#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_৮
“সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমার চোখে পানি দেখবো বলে তো তোমাকে আমার বউ হিসাবে আল্লাহ তাআলার কাছে চাইনি মিষ্টি।” বলে তিনি উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। খাবারগুলো নিজেই প্লেটে সাজিয়ে নিতে লাগলেন। এরপর এক লোকমা আমার মুখের সামনে ধরে বললেন‚ “এখন এসব কান্না থাকুক। আগে খেয়ে নাও।”
আমি ডান হাতে তার খাবার ধরে রাখা হাতটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম‚ “আমি মুগ ডাল পছন্দ করি— এটা আপনি জানলেন কীভাবে?” হঠাৎ এমন প্রশ্নে তিনি অবাক হবেন— এমন ধারণা ছিল আমার। কিন্তু অবাক হলেন না। চোখ নামিয়ে হাসলেন। সারা মুখে তৃপ্তি আর লজ্জা ফুটে উঠলো তার। ছেলেরাও লজ্জা পায়! তার বদলে আমি নিজেই অবাক হলাম এবং সম্মত হলাম যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা আমাকে অবাক হওয়ার ক্ষমতা সত্যিই বেশি দিয়েছেন।
“ধীরে ধীরে ইন শা আল্লাহ সব জানতে পারবে।” এতটুকু বলে এবার চোখও তুললেন আর হাতের খাবার আবারও মুখের সামনে ধরে বললেন‚ “বিসমিল্লাহ্ বলে খেয়ে নাও।” এমন আমুদে আমুদে সারাদিন পেরিয়ে গেল। তিনি সত্যিই সারাদিন বাড়িতে রইলেন; এক পা-ও অন্যত্র নড়লেন না।
রাতের আঁধার কে*টে এখনো দিনের আলো ফোটেনি। আজকে আমি নিজেই ঘুম থেকে সাততাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে যখন বের হলাম‚ ভাবলাম তিনি বুঝি জেগেছেন। কিন্তু আজ তার ঘুম ভাঙার নামই নেই। আমি ডাকলাম‚ “ভোর হয়ে যাচ্ছে। উঠুন।” দুই তিনবার বললাম কিন্তু তার থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। খুব বড়াই করে প্রথাটথা উপেক্ষা করলেও অজানা কারণে তার নামটা আমার মুখে এলো না। নাম ধরে ডাকতেই পারলাম না। এদিকে ফজরের নামায কাযা হলো বলে। আমি দ্বিধান্বিত মনে বিছানায় তার পাশে বসলাম। ইতস্তত চিত্তে তার বাহু স্পর্শ করে মৃদু নাড়িয়ে ডাকলাম‚ “শুনছেন?”
প্রায় সাথে সাথেই জবাব এলো‚ “শুরু থেকেই।” কেমন পরিষ্কার গলায় তিনি জবাব দিলেন। আমি প্রায় লাফিয়ে যেন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আর মুখ ছিটকে বেরিয়ে এলো‚ “মানে?”
তিনি চোখ মেলে আমাকে দেখলেন। নিরুত্তাপ গলায় বললেন‚ “বললাম যে শুরু থেকেই শুনছি। আমি তো ভোর চারটা থেকেই জেগে আছি।”
আমি চমকে গেলেও ঈষৎ রাগ ভাসিয়ে জানতে চাইলাম‚ “তাহলে এতক্ষণ ধরে জবাব দিচ্ছিলেন না কেন?”
“ইচ্ছে করেই।”
“কোন কারণে সেটা জানতে পারি?”
শোয়া থেকে চট করে উঠে বসে বললেন‚ “অবশ্যই। দেখছিলাম আমার বউ কীভাবে আমাকে ডেকে তোলে আর এমন করছি জানার পর কী করে।” বলেই হাসলেন।
“সাতসকালে আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি করলেন!”
“অ্যাই‚ এখন এসব কথা রাখো। আগে নামায পড়ে নিই চলো।” বলেই হাত ধরে টানতে লাগলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার পথে।
নাস্তা শেষ করে বের হতে সকাল পৌঁনে সাতটা বেজে গেল। দশটায় ফ্লাইট; এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। মা আর শাপলা ফুপু মিলে বাকি গোছগাছ সেরেছেন বলে তাও বাঁচোয়া নয়তো আটটা বাজেও বের হওয়া যেত কিনা সন্দেহ আছে। কালকে তার কাছে জানতে পারলাম শাপলা ফুপু হলো আমার শ্বশুর বাবার চাচাতো বোন। আপন হলেও খুব গরীব তারা আর দুই কুলে কেউ ছিল না। তাই আমার দাদী শ্বাশুড়ি এই বাড়িতে শাপলা ফুপুকে অনেক ছোটোবেলায় এনে রেখেছিলেন। তার বিয়ে হয়েছিল‚ কিন্তু সংসার টেকেনি। বছর না ঘুরতেই স্বামী মারা যান। ফলে শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে এখানেই আবার চলে আসেন। সবাই বলেছিল আবার তাকে বিয়ে করতে। কিন্তু তিনি আর রাজী হোননি। সেই থেকে এই বাড়িতেই আছেন।
রাস্তায় যানজট দেখে ভেবেছিলাম ফ্লাইট মিস হবে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার মেহেরবানিতে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পেরেছি। প্লেনে বসার পর আমার সমস্ত শরীর বিস্ময়ের ঘোরে ডুব দিয়েছিল কারণ আমি যে জীবনের প্রথম প্লেনে চড়েছি‚ এত কাছ থেকে প্লেন দেখেছি। ছোটোবেলায় মাথার ওপর দিয়ে প্লেন যাওয়ার শব্দ পেলেই পিটপিট চোখে রৌদ্রস্নাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কৌতূহল আর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করতাম। আজ এত বছর পর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে‚ আলহামদুলিল্লাহ।
“বউ গো বউ খালি প্লেন দেখলেই হবে?” জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। নীচু স্বরে করা প্রশ্নটা কানে ভেসে আসতেই ফিরে তাকালাম। তিনি ফিসফিস করে বললেও আমি স্বাভাবিক স্বরে জানতে চাইলাম‚ “তাহলে কী করবো?”
