শহর জুড়ে আলোর মেলা পর্ব-০৮

0
365

#শহর_জুড়ে_আলোর_মেলা
কলমে : লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৮

পাপ করলে পাপের শাস্তি পেতে হয়। ইদ্রিসের ভয়ে এলাকার অভিভাবকেরা ভীতু ছিল। ছেলে অথবা মেয়ে ওর কোনো ঝামেলায় পড়লে ভোগান্তির শেষ ছিল না। মুখে মুখে সকলে জানতো রেবা মা*র্ডা*রের সঙ্গে ইদ্রিস জড়িত কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে সাহস করেনি। মৃ*ত্যুর পর এলাকাবাসী ওর দা*ফনে অংশ নিতে আসেনি। লা*শে*র অবস্থা বাজে ছিল। পরিচিত কয়েকজন ছিল ওরা ভয়ে আশেপাশে ঘেঁষতে ভয় পেয়েছে। এলাকা জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। যদিও ইদ্রিসের ভাই আর আত্মীয়রা মিলে সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ করেছে। জানাজার সময় হাতে গোনা কয়েকজন এসেছে। লোকটা কতটা ঘৃণিত ছিল এটা তার উজ্জল দৃষ্টান্ত। আলো নিউজ দেখে শান্তি পেয়েছে। রেবার লা*শ নিয়ে কিছু মানুষ ফতুয়া দিয়েছিল,অপবিত্র লা*শে*র জানাজা বা কা*ফন তারা করাবেনা অথচ মেয়েটার কোনো দোষ ছিল না। উপরে আল্লাহ আছেন, ঠিক সময়ে ঠিক বিচার হয়ে যায়। সন্ধ্যায় নাস্তার টেবিলে বিষয়গুলো নিয়ে তুলি শ্রাবণকে বলছিলো তখনই হন্তদন্ত হয়ে পাশে বসলেন ইকবাল মাহমুদ। শ্রাবণকে সন্ধ্যায় পাওয়া আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো। ঠিকঠাক রাতের ডিনার পযর্ন্ত বাড়িতে করেনা। আজ হয়তো বাইরে তেমন কাজ নেই। কথাটা ভেবে উনি গম্ভীর মুখে বললেন,

> তুমি ইসহাক ভাইয়ের সঙ্গে বেয়াদবি করেছো? ভদ্রলোক আমার সিনিয়র বড় ভাই। সম্মানিত মানুষ। তুমি তার বাড়িতে গিয়ে উনার মেয়েকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে এসেছো।এসবের মানে কি? আমাকে ভদ্র সমাজ থেকে কি তোমার জন্য চলে যেতে হবে? ভদ্রলোক ক্লিনিকে এসে দুঃখ করছিলেন। শুনো শ্রাবণ এখন থেকে একটু ভালো হওয়ার চেষ্টা করো। আমাকে এভাবে লোকের কাছে ছোট করো না।

শ্রাবণ কফির কাপে চুমুক দিয়েছিলো কোনোরকমে গিলে নিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

> উনি আর উনার মেয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে কি প্রস্তাব দিয়েছে এইটা বলেনি? ভদ্রলোক বলে যে মাথা খারাপ করছো আসলে ওই লোক এক নাম্বারের অ*ভ*দ্র আর অ*মা*নুষ। মেয়েকে আসকারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ওর বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে তবুও চোখে পড়ে না। এখনো কিছু বলিনি। আরেকববার আমাকে নক করুক ওর চৌদ্দ গোষ্ঠী আমি উদ্ধার করে দিবো। শ্রাবণকে ওরা ভালো করে হয়তো চিনতে পারেনি। লজ্জা থাকলে সেই কথা তোমাকে বলতে আসতোনা। যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। কোথা থেকে ডাউনলোড হয়েছে দেখতে হবে তো?

