#সৎ_মা
#পর্বঃ২১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
“মায়ের অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো। একটু পরেই মাকে কেবিনে শিফট করা হবে।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ইরফানের ফোনকল পেয়ে। নাস্তাগুলো টিফিনবক্সে করে আমরা চললাম হাসপাতালের পথে।
নাস্তা করার পর বাইরে সবাই বসে আছে। ডাক্তার ভেতরে মাকে দেখছে। একেবারে সুস্থ না হলেও মা এখন কিছুটা ভালো । দুইদিন অবজারভেশনে রাখার পর ডিসচার্জ করা হবে। সবার মুখ থেকে আতংক নামক কালো মেঘ একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। যদিও ভয় একবারে যাবে না। মায়ের যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। সবাইকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। কেবিন থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসলেন। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“দেখুন আপনারা নিশ্চয়ই রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। রোগী যতদিন বেঁচে আছে ততদিন উনাকে কোনো রকম মেন্টাল প্রেশার দিবেন না। এখন উনি ঘুমোচ্ছে। বিকেলের দিকে ঘুম ভেঙে যাবে। তখন এক এক করে সবাই দেখা করবেন।”
সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। ডাক্তার কিছুটা পথ চলে গিয়েও আবার ফিরে আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“এখানে ইনসু না ইনসিয়া কে?”
চট করে দাঁড়িয়ে বললাম,
“আমি ইনসিয়া। কেন কি হয়েছে?”
” রোগী ঘুমানোর আগে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। এখন উনার ঘুমের প্রয়োজন বলে আমি দেইনি। বিকেলের দিকে আপনি প্লিজ সবার আগে উনার সাথে দেখা করবেন।”
আমি “আচ্ছা” বলতেই উনি চলে গেলেন।
দীর্ঘশ্বাসে চারপাশ ভারী হতে লাগলো। হাসপাতাল নামক স্থানটাই আতংকের জায়গা। হাসপাতালেই কেউ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যায়। আবার কোনো ফুটফুটে শিশু সদ্য ভূমিষ্ট হয়। আবার কেউ কেউ আরোগ্য লাভ করে পরিবারের কাছে ফিরে যায়।
বাবার নিকটে গিয়ে বললাম,
“এবার তুমি আর ইরফান বাসায় যাও। দুইদিনে তো চেহেরার আরো করুন অবস্থা করেছো। বাসায় গিয়ে গোসল দিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্যে ঘুম দেও। তোমাদের দু’জনের ঘুম দরকার। বিকেলে আবার এসো। আমরা এখানে আছি।”
আরজার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
“আরজার আব্বু এরা এভাবে যাবে না।আপনি দয়া করে এদের জোর করে নিয়ে যান না।”
____________________________________________
সূর্য্যিমামা পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। রৌদ্রের প্রখরতা ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে। আরজার দাদুকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ইকরা কেবিনের ওয়াশরুমে। আমি মায়ের হাতে আমার কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে। মায়ের অন্যহাতে ক্যানুলা ফিট করা। অনুভব করলাম মায়ের হাত কিঞ্চিৎ নড়াচড়া করছে। তন্দ্রাভাব কে’টে গেলো আমার। মা পিটপিট করে তাকালো আমার দিকে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি।পরক্ষণেই মায়ের চোখ অশ্রুসিক্ত হতে লাগলো। চোখের কার্ণিশে থাকা জল মুছে দিলাম সযত্নে। ইকরা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মায়ের জ্ঞান ফিরতে দেখে দৌড়ে আসলো। মা দূর্বল হাতে আমার হাত মুঠোবন্দি করতে চেয়েও ব্যর্থ হলো। আমিই মায়ের হাত মুঠোয় নিলাম। মা ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,
“আমি তোর সাথে করা সকল অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছিরে মা। যখন মাথায় যন্ত্রণা হয়, তখন ইচ্ছে করে কিছু একটা দিয়ে আমার মাথা দ্বি’খ’ন্ডি’ত করে ফেলি। সহ্য হয় না আমার একেবারেই সহ্য হয় না। এই পাপী মানুষটা যদি তোর কাছে তার করা অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চায় করবি তো ক্ষমা? জীবন-ম’র’ণে’র সন্ধিক্ষণে আমার করা অন্যায়গুলো যে আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।”
মায়ের কথাগুলো কাঁটার ন্যায় বুকে এসে বিঁধছে। ইকরা মায়ের শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে চলেছে। কোনো সন্তানই মায়ের শারীরিক যন্ত্রণার কথা শুনে সহ্য করতে পারবে না। মা আমার হাতটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা আবারও করে বললো,
“আমি যদি তোর কাছে কোনো আবদার করি রাখবি তো?”
