প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-১০

0
301

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১০
#রাউফুন

মালা রোজকার মতোই কাজ থেকে ফিরছিলো। আজ রাত একটু বেশিই হয়ে গেছে। টেক্সি বা অটো পাওয়া দুষ্কর হয়ে পরবে এটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে মালা। যা পাচ্ছে সব গুলোই ভর্তি খালি আর পাচ্ছে না। অন্তরিক্ষ তখন স্তব্ধ,শান্ত। অজস্র তারার ভিড়ে চন্দ্রপ্রভা। কনকনে বাতাস, পাতা নড়ছে মৃদু মৃদু। শীতের প্রকোপে মালার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শিরশির করে নাকের ভেতরে সুরসুরি দিচ্ছে। অল্প বিস্তর দূরেই ও দেখতে পেলো কোনো একটা গাড়ি আসছে। গাড়ি টাকে দাঁড়াতে বলবে কি না এটা নিয়ে দোটানায় পরলো সে। তার দাঁড়াতে বলার অপেক্ষা করতে হলো না। তার সামনে এসেই গাড়িটা থামলো। সে দেখলো মিষ্টার প্রিহান এর গাড়ি এটা।

‘উঠে আসুন!’ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো প্রিহান।

‘আপনি এখানে?’ অকপটে শুধালো মালা।

‘আমি এখানে কেন সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আপাতত উঠে বসুন। মনে তো হচ্ছে অনেক্ষন দাঁড়িয়ে আছেন।’

মালা ঘড়িতে দেখলো বারোটা বাজতে চললো। নাহ এখন আর এতো ভেবে কাজ নেই। সে মন মস্তিষ্কের সাথে কানাঘুঁষা করতে করতে উঠেই পরলো গাড়িতে। প্রিহান মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

‘তো আজকে এতো লেট কেন?’

‘এমনিতেই কাজ বেশি ছিলো!’

‘ওহ আচ্ছা তাই বলুন। আমি না আসলে আপনার আরও দেরি হতো ভাগ্যিস খোঁজ নিয়েছিলাম দারোয়ান কাকার থেকে।’

‘মানে এখানে আসাটা আপনার কাকতালীয় নয়!’

‘অবশ্যই না। আমি আপনাকে নিতেই এসেছি! হবু বউ বলে কথা!’

‘আপনার বউ হতে আমার বয়েই গেছে। আপনি কি ভেবেছেন এসব করলেই আপনার প্রতি আমার ভালো লাগা তৈরি হবে? কখনোই না।’

‘ভালো লাগা হতে হবে কেন? আমি তো জানি আপনার আমাকে ভালো লাগে। অযথা ওটা কষ্ট করে আমার জন্য তৈরি কেন করাবো?’

‘এই আপনার কোনো বদ মতলব নেই তো? এভাবে কেন পিছনে পরেছেন আমার?’ সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করলো মালা।

‘আপনার পিছনে কোথায় পরলাম? আমি তো আপনার সামনেই থাকি সব সময়!’

‘আপনি একটা বজ্জাত লোক এটা কি আপনি জানেন?’ দাঁত কিড়মিড় করে বললো মালা।

‘নাহ। কারণ এর আগে কেউ-ই আমাকে এ কথা বলে নাই। আপনি না বললে নিজের নামে এমন ভালো কথা শুনতামি না। হাহাহা।’

প্রিহানের গা জ্বলানো হাসি তে মালার সারা শরীর শিরশির করছে। আজব পাবলিক। বলা নাই কওয়া নেই এতো রাতে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে লোকটা।
নিরব রইলো মালা। ”যে কারণেই আসুক না কেন এসেছে ভালোই হয়েছে। উফফ যা ঠান্ডা পরেছে।” মনে মনে ভাবলো মালা। প্রিহান সুন্দর একটা সফট মিউজিক চালালো৷ আশ্চর্যের বিষয় হলো এটা মালার ফেভারিট সং। সে কি করে জানলো যে এটা
তার পছন্দের গান। এটা কি কাকতালীয় নাকি সে মালার পছন্দ সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছে? কি জানি নিতেও পারে। লোকট আসলেই অদ্ভুত। কোনো কথায় গায়ে মাখে না।

‘দিস সং ইজ ভেরি ক্লোজ টু মাই হার্ট। আই কান্ট এক্সপ্লেইন দিস ফীলিংস!’ দু চোখ বন্ধ করে আনমনে বললো মালা।

‘মাই সিঙ্গেল হার্ট হ্যাজ থাউজ্যান্ড ফীলিংস ফর ইউ। আই লাইক ইউর এভরিথিং এন আই লাইক ইউ মোর!’

