#আমার একলা আকাশ
#পর্ব-০৩+০৪
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
মাথায় হাত রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আদনান। তার চোখে-মুখে ক্রোধ ও চিন্তা উভয়ই আছে। সুমনা বেগম নারিকেল তেল আর পানি মিশিয়ে প্রাপ্তির মাথার স্ক্যাল্পে আলতো করে ঘষে দিচ্ছেন। মেয়ের হঠাৎ এমন অসুস্থতায় তিনি নিজেও কিছুটা চিন্তিত। আদনানের কাছেই খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন তিনি। ঘরদোর পরিষ্কার করে এখন প্রাপ্তির মাথার কাছেই বসে আছে।
‘তুই এখনো এখানে বসে আছিস কেন? বাইরে যা। সবার সাথে সময় কাটা।’ প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন সুমনা বেগম।
আদনান চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,’ভালো লাগছে না।’
‘তোর কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি।’ বলে উঠে দাঁড়ায় আদনান। একটাবার শুধু প্রাপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে বাইরে চলে যায়।
প্রাপ্তি বিহীন সেতুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সেতু বেশ কয়েকবার সবার কাছে প্রাপ্তির খোঁজ করেছিল। আদনান জানিয়েছে, সিম্পল মাথা-ব্যথা তাই আসেনি। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে প্রাপ্তির কাছে আসার পর বিষয়টা মোটেও সেতুর কাছে সিম্পল মনে হয়নি। একদিনেই যেন প্রাপ্তির সে কি বিধ্বস্ত অবস্থা! নিজে ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও সে অনেকক্ষণ যাবৎ রাত জেগে প্রাপ্তির কাছে বসে থাকে। একটা সময় প্রাপ্তির পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে।
.
রাত আনুমানিক আড়াইটা কি তিনটা বাজে। ছাদে একা একা পায়চারি করছে আদনান। সেই যে রাত একটায় কারেন্ট চলে গেছে, এখনো আসেনি। গরমে রুমে টেকা যাচ্ছিল না তাই ছাদে চলে এসেছে। আকাশও যেন গুমোট মেরে আছে। চাঁদ নেই, তারা নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। কেমন যেন নিস্তব্ধ পরিবেশ!
হাঁটতে হাঁটতেই সে প্রাপ্তির কথা ভাবে। ছোটো থেকেই দুজনের দা-কুমড়ার সম্পর্ক ছিল। একজন আরেকজনের সাথে কখনোই মিলতো না। রেহেনা বেগম কিংবা সুমনা বেগম যদি কখনো একজনকে রেখে অন্যজনকে আদর করত তাহলে সেদিন বাসায় ভাঙচুর থেকে শুরু করে ভূমিকম্প পর্যন্ত হয়ে যেত। বয়সের পার্থক্যও কখনো ওদের মস্তিষ্কে হানা দিতে পারেনি। কতবার পরীক্ষার সময় প্রাপ্তি দোয়া করেছিল, আদনান যেন এক্সিডেন্ট করে। পরীক্ষা যেন না দিতে পারে। এর একটা কারণও অবশ্য আছে। প্রাপ্তির সঙ্গে আদনানের যখনই ঝগড়া হতো আদনান একটা কথাই বলত,
‘বেশি বকবক করবি না। একদম মাথায় তুলে আছাড় মারব। আমি তোর চেয়ে বড়ো জানিস না?’
মা-বাবা’ও সবসময় বলত,’আদনান তোমার বয়সে বড়ো। মারামারি, ঝগড়া এসব কেন করো? তুই করেও বলবে না।’
প্রাপ্তির ভীষণ রাগ হতো। বয়সে বড়ো বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি। তাই সে খুব করে চাইত আদনানের এক্সিডেন্ট হোক, পরীক্ষা দিতে না পারুক। ক্লাস গ্যাপ যাক ইত্যাদি ইত্যাদি। বদদোয়া হোক বা যেটাই হোক, একদিন সত্যি সত্যিই আদনান রাস্তায় বাইকের সাথে এক্সিডেন্ট করল। বাম পা এবং ডান হাতে বেশ আঘাত পেয়েছে। তখন তার জে.এস.সি পরীক্ষার মাত্র দেড় মাস বাকি ছিল। ঐ অবস্থায় পরীক্ষা দেওয়াটা সম্ভব ছিল না বলে, পরীক্ষা দিতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ আদনানের এক বছর নষ্ট হয়। প্রাপ্তি কেন জানি আদনান এক্সিডেন্ট করার পর খুশি হতে পারেনি। বরং সে লুকিয়ে লুকিয়ে খুব কান্না করেছিল। আদনান যখন এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে তখন একদিন মুখ ফসকে প্রাপ্তি বলে ফেলেছিল,
‘আমায় কখনো রাগাবি না। এমন বদদোয়া দেবো, দেখবি সত্যি সত্যি আবার এক্সিডেন্ট করবি।’
আদনান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,’মানে কী?’
