জোয়ার-ভাটা পর্ব-১+২

0
505

#জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১।

কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের ধারেই সব থেকে বড় আলিশান হোটেলের দশ তলার একটি ভিআইপি রুমের বিছানার উপর শুয়ে আছে সতের বছর বয়সী মার্জান। আলুথালু শরীর। পড়নের গাউনটা ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। গালের মাঝে পাঁচ আঙ্গুলে দাগ বসে আছে ওঁর। বড় ঘন কালো চুল গুলো স্পর্শ করছে ফ্লোরে বিছানো দামি কার্পেটের উপর। মার্জানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মধ্য বয়সী সুরভী। সম্পর্কে মার্জানের খালাজান। ঠোঁটের কোনে শয়তানি হাসি হাসচ্ছে। মার্জান এবার উঠে বসার চেষ্টা করলো। মাথাটা কেমন যেন রিমিঝিম করছে। সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে আবারো বোঝার চেষ্টা করলো নিজের অবস্থান।

” খা’লা’জান”

ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলে উঠলো মার্জান। সুরভী রহস্যময় হাসলো। বলল,

” হ্যাঁ খালাজান।”

বলেই কাছে এগিয়ে এলো মার্জানের। মার্জান শরীর থরথর করে কাঁপছে ভয়ে। কিছুক্ষণ আগেই সুরভীর হাতে থাপ্পড় খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো ওঁ। মার্জান বিছানার পিছনে সরে যেতে চাইছে, আবার বুঝি মারবে ওঁর খালাজান। বিশ্বাস হচ্ছে না মার্জানের ওঁর প্রিয় খালাজান ওঁকে মা’রতে চাইছে! সুরভী হাত ধরে ফেললো। মার্জানের প্রান পাখি যেন এবার উড়েই যাবে। মার্জান কম্পিত গলায় বলল,

” খা-লা, খালা,জান আমাকে ছেড়ে দিন! যেতে দিন। আমি মায়ের কাছে যাবো!”

সুরভী ঠোঁট বাকিয়ে ফেললো,
“যাবে তো অবশ্যই, আগে আমার কাজ হোক।”

বলেই হাতের ইনজেকশনটা পুশ করে দিলো মার্জানের শরীরে। মার্জান এক চিৎকার করে উঠলো।
মার্জানকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিলো সুরভী। এর পরেই ফোন দিলো কাউকে,

” কোথায় আছেন আপনি? আপনার জন্যই ওয়েট করছি। হ্যাঁ শরীরে পুশ করে দিয়েছি ঔষধ। আপনার খাবার একদম রেডী। কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। আপনি যতক্ষণে আসবেন ততক্ষণে কাজ হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ ওর কিছু লজ্জাজনক ছবি অবশ্যই তুলে আমাকে সেন্ড করবেন। আমি দেখাতে চাই আমার বোন-কে কতটা সতি-সাবেত্রী ওঁ। হ্যাঁ, হ্যাঁ চিন্তা করবেন না। আমার ভাগ্নী এখনো ভার্জীন। এখন-ও পুরুষ মানুষের স্পর্শ পড়েনি। সুন্দর গোলাপী তুলতুলে দেহ। পাগল হয়ে যাবেন একেবারে! হা হা হা। চলে আসুন জলদি।”

বলেই ফোন কেঁটে দিলো সুরভী। কার্লি চুল গুলো-তে হাতে আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিলো মার্জানের উপর। বলল,

” তোর মায়ের খুব অহংকার না তোকে নিয়ে? এবার কি করবে সে? মুখ কিভাবে দেখাবে সমাজে? চু চু চু।”

মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ বের করতে করতে হাসলো। এর পরেই বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো রুমটি থেকে। মার্জানের চোখ টলমল করছে। কাতরাচ্ছে বিছানার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। মার্জান দেহের বাকে বাকে এবার অসহায়ত্বের ছাপ। যেন কয়কশ পোকা কামড় বসিয়েছে দেহে। গলা শুকিয়ে আসছে। মার্জানের চোখের সামনে দুলছে সব। ঘোলাটে হচ্ছে চাহনি। নিজেকে শক্ত করতে পারছেনা কোনো মতেই। ওঁ এবার হাতরিয়ে হাতরিয়ে নেমে পড়লো বিছানা থেকে ওয়াইন কালার গাউনটা তুলে ধরে বেড়িয়ে পড়তে চাইতেই ঢুকে পড়লো এক থলথলে বিদ্ঘুটে দেখতে লোকটি। মার্জানকে দেখেই যেন হাতে চাঁদ পেল। কচি মেয়েদের প্রতি একটু বেশি-ই আসক্ত কি-না। মার্জানের হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে বুকের কাছে নিয়ে এলো । স্পর্শকাতর জায়গায় স্পর্শ পড়তেই যেন কারেন্ট লেগে গেলো ওঁর শরীরে। নিজেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। ছুটে পালিয়ে কোথায় লুকিয়ে পড়তে চাইলো। ইশ! এইটা যদি সিনেমা হতো? অবশ্যই টিবি ওফ করে দিতো মার্জান। ছোট থেকে এসব উৎপীড়ন থেকে বর্গমাইল দূরে রেখেছে মার্জানকে ওঁর মা টগর। অথচ? অথচ আজ এই অসভ্য লোকেদের হাতে পড়েছে মার্জান? মার্জান ফোপাঁতে লাগলো। জোড়ালো কন্ঠে সাহায্য চাইলো। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক যেন কাজ করাই বন্ধ করে দিচ্ছে মার্জানের। মার্জানের চোখের সামনে এবার ভেসে উঠলো ওঁর মায়ের মুখটি। সর্ব শক্তি দিয়ে এবার ধাক্কা দিলো লোকটিকে। লোকটি মুখ থুবড়ে পড়লো। এই সুযোগীই নেশাগ্রস্ত মার্জান এস্ট্রে তুলে নিলো। লোকটি কাছে আসতেই ধাম করে বাড়ি বসালো ওঁর মাথায়। লোকটি কককিয়ে উঠলো। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে পালাতে লাগলো মার্জান। ঢুলতে ঢুলতে এদিক সেদিক ছুটছে। পিছনে ছুটছে ওই লোকের বডি গার্ডরা। মার্জান আর পাড়ছে না। লুকিয়ে পড়বার জন্য প্রতিটি রুমে বাড়ি দিচ্ছে।

” প্লিজ হেল্প। খোলো, দরজা খোলো। আমাকে সাহায্য করো। খুলো প্লিজ। ”

কিন্তু দূর্ভাগ্য যাকে বলে? কেউ খুলছে না। মনে হচ্ছে এই ফ্লোরটি জন-মানব শূন্য। মার্জান এবার দাঁড়িয়ে পড়লো দেয়াল ঘেসে। ওঁর দিকেই আসচ্ছে লোক গুলো দেখতে পেয়ে ঢুকরে উঠলো। এ’টুকুন বয়সেই কি করবে ওঁ। নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলবে তাহলে মার্জান? মার্জানের এবার সারা শরীরে মনে হচ্ছে কি যেন কিড়মিড় করছে। ভিতর থেকে হয়তো কিছু একটা বেড়িয়ে যেতে চাইছে। আচ্ছা মার্জান কি মা’রা যাচ্ছে? মার্জান আর দৌঁড়াতে পাড়ছে না। একটি রুমের সামনে এসে থামতেই একটি হাত ওঁকে ধরে টান দিয়ে ঢুকিয়ে নিলো রুমটির ভিতরে। মার্জান এবার বোধ শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছে। কোনো এক অজানা পুরুষের বুকের সাথে মিশে যাচ্ছে। মার্জানের ছোট পাতলা হাতের আঙ্গুল গুলো দিয়ে স্পর্শ করছে ছেলেটির চোখ, মুখ, ঠোঁট আর খোলা বুক। যেন এতক্ষন পড়ে শান্তির একটি স্থান পেয়েছে। মার্জান বিড়বিড় করে বলল এবার,

“হেল্প, হেল্প মি।”

” কে তুমি? কি হয়েছে তোমার?”

