সৎ মা পর্ব-১৯+২০

0
264

#সৎ_মা
#পর্বঃ১৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

পাঁচবার কল দেওয়ার পর ছয়বারের সময় গিয়ে উনি ফোন রিসিভ করলেন। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। উনি আমায় তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি হয়েছে ইনসিয়া? কাঁদছো কেন? তোমরা সবাই ঠিক আছো তো?”

উনার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে ফুঁপিয়েই চলেছি আমি। গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের করতে পারছি না। উনি অসহায় কন্ঠে বললেন,

“এই মাঝরাতে ফোন করে কোনো কথা না বলে ফুঁপিয়ে চলেছো। টেনশন হচ্ছে তো। এমনিতেই দূরে আছি তোমাদের ছাড়া। কিছু তো একটা বলো।”

কান্না থামিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

“এতোক্ষণ ফোন কেন বন্ধ ছিলো আরজার আব্বু? জানেন কত টেনশন হচ্ছিল।”

“এইখানে বৃষ্টি হচ্ছে ইনসিয়া, তাই নেটওয়ার্কের বেহাল দশা।”

“আপনি ঠিক আছেন তো? আরজার আব্বু, আমি না খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি। যেন কিছু একটা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আজ কয়দিন যাবৎ মানসিক ভাবে শান্তিও পাচ্ছি না। আমার চারপাশটা কেমন বি ষা ক্ত মনে হয়। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমার এমন কেন লাগে আরজার আব্বু? সত্যি করে বলবেন আপনার কিছু হয়নি তো?”

আমার কথায় উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

” আমার কিছু হয়নি ইনসিয়া। তবে আমার একটা অনুরোধ তোমার কাছে, ও বাড়িতে একটা ফোন দিও। অনেক তো হলো। এবার সম্পর্কটা আগের মতো করে নাও। মনে করো উনি ভুল করে ফেলেছেন। তবে উনারা কেউ ভালো নেই ইনসিয়া। তুমি বলেছিলে, যেগুলো থেকে তুমি দূরে থাকতে চাও সেগুলো বার বার তোমার চোখের সামনে আসে। সেজন্য তোমাকে কিছু বলা হয়নি।”

“আরজার আব্বু, ও বাড়ির সময় ভালো আছে তো? আজকাল ইরফানটাও হা হু করে কল কেটে দেয়। আপনি মিথ্যে বলবেন না ও বাড়ির কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে তাই না?”

“মানুষ কি আর সবসময় একরকম থাকে? তার শারীরিক মানসিক সব রকমের পরিবর্তন আসে। তুমি বেশি টেনশন নিও না। সকালে তোমার বাবার নাম্বারে একটা কল দিও। আর আমি কক্সবাজার থেকে এসে তোমাকে ও বাড়িতে নিয়ে যাবো। এখন ঘুমাও মাথায় কোনো চাপ না দিয়ে।”

মোবাইল কান থেকে নামিয়ে মূর্তির ন্যায় বসে আছি। অশান্তির মাত্রাটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। ও বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? আমার বাবা, আমার বাবা সুস্থ আছে তো? আমি যে ওদের সাথে দেখা করি না, কথা বলি না কাজ টা ঠিক করলাম না ভুল করলাম?

____________________________________________

সকালে অন্যমনস্ক হয়ে কেটলি থেকে চায়ের কাপে চা ঢালতে গিয়ে আঙুলে চা ফেলে দিলাম। ওমাগো চিৎকার দিতেই মা দৌড়ে আসলেন। তারপর ফ্রীজ থেকে বরফ বের করে ব্যস্তভঙ্গিতে আমার হাতে বরফের টুকরো ঘঁষতে লাগলেন।

“এভাবে অমনোযোগী হয়ে কাজ করলে হয়। দেখলি তো হাতে কেমন গরম চা পড়লো।”

মায়ের কথা শুনে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে দিলাম। মা বরফের টুকরোটা ফেলে তৎক্ষনাৎ আমাকে উনার সাথে মিশিয়ে নিলেন। তটস্থ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“কি হয়েছে ইনসিয়া? হাতে কি বেশি জ্বালা করছে?”

