এক আকাশ অভিমান পর্ব-০৫

0
246

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ৫

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই নামাজ আদায় করে নিলো তরী। শ্রাবণ নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে , ঘুমন্ত শ্রাবণকে বাচ্চাদের মতো লাগছে।একটা সময় এই মানুষটাই ছিল ভীষন কাছের। কিছু ভুল বুঝাবুঝির জন্য আজ কাছের মানুষটাই পর। কিছু কাল আগে যে চোখে নিজের জন্য মায়া দেখতো সেই চোখেই আজ ঘৃনা দেখতে পায় তরী।
ভাগ্যের পরিহাসে সেই মানুষটার সাথেই ভাগ্য জুড়ে গেছে। তবে একটা সময় যে মানুষটা কে মনে প্রাণে চাইতো আজ সেই মানুষটা নিজের স্বামী হওয়া সত্বেও মেনে নিতে পারছে না।
ভালোবাসার মানুষ গুলো যে পরিবর্তন হয়ে গেছে। তরীর মন জুড়ে আজ অনিকের বিচরণ আর শ্রাবণের মনে নদী।

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েকে নিয়ে রওনা দিলো শ্বশুর শাশুড়ির কক্ষের দিকে। উনারা নামাজ আদায় করে এই সময়টায় বসে থাকেন চাঁদ কে কোলে নিয়ে।আর তরী নাস্তা বানায়।। আজও অন্যথা হলো না।
চাঁদ কে রাবেয়া বেগম কোলে দিয়ে বের হবে সেই সময় পিছন থেকে ডাক দিলেন সিরাজুল সাহেব। শ্বশুরের ডাক শুনে দাড়িয়ে গেলো তরী।

” তুমি কি আমার ওপর অভিমান করে আছো বৌমা? ”

” আপনার ওপর আমার কোনো অভিমান বা অভিযোগ নেই বাবা। আপনি আমার শ্বশুর, আপনার ছেলে চলে যাওয়ার পর আমাকে যে দয়া করে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। আপনি চাইলেই আমাকে বের করে দিতে পারতেন কিন্তু আমাকে ঠাই দিয়েছেন। কজন মানুষ সেটা পারে।আপনি আবার আমার বিয়ে দিলেন। ছেলের বউ বলেই হয়তো মন বুঝার চেষ্টা করেন নি। মেয়ে হলে তো বুঝতেন ।”

অবাক হলেন না সিরাজুল সাহেব। তিনি জানতেন তরী এই কথা গুলোই বলবে। তবুও মনে দুঃখ পেলেন।

” শুনো বৌমা, আমাদের কোনো মেয়ে সন্তান আল্লাহ তায়ালা দান করেন নি। একমাত্র ছেলের পছন্দ অনুযায়ী তোমাকে এই বাড়িতে বউ করে নয় মেয়ে করে নিয়ে এসেছি।আমার ছেলেটা দুনিয়াতে নেই কিন্তু তার রেখে যাওয়া অস্তিত্ব তো আছে। তুমি আমাদের মেয়ে তরী। আমাদের বেছে থাকার শেষ আশা। আর চাঁদ তো আমার বংশের একমাত্র প্রদীপ।তোমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার একটাই কারণ যেনো চাঁদ কে আমাদের কাছে রাখতে পারি। তোমাকে নিজেদের কাছে রাখতে পারি। তোমার সৎ মা উঠে পড়ে লেগেছেন তোমাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য। তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিলে আমাদের চাঁদ যে একা হয়ে যেতো। আমি আমার নাতনি কে মা ছাড়া করতে পারি না। একটা দুধের শিশু কে মায়ের থেকে আলাদা করার মতো পাপ আমি করতে পারি নি মা।কিন্তু তোমার ও তো ভবিষ্যৎ আছে চাঁদের ও বাবা প্রয়োজন। ও যদি ছোট থেকেই ওর বাবা কে কাছে না পায় ওর মানুষিক বিকাশে বাধা আসবে। একটা শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের পাশাপাশি বাবার ভূমিকা প্রয়োজন। তোমাকে অন্যত্র বিয়ে দিলে সেই ছেলে টা কেমন হবে চাঁদকে কিভাবে মেনে নিবে সেটা অনিশ্চিত ছিলো। হয়তো মেনে নিবে চাঁদের এই সম্পত্তির জন্য । কিন্তু সেটা মন থেকে নয় লোক দেখানো হবে। তোমাকে বিয়ে দিয়ে একটা পরিচয় দিলাম যেনো কোনো কুদৃষ্টি তোমার উপর না পরে। আমি আর তোমার মা আজ আছি কাল থাকবো না । তখন তোমাদের কে দেখে রাখবে। বিপদে আপদে কে রক্ষা করবে? তুমি একা একটা মেয়ে এই লড়াইটা লড়তে পারবে না।তোমার পাশে তোমাকে আগলানোর জন্য একজন বিশ্বস্ত মানুষ প্রয়োজন ছিল ।শ্রাবণ ভালো ছেলে চাঁদ কে আগলে রাখবে।হয়তো এখনো মন থেকে মানতে পারে নি , আমার বিশ্বাস শ্রাবণ ঠিক মেনে নিবে সব কিছু। চাঁদের বাবা হয়ে উঠতে পারবে।
আমার মেয়ে হলেও আমি এই কাজ টা করতাম।হয়তো তোমার সাথে অন্যায় করেছি। পারলে এই বাবাটাকে ক্ষমা করো মা। আমি তোমাদের খারাপ চাইনা।।”

