গল্পঃ #ছায়া_বিহীন (২য় পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
যার জন্য নিজের পিতার মৃত্যুর দায়ভার কাঁধে নিয়ে ২৫ টা বছর নিজের মা’কেও দেখার সুযোগ হারিয়েছে জোহানা, সে তার মেয়েকেই কি করে নিজের ছেলের বউ করবে?
সেসময় রসিদ সাহেব জোহানার হাতের উপর আস্তে করে হাত রাখলেন। তাতে জোহানা একটুও চমকালো না কিন্তু শব্দ করে কেঁদে ফেললো। রসিদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন,
___জুহি জুহি তোমার কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? তোমার মায়ের কথা মনে পড়ছে? কিংবা তোমার আত্মীয় কাউকে রাস্তায় দেখেছো?
জোহানা রসিদ সাহেবের হাতে ধরা অবস্থায় উঠে বসলেন। রসিদ সাহেব ভাবলেন নিশ্চয়ই জোহানা নিজের পরিবারের কোনো চিহ্নের মুখোমুখি হয়েছে, এর আগেও এমন হয়েছে! তার চাচাতো বোনকে জ্যামে আটকা অবস্থায় হুট করে দেখেছিলো, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কথা বলার অধিকার ছিল না তার, কিন্তু তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। সেদিনের পর থেকে জোহানা অনেকদিন নিজের পরিবারের কথা মনে করে কেঁদেছে, রাতের বেলা ঘুম থেকেও মা মা কিংবা বাবা বাবা বলে কেঁদে উঠেছে।
এরপর রসিদ সাহেব অনেক চেয়েছেন তিনি শেষবার তাদের পায়ে নত হয়ে ক্ষমা চাইবেন কিন্তু জোহানা সেটাও মানতে রাজী ছিল না। কারণ রসিদ সাহেবের তো সেদিন কোনো দোষ ছিল না। তাহলে তিনি কেন মাফ চাইবেন!
জোহানা আর স্বামীর হাতটা আরো শক্ত করে ধরে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,
___ইনাম..ঊষা মানে ঊষার বাবা রোমান সিদ্দিক! আমি কি করে ওই বাড়িতে নিজের ছেলেকে বিয়ে করাবো? কিন্তু আমার ছেলের চেহেরাটা দেখেছিলে তুমি? আমি নিতে পারছিনা কিছু!
রসিদ সাহেব এখনো কিছু বুঝতে পারলো না। তিনি বললেন.
___হ্যাঁ রোমান সিদ্দিকের মেয়েই তো ঊষা। কি হয়েছে ওই বাড়িতে?
___তুমি কি করে ভুলে গেলে রোমান কে ছিল? মনে নেই ২৫ বছর আগে আমাকে ঠিক কোন অবস্থায় তুমি বিয়ে করেছিলে? নিজের পরিবার যখন আমাকে তাদের মেয়ে বলতে অস্বীকার করেছিল, শুধু পরিবার না পুরো গ্রামবাসী আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। নিজের প্রেমিক মাঝ রাস্তায় ফেলে হারিয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেসময় একটা মানুষই আমাকে ভরসা দিয়েছিলো। সেটা তুমি! আমি সব হারিয়েও শুধু তোমায় নিয়ে পুরো পৃথিবী ভুলে গেয়েছিলাম। এতো বছর পরে নিজের সন্তানের জীবনের সাথে জড়িয়ে সেগুলো কেন আজ সামনে আসতে হচ্ছে? না না আমি চাইনা এই সম্পর্ক, আমি আমার ছেলের বিয়ে ওই বাড়িতে দিতে পারবোনা।
রসিদ সাহেবের বুকে মুখ গুঁজে জোহানা কাঁদতে লাগলো। উনার সবকিছু বুঝতে আর কষ্ট হলোনা। এতো বছর পর রোমানের নামটা মনে না থাকারই কথা,কারণ জোহানা সেদিনের পর এই নামটা আর উচ্চারণ করেনি। তাছাড়া রসিদ সাহেব তখন রোমানকে দেখেওনি।
”
”
রোমান আর জোহানার প্রথম দেখা হয়েছিল ট্রেনে। পরিবারের সঙ্গে জোহানা সিলেট থেকে ঢাকা গমন করছিলো, আর রোমান বন্ধুদের সাথে সিলেটে ভ্রমণ করে নিজের শহরে ফিরছিলো।
