#শৈবলিনী—-৩১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★পুরো পরিবার স্তম্ভিত হয়ে আছে আদিত্যর কথায়। তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে এই পরিবারের ছেলে হয়ে আদ্র এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। রেহনুমা বিস্মিত কন্ঠে বলল,
–কী বলছ তুমি এস আদি! হুঁশে আছোতো তুমি? আদ্রর ব্যাপারে কথা বলছ তুমি। আদ্র, আমাদের আদ্র। তুমি ভাবলেও কী করে ও এমন জঘন্য কাজ করতে পারবে? আর কে বলেছে তোমাকে এসব অশালীন কথা?
–কেউ বলেনি মা। তোমার মনে হয় আমি শুধুমাত্র কারোর কথার ওপর ভরসা করে ওকে দোষী সাব্যস্ত করবো? আমি নিজে এটা জানতে পেরেছি। তোমার গুনধর সন্তান এবং ওর বন্ধুরা মিলে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। ওরা নূরের বোন অমালিয়াকে রে,…. ছিহহ্ আমার উচ্চারণ করতেও ঘৃণা হচ্ছে।
রেহনুমা বেগম জ্বলে উঠে বললেন,
–ও আচ্ছা তো এখন বুঝতে পারলাম। আসল কলকাঠি তাহলে ওই মেয়েটার। ওই মেয়েটা তোমার মাথা পুরো খেয়ে ফেলেছে। তাইতো আজ তুমি পাগলের মতো কাজকর্ম করছ। এইজন্যই আমি তোমাকে ওই মেয়েটার সঙ্গ ছাড়তে বলছিলাম। দেখেছ আমার ধারণাই ঠিক হলো। ওই মেয়েটা তোমার পরিবারের ভেতরও ভাঙ্গন ধরিয়ে দিয়েছে। তাইতো আজ তোমার মাথায় তোমার ভাইয়ের নামে মিথ্যে বদনাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর তুমিও তাই বিশ্বাস করে নিজের ভাইকে অপরাধী বানাচ্ছ। তুমি বুঝতে পারছনা ওই মেয়ের ষড়যন্ত্র। আরে এসব মেয়েদের আমার অনেক ভালো করে চেনা আছে। এদের পুরো পরিবারই হয় ধান্ধাবাজ। এরা এদের ছেলেমেয়েদের এসব ধান্ধাবাজই শেখায়। এক মেয়েকে তোমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। আর আরেক মেয়েকে দিয়ে এসব মিথ্যে কাহিনি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্ধা করছে। এসব থার্ড ক্লাস পরিবারের কাজই এই।
আদিত্য হাতে তালি বাজিয়ে তিরস্কারের সুরে বলল,
–বাহ্ মা বাহ্, তোমার চিন্তাধারা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে এতটাও নিচে নামিওনা মা যে,একসময় সন্তানের চোখেই নেমে যাও। তুমি নূরের পরিবারের শিক্ষার কথা বলছিলেনা? তো সেটা নাহয় পড়েই বিচার করা যাবে। আপাতত আমি এই পরিবারের শিক্ষার পরিচয় দিতে চাই। দেখাতে চাই তুমি তোমার সন্তানকে কেমন শিক্ষা দিয়েছ। সাহস আছেতো দেখার?
আদিত্য নিজের ফোন বের করে একটা সিসিটিভি ফুটেজ দেখালো। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আদ্র আর ওর বন্ধুরা মিলে একটা মেয়েকে গাড়ি থেকে নামিয়ে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। আদিত্যর মা,বাবা,আহানা সবাই দেখলো ভিডিওটা। পায়ের নিচে মাটি সরে গেল সবার। আহানা ভাইয়ের এই নিকৃষ্ট কাজ দেখে হতবাক হয়ে মুখে হাত চেপে ধরলো। ক্রোধে ফুঁসে উঠল এবার আদিত্যর বাবাও। রেগে গিয়ে মার খেয়ে বসে থাকা আদ্রর গালে সজোরে এক থাপ্পড় মেরে দিয়ে বলল,
–তুই আমার সন্তান ভাবতেও নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। এমন জঘন্য কাজ করার আগে ম,রে গেলিনা কেন তুই?
রেহনুমা বেগম স্তব্ধ হয়ে সোফার ওপর ধপ করে বসে পড়লো। আদিত্য মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–তো বলো মা, নূরের পরিবারের শিক্ষার কথা বলছিলেনা তো এখন নিজের সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে কী বলতে চাও তুমি? পরের দোষ টা খুব সহজেই চোখে পড়ে। অথচ নিজের ঘরের দোষ কারোর চোখে পড়ে না। একটা কথা জেনে রাখো মা। মানুষ যতোই খারাপ হোক। কোনো মেয়ে কখনো নিজের ইজ্জত নিয়ে এতবড় মিথ্যে কথা বলবেনা। তাছাড়া আমাকে আদ্রর কথা ওরা বলেনি। কারণ ওরা নিজেও জানে না এই কাজ আমার ভাই করেছে। আমি নিজেও কাল রাত পর্যন্ত এই জঘন্য সত্য থেকে অজ্ঞাত ছিলাম। কাল যখন অমালিয়া আমাকে ওই জায়গাটার বর্ননা দিলো। তারপর থেকেই আমি ওই জায়গাটার খোঁজ করছিলাম। তখন হঠাৎ আমার মনে হলো আমাদের ফার্মহাউসের পাশেও তো একটা মাজার আছে। ভেবেছিলাম হয়তো ফার্মহাউস ফাঁকা থাকায় ছেলেগুলো ওখানে নিয়ে যেতে পারে অমালিয়াকে। কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে,সেই ছেলেগুলোর মধ্যে আমার ভাইও থাকবে। ফার্মহাউসের সেফটির জন্য আমি একটা গোপন ক্যামেরা লাগিয়েছিলাম। যার কথা কেউ জানেনা। আর সেই ক্যামেরার ফুটেজেই এটা ধরা পড়ে। এটা দেখতেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। আমি ক্লিয়ার হওয়ার জন্য একবার না, বারবার বারবার দেখছিলাম। চাইছিলাম এটা যেন আমার চোখের ভুল হয়। কিন্তু না, এই ক্রিমিনাল আর কেউ নয় বরং আমারই ছোট ভাই। মন চাচ্ছে এখুনি খু,ন করে ফেলি ওকে।
বলতে না বলতেই আরেক ঘা লাগিয়ে দিলো আদ্রকে। আদ্র এতক্ষণে মুখ খুলল। ভয়ে, আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–ভাইয়া, ভাইয়া প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে। সেদিন বন্ধুদের আড্ডায় পড়ে অনেক নেশা করে ফেলেছিলাম। হুঁশ ছিলোনা আমার। আর ওই মেয়েটা সবার সামনে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলো। যারজন্য অনেক রাগ উঠে গিয়েছিল আমার। বন্ধুরা আমাকে প্রতিশোধ নিতে বলে। নেশা আর রাগের বশে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে আমি এতবড় অন্যায় করে ফেলেছি ভাইয়া। আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দাও প্লিজ!
