হারিকেন পর্ব-০৮

0
1870

#হারিকেন (সাজু ভাই সিরিজ)
#পর্ব:- ০৮

মেয়েটা বললো, সামনে বাড়ালে সাজুর গলা কেটে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। আমি এতটা বোকা নই যে বুদ্ধি করে আমাকে ধরা হবে।

– সজীব বললো, তুমি কিন্তু অনেক খেলা খেলছো এখন বন্ধ করে নিজে আত্মসমর্পণ করো নাহলে কিন্তু পরিমাণ ভয়াবহ।

– তাহলে আমাকে যেতে দাও, আমি যদি এখান থেকে যেতে পারি তবে তাকে কিছু করবো না।

– পুলিশ বললো, সেটা সম্ভব না তোমার জন্য খুব ভালো হবে তুমি যদি আত্মসমর্পণ করো।

– ধরা যদি পরতেই হয় তাহলে সাজু সাহেবকে খুন করে তারপর আত্মসমর্পণ করবো, সাজু সাহেব আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে।

মেয়েটা যখন সজীব আর পুলিশের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল তখন সাজু আস্তে আস্তে নিজের হাত দিয়ে বালিশ সরিয়ে মুখের উপর দিল। আর দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে থাকা কবিতা সেটা দেখতে পেয়ে নিজের হাতের ভাতের বাটিটা তার সজোরে মারলো মেয়েটা হাঁটু বরাবর। মেয়েটা তখন ধুম করে না দেখেই সেকেন্ডের মধ্যে হাত রাখলো সাজুর মুখের দিকে কিন্তু ছুরিসহ হাতটা পরলো বালিশের উপর। আর এই দুই সেকেন্ডের মধ্যে সজীব এক লাফ দিয়ে মেয়েটার কোমড়ের কাছে ধরে এক জাটকা মের ফেলে দিল ফ্লোরে। দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ দুজনেই তাদের দায়িত্ব পালন করতে ভুলেন নাই, তারাও সঙ্গে সঙ্গে ওই মেয়েকে ধরে হাত পিছনে করে ফেললো।

মেয়েটা অসহায় হয়ে কেঁদে উঠলো, আর সাজু ভাই তখন মুখের উপর দিয়ে বালিশ সরিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসতে চাইলো। কবিতা সেটা লক্ষ্য করে নিজেই এগিয়ে গিয়ে সাজুকে ধরে বসতে সাহায্য করলো।

– সজীব বললো, তুই ঠিক আছিস তো সাজু?

– হ্যাঁ ঠিক আছি, সজীব তাড়াতাড়ি কেবিনের দরজা বন্ধ করে দে কাজ আছে।

দরজা বন্ধ করে সজীব সাজুর দিকে তাকিয়ে রইল আর সাজু তখন আস্তে করে বললো:-

– বাহিরে প্রচার করে দিবি যে সাজু ভাই একটা অপরিচিত মেয়ের ছুরিকাঘাতে মারা গেছে।

– কিন্তু কেন?

– বলছি একটু পরে।

এরপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

– ইন্ডিয়ান বাংলা একটা সিনেমার মধ্যে একজন ভিলেনকে বলতে শুনেছিলাম ” হারামির সঙ্গে গেইম খেলতে গেলে জাত হারামি হতে হয়। ” তবে তুমি বা তোমার মূল কারিগর কেউ কিন্তু আমার মতো নয়, তাই মারিয়ার মাধ্যমে আমাকে এখানে ডেকে ভুল করছো। নাম কি তোমার?

– মেয়েটা চুপচাপ।

– সজীব বললো, ওই ছেমরি নাম বল।

– মেয়েটা জড়ানো কণ্ঠে বললো, জুলি।

– সাজু বললো, আমার ধারণা যদি ভুল নাহয় তবে তোমার সঙ্গে মারিয়ার স্বামী রাহাত সাহেবের ছোট ভাই রোহানের সম্পর্ক আছে, তাই না?

মেয়েটা তার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, আর সজীব নিজেও অবাক হয়ে গেল। কবিতা শুধু সাজু ভাইয়ের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে তবে কিছু বলছে না।

– মেয়েটা মাথা নেড়ে বললো, রোহান নামে কেউ আমার পরিচিত নেই। কে সে?