শ্রাবণের কথা লাগাম ছাড়া। মনে যা আছে মুখ দিয়ে সবটা বের করে ছাড়ে। কিন্তু ভদ্র সমাজে বসবাস করতে গেলে কি এরকম করা সাজে? আমাদের সঙ্গে কতকিছু ঘটে যায় অথচ সবটা জেনে বুঝে চুপ থাকতে হয়। মানুষ সামাজিক জীব, সমাজ ছাড়া বসবাস করতে পারেনা। যদি পারতো তাহলে ক্রমান্বয়ে দল,সমাজ,গ্রাম অথবা রাষ্ট্র গঠন হতো না। আদিম যুগেও মানুষ একাকী থাকেনি দল ছাড়া সেখানে সভ্য যুগের বাসিন্দা হয়ে এমন বিরূপ মনোভাব কতটুকু যুক্তিগত? ইকবাল সাহেব রেগে উঠলেন,

> প্রস্তাব পছন্দ না হলে চুপচাপ চলে আসতে তাকে অপমান করার সাহস তোমার কিভাবে হয়? খেপাটে ষাঁড়ের মতো আচরণ করবে না। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো। আমি নিজেই ব্যার্থ আমার ছেলেকে মানুষ করতে সেখানে অন্যদের কথা কি বলবো? সমাজে আমার মুখ দেখানোর উপায়ন্তর রাখলে না। আমার একটা কথা যদি রাখতে।

ভদ্রলোকের কণ্ঠ হতে আফসোস ঝরে পড়ছে। শ্রাবণ বাবার সঙ্গে খুব একটা বেয়াদবি করেনা। যতটা পারে চুপচাপ থাকার চেষ্টা করে। আজ চুপ থাকতে পারলোনা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

> একটা কথাও শুনিনা বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছো? তোমার এক কথাতে আমি বাচ্চাসহ একটা মেয়েকে ঘরে তুলেছি। একবার জিঞ্জাসা করেছো আমার মনে কেউ আছে কিনা? বা আমি কাউকে পছন্দ করি কিনা? আমি কিছুই বলিনি। তুমি যেভাবে বলেছো আমি প্রশ্ন ছাড়া মেনে নিয়েছি। এই সমাজে কোন আবুল আছে যে বাচ্চাসহ অচেনা এক মেয়েকে বাবার কথা রাখতে বিয়ে করে নিবে? বারবার আমাকে খোঁচানো তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমাকে রাস্তায় আনতে ছলচাতুরি করে আলোকে এই বাড়িতে বউ করে নিয়ে এসেছো।একবার ভেবে দেখেছো ওই মেয়েকে যদি আমি মন থেকে না মানতে পারি তাহলে আমার কি হবে?আলোর কি হবে? কোনো কিছু না ভেবে ছেলেকে আলোর মতো বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে তোমার ভাবতে হয়নি। আবার এসেছো আমার ন্যায় অন্যায় নিয়ে আলোচনা করতে। তোমার প্রাণের সিনিয়র ভাই আমাকে তার কন্যার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন তাহলে রাজি হয়ে যায়? সুন্দরী ডাক্তার পুত্রবধূ পাবে সমাজে নামডাক বাড়বে। ওরা আলোর পাওনা সব বুঝিয়ে দিয়ে সম্মানের সহিত বাড়িতে রেখে আসবে। ঝামেলা শেষ।