আমি মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।
” আমার ইরফানটার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ আর ইকরার জন্য একটা রাজপুত্র এনে দিবি? দু’জনের একটা গতি দেখে আমি চোখ বুঁজলেও শান্তি পেতাম। ছেলেমেয়ে দু’টো কেমন ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমি জানি, আমি তোর সাথে যতই অন্যায় করি না কেন তুই কখনো আমার ছেলেমেয়েদের খারাপ চাইবি না।”
বলতে বলতে মায়ের শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো। ডাক্তারকে ডাকতে যাবো তখনই ওই ডাক্তারটা এলো। মায়ের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি করে কাছ আসলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” আপনাদের না বলেছি উনাকে উত্তেজিত করবেন না। উনার অবস্থা সম্পর্কে তো আপনারা অবগত। তারপর কেন বোকার মতো কাজ করেন?”
“আমরা তো মাকে,,”
কথা সম্পূর্ণ করতে পারলাম না। উনি বললেন,
“আপনারা প্লিজ বাইরে যান। রোগীকে দেখতে দিন। এই কারনে বাড়ির লোক সহজে এলাউ করি না।”
____________________________________________
কেবিনের বাইরে মূর্তির ন্যায় বসে আছি। ইকরা হেঁচকি তুলে কেঁদে চলেছে। কিয়ৎকাল পরেই উপস্থিত হলো বাবা, ইরফান আর আরজার বাবা। আরজার বাবা বললো,
“বেলা তো প্রায় শেষ হয়ে এলো।তোমাদের তো খাওয়া দাওয়া হলো না। চলো হাসপাতালের ক্যান্টিনে।কিছু খেয়ে নিবে।”
উনি সামনে এগিয়ে যেতেই বললাম,
“আমি ইকরার বিয়ে দিতে চাই সাথে ইরফানেরও। একই সময়ে একই দিনে।তোমরা সম্মতি দিলেও বিয়ে দিবো না দিলেও দিবো।”
আমার কথা শোনা মাত্রই সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। আরজার বাবা চাপা গলায় বললেন,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ইনসিয়া? তোমার মায়ের এই অবস্থায় তুমি বিয়ের কথা বলছো?”
“মায়ের শেষ ইচ্ছে এটা। মৃ’ত্যু’পথযাত্রী মা যে তার সন্তানের সংসার দেখে যেতে চায়।”
____________________________________________
মাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সিঁড়ি উঠানামা একেবারে নিষেধ। ড্রয়িংরুমের সাথে যে রুমটা গেস্ট রুম হিসেবে ছিলো ওটাই এখন বাবা মায়ের রুম। আপতত মা হুইলচেয়ারে বসে চলাচল করে। আমি কয়েকদিন এ বাড়িতে থাকবো।মা আরজার বাবা ফিরে গেছে ওই বাসায়।
রাতের খাবার শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। আরজাকে ঘুম পাড়িয়ে ইকরার পাশে শুইয়ে আমি ইরফানের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হলাম। ইরফানের রুমে গিয়ে দেখি ও নেই। গুটি গুটি পায়ে পা বাড়ালাম ছাদের উদ্দেশ্যে। রাতের হিমেল হাওয়ায় একটা সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান। একমনে আকাশ দেখে চলেছে। ওর কাঁধে হাত রাখলাম। কিন্তু কোনো ভাবান্তর হলো না ইরফানের। ওর নাম ধরে ডাকতেই ও বলল,
“কিছু বলবি আপু?”
