#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩১
#আফনান_লারা
________
‘কি জন্য ডাকলি সেটা বল,আমার অনেক কাজ আছে’
‘ওমা তাই নাকি?তাহলে আর কি করার!কাজেই যাও।ভাবলাম সারথি আপুকে তোমার হাতের সেমাই খাওয়াবো।তোমার যেহেতু সময় নেই,তবে যাও’
আনাফ হেসে বললো,’আগে বলবিনা!!তুই না বললেও আমি যাইতাম সেমাই বানাইতে।আমার নিজেরই খেতে ইচ্ছে করছিল।’
অধরা তখন তাচ্ছিল্য করে বলে,’তোমার না কত কাজ?’
‘কাজ পরে আগে সেমাই’
এটা বলেই আনাফ চললো রান্নাঘরের দিকে।
অনেকক্ষণ ধরে খালি ঠুসঠাস করে যাচ্ছে।অধরা বললো ভাইয়া রান্নাঘরের এমন অবস্থা করবে বুয়ার সেটা পরিষ্কার করতে নাকি দুইদিন লেগে যায়।
এই কথা শুনে সারথি বললো সে যেন গিয়ে আনাফকে থামতে বলে,সেমাই খাওয়ার দরকার নাই,
কিন্তু কে শোনে কার কথা।অধরাও যায়নি আর আনাফও তার রান্না করা থামায়নি।
এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর সেমাই টেবিলে এনে আনাফ ওদের ডাক দেয়।অধরা সেই কবে থেকে বসেছিল একটা ডাকের।
ডাক শুনেই ছুটে আসলো।এসেই খেতে বসে গেছে,সারথি দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে তখনও।আনাফ ওর জন্য সেমাই বাটিতে নিয়ে বললো এসে বসতে।পরে নিজেই অধরাকে খোঁচা দিলো গিয়ে ওকে নিয়ে আসার জন্য।অধরা খাওয়া রেখে উঠে গিয়ে সারথির হাত ধরে টেবিলের কাছে নিয়ে আসলো।
চেয়ারে বসে বাটি হাতে সেমাই মুখে দিয়ে সারথি জানালো অনেক মজা হয়েছে।এই কথা শুনে আনাফ তো গলে শেষ।তার গলে যাওয়া সারথি না দেখলেও অধরা ঠিকই দেখেছে।এবং সে দাঁত কেলিয়ে বলে দিলো,সারথি আপু তোমার হবু বর তো গলে পানি হয়ে গেছে গো!!’
——-
তিনজনের সেমাই আড্ডা বেশ জমে গেলো।সেমাই খাওয়ার সাথে সাথে অনেক গল্প করেছে তারা।বেশির ভাগ ছিল আনাফের কলেজ লাইফের গল্প।তারপর অধরার গল্প।মাঝখান দিয়ে সারথি তার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো গল্প শেয়ার করেনি।যার জীবনটাই বিষাদে ভরা তার আবার কিসের সুন্দর সুন্দর ঘটনা!
অধরার পরীক্ষা বলে সে খুব বেশি সময় ধরে গল্প করেনি।উঠে চলে গেছে মাঝ পথেই।সারথি ও উঠতে চাইছিল কিন্তু আনাফ বললো আরেকটু বসতে।সজীবকে নিয়ে তার কিছু কথা আছে সারথির সাথে।
‘বলুন কি জানতে চান!’
‘সজীব কি আপনাকে আপনার দূর্বলতার কারণে ভালবাসেনা?নাকি সত্যি সে ৩য় ব্যাক্তিতে আসক্ত?’
‘দূর্বলতার কারণেই তো মানুষ ছোট হয়ে থাকে,ওপারের মানুষটা তখন আরও একজনকে জীবনে আনতে আর ভাবেনা।আমার সাথেও তেমন হলো’
‘সজীব ডিভোর্স দিবে সত্যি?’
‘হ্যাঁ,উনি না দিলেও আমি দিয়ে দিবো।যেখানে সত্যিটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে সেখানে আর কি জোড়া লাগানোর আছে?’
‘আপনার কি মনে হয়না আপনার আর সজীবের একান্তে আলোচনা করে সব ঠিক করে নেয়া উচিত?’
‘না মনে হয়না।যে মানুষটা বিয়ের পর থেকে আমার পাশে বসে দু মিনিট সময় কাটায়নি সে এখন ডিভোর্স হওয়া নিয়ে সময় কাটাবে?দরকার বলে মনে করিনা’
‘ডিভোর্সের পর কি করবেন?’
‘নাচবো!আপনার কোনো সমস্যা আছে?’
‘রাগ করেন কেন?আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করলাম’
‘এত জানার প্রয়োজন নেই।’
সারথি এবার রেগে গিয়ে উঠে চলে গেছে।আনাফ গালে হাত দিয়ে ভাবছে যেটার জন্য সজীবের টপিক উঠিয়েছিল সেই কথাটাই বলা হলোনা।ধুর ধুর!!
ভেবেছিল সজীবের চ্যাপটার শেষ করে বলে ফেলবে সে সারথিকে বিয়ে করতে এক পায়ে খাড়া।তা আর বলাই হলোনা।মেয়েটা হুটহাট এত রেগে যায়!!
————
ফারাজদের ছুটতে ছুটতে সন্ধ্যা নেমে গেছে।শহরে সন্ধ্যা নামতেই বসে আলোর মেলা।ফুটপাত দিয়ে চলার পথে ফারাজ পূর্ণতা হঠাৎ হেসে ফেললো,বিশ্বজয়ের হাসি।
হাসি মুখে ফারাজ জানালো শত কষ্ট শেষে তারা জিতে গেছে।
কিন্তু পূর্ণতা মুখ আবার ফ্যাকাসে করে বললো,’যদি বাসায় গিয়ে দেখি আজিজ দাদু সেখানে গিয়েও হাজির।তখন?’
‘আজ ফিরবেইনা।আনাফ ভাইয়ের বাসায় থেকে যাবো’
‘এভাবে বললেই কারোর বাসায় থাকা যায়?’
