প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-১১

0
364

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১১
#রাউফুন

‘প্রত্যেকটা দিন দেরি করো পুতুল। কখন তোমাদের দুই ভাই বোন কে ডেকে দিয়েছি। আর একজন তো আছেই। তোমাদের বাপ এতো দিন জ্বালিয়ে এসেছে, এসেছে কি এখনো জ্বালাচ্ছে আর তোমরাও জ্বালাও। আর ভালো লাগে না রোজ রোজ এই রুটিন মাফিক কাজ করতে।’ গজরাতে গজরাতে মালার মা রাশেদা বললেন। তার কাছে সকাল টা একটা যু’দ্ধক্ষেত্রের মতো কা’টে।
টেবিলের উপরে দুই হাত দিয়ে খোশমেজাজে গহীন তবলা বাজানোর মতো আওয়াজ করছে। আর রাশেদা তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। তার বন্ধ মুখ টা সঞ্চিত খাবারের জন্য কিছু টা ফুলে উঠেছে।

‘এই গহীন মুখের খাবার ধরে রাখা টা কোন ধরনের অভ্যাস? মুখ চালাও জলদি না হলে চা’ম’চ দিয়েই দেবো বা’রি।’

মায়ের কথায় ভয়ে মুখের খাবার গিলে নিলো গহীন।
তখনই মালা আর পুতুল এসে টেবিলে বসলো। সকালে ওঁরা তিন ভাই বোন ভাত খাবেনা বলে মায়ের সঙ্গে এক প্রকাত যু’দ্ধ ঘোষণা করে। আগে গহীন ভাত খেয়ে স্কুলের জন্য বেরোলেই ব’মি করে দিতো৷ তাই এখন তাকে আলাদা ভাবে খাবার তৈরি করে দিতে হয়। পুতুল ভাত খাই সামান্য তবে বেশি না। মালা রুটি, সবজি খাবে। তিন সন্তানের তিন রকমের খাবার করতে হিমশিম খেতে হয় রাশেদাকে।

আজ প্রশান্ত আসেনি পড়াতে। সেজন্য বেজায় মন খারাপ পুতুলের৷ এই এক কয়েক মাসে প্রশান্ত শুক্রবার ছাড়া এক দিন ও প্রাইভেট পড়ানো বাদ দেইনি। তাহলে আজকে হঠাৎ কি হলো? এটা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে৷ প্রশান্তর শরীর খারাপ করেনি তো? এতক্ষন ধরে মালা পুতুলের অন্য মনস্কতা খেয়াল করেছে। মেয়েটা খাবার নারাচারা করছে অযত্নে। মালা রুটির অংশ ছিড়ে পুতুল কে বললো,

‘এই পুতুল, কি ভাবো? খাও জলদি। স্কুলে যেতে দেরি হচ্ছে তো নাকি?’

‘খাচ্ছি আপু!’

পুতুলের খাবার গলা দিয়ে নামছে না। তাও জোর করে খাবার খেলো৷ না হলে মায়ের বকবকানি শুনতে হবে। হঠাৎ মালার ফোন আসে। একজন আগুন্তকের আসতেই তড়িৎ বেগে খাওয়া ছেড়ে উঠে সে। আর ব্যাগ সমেত বাইরে আসে। পেছন থেকে রাশেদা চেঁচিয়ে ডাকলেন সম্পুর্ন খাবার শেষ করে আসার জন্য। কিন্তু মালার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দ্রুত একটা টেক্সিতে উঠে পরলো।

গহীন আর পুতুল স্কুলের জন্য বেরিয়ে পরলো। পুতুলকে আজ অন্য রকম দেখে গহীন নিজেই যেনো বুঝলো। সে বললো,

‘পুতুল আপু তোমাকে এমন লাগে কেন?’