দুজনের সীট পাশাপাশি ছিল, প্রথম দেখাতেই রোমান জোহানার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। রোমানের ভাব ভঙ্গিতে জোহানা সবকিছু স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলো। রোমানের বাঁকা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা, কেন জানি জোহানাকে এলোমেলো করে দিচ্ছিলো। সেদিন জোহানা বুঝতে পেরেছিলো প্রথম দেখাতেও প্রেমে পড়া যায়! ট্রেন থেকে নামার সময় দরজার সামনে ভীড় ছিল, তখন তার পরিবারের চোখের আড়ালে রোমান তার হাত ধরে ফেলেছিল, জোহানা কোনো রকম হাত ছাড়িয়ে ট্রেন থেকে নেমেছিল কিন্তু আর রোমানকে তখন আর দেখতে পায়নি। তার ভেতরটা কেমন যেন করছিল, কথা বলার কোনো মাধ্যম যে নেই! তার উপর তার নাম ঠিকানা কিছুই সে জানেনা। চারপাশে যতটা সম্ভব সে রোমানকে খুঁজেছিল। কিন্তু পায়নি।
ঢাকাতে তার আত্মীয়ের বাসায় গিয়েও তার মনে হয়েছিল তাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। কিংবা ছেলেটার সাথে তার কথা হবে। রাতে পোশাক পরিবর্তন করতে জোহানা তার কাঁধ ব্যাগের চেইন খুলতে যাবে তখনি সেখানে আটকে থাকা একটা ছোট্ট কাগজ নিচে পড়ে গেলো। কাগজটা খুলে দেখলো সেখানে লেখা.. রোমান সিদ্দিক এবং তার নিচে নাম্বার দেওয়া। জোহানা বুঝতে পেরেছিলো ট্রেন থেকে নামার সময় ভীড়ের মধ্যে রোমান এই কাজ করেছে। এক গাল হেসে লেখাটার উপর তাকিয়েছিল অনেক্ষণ!
তখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ছিল না৷ তাদের বাসায় একটা ল্যান্ডফোন এবং শুধুমাত্র তার বাবার হাতে একদম নরমাল নোকিয়া একটা সেট ছিল।
নাম্বারটা জোহানা এতবার পড়েছিল যে মুখস্থ হয়ে গেছে।
পরেরদিন তার বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে মোবাইল এনে রোমানকে ছোট করে মিসডকল দিয়েছিল, কারণ টাকা কেটে গেলে তার বাবা বকা দিবে। আর তখন প্রতি মিনিটে অনেক টাকা কেটে যেতো।
মিসডকলের সাথে সাথে রোমান কল ব্যাক করেছিল। তার কথা ছিল সে জোহানার ফোনের অপেক্ষায় ছিল।
এরপর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েক মিনিট কথা হতো তাদের। এই থেকে গভীর সম্পর্ক, দুজন দুজনের প্রতি ছিল তীব্র আকুলতা। সেবার ঢাকা থেকে আসার সময় জোহানার কথামতো রোমান স্টেশনে এসে আগে থেকেই তাকে দেখার অপেক্ষা করছিলো। লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে সেদিন চোখে চোখে তাদের অনেক কথা হয়েছিল। এটাই ছিল তাদের প্রেমের ২য় এবং শেষ দেখা।
কিন্তু দীর্ঘ দুইবছর তাদের ফোনে কথা বলা হতো, খুব বেশিনা দুই তিন মিনিট কথা বলার মধ্যে রোমানের জন্য আকাশসম অনূভুতি খুঁজে পেতো জোহানা।
অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছিল তখন, যখন জোহানার বিয়ে ঠিক হয়। জোহানা যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, যার জন্য যে কেউ একবার দেখলে প্রেমে পড়তে বাধ্য।