‘সারথি যদি থাকতে পারে,তবে আমরাও পারবো।বেশি কথা না বলে পথ চলুন। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বাস ধরতে হবে।রাত ন’টার আগে পৌঁছাতে পারলেই হলো।’
কথা শেষে দুজনে হাঁটার গতি বাড়িয়ে একটা বাসে উঠে পড়ে।সেই আগের মতন সবার পেছনের সিট।পূর্ণতা জানালার কাছে বসে মুখ ভার করে রেখেছে।গরমে তার কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে কিন্তু ফারাজের কারণে একটুখানিও জানালা খোলার সাহস পাচ্ছেনা সে।
বাস এবার জ্যামে পড়েনি,এক টানে সাইনবোর্ড নিয়ে এসেছে।ভাঁড়া দিয়ে দুজনে আনাফের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী নামলো।সমস্যা হলো একই রকম দেখতে দুটো বাড়ি।কোনটাতে আনাফ থাকে!
ফারাজ ফোন নিয়েছে ওকে কল করার জন্য দেখলো ফোন অফ হয়ে আছে।অনই হচ্ছেনা, অন না হলে নাম্বার নিয়ে পূর্ণতার ফোন দিয়ে যে কল করবে সেই উপায় ও নেই।কি মুশকিল!
ফারাজ পূর্ণাকে দাঁড় করিয়ে একটু সামনের দিকে গিয়ে একটা লোককে জিজ্ঞেস করলো ২০৩ নাকি ২০৪ নাম্বার বাসা আনাফের।
লোকটা ফারাজের কথা শুনে বললো,’আনাফ কেডা?’
ফারাজ এবার তাকে ছেড়ে আরেকজনের কাছে জানতে চাইলো আনাফের বাসা কোনটা।
লোকটি বললো,’ডাক্তার আনাফ?’
‘হ্যাঁ,হ্যাঁ’
‘ঐ তো নীল রঙের বাড়িটা’
‘ভাই ওখানে তো নীল রঙের বাড়ি দুইটা’
‘নাম দেখেন’
‘নাম থাকলে তো হতোই।নাম নেই বাড়ির’
লোকটা মাথা চুলকে বললো,’যে বাড়ি দেখলে ডাক্তার ডাক্তার ফিল আসবে সেটাই আনাফের বাড়ি হতে পারে’
ফারাজ কপাল চাপড়ে পূর্ণতার কাছে ফিরে এসেছে।ও বললো এমন খোঁজাখুঁজি না করে তারা বরং দুটো বাড়িতেই গিয়ে দেখবে কোনটা আনাফের।
তাই প্রথম যে বাড়িটা আছে ওরা আগে ওটাতেই গেলো।কলিংবেলে চাপ দেয়ার পাঁচ মিনিট পর দরজা খুলেছে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে,তার হাতে টেডি বিয়ার।
ফারাজ আর পূর্ণাকে দেখে সে বললো,’মাম্মা পাপা ঝগড়া করতেছে,কি চাই তুমাদের?’
‘এটা কি আনাফের বাসা?’
‘আনাফ চাচ্চু?পাশের বাসা তাদের।এটা তো আমাদের বাসা’
ফারাজ এবার বুঝে গোছে তারা প্রথমটাতেই ভুল এসেছে।চট করে পাশের বাসার দিকে ছুটলো দুজন। গিয়ে কলিংবেলে চাপ দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
অনেকক্ষণ পর আনাফের বাসার বুয়া এসে দরজা খোলে।ওদের দেখে হাসিমুখে ভেতরে আসতে বলে চলে গেছে।
ফারাজ সারথিকে খুঁজতে খুঁজতে ভেতরে ঢুকে গেলো।
কাউকে না দেখে একবার সারথির নাম ধরে ডাকলো সে।ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ ভেসে আসলোনা দেখে দুজনে চুপচাপ সোফায় বসে।বুয়া গেছে মনে হয় তাদের ডাকতে।বেশ কিছু সময় পর আনাফ হন্তদন্ত হয়ো ছুটে আসলো ফারাজকে দেখতে।ওকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে হাত মিলালো দুজন।
‘জানো!তোমার বোন আবারও এক্সিডেন্ট করতে গেছিলো।সেই আগের মতন আবারও বাঁচিয়ে ফেললাম।তারপর ভাবলাম আমার বাসায় নিয়ে আসি।ওনার এখন মানসিক ভাবে সুস্থ হতে হবে।এই বাসায় আমার ছোট বোন আর বুয়া থাকে।একেবারে সেফ ওনার জন্য।আমি থাকি ঢাকর বাসায় আম্মুর কাছে।’
‘ও কেমন আছে ভাই?’
‘ভালো আছে,হয়ত রাগ তোমার উপর।গিয়ে কথা বলতে পারো।সোজা গিয়ে ডানের রুমটা’
ফারাজ চট করে উঠে চলে গেলো সেদিকে।পূর্ণতা ও পিছু পিছু আসছে।তবে সে রুমে ঢোকেনি, দূর থেকেই দেখছিল।
ফারাজ পা টিপে টিপে কাছে এসে সারথির কপালে চুমু দিতেই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো।ফারাজ এবার ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,’মাফ করে দে সারথি।আর হবেনা কোনোদিন’
সারথি চুপ করে আছে,ফারাজ এবার ওর কোলে মাথা রেখে বললো,’একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবিনা?জানিস কত কষ্টে তোকে পেয়েছি?আমার তো জান বের হয়ে আসছিল’
সারথির নিরবতা বলে দিচ্ছে তার রাগ সহজে ভাঙ্গবেনা।ফারাজ অনেকক্ষণ ওর কোলে মাথা দিয়ে ছিল তাও কোনো নড়চড় না দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি কি চলে যাব?তুই এটাই চাস?’