‘আচ্ছা আপনার আমাকেই কেন পছন্দ হলো বলতে পারেন? শুধুমাত্র সুজানা আপুর উপর প্রতিশোধ পরায়ন হয়েই কি আপনি আমাকে বাঁছলেন?’ হঠাৎ প্রিহানের কথা শুনে সহসা প্রশ্ন করলো মালা।

‘আপনার কি তাই মনে হয়? আমি তো জানতাম আপনি ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ে! যদি সুজানার উপর আমার প্রতিশোধ নেওয়ারই থাকতো তবে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইবো কেন? এখানে লজিক টা একটু দেখান। যদি আমার মনোভাব তেমনি থাকতো তবে আমার বাড়ির সবাই ওর সত্যি জানতো। আর প্রতিশোধ নেওয়ার আরও অনেক হার্ড পদ্ধতি আছে যা আমি চাইলেই অবলম্বন করতে পারতাম! আইনের কাজ করি আমি প্রতিশোধ নেওয়াটা আমার কাজ নয়।’

‘আচ্ছা কেন জানান নি সুজানা আপুর ব্যাপারে? আপনার বাড়ির লোক তো তবে আপনাকে দোষী ভাবছে। আপনাদের এতো দিনের সম্পর্ক ভেঙে আপনি সুজানা আপুকে রিজেক্ট করেছেন! সেজন্য তো আপনাকেই দোষী ভাববে সবাই তাই না?’

‘আমার আর সুজানার মধ্যে কোনো দিন কোনো সম্পর্ক ছিলোই না এর আগেও বলেছি আপনাকে। আজ একটা সত্যি কথা বলি, আমি যেদিন আপনাকে প্রথম দেখি সেদিনই আপনার প্রতি আমার আলাদা একটা টান অনুভব করেছি যেটা এর আগে কখনোই কারোর প্রতি অনুভব করিনি। এরপর রুপম কে দিয়ে আপনার ব্যাপারে সমস্ত কিছুর খোঁজ- খবর নিয়েছি। আপনার প্রতি প্রথম দিনের সেই টান আজো আমি ভুলতে পারিনি৷ আর আমি চাই না এটা আমার মন থেকে চলে যাক!’

মালা বিমর্ষচিত্তে বলে উঠলো, ‘আপনি আমার বর্তমান সম্পর্কে জানলেও আমার অতীতের কালো অধ্যায় সম্পর্কে বিন্দু মাত্র ধারণা নেই। আপনার কি মনে হয় একটা মেয়ে এমনি এমনি এতোটা ঘৃণা করবে পুরুষ জাতীকে? উঁহু। আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছিলাম যে আমার মন টাই বিষিয়ে গেছে। এরপর চাইলেও নিজের মন টাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। আমি জানি আপনি ভালো একজন মানুষ কিন্তু তাও আপনার কোনো কিছুই আমার ভালো লাগে না। আমি মানসিক ভাবে সিক মিষ্টার প্রিহান! আপনি আরও অনেক ভালো কাউকে আপনার লাইফে ডিজার্ভ করেন।’

‘আমার আপনাকেই চাই সেটা আপনি না চাইলেও। যে আমাকে সব সময় এপ্রিশিয়েট করবে, আমার সব কিছুতেই আমার পাশে থাকবে।’

‘আপনি কেন বুঝতে পারছেন না। আমি ভেতর থেকে ভেঙে, গুড়িয়ে যাওয়া, জীবনে পিছিয়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যে একজন! যার সংস্পর্শে এলে আপনি শেষ হয়ে যাবেন। তাছাড়া আমি আপনাকে কখনোই বিয়ে করবো না। শুধু আপনাকে কেন আমি কাউকেই আমার মনে জায়গা দিতে পারবো না। আজীবন একা একাই কা’টিয়ে দেবো।’

‘জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা হল, নিজের অবস্থানে সর্বদা সন্তুষ্ট থাকা। আর আপনার এই গুণ টাকেই আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছিলাম! তবে আপনার সেই কনফিডেন্স আজ নেই কেন? এভাবে আপনাকে মানায় না। আপনার মধ্যে সব সময় সেই লড়াকু মালাকে দেখতেই ভালো লাগে।’

কোনো কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না মালা। সে তো কারোর সম্মুখে নিজেকে, নিজের দুর্বলতাকে দেখাতে চাইনি। তবে এই লোকটার সামনে নিজেকে কেন এভাবে পেশ করছে সে? তাহলে কি সে নিজের অজান্তেই এই লোকটার প্রতি দুর্বল হচ্ছে? না এসব সে কি ভাবছে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে সে বললো,

‘ঔশী এখন কেমন আছে?’

প্রিহান বুঝতে পারছে মালা প্রসঙ্গ বদলাতে চাইছে। সেও আর মালাকে ঘাটাতে চাইলো না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। ঔশী আপনাকে দেখতে চেয়েছে। খুব বায়না করেছে আজ। কাল আপনার সময় হবে?’

‘উম হবে। তবে বেশিক্ষণ নয়।’ একটু ভেবে বললো মালা।

‘ঠিক আছে আমি আপনাকে পীক করে নেবো। বলুন কোথায় আসবো! আমার বাড়িতে আসতে অসুবিধা হবে?’

‘নাহ অসুবিধা আর কি!’