“হাবিবার বাবার ফোন নাম্বারটা দে। ওনার সাথে তোদের বিয়ে নিয়ে কথা বলবো।প্রস্তাব পাঠাবো।”
“হাবিবার সাথে আমার আর কোনো কিছুই নেই আপু সব শেষ হয়ে গেছে।”
আমি চমকায়িত কন্ঠে বললাম,
“মানে?”
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আজ মাসখানেকের মতো ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। মায়ের অসুস্থতা তার উপর ও ফোন করে বলল ওকে নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আবার বাবার দেওয়া ব্যবসার দায়িত্ব। আমি তো কিছুই বুঝি না আপু। নিজের পড়াশোনা কোনোরকম চালিয়ে নিচ্ছি। কি করবো না করবো বুঝতে পারছিলাম না। এতোটা মানসিক চাপ আমি আর নিতে পারছিলাম না। নিজেকে রিমোট নিয়ন্ত্রিত রোবট মনে হচ্ছিলো। তাই ওকে বলেছি, আমি তাকে ভালোবাসি না। বিয়ে করতে পারবো না। রাগ করে ও আমার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে।”
ইরফানের কথা শুনে আমি যেন বাকশূণ্য হয়ে গেলাম। কতটা মেন্টাল প্রেশারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। ও কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“আমি হাবিবাকে প্রচন্ড ভালোবাসি আপু। তুই ওকে আমার করে দিবি? মায়ের অসুস্থতা তার উপর ওর শূন্যতা আমি ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে আপু। জীবন্ত লা’শে পরিণত করছে আমাকে। আমাকে বাঁচা আপু আমাকে বাঁচা।”
ওর মুড ঠিক করার জন্য বললাম,
“আমার ভাইটার বয়স জানি কত? উমমম কয়দিন পর ২৩ হবে। আমার ছোট ভাইটা ভালোবাসার গভীরতা বুঝে বাব্বাহ্। আমার ভাই বিয়েও করবে কয়দিন পর বাবাও হয়ে যাবে। তারপর বাবা ছেলে একসাথে পড়াশোনা করবে। দে দে হাবিবার নাম্বারটা আগে দে।”
ইরফান আতংকিত হয়ে বলল,
“আপু ওর যদি বিয়ে হয়ে যায়? আমি ওকে ছাড়া থাকবো কিভাবে আপু?”
“আমার ভাইয়ের সুখের জন্য দরকার পড়লে ওর স্বামীর ঘর থেকে নিয়ে আসবো।”
হাবিবার নাম্বারটা ডায়াল করতেই বুকটা দুরুদুরু করতে লাগলো। আসলেই যদি মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায় তখন কি করবো? পরপর দু’বার রিং হওয়ার পরে কেউ ফোন রিসিভ করে মিষ্টি কন্ঠে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
সালামের জবাব দিয়ে বললাম,
“আমি কি হাবিবার সাথে কথা বলছি?”
তৎক্ষনাৎ মেয়েটি জবাব দিলো,
“জ্বি আমি হাবিবা। আপনি কে বলছেন?”
“আমি ইরফানের বড়বোন ইনসিয়া বলছিলাম।”
তারপর দু’জনেই চুপ। ফোনের ওপাশ থেকে কিয়ৎকাল পরে ফুঁপানোর শব্দ পেলাম। মেয়েটা বলল,
“আপনার ভাই তো আমাকে অর্ধেক শেষ করেই দিয়েছে। বাকিটা শেষ করার জন্য কি আপনি ফোন দিয়েছেন?”
“মেয়ে তুমি কি আমার পাগল ভাইটার দায়িত্ব সারাজীবনের নিবে? আমার অসুস্থ মাকে নিজের মা বানাবে? আমার বৃদ্ধ বাবার তিনবেলা ঔষধ খাওয়ানোর দায়িত্ব নিবে? সর্বোপরি এই সংসারটা কে নিজের সংসার বানাবে? সংসারটা আগলে রাখার দায়িত্ব নিবে?”