সারথি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি, ছেড়ে দিয়েছে অশ্রুর ঢল।ফারাজ আবারও ফ্লোরে বসে ওর চোখ মুছতে মুছতে বললো,’দাদাজান আমাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।কাল থেকে দুটো মেয়ের ব্যবস্থা ও করে ফেলেছেন।একটাকে দেখিয়ে দিছেন।আজ আরেকটা আসার কথা ছিল।খুব ব্যস্ত ছিলাম।আমাকে মেয়েদের মতন সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে যেতো।তুই তো জানিস জীবনে আমি রঙচটা কিছু পরিনা।আর দাদাজান আমায় সাদা পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে রঙিন পাঞ্জাবি পরিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে মেয়ে পক্ষের সামনে।
এত শত ঝামেলায় আমার মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গেছিলো তুই বাসায় নেই।পরে একবার মনে হলো তুই বুঝি আমাদের সাথে রাগ করে সজীব ভাইয়ার বাসায় চলে গেছিস।এর বেশি মাথায় আসেনি তুই যে নিজরে বিপদ ডেকে আনতেই বেরিয়েছিলি’
সারথি কান্না থামিয়ে আবার নিরব হয়ে আছে।পূর্ণতা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভাইবোনের এই মূহুর্ত দেখে কান্না করছিল।সে আবার সারথির মতন করে নিঃশব্দে কাঁদতে পারেনা,ভ্যাঁ ভ্যাঁ করেই কেঁদে দিয়েছে।তার কান্নার আওয়াজে ফারাজ,সারথি একসাথে চুপ হয়ে গেছে।
আনাফ পেছন থেকে টিস্যুর বক্স নিয়ে এসে ওর হাতে দিলো।দিয়ে বললো,’ভাবী চোখ মুছেন’
পূর্ণতা চোখ মুছতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো আনাফ তাকে ভাবী বলেছে।মুখ তুলে কাঁদো কাঁদো স্বরে সে বললো,’ভাবী?আমি আপনার ভাবী হলাম কবে?’
‘সারথির ভাবী মানে আমারও ভাবী’
‘মানেহ!সারথি আপুর ভাবী হলাম কবে?’
‘ওমা!সারথি তো বললো আপনার সাথে ফারাজ ভাইয়ের ইটিসিটি ‘
‘ইটিসিটি কি?’
‘প্রেম-সেম আর কি’
‘এগুলো সারথি আপু বলেছে?’
‘হ্যাঁ,নাহয় বলুন আমি আর কার থেকে জানবো?’
পূর্ণতা নাক মুছতে মুছতে ফারাজের কাছের দিকে গেলো।ফারাজ উঠে দাঁড়িয়ে ওকে ইশারা করে বললো রুম থেকে যেতে।সারথির সাথে ওর আরও কথা আছে।
‘আরে আমার জরুরি কথা আছে শুনুন’
‘আপাতত সারথির চেয়ে জরুরি বলে আমার কাছে আর কিছুই নেই।’
সারথি সেসময় ঘুরে বললো,’পূর্ণাও এসেছে?’
‘হ্যাঁ।জোর করে এসেছে।নাহলে আমি জেনেবুঝে কেন ঘাড়ে করে একটা বোঝা নিয়ে আসবো?’
‘আমি বোঝা?জানো আপু!তোমার ভাই এত ন্যাকামি করে!বাসের জানালা খুলতে দেয়না আমাকে’
সারথি হেসে বললো ওর হাঁপানির সমস্যা আছে।
‘ভাল হয়েছে আমি শুরুতেই ওনাকে বিয়ে করতে না করে দিয়েছি তা নাহলে বাসর রাতে বলতো,’পূর্ণা আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে।ইনহেলার আনো’
আনাফ কথাটা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো।সারথিও হাসছে।মাঝ দিয়ে ফারাজ রেগে গিয়ে বললো,’ম্যাচিউর মানুষদের সামনে এগুলো কোন ধরনের কথাবার্তা? ‘
‘আমিও তো ম্যাচিউর’
‘বয়স বাড়লেই ম্যাচিউর বলেনা।বয়স যে বেড়েছে তা কথাবার্তায় প্রকাশ পেতে হয়।আর আপনি যে উজবুক তার প্রমাণ দিলেন আজকে’
পূর্ণতা আরও কিছু বলতে চাইলো ওমনি সারথি ধমক দিয়ে ফারাজকে বললো,’শুরু থেকে দেখছি পূর্ণতাকে অপমান করে কথা বলিস।ও আমাদের আত্নীয় এবং মেহমান।সুন্দর করে কথা বলবি এখন থেকে’
‘বেশি সুন্দর করতে গেলে দেখা গেলো দাদাজান ধরে বিয়ে পরিয়ে দেবেন,আজ একটুর জন্য কাবিন হয়ে যেতো’
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩২
#আফনান_লারা
________
সারথি হাত বাড়িয়ে ফারাজের হাতটা খুঁজে বের করে ধরে মুচকি হেসে বলো,’মন্দ কি?পূর্ণতা কিন্তু দারুণ একটা মেয়ে’
‘সব দারুণ ফারাজের কেন হবে?’
কথাটা বলে ফারাজ চলে গেছে।পূর্ণতা মুখটাকে যতটা বাঁকাতে পেরেছে বাঁকিয়ে রেখেছে।সারথি না দেখলেও আনাফ তা দেখে হেসে বললো,’দুজন দুজনের প্রতি এত ঘৃনা রাখা ঠিক না ‘
‘কেনো?’
‘ঘৃনায় ঘৃনায় কাটাকাটি হয়ে প্রেম হয়ে যায়।জানেননা?বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত ‘
পূর্ণতা বিষয়টাকে তুচ্ছ হিসেবে ধরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেছে।সারথি হাসতে হাসতে পিছিয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে।আর একটু গেলেই পিঠে ধাক্কা খাবে ওয়ারড্রবের সাথে।ঠিক সেসময় আনাফ হাত রেখে ফেললো সেখানে।
পিঠ লাগতেই সারথি টের পায় আনাফ আগলে রাখার জন্য হাত বাড়িয়ে রেখেছে।সে সরে দাঁড়িয়ে মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো,’আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে’
‘নির্দ্বিধায় বলতে পারেন,আমি শুনছি’
‘আমার আর সজীবের এখনও ডিভোর্স হয়নি।আমরা আইনত স্বামী স্ত্রী। অথচ আমি একটা অবিবাহিত ছেলের বাসায় থাকতে এসেছি এটা সমাজকে না দেখালে হয়ত দেখবেনা,কিন্তু আমি তো দেখছি।আমার বিবেক বোধ তো তা করতে দেবেনা আমায়,আর আমি চাইওনা সেটা।আমি ফারাজের সাথে ফিরে যেতে চাই।আপনার কি মত?’
