শেষ পাতায় তুমি পর্ব-০১ | বাংলা ধারাবাহিক গল্প

0
5848

#শেষ_পাতায়_তুমি
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১|

অডিটোরিয়াম ভর্তী শতাধিক লোকের সমাগম। মেহের মাথা নিচু করে স্টেজে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টি ওর দিকে। উপস্থিত ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষাও করছে। কেউ চিতকার করে বলছে,
“আরে আরে এটা কি হলো?”

মেহের লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। নিজেকে এই মানুষগুলোর দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার উপায় নেই।

ভীড় ঠেলে ফায়াজ স্টেজের সামনে এসে দাড়ালো। চোখ গেল স্টেজের উপরে। মাইকের সামনে যবথব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। সবুজ রঙের ড্রেসের সাথে কালো হিজাব পরা মেয়েটা। সম্ভবত এই মেয়েই মিষ্টি কন্ঠে গান গাইছিল।

ফায়াজ রক্তচক্ষু নিয়ে চিতকার করে বলল,
“সাইলেন্ট!”

মুহুর্তেই পুরো অডিটোরিয়াম নীরব হয়ে গেল। অডিটোরিয়াম জুড়ে পিনপতন নীরবতা।

মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকালো। রক্তচক্ষু নিয়ে ফর্সা গায়ের রঙের একটা ছেলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বিরক্ত নিয়ে চেয়ে আছে। মেহের চোখ নামিয়ে নিল।

~ফ্ল্যাশব্যাক~
ভার্সিটির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেহেরের নাম এনাউন্স করায় ও গান গাওয়ার জন্য স্টেজে উঠেছে।

ফায়াজ বন্ধুদের সাথে ভার্সিটির গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে আর আড্ডা দিচ্ছে আর তখনই ওর কানে ভেসে আসে কয়েক লাইন।

“ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।
আমার পরাণে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো তোমার চরণমজ্জীরে।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মূখর পাখি- তোমার
প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে।
মনে করে সখী,বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী-তোমার
কনককঙ্কনে।

ফায়াজ বিমোহিত হয়ে শুনছে লাইনগুলো। হটাৎ সিগারেট ফেলে ফায়াজ অডিটোরিয়ামের দিকে গেল। পেছনে পেছনে ওর বন্ধুরা।

মেহের কয়েক লাইন গান গাওয়ার পর মাইকটা বিকট শব্দ করে অকার্য হয়ে গেল। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাইক নষ্ট হয়ে যায়। আর তারপর মানুষের ফিসফিসানি কথা বার্তা জোরালো হয়ে ওঠল। মেহের স্যারের দিকে তাকালেন। তিনি ইশারায় দাঁড়াতে বলছেন। অনেকটা সময় চলে যাওয়ায় মেহের নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আর তখনই মাইক্রোফোন ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু মেহের আর গান গাইবে না বলে ঠিক করে নিয়েছে।
সবাই আসন থেকে চিতকার করে বলছে গান গাইতে। কিন্তু মেহেরের গান গাওয়ার মতো মানসিকতা নেই৷ তাই মেহের স্টেজ থেকে নামার জন্য নিজের জায়গা থেকে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে এল।

ফায়াজ নিচ থেকে বলল,”এই হিজাব কুইন গানটা গাও না। তোমার গান শুনে স্বয়ং ফায়াজ চলে এসেছে শোনার জন্য। প্লিজ গানটা গাও৷”

মেহের ফায়াজের অনুরোধ ফেলতে পারছে না৷ শুকনো হেসে ঢোক গিলে অনুর দিকে তাকাল। অনুর চোখে-মুখে আতংক দেখতে পাচ্ছে। অনু ইশারা করছে গান গাওয়ার জন্য।
মেহের ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
তারপর উপস্থিত ব্যক্তিদের দিকে তাকাল। মাইকের কাছে এগিয়ে গিয়ে গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মেহের ফায়াজের অনুরোধে গানটা আবারও ধরল।

ফায়াজ মনোযোগ দিয়ে গান শুনছে। আর ওর বন্ধুরা ওকে দেখছে। ফায়াজের মনে হচ্ছে এই কন্ঠ আগেও কোথাও শুনেছে। পরিচিত লাগছে খুব। কিন্তু মেলাতে পারছে না৷ কিছুটা গন্ডগোল লাগছে।
ফায়াজের ভাবনার মাঝে মেহেরের গান শেষ। মেহের গান গেয়ে দ্রুত স্টেজ থেকে নেমে ওর বন্ধুদের কাছে গেল।