হেঁচকি দিতে দিতে বললাম,

“মা আমার বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। ওবাড়ির সবার কথা। আমার মন বলছে কেউ ভালো নেই মা কেউ ভালো নেই। আমি এতোটা পাষাণ কি করে হলাম মা? ওরা যেমন অন্যায় করেছে আমিও তো তাহলে ওদের মতোই হয়ে গেলাম।”

মা সযত্নে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

“এখন কি আর আগের যুগ আছে? তুই ফোন কর ও বাড়িতে। তুই তোর বাবার সাথে কথা বলে নিজের অশান্ত মনটাকে শান্ত কর।”

আতংকিত হয়ে বললাম,

“আমার ভীষণ ভয় করছে মা ফোন দিতে। যদি খারাপ কিছু শুনি?”

____________________________________________

মেয়েরা সর্বপ্রথম বোধহয় বাবার মোবাইল নাম্বারটাই মুখস্থ করে। আমিও তেমন। নাম্বার মুখস্থ করার যাত্রা হয় বাবার নাম্বারটা দিয়ে। কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলের কী-বোর্ডে বাবার নাম্বারটা টাইপ করলাম। নাম্বারে ডায়াল করতেই বুকটা ধকধক করতে লাগলো। অসার হয়ে আসতে লাগলো হাত পা। কতদিন পরে বাবার গলা শুনবো।
____________________________________________

বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে আছেন ইকবাল সাহেব। দৃষ্টি সামনের বকুল গাছটায় নিবদ্ধ। ইরফানের কাঁধে সকল দায়িত্ব দেওয়ার পরে, আজকাল উনার সময় কাটে বারান্দার এই রকিং চেয়ারটায় বসে। আর একমনে বকুল গাছটার দিকে তাকিয়ে। এই গাছটা ইনসিয়া খুব শখ করে রোপণ করেছিলো। বকুল ফুল তার ভীষণ পছন্দ বলে। বসার ঘর থেকে আনা পত্রিকাটি অবহেলায় একপাশে পড়ে আছে। কাপের চা টাও বোধহয় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।

আকস্মিক রিংটোনের শব্দে ওনার মনযোগ ক্ষুন্ন হয়। বাম হাত দিয়ে বহু কষ্টে মোবাইলটা কাছে নিয়ে আসে। মোবাইল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা নামটা দেখে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ প্রায় দুই থেকে আড়াই বছর পরে এই নাম্বার থেকে কল এলো উনার মোবাইলে।” বড় মামনী” নামটা দেখে চোখের কোণে যেমন পানি চিক চিক করছে তেমনি ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসি বিদ্যমান। উনার বিশ্বাস ছিলো এই নাম্বার থেকে একদিন না একদিন কল আসবে। এতোকিছু ভাবনার মাঝেই রিংটোন বন্ধ হয়ে গেলো। কম্পিত হাতে নাম্বার ডায়াল করতেই পুনরায় নাম্বারটা থেকে আবার কল এলো। কল রিসিভ করার পরে কারো মুখে কোনো কথা নেই। ফুঁপানোর শব্দ পেয়ে ইকবাল সাহেবের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মেয়েটা সুস্থ আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো? হাজারো চিন্তা আর জড়তাকে দূরে ঠেলে ইকবাল সাহেব বললেন,

“তোর এই পাপী বাবার সাথে কথা বলবি না? “বাবা” বলে ডাকবি না?”