আদ্রর স্বিকারক্তি শুনে যেটুকু সন্দেহ ছিলো তাও এবার দূর হয়ে গেল সবার। রেহনুমা মাথায় হাত দিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বললেন,
–এটা কী করলি তুই আদ্র? কী করলি?
আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–এখন কেন বলছ মা? আমি আগেই বলেছিলাম ওর চলাফেরায় একটু নজর দাও। একটু সাবধান করো ওকে।অতিরিক্ত কোনোকিছুই ক্ষতিকর। টাকা আছে বলেই সেটাকে বিপথে উড়ালে ফলাফল এমনই হয়। ওর এই রাত রাতভর পার্টি করা বন্ধ করতে বলেছিলাম আমি তোমাকে। কিন্তু না। তুমিতো খোলা ছুট দিয়ে রেখেছিলে ওকে। কারণ তোমার কাছে এসব হাই সোসাইটির কালচার ছিলো। তাই ছেলেকে যা ইচ্ছে তাই করতে দিয়েছ। এখন দেখলেতো এর পরিণাম। আজ আদ্রের এই অবনতির পেছনে তোমারও কিছুটা হাত আছে। যেখানে নিজের সন্তানকেই সঠিক শিক্ষা দিতে পারলেনা সেখানে অন্যের শিক্ষার কথা বলার কোনো অধিকার নেই আমাদের। এখন সামনে যা হবে সেটাও আমাদেরই ভোগ করতে হবে।
আদ্র ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
–সামনে যা হবে মানে? কী করতে চাইছ তুমি ভাইয়া?
–খবরদার! ওই মুখে আমাকে ভাই ডাকবিনা। আর তোর মতো অপরাধীদের জন্য দেশের আইন যে শাস্তি নির্ধারণ করেছে তাই হবে, আর কি।তুই কী ভেবেছিস এসব জানার পরও আমি চুপচাপ বসে থাকবো। তোকে তোর শাস্তির ব্যবস্থা তো আমি করেই ছাড়বো।
আদ্র আতঙ্কে শঙ্কিত হয়ে আদিত্যর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–ভাইয়া, ভাইয়া প্লিজ আমাকে পুলিশে দিওনা। প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে। তুমি আমাকে অন্য যেকোনো শাস্তি দাও তবুও পুলিশে দিওনা।তুমি যা বলবে আমি তাই করবো ভাইয়া। তোমার কোনো কথার অবাধ্য হবোনা। শুধু পুলিশে দিওনা আমাকে ভাইয়া। আমাকে ফাঁ,সি,তে দিয়ে ওরা। আমি মরতে চাইনা ভাইয়া প্লিজ। ভাইয়া প্লিজ…
আদিত্য পা ছাড়িয়ে উপরে চলে যেতে লাগলো। আদ্র চিল্লিয়ে কাঁদতে লাগলো। মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বলতে লাগলো,
–মা, তুমি ভাইয়াকে বলোনা আমাকে পুলিশে না দিতে। আমাকে মেরে ফেলবে ওরা মা। মা আমাকে বাঁচাও প্লিজ। তোমরা যা বলবে তাই করবো। এবারের মতো মাফ করে দাও আমাকে। ভাইয়াকে বলোনা পুলিশে যেন না দেয় আমাকে।
রেহনুমা কী বলবে বুঝতে পারছে না। ছেলের আকুতি দেখে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন তিনি। আদ্র পাগলের মতো বলতে লাগলো,
–ঠিক আছে তোমরা আমাকে মে,রে ফেলতে চাও তো। তাহলে পুলিশের হাতে ম,রা,র কী দরকার! আমি নিজেই নিজের জান নিয়ে নিচ্ছি।
বলেই আদ্র দৌড়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে ফল কাটা চা,কুটা নিয়ে নিজের হাত কাটতে নিলেই আহানা আর রেহনুমা দৌড়ে এসে আটকালো তাকে। হাত থেকে ছু,রি টান দিয়ে নিয়ে ফেলে দিলো। আদ্র আবারও কাঁদতে কাঁদতে পুলিশে না যাওয়ার জন্য আকুতি মিনতি করতে লাগলো।
এসব কিছু আদিত্যর কানে এলো। নিচে শক্ত থাকলেও রুমে এসে ধপ করে বসে পড়লো সে। মাথার সামনে সব গোলগোল ঘুড়ছে ওর।ভাইয়ের করুন আকুতি তাকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। জীবন এ কেমন খেলা খেলছে ওর সাথে। আজ নিজের ভাইকে শাস্তি দিতে হচ্ছে ওকে। ওর ভাইটা এমন কীভাবে হয়ে গেল? এতে কী আমার কোনো দোষ নেই? অবশ্যই আছে। বড়ো ভাই হিসেবে আমারও দায়িত্ব ছিলো ওকে সঠিক পথ দেখানো। যে দায়িত্বে আমি বিফল হয়েছি। যারজন্য শাস্তিতো আমারও পাওয়া উচিত।
