ফেইরিটেল পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
876
ফেইরিটেল
গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–24

মার্চের শেষ ভাগ। বলতে গেলে মার্চ মাসের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে৷ দু-তিন দিন বাদেই বিদায় নিবে৷ কিন্তু তবুও নিউইয়র্কের বুকে এখনো শীতভাব যায়নি। উষ্ণতারা উদাসিন হয়ে মাঝে মাঝে দেখা দেয়। তবে শোশো করে বাতাস বয়ে চলছে নির্বিকারচিত্তে। বাতাসের ধ্বনি ও গাছের পাতার মড়মড় আওয়াজে চারপাশ মুখরিত। আজ নিউইয়র্কের আকাশ কমলাটে। বিকেলের সোনাবরণ রোদে অন্যরকম সৌন্দর্য বিরাজমান। ইমান মাত্র ঘুম থেকে উঠে বসল। রুমে বাতি জ্বালানো ছিল না। কাজেই হলদেটে ভাবটা তার রুমের সবখানে ছেয়ে গেছে। সে হাই তুলল। অনেক লম্বা ও ক্লান্তিকর জার্নির পর ঘুম ভালো হয়েছে৷ ঘুম ভালো হওয়ার পরও সে ক্লান্ত। সারা শরীর জুড়ে বিষাদময় ক্লান্তি৷ ভীষণ ক্লান্ত সে। চোখ জ্বালা করছে। সে দ্রুতে বেগে পা ফেলে জানালার ধারে হাঁটা ধরে। জানালার কপাট খুলে দিল৷ হিম হাওয়া বইছে। রাস্তার পাশ দিয়ে পথচারীর আনাগোনা, সব মিলিয়ে আজ যেন সবকিছুই ভীষণ অন্যরকম। সে বেশ কিছুক্ষণ জানালার ধারে চেয়ে থাকে। বিশাল, বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকাতেই তার মনে হলোঃ আকাশ ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ দীর্ঘস্থায়ী না। সবাই ছেড়ে গেলেও, ফেলে রেখে আসলেও, আকাশ সবসময়ই সব জায়গায় একই রকম। বাংলাদেশের আকাশও যা, আমেরিকার আকাশও তাই! দুটো দেশের মধ্যে এই এক জায়গায় তো মিল খুঁজে পায় সে৷

কেমন বিষন্নতা চারপাশে কিংবা তার মনজুড়েই বিষন্নতা জন্য সবকিছুই বিষাদ লাগছে৷ সে জানালা থেকে সরে এসে ফোন হাতে নিল। অনেক মিসড কল এসেছে৷ হোয়াটস অ্যাপে সোনালী আপুর ম্যাসেজ এসেছে। সে সবার আগে আপুর ম্যাসেজটা দেখল এবং রিপ্লেতে লিখলোঃ নিউইয়র্কে পৌছে গেছি৷ এরপর আরেকটা ম্যাসেজ লিখল,” মিরা কেমন আছে?”

ম্যাসেজ সেন্ট করেই সে চমকিত হয়। এবং ডিলিট করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হলেই, সেটা সিন হয়ে যায়৷ আপু টাইপিং করতে লাগলো। ইমানের অস্বস্তি হচ্ছে বেশ৷ এটা কী করে বসলো সে? মিরা কেমন আছে এটা তার কেন জানতে হবে? আশ্চর্য! একমাস আগেও তার মন এতো বেপরোয়া ছিল না। আজকাল মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে। যা কাম্য নয়৷

আপু ম্যাসেজ দিল। সেখানে লেখা ছিলঃ” মিরা তো ওর রুম থেকে বেরই হচ্ছে না। মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে ওর। মনে হয় কান্নাকাটি করেছে বেশি। তোর এতো জলদি যাওয়া ঠিক হলো না। মাত্র বিয়ে হলো। এখন এতোটা দূরত্ব তোদের মধ্যে দূরত্ব না আনুক।”

ম্যাসেজটা পড়ামাত্র তার কপালে সুক্ষ্ম বলিরেখার ভাঁজ ফেলে। সে বিরবির করে বলে, ” আচমকা অসুস্থ কেন হলো?” সে আপুর সঙ্গে আর কথপোকথন বাড়ালো না। নিউইয়র্কে আসলে তার কী যেন হয়! কারো সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছা করেনা। আপুকে এভাবে ইগনোর করতেও ভালো লাগে না। বাংলাদেশ যাওয়ার পূর্বে আপু তাকে বহুবার ম্যাসেজ দিত। সে গড়িমসি করে কাটিয়ে দিত। এবার কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। সবার জন্য মন খারাপ হচ্ছে৷ দাদী! ওনার সঙ্গে কী আর কোনদিন তার দেখা হবে! এতো দূরে সে কেন আসল? যেখানে চাইলেই চট করে কাউকে দেখতে পাওয়া যাবে না৷

তার একবার মন চাইলো মিরাকে কল দিতে৷ কিন্তু কোথায় যেন একটা দ্বিধার সঙ্গে একটা ক্ষোভ কাজ করে। ওর বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। উনি যদি একবারও ক্ষমা চাইতেন তবে সেকেন্ড টাইম ভেবে দেখত ইমান৷ কিন্তু অপরাধী, অন্যায়কারীরাও এতো দেমাগ দেখালো যে, হাত গুটিয়ে সেও বসে থাকবে না৷ তার মনের গুপ্ত ইচ্ছাটাকে মাটি চাপা দিল। মিরাকে ফোন দেওয়া থেকে বিরত রইল সে।

আবারো আকাশের পানে তাকালো। সাদা, পরিষ্কার, শুভ্র আকাশ। ওতো সৌন্দর্যের মধ্যেও কি যেন নাই কি যেন নাই— অনুভূতি ঝাপ্টা মারছে। খালি, খালি, শূন্য, শূন্য লাগছে সবকিছু। সে চেয়ারে গিয়ে হেলান দিয়ে বসল। ফোন চালাতে ব্যস্ত হলো। আজকে অবসরে থাকলেও সে কাল থেকেই অফিস যাবে৷ বাসায় এক একটা মিনিটকে কয়েক ঘন্টা লাগছে৷

