#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ০৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
বাকশূন্য হয়ে মনোয়ারা বেগম দাঁড়িয়ে রইলেন। একদিকে খুশি হচ্ছেন উনার ছেলে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছেন। কিন্তু টেনশন হচ্ছে ওই মেয়েকে বিয়ে করলে ছেলে যদি অশান্তিতে থাকে?
তাহমিদ হয়তো মায়ের অভিব্যক্তি বুঝতে পারলো। মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উনাকে আবারও বসালেন। অতঃপর মায়ের কোলে মাথা রাখলো।
‘ মাথায় হাত বুলিয়ে দাও মা।’
মনোয়ারা বেগম সস্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
‘পাঁচ বছর আগে আমাদের কেউ মিথ্যে বলছিল মা। পাঁচ বছর আগে তেমনটা না হলে আজকের চিত্র অন্যরকম হতো। তখন যদি আমাকে এসব বলতে হয়তো জীবনের মানেটাই বদলে যেতো। বদলে যেতো আরো অনেক কিছু।’
সবকিছু জানার পর মনোয়ারা বেগমের বললেন,
‘মেয়েটা মিথ্যেও তো বলতে পারে।’
‘উহ্ মা, মিথ্যে বলছে না। মুখ মিথ্যে বললেও মানুষের চোখ কখনো মিথ্যে বলে না। মেয়েটা প্রত্যেকটা কথা আমার চোখে চোখ রেখে বলেছে। আর সে যেসব কথা বলেছে নিজের সম্ভ্রম নিয়ে কেউ সেসব কথা কেউ মিথ্যে বলে না। সব সহ্য হয় চরিত্রে কালিমা লেপন যে সহ্য হয় না।’
‘জানতে পেরেছে কে করছে এসব?’
‘না। তবে ধারণা করা যায় যে, গ্রামে একদল থাকে না যাদের মানুষের ভালো দেখতে পারে না ওসব মানুষের কাজ। তবে এর থেকে খারাপ কিছুও হতে পারে। যেমনঃ পারিবারিক শ’ত্রুতা।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনোয়ারা বেগম বললেন,
‘মানুষ যে এসব করে কি পায়?’
নিশ্চুপ রইলো তাহমিদ। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে মায়ের আদর মাখা স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো। মনোয়ারা বেগমও বহু বছর আগের মতো ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তাহমিদ মাথা সামান্য উঁচিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
‘আমি মেয়েটাকে বিয়ে করলে তুমি মেনে নিবে তো?’
মনোয়ারা বেগম ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর প্রত্যেকে নিজের ভালো মন্দ বুঝে। তোর যদি মনে হয় ওই মেয়ে কে বিয়ে করলে ভালো হবে তাহলে কর। আমি শুধু চাই আমার সংসারটা পরিপূর্ণ হউক। কেউ এসে আমার সংসারের হাল ধরুক। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে কেউ এসে ‘দাদু’ বলে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়ুক।এলোমেলো করে দিক আমার ঘরের জিনিসপত্র। আর আমি ঠিক করতে করতে হাঁপিয়ে যাই।’
তাহমিদ লাজুক হেসে বলে,
‘তুমি তো দেখছি আমার থেকেও দু’কদম এগিয়ে।’
প্রতিত্তোরে তিনিও মুচকি হাসলেন। তাহমিদ মনে মনে বলল, ‘তাহলে মিশন শুরু।’
_____________________
সেদিনের পর দূরত্ব বেড়েছে তূবা আর ফয়সালের মাঝে। তূবার সাথে খুব কম কথা বলার চেষ্টা করে ফয়সাল। তূবা খেয়াল করেছে তাকে দেখলে ফয়সালের চোখ-মুখে কাঠিন্যে দেখা দেয়। সব সময় কেমন রেগে কথা বলে। সে প্রথমে ভেবেছে হয়তো অফিসে কাজের চাপ। পরে ভাবলো ফয়সাল তো কখনো এমন করে না।