শ্রাবণ শেষে কথাগুলো একটু উচ্চ শব্দে বলেছে। হাতের মগটা টেবিলের উপরে ঠক করে রেখে উঠতে গিয়ে থমকে গেলো। আলো ওর দিকে চেয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে মেয়েটা মাথা নিচু করে উপরের দিকে চলে গেলো। ড্রয়িং রুমে তর্কবিতর্ক হচ্ছে শুনে মেয়েটা এগিয়ে এসেছিল। হঠাৎ শ্রাবণের মন্তব্য শুনে বেচারীর হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো। কোন মেয়ে সহ্য করবে নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের নাম? আলোর খারাপ লাগছে তাই ওখানে থাকতে পারেনি। ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে শ্রাবণে রাগ দ্বিগুণ হলো। আজ বাড়িতে নাস্তা করতে বসাটা চরম ভুল ভেবে হাতের গ্লাসটা ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসলো। শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠলো। ইকবাল মাহমুদ পুরোপুরি জানতেন না এখন জানতে পেরে উনি লজ্জা পাচ্ছেন। তার সঙ্গে তুলি আর লীমা বেগম উনাকে বকাবকি করছেন। শ্রাবণের রাগ বেশি এইযে বাসা থেকে বের হলো আবার কখন ফিরবে তার ঠিক নেই।
*********
আলো ঝলমলে সোনালী সকাল। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে ধরণীতে। কর্মব্যস্ত নগরী। মেইন রোড থেকে গাড়ির সাউন্ড ভেসে আসছে। আলো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল থেকে শ্রাবণ গায়েব। আলোর সঙ্গে ওর আলাদা কোনো কথাবার্তা হয়নি। ওদের সম্পর্কটা অন্য সাধারণ দম্পতিদের মতো এখনো হয়নি। এক সঙ্গে বসে ভালো মন্দ আলাপ পযর্ন্ত করেনি। আলোর মনে অভিমান জমেছে। প্রশ্ন জেগেছে,গরিব বলে কি শ্রাবণ ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে? নাকি আলো ওর অযোগ্য? লোকটা রেগে গিয়ে সত্যি যদি বিয়ে করে ফেলে তখন ওর কি হবে? লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলবে। বাবার কথা ভেবে আরও খারাপ লাগছে। মনে হলো,এর চাইতে চাষী বাড়িতে বিয়ে করে নেওয়া উচিত ছিল। আলোর ধ্যান ভাঙলো ফোনের আওয়াজ শুনে।আলো ফোন রিসিভ করে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসলো। দিনের বেশিরভাগ সময় ইশা তুলির রুমে থাকে। তুলি আরও পনেরোদিন এখানে আছে। ও এই কয়েকদিন বাচ্চাটাকে কাছে রাখতে চাইছে। আলো নিষেধ করতে পারেনি। তাছাড়া ওর পড়াশোনার জন্য এই বাড়ির লোকেরা সুযোগ করে দিচ্ছে যাতে অতিরিক্ত চাপ পা পড়ে। আলো তাড়াতাড়ি বোরখা পরে ব্যাগ নিয়ে কোনোরকমে শাশুড়ি মায়ের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে আসলো। কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেলো আলোর খোঁজ নেই। দুপুর পেরিয়ে বিকেল, লিমা বেগম না পেরে শ্রাবণকে ফোন করলো। কয়েকবার ফোন বাজার পর রিসিভ হলো,

> মা কিছু বলবে?

লিমা বেগম মিনমিন করে উত্তর দিলেন,

> আলো বাড়িতে নেই। সকালে বের হয়েছে। ফোন করেছিলাম বন্ধ বলছে। তুই একটু দেখবি বাবা? বললো কি একটা দরকারে বাইরে যাচ্ছে এখুনি চলে আসবে অথচ বিকাল হয়ে আসলো। দেখনা বাবা।

শ্রাবণ ফোন রেখে চোখ বন্ধ করলো। গতকাল রাত থেকে রাগে শরীর জ্বলছে সেটা দ্বিগুণ হলো। আলোর জন্য খারাপ লাগা ছিল সেটা মূহুর্তে দূর হয়ে রাগ এসে ভিড় করলো। মেয়েটাকে কতবার করে নিষেধ করা হয়েছে বাইরে না যেতে অথচ ওকে না জানিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরছে। রাহিন রিপোর্ট তৈরী করছিলো শ্রাবণ ওর হাত থেকে কাগজ কেড়ে নিয়ে বলল,

> আলোর লাষ্ট লোকেশন কোথায় ছিল দ্রুত খোঁজ কর।আমি গাড়ি বের করছি। এই মেয়ে আমাকে বডিগার্ড বানিয়ে তবে ছাড়বে। কপাল করে একটা বউ পেয়েছি।