____________________________________________

বাবার এমন কথায় কান্নার মাত্রাটা আমার বেড়ে গেলো। বাবা কন্ঠস্বর আজ কত বছর পর শুনছি। পর পর কয়েকটা শ্বাস ফেলে স্থির করার চেষ্টা করলাম।

“কেমন আছো বাবা তোমরা? তোমার অবুঝ মেয়ে না হয় রাগ করে, অভিমান করে কতকিছু বলেছে। তাই বলে তুমি তোমার অবুঝ মেয়েটার রাগ ভাঙাবে না? নাকি ভুলে গেছো তোমার আরো একটা মেয়ে যে আছে।”

হেসে উঠলেন বাবা।

“এখনো সেই আগের মতো অভিমান আছে? যে মেয়ে সর্বপ্রথম বাবা বলে ডেকে এই অতৃপ্ত মনটাকে তৃপ্ত করেছে বাবা কি করে সেই মেয়েকে ভুলে যাবে? আমি জানতাম আমার অবুঝ মেয়েটা ঠিকই এই অপরাধী বাবা কে ক্ষমা করে দিবে। আবার বাবা বলে ডাকবে। তাই এতো দিন ধৈর্য্য ধরে ছিলাম। সবুরে যে মেওয়া ফলে। আমরা কেউ ভালো নেই মা। তুই চলে যাওয়ার পরে আমাদের প্রানবন্ত বাড়িটা প্রাণহীন হয়ে গিয়েছে। শেষ কবে সবাই হেসেছিলাম মনে নেই। একবার এই বাড়িটাতে এসে প্রাণ ফিরিয়ে দিবি মা? অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আয় না একবার এই বাড়িতে। তোর বকুল গাছটা কত বড় হয়ে গিয়েছে। তোর অপরাধী বাবা যে রোজ এই গাছটার দিকে তাকিয়ে তার বড় মেয়ে দেখার তৃপ্তি মিটায়।”

শেষোক্ত কথাগুলো বলার সময় বাবার কন্ঠ কাঁপছিলো। আমি জানি আমার বাবা কাঁদ ছিলো। আজ কেন জানি না নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।

____________________________________________

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। আমার কান্না দেখে আরজা মন খারাপ করে দাঁড়ানো অবস্থায় আমার কোলে মাথা এলিয়ে দিলো। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার ঠোঁট দুইটা উল্টে কান্না করে দিবে দিবে ভাব। মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

” তোর কান্না দেখে কিন্তু আরজা এখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবে। নিজেকে শান্ত কর আর কান্না থামা। যা হওয়ার তো হয়েই গিয়েছে। এখন কান্না করলে কি ফিরে আসবে?”

“আপনার ছেলে কখন আসবে মা? আর আমি কখন ও বাড়িতে যাবো?”

“ও বাড়িতে গেলে কি সোলাইমানের কাজ লাগবে? আমরা যেতে পারি না?”

“আপনার ছেলে যে উনাকে ছাড়া যেতে নিষেধ করলো।”

“কেন?”

“জানি না মা।”

মায়ের কাঁধ থেকে মাথা তুলে আরজার বাবার নাম্বারে ফোন দিলাম। দু’বার রিং হওয়ার পরে উনি কল রিসিভ করলেন। ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন,

“কি হয়েছে আরজার আম্মু?”

“আপনি ঢাকা থেকে কখন ব্যাক করবেন?”

” বিকেলের দিকে একটা মিটিং আছে। মিটিং শেষ হলে তারপর হোটেল থেকে চেক আউট করে রাতের দিকে রওনা দিবো। ভোর নাগাদ ঢাকাতে পৌঁছাতে পারবো আশা করি।”

“বাবার কাছে কল দিয়ে ছিলাম।”

উনি চটপট করে জিজ্ঞেস করলেন,

“আসলেই দিয়েছো তো?”

ধীর কণ্ঠে বললাম,

“হুম।”

“কি বললেন বাবা?”