গলায় টাই ঠিক করছে ফয়সাল। ফারিয়া বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমোচ্ছে। টেবিলে নাস্তা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে তূবা রুমে প্রবেশ করে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ফয়সালের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। পা দু’টো সামান্য উঁচু করে সে ফয়সালের কাঁধে দু’হাত রাখে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হতবিহ্বল হয়ে যায় ফয়সাল। তূবা নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় ফয়সালের চোখের দিকে। পলকহীন চোখ দু’টো যেন অনেক কিছু বলতে চায়। তূবার মতিগতি কিছুই ভালো ঠেকছে না ফয়সালের কাছে। এইরকম উদ্ভট আচরন তো কখনো করে না। আজ হঠাৎ কি হলো? তূবা ফয়সালের নাক টেনে গলায় টাই বেঁধে দিতে লাগল। কিছুই অনুভবনীয় হচ্ছে না। শুকনো ঢুক গিলে সে।
‘ফারিয়া, মা’ই’র দিবো এখন। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠো।’
অকস্মাৎ তূবার উচ্চবাচ্যে সম্বিত ফিরে পায় ফয়সাল। তাহলে এতোক্ষণ সবকিছু তার অবচেতন মনের কল্পনা ছিলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে সে। মনে ভাবলো এমনটা ঘটলে মন্দ হতো না। ফয়সাল ভেবে পায় না তাদের মাঝে এতো দূরত্ব কেন? এতো বছর যাবৎ সংসার করছে। একটা সন্তান আছে তাদের। তারপরও তারা মনের দিক থেকে একজন আরেক
জনের থেকে যোজন যোজন দূরে। এই দূরত্ব কি তার তরফ থেকে নাকি তূবার তরফ থেকে? সে কি তূবা এবং তার মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছে নাকি তূবা? মনের মাঝে জমা থাকা প্রশ্ন গুলো তূবাকে করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভয় হয়। যদি তূবার সত্যি কারো সাথে সম্পর্ক থেকে থাকে? যদি সে স্বীকার করে অন্য কাউকে ভালোবাসে, তখন? মানতে পারবে না ফয়সাল এসব। সে তার সন্তানের মাকে ভালোবাসে। ভীষণ রকম ভালোবাসে। তার চেয়ে বরং এভাবেই থাক সবকিছু। নিজের মনের সন্দেহ মনেই চাপা পড়ে থাক। স্ত্রীর উপর রাগও করবে মনে মনে। ভালোও বাসবে মনে মনে। প্রকাশ করবে না কখনো। এটা তার চাপা অভিমান। ফয়সাল খেয়াল করলো তার রাগ কমতে শুরু করেছে। সে দুই দিনের বেশি রেগে থাকতে পারে না। রাগ কমে এখন তার প্রেম প্রেম পাচ্ছে। তূবার ললাটের ঘাম মুছে সেখানে টুপ করে একটা চুমু দিতে ইচ্ছে করছে।
আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে রুমের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল তূবা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। রেডি হয়ে এক এক করে সব ফাইল ব্যাগে ঢুকিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো। তূবা গ্লাসে শরবত ঢালছে। তার আঁচলের কোণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফারিয়া। সে চেয়ার টেনে বসলো। ড্রয়িং রুমে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
‘মা কোথায়?’
‘ছাদে গেলো। ডাক্তার বলেছে রোজ সকালে এক ঘন্টা করে গায়ে রোদ লাগাতে। এখনই চলে আসবে।’
‘তুমি আর ফারিয়া খাবে না?’