– ওসি সাহেব কিন্তু চিকন রড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগিয়ে আপ্যায়ন করতে পারে। সেই আপ্যায়ন শেষে তোমার চেয়ে অনেক বড় বড় অপরাধীরাও সবকিছু টেলিভিশনের খবরের মতো হড়হড় করে বলে দেয়।

– জুলি মেয়েটা চুপচাপ।

– সাজু বললো, আর চিকন নিডেল হাতের দশটা আঙ্গুলের প্রতিটি আঙ্গুলে একটা করে গাঁথা হয়। তবুও যদি মুখ দিয়ে উচ্চারণ বের না হয় তাহলে নিস্তব্ধ রাতের থেরাপি চলে। যদি সকল আপ্যায়ন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাও তাহলে আমার কথা অনুযায়ী কাজ করো। রোহানের কথা মেনে তো বহু অন্যায় করলে কিন্তু ফলাফল কি হলো?

– আমি কিছু জানি না।

– বাচ্চাদের মতো কথা বলতে নেই, তোমাকে তো ধরা হয়েছে এখন রোহানকেও ধরা হবে। তারপর ডাক্তার জাফর চৌধুরীকে হত্যার কারণে রোহানের ফাসি হবে, তুমি তাকে নিয়ে বিয়ে করে সংসার করার যে স্বপ্ন দেখো সেটা স্বপ্নই থাকবে। একটা কথা মনে রেখো, ভুল রাস্তা যতই ভালো কিংবা পরিষ্কার হোকনা কেন সেটা সবসময় তোমাদের ভুল গন্তব্যে নিয়ে যাবে।

– মেয়েটা চুপচাপ।

কেবিনের সামনে নার্স ও ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে, ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে বলে কোন শব্দ করে না। ওসি সাহেবকে শুরতেই খবর দেয়া হয়েছে তাই তিনিও এখন প্রায় অর্ধেক পথ চলে এসেছে। এতবড় হাসপাতালের মধ্যে সবাই যে যার রোগীর সঙ্গে ব্যস্ত, আর এদিকে সাজু ভাই তার রহস্য নিয়ে ব্যস্ত।

– মিনিট পাঁচেক চুপ থেকে হঠাৎ করে জুলি নামের মেয়েটা বললো, আমাকে বাঁচতে হলে কি করতে হবে আমার?

– সাজু বললো, রোহানকে কল দিয়ে বলবে যে তুমি আমাকে খুন করতে সক্ষম হয়েছ। আর সে এখন কোথায় আছে সেটা জানবে, মারিয়াকে সে কোথায় বন্দী করেছে সেটাও জিজ্ঞেস করবে৷

– তাহলে আমাকে ছেড়ে দিবেন?

– বিবেচনায় থাকবে।

– আমি যদি কল করি তাহলে মারিয়াকে রোহার এমনিতেই ছেড়ে দেবে তাই তাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।

– হ্যাঁ করো।

– আপনি রোহানকে কীভাবে জানলেন?

– অনুমান করে।

– মানে…?

– হাসপাতালে দাঁড়িয়ে রাহাত সাহেবের কাছে যখন রোহানকে দেখেছি তখনই কিছুটা সন্দেহ ছিল আমার। আমি সেজন্য তার কথা আমার নোটবুকে লিখেছিলাম, কিন্তু তুমি যখন আমাকে জিইসি মোড়ে গিয়ে বিষাক্ত পানির বোতল দিয়ে আহত করলে। তখন সেখানে রাস্তার ওপারে সোহাগ পরিবহনের কাউন্টারের গেইটের কাছে রোহান দাঁড়িয়ে ছিল। আমি কিছুক্ষণ অসুস্থ হয়ে থাকার পরে ওরা যখন আমাকে সিএনজির মধ্যে তুললো তখনও আমার চেতনা ছিল। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে যখন সেই দিকে তাকালাম তখন তোমাকে তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি বোরকা পরে। তুমি সেই মেয়ে, যে কিনা আমাকে কক্সবাজার বসে যারা আক্রমণ করেছে তাদের সঙ্গে ছিলে।