___
মিছরি চিপসের প্যাকেট থেকে গপাগপ চিপস মুখে ঢুকাতে ঢুকাতে মেইন দরজা দিয়ে বাসার ভেতর ঢুকতেই হতভম্ব হয়ে গেল সে । মুখ ভর্তি চিপস নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনের সোফায় বসে থাকা ব্যক্তির পানে। চোখ দুটো ফুটবল আকার ধারণ করেছে। চোখের সামনে যা দেখছে তা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না তার। তবে কী জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে সে? মিছরির হতবাক অবস্থার মাঝেই ইভানও সেখানে এসে উপস্থিত হলো। মিছরিকে এভাবে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইভান ওর মাথায় আলতো চাটি মেরে বলল,
–এই পুচকি এভাবে দাঁড়িয়ে আসিছ কেন? চিপস গলায় আঁটকে গেছে নাকি? সারাদিন খালি এটা ওটা মুখের ভেতর ঢুকাতেই থাকলেতো এমনই হবে। যা গিয়ে পানি খা।
মিছরির তবুও কোনো হেলদোল হলোনা। সে একই ভঙ্গিতে অবাক, বিস্মিত চোখে সামনে তাকিয়ে থেকেই হাত তুলে সামনে ইশারায় ইভানকে দেখালো। মিছরির ইশারা অনুযায়ী ইভান সামনে তাকাতেই সেও হতভম্ব হয়ে গেল। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বুঝি দেখছে সে। তার বড়ো বোন নূর সোফায় হাঁটু ভাজ করে হাঁটুতে থুঁতনি ঠেকিয়ে বসে আছে। বিস্ময়ের কারণ সেটা না। কারণ হলো নূর ওভাবে বসে থেকে সামনের টিভির স্ক্রিনে চোখ গেঁড়ে আছে। টিভির স্ক্রিনে চলছে আদিত্যর মুভির সং। যেখানে আদিত্য অনেক গুলো ব্যাকরাউন্ড ডান্সারদের সামনে সিঙ্গেল আইটেম ডান্স করছে। নূর সেদিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আবার ঠোঁটে মুচকি হাসিও লেগে আছে। বোনের এই আবতার দেখে এদের দুই ভাইবোনের মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। এটা কি ওদেরই সেই বোন, যে কিনা এসব নিজেতো দেখা দূরের কথা ছোটো ভাই বোনদেরও এসব দেখতে দেখলে অগ্নিশর্মা হয়ে যেত? আর আজ কিনা সেই এভাবে বসে মনোযোগ সহকারে দেখছে? এটা সত্যিই ঐতিহাসিক ঘটনা। এরই মাঝে লতিকা বেগমও এগিয়ে এলো। ইভান আর মিছরিকে এমন হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনিও ভ্রু কুঁচকে বললেন।
–এই কী হয়েছে তোদের? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
দুই ভাইবোন এবার ওর মায়ের দিকে তাকালো। ইভান ইশারায় ওর মাকেও সেই অলৌকিক দৃশ্যের সাক্ষী করালো। লতিকা বেগমও ভীষণ অবাক হলো মেয়ের এই পরিবর্তীত রুপ দেখে। হঠাৎ মিছরি মৌনতা ভেঙে বিশ্ববিখ্যাত এক চিৎকার দিয়ে উঠল। চিৎকার দিয়ে মায়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
–মা,মা,বড়ো আপুকে ভুতে ধরেছে। বাঁচাও আমাকে। নাহলে আমার ঘাড় মটকে দিবে।
মিছরির চিৎকারে হকচকিয়ে উঠল নূর। ঠাস করে উঠে দাঁড়িয়ে পরিবারের সামনে ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল সে। তখন সোফায় ফেলে রাখা কাপড়চোপড় গুলো গোছাতে এসেছিল নূর। টিভিটা তখন ছাড়াই ছিলো। হয়তো মিছরি টিভি ছেড়ে রেখে বাইরে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ টিভির দিকে চোখ যেতেই টিভির পর্দায় দেখতে পায় আদিত্যকে। আদিত্যর কোনো মুভির সং চলছিল। যেখানে আদিত্য অতি সুন্দর ভঙ্গিতে নাচছিলো। সেটা দেখতেই অজান্তেই নূরের চোখ আটকেছিল যায় ওই সুদর্শন পুরুষে। যে পুরুষ আজকাল সর্বক্ষণ তার চিন্তা চেতনায় কব্জা জমিয়ে বসে আছে। সেই পুরুষকে দেখার অবাধ্য মনের চাহিদায় কখন যে নূর সোফায় বসে পড়ে তা নিজেরও খেয়াল নেই। তবে এখন পরিবারের এভাবে থতমত খেয়ে গেল নূর। তড়িঘড়ি করে এলোমেলো ভাবে সোফায় রাখা কাপড়চোপড় গুলো গোছাতে গোছাতে, নিজের অপ্রস্তুত ভাব ধামাচাপা দিতে মিছরিকে ধমকের সুরে বলল,
–কি আবোলতাবোল বলছিস? দেবো এক থাপ্পড়।পড়ালেখা বাদ দিয়ে মাথায় খালি এসব উদ্ভট কথাবার্তাই ঘোরে তোর।
মিছরি এবার একটু সাহস জমিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠে বলল,
–বারে, নিজে তাহলে কী করছিলে? এতক্ষণ টিভির সামনে তুমিই তো ভুতের বসে ছিলে। তো ভয় পাবোনা!