‘মা এলে একসাথে খাবো।’
ফয়সাল ‘ওহ’ বলে খাওয়া শুরু করলো। তূবা আনতা আমতা করে বলল,
‘তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’
ফয়সালের ভাবলেশহীন জবাব,
‘রেগে থাকার মতো কিছু করেছো? যদি করে থাকো তাহলে রেগে আছি।’
তূবা অনিমেষ তাকিয়ে রইলো ফয়সালের দিকে। ফয়সালের এইদিকে কোনো ভাবান্তর নেই। নিজের মতো করে খেয়েই চলেছে।
‘আমি না তোমাকে বুঝে উঠতে পারি না। তুমি কখন রেগে থাকো? কখন তোমার মন ভালো থাকে? এতোগুলো দিন একসাথে থাকার পরও তোমার মন পড়তে আমি ব্যর্থ। মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আমাকে ভালোবাসো। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি এবং আমার মেয়ে শুধু তোমার দায়িত্ব। কোথাও এক বিন্দু ভালোবাসা নেই। সন্তানের বাবা মা হওয়ার পরও আমাদের মাঝে সমুদ্র পরিমাণ দূরত্ব। তুমি সমুদ্রের এপাড়ে আর আমি ওপাড়ে। অন্যান্য দম্পতিদের দেখলে আমার বড্ড হিং’সা হয়। তুমি সকালে অফিসে যাও। রাতে ফিরো, খেয়েদেয়ে ঘুমাও। সকালে আবার অফিস। এতো কিছুর মাঝে আমার জন্য সময় কোথায়? স্ত্রী হিসেবে আমারও তো চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে? সঙ্গীর থেকে সময় না পেয়ে যখন নারীরা বিচ্ছেদের পথে যায় তখন দোষ নারীদের হয়। আমার তরফ থেকে ত্রুটি থাকলে বলবে তো নাকি? সময় থাকতে সময়ের মূল্য দাও। সময় গেলে সাধন হবে না।’
এবার থামল তূবা। অনেকদিন ধরে এই কথাগুলো বলবে বলবে করে বলা হয়নি। আজ এগুলো বলে বড় শান্তি লাগছে। ফয়সালের দিকে তাকালো সে। ফয়সাল নির্বিকার হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।।হাতের ব্রেডটা প্লেট রেখে স্থিরদৃষ্টিতে তূবার দিকে চেয়ে ফয়সাল বলে উঠলো,
‘আমি ব্যতীত তোমাকে অন্য পুরুষ স্পর্শ করলে কেমন ফিল হবে? আমি ছোঁয়ায় তোমার যেমন অনুভব হবে, অন্য কারো ক্ষেত্রে কি তেমনটা হবে?’
ফয়সালের ফিরতি প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে পারলো না সে। কিসের মধ্যে কিসব বলছে। চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
গাড়িতে বসে তূবার কথাগুলো ভাবছে ফয়সাল। কোথাও যেন হিসেবে গড়মিল হচ্ছে।
_________________________
‘আচ্ছা মা, কারো উপর অন্যায় হচ্ছে জেনেও চুপ করে থাকা এটা খুব অন্যায় তাই না?’ মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল যুবক।
মাঝ বয়সী মহিলার উত্তর,
‘অন্যায় যে করে আর যে সহে সবাই সমান অপরাধী।’
মায়ের কোলে মাথা রেখে পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,
‘আর যদি আপনজনের প্রাণ সংশয়ের দেখিয়ে সেই অন্যায় করতে বাধ্য করা হয়?’
মহিলাটি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
‘যাইহোক, অন্যায় অন্যায়ই হয়।’
‘কিন্তু মা কেউ একজন ভিতু। ভীষণ ভিতু। সে আপনজনের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া সহ্য করতে পারবে না। সে সব সময় দোয়া করে একজন সাহসী আর বিশ্বাসী মানুষের আগমন যেন ঘটে। যে সকল অন্যায়ের ইতি টানবে?’
এবার সেই মহিলার উৎকন্ঠা গলা শুনা গেল।
‘কি হয়েছে বাবা? এভাবে কথা বলছিস কেন?’