নিরবে চোখের পানি ফেলে বললাম,

“আমি ও বাড়িতে যাবো আরজার আব্বু। আপনি তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসেন।”

মন খারাপের মাঝেই সারাদিন পার হলো। আজ আরজাও মন খারাপ দেখে কম জ্বালিয়েছে। রাতে ঘুমানোর আগে আরজার বাবাকে মেসেজ করলাম,

“ভোরে বাসায় আসলে কলিং বেল চাপবেন না। সন্ধ্যার দিকে মায়ের কোমড়ের ব্যথাটা শুরু হয়েছে। ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। ঘুম ভাঙলে আর ঘুমোবে না। দরজার কাছে এসে মিসডকল দিয়েন তাহলেই হবে। আর মায়ের জন্য টেনশন করতে হবে না।”

____________________________________________

মোবাইলের রিংটোনে আমার ঘুম হালকা হয়ে এলো। বিছানা ছেড়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলে দিতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। উনার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললাম,

“আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”

“না কোনো অসুবিধা হয়নি।”

“আপনি রুমে যান আমি শরবত নিয়ে আসছি। কিন্তু খবরদার মেয়েকে খোঁচা দিয়ে জাগাবেন না। ও জেগে গেলে আর আপনি ঘুমোতে পারবেন না।”

ভেতরে এসে আরজার বাবা দরজা আটকে দিলো। দু’হাতে জড়িয়ে নিলেন আমাকে। মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,

“এখন শরবত লাগবে না। আগে এই মানবীকে ছোঁয়ার তৃষ্ণা মিটিয়ে নেই তাহলেই হবে। তারপর ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো।”

____________________________________________

বিকেলবেলা সবাই রওনা দিলাম ও বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠার পর রাস্তা যত পাড় হচ্ছি ক্রমশ আমার বুক ধকধক করছে। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই আমি চমকে গেলাম।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ২০
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

বাড়ির সামনে এম্বুল্যান্স দাঁড়ানো। সামনে কদম দেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেললাম আমি। নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পড়ে যেতে নিলেই আরজার বাবা এসে আমাকে ধরলো। মা আমার কোল থেকে আরজাকে নিলো। আরজার বাবা আমার বাহুতে শক্ত করে ধরে বললো,

“একটুতে এভাবে ভেঙে পড়লে চলে? তুমি এমন করলে তোমার ভাই বোনকে কে সামলাবে? তোমার বাবা মায়ের পরে যে তুমি তাদের ঢালস্বরূপ।”

উনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে গেলাম সেখানে। মা স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। বাবার দিকে তাকাতে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার কি বাবা কি হয়ে গিয়েছে। হাড্ডিসার শরীর চোখের কোণে পানি চিক চিক করছে। চোখ দুইটা গর্তে চলে গেছে। সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকা বাবা আমার যে অগোছালো হয়ে গেলো। বাবা আমার দিকে এগিয়ে আসতেই কেউ দৌড়ে এসে আমাকে ঝাপটে ধরলো। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই আরজার বাবা পিছন থেকে ধরে রাখে। বুঝতে পারলাম আর কেউ না আমাকে ইকরা জড়িয়ে ধরেছে।

“আপুরে আমার মা আজ একটা বছর যাবৎ কষ্ট ভোগ করছে। এতো কষ্টও ওনার কপালে ছিলো? আমি মেয়ে হয়ে নিজের মাকে তীলে তীলে শেষ হতে দেখছি। মানুষটা ঠিক মতো কথা বলে না। ঠিক মতো খায় না। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে কেমন যেন করে। মনে হতো এই বুঝি আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রতিটা সময় মা মৃত্যুসম যন্ত্রণা ভোগ করে । মায়ের যন্ত্রণাগুলো দেখলে মনে হয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে কোথাও পালিয়ে যাই।”

আমার থেকে ছাড়িয়ে নিলাম ইকরাকে। ইকরার চেহেরার দিকে তাকাতেই আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম। মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। চেহেরারা লাবণ্যতা আর আগের মতো মতো নেই।চেহেরায় অসংখ্য ব্রণ আর চোখের নিচের কালো দাগ নিদ্রাহীনতার সাক্ষী। যে মেয়ে মুখে একটা ব্রণ হলে সারা বাড়ি মাথায় তুলতো তার পুরো শরীর আজ যত্নহীন।ইকরার ক্রন্দনরত মুখশ্রী ক্ষনে ক্ষনে আমার বুকে ঝড় তুলছে। ইকরাকে কি সান্ত্বনা দিবো আমি নিজেই তো আজ অশান্ত হয়ে গিয়েছি।

এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন কর্ণপাত হতেই আমি চট করে এ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়লাম। সাথে কে আসলো না আসলো সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি শুধু শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখছি। অক্সিজেন মাস্ক দেওয়ার পরও মানুষটা কেমন ছটফট করছে। আমার দিকে দৃষ্টি পড়তেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়াতে লাগলো।

হাসপাতালে পৌঁছাতে মাকে আইসিইউতে শিফট করা হলো। অনুভূতিশূণ্য হয়ে করিডোরে বসে আছি। না মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে পারছি আর না একটু কাঁদতে পারছি। খেয়াল করলাম একে একে সবাই হাসপাতালের করিডোরে এসে উপস্থিত হচ্ছে। বাবা উনার জীর্ণশীর্ণ দেহটা নিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন। আমার মাথাটা এলিয়ে দিলাম উনার কাঁধে। একটু মানসিক শান্তি দরকার। ইকরাকে মা সান্ত্বনা দিচ্ছে। মেয়েটা এক নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। আরজার বাবা আরজাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট পাঁচেক বাদে আমার সামনে ইরফান এসে দাঁড়ালো। নিজের দূর্বল শরীটা নিয়ে দাঁড়ালাম ওর সামনে। শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলাম ওর গালে। আমার আকস্মিক কান্ডে উপস্থিত সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। এলোপাতাড়ি মা র তে মা র তে বললাম,

“আমি যে তোর সৎ বোন তা প্রমাণ করে দিলি তো? নাকি আমাকে পাষাণ মনে করিস যে আমার কোনো দয়া মায়া নেই। মানুষটা যেমনই হউক সে আজ এতোটা দিন ধরে সে মৃত্যুর সমান যন্ত্রণা ভোগ করছে সেই খবর টা জানার অধিকার আমার নেই তাই না। প্রমাণ হয়ে গেলো তোরা কেউ আমাকে আপন মনে করিস না। সবাই পর ভাবিস। আমাকে সৎ বোনই ভাবিস।”

আমার পা গ লা মি দেখে আরজার বাবা আরজাকে কোল থেকে নামিয়ে একটানে উনার বুকের সাথে আমাকে মিশিয়ে নিলেন। উনার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“ওরা আমাকে কি মনে করে আরজার আব্বু? আমার মন নেই নাকি আমি পাষাণ? এই আড়াই বছরে ওরা কেউ কোনোদিন গিয়েছিল আমার অভিমান ভাঙতে নাকি একদিন খোঁজ খবর নিয়েছে। ওরা কিভাবে পারলো আমাকে কিছু না জানাতে?”

চোখের পানি মুছে বাবার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলাম। খানিক বাদে ইকরা আমার পাশে বসে আমার হাত জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। এর কিছু সময় পরই মেঝেতে বসে আমার কোলে মাথা রেখে নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। একজন নার্স এসে বললেন,

“আপনারা প্লিজ এখানে সিনক্রিয়েট করবেন না। রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে।”

____________________________________________

ইরফানের যে গালে চ ড় দিয়েছি সে গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। তিন আঙ্গুলের ছাফ স্পষ্ট। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,

“কি থেকে কি হলো মায়ের একটু বলবি?”

আমি ইরফানকে কোনোদিন কান্না করতে দেখিনি। মায়ের অসুস্থতায় ছেলেটা কেমন ভেঙে পড়েছে। ইরফান ভাঙা ভাঙা গলায় উত্তর দিলো,

“বছর খানেক আগে থেকে মায়ের শ্বাসকষ্টের মাত্রাটা চরম পর্যায়ে আছে। মাঝে মাঝে ইনহেলার দিয়ে কাজ হতো না। চোখ মুখ উল্টে কেমন জানি করতো। মাঝে মাঝে আবোল তাবোল কথা বলতো আবার এমনি ঠিক হয়ে যেতো। গত পনেরো থেকে বিশ দিন আগে মাথার চুল গুলো টানতে থাকে। জিজ্ঞেস করায় বলে, মাথা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে।সহ্য ক্ষমতার বাইরে সেই যন্ত্রণা। পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে জানতে পারলাম মায়ের ব্রেইন টিউমার। যা একেবারে লাস্ট স্টেজে আছে। অপারেশন করলে বাঁচার চান্স এক পার্সেন্টও না।”

“আমাকে এসব বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?”