রাহিন বিনিময়ে হাসলো। শ্রাবণ সকাল হতে এই পযর্ন্ত হাজার বার আলোর নাম নিয়েছে। মেয়েটা এমন ওমন কতকিছু। অথচ শ্রাবণ খুব একটা কাউকে এভাবে মনে করেনা। এবার বুঝি বখাটে ঘাড় ত্যাড়া বেটার ঘন্টা বেজে গেলো।
*******
পৌরসভা কাউন্সিলে মিটিং বসেছিল সেটা প্রথম পর্যায়ে ঝগড়া তারপর মা*রা*মারিতে রূপ নিয়েছে। এক লোক স্ত্রী সন্তানের খোরপোষ না দিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ করছে যা তার পরিবার সাপোর্ট করে। অন্যদিকে ভিকটিম কোর্টে কেস করেছিল ওরা চেয়ারম্যানের নিকট নোটিশ পাঠিয়েছে দুপক্ষের মধ্যে মিমাংসা করার জন্য। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সিনিয়র অফিসার, চেয়ারম্যান আর সমাজ কর্মিগণদের উপস্থিতিতে আলোচনা চলছিলো। সব শেষ ঠিক তখন নতুন করে ঝামেলা শুরু। ভদ্রলোকের দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাই স্থানীয় পাতি নেতা। ওরা কিছুতেই প্রতিমাসে এতগুলো টাকা খোরপোষ দেবার পক্ষে না। ছেলে বাবার সঙ্গে থাকবে আর প্রথম স্ত্রীকে কাবিনের টাকা পরিশোধ করে তালাক দেওয়া হবে এটাই শেষ কথা। অন্যদিকে প্রথম স্ত্রী তালাক দিতে রাজি না। সে খোরপোষ নিবে এবং এই স্বামীর বাড়িতেই থাকবে। কি একটা ঝামেলা। দুই পক্ষের কেউ দাবি ছাড়তে রাজি না। যদিও বেশিরভাগ মানুষ প্রথম স্ত্রীর পক্ষে। সামাজ কর্মি জেসমিন নাহার আলোকে ডেকে নিয়েছে।ওদের আরও কাজ আছে তবে এটা শেষ করে ওখানে যাবে। এর মধ্যে মা*রামা*রি শুরু। কেউ বের হতে পারেনি। পুলিশ হচ্ছে মা*রা*মা*রির শেষে আসা চতুর পাবলিক। চারদিক থেকে ভাঙা ইটের টুকরো বৃষ্টির মতো ঝরছে। আলো ভয়ে চুপসে আছে। যে যার মতো ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আলো দৌঁড়ে কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। জেসমিন নাহার ওর হাত ধরে টেনে পৌরসভা অফিসের বারান্দায় গিয়ে উঠলো। কতক্ষণ যে এভাবে আটকে থাকবে খোদা জানে। শ্রাবণ হন্যে হয়ে ওকে খোঁজ করছে। লাষ্ট লোকেশনটা দেখার পর মাথায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। পূর্বে নিউজ পেয়েছিলো ওখানে ঝামেলা হচ্ছে। শ্রাবণ আর রাহিন গাড়ি পেছনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ডোবার পাশ দিয়ে কাউন্সিলে প্রবেশ করলো। পুলিশ মেইন রোডে চলে এসেছে। তবুও মানুষ থামছে না। শ্রাবণ ভেতর প্রবেশ করে দূর থেকে আলোকে দেখে দম ছাড়লো। কাছাকাছি যাওয়ার আগেই একটা ভাঙা ইট এসে আলোর কপাল ছুয়ে বেরিয়ে গেলো। শ্রাবণ দিব্যজ্ঞান শূন্য হয়ে দৌঁড়ে গিয়ে ওকে ধরলো। জেসমিন নাহার পাশে আছে। শ্রাবণ আলোকে বুকের সঙ্গে আটকে নিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

> আমার বউয়ের মাথায় এসব আজেবাজে ভুত আপনি ঢুকিয়েছেন তাইনা? বয়সের পার্থক্য বুঝেন না আপনি? ও নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জানেনা আর আপনি ওকে এসব প্যাচালে এনে মাথা বিগড়ে দিচ্ছেন? আমার বউয়ের থেকে দূরে থাকবেন। আপনাকে বলেছিলাম না যেকোনো প্রয়োজনে আমি আপনাকে সাহায্য করবো? আমাতে হয়নি এখন আমার বউয়ের পেছনে পড়েছেন? এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেন সামনে এগিয়ে জান। ইট না আপনার মাথায় একটা পা*থর পড়া উচিত। এভাবে মিমাংসা হয় কে বলেছে? থানায় নিয়ে পিঠের উপরে কয়েকটা ঘা বে*ত পড়লে বাপ বাপ করে খোরপোষ দিতে বাধ্য হতো। আর আজাড়ে সময় নষ্ট করে এখানে মিটিং বসিয়েছেন। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।