আনাফ হাতটা যেভাবে ওয়ারড্রবে লাগিয়ে রেখেছিল সেভাবেই রেখেছে।সারথির বিরাট বড় ভাষণ শুনে একটু একটু করে সারথির একেবারে কাছে ঘেঁষে দাঁড়ায় সে।
গোসল করে আতর লাগিয়েছিল।সারথি সেই আতরের গন্ধটা তীব্র আকারে পাচ্ছে এখন ।সে বুঝে গেছে আনাফ তার একদম কাছে তাও সে যে জায়গায় ছিল সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।আনাফ এবার গলার আওয়াজ হালকা করে বললো,’একদিন আমার এই হাতে এই পিঠটাই ইচ্ছাকৃত লাগবে।সেদিনের অপেক্ষায় আপনাকে যাবার অনুমতি দিলাম।সাবধানে যাবেন,তবে আর একদিন যদি শুনি সুইসাইডের চিন্তাভাবনা করেছেন তবে সেই মূহুর্তে সজীবকে কল করে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করে,ওকে আনিয়ে ডিভোর্স করিয়ে আপনাকে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসবো।এটা আমার শেষ কথা।আপনি সজীবের না,আপনি আমার।ডাঃ আনাফের উড বি।এখন যান’
আনাফ চলে গেলো।সারথি রোবটের মতন দাঁড়িয়ে আছে শুধু।একটা মানুষকে বিয়ের পর থেকে হাজার হাজার চেষ্টা করেও সে ধরে রাখতে পারেনি আর এই মানুষটাকে কিছু না করেও নিজের করে পেয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
আনাফ ফারাজ পূর্ণতার কাছে না গিয়ে করিডোর ঘেঁষে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলেছে।সারথির হুশ ফিরলো ফারাজের ডাকে।ফারাজ জানতে চাইছে ও যাবে কিনা,না গেলে ফারাজ চলে যাবে।থাকলে থাকতে পারে এখানে।জোরাজুরি নাই।সব চাইতে জরুরি সারথির ভাল থাকা।
সারথি চুপচাপ ফারাজের সাথে বেরিয়ে চলে গেছে।যাবার পথে অধরাকে ধরে চোখের পানি ফেলেছিল।বাসা থেকে বের হয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিল ফারাজ।সারথির শুস্ক চুলগুলো বারে বারে উড়ছিল।দমকা হাওয়ায় বারবার মনে হচ্ছিল পেছন থেকে আনাফ তাকে দেখছে।তাকে দেখার জোর নাই সারথির,কোনো ক্ষমতা নাই। আছে কেবল অনুভূতি।সেই অনুভূতির শক্তি দিয়ে সে দিব্যি বুঝতে পারছে আনাফ ডাকে দেখছে।
এবং সে জানে তার আন্দাজ সঠিক।একবার পেছনে ফিরে হাত উপরে তুলে সে নাড়ালো।বিদায় জানালো।
আনাফ সত্যি সেখানে ছিল বারান্দায় দাঁরিয়ে। এতক্ষণ ওকে দেখছিল।তাকে অবাক করে দিয়ে সারথি হাত নাড়িয়েছে বলে সে এত খুশি হলো যেটা সে প্রকাশই করতে পারছিলনা।সারথি কিভাবে বুঝলো সে ওকে দেখছে।মনের মিল এভাবে কি করে হতে পারে!
সারথি আবারও সামনে মুড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আনাফের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।একটা অন্ধ মেয়ের অনুভূতি এতটা শক্ত হতে পারে দেখে সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।তার চয়েস করা মানুষটা যে সঠিক তার প্রমাণ পেয়ে সে খুশিতে কাঁদছে।চোখ মুছে পেছনে ফিরতেই দেখলো অধরা দাঁড়িয়ে আছে।আনাফ চোখ মুছে জানতে চাইলো কি কারণে এসেছে সে।
অধরা বললো,’সারথি আপু আবার কবে আসবে জানো?’
‘জানি ‘
‘কবে? ‘
‘আজ থেকে ঠিক দু মাস পর’
‘এতদিন কেন আসবেনা?’
‘আমি আনবোনা তাই’
‘তুমি কেন আনবেনা?’
‘ওর বিয়ের বয়সনি তাই।দু মাসে পরিপক্ব হবে তারপর আনবো,এখন যা সামনে থেকে।আমি একটু গান শুনবো, তারপর ঘুমাবো’
অধরা ভেংচি কেটে চলে গেছে।
————
সজীব লেভেনকে
শান্ত করে বাংলাদেশের টিকেট কেটে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনাও দিয়ে ফেলেছে। সারথির সাথে ডিভোর্স নিয়ে কথা বলে ডিভোর্স দিয়ে তারপর সে ফিরে আসবে একেবারে লেভেনের হয়ে।একসাথে বসে কথা বলার কারণ হচ্ছে সারথিকে বোঝানো।সে সজীবকে নিয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে যার কারণে সজীবের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে শুনে সে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।তাকে বিষয়টা নিয়ে বোঝাতে হবে।
এয়ারপোর্টে এসে ফোন বন্ধ করে ফেলেছে সজীব।মা ফোন করেও পাবেনা কারণ এই নাম্বারটা মালেশিয়ার।সে মাকেও জানাতে চায়না এ ব্যাপারে।কারণ মা জানলে কখনওই ডিভোর্স হতে দিবেন না।
——–
সারথি বাড়ি ফেরার পর থেকে একবারও ঠিক করে দম ফেলতে পারেনি।বাবা মা,দাদাজান,কাকি সহ সকলে ঘিরে ধরেছে তাকে।সে কোথায় ছিল,কি জন্যে না বলে বেরিয়েছিল সকলের একই প্রশ্ন।ফারাজ সবার থেকে ওকে বাঁচিয়ে সোজা রুমে নিয়ে দিয়ে এসেছে।এবার সবাই ফারাজকে ধরেছে মূল বিষয় নিয়ে বলার জন্য।
শেষে ফারাজ বলে দিলো সারথি তার এক বান্ধুবীর বাসায় গিয়েছিল। এর বেশি কিছু হয়নি।
তারপর সবাই শান্ত হয়ে যার যার কাজে গেছে।কিন্তু মিসেস সোনালীর মনে শান্তি আসলোনা।তার চিন্তা হয় সারথিকে নিয়ে।ওর মুখের ফ্যাকাসে ভাবটা বারবার করে বলে দেয় সে ভাল নেই,সে বড় কষ্টে আছে।
এক গ্লাস দুধ নিয়ে তিনি সারথির রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন এইসব ভেবে।ঢুকবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন।সজীবের সাথে জোর করে বিয়ে দেবার পর থেকে তার আর সারথির সম্পর্কটা একেবারে কেমন যেন পানসে হয়ে গেছে।
মা মেয়ের সম্পর্ক যত ভাঙ্গাই হোক না কেন,দিন শেষে ঠিক জোড়া লেগে যায়।কিন্তু সারথির আর সোনালীর বেলায় কেন যেন মিল খাচ্ছেনা।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তিনি মন খারাপ নিয়ে আবার ফেরত চলে যাচ্ছিলেন তখন পূর্ণতা এসে দাঁড়ায় তার সামনে।ওনার দিকে চেয়ে থেকে হাসিমুখে সে বললো,’আপনি না মা??আপনার কিসের ভয়?সারথি আপু আপনারই সন্তান।জানি, হয়ত মনমালিন্য আছে তবে সেই মনমালিন্যর কি এতই জোর যে মা মেয়ের জড়িয়ে ধরাতেও টিকে থাকতে পারবে?একবার গিয়ে জড়িয়ে ধরুন,দেখবেন যত শত বছরই হোক না কেন ঠিক সব ধুয়ে মুছে যাবে।’
পূর্ণতার থেকে সাহস পেয়ে মিসেস সোনালী দরজা ফাঁক করে সারথির নাম নিয়ে ভেতরে গেলেন।সারথি তখন জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।মায়ের পায়ের আওয়াজ পেয়েও কোনো নড়চড় করেনি সে।
তিনি গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে একটু এগিয়ে দাঁড়ালেন।সারথি তখন পেছনে ফিরলো।বললো,’কি চাই?’