‘ঠিক আছে।’

এরপরে দুইজনেই চুপ। আজ প্রিহানকে কোনো গড়িমসি করতে না দেখে একটা কিছু ভাবলো।নির্জিব, বিচলিত লাগছে লোকটাকে। জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবলেও পরক্ষণেই নিজের মনোভাব বদলালো। যদি আবার ভেবে বসে তার প্রতি সে দূর্বল। হইতো কোনো কেস নিয়ে বিভ্রান্ত আছে। মালার বাড়ি আসতেই সে নেমে পরলো। যেতে নিয়েও ফিরে এসে বললো,

‘থ্যাংক ইউ মিষ্টার প্রিহান! উম অবশ্যই লিফট দেওয়ার জন্য।’

প্রিহান হাসলো শুধু। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে গেলো সে।

প্রশান্ত পড়াচ্ছিলো। গহীন অংক করেছে। গহীন আজও অংক ভুল করেছে। এই অংক টা প্রশান্ত অনেক বার করিয়েছে কিন্তু একই জায়গায় গিয়ে গহীন একই ভুল করছে। এর মধ্যে পুতুলের পড়ার এতো অবনতি দেখে তার মাথা ফে’টে যাচ্ছে। মেয়েটা দিন কে দিন একটা গবেট তৈরি হচ্ছে। এতো মেধাবী একটি মেয়ের এরকম অবস্থা দেখলে কার মাথা ঠিক থাকবে। বাড়িতে এই বিষয় টা ইনফর্ম করবে ভাবলো। মালাকে জানাবে প্রথমে। একমাত্র মালাই পুতুল কে বুঝাতে সক্ষম হবে। সে পুতুলের খাতা দেখতে দেখতে বললো,

‘পুতুল আজকাল কি পরীক্ষায় ডাব্বা পাওয়ার ইচ্ছে আছে তোমার? কোনো একটা পড়া ঠিক করে হচ্ছে না তোমার। মাথায় কি গোবর, কেঁচোর বসবাস হয়েছে?’

পুতুল ভ্যাবাচেকা খেয়ে কিছুক্ষন তব্দা খেয়ে বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো প্রশান্তর দিকে। পুতুলের ও ভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে হাতে থাকা খাতা দিয়ে একটা বারি দিলো প্রশান্ত৷ বারি খেয়েও সে সপ্রতিভ হেসে বেকুবের মতো এমনি একটা প্রশ্ন করে বসলো,

‘কচু খেলে আমাদের গলা চুলকায় কেন স্যার?’

প্রশ্ন শুনে কিঞ্চিৎ দলিতমথিত হলো প্রশান্ত। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রেখেছিলো। উত্তর দিতে দিতে হেসেই ফেললো। পুতুল মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখছিলো।

‘কারণ কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট আছে।’

‘ওও আচ্ছা।’ প্রশান্তর দিকে তাকিয়েই ঠোঁট গোল করে বললো পুতুল।

‘ক্লোরোপিক্রীন স্প্রের অপর নাম কি?’

‘জানি না স্যার।’

‘কাঁদুনে!’

‘কি বললেন স্যার, আমি কাঁদুনে?’

এমনিতে গহীন পড়ার সময় একটাও কথা বলে না। কিন্তু এখন সে মাঝখানে ফোঁড়ন কে’টে বললো, ‘হ্যাঁ স্যার পুতুল সত্যিই কাঁদুনে। ওঁ খুব কাঁদতে পারে। আমার যখন অপারেশন হয়েছিলো ও খুব কেঁদেছে।’

‘এই তুমি চুপ করো।’ ধমক দিলো পুতুল।

‘নাহ নাহ তুমি কাঁদুনে হতে যাবে কেন?’ হাসি আটকে বললো প্রশান্ত।

‘আপনিই তো বললেন স্যার।’

‘আরে কখন বললাম?’

‘এই তো একটু আগেই বললেন কাঁদুনে।’

‘আরে গবেট। ক্লোরোপিক্রীন কাঁদুনের স্প্রের অপর নাম। বুঝলে?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘উফফ বাঁচালে।’

তখনো পুতুল অন্য এক ঘোরের মধ্যে ছিলো। সে আপন মনে বললো,

‘স্যার আই লাভ ইউ!’

‘হোয়াট?’ চেচিয়ে উঠলো প্রশান্ত।

‘কিছু না। কিছু না। কিছু না স-স্যার!’

‘তোমার বয়স কত পুতুল?’

এসময় এরকম প্রশ্ন ভাবালো পুতুলকে। সে বললো,

‘চ-চোদ্দ বছর এগারো মাস স্যার!’

‘এই বয়সেই এসব কি চিন্তা-ধারা হ্যাঁ?’

‘স্যরি স্যার!’

‘আর যদি এসব মুখের এনেছো খবর আছে! সোজা তোমার আব্বুর কানে কথা তুলবো।’

‘না না স্যার এমন টা করবেন না।’

‘একটা শর্ত আছে ওটা মানলে বলবো না।’

‘কি শর্ত স্যার আপনি বলুন আমি সব শর্তে রাজি!’

‘ওকে তাহলে পড়াশোনা করতে হবে ঠিকঠাক! ঠিক আগের মতো। রাজি?’

‘রাজি!’ অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে অসহায় মুখ করে বললো পুতুল

#চলবে