ফোন চালাতে চালাতে সময় অতিবাহিত হয়ে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামল। বাতাসের তীব্রতা বেড়ে গেল। আচমকা দরজায় নক হলো। সে গলার স্বর উচু করে বলে উঠে, “ইয়েস? কাম প্লিজ।”

দরজা খুলে গেল এবং খুব মিষ্টি কণ্ঠে কেউ বলে উঠে, “হাই মিষ্টার খান।”

সে চকিতে উঠে। মিষ্টার খান বলে বহুজনই ডাকে তাকে৷ কিন্তু এতো সুন্দর ও যত্ন নিয়ে একজনই ডাকে। জুই! তার কলিগ এবং সেই সাথে বান্ধবীও বলা যায়। দে হ্যাভ এ গুড রিলেশন এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

চোখ উপরে মেলতেই সাক্ষাৎ হলো জুইয়ের সঙ্গে। তার ঝলমলে হাসোজ্জল মুখ দেখে ইমানও স্নান হাসল এবং উঠে দাড়িয়ে বলে উঠে,” হোয়াট এ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ!”

জুই এগিয়ে এসে তাকে হাগ করল। সেও রেসপন্স করে এবং হেসে দিয়ে বলে, “তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। কেমন আছো জুই? ”

জুই হাল্কা হেসে বলে, “এতোদিন ভালো ছিলাম না। বাট আজ খুব খুশি।”

ইমান তার খুশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলো না। এদেশে বেশিরভাগ মানুষই খুশি কারণ এখানে দারিদ্র্যতা নেই বললেই চলে৷ যেখানে দারিদ্র্যতার প্রকট নেই, সেখানে দুঃখ খুব কম রাস্তা মাড়ায়৷

জুই উৎসাহ দেখিয়ে বলে, “নিচে আসো।”

–” কেন?”

— “উফ, আসোই না! এতো প্রশ্ন কর কেন যেন বাঘের খাচার সামনে ফেলে আসব। আস এখনিই।”

–“ওকে আসছি৷”

ইমান ফোন বেডে ফেলে রেখে নিচে নেমে যায়৷ নিচে হলরুমের টেবিলে বিশাল বড় ফুলের বুকেট। এবং একটা কেক রাখা। কেকের উপর লেখা ওয়েলকাম ব্যাক৷ পাশেই কুকিজ, চকলেট এবং তার প্রিয় গ্রিল চিকেন উইথ গার্লিক ব্রেড রাখা। এসব নিশ্চয়ই জুই নিজে কুক করে এনেছে৷ মেয়েটা দারুণ ভালো রাঁধে। নিশ্চয়ই ডান হাতে তিল আছে। এমন চিন্তা মাথায় আসতেই তার একজনের কথা মনে পড়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে ব্রেইনকে ডাইভার্ট করল। চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে বাকি জিনিস গুলো৷ একটা হ্যান্ড মেড ওয়েলকাম ব্যাক কার্ডও আছে৷ এতো সময় কই পায় জুই?

তাকে দেখে হাসনাহেনা বলে উঠে, “তোমার জন্য জুই সেই চারটা থেকে এসব প্রিপারেশন নিচ্ছে।আর তোমার এখন সময় হলো নিচে আসার৷”

ইমান কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেকের দিকে তাকালো। কেকটা দেখেই তার কেমন লাগছে। শরীর খারাপ হলো নাকী তার? শরীর খারাপ লাগলেই তার খাবার দেখলে গা গুলায়।

জহির সাহেব বাসায় নেই। তবে সাদ মাত্র বাসায় ফিরল। ভাইয়াকে দেখেই গিয়ে হাগ করে বলে, “বিগ ব্রো! ঘুম থেকে উঠলে কখন ? ”

ইমান বলে উঠে, “একটু আগে।”

সাদ আস্তে করে বলে,” তোমার জন্য তোমার গার্লফ্রেন্ড কতকিছু করল৷ ইউ আর লাকি! আমাকে দেখো, আমার গার্লফ্রেন্ড কখনোই এমন কিছু স্পেশাল করেনা৷” উলটো ডেটিংয়ের সব খরচা আমার।”

ইমান চোখ মুখ শক্ত করে বলে, “সি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড। শুধু ফ্রেন্ড হয়। ”

সাদ হেসে বলে, “জাস্ট ফ্রেন্ড ক্যান বি গার্লফ্রেন্ড ইন ফিউচার৷”

— “নট পসিবেল৷”

— “কেন?”

ইমান উত্তর দিল না৷ হুট করে শরীর খারাপ লাগছে৷ জুই কেক কাটার জন্য জোরাজোরি করলে সে কেক কাটলেও মুখে তুলল না৷ অযুহাত দিয়ে রুমে চলে আসে। বমি বমি লাগছে৷

হাসনাহেনা মুখ বাকিয়ে জুইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ওর সবকিছুতেই প্রবলেম৷”

সাদ পরিবেশ হাল্কা করার জন্য বলে, “বিউটিফুল লেডি, আজকের ওয়েদার এতো রোমান্টিক কেন?আমার সঙ্গে ডে*টে যাবা? ”

জুই হেসে বলে, “নেভার।”

সাদ কষ্ট পাওয়ার মতো ফেস করে। জুই উপরে উঠে যায়। ইমানের রুমে ঢুকে সে সোজাসাপটা প্রশ্ন করে, “তোমার কী মাইগ্রেনের সমস্যা? ”

ইমান মাত্র বিছানায় শুয়েছে৷ এমন প্রশ্ন শুনে সে বলে উঠে, “নাতো।”

–“ওহ। গুগলে মাইগ্রেন নিয়ে সার্চ করেছো জন্য ভাবলাম তোমার অসুবিধা হচ্ছে বোধহয়।”

ইমান নিজেও বেশ অবাক হলো। কখন যে সে মাইগ্রেন নিয়ে সার্চ দিল!