‘ভাল আছিস?’
‘যেমন মানুষ ভাল রাখছে, তেমনই বেশ ভাল আছি’
মিসেস সোনালী আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেননা।এগিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেললেন।
সারথি অবাক হয়ে গেলো।সে ভাবেনি মা এমনটা করবে।
কাঁদতে চায়নি আজ তাও চোখ ভিজে গেলো অশ্রুতে।প্রকৃতির কি নিয়ম!
সারথি হঠাৎ বলে উঠলো,’মা আই এম সরি।অনেক কষ্ট দিয়ে কথা বলেছি তোমায়’
‘আমিও সরি রে মা আমার’
পূর্ণতা দূর থেকে দেখে মুচকি হেসে পেছন ফিরতেই ফারাজের সাথে এক ধাক্কা খেলো।ফারাজ কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।ওকে দেখে পূর্ণতা থতমত খেয়ে গেছে।
ফারাজ প্রথমে রাগী লুক নিয়ে থাকলেও হঠাৎ মুখটাতে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,’ধন্যবাদ’
‘কেনো?’
‘মা আর সারথিকে মিলিয়ে দেয়ার জন্য’
‘বুঝতে হবে আমি যে জিনিয়াস!’
‘একটা কাজ ঠিকঠাক করলেই জিনিয়াস হওয়া যায়না।আরও পারতে হয়’
‘তো বলুন আর কার সাথে কার মেলাতে হবে?’
‘আজিজ দাদু দাদাজানের ঘরে বসে চা খাচ্ছেন, দেখে এলাম।আমাদের বিয়ে দেয়ার ফন্দি আঁটছে’
‘আপনাকে না দেখতে আসার কথা ছিল?’
‘আমি তো বাসায় ছিলাম না,আর যে মেয়ের ভাই দেখতে আসবে সে নাকি ঘুরেটুরে চলে গেছে’
‘আপনার বিয়ের দায়িত্ব আজ থেকে আমার।ঐ মেয়ের ভাইকে ঘাঁড় ধরে টেনে নিয়ে আসার দায়িত্ব ও আমার।বাই’
আঁচল ঘুরাতে ঘুরাতে পূর্ণা চলে গেলো।ফারাজ তাচ্ছিল্য করেছে ওর কথাগুলোকে।কারণ পূর্ণা যে টাইপের মেয়ে।কোনো কাজ ঠিক করে করতেই পারেনা,একটা না একটা ভেজাল বাঁধাবেই।এক শতাংশে তার নিরানব্বই ভাগই থাকে ভুল দিয়ে ভরা।ওর থেকে আর কি আশা করা যায়!
———
আজিজ খান চা খেতে খেতে রুম থেকে বের হতেই দেখলেন পূর্ণতা নাচতে নাচতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে।
‘নাতিন শুনো!’
আজিজ খানের গলা শুনে পূর্ণা পালানোর জন্য দিলো এক দৌড়।ওমনি সিঁড়িতে বেসামাল হয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো।আজিজ খান ওখানে এসে বললেন,’গুরুজনের ডাকে সাড়া দিতে হয় তা নাহলে বিপদ হয়,দেখলে তো!কোমড় ভেঙ্গেছে?’
‘নাহ,মন ভেঙ্গেছে’
‘আহা এই টুকুন মেয়ের মন ভাঙ্গলো কেন?’
পূর্ণতা উঠে দাঁড়িয়ে কথাটাকে এড়িয়ে জানতে চাইলো উনি ডাকলেন কি জন্য।
‘আমি ডাকলাম তোমার হাত দেখতে।আমি ভাল হাত দেখতে জানি,বলতে পারো জ্যোতিষী।তোমার হাত দেখে বলে দিবো তোমার সাথে ফারাজের বিয়ে হবে কিনা’
‘এগুলা ভুয়া।আমি বিশ্বাস করিনা’
‘আমি তো করি।দেখি সোফায় বসো’
কথাটা বলে উনি পূর্ণাকে জোর করে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে চেক করা শুরু করে দিয়েছেন।
অনেকক্ষণ ধরে দেখে বললেন,’হুমমমমমমম!তোমার বিয়ে হবে মিরাজুলের সাথে’
‘তার মানে ফারাজ ভাইয়ার সাথে হবেনা।আমি খুব খুশি।আপনাকে বকশিশ কত দিতে হবে?’