“কিন্তু আপনার ভাই যে আমাকে ভালোবাসে না। সে নিজের মুখে বলেছে।”
“কে বলল ভালোবাসে না? পাগলাটে প্রেমিক যে তার প্রেমিকার সাথে কথা বলতে না পেরে মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। আমি তোমাদের সম্পর্কের শুরু থেকে সব জানি। আমার বাচ্চা ভাইটা তোমায় কতটা ভালোবাসে কেউ না জানলেও আমি জানি। আমার মায়ের অসুস্থতার সম্পর্কে হয়তো তুমি অবগত নও। ইরফান মেন্টাল প্রেশার থেকে তোমাকে কথাগুলো বলেছে।”
“আপু আন্টির কি হয়েছে?”
“পরে তোমাকে সব বলবো।এখন তোমার বাবার নাম্বারটা দাও।”
“জানেন আপু আমাকে যখন পাত্রপক্ষ দেখতে এলো সেদিনই ওনারা কাবিন করতে চেয়েছিলো। আমাকে আর পাত্রকে যখন কথা বলতে দেওয়া হলো, আমি শুধু ছেলেকে বলেছি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি অন্যজনের সাথে কমিটেড। ওরা আমার বাবাকে আর আমাকে অপমান করে গেছে। আমার বাবা আমার সাথে কথা বলে না।আমাকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”
” তুমি কি ইরফানের নাম বা ছবি তোমার পরিবারের কাউকে দেখিয়েছো?”
হাবিবা নাক টেনে জবাব দিলো,
“না।”
“তাহলে আর কিছু বলার দরকারও নেই। আমি ঘটকের মাধ্যমে তোমার পরিবারে প্রস্তাব দিবো। তুমি বাবার বাধ্য মেয়ের মতো রাজি হয়ে যাবে। ঠিকাছে? এখন আমার ভাইয়ের নাম্বারটা আনব্লক করে কথা বলো।”
____________________________________________
পরদিন বিকেলবেলা আরজার বাবা এলো। চা দিতেই ওনি সবাইকে বসতে বললেন। ইতস্ত করতে করতে বললেন,
“আমি একটা কথা বলতে চাই যদি অনুমতি দিতেন?”
বাবা বললেন,
“এতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে বাবা। বলে ফেলো।”
“আসলে আপনারা তো ইকরার বিয়ের কথা ভাবছেন। আমার বসের ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখছেন।বস আমাকেও মেয়ে দেখতে বলেছেন। ওনি মানুষটা একেবারে অমায়িক। ওনার ওয়াইফ আর একটা ছোট ছেলে। বাবা নেই ঘরে বৃদ্ধ মা। আর বসের ভাই বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে নিজের কোম্পানিতে কর্মচারীর মতো আছে। দু’জনেরই কিন্তু সমান শেয়ার। সে নিজের কোম্পানিতে চাকরি করে নিজের যোগ্যতা বিচার করতে চায়। নিজের অভিজ্ঞতা বাড়াতে চায়। যে ছেলের ভেতর এমন মনোভাব আছে সেই ছেলে নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। এখন আপনারা যদি অনুমতি দেন তো আমি কথা বলবো।”
এতোক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো ইকরা। কথা শেষ হতেই দৌড় লাগালো রুমের দিকে। আমি ওর পিছু পিছু গিয়ে দেখতে পেলাম,,,
#চলবে
বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
#সৎ_মা
#পর্বঃ২২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
ইকরা উল্টো দিকে ঘুরে নিরবে কেঁদে চলেছে। কান্নার প্রকোপে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীর। আমি ওর পিছু গিয়ে কাঁধ হাত রাখতেই আমার দিকে ফিরে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
“তোর কোনো পছন্দ আছে ইকরা? কাউকে ভালোবাসিস? তোর পছন্দ থাকলে বল তাহলে তোর ভাইয়াকে বলে দিবো যাতে কথা আগায়।”
“আমার কোনো পছন্দ নেই আপু।”
“তাহলে এভাবে কাদঁছিস কেন?”