অনেকেই জোহানাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে পাগলাটে ছিল রসিদ। কিন্তু সে বখাটে ছেলেদের সাথে থাকতো, আচরণও ছিল বখাটে। কিন্তু জোহানার দিকে সে ছিল দূর্বল। রসিদের জন্য জোহানাকে কেউ ডিস্টার্ব করতে সাহস পেতোনা। রসিদের মা বাবা ছোট বেলায়ই মারা গিয়েছিল, বড় ভাই ভাবীদের কাছে অনেকটা অবহেলায়ই সে বড় হয়েছে, তাই পড়ালেখা মেট্রিক পর্যন্ত গিয়েই থেমে গিয়েছিল। কিন্তু রসিদের বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ পেয়েছিলো অনেক, যার কিছু কিছু বিক্রি করেই সে নিজের মতো টাকা উড়াতো।
জোহানার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে সে জোহানার বাবার কাছে গিয়ে অনেক আকুতি করেছিলো তাকে বিয়ে করার। কিন্তু তাকে অযোগ্য বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল জোহানার বাবা। জোহানা শুনেছিলো এরপর নাকি রসিদ নেশা করতো, গায়ে হলুদের আগের রাতে জোহানার জানালার কাছে এসে রসিদ চিৎকার করে করে বলেছিল, মনে রাইখো তোমারে না পাইলে আমি এভাবেই তিলে তিলে মইরা যামু।
কিন্তু রসিদ জানতো না, জোহানা এই বিয়েতেও রাজী নয়, রসিদ এটাও জানতো না গোপনে জোহানার অন্য কারো সাথে প্রেম ছিল।
পরেরদিন গায়ে হলুদের রাতে সে রোমানের সাথে কথা বলেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল জোহানা। রাতের ট্রেনে সে ঢাকা গিয়েছিল। পৌঁছাতে ভোর প্রায় হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে রোমান ছিল না। সকাল হওয়ার পরে বাইরে থেকে তার নাম্বারে অনেকবার ট্রাই করেছিলো কিন্তু রোমানের নাম্বার চিরতরে বন্ধ।
সারাদিন অপেক্ষা করে কাঁপা কাঁপা হাতে সাথে নিয়ে আসা ব্যাগটা আবার হাতে তুলে নিয়েছিল জোহানা।
যেমন রাতে বের হয়েছিল, তেমন রাতেই সে নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণে পা রেখেছিল তবে বিয়ে হচ্ছেনা তবুও বাড়িতে ছিল গ্রামের মানুষের উপচে পড়া ভীড়, সবাই কাঁদছিল। বাড়িতে শুধুই শোরগোল। লোকজন কি জানি বলাবলি করছিল। জোহানা আড়াল থেকে শুনলো কে জানি বলছে..
__বাপের একটা আদরের মেয়ে ছিল। বিয়ের আগেরদিন কার সাথে যেন পালিয়ে গেছে, মেয়ের শোক, লোকজনের নিন্দা আর বরপক্ষ থেকে অপমান মেয়েটার বাবা সহ্য করতে পারে নাই, হার্ট অ্যাটাক করেছে। হাসপাতালে নিছিলো কিন্তু বাঁচাতে পারে নাই। মেয়ে স্বামী হারিয়ে মেয়ের মাও পাগল পাগল অবস্থা।
এটা শোনার পরে জোহানার পুরো পৃথিবী এখানেই থেমে গিয়েছিল। অজান্তেই সে চিৎকার করে উঠেছিল, সাথে সাথে তার কাছে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। সবাই খুব বাজেভাবে বকছিল তাকে, চিনেনা এমন মানুষও তাকে মারতে এসেছিলো সেদিন। তার মা তার ফিরে আসার কথা শুনে বলেছিল কোনোভাবেই যেন তার বাবার মরা মুখ তাকে দেখতে না দেওয়া হয়, এবং উনার সামনেও যেন কোনোদিন না আসে। তাহলে উনিও তার স্বামীর মতো চলে যাবেন। নষ্টা কলঙ্কনী বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে লোকজন তাকে বের করে দিয়েছিল। তার জানা ছিল না সে তখন কোথায় যাবে এবং কি করবে?