নূর আমতাআমতা করে নিজের দাপট বজায় রাখার প্রয়াসে বলে উঠলো,
–ও ওটাতো আমি পরিক্ষা করছিলাম। তোরা সবসময় বলিস আমি নাকি তোদের টিভি দেখা নিয়ে অযথাই বকাঝকা করি।তাই আমি আজ দেখে জানার চেষ্টা করছিলাম আসলে এসবের মাঝে কী এমন আছে যারজন্য তোরা নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে বসে দেখতে থাকিস। যদি তেমন কোনো কারণ খুঁজে পাই তাহলে আর তোদের বকবো না। কিন্তু কিছুই পেলাম না। এসব আসলেই এক্কেবারে ফালতু জিনিস ছাড়া আর কিছুই না। তাই এসব তোদের দেখতে না দেওয়ার বিষয়টায় আর কোনো দ্বিমত থাকলো না। বুঝতে পেরেছিস।
মিথ্যে বিশ্লেষণ শেষে কাপড়চোপড় গুলো নিয়ে চলে গেল নূর। আজ এই লোকটার জন্য কী একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল সে। মিঃ নায়ক টা সত্যি করেই মাথা খেয়ে ফেলেছে। মনে মনে এসব ভেবে হাসলো নূর। যা অন্য কারো নজরে না পড়লেও লতিকা বেগমের নজরে ঠিকই পড়লো। তার মেয়ের মাঝে এই পরিবর্তনের উৎস অনেকটাই বুঝতে পারলেন তিনি। আদিত্য নামের ওই ছেলেটাই তাঁর জীবনের এই পরিবর্তনের কারণ। যার কিছুটা ধারণা তাঁর আগেই হয়েছিল। ছেলেটার চোখে তিনি নূরের জন্য অনুভূতি টের পেয়েছিলেন। শেষমেশ তাঁর মেয়ের জীবনেও কেউ নতুন রঙ ছড়াতে সক্ষম হয়েছে এটাই আপাতত তাঁর জীবনের সবচেয়ে খুশির বিষয়। মেয়েটা অন্যের জন্য অনেক করেছে। এবার যেন নিজের জন্য একটু খুশি পায় সে। তাঁর মেয়ের এই খুশি যেন এভাবেই অক্ষুণ্ণ থাকে এটাই একমাত্র চাওয়া তাঁর।
___
নিজেকে অনেক কষ্টে শক্ত করে নিয়ে নূরকে ফোন করে জানাতে চাইলো যে,সে যে অপরাধীকে খুঁজছে সে আর কেউ নয় বরং ওরই আপনা ভাই। জানিনা এটা জানার পর নূর কী করবে।আমাদের সম্পর্কই বা কোন দিকে মোড় নিবে। তবে যাই হয়ে যাক নূরকে দেওয়া প্রমিজ সে পূরণ করবে। অপরাধীকে তুলে দিবে তার হাতে। এমনিতেও তার ভাই যদি অন্য কারোর সাথেও এটা করত তবুও সে একই কাজ করত। তার কাছে সব অন্যায় কারীই এক। সে যেই হোকনা কেন। এমন নিকৃষ্ট কাজের জন্য সে কাউকেই ছাড় দিবে না। আদিত্য ফোন বের করে নূরের নাম্বারে ডায়াল করতেই যাবে ঠিক তখনই রেহনুমা বেগম এসে পড়লেন। আদিত্যর পাশে বসে ভারাক্রান্ত গলায় বললেন,
–আদি,দেখ মানছি আদ্র অনেক বড়ো অন্যায় করেছে। অন্যায় না পাপ করেছে। তুমি তখন ঠিকই বলেছ, দোষ আমারই। আমিই ওকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। যারজন্য ও এমন বিপথে চলে গেছে। কিন্তু ও ইচ্ছে করে এমন করেনি। খারাপ সঙ্গ পেয়ে নেশার ঘোরে এই কাজ করে ফেলেছে ও। ও নিজের ভুল বুঝতে পারছে। সেটা স্বিকারও করছে। দেখ যেমনই হোক ও তোমার ভাই। তাকে তুমি এভাবে পুলিশে দিওনা। এখন আইনে রে,প কেসে সরাসরি ফাঁ,সি দিয়ে দেয়। একটা অন্যায়ের জন্য তাকে তুমি মৃ,ত্যু,দ,ন্ড দিওনা। ওকে আরেকটা সুযোগ দাও।
আদিত্য বিস্মিত কন্ঠে বলল,
–মা,তুমি একবারও ভাবছ কী বলছ তুমি? তুমি চাইছ আমি একটা রে,পি,স্টকে বাঁচিয়ে দেই? সরি মা,এটা আমার দ্বারা সম্ভব না। ও যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি ওকে ভোগ করতেই হবে। আজ ওই মেয়ের জায়গায় আহানা হলে কী করতে তুমি? তখনও কি এটাই বলতে?
রেহনুমা কেঁদে উঠে বললেন,
–জানি না, জানি না কী করতাম। এখন শুধু আমি আমার ছেলের কথাই জানি। নিজের সন্তানকে আমি চোখের সামনে মরতে দিতে পারবোনা। প্লিজ আদি,আমি তোর পায়ে পড়ছি, মা হয়ে ভিক্ষা চাইছি তোর কাছে। ওকে তুই পুলিশের হাতে দিসনা।
বলতে বলতে আদিত্যর পায়ের কাছে বসে পড়লো রেহনুমা। সন্তান হয়ে মায়ের এমন করুন আকুতি কীভাবে সহ্য করবে আদিত্য। আদিত্য দ্রুত নিচে বসে রেহনুমার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে কপালে ধরে করুন সুরে বলল,
–মা…..তুমি কী আমাকে জাহান্নামের ভাগিদার করতে চাও। প্লিজ ডোন্ট ডু দিস। তুমি কী একবারও ওই মেয়েটার কথা ভাবছ? যার জীবন তোমার ছেলের কারণে নষ্ট হয়ে গেল। ওই পরিবারের ওপর দিয়ে কী ঝড় যাচ্ছে একবারও ভেবে দেখেছ? আমি নাহয় তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু নূর ঠিকই তার বোনের অপরাধীকে খুঁজে বের করবে। তখন কী করবে তুমি? কীভাবে বাঁচাবে তোমার ছেলেকে?
–সেটারও একটা উপায় বের করেছি আমি। যাতে দুই পক্ষেরই সুবিধা হয়। দেখ এমনিতেও এসবের পর ওই মেয়ের ভালো কোথাও বিয়ে দিতে পারবেনা ওরা।কথার কথা কেস জিতে গেলেও তাতে ওই মেয়ের ভবিষ্যত শুধরাবে না। তাই আমি আদ্র আর ওই মেয়েটার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে করে ওদেরও ভালো হবে। আর আমার ছেলেটাও ফাঁ,সির দড়ি থেকে বেঁচে যাবে। আর এতে করে আদ্রও নিজের ভুল শুধরে নিতে পারবে। দুই পরিবারই উপকৃত হবে।
আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–বাহ্ মা বাহ্, যখন নূরকে আমার বউ করার কথা উঠেছিল তখনতো তুমি কঠোর হয়ে বসলে। স্টাটাস এর দোহায় দিয়ে নূরের পরিবারকে নর্দমায় ঠেলে দিলে। আর এখন নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ওই পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করতেও রাজি হয়ে গেলে? আর কতো নিচু চিন্তাধারার পরিচয় দিবে? কিন্তু আমি এতো নিচে নামতে পারবোনা মা। আমাকে প্লিজ এতবড়ো অপরাধী বানিয়ো না। প্লিজ মা..
