শিকড় পর্ব-১+২

0
320

শিকড়
(পর্ব-১,২)

দুইহাত ভর্তি বাজার নিয়ে জমির আলী যখন বাড়ির দোরগোড়ায়, সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে।এতো বাজার দেখে আসমা বেগম হতবাক হয়ে যান।
-এতো সদাই আনছেন ক্যান?কি ঘটনা?
-রাইতে বিশেষ কুটুম আইবো বউ।ভালা কইরা রাইন্ধো।
-কে আইবো কইবেন তো আমারে।
-শোন,পোলাও-কোর্মা রানবা, ছোড আলু দিয়া ঝাল কইরা কয়খান গোস্তও রানবা।মাছের একটা ভর্তা কইরো আর বাদবাকি তোমার যা মন চায়।
-দুপুর হইয়া গেছে, আমি কেমনে কি করুম?
-পারবা,পারবা।আমি যাই একটু দই-মিষ্টির জোগার করি।
-মানুষডার খুশি দেইখা হাসে আসমা।নিজের মনে বলে,নিজেগো যা আছে তাই নিয়া আল্লাহর রহমতে ভালাই আছি, তয় হাসি-খুশি নাই, ঘরডা যে খা খা করে।থাউক,যে কুটুমই আসার আসুক, মানুষডা খুশি থাউক।
আশেপাশের বউ-ঝিদের নিয়ে কাজে লেগে যায় আসমা।ঠিক করে, বেশ কয়েকপদ রান্না করবে।গল্প করতে করতে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে চলে।

দই-মিষ্টি নিয়ে জমির আলী বাড়ি আসেন। আসমাকে ডেকে বলেন
-সইন্ধ্যার আগে সব রান্ধা শেষ কইরো, তাইলে রং রুপ বুঝতে পারবা। আর মেহমান আসলেওতো সময় দেওন লাগবো। আমি দেহি কয়ডা ডাব পারাইতে পারিনি। কারে যে পাই এহন…

রান্না শেষ করে সবাই মিলে কয়েকরকম পিঠা বানাতে বসে।তখন অবশ্য আসমার দুই চাচীশ্বাশুড়িও বসেন সাহায্য করতে। বছর পাঁচেক আগে আসমার শ্বশুর মারা যান,ছয়মাস পরেও শ্বাশুড়িও চলে যান ওপারে।কিন্তু দুই চাচী সবসময় আসমাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছেন। শ্বশুর -শ্বাশুড়িও আসমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু একটা আফসোস নিয়ে তারা দুনিয়া ছাড়লেন,কোন নাতি নাতনির মুখ দেখে যেতে পারলেন না।
সেইদিনের সেই ঘটনাতো বাড়ির কেউই জানেনা,শুধু জমির আলী আর আসমা বেগম
এতোগুলা বছর ধরে নিজের মনে সযত্নে আগলে রেখেছেন।
মাগরিবের নামাজ শেষে আসমা চা নিয়ে এসে বলেন,
-আপনে চা খাইয়া লন,মেহমান আসলে তাদের দিমুনে।
-তোমার চা আনো নাই?
-হ আনছি।
-আসাদের বউরে কইছো,মেহমান আসলে যেন তোমারে সাহায্য করে।
-হ কইছি,মন চাইলে আইবো,না চাইলে নাই। আমি তো আর জোর খাডাইতে পারমুনা,আমার পোলার বউ তো না।
-দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জমির আলী। পোলাডা এখন কতো বড় হইবো,কও তো?
-কেমনে কমু?আমিতো চোখের সামনে খালি পিচ্চি মুখটাই দেহি।
-মাজে মাজে বড় মনডা পুড়ে,আবার ভাবি,আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুইতো ঘটে না।
-ঠিকই কইছেন,সবই আল্লাহর ইচ্ছা। পোলাডা ভালা থাকলেই আমি খুশি।
-আচ্ছা বউ,পোলাডা যদি আসে কোনদিন,আমরা কি চিনুম?

