছি৷”

ইমান উঠে চলে গেল। মিরা টিফিন ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিল। দশ মিনিট পর ইমান ফিরে এলো। ইমান চাচ্ছিল মিরা এখনি চলে যাক। কিন্তু মিরা যায়নি। উপরে উঠে আসে সে।

দুইজন একই বেঞ্চে বসে পরে৷ কারো কিছু করার নেই৷ সে চোখ বুজে ফেলতেই, মিরা নিজের শীতল হাত দিয়ে তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগে। প্রশান্তিতে ইমানের ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। ব্যথায় মাথার রগ টান লেগে গিয়েছিল। এখন এই নরম স্পর্শে যেন রগগুলো শিথিল হচ্ছে৷

ইমান অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে মিরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, মিরা, “আমাকে আর সাতদিন পর যেতে হবে৷”

সে অবুঝের মতো প্রশ্ন করে, “কোথায় যাবেন?”

— যেখান থেকে এসেছিলাম। অর্থাৎ আমার বাসায়।আমি নিউইয়র্ক ব্যাক করছি সাতদিন পর।”

এই সাধারণ কথা শোনামাত্র মিরার বুকের বাম পাশটায় তোলপাড় উঠে। সে তো কখনোই ইমানের ফিরে যাওয়া নিয়ে ভাবেনি৷

চলবে৷