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–25

হুট করেই আকাশটা মেঘলা হয়ে গেল। ঘণ হয়ে ধেয়ে আসতে লাগলো মেঘকুঞ্জ৷ এমন ধুলো ওড়া বাতাসের মাঝে বৃষ্টি তেমন একটা হয়না। কিন্তু ইমানকে বোকা বানিয়ে দিয়ে ঝুমঝুম করে রেইনফল হলো। নিউইয়র্ক রেইনফলের চেয়ে স্নো-ফলের জন্য বেশি ফেমাস৷ তার মানে এই না যে নিউইয়র্কের বৃষ্টি সুন্দর না। অপূর্ব সুন্দর করে বৃষ্টি নামে এখানে৷ স্বচ্ছ, টলটল, পরিষ্কার বৃষ্টি দেখামাত্র ভিজতে মন চায়৷ ইমানের রুমের উইন্ডো খোলা আছে হাট করে। বৃষ্টির ফোঁটা এসে রুমের একভাগ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে৷ সে বেডে বসে লাইট নিভিয়ে দিল। নিশ্চুপ লোকালয়ে বৃষ্টি পড়ার শব্দ অন্য এক ভূবনের স্বাদ দেয়। মনে হবে কোন বন-অরণ্যের মাঝে বসে আছে সে। লাইট নিভিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তার রুমে কেউ প্রবেশ করে। এখানে লাইট বন্ধ করে রাখলে কেউ আর ডিস্টার্ব করেনা। আজ ব্যতিক্রম হলো যেন৷ কেউ দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে। তার পায়ের শব্দ ইমানের কানে এলো। অবশেষে ছায়ামূর্তি বলে উঠে,

–“মিষ্টার খান, আপনি কী একটু বেশি সিক?”

ইমান সচকিতে উঠে। এবং হাল্কা গলায় বলে, ” সামান্য সিক। রেস্ট নিলে সেরে যাবে৷”

সে এগিয়ে এসে তার সামনে দাড়ালো। ইমান একবার চোখ তুলে তাকালো। এবং সেকেন্ডের মধ্যে চোখ নামিয়ে নিল৷

জুই জানালার দিকে তাকিয়ে বলে, “বৃষ্টিতে সব ভিজে যাচ্ছে তো।”

–” ভিজুক।”

জুইয়ের কি যেন হলো। ইমানের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করল। এরপর সে চেয়ার টেনে এনে ইমানের মুখোমুখি বসে মিষ্টি গলায় বলে, ” মন খারাপ কী জন্য?

ইমানের জুইয়ের কথায় হচকচিয়ে যায়৷ এতোক্ষণ পর সে নিজে উদাসীন থাকার কারণ ধরতে পারল। তার আসলে মন খারাপ। এই সামান্য বিষয়টি মাথায় আসেনি৷

সে জুইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,” কীভাবে বুঝে গেলে? আমি নিজেই তো ধরতে পারছিলাম না৷”

–মন খারাপ হলেও বুঝো না?

–” প্রথমবার মন খারাপ হলো সেজন্য বুঝিনি। এরপর যদি কখনো মন খারাপ হয়, সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলব৷”

জুই ঠাট্টা করে বলে, “এমন হলে তো ফাস্ট টাইম প্রেমে পড়লে টের পাবে না।”

ইমান তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। জুই প্রশ্ন করে, “তোমার কি মাথাব্যথা?”

–“না।একবার বললাম তো।বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কীভাবে জানলে আমি মাইগ্রেন নিয়ে সার্চ দিয়েছি?”

–” তোমার উপর এফবিআই গিরি করি স্যার।”

–” মজা করো না। মুডে নেই৷”

জুই তার চুলগুলো পলিটেল করার চেষ্টা করতে করতে বলে,” তোমার ফোনের স্ক্রিনে দেখেছি। সুইচ অফ না করেই ফেলে রেখে গিয়েছিলে৷”

–“ওহ।”

–” মাথাব্যথা নাহলেও তোমাকে সিক দেখাচ্ছে৷

তখন হুড়মুড় করে বাতাস বইতে লাগে। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো শীতল বাতাস। এ বাতাসে মনে হয় সব উড়ে নিয়ে যাবে৷ জুইয়ের চুলও বেশ ভালোভাবেই উড়াউড়ি শুরু করল। ঘর ক্রমশ অন্ধকার হতে লাগলো। অবশ্য বাইরে থেকে আলো আসছে। কিন্তু পর্দার বেসামাল নড়চড় যখন-তখন অন্ধকারের আগামন ঘটাচ্ছে৷ ইমান সেজন্য বাতি জ্বালিয়ে দিল। হলদে রঙের আলো নির্গত হয় এই বাতি দিয়ে। হাল্কা টিমটিমে চোখ না লাগার মতো এর ভোল্টেজ। এই বাতির নিচে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই ঘুম পাবে ভীষণ।

বাতি জ্বালানোর সাথে সাথে জুইয়ের মুখশ্রী দৃশ্যমান হলো৷ মেয়েটার চেহারায় লাবণ্যতায় ঘেরা৷ টানা টানা চোখে যখন তাকায়,মনে হবে সে মনের ভেতরটা পড়তে জানে৷ সে আপাতত ব্যস্ত তার চুল নিয়ে। ব্রাউন কালার করা চুলগুলোকে একসঙ্গে বিন্যস্ত করে ঝুটি করতে গেলে, ইমান বলে উঠে, “চুল খোলাই রাখো।”

জুই ভ্রু কুচকে তাকালো তার পানে৷ ইমান জানালার ফাক গলে কিঞ্চিৎ আকাশ টুকরোর দিকে তাকিয়ে বলে, “এমন হাওয়া-বাদলের দিনে চুলগুলোকে ছুটি দাও। উড়াউড়ি করুক। তুমি বাতাসের প্রকটে উড়ন্ত এলোমেলো চুলের ঝাপটা উপভোগ করো৷”