প্রাপ্তি তখন সব খুলে বলে। আদনান হতবাক। শত্রুও তো মনে হয় না এমন কামনা করে কখনো! সে ক্রুব্ধ হয়ে বলল,’তুই তো আচ্ছা অ’স’ভ্য মেয়ে! এসব বদদোয়া করতি? আর শোন, তোর বদদোয়া-টদদোয়া কিছু লাগেনি। এটা আমার ভাগ্যেই ছিল।’
প্রাপ্তি ভেংচি কাটে। আদনান বলে,’ভেংচি কাটিস আর যাই করিস এত খুশি হওয়ারও কিছু নেই। আমি এখনো তোর থেকে বয়সে বড়ো এবং ক্লাসেও এগিয়ে আছি ভুলে যাস না।’
দুজনের এত ঝগড়া আর মারামারি কমে এলো আদনান যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিল। তখন থেকে আদনানের প্রতি প্রাপ্তি অন্যরকম টান অনুভব করত। আদনান অবশ্য এসব কিছু ভাবে না। উলটো তার মাঝে দাম্ভিকতা এসে ভর করেছিল। ছুটিতে যেই বার ঢাকায় এলো তখন প্রাপ্তিকে কাঠকাঠ গলায় বলেছিল,
‘আমাকে খবরদার তুই করে বলবি না। তুমি করে বলবি।’
তখন থেকেই পরিবর্তন আসে একটু একটু করে। ভুলক্রমে প্রাপ্তি কখনো কখনো তুই-ও বলে ফেলে। তবে এখন আর আগের মতো ঝগড়াঝাঁটি নেই। বাড়িতে ফিরলে আদনান প্রায়ই প্রাপ্তির পেছনে লেগে থাকে। ঝগড়া করার চেষ্টা করে। তবে প্রাপ্তি এখন আর আগের মতো ঝগড়ুটে নেই। সে এখন চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের হয়ে গেছে। তবে কখনো বাড়াবাড়ি মাত্রায় রেগে গেলে তখন ও’কে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
বর্তমানে আদনান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনালে ইয়ারে পড়াশোনার পাশাপাশি একটা কোম্পানিতে জবও করে। প্রাপ্তি ঢাকাতেই ন্যাশনালে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে।
অতীতের স্মৃৃতিচারণ করতে করতে আদনান আনমনে কিছুটা হাসে। ছোটোবেলার দুষ্টুমির কথাগুলো মনে পড়ে যায়। সে এগিয়ে যায় প্রাপ্তিদের বাড়ির ছাদের দিকে। দুটো বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় মাঝখানে গ্যাপ একদম কম। চাইলেই এই ছাদ থেকে ঐ ছাদে যাওয়া যায়। সে রেলিঙের কাছাকাছি যাওয়ার পর নারী অবয়ব দেখতে পায় অন্ধকারে। ভ্রুঁ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘কে ওখানে?’
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আদনান ফের আবারও ডাকে। এবারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। এবার সে নিজেই ছাদ টপকে প্রাপ্তিদের ছাদে যায়। একটু একটু করে এগিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে,
‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ…ঐটা কে রে!’
তবুও কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। আদনান এবার জোরেশোরেই বলল,’ঐ কে? কথা বলে না কেন?’
‘আদনান, আমি!’ বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে বলল প্রাপ্তি।
‘ওহ তুই। আমি ভাবলাম কোন ভূত-পেত্নী।’
প্রাপ্তি কিছুই বলে না। আদনান ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,’তুই এত রাতে ছাদে কী করিস?’
‘হাওয়া খাই।’
‘এত খাস তাও তো মোটা হস না।’
‘তোমার মতো বেলুন হব নাকি?’
‘আমি বেলুন? তোর চোখ গেছে। আমি একদম ফিট আছি বুঝছিস।’
প্রাপ্তি নিরুত্তর। আদনান বলল,’মাথা-ব্যথা কমেছে?’
‘হু।’
‘এত রাতে একা একা ছাদে এসেছিস, ভয় লাগে না?’
‘না।’
অন্ধকারেই আদনান কিছুক্ষণ প্রাপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,’তখন আমি ওষুধ আনতে যাওয়ার পর রুমে কে এসেছিল?’