‘কেমন লাগে?’ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো পুতুল।

‘না আজকে তোমাকে অন্য রকম লাগছে।’

‘বাদ দাও। চলো পা চালিয়ে।’

কিন্তু গহীন দাঁড়িয়ে পরলো। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে দেখলো ওর সহপাঠী আবিরের বাবার গাড়ি পার্ক করা। একই বিল্ডিংয়ে তারা ভাড়া থাকে। তার মুখে চুইঙ্গাম ছিলো। যদিও সেটা পুরো চিঁবোনো হয়নি। সে দ্রুত ওটা গাড়ির দরজায় আটকে দিলো। পুতুল গহীনকে সাথে না দেখতে পেয়ে পিছনে ফিরে দেখলো গহীনের কার্যকলাপ। সে ছুটে এলো ওঁকে থামাতে। কিন্তু ততক্ষণে গাড়িতে চুইঙ্গাম টা আটকানো শেষ।

‘এটা কি করলে গহীন?’

‘ঠিক করেছি আপু! তুমি জানো না আবির সেদিন আমাকে ধা’ক্কা মে’রে’ছিলো।’

‘দেখো গহীন, আবির তোমাকে মে’রে’ছে বলেই যে তোমাকেও তার বদলে ওর আব্বুর গাড়িতে চুইঙ্গাম লাগাতে হবে এটা কিন্তু ঠিক না। এটা তুমি করতে পারো না।’

‘কেন পারবো না হুহ্! একশোবার পারি।’

‘আহা সোনা ভাই আমার। আবির না তোমার বন্ধু হয়। ওঁ যেমন ই হোক ওঁ কিন্তু তোমার বন্ধু। ওর সঙ্গে ভাব করে নিও আজ স্কুলে গিয়ে।’

‘তুমি বলছো তাই ভাব করে নেবো।’

‘আমার সোনা ভাই।’৷ বলেই ভাইকে স্নেহের চ’মু দিলো পুতুল।

স্কুল থেকে ফেরার পথে পুতুল প্রতিদিনের মতোই মাহিয়ার সঙ্গে এলো। কি করে যে এখন ওঁ মাহিয়াদের বাড়িতে যাবে এটা বুঝতে পারছে না। কি জানি প্রশান্ত স্যারের এখন কি অবস্থা। তার শরীর কেমন আছে এটা কি একবার জিজ্ঞেস করবে সে মাহিয়ার কাছে? কিন্তু মাহিয়া যদি কিছু মনে করে এতে। প্রশান্ত কে দেখার জন্য তার ব্যাকুলতা যেনো বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে পুতুলের দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রশান্তকে না দেখলে সে মা’রা যাবে। যে-করেই হোক প্রশান্ত কে সে দেখেই যাবে। পুতুলের ছটফটে ভাব দেখে মাহিয়াই জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে রে তোর? তোকে এমন বিচলিত লাগছে কেন?’

‘কিছু না রে।’ ইতস্তত করে উত্তর দিলো। সত্যিটা বলতে পারলো না সে।

‘তোর কি শরীর খারাপ। দেখি।’ বলতে বলতে মাহিয়া ওর কপাল, গাল ছুঁয়ে দেখলো।

‘কই নাহ,জ্বর নেই। সেই ক্লাস থেকে দেখে আসছি পুতুল তোকে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।’

ঝট করে পুতুল মাহিয়ার হাত ধরলো। দোনামোনা করে বললো,

‘মাহিয়া তোকে একটা কথা বলবো। প্লিজ তুই আমাকে ভুল বুঝবি না বল?’

‘আরে এভাবে কেন বলছিস? কি হয়েছে তোর?’ কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো মাহিয়া।

পুতুল কিছুটা সময় নিলো। কথা গুছিয়ে নিলো মনে মনে। এর মধ্যে মাহিয়ার বাড়ি চলে এসেছে। তাই মাহিয়া বললো,

‘কি রে বলবি নাকি? আমার বাড়ি এসে গেছে। এখন যদি বলতে পারিস তো বলে ফেল!’