যুবকের নিস্তেজ গলা,
‘কিছু হয়নি মা। তবে তোমার ছেলে মানসিক ভাবে ক্লান্ত। দোয়া কর যেন কোনে মিরাকল ঘটে।’
‘কোনো কিছু বুকের মাঝে চেপে রাখিস না বাবা। চেপে রাখা কথা গুলো ভয়ঙ্কর রকমের ভারী হয়। অব্যক্ত কথার ভার সবাই বইতে পারে না। তুই ছাড়া আমার কেউ নাই। তোর বাবা তো থেকেও নেই।’
‘উহ্, কিছু হবে না মা। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। আমি একটু ঘুমাবো শান্তির ঘুম।’
______________________
ফাইলে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে নাযীফাহ। পিয়ন এসে বলল তার নামে একটা পার্সেল এসেছে। কপালে ভাঁজ পড়ে তার। সে তো কিছু অর্ডার করেনি তাহলে? নাযীফাহকে চিন্তামগ্ন দেখে পিয়ন বলল,
‘ম্যাডাম, ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে আছে। আপনি গিয়ে পার্সেলটা রিসিভ করুন।’
সেখানে যেতেই ডেলিভারি বয় বলল,
‘আপনি নাযীফাহ তাসনিম?’
হ্যা বোধক মাথা নাড়ায় নাযীফাহ।
‘তাহলে আপনি এইখানটায় সই করুন।’
নিজের আসনে বসে পার্সেল উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল সে। বক্সে কি থাকতে পারে সেটাই ভাবতে লাগল সে। তন্মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয় তনয়া। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,
‘নীল রঙের ফাইল টা কমপ্লিট করেছেন? স্যার নিয়ে যেতে বলল।’
বলেই তার চোখ পড়ে সেই পার্সেলের উপর।
‘কি অর্ডার করেছিলেন?’
‘জানি না কি আছে এর ভেতর। আমি অর্ডার করিনি।’
‘তাহলে কি বয়ফ্রেন্ড দিলো?’
‘যেখানে বয়ফ্রেন্ডই নেই সেখানে গিফট আশা করা বিলাসিতা।’ বলেই দু’জন অট্ট হাসতে লাগলো।
‘আচ্ছা যাইহোক খুলে দেখেন কি আছে।’
পার্সেল খুলে দেখল সেখানে বিভিন্ন সেইপের, বিভিন্ন ডিজাইনের অনেকগুলো নোজপিন।
তনয়া ‘ওয়াও’ বলে নাযীফাহ থেকে নিলো।
‘মানতে হবে যে পাঠিয়েছে তার চয়েজ আছে। সবগুলোই কি সুন্দর। এখান থেকে একটা পড়ুন তো। বেশ মানাবে আপনাকে।’
‘ইশ! কার না কার। আমি পড়বো এটা মোটেও না।’
‘আপনি চুরি করেছেন নাকি? গিফট দিয়েছে আপনাকে। এখন সে যদি লুকিয়ে গিফট দিতে চায় এতে তো আপনার কিছু করার নেই। পড়ুন পড়ুন দেখি আপনাকে কেমন মানায়।’
অগত্যা বাধ্য হয়ে সে নাকের নাকফুলটা খুলে সেখান থেকে একটা নাকফুল নাকে দিলো। তনয়া এক গাল হেসে বলে,
‘আপনাকে কিন্তু মিষ্টি লাগছে। আর একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি অন্যান্যদের থেকে আপনার পারফরম্যান্স বেশ ভালো। মনে হচ্ছে আপনি সিলেক্টেড। বাকিটা বস জানে। আপনি আপাতত তাহমিদ স্যারের কেবিনে যান। স্যার নীল ফাইলের খোঁজ করেছে।’
ফোনে কথা বলছিল তাহমিদ। নাযীফাহ নক করতেই সে ভেতরে আসতেই তার দম আটকে এলো। কথা বন্ধ রেখে নাযীফাহ’র নাকের দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর শুকনো ঢুক গিলে বলল,
‘ফাইলটা দিন।’
হাতে থাকা ফাইলটা তাহমিদের দিকে বাড়িয়ে দিলো সে। তাহমিদ মনযোগ সহকারে সবটা দেখার পর বলল,
‘সব ঠিক আছে। তবে লাস্ট গিয়ে একটু গড়মিল করে ফেলেছেন। এখনি গিয়ে ঠিক করে ফেলুন।’
নাযীফাহ ‘আচ্ছা’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে আচমকা থমকে দাঁড়ালো।
#চলবে
বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।