#সেই তুমি
#পর্ব-১৮
#-সানজিদা সন্ধি
পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলো জাফনা। চারদিক থেকে তখন আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সালাত আদায় করেই গোসলে ঢুকলো সে। শীতকালে বরাবর সে গোসলের জন্য গরম পানি ব্যাবহার করলেও আজ কনকনে ঠান্ডা পানি শরীরে দিলো। দীর্ঘক্ষণ ধরে পানির নিচে দাঁড়িয়ে রইল। ভীষণ শান্তি লাগছে তার। এরপর রুমে এসে রেডি হতে লাগলো কলেজের জন্য। স্কুল ড্রেস পরে, হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে পরিপাটি করে দুই বেণী করলো, ঠোঁটে দিলো ভ্যাসলিন আর মুখে একটা বেবি ক্রিম। কাল সারারাত ধরে জাফনা ভাবলো প্রপোজ যখন একদিন করবেই তখন সেটা তাড়াতাড়ি করে দেওয়াই ভালো। আজ বুকে সাহস সঞ্চার করে কাজটা করেই ফেলবে সে। আহনাফ হয়তো অনেক ধমকাবে, বকবে, বাসায় কমপ্লেন জানাতেও পারে কিন্তু যাই হয়ে যাক না কেন আজ জাফনা আহনাফকে তার মনের কথা জানাবে। আহনাফ প্রতিদিন বাইকে করে কলেজে আসে। কলেজের পার্কিং জোনে বাইক পার্ক করে সে। আহনাফ কোনো এক কারণে সবার আগেই কলেজে আসে যখন খুব বেশি ছাত্র ছাত্রী বা মানুষজন থাকে না। জাফনা কলেজের দারোয়ানের থেকে রাতেই সব খবর জোগাড় করে রেখেছিলো। স্কুলের ম্যাগাজিনে তার নম্বর ছিলো। সেখান থেকে ইনফরমেশন কালেক্ট করে সব প্ল্যানমতো সাজিয়ে নেয় জাফনা। সে আজ আহনাফেরও আগে স্কুলে এসেছে। শীতের প্রভাব দিনদিন কমছে। সকালে আর সন্ধ্যায় যা একটু অনুভত হয়। স্কুলে আসার সময় জাফনা বাগান থেকে একটা গাঁদা ফুল ছিঁড়ে আনে। সবাই তো গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করে সে নাহয় গাঁদাফুল দিয়েই করলো। তাতে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
পার্কিং জোনে পায়চারি করছিলো জাফনা। এরমাঝেই আহনাফ এলো। সকাল সকাল জাফনাকে এমন স্থানে দেখে আহনাফ ভ্রু কুঁচকালো। জাফনা সালাম দিয়েই হুড়মুড় করে আহনাফের সামনে আসলো। আহনাফ জাফনাকে দেখে বুঝলো সে কোনো একটা কারণে ভীষণ নার্ভাস। কিন্তু কারণটা ধরতে পারলো না সে। আর পারবেই বা কী করে। পারার কথাও নয়। জাফনা স্কুল সোয়েটারের পকেট থেকে গাঁদা ফুলটা বের করে একনাগাড়ে বলতে লাগলো,” দ্যাখেন স্যার আই লাভ ইউ। কখন, কীভাবে, আপনার ভালোবাসার পুকুরে টুপ করে ডুবে গিয়েছি জানিনা। এখন কথা হচ্ছে আমাকে গ্রহণ করেন। আর বলেন আই লাভ ইউ টু। জানি আপনি একটু রাক্ষস টাইপের। আপনার সাথে কোনো সুস্থ মানুষ থাকতে পারবে না। তারপরেও আই লাভ ইউ। হুস কিসব বলছি। এতোকিছু জানিনা এবার উত্তর দিন!”