শ্রাবণ আলোকে নিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে নিয়ে চললো। আলো ভয়ে চুপসে আছে। মাথা ফুলে আলু হয়েছে। যন্ত্রণা করছে কিন্তু কোনো আওয়াজ করছে না। শ্রাবণ তেতে আছে। কথা বললেই এখন কিছু কটু কথা শুনতে হবে। শ্রাবণ ওকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। রাহিন ভিডিও করছে আসতে লেট হবে। শ্রাবণ আলোর মুখটা ধরে কপালের কা*টা অংশ টিস্যু দিয়ে মুছিয়ে দিলো। হাত না পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে মেয়েটার। ঝগড়া ঝামেলা দেখে অভ্যস্ত না তাছাড়া কয়েকদিন আগের ঘটনা এখনো মনের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। শ্রাবণ ভেবেছিল ফর্সা গালে টেনে একটা থা*প্পড় বসিয়ে দিবে কিন্তু পারলোনা। যেই গালে এখনো অবধি একটু চুমু দিতে পারেনি সেখানে থাপ্পর দেওয়া বেমানান। আলো মিনমিন করে বলল,

> আমি বুঝতে পারিনি। আন্টি আসতে বলেছিল আমি জানতাম না এসব হবে।

শ্রাবণ হাত থামিয়ে ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা ঠিকঠাক বসতে পারছে না। শান্ত হওয়া অবশ্যক।প্যানিক এ্যাটাক করে বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই পার হলো। রাহিন দৌঁড়ে এসে গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল,

> ভেতরে ঝামেলা আরও বেড়েছে এখানে থাকা রিস্ক হয়ে যাবে। আমি ড্রাইভ করছি।

রাহিন কথাগুলো বলে পেছন তাঁকিয়ে ওদেরকে এভাবে দেখে ভড়কে গেলো। শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে ইশারা করলো সামনে তাঁকাতে। রাহিন দ্রুত সামনে তাকিয়ে গাড়ি ছাড়লো।

বাড়িতে না গিয়ে ওরা সোজা ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে উঠলো। আলো চুপচাপ বসে আছে। পা আর চলছে না। সারাদিন না খাওয়া। দশ মিনিটের জন্য বাইরে গিয়ে এমন বিপদ হবে কে জানতো? আলো সিদ্ধান্ত নিলো বাসা থেকে কিছুতেই আর বাইরে আসবে না। শ্রাবণ খাবারের অর্ডার দিয়ে আলোর পাশে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ আলোর শুকনো মুখের দিকে চেয়ে বলল,

> কিছু কথা বলবো শান্ত হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনো। তোমার বয়স কম, র*ক্ত গরম। সামনে যা কিছু দেখো রঙিন লাগে। এইযে বন্ধুরা মিলে মি*ছি*ল মিটিং ধর্ম*ঘট করে ভাবছো এভাবে প্রতিবাদ করে মানুষের কল্যাণ করতে পারবে। আসলেও কি পারবে? সমাজ পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে তোমার নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। নিজেকে এমন পজিশনে নিতে হবে যাতে তোমার কথা লোকেরা শুনতে বাধ্য থাকে। ক্ষমতা ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। তুমি এডমিশন দিবে,বলা যায় এইটুকু দুধের বাচ্চা। তোমার কথা কে শুনবে বলো? যেখানে গিয়েছিলে ওখানে তোমার কথা কি কেউ মানতো?