–“ওকে।”

ইমান আনমনে বলে উঠে, “আমি আমার প্রেয়সীকে কোনদিন এমন বৃষ্টির দিনে চুল বাঁধতে দিব না৷ বাতাসে চুলের দুষ্টুমির জন্য যতোবারই সে বিরক্ত হবে, ততোবারই আমি তার কপালে চুমু দিব৷”

লাইনটা বলেই ইমান ভীষণ অপ্রস্তুত বনে যায়। জুইয়ের সামনে এমন কথা বলা একদম ঠিক হলো না৷ সাধারণত কাজের কথা ছাড়া এমন বেখাপ্পা কথাবার্তা সে বলে না৷ কিন্তু জুই এর বিপরীত। অনর্গল কথা বলে যাবে তার সাথে। কোন সমস্যা ফেস করলেই তার কাছে আসবে। ইমান অবশ্য মন-প্রাণ দিয়ে জুইয়ের মঙ্গল কামনা করে। মেয়েটা খুব ভালো৷

জুই যেন তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ মানে মিষ্টার খানের মুখ দিয়ে এমন কথাও বের হয়৷ এই প্রথম প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সে তার সঙ্গে কথা বলছে। সেই সাথে জুই আরেকটা বিষয় নিয়ে খুব উত্তেজিত। মিষ্টার খান তো তাকে চুল বাঁধতে বারং করল৷ আবার বলছে নিজের প্রেয়সীকে কোনদিন এমন ওয়েদারে চুল বাঁধতে দিবে না৷ তবে কী তাকেই ইনডিকেট করল? উফফ এই ইমান এতো কমপ্লিকেটেড কেন?

দুইজনের মধ্যেই নীরবতা। জুই সর্বপ্রথম মৌনতা ভেঙে বলে, ” তোমার আসলে মনের অসুখ হয়েছে। মনকে খুশি রাখতে হবে। চল হাঁটতে বের হই। তোমার এমন আবহাওয়ায় হাঁটতে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। সতেজ লাগবে৷ ”

ইমান বলে, আজ না। আরেকদিন যাব৷

— আরেকদিন কী তোমার মন খারাপ থাকবে? কাম অন৷ প্লিজ!

অগত্যা সে উঠে দাঁড়িয়ে ট্রাউজার চেঞ্জ করে নিল। এবং নিচে নেমে যায়। জুই তার আগেই নিচে নেমে গেছে। সে যখন করিডোর বেয়ে সদর দরজার সামনে আসলো, তখন জুই ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা বেরিয়ে গেল। হাসনাহেনা একবার তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে কাজে মনোযোগ দিলেন৷

রাস্তায় বেরিয়ে আসলেই ইমানের সতেজ লাগা শুরু করলো। স্নিগ্ধ শীতল আরামদায়ক বাতাস এসে গায়ে ধাক্কা লাগলো। চারপাশ নিরিবিলি। কয়েকজন রেইনকোট পরে হেঁটে যাচ্ছে। দ্রুত গতিতে গাড়ি পাড় হচ্ছে৷ ইমানরা মেইন সিটিতেই থাকে। তবে তার বাসা মেইনরোড থেকে দশ মিনিটের হাটাপথ৷ জুই একটামাত্র ছাতা নিয়ে বের হয়েছে৷ আর বাইরে বেশ ভালোই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে এখনো৷ সামান্য হাঁটলেই গা ভিজে যাবে। জুই ছাতা মেলে ধরে ইমানের জন্য অপেক্ষা করল। ইমান ইতস্তত করে হলেও জুই সঙ্গ নিল। দু’জনে একটা ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরে সামনের দিকে।

দুইজন নিঃশব্দে হাঁটছে। পরিষ্কার রাস্তায় কোথাও বৃষ্টির পানি জমে নেই। অদৃশ্যমান ড্রেনের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। বিশাল উচু ভবন গুলোর মাঝের রাস্তার দুইধারে গাছ আর গাছ। গাছে বৃষ্টির পানি পরায় পাতাগুলো যেন আরো ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠেছে৷ কোনদিকে একবিন্দু ময়লা কিংবা নোংরা নেই। চোখে আরাম দেওয়ার মতো দৃশ্য৷

ইমান চলতে চলতে একবার জুইয়ের দিকে পরখ করল৷ ও এমন পরিবেশ দারুণ উপভোগ করছে৷ সত্যি বলতে ঘণ ধূসর মেঘের নিচে এমন মনোমুগ্ধকর বাতাস, সঙ্গে ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো। বর্ননার বাইরের মুহুর্ত যেন!

সে বলে উঠে, ” জানো ভাংলাদেশে যখন বৃষ্টি হয় তখন একদম মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামে। মুষুলধারে বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে যায়। একবার কী হলো জানো? বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি বের করে বেকায়দায় পরে গেলাম। রাস্তায় এতো পানি জমে গেছে যে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গেল। গাড়ি আর স্টার্ট হয় না৷ ”

জুই অবাক হলো। রাস্তায় পানি জমার চিন্তা তার মাথায় কোনদিন আসেনি৷ আর বৃষ্টির পানি ইঞ্জিনে ঢুকা। বাপরে! কী ভয়াবহ ঘটনা৷

সে চোখ বড় করে বলে, “ডেঞ্জারাস ব্যাপার তো। অনেক বড় বিপদে পড়ে গিয়েছিলে? ”

— “আরে ধুর। বাংলাদেশে এসব কোন ব্যাপার না৷”

— “এতো বৃষ্টির মধ্যে বের হওয়ার দরকার কী ছিল?”

ইমান উত্তর দিল না৷ কী বলবে সে? কাজী ডাকতে গিয়েছিল?