“তোকে কি বলবো আপু আমি নিজেই তো খবরটা হজম করতে পারছি। মায়ের ভেতরে এতোবড় রোগ বাসা বেঁধেছে আমরা বুঝতেও পারলাম না।
আমার মা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সন্তান হয়ে এসব দেখেও কিছু করতে পারছি না। এর থেকে ব্যর্থতা আর কি হতে পারে।”

____________________________________________

রাত বাড়ার সাথে সাথে সবাই বলতে লাগলো মাকে, আরজাকে আর ইকরাকে নিয়ে বাসায় যেতে। ওদের কিছু খাইয়ে দিতে। আমি নাছোড়বান্দা বসে রইলাম। আমি এখান থেকে যাবো না। আরজার আব্বু আমার পাশে বসে বললেন,

“তুমি বড় হয়ে যদি এমন পা গ লা মি করো তাহলে হবে? তুমি যদি ভেঙে পড়ো তো ওদের কে সামলাবে? ইকরার মুখের দিকে তাকাও মেয়েটা নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত করেনি। আর আরজাও এখানে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। এখানে তো আমরা আছি।”

অগত্যা ওদেরকে নিয়ে বাসায় এলাম। ইকরাকে জোর করে গোসল করিয়ে দিলাম। খাবারের প্লেট নিয়ে বসতেই ও বলল,

“আপু জোর করিস না প্লিজ। আমার খাবার খাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই।”

আরজা গুটি গুটি পায়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইকরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” বাবাই বলেতে তুমি নাকি আমাল খালামনি। খালামনি তুমি এতো বল মেয়ে হয়ে খাত্তো না কেন? আম্মু বলেতে যালা খাবাল খায় না নত্ত করে তাদেল কে আল্লাহ বালোবাতে না। তুমি না খেলে আলদা মনি তোমাকে পিতি দিবে।”

ইকরা অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিক করে হেঁসে দিলো। ইকরাকে খাইয়ে বিছানা গোছানোর সময় বললো,

” আপু আমি তোর সাথে ঘুমাবো। তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। আমার ভয় করছে একা একা।”

মা পাশের রুমে। আরজা হেলতে দুলতে এই রুমে এসে আমাদের দুইজনকে শুয়ে থাকতে দেখে বলে,

” খালামনি তুমিও আমাল আল বাবাই এল আম্মুকে জলিয়ে দলে গুমাবে?”

লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে রাখলাম। মেয়ে আমার মানসম্মান রাখবে না। মুচকি হেঁসে ইকরা মাথা নেড়ে হ্যা বলল। আরজা ঠোঁট উল্টে বলল,

“তাহল আমি কোতায় গুমাবো?”

ইকরা আরজার গাল টেনে বলল,

” পাকাবুড়ি তুই ওইপাশে ঘুমাবি আর আমি এইপাশে ঘুমাবো। ঠিক আছে?”

আরজা চোখ পিটপিট করে বলে,

“আত্তা তিকাতে।”

“মাঝরাতে আরজার শরীরে কাঁথা নেই দেখে একটু নড়েচড়ে ওর কাঁথাটা দিতে ইকরা ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

“আপু নড়িস না প্লিজ একটু ঘুমোতে দে। তোর গাঁ থেকে না কেমন একটা মা মা গন্ধ আসছে।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই থমকে গেলাম আমি।

____________________________________________

মায়ের অসুস্থতার দু’দিন পার হয়ে গেলো। অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। নাস্তা বানাচ্ছি হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হবে। মোবাইলের রিংটোনের শব্দে দৌড়ে রুমে গেলাম। ইরফান ফোন করেছে। রিসিভ করতেই ইরফান বলল,,,

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।