” আমি মাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না আপু। মাকে ফেলে কোথাও গেলে আমি একটা দিনও শান্তি পাবো না। আমি বিয়ে করবো না আপু।”
ইকরার চোখের পানি মুছে আলতো করে মুছে দিয়ে বললাম,
“পাগল মেয়ে বলে কি। সব মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়।”
তপ্ত শ্বাস ফেলে আবারও বললাম,
“সেদিন মায়ের সব কথাই তো শুনলি। প্রত্যেক মা’ই মৃত্যুর আগে তার সন্তানের সুখের সংসার দেখতে চায়। তুই আর পাগলামি করিস না। মায়ের অবস্থাটা একবার চিন্তা কর।”
____________________________________________
মাকে স্যুপ খাওয়াচ্ছি। বাবা খবর দেখছেন। মায়ের মুখে এক চামচ স্যুপ দিয়ে বাবাকে বললাম,
“বাবা কাল সকালে এক জায়গায় পাত্রী দেখতে যাবো। তোমাকে আর তোমার জামাইকে নিয়ে।”
বাবা চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বললেন,
“জামাই ওই ব্যপারটা নিয়ে কিছু বলেছে তোকে?”
“না বাবা।বলেছে রাতে জানাবে।”
“নানু ভাই কোথায়?”
“ইকরার সাথে ছাদে গেলো একটু আগে।”
“এই রোদের মধ্যে ছাদে?”
“তোমার নাতনি জোর করে নিয়ে গেলো।”
“বলছিলাম কি, তোর শ্বাশুড়ি তো ওই বাসায় একা। এখানে চলে আসতে বল।”
খাওয়ানো শেষ করে মায়ের মুখ মুছে দিয়ে বললাম,
“বলেছিলাম বাবা। মায়ের নাকি লজ্জা করে ছেলের শ্বশুরবাড়িতে এসে থাকতে।”
“ধ্যাৎ এগুলো কোনো কথা? বেয়াইন কি আমার বাড়িতে সারাজীবনের মতো থাকবে নাকি? সমস্যা বলেই তো কয়েকদিন থাকবে।”
“বলেছিলাম বাবা।কিন্তু আমার কথা শুনলে তো।”
____________________________________________
পরদিন সকালবেলা, হাবিবার বাসার ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি, বাবা আর আরজার আব্বু। আমাদের সামনে হরেকরকমের নাস্তা। হাবিবার বাবাকে বললাম,
“আংকেল যদি হাবিবাকে নিয়ে আসতেন তো ভালো ছিলো।”
উনি নিজের চশমা ঠিক করতে করতে বললেন,
“তুমিই কি আমার সাথে ফোনে কথা বলেছিলে মা?”