জুই অবশ্য আর ঘাটালো না। তারা মেইনরোডের দিকে এসে গেছে। মেইন রোড ধরে একাধারে বেশ কিছু শপ আছে। সবার আগে তার চোখে পড়ল আইসক্রিম পার্লার। আচানক তার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করল। ক্রেভিংস উঠলো খুব৷ এমন ওয়েদারে আইসক্রিম খাওয়া ডিমান্ডেবেল৷

সে তার ইচ্ছে প্রকাশ করে বলে,” চল আইসক্রিম খাই৷”

ইমাম হতভম্ব হয়ে বলে, “এমন ঠাণ্ডা পরিবেশে কেউ আইসক্রিম খায়?”

— ” আমরা আইসক্রিম লাভাররা খাই৷ ”

–” তুমি খাও। এখন আইসক্রিম খেলে আমার টনসিল ফুলে যাবে৷ ”

জুই তাকে আর জোরাজোরি করল না। সে একটাই বাটারস্কচ ফ্লেবারের আইসক্রিম কিনল। এবারে ছাতা ধরল ইমান। জুই আইসক্রিম খাচ্ছে। তারা ফিরে আসছে। উলটো পথ ধরল। দু’মিনিট হাটার পর জুই তার মুখের সামনে আইসক্রিম ধরে বলে, “টেক আ্য বাইট৷ ”

এর আগে বহুবার জুইয়ের সঙ্গে ফুড শেয়ার করেছে সে। তাই কোন বাহনা না দিয়ে ইমান জাস্ট একটা বাইট নিল৷ আইসক্রিম খেয়ে সে জুইকে ফেরত দিল। জুই তার আড়ালে ওই জায়গায় একটা বাইট বসালো। যে-জায়গা থেকে ইমান মাত্র বাইট নিল।

বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় নিয়ে আইসক্রিম খাওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথমবার হলো ইমানের বিষয়টা মজার অনেক। তার কেন যেন মনে হলো, এই জায়গায় মিরা থাকলে অনেক বেশি মজা পেত মেয়েটা৷ না জানি অসুস্থ অবস্থায় ঠিকঠাক কিছু খেতে পারছে কিনা!

–” কী ভাবছ?”

ইমান থেমে গিয়ে দূরের সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “একজনের কথা ভাবছি। সে অসুস্থ। ”

— “তার দ্রুত সুস্থতার জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি৷”

ইমান পুনরায় উদাস হয়ে পরে। জুই ব্যাপারটা খেয়াল করল। মিষ্টার খানের খুব কাছের কেউ অসুস্থ কী?

ইমানের বাসার সামনে এসে দুইজনই থামল। ইমান বাসায় ঢুকার আগে জুইকে বলে, “থ্যাংক ইউ জুই৷ বিশ্বাস কর এখন অনেক টা হাল্কা লাগছে৷ কালকে দেখা হবে অফিসে৷ ”

— “বাই৷”

জুই ছাতা হাতে তার বাসার দিকে হাটা ধরল৷ ইমান একবার তাকে দেখেই ভেতরে ঢুকে যায়৷

বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে সে ফোন হাতে নিয়ে বসল৷ অনেক ভাবার পর সে সোনালী আপুকে সরাসরি কল দিল। আপু তিনবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরে বলে, “নিউইয়র্কবাসীর আমার কাছে কী?”

ইমান চুপ করে থাকলো৷ সকালে তাকে ইগনোর করায় আপু রেগে আছে বোধহয়।

ইমান এসব তোয়াক্কা না করে বলে, “মাইগ্রেন হলে কালিজিরার গন্ধ নাকে নিলে রিলিভ পাওয়া যায়৷ ”

— “এটা আমাকে বলে লাভ কী?”

— “কোন লাভ নাই তোমার। ”

— “তাহলে আমাকে কেন বলা হচ্ছে? যার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠছে, তাকে গিয়ে বল কালিজিরার গন্ধ নিতে। ”

— “তুমি বলে দিও৷ ”

— “তুই বললে কালিজিরা কাজ করবে না?”

ইমান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,” এতো প্যাচাও কেন?”

— “তুই প্যাচাস সবকিছু। কী সমস্যা তোর? মিরা কত আপসেট হয়ে আছে! বেয়াদব একটা। তুই মিরাকে কল দিস না কেন? ”

ইমান দু’মিনিট চুপ থেকে বলে, “ঝগড়া হইছে৷”

আপুর সঙ্গে কথা বলে ফোন রাখতেই বাংলাদেশী নাম্বার থেকে কল আসে একটা। সে মনে মনে খুশি হলো। মিরা কল দিতে পারে। তার উচিত কল দেওয়া। সে এতো পথ পাড়ি দিয়ে এলো, শক্রু হলেও অন্তত একটা কল দিয়ে খোঁজ নেওয়া মানবিকতার মধ্যে পড়ে৷ সে এক বুক আশা নিয়ে ফোন রিসিভ করে৷ কিন্তু তার আশায় পানি ঢালা হলো যেন। বিল্ডার্ডস কল করেছে তাকে। উনি আনন্দের সঙ্গে জানালেনঃ “আগামীকাল বাসা ছাড়ার নোটিশ দিব ভাইয়া। তিন মাস সময় দেওয়া হবে। এরপর বাসা ভেঙে আগামী পাঁচ মাসের মাথায় কন্সট্রাকশনের কাজ শুরু করা হবে৷”

_____________________

রাতে ইমান শুধু গ্রিন টি খেল। এবং শুতে যায়। কাল অফিস যেতে হবে৷ অনেক কাজ পড়ে আছে৷ আজ সাউন্ড স্লিপ দরকার। কিন্তু ঘুম বাবাজির দেখা নাই। সে বিছানায় গড়াগড়ি করল। এরপর বিরক্ত হয়ে উঠে বারান্দায় গেল। তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে৷ আজকে কী তবে আকাশেরও মন খারাপ?