প্রাপ্তি শক্ত গলায় বলল,’কেউ না।’
‘মিথ্যে কথা বলবি না। কে এসেছিল বল?’
‘বললাম তো কেউ না।’
‘তোর গালে আমি স্পষ্ট আঘাতের দাগ দেখেছি। রায়হান এসেছিল?’
‘না।’
‘আবারও তুই মিথ্যে কথা বলছিস। কথা লুকাতে শিখে গেছিস খুব তাই না?’
‘আমি কিছুই লুকাচ্ছি না।’
‘রায়হানের সাথে সম্পর্ক কতদিনের তোর?’
প্রাপ্তি চমকে তাকায়। অন্ধকারে দুজনেরই দৃষ্টি সয়ে এসেছে। তাই প্রাপ্তির চমকে যাওয়াটাও আদনানের দৃষ্টিগোচর হয়। এদিকে সে নিজেও প্রাপ্তির চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রাপ্তি আর তাকিয়ে থাকতে পারল না। দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
‘কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।’ বলল আদনান।
প্রাপ্তি ক্ষীণস্বরে বলল,’তিন মাসের।’
‘আমি যদি ভুল না হই, তাহলে তোর গালে ভালোবাসার চিহ্ন নয় বরং আঘাতের চিহ্ন ছিল। রিলেশন করবি ভালো কথা। মানুষ চিনে করবি না? যার তার সাথে রিলেশন করলেই হবে?’
‘আগে থেকেই মানুষ চিনব কী করে? সেতু আপুর ক্লাসমেট বন্ধু হয় রায়হান। আপুও তো কত কত ভালো ভালো কথা বলেছে। রায়হান অনেক পাগলামি করেছিল। অনেক কান্নাকাটিও করেছিল। আর…আর..’
‘আর কী?’
‘আর তোমার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়েই আমি ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি।’
‘আমার যন্ত্রণায়?’
‘হ্যাঁ। সারাক্ষণ তোমার হূরের গল্প শুনতে শুনতে আমি অতিষ্ঠ। আমরা যে এত বছরের বন্ধু কখনো আমায় একটু সেভাবে মূল্যায়ন করেছ? দেখা হলে, কথা হলেই কীভাবে ঝগড়া করা যায়,কীভাবে পেছনে লাগা যায় সর্বদা সেই মতলবে থাকো। সঙ্গে বকাঝকা, ঝাড়ি তো ফ্রি আছেই। মাঝে মাঝে শুধু আমি এটাই ভাবি, শুধুমাত্র মারটাই বা কেন বাকি রেখেছ।’
‘আমি কাপুরুষ নই প্রাপ্তি। মেয়েদের গায়ে হাত তোলা আমার পছন্দ না। আর এইযে রায়হানের সাথে তোর সম্পর্ক এটা কিন্তু ভালোবাসা না। রায়হানের পাগলামি, কান্নাকাটি এসব দেখে তোর মনে ওর জন্য একটা সিমপ্যাথি কাজ করেছে। আবার আমার ওপর নাকি রাগ, জেদ করেও তুই সম্পর্কে জড়িয়েছিস। তাহলে এসবের মধ্যে ভালোবাসাটা কোথায়?’
প্রাপ্তি নিশ্চুপ। আদনান বলল,’রাগ, জেদ, অভিমান, মায়া এসব ভালোবাসার অংশ; কিন্তু ভালোবাসা নয়। শুধু শুধু এরকম ট’ক্সি’স একটা রিলেশনশিপে থেকে নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না। আমি বলছি না যে, ব্রেকাপ করে ফেল। একটু সময় নে। ভাব। ওর সাথে খোলামেলা কথা বল। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সরাসরি কথা বলাটা অনেক বেশি জরুরী। মনে মনে কথা জমিয়ে রাখলে একটা সময়ে মানুষ ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে। আর তখনই একটা সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে।’
‘ব্রেকাপ হয়ে গেছে আমাদের। ও নিজেই করেছে।’
আদনানের কিছু বলার ভাষা নেই আর। প্রাপ্তিকে এসব ব্যাপারে এখন কিছু জিজ্ঞেস করা মানেই অযথা খুঁচিয়ে কষ্ট দেওয়া হবে। তাই সে একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঘাড় এদিক-সেদিক বাঁকিয়ে বলল,
‘ঘরে যা।’
‘পরে।’
‘এখনই যাবি। রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে কোনো? অযথা কোনো তর্ক শুনতে চাচ্ছি না আমি। যা ভেতরে।’
প্রাপ্তি বিরক্ত হয়ে হনহন করে নেমে যায় ছাদ থেকে। আদনান কিছুক্ষণ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের ছাদে চলে যায়।
__________
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান মিস করায় প্রাপ্তির নিজেরও ভীষণ রকম মন খারাপ ছিল। তবে আজ সকাল থেকে সে বেশ সুস্থ অনুভব করছে। যদিও কদাচিৎ মাথা-ব্যথাও ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করছে বটে; তবে সেভাবে পাত্তা দিচ্ছে না। বিয়ের অনুষ্ঠানও যদি মিস করে তাহলে আফসোসে আফসোসেই তার বাকিটা জীবন পার হবে।
সেতুর সাথে পার্লারে গেছে প্রাপ্তি। সঙ্গে আরো কয়েকজন কাজিন আর সেতুর কাছের দুজন বান্ধবীও এসেছে। সেতুর বিয়ে উপলক্ষে প্রাপ্তি লাল-খয়েরী রঙের একটা লেহেঙ্গা নিয়েছে। লেহেঙ্গার ওপর স্টোনের কাজ করা। মামা যখন নিজে পছন্দ করে প্রাপ্তিকে লেহেঙ্গাটি কিনে দিয়েছে, তখন তার সে কি খুশি!