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বললাম,
“জ্বি আংকেল।”
দেখাদেখির পার্ট চুকিয়ে উনাদের উদ্দেশ্যে বললাম,
“বাবা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো পাত্রী পছন্দ করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ পাত্রী আমার পছন্দ হয়েছে। এখন সামনের দিকের কথাবার্তা এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। বড়দের কথার মাঝখানে আমার আর কোনো কথা নেই।”
বাবা হাবিবার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ভাই সাহেব আমার মেয়ে যেহেতু আপনার মেয়েকে নিজের ভাইয়ের বউ বানানোর জন্য পছন্দ করেছে।এখানে আমার আর কিছু বলার নেই। আমার মেয়ের পছন্দের উপর আমার পুরো ভরসা আছে। এখন যদি আপনারা আমাদের সম্পর্কে আর আমার ছেলের সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবর নিতে চান তো নিতে পারেন।”
হাবিবার বাবা আমার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ভাই সাহেব একমাত্র মেয়ে আমার। আমাকে দু’টো দিন সময় দিন। আমি দু’দিন পরে ফোন করে আপনাকে জানাবো।”
____________________________________________
বাড়িতে আসার পরই বাবা আরজার আব্বুকে জিজ্ঞেস করলো ইকরার বিয়ের ব্যপারটা নিয়ে। আরজার আব্বু বললেন,
“আমি উনাদের ইকরার কথা বলেছি।ছবিও দেখিয়েছি। এখন উনারা ইকরাকে সামনাসামনি দেখতে চাইছে। বাবা, আমি আপনাদের না জানিয়ে উনাদের বলেছি আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে মিট করবো। আসলে মায়ের এই অবস্থায় বাড়িতে বাড়াবাড়ি করতে চাইছিলাম না।”
“না ঠিকই আছে। বাড়িতে দেখাদেখির ব্যবস্থা করলে এসব ঝামেলা। আমি বুড়ো মানুষ আমাকে আর এসবের মধ্যে টেনো না। তোমরা তোমরাই ইকরা কে নিয়ে চলে যেও।”
আমি বাবাকে বললাম,
“আমরা কেমনে কি বাবা? আমরা বড়জোর পছন্দ করতে পারবো। তুমি অভিজ্ঞ মানুষ। আমি বাহিরটা বিবেচনা করবো আর তুমি ভেতরটা বিবেচনা করবে।”
আমার কথা শুনে বাবা বললেন,
“আমি সোলাইমানকে এই কয়েকদিনে যতটুকু দেখেছি বা চিনেছি ওর মতো মানুষ হয়না।তোদের বিয়ের দিনের কয়েকটা কথা বলেই সে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে। সে নিশ্চয়ই আমার মেয়ের জন্য খারাপ কাউকে পছন্দ করবে না। তোরাই যা মা।বুড়ো মানুষটাকে আর টানাটানি করিস না। এর পরেও ইকরার কপালে দুঃখ থাকে তো বুঝে নেবো মেয়েটার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না।”
কথা বলার মাঝখানেই আরজা বাবাই বলে চিৎকার করে ওর বাবার কোলে গিয়ে উঠলো। অভিমানের স্বরে বললো,
“বাবাই আম্মু আল আমাল কাতে আসে না। খালামনিল কাতে দিয়ে কোতায় জানি দায়। তাই আমি আম্মুল সাতে লাগ কলেতি। আম্মুল সাতে আলি।”
মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে ওর বাবা বললো,
“আম্মু তো কয়েকটা দিন বেশি ব্যস্ত তাই এমন হচ্ছে মা।আরো কয়েকটা দিন যাক তাহলে আবার তোমার সাথে খেলবে।”
“তাহলে তুমি আম্মুকে বলে দাও আমি ( হাতের আঙুল গুণার ভান ধরে) একতা দুইতা তিনতা নানা তারতা তক্কেত খাবো।”
উনি অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,
“চার””””””’টা?”
আরজা ঠোঁট উল্টে বললো,
“হুম তারতা।”
ড্রয়িং রুমে হাসির রোল পড়ে গেলো।
____________________________________________
মায়ের অসুস্থতা তার উপর আবার বিয়ের কারসাজি আরজা বাবা অফিস থেকে দুই দিন পর পর ছুটি নিচ্ছে। সেজন্য সেইদিন সন্ধ্যায় আমরা ইকরাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম। আমি, ইকরা আর আরজার বাবা। ওই তরফ থেকে পাত্র, পাত্রের ভাই আর ভাবি। মোটামুটি কথাবার্তা বলার পর আরজার আব্বু বললেন,
“বলছিলাম কি স্যার, আপনাদের যদি আমার শালিকাকে পছন্দ হয় তাহলে বাকি খোঁজ খবর নিয়ে খুব দ্রুত জানালে ভালো হয়। বিয়ে-শাদির ব্যপারটা আমরা খুব দ্রুতই সামাল দিতে চাচ্ছি। আপনি তো মোটামুটি সবই জানেন।”
লোকটা আরজার বাবাকে বললেন,
“সোলাইমান সাহেব, এখানে এসেও কি স্যার বলবেন? আমরা কিন্তু এখন অফিসের বাইরে আনঅফিশিয়াল কাজে এসেছি।”
বলেই হাসতে লাগলেন। উনার স্ত্রী বললেন,
“এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যপারটা এগোতে চাচ্ছেন কোনো কি সমস্যা?”