রেহনুমা কাঁদতে কাঁদতে মিনতির সুরে বললেন,
–এই মায়ের অনুরোধ টা রাখ আদি। প্লিজ আমার ছেলেটাকে বাঁচা। নাহলে আমিও ম,রে যাবো। আদ্রকে পুলিশে দিলে ওর সাথে সাথে আমার লা,শও দাফন করতে প্রস্তুত থাকিস আদি।
স্তব্ধ হয়ে গেল আদিত্য। তীব্র আহত দৃষ্টিতে তাকালো সে মায়ের পানে। কোনো সন্তানই পারবেনা তার মাকে মৃ,ত্যু,র মুখে ঠেলে দিতে। তাহলে আদিত্য কী করে পারতো। হেরে গেল সে মায়ের অন্যায় আবদারের কাছে। নিজের আদর্শ, ওয়াদা সব বিসর্জন দিতে বাধ্য হলো সে। পরাজিত সৈনিকের ন্যায় বলল,
–ঠিক আছে মা। তুমি যা চাও তাই হবে। তবে একটা কথা জেনে রেখ মা। তোমার এই সিদ্ধান্তের কারণে আজকের পর থেকে তুমি আমার নজর থেকে চিরতরে নেমে যাবে। আমি চাইলেও তোমাকে আগের নজরে দেখতে পারবোনা।
বলেই উঠে চলে গেল আদিত্য। রেহনুমা মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। এক ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক ছেলের কাছ থেকে বুঝি অনেক দূরে চলে গেলেন উনি।
চলবে…..
#শৈবলিনী—৩২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★শুভ্রতায় মুড়ে স্বপ্নময় ভেলায় চড়ে এলো এক স্নিগ্ধ সকাল। ঘুম থেকে জেগে জানালার পর্দা খুলে দিতেই শীতল দমকা পবন এসে লাগলো নূরের মুখাবয়বে। আজ প্রথম সকালটাকে এত সুন্দর লাগছে নূরের। তার কাছে এখন সবই সুন্দর লাগে। জানালার পাশে কাঠগোলাপ গাছটাতে একজোড়া শালিক বসে আছে। নূর আবেশিত মনে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। বুঝতে চাইলো তারা কী আলাপ করছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো নূর আজই প্রথম এই কাঠগোলাপ গাছটাকে খেয়াল করলো। এর আগে সে খেয়ালই করেনি যে,এটা কী গাছ। তার কাছে শুধুই একটা গাছ ছিলো যার ডাল-পালা, পাতা আছে। কিন্তু আজ নূরের রঙিন ভুবনে সব মনোরম বস্তুই তার চোখে দৃশ্যমান হচ্ছে। মন হারালে বুঝি এমনই হয়। নিজেকে কেমন হাওয়ায় ভাসমান মনে হয়। সে ভাসতে চায়, ভাসতে চায় তার মিঃ নায়কের সাথে। তার হাতে হাত রেখে ভেসে যেতে চায় অচীন দেশে। নূরের মোহময় ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কারোর চিৎকারের আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠলো নূর। খেয়াল করলো এটা অমালিয়ার কন্ঠ। নূর ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে গেল অমালিয়ার রুমে। সেখানে এসে দেখলো অমালিয়া বিছানার উপর থাকা ওর ফোনটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপছে। নূর দ্রুত ওর কাছে গিয়ে অমালিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে বলল,
–কী হয়েছে লিয়া? চিৎকার করলি কেন? এভাবে ভয় পাচ্ছিস কেন, বল আমাকে?
অমালিয়া ভয় নূরের সাথে মিশে গিয়ে ভয়ে ভয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে ফোনের দিকে দেখালো। নূর ভ্রু কুঁচকে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আদিত্যর ছবি। ছবিতে তার পাশে একটা সুন্দর মেয়ে আর অন্য আরেকটা ছেলেও আছে। নূর ক্যাপশনের লেখা দেখে বুঝলো আদিত্যর ভাই বোন এরা। কোনো পার্টি থেকে তোলা ছবি।আদিত্যর ফেইসবুকে পোস্ট করা হয়েছে। ছবি দেখে নূর বলল,
–এটাতো মিঃ নায়কের ছবি। তুই এটা দেখে ভয় পাচ্ছিস কেন?
অমালিয়া আতঙ্কিত কন্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
–ও ও ওটাই সেই জা,নো,য়া,র,টা।
–মানে? কার কথা বলছিস তুই?
–ওইযে আদিত্যর পাশে যে ছেলেটা। ওই আমাকে সেদিন…….
আর বলতে পারলোনা অমালিয়া। কাঁদতে লাগলো সে। নূর স্তব্ধ হয়ে গেল। তারমানে সেই অপরাধী আর কেউ নয়, মিঃ নায়কের ভাই? মাথা ঘুরতে লাগলো নূরের। এ কেমন গোলকধাঁধা! আদিত্য যাকে খুঁজে বের করে আনার জন্য আমাকে ওয়াদা করেছে সেই অপরাধী কিনা ওরই ভাই! এক মিনিট, আদিত্য কি এসব আগে একবার জানে? সে কি জেনে শুনেই আমার সাথে খেল খেলছে? না না, কী ভাবছি আমি? আদিত্য এমন করতে পারে না। আমার বিশ্বাস আছে ওর ওপর। ও নিশ্চয় ওর ভাইয়ের কথা জানে না। জানতে পারলে সে অবশ্যই অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দিবে। আমাকে দেওয়া ওয়াদা ভাঙবেনা সে। কিন্তু ভাইয়ের কথা জানতে পারলে কী সে তার ওয়াদা পূরণ করতে পারবে? অবশ্যই করবে। বিশ্বাস যখন করেছি তখন কোনো দ্বিমত রাখবোনা। আদিত্য ওর কথা অবশ্যই রাখবে। অন্যায়কারীকে সে নিশ্চয় ছাড়বেনা।আমি এখন কী পুলিশকে সব জানাবো? না না, আগে আমি নিঃ নায়ককে জানাবো।দেখি কী হয় উনার সিদ্ধান্ত। তারপর নাহয় পরের কার্যবিধি করা যাবে। নূর অমালিয়াকে কোনোরকমে শান্ত করে ওকে শুইয়ে দিয়ে বাইরে এলো।এসব কথা ফোনে বলা ঠিক হবে না।তাই আদিত্যকে মেসেজ করে বাসায় এসে দেখা করতে বলল নূর। হঠাৎ তখনই গ্যারেজ থেকে পল্টুর ফোন এলো। সে জানালো গ্যারেজে নাকি একটা ভেজাল হয়েছে। এক কাস্টমার এসে নাকি গ্যাঞ্জাম বাঁধিয়ে ফেলেছে। নূরকে ইমার্জেন্সি যেতে হবে সেখানে। নূর তাই দ্রুত বেড়িয়ে পড়লো গ্যারেজের উদ্দেশ্যে। ভাবলো আদিত্য আসতে আসতে সে ভেজাল টা সেরে আসুক।