ঝংকার তোলা পুরুষালি কন্ঠের ধীমী ধীমী আওয়াজ কর্ণপাত হলো শুধু। এরপরে আর কিছু মনে নেই মার্জানের।

সকালের মিষ্টি রোদ স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে ঢুকছে রুমটিতে। রোদের হলদে রঙ্গের আভায় সুন্দর দেখাচ্ছে মার্জানের মুখখানি। চোখ মুখে রোদ পড়তেই কুঁচকে ফেললো মুখ। বলল,

” আম্মু জানলা ওফ করো আমি আরো ঘুমাবো।”

বলে বালিশে আরো শক্ত করে মুখ গুঁজে ফেললো। ওঁর হাত কারো উপর পড়তেই চমকে গেলো সে। ফট করে চোখ খুলতে ঘাবড়ে গেলো। কারো চওড়া পিঠ দেখে অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো শরীর। চট জলদি নেমে যেতেই পৃথিবী ঘুরে উঠলো। পেটের পীড়ন আর মাথার তীব্র ব্যথায় মরেই যাবে ওঁ। ধীরে ধীরে রাতের কথা মনে করতে চাইলো। খালাজানের সাথে এসেছিলো এই জায়গায় ঘুরতে মার্জান। ওঁর কোনো এক বান্ধবীর মেয়ের জন্মদিন রেখেছিলো এখানে। মার্জান আসতে চায়নি। কিন্তু খালাজানের পীড়াপীড়ি আর ওঁর মায়ের কথাতেই এসেছিলো এখানে। অথচ আজ ওর সব থেকে বড়, নারীর অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললো? মার্জান পিছনে ফিরলো আবার। এই লোকটি তাকে বাঁচিয়ে ছিলো। অথচ মার্জান নিজেই নিজেকে সপে দিলো যুবকটির হাতে? মার্জান নিজেকে সামলে নিলো। নিজের সর্বস্ব হারিয়ে ফেললো। মার্জান আবারো ঢুকরে উঠলো। বাড়ি ফিরে কি বলবে ওঁ। কেউ কি বিশ্বাস করবে ওঁর কথা, ওঁর খালাজান ওঁকে সামান্য একটি লিড রোলের জন্য বিক্রি করে দিয়েছে? ভাবতে ভাবতেই নিজের কাপড় কুড়িয়ে পড়ে নিয়ে হোটেল থেকে বেড়িয়ে আসলো। বাড়ি ফিরতেই থমথমে পরিবেশের মুখে পড়লো মার্জান। এই বাড়িটি মুলত মার্জানের নানাজান তাহের শেখের বাড়ি। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন নানাজান। এতে বড্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলো তাহের শেখের দ্বিতীয় বিবি জোহরা শেখ। কিন্তু উনার মেয়ে আর মার্জানের মা টগরের ছিলো অনেক মিল। খালাজান ছিলেন এন্টারটেইনমেন্ট জগতের অংশ। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে নিজের লাবণ্যতা হারিয়ে ফেলাতে পর পর ছুটছে সব কাজ। আবার এ,দিকে সহজ সরল টগরের স্কীন তখন সুন্দর টান টান। যদিও মিডিয়া জগৎ থেকে উনি সব সময় দূরে থাকতেই পছন্দ করেন। তবে এ বাড়িতে কোনো ডিরেক্টর, প্রোডিউসার এলেই ৩৫ বছরী টগরকে নায়কার রোলের জন্য ওফার করে যায়। কিন্তু টগর তাতে নারাজ। তবে এসবের প্রতি ঝোঁক ছিলো মার্জানের। ছোট থেকেই কয়েকটি ছবিতে শিশু চিত্রে ছবি করেছে ওঁ। এদিকে সুরভীর হাজবেন্ড দিন রাতে গুন গান করতো টগরের। সুরভীর নিজের-ও একটি ১৫ বছরের মেয়ে আছে। যাকে এখন পর্যন্ত পারেনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি-এ ঢুকাতে। এসব কিছু মিলে মনের কোনো বড় ধরনের ষড়যন্ত্র করে ফেললো সুরভী। অন্ধকার জগতে ঠেলে দিতে চাইলো মার্জানকে। কিন্তু এখানে ওঁর দোষটা কই?

মার্জানের নানাজান এবার মুখ খুললেন,

“কোথায় ছিলি!”