সে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো। শুকতারা দেখা যাচ্ছে। চাঁদ আপন গতিতে মিষ্টি কিরণ বিলিয়ে দিতে ভারী ব্যস্ত৷ জোত্যি ছড়াচ্ছে। সেই জোত্যির সঙ্গে টুপটুপ বৃষ্টি কেমন গা ছমছমে ভাব তৈরি করছে৷

সে ফোন বের করে কাঙ্খিত নাম্বারে কল দিল। ওই সময় তার বুকে দ্রিমদ্রিম শব্দ হতে লাগে৷ সে কী সম্মুখীন হতে ভয় পাচ্ছে?

ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো। মিরা বলে উঠে, “হ্যালো?”

কণ্ঠটা শোনামাত্র কোথা থেকে যেন এক পশরা শান্তি তার মনে এসে আছড়ে পড়ল। সে মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না৷

মিরাও চুপ রইল। তার গলার স্বর ভেঙে গেছে বোধহয়। দুইজন প্রায় ছয় মিনিট চুপ থেকে সিম কোম্পানির লাভ বাড়ালো৷ অবশেষে ইমান নীরবতা ধ্বংস করে বলে, কেমন আছো?

সুদীর্ঘ সাত সমুদ্র তের নদীর ওপ্রান্ত হতে মিরা বলে উঠে, “ভালো নেই৷”

ইমানের বুক ছ্যাত করে উঠল। সে নির্বাক হয়ে পড়ে৷ মিরা বলে উঠে, ” এই কথাগুলো শোনার জন্যই তো এতো ব্যাকুলতা! এতো শ্রম দিলেন আমার উপর । আপনি সফল হয়েছে৷ আমি ভালো নেই। খুশি? এবার সেলিব্রেশন করুন৷”

মিরার খোটা মারা কথাগুলো তার মনকে করাত দিয়ে কেটে দু’ভাগ করে দিল যেন। মিরার বলা কথাগুলো তার ভেতরকার ব্যক্তিকে নাড়িয়ে তুলল। অশান্তি নামক কুচকুচে বিশ্রী পাখিটা আবারো মনের রাজ্যে এসে হানা দিল৷ সবকিছুই আগের মতো বিষাক্ত হতে লাগলো৷

রাতের হাসনাহেনা বেশ রাগী চেহারা নিয়ে জহির সাহেবের কাছে অভিযোগ করে বলেন,” তোমার বড় ছেলে খুব বাড়াবাড়ি করে। আমরা রক্ষণশীল সভ্য পরিবার থেকে বিলং করি। আমেরিকায় থাকলেও আমরা মুসলিম কালচার মেনে চলি। সে বাসায় মেয়ে এনে একসঙ্গে রুমে একা সময় কাটায়। এসব বেহায়াপনা আমি সহ্য করব না৷”

জহির সাহেব অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালো। উনি বলে উঠে, ” ছেলের চরিত্র নষ্ট হওয়ার আগে বিয়ে দিয়ে দাও৷”

জহির সাহেব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। আসলেই কী তার ছেলে এমন বেহায়াপনা করে? তার বিশ্বাস হলো না৷ তবুও ছেলের বিয়ের বয়স হচ্ছে। বিয়ে তো দেওয়া উচিত।

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–26

নির্ঘুম রাতেরা এমন বিচ্ছিরি হয় তা আজ হারে হারে, প্রাক্টিক্যালি টের পাচ্ছে ইমান৷ একরাত না ঘুমানোর জন্য তার চোখে ক্লান্তিভাব এবং চোখের নিচে কালি উপহার পেল৷ অপ্রিয় রজনী গুলো খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়৷ সে ভোরবেলা উঠে গোসল সেরে বসে থাকলো৷ সকাল সাতটা বাজতেই নাস্তা না করে অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায় সে। সাধারণত আটটা থেকে সোয়া আটটার মধ্যে সে অফিস যায়। আজ ব্যতিক্রম ঘটালো৷ অফিসেই যেন সব সুখ লুকিয়ে আছে৷ তার ভাবখানা এমন যেন অফিসে গেলেই সকল অবসাদ থেকে মুক্তি পাবে৷

সে যখন অফিসে পৌঁছে তখন মাত্র ওয়াচম্যান দাঁড়িয়ে ছিল। আর সম্পূর্ণ অফিস ফাঁকা। কালকের বৃষ্টির ছিটেফোঁটা চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। চারদিক সূর্যের কিরণে ঝলমলে করছে। উদাসীনতা কোথাও হারিয়ে নতুন আশার আলোময় সূর্য হাসছে৷

ওয়াচম্যান তাকে অনেকদিন পর দেখে আনন্দিত হয়ে কাছে এগিয়ে এসে বলে, ” হ্যালো স্যার। নাইস টু মিট ইউ।”

ইমান হাসিমুখ করে বলে, “কেমন আছো জনসন?”

— “ভালো স্যার, আপনি? ”

সারারাত জেগে থেকে, না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, অযথা দুশ্চিন্তা করে কোন ব্যক্তির পক্ষে পরেরদিন সকালে ভালো থাকা অসম্ভব প্রায়৷ কিন্তু তবুও সবাইকে নিজের ভালো না থাকার কথা বলা যায় না৷ গুটিকয়েক মানুষের কাছে নিজের খারাপ থাকার কথা বলা যায়৷ কাল রাত থেকে ইমান এমন কাউকে খুঁজছে যাকে অবলীলায় বলতে পারবে আমি ভালো নেই৷ কিন্তু আফসোস তাকে খুঁজে পাচ্ছে না৷ এমন কেউ তার পরিচিত নেই৷ সম্ভবত সে কারো সঙ্গে মিশতে পারেনা এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ মেবি সে খুব নিষ্ঠুর একটা মানুষ। নাহলে অন্যকে এতো কষ্ট কীভাবে দিল?

ওয়াচম্যান উত্তরের আশায় চেয়ে আছে৷ ইমান বহুকষ্টে বলে, “আমি ভালো আছি৷”

–” নিউইয়র্ক ফিরলেন কবে?”

— “দুদিন আগে এসেছি৷ জনসন আমার জন্য ব্রেকফাস্ট আনাতে পারবে?”

— ” আপনি ব্রেকফাস্ট করে আসেননি?”