ঘন্টা দুই পরেই ফিরে এলো নূর। অনেক জলদি জলদি এসেছে সে। আদিত্য নিশ্চয় চলে এসেছে এতক্ষণে। তার সাথে দেখা করতেই দ্রুত এসেছে সে।এবং তড়িঘড়ি করে বাসার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল সেই কাঙ্ক্ষিত মানবটিকে। পেছন থেকে তাকে দেখতে পেয়েই ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো নূরের। তবে যখনই সে সামনে এগুতে নিলো। ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগলো। কারণ সোফায় শুধু আদিত্য একা বসে নেই। তার সাথে আরও কিছু লোক বসে আছে। আর তাদের সামনে নূরের মা আর ইভান বসা। কোনো অশুভ কিছুর আভাস হতে লাগলো নূরের। বুকের ভেতর টা কেমন ধুকপুক করতে লাগলো তার। সেটা আরও বৃদ্ধি পেল যখন সে সামনে এসে লোকগুলোর মুখ দেখতে পেল। নূর দেখলো আদিত্যর পাশের মহিলাটা আর কেউ নয় বরং সেদিনের সেই মহিলা। আদিত্যর মা তিনি, তা চিনতে এক মুহুর্তও সময় লাগলো না নূরের। আর উনার পাশে একজন ভদ্রলোক বসা, হয়তো আদিত্যর বাবা হবে। আর তার পাশে যে বসা আছে তাকে দেখতেই পায়ের র,ক্ত তড়াৎ করে মাথায় উঠে গেল নূরের। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ ক্রোধে ছেয়ে গেল। এই বা,স্টা,র্ড টার সাহস কী করে হলো এখানে আসার! রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে নূর কাঁধের হ্যান্ডব্যাগ টা ছিটকে ফেলে তেড়ে গিয়ে দুই হাতে আদ্রর কলার চেপে ধরে টেনে তুলে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলতে লাগলো,
–ইউ ব্লাডি রে,পি,স্ট, তোর সাহস কী করে হলো এখানে পারা দেওয়ার! এখানে এসে তুই নিজের মৃ,ত্যু ডেকে এনেছিস। আজ তোকে আমি….
নূরের হঠাৎ আক্রমণে আদিত্য বাদে সবাই ঘাবড়ে গেল। আদিত্য মাথা নুইয়ে বসে আছে। আজ যে নূরের দিকে তাকানোর মুখ নেই তার। নূরকে আটকাতে লতিকা বেগম ছুটে এলো। মেয়ের হাত ছাড়িয়ে সরিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বলল,
–নূর, কী করছিস এসব! ছাড় ওকে।
নূর রাগী কন্ঠে বলল,
–মা, তুমি জানোনা এই বদমাইশকে। জানোনা ও কী করেছে। ওই সেই অপরাধী, যে আমাদের লিয়াকে…..
–জানি আমি।
কথার মাঝেই মায়ের এই বাক্যে থমকে গেল নূর। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সে মায়ের দিকে। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
–জানো মানে? জেনে শুনেও তুমি ওকে বসিয়ে আত্মীয়র মতো কেন ট্রিট করছ? দাঁড়াও আমি এখুনি পুলিশকে ফোন করছি।
বলেই নূর ওর ফোন বের করে ফোন করতে নিলেই লতিকা বেগম আবারও আঁটকে দিলো তাকে। নূর অবাক হয়ে বলল,
–আটকাচ্ছ কেন মা! পুলিশকে ডাকতে হবে এক্ষুনি।
লতিকা বেগম বলে উঠলো,
–কাউকে ডাকতে হবে না।
–মানে?
–তুই আয় আমার সাথে। কথা আছে।
লতিকা বেগম নূরের হাত ধরে রুমের দিকে টেনে নিয়ে গেল। নূর কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা।যেতে যেতে একবার পিছে তাকিয়ে সে আদিত্যর দিকে তাকালো। কিন্তু আদিত্য ওর দিকে তাকাচ্ছে না কেন? অপরাধীর মতো নজর কেন লুকাচ্ছে সে? কী চলছে এখানে? কেমন অদ্ভুত একটা ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে নূরের মনে। অশুভ কিছুর আভাস যেন আরও জেঁকে বসছে। লতিকা বেগম নূরকে রুমের মাঝে নিয়ে আসলো। নূর অধৈর্য হয়ে বলল,
–এসব কী হচ্ছে মা?আমাকে টেনে আনলে কেন? আর ওই অপরাধীকে ওভাবে আদর করে বসিয়ে রেখেছ কেন?এটা কি তার শশুর বাড়ি?
লতিকা বেগম বলে উঠলেন,
–শশুর বাড়ি না, তবে হতে চলেছে।
তীব্র বেগে বাজ পড়লো যেন নূরের ওপর। বিস্ফোরিত, হতভম্ব নজরে তাকালো সে মায়ের পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
–হোয়াট!! কি বলছ এসব তুমি মা! মাথা টাথা ঠিক আছে তো! তুমি ওই রে,পি,স্টাকে জামায় বানাতে চাচ্ছো?
লতিকা বেগম শক্ত গলায় বলে উঠলেন,
–হ্যাঁ চাচ্ছি,দেখ আমার কথা বোঝার চেষ্টা কর। লিয়ার সাথে যা হয়েছে তাতো হয়ে গেছে, সেটা কোনোকিছুর বিনিময়ে ফেরত পাওয়া যাবে না। কথার কথা যদি আমরা কেস জিতেও যাই তবুও ওর ক্ষতি পূরণ হবে না। ওর বদনামী ঘুচবে না। সমাজ ওকে এক ধ,র্ষি,ত নারী হিসেবেই জানবে। যার কারণে ওর ভবিষ্যত অন্ধকারে ডুবে যাবে। কোনো ভালো ঘরে বিয়ে হবে না ওর। তারচেয়ে এটাই সবচেয়ে ভালো হবে। ওরা নিজের দোষ শিকার করে লিয়াকে তাদের ঘরের বউ করে নিতে চায়। আর আমার কাছেও এটাই সঠিক উপায় মনে হয়েছে। এতে করে লিয়ার জীবন একটু হলেও শুধরাবে। তাই তাদের প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে গেছি। আর তুইও কোনো দ্বিমত করিসনা।
নূর স্তম্ভিত হয়ে গেল তার মায়ের কথায়। আহত স্বরে সে বলল,
–মা তুমি এসব কীভাবে মেনে নিতে পারো? অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে তার হাতে মেয়ের হাত দিয়ে দিতে চাচ্ছ? তাও শুধু সমাজের সামনে সম্মান রক্ষার জন্য? তুমি কীভাবে করতে পারলে এমনটা মা! আমি আমার পরিবারকে এতটা দূর্বল কখনো ভাবিনি। তোমার মতো কিছু মানুষের কারণেই সমাজে এসব অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যখন ধরা খাওয়ার ভয় পায় তখনই এই বিয়ে নামক জাল ফেলে আবারও ছাড় পেয়ে যায়। তুমি ওদের ষড়যন্ত্রে পা দিওনা মা। প্লিজ এটা হতে দিওনা।
–দেখ নূর, এসব আদর্শ কথা শুনতেই ভালো শোনা যায়। বাস্তবে এসব কেউ দেখেনা। নীতিকথা দিয়ে জীবন চলেনা। আর সমাজকে শুধরানোর দায়িত্ব আমাদের একার না। সমাজে থাকতে হলে সমাজকে এরিয়ে চলা যায়না। তাই আমার কাছে এটাই সবচেয়ে উত্তম উপায়। এতে করে দুই পক্ষরেই উপকার হবে।
–কিন্তু মা,ওই ছেলের সাথে লিয়া ভালো থাকবে কিনা তার কী গ্যারান্টি আছে?