উনার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,
“আমার মায়ের ব্রেইন টিউমার। একেবারে লাস্ট স্টেজ। যেকোনো সময় যেকোনো যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। মায়ের শেষ ইচ্ছে ছেলের বউ আর মেয়ে সংসার দেখে,,,,”
কান্নার জন্য আর বাকি কথা শেষ করতে পারলাম না। ইকরা আমার হাত খাঁমচে ধরে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। ওই মহিলা বললেন,
“স্যরিরে বোন আমি জানতাম না।”
পাত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ফাইয়াদ বিয়ে কিন্তু তুমি করবে।তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা এখানেই বলো যাও। সবই শুনলে। সবকিছু এখানেই কাটছাঁট করে যাও।পজিটিভ হলে পজিটিভ আর নেগেটিভ হলে নেগেটিভ। পরে উনারা আমাদের আশায় বসে থাকা লাগবে না। তোমার ভাইয়ার কথা জানি না তবে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।”
লোকটা বললেন,
“আমারও পছন্দ হয়েছে। এবার তোর মন্তব্য বল ফাইয়াদ।”
ছেলেটা ইকরার ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাদের কথার উপর দিয়ে আজ পর্যন্ত আমি কোনো কথা বলেছি? তোমরা যা বলবে তাই।”
আরজার বাবা বললেন,
“তাহলে আপনারা আরো খোঁজ খবর নিন।আজ তাহলে উঠি।”
____________________________________________
রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আরজাকে কোলে নিয়ে বসে আছি। আসলেই কয়েকদিন যাবৎ মেয়েটাকে একদম সময় দেওয়া হয় না। ইরফান রুমে এসে ওর মোবাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।চোখের ইশারায় বললো কথা বলার জন্য। ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে “হ্যালো” বলতেই হাবিবা বললো,
“আপু, আপু, আপু্। জানেন আপু বাবা কি বলেছে? বাবা বলেছে আমি যেন বাধ্য মেয়ের মতো এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাই।আর যেন কোনো বাড়াবাড়ি না করি।”
মুচকি হাসলাম আমি। বললাম,
“এবার খুশি তো?”
“হুম খুউউউউব খুশি। এখনই বোধ হয় বাবা আপনার বাবার সাথে কথা বলবে।”
ইরফানের হাতে মোবাইল দিয়ে আমি চললাম বাবার রুমের দিকে।আরজার বাবা ওয়াশরুমে। গিয়ে দেখি বাবা কথা বলছেন। যতদূর বুঝলাম নিশ্চয়ই হাবিবার বাবা। চুপচাপ উনাদের কথা শুনছি। বুঝলাম হাবিবার বাবাও তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজ শেষ করতে চাইছে। মা বিছানায় শুয়ে সব শুনছে। মায়ের সামনে গিয়ে পাত্র আর পাত্রীর ছবি দেখালাম। ছবি দু’টো হাতে নিয়ে মা কেঁদে দিলো।
____________________________________________
চলে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ দু’জনের বিয়ে। একজন বাড়ি থেকে বিদায় নিবে আরেকজন নতুন বউ নিয়ে প্রবেশ করবে। সব আয়োজন কমিউনিটি সেন্টারে করা হয়েছে। শ্বাশুড়ি মা আর মা একসাথে বসে আছে। আমি সবকিছু তদারকি করছি আর আমার পিছু পিছু আরজা ঘুরছে। সবাই ব্যস্ত।
বিদায়ের সময় ইকরা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ওর এক কথা ও যাবে না। হুইলচেয়ারে বসে মাও কাঁদছে। ইকরা কে কোনোমতে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ভাবির হাতে ওর হাত দিয়ে বললাম,
“ভাবি আমার বোনটা ছোট। সংসার সম্পর্কে ধারণা নেই। নিজের মতো করে গড়ে নিয়েন। ও কোনো ভুল করলে ছোট বোন মনে করে ডা শুধরে দিয়েন।”