মেহেরের বন্ধু আলিফ, অলিদ, অনু দাঁড়িয়ে ছিল। মেহের ওদেরকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
মেহের অস্থির হয়ে আছে। এই প্রথম এমন একটা ঘটনা ঘটল। স্কুল,কলেজে সব সময় নাচ-গান করেছে। এই প্রথম এভাবে লজ্জায় পড়তে হলো। আলিফ, ওলিদ,অনু মেহেরকে শান্তনা দিচ্ছে।

মেহের মুচকি হেসে বলল,” বাদ দে চল আইসক্রিম খাই।”

ওরা তিন জন মেহেরের ছোট বেলার বন্ধু। এক সাথে বড় হয়েছে। স্কুল, কলেজ এক সাথে শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় এক সাথে স্কুলে যেত, খেলাধুলা করতো তাই ওদের মধ্যে খুবই শক্ত একটা সম্পর্ক।

মেহের আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করছে বন্ধুদের সাথে। তখনই চোখ পড়ল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ একটা ছেলের কাঁধে হাত রেখে হেসে হেসে কি যেন বলছে। মেহের তখন ফায়াজকে ভালো করে দেখে নি। এখন ভালো করে দেখছে। ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর, ড্যাশিং, হ্যান্ডসাম। সিল্কি বাদামী চুল,চোখ গুলো মায়াবী, হাসি হাসি মুখ। একদম যেন চকলেট বয়।

মেহের ওর বন্ধুদের ফায়াজকে দেখিয়ে বলল,
“এই ছেলেটা সেই ছেলেটা না?”

অনু মেহেরের আঙুল ধরে নামিয়ে বলল,” হাত দিয়ে দেখাচ্ছিস কেন?হাত নামা।”

মেহের ভ্রু কুচকে বলল,”কেন কি হয়েছে? ”

ওলিদ বলল,”তুই ওকে চিনিস না?”
মেহের মাথা নাড়িয়ে বলল,” না।কে?”

আলিফ মেহেরকে ভেংচি কেটে বলল,
“চিনিস না? ৬মাস ধরে এই ভার্সিটিতে আছিস আর এই ফায়াজকে চিনিস না?”

মেহের ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,” সত্যিই চিনি না।”

আলিফ ওলিদ আর অনুর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” এই মেয়ে থাকে কই আল্লাহ জানে।”

” এ হচ্ছে ফায়াজ নওয়াজ খান। ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। পাশাপাশি ভার্সিটির পলিটিকাল লিডার। অনেক পাওয়ার তার। ওর অনেক ছানাপোনা আছে। মারামারি এদের নিত্যকার কাজ।
কত মানুষকে মেরে হাসপাতালে পাঠায় তার হিসেব নেই। এক কথায় খুবই খারাপ লোক।”

মেহের ঢোক গিলে ফায়াজের দিকে একবার তাকাল। তারপর বলল,
“তাহলে তো দেখছি ভয়ংকর লোক। দেখে বুঝা যায় নি।”

মেহের ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে বাড়িতে যাওয়ার জন্য গেইটের সামনে দাঁড়িয়েছে। ফায়াজ মেহেরকে দেখে সাথের বন্ধুদের বলল,” কে রে এই মেয়ে? নাম কি?”

ফায়াজের বন্ধু বলল,” ভাই তোর ব্যাপার কি? মাহিরাকে রেখে এই মেয়ের প্রেমে পড়লি নাকি?”

ফায়াজ ঘাড় কাত করে চোখ পাকিয়ে বলল,”কি বললি?”

ফায়াজের বন্ধু দাঁত কেলিয়ে বলল,
“ভাই মজা করছি। সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? ওর কথা জানতে চাইলি তাই বললাম।”

ফায়াজ ওর কান মুচড়ে ধরে বলল, ওর কথা জানতে চেয়েছি কারণ ওর ভয়েস আমার ভালো লেগেছে তাই। এর বেশি ভাবার দরকার নেই। আই হেভ মাহিরা।”

“জি ভাই। একদম ভাববো না।”(কান ধরে)

মেহের ফায়াজকে দেখে না দেখার ভান করে দ্রুত বের হয়ে গেল।

বাড়িতে গিয়ে কাঁধে থেকে ব্যাগ নামিয়ে ধুপধাপ করে হাঁটতে হাঁটতে সিড়ি দিয়ে উঠছে। তারপর হটাৎ থেমে গেল। পা টিপে টিপে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাড়াল। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখছে। তারপর পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকল। আস্তে আস্তে বিছানার কাছে গিয়ে চাঁদর টান মেরে সরিয়ে ফেলল।

একটা মেয়ে কপাল কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,” মেহু পাখি তুই মানুষ হবি না? দুষ্টুমি করা কবে ছাড়বি?”