–যেমন থাকে থাকবে, এমনিতেও এসব ওর দোষেই হয়েছে। তাই ভালো মন্দ যেমনই হোক ওটাই ওর ভাগ্য। দেখ, আমি যদি সত্যিই তোর মা হয়ে থাকি তাহলে আমার সিদ্ধান্তে বাঁধা দিবিনা তুই ।
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল নূর। প্রতিত্তোর করার ভাষা খুঁজে পেলনা সে। ধরা গলায় শুধু একটা কথাই বলল,
–আর লিয়া? ও কী রাজি?
–সেটা তুই নিজেই জিজ্ঞেস করে দেখ।
অমালিয়াকে ডেকে আনলো লতিকা বেগম। নূর ওকে জিজ্ঞেস করলো,
–তোর কী মতামত এই বিষয়ে। তুইও কী এটাতে রাজি? দেখ কোনো ভয় নেই। তোর মত না থাকলে আমাকে বল। আমি কিছুতেই হতে দিবোনা এই বিয়ে।
লিয়া মাথা নিচু করে বলল,
–না আপু, আমি রাজি। আমি ভেবে দেখলাম এটাই ভালো হবে। এমনিতেও সমাজে বদনামী তো হয়েই গেছে। তাই যার অপরাধ তার ঘাড়েই পড়াই ভালো। এতে করে সব ঝামেলা চুকে যাবে।তাছাড়া এতবড় পরিবারের বউ হতে পারলে আর কী লাগে।
নূর আরও একবার ধাক্কা খেল। এটাই কী ওর পরিবার? কাদের জন্য লড়াই করছে ও? যেখানে ওর পরিবারই অন্যায়ের সামনে নত হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আর কিই বা বলতে নূর। হতবিহ্বল হয়ে গেল সে। ব্যাথিত মনে আস্তে করে বলল,
–ঠিক আছে, কর যা খুশি তাই।
বলেই বেড়িয়ে গেল নূর। বাইরে আসতেই আদিত্যর দিকে নজর গেল তার। এই লোকটাও তাহলে এসবে সামিল আছে! বাহ্, আর কতো ধাক্কা খেতে হবে তাকে। নূর আর থাকতে না পেরে দ্রুত নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
রেহনুমা কাজী ডেকে এখনই বিয়ে পড়াতে চাইলেন। লতিকা বেগমও তাতে সায় দিলেন। ইভান কে বলে কাজী ডেকে আনালেন তিনি। ঘন্টাখানিকের মধ্যেই বিয়ে পড়ানোর কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেল। এসবের মাঝে নূর আর বাইরে এলোনা। আদিত্য অপরাধী চোখে বারবার নূরের রুমের দরজার দিকে তাকালো। নূর একবারের জন্যেও এলোনা। সে যে কতটা হার্ট হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই আদিত্যর। হৃদয় টা পুড়ছে তার। সেও পারলে এখানে আজ আসতো না। কিন্তু নিজের শাস্তি থেকে সে পালাবেনা সে। আজ যে সে জীবনের কঠিনতম শাস্তি পেতে চলেছে।নূরের বিশ্বাস ভঙ্গ করার মতো যে অপরাধ সে করেছে, তার শাস্তি যে তাকে পেতেই হবে। সেই শাস্তির ভয়াবহতা যে কতটা বৃহৎ হবে তা ভাবতেই আদিত্যর হৃদপিন্ড চিপে আসছে।
বিয়ের কার্যক্রম শেষে বিদায়ের পালা এলো। যাওয়ার আগে অমালিয়া বড়ো বোনের সাথে দেখা করার জন্য দরজায় নক করলো। নূর দরজা খুলে বের হলো। অমালিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
–আপু আমি যাচ্ছি। একটু কথা বলবিনা আমার সাথে?
নূর নিজের ভেতরের কষ্ট লুকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
–যাচ্ছিস যা,তবে একটা কথা জেনে রাখিস। আজকের পর তুই তোর বড়ো বোনকে হারিয়ে ফেললি। তুই সবসময়ই আমাকে ডিসিপয়েন্ট করেছিস। তবে আজকের এই কাজে তুই চিরতরে আমার কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে গেলি। এটা তোরও বাবার বাড়ি। সবার মতো তোরও সমান অধিকার আছে এই বাড়িতে। তাই তোকে এবাড়িতে আসতে মানা করার অধিকার নেই আমার। তবে আমার কাছে আর কখনো বোনের অধিকার নিয়ে আসবিনা। যা এখন, আশা করি ভালো থাকবি। বাকিটা তোর ভাগ্য। যা তুই নিজেই চুজ করেছিস।
বোনের কঠোর বানীতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অমালিয়া। সে সত্যিই আজ তার বাবার জায়গায় থাকা বোনকে হারিয়ে ফেললো। উপরে উপরে শক্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে কী তুফান চলছে তা শুধু নূরই জানে। নূর এবার আদিত্যর পানে তাকালো। আদিত্য তিব্র কাতর আর অপরাধী চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূরের চোখের চাহুনি দেখে বুকের মাঝে হাজার টা ছু,রি,র আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো আদিত্যর হৃদয়। ওই চোখের চাহুনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আজকের পর আর আমার মুখও দেখতে চায়না সে। চিরতরে হারিয়ে ফেলল বুঝি নূরকে সে।
দেখতে দেখতে অমালিয়াকে নিয়ে চলে গেল আদিত্যর পরিবার। লতিকা বেগম বসে বসে কাঁদছেন। ইভান তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। নূর এসব আর দেখতে পারলোনা। দরজা আঁটকে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে গুমরে কেঁদে উঠলো সে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল নূরের। আর ফোন রিসিভ করতেই আজকের সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেল সে। যা তার হৃদয়টাকে ভেঙে হাজার খন্ডে খন্ডিত করে দিলো। যখন ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি বলে উঠলো,
–ম্যাম,আমি *****ডিসকো ক্লাবের ম্যানেজার বলছি। ওইযে সেদিন আপনারা যে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে এসেছিলেন।
নূর একটু সচেতন হয়ে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। বলুন কী বলবেন?