— “এখন করব। তুমি হাল্কা কিছু এনো৷”

বলেই সে ভেতরে প্রবেশ করে লিফটের এগারো তলায় উঠে পড়ল। কাঁচ দিয়ে ঘেরাও করা লিফট বেশ তীব্র গতিতে মুহুর্তের মধ্যে এগারো তলায় পৌঁছে দিল। সম্পূর্ণ অফিস আপাতদৃষ্টিতে ফাঁকা মনে হলেও কয়েকজন এসে পড়েছে৷ ইমান আইটি সেক্টরে কাজ করে। তার ডিপার্টমেন্ট আলাদা। তবুও অন্যদের দেখামাত্র সে সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময় করে নিজের কেবিনে চলে গেল৷ তখনই জনসন নাস্তা নিয়ে ফিরল। ব্রেড আর জেলি সঙ্গে ফ্রেশ জুস৷ সে কোনমতে পানি দিয়ে নাস্তা গিলল৷ আটটা বাজতেই অফিস জমজমাট হয়ে গেল। কাযে মনোযোগ দিতে গিয়ে বারবার কানে ভাসছে মিরার বলা কথাগুলো, ” আমি ভালো নেই।” কেন যেন এর প্রতিউত্তরে বলতে মন চাচ্ছে, “তোমাকে ভালো না রেখে, আমিও ভালো নেই।”

অফিসের অনেকেই তার সঙ্গে এসে মিট করে গেল৷ অবশেষে এই অফিসের চেয়ারম্যান পিটার স্মিথ আসলেন। তার ডাক পড়ল ওনার রুমে৷ সে নিজেকে একবার ধাতস্থ করে ওনার কেবিনের দিকে অগ্রসর হলো।

পিটার সাহেব মাত্র অফিসে এসেই জেনেছেন ওনার সবচেয়ে হার্ড ওয়ার্কিং এবং প্রিয় এমপ্লয়ি অফিসে এসেছে। সে বেশ খুশি হলো। ইমানের ছুটি আরো কয়েকদিন ছিল। সে সময়ের আগেই ফিরে এসেছে। অবশ্য পিটার সাহেবের সঙ্গে ইমানের বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে৷ এইজন্য ইমানকে সে এক্সট্রা কেয়ার দেয়৷

ইমান তার রুমে আসতেই পিটার উঠে দাড়ালো এবং তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে, ” মাই বয়, কেমন আছো?”

–” ভালো আছি স্যার৷ আপনি কেমন আছেন? ”

–” তোমাকে দেখে ভালো লাগছে বেশ।”

ইমান তার কথা শুনে বিমুগ্ধ হলো৷ সে জানে না সামনের দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক এবং তার কন্যা কেন তাকে এতো গুরুত্ব দেয়?

সে স্মিত হেসে বলে, “স্যার প্রজেক্টের অনেক কাজ পেন্ডিং আছে৷ আমি তাহলে যাই।”

— “ওহ ভালো কথা। দুইদিনের মধ্যে আর্জেন্ট আবারো টেক্সাস যেতে হবে তোমাকে৷”

–! যাব।”

— “লাকিলি সঙ্গে জুইও থাকবে।”

ইমানের মুখ কালো হয়ে আসলো। জুইয়ের সঙ্গ আজ-কাল অস্বস্তির সৃষ্টি করছে মনের কোণে। কিন্তু তবুও কাজ আগে প্রাধান্য পাবে। কাজের জন্য অনেককিছুই স্যাকরিফাইস করতে হয়। না চাওয়া সত্ত্বেও অনেককিছু করতে হবে৷

সে কেবিনে ফিরে এসে কাজে মনোযোগ দিল। সে হলো এ অফিসে আইটি ডিপার্টমেন্ট হেড। উন্নত এ দেশে আইটি সেক্টরের প্রয়োজন অনেক বেশি। তার অনুপস্থিতিতে অনেক কাজ পেন্ডিং। তার আন্ডারে জুই৷ তাদের অনেক কাজই গ্রুপভিত্তিক করতে হয়৷ লাঞ্চ আওয়ারের আগেই, জুই তার কেবিনে আসল।

ইমান তখন ডেস্ক ল্যাবটপের উপর চোখ রেখে কাজ করছিল। জুইয়ের প্রবেশ তার মনোনিবেশ ভঙ্গ করল।

জুই বলে উঠে, ” অনেক তো কাজ হলো মিষ্টার। এবার আসো লাঞ্চ করি৷”

ইমান মুখ তুলে তাকালো। আজকে জুই স্কার্ট পরেছে। টপস-স্কার্ট পরায় তাকে বাচ্চা লাগছে। কেশ গুলো ছেড়ে রেখেছে৷ ওর চুল বেশি বড় ন। কাঁধে গিয়ে ঠেকে। আজকে চোখে লেন্স পরেছে, জন্য অন্যরকম লাগছে৷

সে বলে উঠে, ” একটু পর। কাজ বাকি আছে৷”

“ওকে” বলেই জুই তার বিপরীতে রাখা চেয়ারে বসে তার জন্য অপেক্ষায় থাকল।

ইমান পুনরায় কাজে ব্যস্ত হলো। পড়শু যদি টেক্সাস যাওয়া লাগে তাহলে আজ আর কাল বাকি আছে কাজ শেষে করার জন্য। তার মানে এই দুইটা দিন তাকে রাত-দিন এক করে কাজে লাগাতে হবে৷

আধঘন্টা পাড় হয়ে যায় জুই বসে আছে৷ সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে মিষ্টার খানের কাজ-কর্ম গুলো। মিষ্টার খান কাজে এতোই ব্যস্ত যে তার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। আর অপেক্ষা করা যায় না৷ সে উঠে ডেস্কের সামনে ঝুকে ল্যাপটপ সুইচ অফ করে দিয়ে বলে, ” কীভাবে এতো কাজ কর তুমি? আমি তো দশ মিনিটও পারি না। ”

ইমান বেশ বিরক্ত হলো৷ কিন্তু প্রকাশ করল না। জুইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কাজ করো না জন্যই আমাকে এতো কাজ করতে হয়।”

জুই বললো, “তুমি সব কাজ করে ফেলো জন্য আমি কিছু করি নাহ৷”

–” তাই নাকি?”