আন্টিকে বললাম,
“আন্টি আমার বোনটাকে নিজের মেয়ের মতো আদর আর শাসন করবেন। আমার মায়ের পরে আপনিই কিন্তু ওর আরেক মা।”
ইকরা ফুলে সজ্জিত গাড়িতে উঠতে গিয়েও মা বলে চিৎকার করে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা দূর্বল হাতে ইকরা মুখ হাতের আঁজলায় নিয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ালো।
____________________________________________
ইরফান বউ নিয়ে সদরদরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বরণ করার পর হাবিবার হাত ধরে বললাম,
“এই পরিবারের মানুষ গুলো থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটা কোণায় যা যা আছে সবকিছুর দায়িত্ব তোমার। আমার বৃদ্ধ মা বাপ দুইটাকে নিজের বাবা মা মনে করো আর কিছু চাইনা।”
আরজাকে ঘুম পাড়িয়ে নিচে এসে বসতেই বাবা বললেন আমাকে নাকি মা ডাকছে। ধীর পায়ে বাবার রুমে গেলাম। রুমে যেতেই মা চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমার হাত দু’টো ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে,
“আমি তোর কাছে সারাজীবনের মতো ঋণী হয়ে গেলাম। তোর সাথে এতো কিছু করার পরও তুই আমার সকল আশা পূরণ করেছিস। আজ আমার সংসার পূর্ণ। এবার আমি সারাজীবনের চোখ বুঁজলেও শান্তি। আমার ছেলে মেয়ে দু’টোর ঠিকানা হয়েছে। আমার তিন ছেলেমেয়ের এখন ভরা সংসার।”
____________________________________________
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে অগোছালো চুলগুলো খোঁপা করছি। আমার পিছনে আরজার বাবা এসে দাঁড়ালো। আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। ভ্রু নাচিয়ে উনাকে বললাম,
“কিছু বলবেন মশাই?”
উনি আমার মাথাটা খানিক এলিয়ে নিজে নিচু হয়ে আমার কপালে উনার ঠোঁটের উষ্ণ পরশ দিলেন। আমার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন,
“তুমি অনন্যময়ী ইনসিয়া।তোমার তুলনা হয় না। তোমাকে দেখলে অবাকের পরে অবাক হই। আগের সবকিছু ভুলে কি সুন্দর সব সামলে নিলে। শয্যাশায়ী মায়ের ইচ্ছেও পূরণ করলে।বিশ্বাস করো আমি ছেলে হয়েও এতো কিছু পারতাম না।”
“আসলে কি বলুন তো, মেয়েরা তরল পদার্থের ন্যায়। এদের যেই পাত্রে রাখা হয় ঠিক সেই পাত্রেরই আকার ধারণ। মেয়েদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়।সহ্য করতে হয়।তবেই না সে মেয়ে।”
____________________________________________
ও বাড়ি থেকে চলে এসেছি আজ বেশ কিছুদিন হলো। আবার সেই আগের রুটিন। নিজের সংসার সামলানো আরজার সাথে খুনসুটি। আরজার বাবার জন্য অপেক্ষা করা।এভাবেই দিন কে’টে যাচ্ছে। আমার আরজাটাও একটু একটু করে বড় হচ্ছে।
ঘুমিয়ে আছি। খুব ভোরে মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। আরজার বাবাও পিটপিট করে তাকিয়ে রইলেন। আমি ঘুম ঘুম কন্ঠে “হ্যালো” বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে যা শুনলাম আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। আমার কাঁপা-কাঁপি দেখে তড়িঘড়ি আরজার বাবা উঠে বসলো। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে ইনসিয়া এমন করছো কেন?”
আমি কিছু বলার আগেই মোবাইল হাত থেকে ফেলে ঢলে পড়লাম আরজার বাবার বুকে।
#চলবে
বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।