মার্জান ছোট থেকে ভয় পায় ওঁর নানাজানকে। এই এলাকায় তাহের শেখকে সবাই সম্মান করেন। অন্যায়কে উনি কখনোই প্রশ্রয় দেন না। আর আজ নাতনী সারা রাত বাহিরে পার করে এসেছে? এইটা কি অন্যায় নয়? মার্জান ডাগর ডাগর আঁখি মেলে চাইলো। কিশোরীর মুখে ভয়ংকর রাতটির ছাপ স্পষ্ট।
গর্জন করলেন এবার নানাজান,

” কথা বল!”

মার্জান ভয়ে ভয়ে মার দিকে চাইলো। ওঁর মা কাঁদছে। সুরভী পাশেই সান্ত্বনার ভঙ্গিমা করে হাসছে মার্জানের দিকে তাকিয়ে। মার্জান ভাবলো, এখন যদি মরে যেতো। উড়ে যেত প্রাণ পাখি। মার্জানের বড় বড় চোখ দিয়ে বড় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। কাঁপা কন্ঠে বলল,

” খা-লা-জা-ন..”

বাকিটুকু বলার আগেই লাঠির বাড়ি পড়লো পিঠে। “আহঃ “করে বেড়িয়ে এলো চিৎকার। তাহের শেখ লাঠি দিয়ে নাতনীকে আঘাত করে যাচ্ছেন। রাগে গজগজ করে বলছেন,

” বল.. কোন জানোয়ারের সাথে রাত কাটিয়ে এসেছিস? বল?”

মার্জান আর কিছু বলার মতো অবস্থায় রইলো না। রাতের ঘটনা আর সকালের এই মা’রের পর আর কিভাবে সইবে বাঁচ্চা মেয়েটি? কিভাবে পাড়বে, নিজের সত্যিটা তুলে ধরতে।

” আমি-তো আগেই বলেছিলাম, দুধ-কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছো। কে শোনে কার কথা? এবার বুঝো, এলাকায় কি মুখ থাকবে এবার? আঙ্গুল তুলে কথা বলবে সবাই!”

মার্জান এবার চেঁচিয়ে উঠলো,

” আমি অন্যায় কিছু করিনি নানাজান। আমি কিছু করিনি আমাকে মে’রো না।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা? এদিকে টগর চিৎকার করছে,

” বাবা ছাড়ো ওকে আবার বাচ্চা মেয়েটা সইতে পারছে না।”

টগরকে ছাড়ছে না সুরভী। আনন্দ পাচ্ছে ও পৈশাচিক আনন্দ।

এদিকে নানাজান মুখে যা আসচ্ছে বলে যাচ্ছে। এক পর্যায় হতভম্ব হয়ে যায় নানাজানের কথা মার্জান। নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কমে যায় ছটফটানি।

“রক্তের ধারা তো আর ছাড়বিনা? নষ্ট খুন নষ্টামিই করতে জানে! ময়লা পানিকে তুলে যতই কাজের পাত্রে রাখা হোক। পাত্রের বাকি পানিতো ঘোলা হবেই।”

তাহের শেখের শেষ কথা গুলো টগর আর মার্জানেন বুকে গিয়ে বিধলো সুচের মতো। মুহূর্তই স্তব্ধ হয়ে গেলো চতুর্দিক। স্তব্ধ হয়ে গেলো হল ঘরটির হাওয়া। বাক্য হারিয়ে চেয়ে রইলো টগর ওর কলিজার ধনটির দিকে। মেয়েটি কাঁদছে। মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।

কি হবে এবার মার্জানের? সুরভীকে ভুল প্রমাণ করতে পাড়বে ওঁ? যে দাগ বসেছে ওর নারীত্বতে তাকি মিটাতে পাড়বে ওঁ?