জাফনা ভেবেছিলো এসব বলার পরে আহনাফ কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারবে তাকে, বকাঝকা করবে। এসব সহ্য করার জন্য প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে সে। কিন্তু জাফনার সমস্ত ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে আহনাফ বললো, ” তোমাকে এই ফালতু ডেয়ার আবার কে দিয়েছে হ্যাঁ? তাকে ধরে নিয়ে এসো। এবার তোমাকে না তাকে দেখে নিবো আমি।”
হাওয়া অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে জাফনা তড়িঘড়ি করে বললো, “আরে স্যার! ট্রাস্ট মি এটা ডেয়ার নয়। আমি সত্যি ভালোবাসি আপনাকে। ”
আহনাফ কিছুক্ষণ ভাবলো যে মেয়ে তাকে দুদণ্ড সহ্য করতে পারে না সেই মেয়ে আবার তাকে প্রেম নিবেদন করছে। আজব। আহনাফ এবার সরাসরি বললো, ” বুঝেছি পাওয়ার খাটিয়ে আমার সাথে জিততে পারোনি বলে এখন বুদ্ধি খাটাতে এসেছো? এসব বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দাও। ”
কথাগুলো বলে হনহনিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলো আহনাফ। ততক্ষণে সবাই একেএকে আসতে চলেছে স্কুলে। জাফনা দৌড়ে গিয়ে বললো,” কেন বিশ্বাস করছেন না স্যার? আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি।” আহনাফ রেগে গিয়ে বললো, ” তুমি যে সত্যি কথা বলছো সেটা আমি বুঝবো কি করে? আচ্ছা এককাজ করো! ছয়তলা থেকে মাটিতে ঝাপ দাও। তারপর আমি বিশ্বাস করবো তোমার বচন।” আহনাফের কথা শুনে জাফনা আহাম্মক হয়ে গেলো। এমন আহাম্মক সে তার পুরো জীবনেও হয়নি। কী ছেলে বাপরে বাপ। এমন কথা কেউ কাউকে বলতে পারে না কি? পুরো বিষয়টা অনুচিত জানার পরেও জাফনা আহনাফকে বললো সে ছয় তলা থেকে ঝাঁপ দিবে। জাফনার কথা শুনে আহনাফ নিশ্চিন্ত মনে স্টাফরুমের দিকে পা বাড়ায়। এদিকে জাফনা বুঝছেনা আহনাফের মধ্যে হৃদয় বলে কোনো বস্তু আদতেও আছে কি না। এমন হতে পারে না কি কোনো মানুষ। জাফনার পা অসাড় হয়ে গিয়েছে আহনাফের কথা শুনে। গুটিগুটি পায়ে সে এগোতে লাগলো ছয় তলার উদ্দেশ্য।
স্টাফরুমে গিয়ে বসলো আহনাফ। বেশ কদিন ধরে সঞ্জয় লা পাত্তা। প্রিন্সিপালের কাছে না কি ছুটি নিয়েছে সে৷ খানিক বাদেই সঞ্জয় এসেই আহনাফকে জড়িয়ে ধরলো। আহনাফ বুঝতে পারলো না কিছুই৷ তারপরেও কুশল বিনিময় করে বললো, ” কিরে কোথায় ছিলে? হুট করেই মিলিয়ে গিয়েছিলি।”
সঞ্জয় আসলে কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছিলো না। অদিতির মুখে তার স্বীকারোক্তি সঞ্জয়কে ধাক্কা দিয়েছে ভীষণ রকম। মানুষের কল্পনার বাহিরেও অনেক কিছু হয়। তবে আহনাফ আর অদিতির বিষয়টা যেন একটু বেশিই কল্পনাতীত সঞ্জয়ের জন্য। নিজেকে কিছুটা স্পেস দিতেই সঞ্জয় ছুটি নিয়েছিলো। আজ ফিরে এলো।
খানিকটা বাদে মালিহার এলো। এসেই আহনাফের ঘাড় জড়িয়ে ধরলো। আহনাফ অবাক না হয়ে বিরক্ত হলো। সে আন্দাজ করেই নিয়েছিলো মালিহা আজ সিনক্রিয়েট করবে। আসতে না আসতেই সেটা শুরু করে দিয়েছে।
সঞ্জয় বিব্রত বোধ করলো। গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো, “এটা কেমন ধরনের আচরণ মালিহা। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ কারো ঘাড় জড়িয়ে ধরে না কি?”