“আল্লাহর বান্দা আর তোমার একমাত্র জামাইকে দেখবে। তোমার দুইখানা হাত দিয়ে তার হাত ধরবে‚ মেহগনি কণ্ঠে তাকে ভালোবাসার কথা বলবে………” হঠাৎ করে তার কী হলো বুঝতে পারছি না। এমন সব কথা কেন বলছে? আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম‚ “আপনার কি শরীর খারাপ?”
কিঞ্চিৎ অবাক হলেন‚ “শরীর খারাপ হবে কেন?”
“তাহলে আজব কথাবার্তার ঝুলি খুলে বসেছেন কেন? মেহগনি কণ্ঠ মানে কী? মেহগনি গাছ বা কাঠ হয়। উপমা যখন দিতে শেখেননি তো দিতে আসেন কেন?” একটু রাগ ভেসে উঠলো আমার কথায়। কিন্তু তিনি পাত্তা দিলেন না। বললেন‚ “এখানে কিন্তু আমি ছাড়া তোমার আপন কেউ নেই।”
“তো?”
“তো? একটু পরেই বুঝতে পারবে‚ তো না থহ।” তাচ্ছিল্যের সুরে তিনি এসব বলে সিট বেল্ট বাঁধতে লাগলেন। আমি এদিকে তার কথার আগামাথা কিছু বুঝলাম না। কিছুক্ষণ অকারণে তাকিয়ে থেকে নিজেও সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম।
পিচঢালা পথে বাস ট্রাকের মতো প্লেন চলতে শুরু করেছে‚ খুব আস্তেধীরে। একবারে তাকে আঁড়চোখে দেখে আমি জানালার বাইরে তাকালাম। মুগ্ধ হয়ে গেলাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার তৈরি সৃষ্টি দেখে। শুকরিয়া আদায় করতে করতে যখন খুশি মনে এটা-সেটা ভাবছিলাম আচমকা প্লেনের গতি বেড়ে গেল। খুব জোরে পিচঢালা পথ বেয়ে যখন প্লেন আকাশমুখি হলো‚ তখন গতিবেগে আমি পিছনের দিকে হেলে পড়লাম; প্লেন পিছনের দিকে বাঁকা হয়ে আছে।
ভয়ে সমস্ত শরীর আমার অসার হয়ে গেছে। নিকাব পরা সত্ত্বেও মুখে দুই হাত গুঁজে চাপা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড এরকম চলার পর প্লেন সোজা হলো ঠিকই কিন্তু মনে হলো নীচে পড়ে যাচ্ছে। আমি আর পারলাম না। তার বুকে মুখে গুঁজে মোজা পরা হাতে শুভ্র পাঞ্জাবি খামচে বাচ্চাদের মতো বায়না করলাম‚ “আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে নামিয়ে দিতে বলুন। আমি যাবো না। যাবো না আমি।”
আমার কান্ড দেখে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন‚ “বলেছিলাম না আমি ছাড়া তোমার এখানে আপন কেউ নেই? জানতাম তো এসব হবে।”
প্রায় কেঁদে দিবো এমন গলায় আমি তাকে আকুতি জানালাম‚ “আমি আর কখনো আপনার সাথে রাগারাগি করবো না। প্লিজ আমাকে নামিয়ে দিতে বলুন। এসব সিলেট ফিলেট আমি যাবো না।”
“রাগারাগি করো তাতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু যদি বলো যে আমার কথা শুনে চলবে তাহলে কিছু একটা করতে পারি।” আমি আগে পিছে কিছু না ভেবেই তার কথায় সায় দিয়ে বলে উঠলাম‚ “শুনবো শুনবো। একশো বার শুনবো।” আমার সম্মতি পেয়ে তিনি নিজের ডান হাতটা আমার পিঠ ঘুরিয়ে আমাকে আরও কাছে টেনে নিলেন। তার পাঞ্জাবি খামচে ধরা হাতের পিঠে বাম হাত দিয়ে মালিশ করতে লাগলেন। এদিকে আমি তো আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলাকে বলছি‚ “আর জীবনেও প্লেন নিয়ে আহ্লাদ করবো না রাব্বুল আলামিন। এবাবের মতো আমাকে বিপদমুক্ত করুন। প্লেন যেন ধ*সে না পড়ে ইয়া রাহীম।”
কতক্ষণ পরে তা জানা নেই। তিনি আমাকে ডাকলেন‚ “মিষ্টি?” কীজন্য ডাকলেন সেটা না শুনেই আমি বলে উঠলাম‚ “না আমাকে ছাড়বেন না। খবরদার ছাড়বেন না। শক্ত করে ধরে রাখুন।”
হালকা হেসে তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন‚ “একেবারে শক্ত করে ধরে রাখবো গো বউ?”
……….চলবে ইন শা আল্লাহ