আদনানের পার্লারে আসার কথা ছিল ওদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কাজে আটকে যাওয়ায় সে আসতে পারেনি। মামা এসেছে। অযথা একটু মনও খারাপ হলো প্রাপ্তির। মন খারাপের রেশ কেটেছে বাড়িতে গিয়ে। আদনানকে দেখার পর তার কী যে ভালো লাগছে! যতই ঝগড়া করুক, অহংকার দেখাক না কেন ছেলেটার মনটা ভীষণ ভালো। নিঃসন্দেহে ওর হূরপরী একজন ভাগ্যবতী নারী।
প্রাপ্তির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও আদনান ও’কে খেয়াল করল না যেন। অথচ দুজনেরই চোখাচোখি হয়েছে। আদনান অফ হোয়াইট রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে। শ্যামবর্ণের হওয়ায় পাঞ্জাবিটিও ভীষণ ফুটে উঠেছে শরীরে। ক্যামেরাম্যান সবার একসাথে গ্রুপ ফটো তুলে দিচ্ছিল। সেতুর সিঙ্গেল ছবি তোলার সময় আদনান প্রাপ্তির কাছে আসে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,
‘একটু এদিকে আয় তো। কথা আছে।’
আদনানের পিছু পিছু যায় প্রাপ্তি। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আদনান বলে,’তোকে একটা কথা বলার আছে। তোর মামা সব কাজ দিয়েছে আমার ওপর চাপিয়ে। এখন গাধার খাটনি খাটতে হচ্ছে আমার।’
প্রাপ্তি মুখ ভার করে বলল,’এতই যখন অসুবিধা মামাকে তখন না করতে পারলে না?’
‘এটাই তো আসল সমস্যা। আমি আবার কাউকে কষ্ট দিতে পারি না। আমার মনটা অনেক ফ্রেশ কিনা! তুই মুখ ওরকম বানিয়ে রেখেছিস কেন?’
‘কী বলতে চাইছ সেটা বলো।’
‘বলছি। এত অস্থির হচ্ছিস কেন?’
‘আমি স্থিরই আছি।’
‘তুই কি আর রঙ খুঁজে পাসনি?’
‘মানে?’
‘মানে হচ্ছে বিয়েতে ড্রেস পরার জন্য আর রঙ খুঁজে পাসনি। একই কালার, আবার লেহেঙ্গা। তুই আর সেতু পাশাপাশি দাঁড়ালে মানুষ তো কনফিউজড হয়ে যাবে আসলে বউটা কে। তোর বিয়ে নাকি? তুই এত ভারী ড্রেস কেন পরেছিস?’
মনটাই খারাপ হয়ে গেল প্রাপ্তির। ইচ্ছে করছে আদনানকে দু’চারটে কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু সে এমন কিছু করল না। চুপচাপ স্থান ত্যাগ করে একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসে রইল। গালে হাত রেখে মনে মনে ভাবছে, আজকের দিনেও কি এমন বাজে ব্যবহার করা লাগল?
‘প্রাপ্তি।’
ভ্রুঁ কুঁচকে পেছনে তাকায় প্রাপ্তি। অপরাধীর মতো মুখ বানিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রায়হান। প্রাপ্তি তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়ায়। হাত টেনে ধরে রায়হান। আকুতি-মিনতি করে বলে,’প্লিজ! আমার কথাটা শোনো।’
‘আমার হাত ছাড়ো। কোনো কথা নেই আমার তোমার সাথে।’
‘এরকম কোরো না প্রাপ্তি। আমি দুঃখিত কালকে ওরকম ব্যবহার করার জন্য। এবারের মতো মাফ করে দাও প্লিজ!’