‘মিরাজুল ফারাজের আরেক নাম।বেলায়েত রেখেছিল এই নাম।তুমি জানোনা?বকশিশ দিতে চাও?তাহলে গরম গরম জিলাপি বানিয়ে খাওয়াও।খুব খাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে।’
পূর্ণতা বিড়বিড় করতে করতে উঠে চলে গেছে।আজিজ খান উঠতে যেতেই মতিন এসে ফ্লোরে বসে গিয়ে হাত পেতে বললো,’দাদাভাই আমার হাতটাও দেখে দেন আপনাকে লেবুর শরবত করে খাওয়াবো’
‘তোমাদের টাংকির পানি দিয়ে না তো?’
‘না, সাপ্লাই পানি দিয়ে’
‘তাহলে দাও দেখি তোমার কপাল কেমন পোড়া ‘
অনেকক্ষণ ধরে দেখেই যাচ্ছেন তিনি।শেষে মতিন বাধ্য হয়ে জানতে চাইলো কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা।তখন আজিজ খান বলেন,’তুমি তো দেখি এই এলাকার সবগুলো কাজের বুয়ার সাথে লাইন মেরেছো।এখন আবার বানু নামের একটা মেয়ের সাথে লাইন মারতেছো!’
‘না ডাহা মিছা কথা।আপনি হাত মুছে তারপর আবার দেখেন’
আজিজ খান আবার দেখে বললেন,’তোমার সামনে বিরাট বড় লস হতে যাচ্ছে’
‘কি সেটা?’
‘তোমার তো বানুর সাথে বিয়ে হবে’
‘তাহলো লস কেন?’
‘বানুই তোমার লস করবে।কাবিনের টাকা নিয়ে পালাবে’
‘তাহলে কি বিয়ে করবোনা?’
‘বিয়ে তো করতেই হবে।লেখা আছে তোমার বানুর সাথেই বিয়ে হবে’
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৩
#আফনান_লারা
________
পূর্ণতা জিলাপি বানাতে বানাতে ভাবছিল আজিজ খান এতসব কি করে জানে!এটা তো অসম্ভব। পরে মাথায় আসলো হয়ত দাদাজান সব বলেছেন।
জিলাপি হাতে সোজা দাদাজানের রুমের দিকে যাচ্ছিল সে সেসময় ফারাজ সামনে পড়লো,তাকে নাকি দাদা ডেকেছেন।পূর্ণতার হাতে এক প্লেট তাজা গরম গরম জিলাপি দেখে লোভ সামলাতে পারেনি ফারাজ।এক টান দিয়ে দুটো নিয়ে ফেললো।পূর্ণতা ভ্রু কুুঁচকিয়ে বললো,’খান খান।আপনার বিয়ের মিষ্টি’
‘আমার বিয়ের মিষ্টি মানে?’
‘দাদাজান আমার এই সুন্দর হাতখানা দেখিয়া বলিয়াছেন আমার বিয়ে হবে মিরাজুলের সাথে।’
‘কিহ?মিরাজুল তো আমি।’
‘জ্বী,ঠিক ধরেছেন।’
পূর্ণতা এবার চলে গেছে।ফারাজ অবাক হয়ে হাতে জিলাপি নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এরপর যে প্রস্তাব আসবে টাতে চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে যেতে হবে।নাহলে দেখা গেলো দাদাজান জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিবেন পূর্ণার সাথে।
হাতের জিলাপি যে ইচ্ছে নিয়ে সে হাতে নিয়েছিল এখন সেই ইচ্ছা বিস্বাদ মনে হচ্ছে।খাওয়ার ইচ্ছা নেই বলে সিয়ামকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দাদাজানের রুমের দিকে চললো সে।
পূর্ণতা ততক্ষণে পৌঁছেও গেছে।
দুজনে একত্রে দাঁড়িয়ে দুই দাদার কথা শুনার অপেক্ষায় আছে এখন।
‘শুনো নাতি নাতিন!তোমরা একে অপরের জন্য শতে শতে দুইশ!!আমি কি বলছি বুঝতে পারছো?তোমাদের দুজনের সাথে দুজনকে মানায় বলেই আমরা বড়রা মিলে তোমাদের বিয়ে দিতে চাইতেছি।তাহলে কেন তোমরা মানা করছো?ক্ষনিকের ঘৃনা কি সারাজীবন থাকে?বিয়ে করলে মনে প্রেম জাগবে,জীবন সুন্দর কাটবে।আমাদের কথা মানো, বিয়েতে বসে যাও।বলো এবার তোমাদের যা বলার’
ফারাজ পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্ণতাও ওর মুখের দিকে চেয়েছিল।এরপর ফারাজ বললো,’আমার সাথে যে কেবল পূর্ণাকেই মানায় তা কিন্তু নাহ।
আরও অনেক মেয়ে আছে।আপনারা দয়া করে সেই কাতার থেকে একটি মেয়ে খুঁজে আনেন।পূর্নাকে না প্লিজ!’
বেলায়েত হোসেন গাল ফুলিয়ে পূর্নতার মুখের দিকে তাকিয়েছেন।পূর্ণা বললো,’আমারও একই কথা।আমার জন্য কি ছেলের অভাব পড়েছে?!আমার বাবাও পাশে নেই।আমি এখন বিয়ে করতেও চাইনা। ‘
ওদের দুজনের কথা শুনে দুই দাদা ভীষণ ক্রোধীত হলেন।
রাগে তাদের চোখে যেন আগুন জ্বলছিল।দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের কাছে তারা এমন সোজা উত্তর হয়ত আশা করেননি।এখনকার ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের সম্মান দিতে জানেনা।নাহলে তাদের কথা ধরে হলেও বিয়েতে হ্যাঁ বলা ওদের কর্তব্য ছিল।তা না করে শুরু থেকে মুখের উপর না করে যাচ্ছে ওরা।
ফারাজ হাতের ঘড়িটা দেখে বললো,’আমার কাজ আছে।যেতে পারি?’
দাদাজান তখন রেগে বললেন,’আমি কি বলেছি আমার কথা শেষ হয়েছে?’