‘আমি তোকে বলেছিলাম না, আমি আমার টিউশনির স্যার কে পছন্দ করি? ওটা আর কেউ-ই নয় তোর ভাইয়া প্রশান্ত!’

মাহিয়া চট করে পুতুলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।

‘এটা তুই কি বললি হ্যাঁ? তুই এটা করতে পারলি আমার সঙ্গে?’

‘দেখ মাহিয়া প্লিজ আমায় ভুল বুঝিস না। আমি তো জানতাম না যে প্রশান্ত স্যার তোর ভাই। আমাকে ভুল বুঝিস না জান পাখি। প্লিজ!’ ঘাবড়ে গিয়ে বললো পুতুল।

পুতুলের ভীতসন্ত্রস্ত ফেস দেখে খুব হাসি পেলো মাহিয়ার। পুতুল ভয়ে কেঁদেই দিলো। এবার মাহিয়া ফিক করে হেসে দিলো। আর লাফিয়ে উঠে বললো,

‘কি মজা, তুই আমার ভাবি হবি ইয়েএএএএ!’

পুতুল চকিতে তাকালো। মাহিয়া টেনে ওঁকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো।

‘আমি খুব খুশি পুতুল!’

‘তার মানে তুই আমার উপর রাগ করিস নি?’

‘আরে জান পাখি তোর মতো মেয়ে তো লাখে একটা হয়। তোকে আমি ভাবি হিসেবে পেলে ধন্য হয়ে যাবো। আর আমার ভাই ও।’

পুতুল মাহিয়াকে জড়িয়ে ধরলো খুশিতে। খুশিতে পুতুল কেঁদে কেঁদে বললো,

‘লাভ ইউ দোস্ত!’

‘লাভ ইউ টু পাখি!চল এবার ঘরের ভেতরে চল।জানিস ভাইয়ার খুব জ্বর এসেছে। তাই আজকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেইনি আম্মা।’

‘কি বলছিস তুই? উনার জ্বর এসেছে?’

‘হ্যাঁ রে!’ মন খারাপ করে বললো মাহিয়া।

‘উনার সঙ্গে কি একবার দেখা করতে পারি?’

‘হ্যাঁ চল। আমি ব্যবস্থা করছি।’

পুতুলকে দেখেই সালেহা অনেক খুশি হলেন। তিনি ভীষণ পছন্দ করেন পুতুল কে। মাহিয়া ছলেবলে কৌশলে প্রশান্তর ঘরে পুতুল কে পাঠালো। পুতুল এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো প্রশান্ত পানির গ্লাস নেওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু হাতের নাগালে পাচ্ছে না। পুতুল ছুটে গিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। প্রশান্ত খেয়াল না করেই পানির গ্লাস নিয়ে পানি পান করলো। পানির গ্লাস রাখতে দেওয়ার জন্য গ্লাস এগিয়ে দিতেই সে খেয়াল করলো মেয়েটা তার মা বা বোন কেউ-ই নয়। এটা কি তার ইল্যুশন নাকি সত্যিই পুতুল?

‘কে?’

‘আমি!’ কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলো পুতুল!

প্রশান্ত সচকিত হয়ে বসলো।

‘তুমি এখানে?’

‘আম আসলে আপনি আজকে পড়াতে যান নি তো তাই আর কি ভাবলাম হইতো আপনার শরীর খারাপ সেজন্য—!’

‘তাই এখানে তুমি আমাকে দেখতে এসেছো?’

পুতুল মাথা নত করে স্বস্থানে দাঁড়িয়ে রইলো। মৃদুস্বরে বললো, ‘আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো তাই !’

‘ঠিক আছে দেখা শেষ এবার যাও!’