হঠাৎ গাড়ির শব্দে কাপ নিয়ে তড়িঘড়ি ভেতরে চলে যান আসমা বেগম।আর মেহমানকে আপ্যায়ন করতে বাইরে ছুটেন জমির আলী।
★★★
বেশ বড় বাড়ি জমির আলীদের।ঠিক মাঝখানে তাদের ঘর,দুই পাশে দুই চাচার।চাচাদের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই বাড়ির বাইরে।মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে আর ছেলেরা বিভিন্ন চাকরি নিয়ে শহরে থাকে। নিজের আপন কোন ভাই না থাকলেও বোন আছে দুইজন।তারা বছরে দু-একবার পরিবারসহ এসে থেকে যান।ছোট চাচার বড় ছেলেটা অবশ্য বাড়িতে আছে। তার আবার চারটা ছেলেমেয়ে। ওরাই সারা বাড়ির প্রানভোমরা।বড় ছেলে আসাদকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেন আসমা,আসাদও আসমার কাছেই থাকতো বেশি।এতে আসাদের মায়েরও অনেক সাহায্য হতো পিঠাপিঠি চারটা সন্তান। আসমার খুব শখ ছিল,আসাদ লেখাপড়া করে ভালো একটা চাকরি করবে।কিন্তু আসাদ হলো একবারে ওর বাবার মতো।না লেখাপড়া, না কামকাজ কোন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই।এর মধ্যে একদিন হুট করে বিয়ে করে বসে।বাড়ির কেউই জানতো না।হঠাৎ বউ নিয়ে হাজির।খুব দুঃখ পেয়েছিল সেদিন আসমা।নিজের ছেলেটাকে হারিয়ে আসাদকে নিয়েই বেঁচে ছিলো সে।আসাদের বিয়ে নিয়ে কতো স্বপ্ন ছিল তার।

বউটাও খুব মুখরা।কারো সাথে খুব একটা মিশে না।আসমার কাছে তো একদমই আসতে চায় না।ইদানিং আসাদও আর এমুখো হয় না।জমির আলী সবটাই বুঝেন,আসাদের বউ মনে করে আসমার ছায়াও তার জন্য অমঙ্গলের। আসমা যে নিঃসন্তান।

বাজারে জমির আলীর মুদি দোকান।দিনের বেশির ভাগ সময় সেখানেই কাটায় সে।আজ সকালে অপরিচিত একজন দোকানে এসে জমির আলীকে দিকে নিজের মোবাইল দিয়ে বলেন
-স্যার আপনার সাথে কথা বলতে চান।
-কোন স্যার।
-আমার স্যার,মানে আমি যার গাড়ি চালাই।
-নাম কি আপনের স্যারের,আমি কি চিনি?
-কথা বললেই বুঝতে পারবেন।

-আস্লামালিকুম।
-ওয়া লাইকুম আস সালাম, জমির সাহেব বলছেন?
-জি,আমি জমির আলী, সাহেবতো হই নাই।
-বাহ,সুন্দর কথা বললেন তো।
-আমরা তো আর আপনাদের আদব-কায়দা অতশত বুঝি না,যা মনে অয় সেটাই কই।আমার লগে আপনের কি কোন দরকার?
-জি ভাই,অনেক বড় দরকার। আমার এক পরিচিত লোকের কাছে আপনার কথা জেনেছি।
-কি জানছেন?
-এই যে,আপনি কত ভালোমানুষ, উপকার করার জন্য আপনি সবসময় প্রস্তুত।
-আমি আপনের কথা বুঝতে পারতাছি না।
-ভাই আমার একটা উপকার করবেন?বড় আশা নিয়ে আপনার সাথে যোগাযোগ করছি।
-আমার সাইধ্যে কুলাইলে নিশ্চয়ই করুম।
-আমার ছেলেটা আজ রাতে আপনাদের গ্রামে যাবে,তিনদিন থাকবে।ও একজন ডাক্তার। আমার ছেলেটাকে যদি আপনার বাড়িতে আশ্রয় দিতেন,তাহলে কৃতজ্ঞ থাকবো।
-এইডাতো খুশির কথা,এইডা কইতে আপনি এতো সময় লাগাইলেন।আমার বাড়িতে আপনের পোলা নিজের বাড়ির মতোই থাকবো,থাকন-খাওন আমরা সাইধ্যমতো করমু কিন্তু এইহানে তো শহরের মতো ঠান্ডার মিশিন টিশিন নাই।হেয় কি থাকতে পারবো।
-পারবে ভাই, আমি নিশ্চিন্ত হলাম।আলহামদুলিল্লাহ। পরে আবার কথা হবে ভাই। আল্লাহ হাফেজ।

তারপরই বেড়ে যায় জমির আলীর ব্যস্ততা।বাজার-সদাই করা,দই-মিষ্টির জোগাড় করা,ডাব পারানো।কাল সকালে পুকুরে জাল ফেলবে বলেও ঠিক করে।

বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে জমির আলী যখন পুকুরপার ধরে এগুচ্ছেন, ততক্ষণে গাড়ি বাড়ির ভিতর চলে এসেছে। ধবধবে সাদা গাড়িটা থেকে নামল সকালের সেই লোকটি।সালাম বিনিময় করে পেছনের দরজা খুলে দিল।গাড়ি থেকে নেমে এলো এক সুদর্শন যুবক।

তাকে দেখে জমির আলীর মনটা যেনো কেমন করে উঠল।ছেলেটার চেহারায় যেনো নিজের বাবার আদল দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
হাসিমুখে এগিয়ে আসে ছেলেটি।
(চলবে)