‘আচ্ছা বলুন।শুনছি’
‘তোমাদের না বলেছিলাম একসাথে থাকবেনা?তাহলে একসাথে সারথিকে আনতে কেন গিয়েছিলে?আমি কিন্তু আমার কথায় অটল।আর একদিন দুজনকে একসাথে দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিব।আজিজ এখানেই থাকবে।দেখি তোমরা কত লুকোচুরি পারো’
পূর্ণতা আর ফারাজ মুখ ফুলিয়ে চলে এসেছে।বাইরে বের হয়ে দুজনে আবার দুদিকে চলেও গেছে।
————
সারথি মাত্র বিশ ঘন্টায় যেন আনাফের পুরা বাসাটাকে ভরিয়ে দিয়ে ফেলেছিল।সেই পরিবেশটা এখনও যায়নি।চারিদিকে ভাসছে।আর সেই মেয়েটা যদি একেবারে থেকে যেতো তাহলে কি না হতো!তাই ভেবে আনাফের বুকটা খালি হয়ে যাচ্ছে।কবে সেই মেয়েটিকে একেবারে নিজের করে সে পাবে সেই দিনটার অপেক্ষায় আছে সে।
একাকি রাতটায় সারথির বড্ড প্রয়োজন ছিল। মানসিক চাহিদার জন্য হলেও এই মেয়েটিকে তার চাই।এখনই!!
সে বড় একা।তার একাকিত্ব সারথি নামের মেয়েটা ছাড়া আর কেউ মিটাতে পারবেনা।আনাফ পারতে দেবেওনা।
কেন যে এই রাতেই চলে যেতে হলো তার!বেশ তো তার মুখ চেয়ে আরামসে সময় কেটে যাচ্ছিল।যে আনাফের ব্যস্ততার মাঝে সময় বলে জ্ঞান ছিলনা,ধারণা থাকতো না,সে আনাফ এই কয়েক মূহুর্তে বুঝে গেছে সময় কত মূল্যবান।কেবল চাকরিটাই সব হয়না।আমাদের নিজেদের একটা ব্যাক্তিগত লাইফ থাকে।
মেয়েটা সব বুঝেও চলে গেলো,থেকে গেলে কি এমন হয়??আমার অনুভূতির কি কোনো দাম নেই তার কাছে?’
——-
সজীব বাংলাদেশে ফিরে হোটেলে উঠেছে।বাসায় যায়নি।সবার আগে কোর্টে যাবে।তার পরিচিত উকিলের সাথে কথা বলে ডিভোর্স লেটার রেডি করে তারপর সারথির সাথে দেখা করবে।তার আগে না।
একটু রেস্ট করে সে বেরিয়ে পড়েছে কাজে।
ওদিকে সারথি সকাল থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।তার ফুড পয়েজনিং হয়েছে।ফারাজ ডাক্তার এনে দেখিয়ে ঔষুধও এনে দিয়েছে তাও ভাল হচ্ছেনা।বমি করতে করতে সারথির অবস্থা কাহিল।
সবাই সজীবকে কল করে যাচ্ছে কিন্তু ওর ফোন বন্ধ বলছিল বারবার।শেষে বাধ্য হয়ে ওর মাকে কল করেছেন জনাব মানিক।
সজীবের মা জানালেন তিনিও সজীবকে কলে পাচ্ছেন না।হয়ত জরুরি কাজে ব্যস্ত বলে ফোন বন্ধ রেখেছে।
তিনি রওনা হয়েছেন সারথিকে দেখতে আসার জন্য।পূর্ণতা একটা টোটকা হিসেবে শরবত বানাচ্ছিল সারথির জন্য, ঠিক সেসময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মতিনকে বললো গিয়ে দেখতে।বাকি সবাই উপরের তলায় সারথির রুমে ছিল।মতিনের হাতে আটা মাখা বলে সে পূর্ণাকেই পাল্টা আদেশ করে গিয়ে দরজা খোলার জন্য।তাই পূর্ণা হাতের কাজ রেখে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলতেই তার সাথে দেখা মিললো এক সুদর্শন পুরুষের।
পরনে কালো ফুল শার্ট,প্যান্ট।এক হাত পকেটে ঢোকানো আর এক হাতে একটা ফাইল।পকেট থেকে হাত বের করে চোখের চশমাটা খুলে সজীব বললো,’হাই??আমি সজীব।সারথি কি বাসায় আছে?’
সজীব শুনে পূর্ণতা ইয়া বড় হা করে এক দৌড় দিলো।
সজীব ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকেছে।মতিন আটামাখা হাত নিয়ে বাইরে বের হয়ে সজীবকে দেখে সেও এক দৌড় দিলো।
সিয়াম আর অর্ক একটা সাবজেক্ট নিয়ে তর্কাতর্কি করছিল।করতে করতে সজীবের সামনে এসে ওকে দেখে তারা ইয়া বড় হা করে এবার দুজন মিলে দৌড় দিলো।সবাই উপরের তলায় এসে বাকি সবাইকে গিয়ে জানালো সজীব এসেছে।কেউ শুরুতে বিশ্বাস করেনি।পরে যখন একসাথে সবাই বলা শুরু করলো তখন তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো।
সবাই এবার সারথিকে রেখে নিচ তলার দিকে ছুটেছে।সারথি এখন একা।
সারথিও শুনেছে সজীব এসেছে।কিন্তু সে তার কানকে বিশ্বাস করেনি।কেবল কানের ভ্রম বলে ধরে নিয়ে সে চোখ বুজে দম ফেললো।শরীর এমনিতেও টানছেনা তার উপর উদ্ভত সব কল্পনা।
মিনিট দশেক পর দরজা খোলার আওয়াজ শুনে সারথি।তখন সে এপাশ করে ফিরে বললো,’মা আমি একটু ঘুমাবো।সবাইকে বলবে যেন বিরক্ত না করে।’
দরজাটা খুলার পর এবার বন্ধের আওয়াজ ভেসে আসলো।সারথি বুঝলো চলে গেছে হয়ত।তার এক মিনিট পর নিজের কাছে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চট করে উঠে বসে সারথি।খোলা চুলগুলোকে সামলে মৃদু স্বরে বলে,’কে?’
‘আমি’
কণ্ঠস্বরটা খুব চেনা সারথির।মূহুর্তেই সে বুঝে গেছে এটা কল্পনা নয়,সত্যি সজীব এসেছে।হাসবে নাকি কাঁদবে সেটা ভেবে পাচ্ছেনা সারথি।
হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো।ওমনি তার হাতটা যাকে খুঁজতে এগিয়েছিল সেই মানুষটা নিজেই ছুঁলো তাকে।সারথি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,’কেন দিলেন এত বড় শাস্তি!আমার কি দোষ ছিল!’