পুতুল এই কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলো। মানুষ টা তার সঙ্গে এভাবে কথা বললো? কিশোরীর কোমল হৃদয় প্রেমিকের এমন উপাখ্যান সইতে পারলো না।তার উপর একদিনে মানুষ টার একি হাল হয়েছে দেখেই বুক টা চিনচিন করছে তার।সব মিলি সে আবেগ প্রবন হয়ে হাটু মুড়ে বসে পরলো প্রশান্তর সামনে।প্রশান্তর হাত ধরে কান্না করতে থাকলো। প্রশান্ত আর সইতে পারছে না।এভাবে কেন কাঁদছে মেয়েটা?এভাবে কাঁদার কি আছে? সে কি এমন বলেছে যে এভাবে কাঁদতে হবে!

‘আহা কান্না করছো কেন?’

‘আপনার একি অবস্থা হয়েছে স্যার? আপনি কেমন শুকিয়ে গেছেন।’

‘আরে শান্ত হও পুতুল। আম্মা বা মাহিয়া তোমার কান্না শুনলে কি ভাববে?’

পুতুল আস্তে আস্তে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো। থেকে থেকে নাক টানছে মেয়েটা। প্রশান্ত অবাক হয়ে দেখছে পুতুল কে।

‘এটুকুর জন্য কেউ এভাবে কাঁদে? আমি কি ম’রে যাচ্ছি নাকি!’

‘চুপ!’ বলেই পুতুল প্রায় ঝাঁপিয়ে পরলো প্রশান্তর বুকে। প্রশান্ত কি করবে ভেবে পেলো না। এই মেয়েটা এমন ছিচকাঁদুনে কেন? পুতুলকে শান্ত করতে প্রশান্ত ওর পিঠে হাত রেখে স্বান্তনার স্বরে বলে,

‘আরে পা’গ’লী মেয়ে কাঁদছো কেন? আমি ঠিক আছি। এই দেখো, কাঁদতে মানা করলাম তুমি আরও বেশি করে কাঁন্না করছো? মহা মুশকিল তো!’

মিনিট দুই এক পর যখন পুতুলের হুশ ফিরলো সে তড়িৎ বেগে প্রশান্তর থেকে সরে এলো। হাই আল্লাহ ওঁ এটা কি করে ফেলেছে। লজ্জায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মাহিয়া আর সালেহা বেগম ওঁকে পিছু ডাকলো। মাহিয়া ওর মাকে থামিয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো। সালেহাকে সব কথা মাহিয়া বললে উনার মুখ খুশি তে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

‘হ্যালো? কে বলছেন?’ বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে বললো মালা।

‘আমি কে সেটা না জানলেও চলবে। যদি ঔশীকে বাঁচাতে চাও তবে আমরা যা বলবো সেই ইন্সট্রাকশন অনুসারে কাজ করো!ঔশীর প্রা’ণ ভোমড়া এখন তোমার হাতে!’

‘কে আপনি? আমি আপনার কথা কেন শুনবো? আপনি ঔশীর পিছনে নে’ক’ড়ে’র মতো কেন পরেছেন? ওই নিষ্পাপ শিশু কি ক্ষতি করেছে আপনার?’

‘আমাদের কথা শুনবে নাকি, আমরা আমাদের কাজ শুরু করবো। কত দিন তুমি ঔশীকে এভাবে আগলে আগলে রাখতে পারবে গুহ ? যদি ওঁকে বাঁচাতে চাও তবে আমাদের কথা তোমাকে শুনতেই হবে।’

‘না না বলুন কি করতে হবে। আমি সব কিছু করবো।’

‘সঠিক সময়ে সঠিক ইন্সট্রাকশন পেয়ে যাবে।’

বলেই সে আগুন্তক কল কে’টে দিলো। মালা হ্যালো হ্যালো করলো। কিন্তু কল তো ডিস-কানেক্ট হয়েই গেছে। কি হচ্ছে তার সঙ্গে এসব। ওই লোক গুলো তাকেই কেন বেছে নিলো এসবের জন্য? আর ঔশীকে গুটি বানিয়ে কি করতে চাইছে ওঁরা?

#চলবে