চলবে,

#জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২।

সকালের মিষ্টি রোদ এখন আর নেই। অভিমানী কিশোরীর মতো তপ্ত হয়েছে রোদের তেজ।হোটেল রুমটির বড় জানালার পর্দা গুলো ফরফর করে উড়ছে। সটান খুলে থাকা জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে আলো-বাতাস। এই রুমটির বাহির থেকে দৃশমান সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসচ্ছে সাথে। বিছানায় শুয়ে থাকা দীর্ঘকায় যুবকটির ঘুম এবার ভেঙ্গে গেছে। মাথা তুলতেই কাল রাতের মেয়েটিকে আর দেখতে পেলো না ওঁ। কিন্তু মাথা কাছে মেয়েটি বেসলেট ফালিয়ে গেছে। মুখ বাকালো যুবক। এক পলক তাকিয়ে অন্য দিকে ফিরে আবার শুয়ে পড়লো যুবকটি ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে।

বিকেল প্রায় শেষ ভাগ।সাঁঝ নামবে বলে। প্রভাতের সাথে সাথে ক্ষীপ্ত হতে থাকা সূর্যী মামার মেজাজ এবার কিছুটা শীতল। পুরো শহরে লালিমা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে, তন্ময় হয়ে দেখছে ওঁর বিদায়। টগর মেয়েকে জড়িয়ে বসে আছে। চোখে এখন পানি। মেয়েটিকে ওঁর বাবা কুকুরের মতো মে,রে,ছে।যে কারো দেখলেই মায়া লাগবে। টগর মার্জানের মুখটি উপড়ে তুললো। মার্জানের চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে।নিজেকে মা ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে টগরের। আজ যদি ওঁর নিজের বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে কি এমন হতো? বাবা কি দিতো? এত এত সব অন্যায় হতে নিজের মেয়ের উপর? মার্জান এবার মুখ খুললো,

” মা তোমার-ও কি মনে হয়? আমি এমন কিছু করেছি?”

টগর মার্জানের চুল গুলো বিলি কেঁটে দিলো। কঁপালে চুমু খেয়ে বলল,

” আমার পুরো ভরসা আছে তোমার উপর! ”

মার্জান ফিকে হাসলো।ম্লান মুখটায় কতটা মায়ায় জড়িত। আবার বলল,

” মা? তোমার কাছে-ও কি আমাকে নষ্ট রক্তের মনে হয়?”

টগর হতবুদ্ধি। মেয়েকে কাছে টেনে শক্ত করে আবার জড়িয়ে ধরলো,

” নাহ্! তুমি আমার মেয়ে। আমার রক্ত! আমার রক্ত কখনো খারাপ হতে পারে না!”

মার্জান এ পর্যায় ফুপিয়ে উঠলো। মায়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে সব কষ্টের বিসর্জন দিতে চায়।

কয়েকটি পায়ের শব্দে ভঙ্গ হয় মা-মেয়ে সুন্দর মুহূর্তটুকু। দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে আসে ২৩ বছরের সুদর্শন যুবক ভাদ্র। ভাদ্র হচ্ছে মুলত মার্জানের ফুপির ছেলে। পড়াশোনার পাশা-পাশি বাবার ব্যবায় ও চলচ্চিত্র জগৎ প্রডিউসার হিসেবে কাজ করে -ওঁ। মার্জানের সাথে বিয়ে দেয়ার খুব শখ ছিলো ওর ফুপির। দু’পরিবারের মানুষজন এতে রাজি। কথা ছিলো মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হলে আকাদ করে। কয়েকবার ডেটে-ও গেছিলো ওঁরা। কিন্তু মার্জান ভাদ্রকে তেমন একটা পছন্দ করে না। ওর থেকে এড়িয়ে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ভাদ্রের পিছন পিছন চলে আসে মার্জানের খালাতো বোন রিয়ানা। ভাদ্রকে দেখে হেসে সমর্থন করে টগর,

” ভাদ্র এসে না। বসো!”

ভাদ্রকে চিন্তিত দেখালো মার্জানের এই অবস্থা দেখে। আজ সকালেই বিজনেস ট্যুর থেকে ফিরে এক পলক মার্জানকে দেখবে বলেই ছুটে এসেছিলো। ভাদ্র মার্জানের কাছে গেলো। মার্জানের সুন্দর গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ দেখে শিউরে উঠলো। চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

” আন্টি? ওঁর কি হয়েছে?”