‘প্লিজ রায়হান হাত ছাড়ো।’
রায়হান এবার হাত ছেড়ে প্রাপ্তির পা পেঁচিয়ে ধরে বলে,’পা ধরে মাফ চাইছি। এবার তো ক্ষমা করে দাও। একটা সুযোগ দাও। ভুল তো মানুষেরই হয়। ক্ষমা করো প্লিজ!’
প্রাপ্তি আশেপাশে একবার তাকিয়ে চাপাস্বরে বলে,’এসব কী করছ? ছাড়ো। কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে?’
‘তুমি আমায় ক্ষমা করেছ বলো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না প্রাপ্তি। কেন বুঝতে চাচ্ছ না?’
প্রাপ্তি লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল,’ওকে। তুমি পা ছাড়ো। আমরা বসে কথা বলি।’
রায়হান পা ছেড়ে দেয়। দুজনে এখন মুখোমুখি বসে আছে। নিজে নিজে মনে কথাগুলো আগে গুছিয়ে নিয়ে প্রাপ্তি বলে,’আমি রিলেশন ঠিক করব। তবে একটা শর্তে।’
‘কী শর্ত বলো? তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব।’
‘আমি যেসব কাজ পছন্দ করি না সেসব একদম আমার সাথে করা যাবে না।’
‘আমি রাজি। কোনো আপত্তি নেই আমার। তুমি শুধু আমায় ছেড়ে যেও না।’
রায়হানের কান্নাকাটিতে প্রাপ্তি আবার গলে যায়। দুজনের সম্পর্কটা বলতে গেলে নতুন করেই শুরু হয় আবার। রায়হান এখন আর আগের মতো আচরণ করে না। প্রাপ্তি যা বলে তাই শোনে।
.
.
বিয়ের পর আজ সেতু নাইওর এসেছে। সেজন্য সুমনা বেগম আর মামি মিলে ভালো ভালো খাবার রান্না করেছে। শুক্রবার আজ তাই আসাদ রহমানের অফিস বন্ধ। তিনি বাসায় থাকলে রেহেনা বেগম খুব একটা এই বাড়িতে আসতে পারেন না। তাই রান্না করা খাবারগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে প্রাপ্তিকে ডাকেন সুমনা বেগম।
প্রাপ্তি তখন রেডি হচ্ছিল রায়হানের সাথে দেখা করতে যাবে তাই। মায়ের ডাকে তাড়াহুড়া করে এসে বলে,’কী হয়েছে?’
‘খাবারগুলো ঐ বাড়িতে দিয়ে আয়।’
‘আমি কেন? আমি পারব না এখন। বাইরে যাব।’
‘যা। যাওয়ার আগে বাটিটা দিয়ে আয়। দশ মাইল দূরে তো আর না বাড়ি।’
আসাদ রহমান বাড়িতে বলে প্রাপ্তি নিজেও ওই বাড়িতে যেতে চায় না। কিন্তু কিছু করার তো নেই এখন। সে একেবারে রেডি হয়েই বের হয়। খাবারগুলো দিয়ে সোজা চলে যাবে। বাড়িতে আর আসবে না।
ও বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল বাজানোর পর মেইড এসে দরজা খুলে দেয়। প্রাপ্তি আশা করেছিল রেহেনা বেগম দরজা খুলবে। তাহলে এখান থেকেই খাবারগুলো দিয়ে চলে যাওয়া যেত। কিন্তু তা তো আর হলো না। কী আর করার! সে যা ভাবে সবসময় তার উলটোটাই হয়। গুটি গুটি পায়ে সে ভেতরে যায়। আসাদ রহমানও ড্রয়িংরুমেই ছিলেন। ফোনে সম্ভবত নিউজ দেখছেন।
প্রাপ্তি বিড়বিড় করে বলে,’ফোনেই যখন নিউজ দেখবেন, তাহলে রুমে বসে দেখলেই তো পারতেন।’
প্রাপ্তিকে দেখে আসাদ রহমান গম্ভীর হয়ে বলেন,’কী ব্যাপার?’
প্রাপ্তি হাসার চেষ্টা করে। সালাম দিয়ে বলে,’আন্টি কোথায়?’
তিনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,’গোসল করে। হাতে কী?’
‘জি, খাবার। মা পাঠিয়েছে।’
‘কেন? আমরা কি খেতে পাই না? ওই বাড়ির খাবারের আশায় বসে থাকি?’