মালিহা উত্তর দিলো, ” আমার ফিউচার স্বামী আহনাফ। আমি তার ঘাড় জড়াতেই পারি। ”
মালিহার কথা শুনে সঞ্জয় আহনাফের মুখের দিকে তাকালো। তাতেই যা বোঝার বুঝে গেলো সে। আর মালিহার কপালে যে দুঃখ আছে আজ সেটাও টের পেলো। আহনাফ আজ মালিহাকে তক্তা বানাবে আজ এটা ভেবেই সঞ্জয়ের খানিকটা খারাপ লাগার সাথে সাথে প্রচন্ড হাসিও পেলো। আর মালিহাটাও হয়েছে একরকম। কলেজ থেকে আহনাফের রিজেকশন পেয়ে আসছে অথচ এখনো লজ্জা নেই। হাসি কোনোমতে চাপিয়ে সঞ্জয় গম্ভীর গলায় বললো, ” দ্যাখ মালিহা! তোর আর আহনাফের আলাদা সম্পর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু এখানে তৃতীয় একজন ব্যাক্তির সামনে নিজেদের বিষয় এক্সপোজ করা কী ধরনের বেহায়াপনা? ”
এবার আহনাফ মালিহার হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে নিলো তারপর সঞ্জয়কে ধমকে বললো, ” আমার আর মালিহার মাঝে কিছু থাকতে পারে এই কথাটা তুই কোন সাহসে উচ্চারণ করলি? আমি কী তোকে একবারো বলেছি? তাহলে মালিহার কথার উপর বেজ করে কথাটা বলাটা কি ঠিক হয়েছে তোর? আর এইযে মালিহা। সাহস খুউউব বেড়েছে তাই-না? তাই এতো ডানা ঝাপটানো? ডানা ছেটে দিবো। আর ভদ্র আচরণ করবে আমার সাথে। বেশি সাহস দেখালে ফল খারাপ হবে।”
আহনাফ উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে দেখে সঞ্জয় ল্যাপটপে মুখ গুঁজলো। মালিহাও ভয় পেয়ে চুপসে গেলো খানিকটা। তবে সে যে হাল ছাড়বে না বোঝাই যাচ্ছে।
চারতলা অবধি এসেই হাঁপিয়ে উঠেছে জাফনা। ছয়তলা অবধি যেতে যেতেই মরে যাবে। ঝাঁপ দিতে হবে না আর। তাছাড়া সকালে উত্তেজনার বশে না খেয়ে চলে এসেছে। এখন বুঝেছে কার জন্য এতো এক্সাইটেড ছিলো সে। আস্ত একটা হার্টলেসের জন্য। চারতলা এসেই আহনাফের স্টাফরুমে উঁকি মারলো সে৷ তারপর চেঁচিয়ে বললো, ” যাচ্ছি স্যার। আচ্ছা চালতাহু দুয়াউমে ইয়াদ রাখনা” কাঁদো কাঁদো গলায় কথাটা বলে কচ্ছপের মতো ধীর গতিতে ছয়তালার পথে পা বাড়ালো সে। শরীর যেন চলছেই না আর। জাফনার কথা শুনে সঞ্জয়, মালিহা দুজনেই আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। সঞ্জয় বললো, মেয়েটা তোর স্টুডেন্ট না কি? আর কি বললো ওইটা?”
আহনাফ শয়তানি হাসি হেসে বললো, ” ও কিছু না! ”
জাফনা এখন ছ তলার বারান্দায়। এখান থেকে ঝাঁপ মারবে সে। পিলার ধরে রেলিং এর উপর উঠলো। এক কদম এগোলেই নির্ঘাত মৃত্যু।
চলবে,,,