– মেয়েটা চুপচাপ।

ওসি সাহেব পৌঁছে গেছেন, হাসপাতালের মধ্যে সাজু ভাইয়ের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেল। মেয়েটা ওসি সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মোবাইল বের করে রাহাতের ভাই রোহানকে কল দিয়ে বললো যে সাজুকে সে খুন করেছে। রোহান তখন খুব আনন্দের একটা হাসি দিল আর সঙ্গে সঙ্গেই জুলির হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়া হলো।

★★

সাজুকে লাশ সাজিয়ে হাসপাতাল থেকে বাহির করে নিয়ে যাওয়া হলো ওসি সাহেবের বাড়িতে। সঙ্গে গেল কবিতা, আর সেই খালি এম্বুলেন্সটাক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ঢাকার দিকে। কারণ সেই রোহান যদি অন্য লোক পিছু লাগিয়ে দেয় তবে সে যেন সত্যিটা বুঝতে না পারে। আর জুলিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো হাজতে।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের নিচে দাঁড়িয়ে টিভিতে খবরের মধ্যে সদ্য পাওয়া একটা ” ব্রেকিং নিউজ ” মনোযোগ দিয়ে সবাই দেখছে। সাজু ভাই নামের যে লোকটা এই হাসপাতালের মধ্যেও এসেছিল সে একটু আগেই খুন হয়েছে চকবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর এমনিতেই হাসপাতালের এই ঘটনা নিয়ে চলছে এক চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি, তাই উক্ত খবরের জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে।

মারিয়ার শশুর এই খবর দেখে দৌড়ে দৌড়ে তিনি কেবিনে গেলেন, কেবিনে ঢুকেই সামনে বসে থাকা মারিয়া রাহাত ও রোহানের দিকে তাকিয়ে বললো,

– সাজু নামের যে ছেলেটা রক্ত দিয়েছিল সেই ছেলে একটু আগে খুন হয়েছে, একটা মেয়ে নাকি খুন করেছে। মেয়েটা ধরা পরেছে ঠিকই কিন্তু সাজু কে নাকি বাঁচাতে পারা যায় নাই।

সাজুর মৃত্যুর খবর শুনে মারিয়া ও রোহানের মুখে কোন ভাবান্তর ঘটে নাই কিন্তু শেষের বলা সেই মেয়ে নাকি ধরা পরেছে এটা শুনে চমকে গেল। মারিয়া ও রোহান দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল অবাক চোখে। তারপর রোহান তার চোখ দিয়ে ইশারা করতেই হঠাৎ করে মারিয়া নাটক করার সুরে বললো:-

– কি বলেন বাবা? আল্লাহ গো এটা কি হয়ে গেল? এ কথা বলে কেবিনের দরজা খুলে বের হয়ে গেল মারিয়া।

আর রোহান তখন ” ভাবি কোথায় যাচ্ছেন? কোই যান আপনি? ” এগুলো বলতে বলতে পিছনে পিছনে বেরিয়ে গেল। মারিয়ার শশুর তখন রাহাত সাহেবের পাশে বসে রইল, কি করবেন যেন কিছু বুঝতে পারছেন না। তবে মারিয়া ও রোহানের চোখের ইশারা দেখে ফেলেছিল রাহাত সাহেব, আর তিনি তখন ভাবছেন ” ঘটনা কি? ”

.

– হাসপাতালের এক সাইডে দাড়িয়ে চিন্তিত হয়ে মারিয়া রোহানকে বললো, তুমি তো একটু আগে বললে যে সাজুকে খুন করে মেয়েটা পালিয়ে গেছে তাহলে ধরা পরেছে কীভাবে? এখন ওই মেয়ে যদি আমাদের কথা পুলিশের কাছে বলে দেয় তাহলে কি বাঁচতে পারবো?

– ভাবি চুপ করো, সবকিছু গন্ডোগোল হয়ে গেল কীভাবে? জুলি তো একটু আগে কল দিয়ে বললো সে খুন করে চলে এসেছে।

– এজন্য তোমাকে বলেছিলাম যে আমি গিয়ে নিজ হাতে কাজটা করে আসবো। কিন্তু তুমি কেন তাকে পাঠাতে গেলে?