মন ছোটো হয়ে যায় প্রাপ্তির। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। প্রাপ্তি জানে লোকটা এমন, তবুও সে খারাপ ব্যবহার নিতে পারে না। কান্না পেয়ে যায়। কথাবার্তা শুনে আদনান তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। প্রাপ্তির কাঁদোকাঁদো মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাবার ব্যবহারই এর কারণ।
‘কখন এসেছিস?’ জানতে চাইল আদনান।
প্রাপ্তি কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,’এখনই। এগুলো রাখো। মা পাঠিয়েছে।’
টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখল আদনান। প্রাপ্তি চলে যাওয়ার সময় সেও পিছু পিছু যায়। মেইন দরজার কাছে গিয়ে প্রাপ্তির হাত ধরে বলে,’কাঁদছিস তুই!’
‘উঁহু!’
‘বাবা বকেছে আবার?’
‘সে তো সবসময়ই এমন ব্যবহার করে।’
‘স্যরি প্রাপ্তি। বাবার হয়ে আমি মাফ চাইছি।’
‘তুমি কেন মাফ চাইবে? সবসময় তুমি এমনটাই করো। কখনো তো প্রতিবাদ করো না।’
‘আমি তাকে সম্মান করি। তাই মুখের ওপর কখনো কিছু বলি না, তুই তো সেটা ভালো করেই জানিস।’
‘এমন বাবার ঘরে যে তোমার মতো ভালো মনের একটা ছেলে কীভাবে হয়েছে একমাত্র আল্লাহ-ই ভালো বলতে পারবে। তুমি রেহেনা আন্টির মতো হয়েছ।’ বলে প্রাপ্তি একটু হাসে। ওর সঙ্গে মৃদু হাসে আদনানও।
আদনানের থেকে বিদায় নিয়ে রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে যায় প্রাপ্তি। রায়হানের খুব ইচ্ছে হয়েছে আজ দুজনে রিকশায় করে ঘুরবে। ওর ইচ্ছেটাই পূরণ করছে প্রাপ্তি।
রায়হান হঠাৎ বলে ওঠে,’থ্যাঙ্কিউ।’
‘থ্যাঙ্কিউ কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল প্রাপ্তি।
‘আমার দুইটা উইশ পূরণ করার জন্য। এক. আমার কথামতো তুমি কালো রঙের থ্রি-পিস পরেছ। আর দুই. আমার সাথে রিকশায় ঘুরছ।’
প্রাপ্তি হাসল কিছুটা।
‘প্রাপ্তি।’
‘হু?’
‘খুব শীঘ্রই আমি বাবা-মাকে তোমার বাসায় পাঠাব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তোমাকে খুব ভালোবাসি প্রাপ্তি।’
একটু থেমে সে ফের বলল,’একটা কথা কিন্তু জানো না।’
‘কী?’
‘আজকে আমার জন্মদিন।’
‘হোয়াট! আমায় আগে কেন বলোনি? ধুর! কাজটা মোটেও ঠিক করোনি তুমি।’
‘আরে রাগ করছ কেন? আগে বললে গিফ্ট নিয়ে আসতে এইতো?’
‘গিফ্ট তো দেওয়াই লাগে তাই না?’
‘না। আমার গিফ্ট লাগবে না। আমি তোমার কাছে অন্যকিছু চাই। দেবে?’
‘দেওয়ার মতো হলে আর সামর্থ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই দেবো।’
‘তোমার পক্ষে অসম্ভব এমন কিছুই চাইব না।’
‘আচ্ছা বলো কী চাও?’
রায়হান প্রাপ্তির কোমর জড়িয়ে ধরে কিছুটা কাছে এনে ফিসফিস করে বলে,’তোমাকে আজ সম্পূর্ণভাবে আমার করে চাই। সুন্দর একটা মুহূর্ত তৈরি করতে চাই। যেই মুহূর্তটুকুতে শুধু তুমি আর আমি থাকব। খুব করে কাছে চাই। তোমায় এতটা কাছে চাই, যতটা কাছে থাকলে দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাসও এক হয়ে যায়। তুমি বুঝতে পারছ তো প্রাপ্তি আমি কী চাচ্ছি?’