টগর চুপ করে রইলো জবাব দিলো না। এদিকে মার্জান নিজের মুখটা ভাদ্রের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ভাদ্র এই রিজেকশন দেখে বার বার অপমানিত মনে করে নিজেকে। যে মেয়েটিকে ওঁ ভালোবাসে, যে মেয়েটির সাথে সময় কাঁটাতে চায় সে মেয়েটি কি-না ওকে পাত্তা দেয় না? মুহূর্তে পরিবর্তন হয়ে গেলো মুখের রং। হাতের মুঠ শক্ত করে তাকিয়ে রইলো মার্জানের নিচু করে রাখা মুখটির উপর।

” তোমরা বসো, আমি কিছু খাবার পাঠাচ্ছি।”

বলেই টগর বেড়িয়ে গেলো।

যাওয়ার আগে রিয়ানাকে ইশারা করে গেলো বাহিরে আসতে। কিছুটা সময় তাদের একা দিতে চায়। রিয়ানার এতে বেশি একটা খুশি বলে মনে হলো না। টগরের পিছন পিছন মুখ গোঁজা করে চলে গেলো।
ভাদ্র নিজের রাগ কন্ট্রোল করলো। মুখের হাসির রেখা ফুটিয়ে, প্যাকেট থেকে একটা বক্স বের করলো।

” মার্জান দেখো আমি এবার ট্যুর থেকে ফিরবার সময় প্যারিস থেকে এই ডায়মন্ডের ন্যাকলেস নিয়ে এসেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে?”

বক্সটি খুলে দেখালো ভাদ্র। কিন্তু মার্জানকে এ-দিকে খেয়েল করতে না দেখে রাগ এবার আর সামলাতে পাড়লো না।

” মার্জান তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেয়ে কি বোঝাতে চাইছো বলবে? ”

মার্জান কিছু বলছে না। আসলে ওঁর শরীরটাই ভালো লাগছে না। কাল থেকে নিজের উপর এত ধকল গেছে যে এখন আর এসবে এনার্জি পাচ্ছে না, না ইন্টারেস্ট। কিন্তু এই ছেলেটাকে ও কি করে বোঝাবে?

মার্জানকে এবারো কোনো কথা বলতে না দেখে দু বাহু চেপে ধরে বিছানা থেকে নামায় ভাদ্র। নিজ বরাবর দাঁড় করিয়ে চোখ রাঙ্গালো ওঁ।

” আনসার মি ডেম এইড।”

মার্জান কুকিয়ে উঠলো ব্যথায়। ওঁর সারা শরীরে মা’রের দাগ গুলো তাজা। তারউপর চাপ লাগতেই জীবন যেন বেড়িয়ে যেতে চাইছে। ভাদ্র বুঝতে পেরে ছেড়ে দিলো,

” সরি, সরি মার্জান। আ’ম সরি। রাগ উঠে গেছিলো খুব। বলো না প্লিজ এসব কে করেছে? কেন করেছে? আমার কি জানার অধিকার নেই বলো? আফটার ওল আমি তোমার উড বি।”

মার্জানের এবার চোখে জল ভরে উঠলো। বলতে চায় তো সব! কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করবে ওঁর কথা? কেউ কি বিশ্বাস করবে ওঁ নির্দোষ। নিজের বাগদত্তা হিসেবে ভাদ্র সত্যি মেনে নিবে ওঁর অন্য কারো সাথে রাত কাঁটানোর কথা? মার্জান এখন একটি শক্ত হাত চাইছে। যেটা ধরে সে নিজেকে সামলাতে পারবে। মার্জান বুকে সাহস যুগিয়ে বলল,

” খা’ লা জান, খালাজান আমাকে নেশার কোনো ঔষধ……”

” কাল দিদুভাই সারারাত বাড়ি ফিরেনি ভাদ্র ভাইয়া। তার উপর দিদুভাইয়ের গলায়, ঘারে লাল,লাল দাগ আর দিদুভাইয়ের কিছু অবাঞ্ছিত ছবি দেখে নানাজান মেরেছে দিদুভাইকে!”