–আসলে ম্যাম আপনাকে একটা সত্য ঘটনা জানাতে চাই। আসলে আপনার বোনের কথা জানতে পেরে আমার খুব খারাপ লাগছিলো। খুব অপরাধ বোধ হচ্ছিল। তাই না জানিয়ে থাকতে পারলাম না। আসলে সেদিন সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব ছিলোনা বরং সেটাকে ইচ্ছে করে আপনার সামনে গায়েব দেখানো হয়েছিল।
নূর কপাল কুঁচকে বলল,
–মানে? কে এমন করেছে?
–আপনার সাথে যে লোকটা এসেছিল সেই এসব করেছে। তখন আমাকে একা নিয়ে গিয়ে উনি আমাকে অনেক গুলো টাকার অফার দিয়ে বলেন ফুটেজ এডিট করে দিতে। আমিও টাকার লোভে তখন রাজি হয়ে যাই। কিন্তু পেপারে যখন আপনার বোনের ঘটনার সম্বন্ধে জানতে পারি। তখন আমার খুব অপরাধবোধ হয়। তাই আপনাকে সত্যটা জানিয়ে দিলাম। যাতে আপনি ষড়যন্ত্রের শিকার না হন। আপনার বিশ্বাস না হলে আমি সেই ফুটেজ আপনার ফোনে পাঠাচ্ছি।আমার কাছে কপি ছিলো। আপনি নিজেই দেখে নিন।
লোকটা ফুটেজ পাঠালো। আর তাতে আদিত্যর ভাইয়ের ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই পুরো পৃথিবী থমকে গেল নূরের সামনে। স্তব্ধ পাথরের মতো হয়ে গেল সে। হাত থেকে ফোনটা ঠাস করে নিচে পড়ে গেল। অনুভূতি শূন্য হয়ে গেল সে। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে নিচে বসে পড়লো সে। ধোঁকা! এতবড় ধোঁকা হলো তার সাথে! এই সবকিছুই তাহলে ধোঁকা ছিলো! আদিত্যর এখানে আসা দেখে ভেবেছিল হয়তো ভাই আর পরিবারের মায়ায় পড়ে সে এখানে এসেছে। কিন্তু এসবকিছুই যে প্রথম থেকেই একটা ষড়যন্ত্র ছিলো তা কল্পনাও করতে পারেনি নূর। ওই লোকটার ওসব কথা সবই তাহলে মিথ্যে ছিলো! সব ছলচাতুরী ছিলো! সে আমার সাথে খেলছিলো। কত্তবড় স্টুপিট আমি, পুরুষের স্বভাব জানা সত্বেও এই ষড়যন্ত্রের শিকার হলাম আমি। আমার মনটাকে নিয়ে এমন বিশ্রী ভাবে খেললো সে। জীবনের প্রথম কাউকে বিশ্বাস করলাম,কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম, কাউকে মনে জায়গা দিলাম আর সেই এতবড় ধোঁকা দিলো! সব আমার দোষ। আমি কী করে তার ফাঁদে পা দিলাম! কী করে তার মিথ্যে মায়াজালে ফেঁসে গেলাম! এতো গুন্ডি সেজে থেকেও কী লাভ হলো! সেইতো এক ছলনাকারী পুরুষের কাছে হেরে গেলাম আমি। কী করে পারলাম! কী করে…কী করে…
রাগে,দুঃখে অসহনীয় যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠলো নূর। চিল্লিয়ে বিছানার চাদর টেনে নিচে ছুঁড়ে ফেললো। মনের মাঝে বইতে থাকা তুফানে তছনছ করতে লাগলো ঘরের ভেতরটা।
অন্যদিকে ফোন কেটে দিয়ে সম্মুখের ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার বলে উঠলো,
–কাজ হয়ে গেছে ম্যাম। আপনি যা বলেছিলেন ঠিক তেমনই বলে দিয়েছি।
বিশ্ব জয়ের সয়তানি হাসি ফুটলো সামাইরার ঠোঁটে। পার্স থেকে টাকার বান্ডিল বের করে ম্যানেজারকে তার কাজের উপহার দিলো। ম্যানেজার তা পেয়ে খুশিমনে চলে গেল। মনে মনে পৈ,শা,চি,ক আনন্দে নাচতে ইচ্ছে হলো সামাইরার। আজ সে তার কাজে সফল হয়ে গেছে। আদিত্য আমাকে রেখে ওই থার্ড ক্লাস মেকানিকের পিছনে পড়েছিল। আমাকে অবজ্ঞা করেছিলো আদিত্য। এখন দেখবো কীভাবে সে ওই মেয়েকে পায়। সেদিন নূরকে পুলিশের সাথে ডিসকো ক্লাবে আসতে দেখেছিল সামাইরা। সেদিন থেকেই খোঁজ লাগিয়ে সব জানতে পারে সে। আর তার হাতে লাগে এই সুবর্ণ সুযোগ।তাইতো সে আগে থেকেই ম্যানেজারকে হাত করে রেখেছিল। ফুটেজ ওই ডিলিট করিয়েছিলো।আর আজ সেই ফুটেজ ব্যবহার করে সে আদিত্যকে ওই মেয়েটার নজরে চিরজীবনের জন্য ঘৃণার পাত্র করে দিয়েছে। সামাইরাকে উপেক্ষা করার শাস্তিতো তাকে পেতেই হতো। দ্যাট লাভ স্টোরি ইজ এন্ড নাও।
চলবে……