‘মামা, রিকশা থামান।’ বলল প্রাপ্তি।
রায়হান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
‘নামো।’ বলে প্রাপ্তি নিজেও রিকশা থেকে নামে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রায়হানকে বলে,
‘ইন্টিমেট হতে চাইছ তাই তো? ওকে, ওয়েট।’
প্রাপ্তি ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে রায়হানের হাতে দিয়ে বলে,’আমি একচুয়ালি জানিনা রাস্তার মেয়েদের রেট কত। সম্ভবত ২০০/৩০০ তেও পাওয়া যায়। আমি তোমাকে ৫০০ টাকা দিলাম। সুন্দরী দেখে একটা মেয়েকে ভাড়া করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে নিও।’
‘প্রাপ্তি!’ মৃদু চিৎকার করে ওঠে রায়হান।
‘আওয়াজ নিচে। একদম আমার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলবে না। রাস্তাঘাটে কোনো রকম সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না আমি। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, আমি ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে; কোনো রাস্তার মেয়ে নই যে তোমার সাথে বিছানায় শুয়ে পড়ব। তোমার ইনটেনশন-ই তো শরীর পাওয়া তাই না? তো যাও না, রাস্তায়, পতিতালয়ে। এতে তোমারও চাহিদা মিটবে আর ওদেরও কিছু টাকা ইনকাম হবে। অযথা ভদ্র পরিবারের মেয়েদের পেছনে কেন পড়ে থাকো? আর হ্যাঁ, আজকের পর থেকে খবরদার আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। কোনো ক্যারেক্টারলেস ছেলের সাথে আমি সম্পর্ক রাখব না।’
চলবে…
#আমার_একলা_আকাশ
#পর্ব_৪
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
আকাশের রঙ আজ অদ্ভূত রকমের। কোথাও আকাশী রঙ তো আবার কোথাও সাদা মেঘের ভেলা। রোদের তাপ নেই একদম। মৃদু বাতাসে মনটা সতেজ লাগছে। আর নিজেকেও প্রাপ্তির আজ অনেক হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো বন্দি পাখি লোহার খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছে। অবশ্য প্রাপ্তির বিষয়টাকেও এভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়। এরকম বি’ষা’ক্ত সম্পর্ক আর খাঁচার মধ্যে তফাৎ-ই বা কী? রাযহানকে তার উপযুক্ত জবাবগুলো দিতে পেরে আরও বেশি স্বস্তিবোধ করছে সে। ওখান থেকে ফিরে এসে একা একাই সে কিছুক্ষণ ঘুরেছে। ফুসকা খেয়েছে, হাওয়াই মিঠাই খেয়েছে। ফুল বিক্রেতা পথশিশুদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। সব মিলিয়ে দারুণ একটা সময় কাটিয়েছে আজ সে। যেখানে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। কোনো চাহিদা ছিল না। একা একাও ভালো থাকা যায়। একাই নিজে নিজেকে সময় দেওয়া যায়। শুধু এইটুকু বিশ্বাস রাখা উচিত, আমি নিজেকে ভালো রাখতে পারব।
বাড়ির পথে আদনানের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সে হাত নাড়িয়ে রিকশাটি থামিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলে,
‘মামা, চলেন।’
প্রাপ্তি কিছুই বলল না। অন্য কোনো সময় হলে রাগ করত। বকত। না হলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকত। কিন্তু আজ সে এসবের কিছুই করেনি। বরং হাসছে। আদনান একটু অবাকই হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘অযথা হাসছিস কেন?’
‘এমনিই।’
‘এমনি কারণ ছাড়া কেউ হাসে? ভূতে আছড় করেছে?’
‘ধুর! সবসময়ই শুধু ফালতু কথা বলো। কোথায় গিয়েছিলে?’
‘মোড়ে গেছিলাম আড্ডা দিতে।’
‘চট্টগ্রাম কবে ফিরে যাচ্ছ?’
‘তোর এত তাড়া কীসের?’
‘আমার আবার কীসের তাড়া?’
‘কথায় তো মনে হচ্ছে, আমি গেলে তুই বেঁচে যাস।’
‘তুমি থাকলেই আমার কী, আর না থাকলেই বা আমার কী? আমি তো তোমার হূরপরীর কথা ভেবেই বললাম।’
‘ওর কথা কী ভাবলি?’
‘বেচারি একা চট্টগ্রামে তোমার অপেক্ষায় আছে। খারাপ লাগছে না?’
‘তোকে কে বলল আমার হূর চট্টগ্রাম থাকে?’
প্রাপ্তি ভ্রুঁ কুঁচকাল,’তাহলে কোথায় থাকে?’
‘আমার সাথেই থাকে। ওর কথা বাদ দে। তুই কোথা থেকে এলি?’
‘ঘুরতে গেছিলাম।’
‘রায়হানের সাথে?’