কিন্তু একটা মানুষ কোনো কিছু না জেনেশুনেই তার হাতটা ধরেছিল ,এবং কাজী ডেকে বিয়ে করেছিল।
সে-ই ছিল আজকের এই রসিদ! বিয়ের রাতে রসিদ কি হয়েছিল একবারও জিজ্ঞাসা করেনি, তাও জোহানা তাকে সব বলেছিল। কেন জানি মানুষটা চোখ বন্ধ তার সব কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিল।রসিদের জায়গায় অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই অনেক কিছু ভাবতো! রাতের বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে পরেরদিন রাতে ফেরা একটা মেয়ের জন্য কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু অঢেল বিশ্বাস নিয়ে তারা নতুন গন্তব্য শুরু করেছিল।
জোহানার জন্য সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিয়েছিল রসিদ। গ্রাম থেকে তারা শহরে বাসা নিয়েছিল, তার পাওয়া গ্রামের জমি বিক্রি করে রসিদ ব্যবসা করে শুরু করে। এক বছরের মাথায় তাদের কোল আলো করে ইনাম জন্ম নেয়। ভাগ্য ধারায় কয়েক বছরে তার ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে। এর ৭ বছরের মাথায় তারা ঢাকা চলে আসে। ধীরে ধীরে রসিদ হয়ে যায় শহরে একজন নামকরা ব্যবসায়ি। তাদের কোনো কিছুরই এখন কমতি নেই, বাড়ি, গাড়ী, ছেলেটাও মানুষের মতো মানুষ !
কিন্তু জোহানার ভেতর এখনো সেই শূন্যতা, সেদিনের করা ভুলটা তাকে খুড়ে খুড়ে খায়। তার জন্য তার বাবা মারা গেছে! তার মা তাকে অস্বীকার করে। সেদিন তার মা তাকে কতটা ঘৃণা করলে রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিল? জোহানা ভাবে নিজের বাবার কাছে তো বেঁচে থাকতে মাফ চাওয়ার সুযোগ নেই, অন্তত নিজের মায়ের কাছে যদি মাফ পেতো হয়তো মৃত্যুকালেও সে কিছুটা স্বস্তি পেতো।
কিন্তু তার সাহস হয়না!
”
”
রসিদ সাহেব জোহানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
___ তুমি যা চাইবে তাই হবে জুহি! তুমি যদি চাও ইনামের বিয়ে হবেনা ওই বাড়িতে৷
কিন্তু জোহানা আস্বস্ত হতে পারছেনা, কি করে হবে?
তার ছেলের ভালোবাসাকে তিনি প্রথম থেকে সাপোর্ট করেছেন, ঊষাকে তিনি দেখেছেন এবং মাঝে মাঝে কথাও বলেন। এখন নিজের অতীতের জন্য দুটো মনকে তিনি কি করে ভেঙে দিবেন? জোহানা ভালো করেই জানেন তার ছেলে তার বাধ্য এবং কোনো কিছু না জেনেও মায়ের কথায় সে ঊষার কাছ থেকে ফিরতে চাইবে কিন্তু ইনাম ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মা হয়ে জেনে-বুঝে সেটা কি সহ্য করবেন জোহানা?
জোহানা রসিদ সাহেবের হাতটা ছেড়ে আস্তে আস্তে ইনামের রুমের দিকে গেলেন। রুমে ঢুকার আগেই দেখলেন ইনাম রুম থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছে, মাকে দেখেই বললো,
___আম্মু তুমি একটু সুস্থ বোধ করছো? তুমি আসলে কেন? আমাকে ডাকতে পারতে। এমনিতেও আমি এখন যেতাম।
___ মা একদম ঠিক আছি বাবা। আসো রুমে আসো।
ইনাম তার মায়ের সাথে গিয়ে বসলো। তার মা কিছু বলতে চাইলো তার আগেই ইনাম বললো,
___ আম্মু ঊষার আব্বুর নাকি বিয়েতে অমত নেই, কিন্তু তুমি চাচ্ছোনা, এমন কিছুই বললো ঊষা। আমি একদম বিশ্বাস করিনি। সে হয়তো মজা করেছে। আমি তো ভালো করেই জানি তুমি ঊষাকে কতটা পছন্দ করো।
ছেলের কথা শুনে জোহানার চোখ আবার ছলছল করে উঠলো। মাথা নেড়ে বললো
__ হ্যাঁ ঊষা ঠিকি বলেছে ইনাম!
চলবে…….