আলো মাথা নিচু করে ভাবলো। সত্যি তো মানুষকে বোঝাতে হলে আগে নিজেকে উপযুক্ত করে তৈরী করা খুব জরুরী। শ্রাবণ খারাপ কিছু বলেনি। আলো ঠিক করলো এবার থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না। ওকে ভাবতে দেখে শ্রাবণ পূণরায় বলল,

> তুমি ছোটখাট বিষয়গুলোতে জড়াতে পারো ওটা আমি দেখে নেবো কিন্তু বড় কিছু না। প্রথমেই তুমি একবারে বিশাল অগ্নিকুণ্ডে হাত দিয়েছো। দিনে অসংখ্যবার আমার কাছে হু*ম*কির কল আসছে। ওরা তোমাকে চাইছে। তোমার একটা প্রা*ণের বিনিময়ে চারটা প্রাণ বাঁচবে। ওরা ভ*য়ং*কর অথচ তুমি এলোমেলো চলাফেরা করে আমাকে টেনশনে রেখেছো। শ্রাবণ মাহমুদ এই প্রথমবার খুব শান্তভাবে কাউকে বোঝাতে বসেছে। শুধুমাত্র বউ বলে তোমাকে এইটুকু ছাড় আমি দিয়েছি। ভেবেছিলাম থা*প্পর দিয়ে গাল লাল করে দিবো কিন্তু আমার অধিকারের সীমাবদ্ধতা ওই পযর্ন্ত যায়নি। যেদিন থেকে চুমু খাবো, সত্যি বলছি গড প্রমিজ ভুল করলে থা*প্প*ড় দিতে একটুও ভুল করবো না।

শ্রাবণের শেষের কথাগুলো শুনে আলোর হেচকি উঠে গেলো। কি ভ*য়ং*কর লোক? আলো আজ চুপচাপ আছে অন্য দিন হলে নিশ্চয়ই উত্তর করতো। শ্রাবণ ওর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলো খেয়ে নিতে। আলো ঢকঢক করে গালাই ঢেলে নিয়ে মিনমিন করে বলল,

> বাড়ি যাব।

শ্রাবণ পাত্তা দিলো না। উঠতে উঠতে বলল,

< ওয়াশরুমে যাচ্ছি। চুপচাপ বসো পাঁচ মিনিট। খাবার খেতে তারপর ফিরবো। ক্ষুধা পেয়েছে। আলো ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ আবারও একটা ভুল করে ফেলেছে। এই বয়সটা সত্যি আবেগের। ভালো খারাপ না ভেবে ভুল করতে পা আটকাই না। রাহিন ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে একটা কাজে গেছে ফিরবে কিছুক্ষণ পরে। হঠাৎ পাশে একটা মেয়েকে দেখে আলো ভড়কে গেলো। বাদামি চুলের মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরী। পরণে আধুনিক পোশাক। আলোকে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা হাত বাড়িয়ে বলল, > আমি কুহেলী, শ্রাবণের গার্লফ্রেন্ড। ওর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল। আমাদের গভীর সম্পর্ক ছিল। একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য সবটা শেষ হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম আবারও ঠিক করবো কিন্তু তোর জন্য হলো না। আঙ্কেল ওকে জোরকরে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। শ্রাবণ এখনো আমাকে ভালোবাসে।

আলো ভ্রু কুচকে তাকালো। জীবনে ঝামেলার শেষ নেই আবার নতুন ঝামেলা হাজির। আলো পানির গ্লাস সামনে রেখে বলল,

> এখন আমার কি করণীয়? শ্রাবণ সাহেব ওয়াশরুমে আছে ফিরলে বলছি। আপনি অপেক্ষা করুন।
কুহেলী কেঁপে উঠলো। চোখের পাতা নাড়িয়ে বলল,
> শ্রাবণ সত্যি আমাকে ভালোবাসে কিন্তু স্বীকার করছে না। তুমি প্লিজ ওকে ছেড়ে দাও। আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি।

> তাড়া কিসের?ছাড়বো আগে ভদ্রলোক আসুক। শুনেছি গতকাল আপনার বাবাকে উনি প্রচুর গা*লিগা*লাজ করেছেন?যেটুকু বাকী আছে অপেক্ষা করুন ঠিক পুষিয়ে দিবে।

কুহেলী চরম অবাক। সাধারণত বউয়েরা সন্দেহ প্রবণ হয়। স্বামীর প্রাক্তন থাকলে ঝামেলার শেষ নেই। অথচ এই মেয়ে কিছু মনে করছে না। শ্রাবণ যেমন তেমনই একটা জোগাড় করেছে। কুহেলী হতাশ। এমন হলে কিভাবে শ্রাবণকে পাবে?

চলবে