” আপনি ক্ষমা ছেয়ে আমাকে লজ্জিত করবেন না বাবা।ছোট বেলায় বাবা হারিয়েছি, বাবার আদর স্নেহ কেমন হয় আপনাকে দেখে বুঝেছি। আপনি আমার বাবা, আমার ভালোমন্দ বিচার করার অধিকার আপনার আছে।আমি না বুঝে আপনার উপর অভিমান করে ছিলাম। আমাকে আপনি মাফ করে দিন বাবা।”

“বাবা মায়ের কাজই তো সন্তানদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া। তুমি ছোট মানুষ, জীবনের অনেক পথ তোমাকে চলতে হবে। সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না।আমি যত দিন বেঁচে আছি তোমাদের ওপর আঁচ আসতে দিবো না।”

রাবেয়া বেগম বললেন ,
” বাবা মেয়ের মান অভিমান শেষ হলে আমাদের দিকেও নজর দাও। আমরা দুই বাচ্চা মানুষ যে এখানে আছি সেই দিকে তো কারো পাত্তাই নেই।”

তরী হেসে দিলো শাশুড়ির কথা শুনে। তারপর নাস্তা বানাতে চলে গেলো কিচেনে।


দুপুর একটার দিকে ঘুম ভাঙলো শ্রাবণের। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নদীর অনেক গুলো মিসড কল।সময়ের দিকে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। আজ একটা জব ইন্টারভিউ ছিল। আর সে এত বেলা অবধি ঘুমিয়েছে!! তরী কি একবারও ডেকে দিতে পারলো না? রাগ হলো শ্রাবণের। গলা ফাটিয়ে ডেকে উঠলো তরীকে।

মেয়ে কে নিয়ে খেলা করছিল তরী। শ্রাবণের ডাক শুনে চাঁদ কে শাশুড়ির কাছে দিয়ে ছুটলো কক্ষের দিকে।
শ্রাবণ বিছানায় বসে রাগে ফুসছে। তরী কক্ষে প্রবেশ করতেই ঠাস করে চর বসিয়ে দিলো গালে ।

গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে তরী। শ্রাবণ ঠিক কি কারণে গায়ে হাত তুলেছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে।

” আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন কেন ?”

শ্রাবণ হুংকার ছেড়ে বললো
” সেটা আবার জিজ্ঞেস করছো? আর কত নিচে নামবে তুমি? আমার জীবন টা তো এমনিতেই শেষ করে দিয়েছো আর কি চাও তুমি? তুমি আমাকে সকালে ডেকে দাও নি কেনো ? আমি তো এই রুমেই ছিলাম।আমার জব ইন্টারভিউ ছিল আজ। তোমার জন্য আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। তোমাকে তো বলেছিলাম সকালে আমাকে ডেকে দিতে আমার ইন্টারভিউ আজ। আমার ড্রিম জব ছিল তোমার জন্য সেটাও চলে গেলো।”

” মিস্টার শ্রাবণ!আপনি কি বলছেন সেটা বুঝে বলছেন ?প্রথমত আপনাকে ডেকে দেওয়া আমার কোনো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না অথবা অধিকারের। আর দ্বিতীয়ত আপনি আমাকে এইরকম কিছুই বলেন নি। রাতবিরেতে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরেছেন।একবারও ভাবেন নি ঘরে একটা বাচ্চা আছে। আপনি নাকি আমাদের দায়িত্ব নিবেন? দায়িত্ব কাকে বলে আপনি তো সেটাই জানেন না। মাতলামি করতে হলে এই কক্ষে প্রবেশ আপনার জন্য নিষিদ্ধ।আপনার এই কুপ্রভাব আমার মেয়ের উপর পড়ুক সেটা আমি মেনে নিবো না। ” বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো তরী।

তরীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল শ্রাবণ। কাল নেশা করেছিল সেটা তো ভুলেই গিয়েছিল। ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো ফোনের রিংটোনের শব্দে।রিসিভ করতেই নদী হন্তদন্ত হয়ে বললো

” সরি শ্রাবণ! আমার মনে ছিল না তোমার ইন্টারিউয়ের কথা। তুমি বলেছিলে সকাল ৭টার মধ্যে ডেকে দিতে আমি সকাল বেলা উঠতে পারি নি। ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে অনেক কল দিয়েছি তুমি রেসপন্স করো নি।”

শ্রাবণ কিছু না বলেই লাইন কেটে দিলো। তার মানে সকালে ডেকে দেওয়ার কথা তরী কে নয় নদী কে বলেছিল সে।
অকারণে মেয়েটার গায়ে হাত তুললো। অপমান করলো।বড্ডো অনুশোচনা হতে লাগলো।
একবার ভাবলো ক্ষমা চেয়ে নিবে তরীর কাছে।। কিন্তু জেদ,ইগোর জন্য ব্যর্থ হলো….

#চলবে ইনশা আল্লাহ……