গলাটা ছিলো রিয়ানার। হাতে খাবারের ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। রিয়ানা মুখ মিষ্টি-ধূর্ত মেয়ে। ঠিক মায়ের মতোই চালাকচতুর। ভাদ্রকে পছন্দ খুব এই ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর। মার্জানের মতো সুন্দরী না হলে-ও কম সুন্দর নয় ওঁ। তবে বয়সের তুলনায় দু’এক বড় মনে হয় ওঁকে। সুরভীর মুখে আদল খানি বসানো যেন। মায়ের মতোই মুখে মধু অন্তরে বিষ। মার্জান এবার চেঁচিয়ে উঠলো,

” আমি কিছু করি-নি। সব খালা’জান….!”

‘ঠাস’ করে একটি শব্দ হলো। মার্জান ছিটকে পড়লো বিছনায়। ভাদ্র চোখে জোড়া লাল হয়ে গেছে। মাথার রগ ফুলে গেছে। শক্ত হাতে টেনে তুললো ওঁকে। গগনবিদারী চিৎকার করে বলল,

” এই-এই জন্য-ই বুঝি আমাকে তোমার কাছে আসতে দাও নি? বলো! বলো মার্জান!”

মার্জানের গাল টন টন করছে ব্যথায়। হাতে কব্জিতে এভাবে ধরাতে ব্যথা করছে খুব। মার্জানের এবার সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করলো। এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা বুঝি খুব কষ্টের? মার্জান এবার মুখ ফুঁটে আর একটি শব্দ উচ্চারণ করতে চাইছে না। ভাদ্র আবারো গায়ে হাত তুলতে নিতেই মার্জান সরে এলো। নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলো,

” ব্রেকআপ!”

ভাদ্র চিৎকার করে উঠলো,

” মার্জান।”

মার্জান এবার আর কিছু বলল না। চুপ করে রইলো। এদিকে রাগে গজগজ করতে করতে ভাদ্র বেড়িয়ে গেলো। এদিকে রিয়ানার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলো।

সপ্তাহ পাড় হলো। মার্জান এখন সুস্থ হলেও। নিজ রুম থেকে বের হয় কম। কিভাবে বের হবে ওঁ? বের হলেই এই বাড়ির মানুষের ঘৃণিত নজরে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। নানাজানের তিক্ত কথায় গলা দড়ি দিতে ইচ্ছে করে। এদিকে ভাদ্র আজ ক’দিন যাবৎ কোনো খবর নেই। হয়তো মার্জানের দেহে পড়া অদৃশ্য দাগের জন্যই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে?

পাখি কিচিরমিচির করছে। কড়া রোদ করছে বেলকনির অপরাজিতা গাছটির উপর। থেকে নরছে মৃদুমন্দ হাওয়া গাছের পাতা আর মার্জানের খোলা কেশ। মার্জানের হাতে একটি বই। পড়ছে খুব মুগ্ধ হয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ি সামনে এসে দাঁড়ালো পর পর তিনটে গাড়ি। ভ্রুযুগল কুঁচকে চাইলো ওঁ। চোখ কঁপালে তুলে তাকিয়ে রইলো মার্জান,

“ফুপিজান!”

বড় বড় থালা হাতে ফুপিজান ঢুকলে বাড়িতে। মার্জান এর কৌতুহল বাড়লো। নিচে নেমে যেতেই মুন্তে পেলো,

” আঙ্কেল আমি ভাদ্রের জন্য মার্জানকে চাইতে এসেছি। ”

তাহের শেখের মুখ থেকে মেদুর ছায়া মিলিয়ে গেলো। খুশি খুশি রাজি হয়ে গেলেন তাহের শেখ। খুব চিন্তিত ছিল এই নষ্ট মেয়েটিকে নিয়ে। এবার ঘাড় থেকে নামবে। ভেবে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ঠিক হলো আজ থেকে এক মাস পড়েই মার্জানের বার্থডেতে আকাদ নয় সরাসরি বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। মার্জান এসব শুনে জামার কোনা শক্ত করে চেপে ধরলো। সত্যি কি ভাদ্র এসবের পর বিয়ে করতে চাইছে? নাকি এ-র পিছনে আছে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র। কেন করছে ভাদ্র এমন? আবারো কোনো ফাঁদে পড়ছে না_তো মার্জান?

চলবে,