মেহের কথার পাত্তা না দিয়ে বলল,”মাহি আপু,তুমি আজকে গেলে না কেন? তুমি জানতে না আজ আমার পারফর্মেন্স আছে? বলো বলো?”

মাহি ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলল,”দেখ আমার গায়ে জ্বর। নয়তো আমার বোনের পারফর্মেন্স আছে আর আমি যাবো না?”

মেহের ঠোঁট বাকিয়ে বলল,” তুমি না গিয়ে ভালো করেছ। আজ যা ঘটনা ঘটেছে। এমন জঘন্য ঘটনা আগে ঘটে নি।”

মাহি ভ্রু কুচকে বলল,” কি হয়েছে রে মেহু পাখি?”
মেহের সবটা খুলে বলল মাহিকে। মাহি ফায়াজের নাম শুনে চমকে ওঠে বলল,”ফায়াজ!”

মেহের বোনের কথা শুনে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,” তুমি চিনো নাকি?”

মাহি ওর প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেল। তারপর শুকনো হেসে আমতা আমতা করে বলল,”আরে নাহ, আমি কি করে চিনবো?”

মেহের চোখ উল্টিয়ে বলল,”যেমন ভাব করলে তাতে মনে হলো চিনো।যাইহোক জানো আলিফ, ওলিদ আর অনু কি বলেছে?”

মাহি আরেক দফা ভয় পেয়ে বলল,” কি বলেছে?”

ওরা ফায়াজের সম্পর্কে যা বলেছে মেহের সবটা বলল।
তারপর বলল,”আমি তো ভালো মানুষ মনে করেছিলাম। দেখতেও কি সুন্দর।দেখে তো মনে হয় খুবই ইনোসেন্ট।”

সবটা শুনে মাহি ধমকে বলল,ফায়াজের থেকে দূরে থাকবি।”

মেহের ধমক খেয়ে বলল,”ঠিক আছে দূরে থাকব। কিন্তু ধমকাচ্ছো কেন?”

“এমনি। আমি সব তোর ভালোর জন্যই বলি মেহু পাখি।”
গালে হাত রেখে আদর করে বলল মাহি।

মাহির ফোন তখনই বেজে উঠল। ফোনের স্কিনে লাভ লেখাটি দেখে মেহের মুচকি হেসে বলল,”জিজু ফোন করেছে। জিজুকে বলে দিও আমি তার সাথে রাগ করেছি। আমার জন্য আইসক্রিম পাঠানোর কথা বলে পাঠায় নি।”

“আমি এখন কারো ফোন রিসিভ করব না। শরীর ভালো লাগছে না। তোর ইচ্ছে হলে কথা বল।” মাহি ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল।

মেহের মুচকি হেসে বলল,”আমি তার সাথে রাগ করেছি। কথা বলব না। বাড়িতেও ঢুকতে দেব না। তুমি জ্বরের ওষুধ খেয়ে নেও। তারপর শুয়ে থাকো। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।”

মেহের যেতেই মাহি স্বস্তির শ্বাস নিল। আর কতদিন লুকিয়ে রাখবে ব্যাপারটা। মেহের তো একি ভার্সিটিতেই পড়ে। ওর চোখ কতদিন ফাঁকি দেবে?

মাহির ফোন আবারও বেজে উঠেছে। ফোনের স্কিনে এফ অক্ষরটা ভেসে উঠেছে। এফ অক্ষরটা দেখে মাহির কপাল কুচকে এল। মাহি ফোন রিসিভ না করে চাদঁর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। বারবার ফোন বাজায় ফোন রিসিভ করে নিলো।

অপর পাশ থেকে বলল,”মাহিরা ফোন পিক আপ করছো না কেন?”

মাহি দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”মেহু পাখি ছিল তাই রিসিভ করি নি।”

বিরক্তি নিয়ে অপর পাশ থেকে বলল,
“তোমার এই মেহু পাখির জন্য প্রেমটাও শান্তি করে কর‍তে পারব না? তোমার বোনকে একটা প্রেম করিয়ে দেই? তোমার বোনকে তো আজ পর্যন্ত দেখলাম ই না।”

মাহি থমথমে মুখ করে বলল,”ফায়াজ, মেহু পাখিকে নিয়ে মজা করবে না। ও আমার কলিজা।”

“আচ্ছা তাই? আর আমি? ”

মাহি চুপ করে গেল। উত্তর দিচ্ছে না।
ফায়াজ হেসে বলল,” যেই তোমার কলিজাকে নিয়ে কথা বললাম আর মুড অফ হয়ে গেল? আমি তো মজা করছিলাম।”

“জানি তুমি মজা করছিলে। আমার শরীর ভালো লাগছে না পরে কথা হবে।”
মাহি ফোন কেটে দিল উত্তরের অপেক্ষা না করে।

চলবে….