— “ইয়েস, এখন আস লাঞ্চ করি৷”

ইমান ঘড়ি দেখে বলে, “চল ”

ক্যান্টিনে এসে তারা বসল। জুই স্যান্ডউইচ নিল৷ ইমান কফি আর রাইস নেয়।

জুই খেতে খেতে বলে, ” আজকে রাতে ফ্রি আছো?

–“কেন?”

–” আমাদের এক কলিগের বাসায় পার্টি। চল এটেন্ড করি।”

–” তুমি যাও। আরেকদিন আমি যাব।”

–” এতো বোরিং কেন তুমি? ”

ইমান শব্দ করে হেসে বলল, “কী জানি! ”

জুই তার হাসি হাসি মুখের দিকে বিমুগ্ধ নয়নে তাকালো। ওকে হাসতে দেখলে তার খুব ভালো লাগে।

_____________________

আজিজ সাহেব মেজাজ গরম করে সুপ্তি বেগমকে ডাকছেন৷ সুপ্তি বেগম তড়িৎ গতিতে তার ডাকে সাড়া দিলেন।

উনি তার স্ত্রীর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে, ” ভাই কী বলেছে তুমি শুনেছো?”

সুপ্তি বেগম বলে, “হ্যাঁ।”

আজিজ সাহেব আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তারপরও এতো স্বাভাবিক কীভাবে আছো?”

সুপ্তি বেগম বলে উঠে, “ইমানের সিদ্ধান্ত তো আমাদের মেজাজের উপর নির্ভর করছে না।”

–” ওই ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বিরাট ভুল করলা মিরার আম্মু। কী বলছিলা, মিরার সঙ্গে বিয়ে হলে ইমান শান্ত থাকবে৷ কিন্তু কী হলো? ও ওর সিদ্ধান্তে অনড়। এখন আমরা কী করব? ” ( ধমক দিয়ে বলে উঠলেন।)

সুপ্তি বেগম দ্বিগুণ ধমকে বলে উঠে, “আর কতদিন? আর কতদিন এভাবে মানুষের কাঁধের উপর ভর দিয়ে থাকবেন? আপনি নিজ থেকে কিছু করেন না কেন? সবসময় মানুষের উপর নির্ভরশীল। এতো মেরুদণ্ডহীন মানুষ কীভাবে হন? আমার তো লজ্জায় কারো সামনে মুখ দেখাতে ইচ্ছা করেনা।”

আজিজ সাহেব থমকে গেলেন।

সুপ্তি বেগম বলে, “ইমান কোন ভুল কাজ করেনি৷ ওর সম্পত্তি ও আমাদের কেন দিবে? বড় আপার ভাগের সব সম্পত্তি তো আগেই আপনি জালিয়াতি করে নিয়ে নিয়েছেন। শুধু এই বাড়িটাই আপার নামে আছে এখনো। যেটা এখন ইমানের। আমরা যেমন আমাদের সম্পত্তির এক আনাও ইমানকে দেইনি। সেই হিসেবে, ইমান কেন আমাদেরকে তার একমাত্র মায়ের সূত্রে পাওয়া জায়গা ছেড়ে দিবে?”

আজিজ সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” এটা আপার নামে ছিল না। আমাদের দুই ভাইয়ের নামে ছিল।”

–” ছিল। কিন্তু আব্বা তো মারা যাওয়ার আগে লিখিত ভাবে আপার নামে লিখে দিয়ে গেছেন৷ আর কেন আপার নামে লিখে দিয়ে গেছে সেটা ভেঙে বলার দরকার নেই নিশ্চয়ই।”

আজিজ সাহেব অপমানে কাঁপতে লাগলো৷

সুপ্তি বেগমও রেগে আছেন৷ স্বামীর উপর সেও ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ। একবার তো ভেবেছিলেন দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার রেখে চলে যাবেন। কিন্তু সম্ভব হয়নি৷ মাটি কামড়ে বহু অপমান সহ্য করে থেকেছেন। এর সিকি ভাগও তার দুই কন্যা জানে না। ইচ্ছা করেই জানতে দেননি তিনি৷ মেয়েরা বাবার কৃতকর্ম জেনে তাকে ঘৃণা করুক সেটা সে চায় না। এক জীবনে বহু নারী তার স্বামীকে ঘৃণা করে পাড় করে দিতে পারে৷ কিন্তু যে সন্তান তার পিতাকে ঘৃণা করে, সে সবচেয়ে অভাগা।

আজিজ সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ” তিন মাসের মধ্যে নাকী এবাসা ছাড়তে হবে। ভাই তো ওনার বসুন্ধরার ফ্লাটের ভাড়াটিয়াকে বাসা ছাড়ার নোটিশ দিল। কিন্তু আমি আমার মেয়েদেরকে নিয়ে কই যাব?”

— আশেপাশেই কোথাও ভাড়া উঠব।”

আজিজ সাহেব আরেকটাবার আফসোস করে বলে, “ইমানের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঠিক করোনি৷”

সুপ্তি বেগম চুপচাপ থাকলেন৷

উনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্ন করে, ” মিরা এখন কী করছে? ও কবে শ্বশুড়বাড়ি যাবে? ইমান কিছু বলেছে? ”

–” সময় লাগবে। ”

–” তাড়াতাড়ি গেলে ভালো হয় না?”

–” ভিসা হতেও তো সময় লাগবে। আরো কাগজ-পত্র তো রয়েছেই।”

— “সামনে আমাদের দুর্দিন আসছে তুমি কী বুঝতে পারছো?”

সুপ্তি বেগম মুখ চোখ শক্ত করে বলে, ” আপনি অন্যায় না করলে এমন দিন দেখতে হত না।”

চলবে৷