– আমি তো তোমার ভালোর জন্য করেছি ভাবি, আর তাছাড়া তোমার সাহস কম। কিন্তু জুলি তো অনেক সাহসী, কক্সবাজার গিয়ে ওই দ্বিতীয় ডাক্তার আর সাজুকে যেভাবে আক্রমণ করলো।

– সেসব বলে লাভ কি এখন? এখন এসব চিন্তা বাদ দিয়ে চলো আমরা পালিয়ে যাই, টাকার জন্য আর মায়া করে লাভ নেই রোহান। রাহাতের তো সই লাগবে সেই টাকা তুলতে, আর টাকার জন্য যদি লোভ করি তাহলে ধরা পরবো।

– কিন্তু যে টাকার জন্য এতকিছু করলাম, তুমি আর আমি অনেকদূর গিয়ে টাকা দিয়ে নতুন করে জীবন সাজাতে চাইলাম। সেই টাকা ছাড়া তুমি আমি কোথায় যাবো ভাবি?

– তাহলে কি আত্মসমর্পণ করবো?

– ভেবেছিলাম সাজুকে হত্যা করতে পারলেই সেই জুলিকে খুন করে পথ থেকে সরিয়ে দেবো কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল? সাজু ঠিকই মরলো কিন্তু আমাদেরকে মেরে তারপর মরছে।

– শুরুতেই তোমাকে বলেছিলাম সাজুকে এসবের মধ্যে জড়িয়ে বিপদ নিয়ে এসো না কিন্তু তোমার নিজের পুরনো শত্রুতা মেটাতে তুমি তাকে টেনে এনে খাল কেটে কুমির ডাকলে।

– আগে তো বুঝতে পারিনি ভাবি, নাহলে তো সেই কক্সবাজারে ওকে জুলিকে দিয়ে খুন করাতাম।

– আচ্ছা তুমি তো চেয়েছিলে সাজুকেও হত্যা করে দেবে, তাহলে সেদিন কেন তাকে একদম হত্যা না করে বাঁচিয়ে রাখতে বললে?

– সেটা কিন্তু তুমিও ভালো করে জানো ভাবি।

– কি জানি আমি?

– আমাদের এই হাসপাতালে যিনি খুন হয়েছে সে আমাদের হাতে খুন হয়নি, তাহলে তাকে কে খুন করেছে? কক্সবাজারে জুলি আক্রমণ করেছে সত্য কিন্তু এখানে কে খুন করেছে?

– তাই তো, আমি নিজেও এটা নিয়ে ভাবছি জানো তুমি? আমি কিন্তু সেদিন ঠিকই খুন করতে গিয়ে চমকে গেলাম, কারণ আমাদের পরিকল্পনা ছিল তাকে খুন করবো। কিন্তু আমাদের আগেই তাকে কে খুন করেছে সেটাই তো জানি না।

– আমি সেটাই তদন্ত করার জন্য সাজুকে খুন করতে নিষেধ করেছি ভাবি, সাজু নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে বের করবে। আর তার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর তুমি ভাইয়ের কাছ থেকে চেক সই করিয়ে সব টাকা নিয়ে পালাবো। কিন্তু এখন….

– রোহান আমার মনে হচ্ছে যেকোনো সময় এই হাসপাতালে ওসি সাহেব আসবে। আর না এলেও এখানে যারা পাহারায় রয়েছে তাদের হুকুম করে আমাদের ধরতে বলবে।

– তাহলে কি করবা ভাবি?

– জানি না।

– চলো পালিয়ে যাই।

– সত্যি তো?

– হ্যাঁ।

★★

ওসির বাড়িতে বসে সাজু ভাই ও ওসি সাহেব বসে আছে মুখোমুখি, ওসি সাহেব বললো:-

– আপনি রোহানকে গ্রেপ্তার করতে নিষেধ করে তার পিছনে লোক লাগাতে কেন বললেন?

– স্যার খুবই সহজ, আমি জানি রোহান আর জুলি দুজনে এখানে জড়িত নয় বরং আরও অনেকে জড়িত আছে। তাই আমার মৃত্যুর খবর শুনে রোহান কার কার সঙ্গে যোগাযোগ বা আলোচনা করে সেটা জানতে হবে।

চলবে…

লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)