‘সারথি প্লিজ কেঁদোনা’
কথাটা বলে সজীব ওর পাশে বসে পড়ে।দুহাত বাড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’আমি তোমায় ধোকা দিতে চাইনি।তোমার বাকি জীবনে কোনো কষ্ট হবেনা সারথি।এই দেখো আমি একটা দলিল এনেছি।এটাতে লেখা আছে আমার উত্তরার যে ফ্ল্যাট আছে ওটা তোমার নামে।আমি তোমার নামে করে দিয়েছি পুরাটা।তাছাড়া তোমার সারাজীবনের ভরণপোষণের দায়িত্বটাও কিন্তু আমার।তুমি ভেবোনা সারথি’
সারথি তাচ্ছিল্য করে হাসে এবার।চোখ মুছে ফেলে বলে,’এটাই কি একটা মেয়ের চাহিদা?আর কিছু নেই আগে পরে?’
‘তুমি চাইলে বিয়েও করতে পারো।ধরা বাঁধা নেই’
‘আপনি আজ কি কারণে এসেছেন?’
‘আরেকটি দলিল এনেছি।ডিভোর্সের।’
‘দিন,সই করে দিচ্ছি।’
কথাটা বলে সজীবের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় সারথি।তারপর কলম নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে রাখে।সজীব পকেট থেকে কলম নিয়ে ওর হাতে দিয়ে কাগজ দেখিয়ে দিলো।সারথি দম আটকে সই করে দিয়েছে।দিয়েই একটু দূরে সরে বললো,’চলে যান।আজ থেকে আপনি মুক্ত।আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবোনা।’
সজীব কাগজগুলো একপাশ করে রেখে ফ্ল্যাটের ফাইলটা সারথির সামনে রেখে বললো,’এটা রেখে দাও’
‘বিয়ের আগে কি আমার মাথার উপর ছাদ ছিল না?তিন বেলা ভাত খেতে পারতাম না?পরনে পোশাক ছিল না?
সব ছিল। সুতরাং আপনার দয়া না ঢাকলেও আমি বেঁচে থাকতে পারবো।আপনি যান এখন’
সারথি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।সজীব সব একপাশ করে রেখে সাররথির পাশে বসে থাকলো,যাচ্ছেনা।সারথি চোখ মুছে ধরে নিলো সজীব চলে গেছে।এবার সে নিজে নিজে বিছানা ছেড়ে নামলো।হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে সেটাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মনে হয় যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেছে ওর।বাইরে থেকে হইচই শোনা যাচ্ছে।জামাই আদরের ব্যবস্থা করছে সবাই।সারথি যতবার চোখ মুছো ততবারই চোখ ভিজে যায় অশ্রুতে।
মেঝোতে বসে সে হাউমাউ করে কাঁদছে।সজীব খাটে বসে এক দৃষ্টিতে ওকে কাঁদতে দেখছে।
সারথির এমন হোক সেটা ও চায়নি।এখন তার নিজের ভেতরটা পুড়ে যচ্ছে সারথির জন্য।বারবার মন বলতে চাইছে সারথি তুমি কোঁদোনা।আমি সই করিনি এখনও,কখনও করবোনা।
সারথি হঠাৎ উঠে দ্রুত দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমে চলে গেলো বমি করতে।শরীর আর কোনো কিছু সহ্য করার অবস্থাতে নেই।মুখ ধুয়ে বের হয়ে দূর্বল শরীরে সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
সজীব নিজের কোটটা খুলে বালিশের উপর রেখে মাথার চুল ধরে টানাটানি করছিল,সারথিকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজে উঠে এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।সারথি তখন অন্য দুনিয়ায়।তার বিশ্বাস হচ্ছেনা সে ডিভোর্স লেটারে সই করে দিয়েছে।মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে সেসবই ভাবছিল সে ঠিক তখন হাতের সাথে সজীবের হাতের স্পর্শ পেলো ।চমকে বললো,’আপনি যান নি?’
‘নাহ,পরে যাব।আসার পর থেকে ভাল ভাবে রেস্ট নিতে পারিনি।আধ ঘন্টা হোটেল রুমে থেকে কাজে লাগতে হয়েছে।’
‘আপনি এই রুম থেকে বের হয়ে যান,এটা আমার অনুরোধ’
‘কই যাব?তুমি চাও হোটেলে ফিরে যাই?’
‘যেখানে খুশি যান’
‘এত বছর পর স্বামীকে পেয়ে হোটেলে পাঠাচ্ছো?’
‘ স্বামী?ডিভোর্স পেপারে সই করলাম পাঁচ মিনিট হলো’
‘আমি কিন্তু করিনি।এখনও তোমার আমার সম্পর্ক ভাঙ্গেনি।সো আমি এখন যাব না।কয়েকদিন থাকি,ঘুরিফিরি তারপর যাব’
সারথি বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে পা বাড়াতেই হোচট খেলো।সজীব ওকে এক হাতে ধরে ফেলে বলে,’তোমার বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। তবে কি জানো?আমি জানি তুমি আমায় ভালবাসো।ফায়দা লুটতে সমস্যা কোথায় বলোতো?’
‘আপনি জানেন আপনি একজন কাপুরুষের মতন কথা বলছেন?আপনার নিজের ভালবাসার মানুষ আছে,আপনি তাকে বিয়েও করবেন।আপনি নিজের স্ত্রীকে সে জন্য ডিভোর্স ও দিবেন, আবার বলছেন সেই স্ত্রীর ফায়দা লুটবেন?’
সজীব হেসে সারথিকে ছেড়ে বললো,’ফায়দা লুটা মানে কি বুঝলে?শারীরিক চাহিদা?উহু!!আমি সেরকম পুরুষ না।তুমি জেনে অবাক হবে আমার আর লেভেনের সম্পর্কটা এখনও শারীরিক অবধি গড়ায়নি’
‘আমার কাছে খারাপ মানে কেবল শারীরিক দিক দিয়ে না!
যে স্ত্রী থাকার পরেও মানসিক ভাবে আরেকজনের জন্য উন্মাদ আমার কাছে সেই মানুষটা খারাপ’
চলবে♥