‘প্রথমে ওর সাথেই গেছিলাম। পরে একাই ঘুরেছি।’
‘কেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আদনান।
প্রাপ্তি কোনো কিছু না লুকিয়েই সবটা আদনানকে বলে দেয়। আদনান দাঁত-মুখে খিঁচে বলে,’শালা জা’নো’য়া’র! জবাব তো একদম উচিত জবাব-ই দিয়েছিস। কিন্তু সাথে দু/চারটা কষে থা’প্প’ড় বসালি না কেন?’
‘দাঁতে যাকে মারা যায় তাকে হাতে মারার কী দরকার বলো?’
‘নেক্সট টাইম বে’য়া’দ’বটার কথায় আবার গলে যাস না প্রাপ্তি।’
‘পাগল নাকি? এরপর আর যদি যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তখন সত্যিই মার খাবে।’
আদনান হাসছে দেখে প্রাপ্তি জিজ্ঞেস করে,’হাসছ কেন?’
‘তোর রাগ আর সাহস দেখে। আমি তো তোকে সেই বাচ্চা-ই ভাবতাম। এখন দেখছি, নাহ্! তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস।’
প্রাপ্তি কিছু বলল না। আদনান নিজেই বলল,’চা খাবি?’
‘বাড়িতেই তো এসে পড়লাম।’
‘সমস্যা নেই। রিকশা ঘুরিয়ে টং দোকানে যাই চল।’
প্রাপ্তি কয়েক সেকেন্ড ভেবে রাজি হয়ে যায়। রিকশা আবার উলটো পথে চলা শুরু করে।
.
ঘুরেফিরে রাতে বাড়ি ফেরার পরে সর্বপ্রথম সেতুর সঙ্গে প্রাপ্তির দেখা হয়। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ যাবৎ ওর জন্যই অপেক্ষা করছে। প্রাপ্তিকে দেখা মাত্রই চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে গেল রুমে। এতক্ষণ বাইরে থেকে প্রাপ্তি ক্লান্ত ছিল। তাই সে ক্লান্তস্বরেই বলল,
‘কী হয়েছে? এভাবে নিয়ে এলে কেন?’
‘রায়হানের সাথে তোর কী হয়েছে?’
রায়হানের নাম শোনামাত্রই প্রাপ্তির চোখ-মুখের ভাব পাল্টে যায়। ক্লান্তি সরে গিয়ে কাঠিন্য ভর করে। ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে কাঠকাঠ কণ্ঠে বলে,
‘হঠাৎ ওর কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’
‘তুই নাকি ওর সাথে ব্রেকাপ করেছিস? নাম্বারও ব্ল্যাকলিস্টে ফেলেছিস?’
প্রাপ্তির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে রাগে গমগম করে উঠে বলল,’ব্রেকাপ করেছি, ব্লক করেছি এসব তো ঠিকই বলেছে। কেন করেছি তা বলেনি কেন?’
‘এত রেগে যাচ্ছিস কেন? আমায় বলবি তো ক্লিয়ার করে কী হয়েছে।’
‘তোমার ফ্রেন্ড একটা খারাপ লোক। সে ইন্টিমেট হতে চেয়েছিল আমার সাথে।’
সেতু অবাক হয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রাপ্তি রেগেই বলল,’আর কখনো ওর কথা আমাকে বলবে না। ওর নামটাও সহ্য হয় না এখন আর আমার।’
সেতু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,’ঠিক আছে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে।’
রাতে আর প্রাপ্তি ডিনার করেনি। ফ্রেশ হয়ে ওমনি শুয়ে পড়েছে। আননোন নাম্বার থেকে কল আসায় তার তন্দ্রা ভাবটুকু কেটে যায়। কল রিসিভ করতেই রায়হানের কণ্ঠ শুনতে পায়। আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। সাথে সাথে নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিয়েছে। এভাবে কতগুলো নাম্বার থেকে যে ট্রাই করেছে তার বোধ হয় হিসাবও নেই। বিরক্ত হয়ে ফোনই অফ করে রেখেছে প্রাপ্তি।
.
ভার্সিটিতে যাবে বলে পরেরদিন সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে যায়। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে তৃধা আর অঙ্কিতাকে দেখতে পায়। একটু অবাকই হয় আজ দুটোকে এখানে দেখে।
তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে,’আজ কী মনে করে বাড়িতে এলি?’
‘তোর বাড়িতে আসার আগে এপপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখতে হবে নাকি?’ ভেংচি কেটে জিজ্ঞেস করে তৃধা।
প্রাপ্তি মুখ টিপে হাসে। ‘কোনো কারণ ছাড়া তোরা বাড়িতে আসিসনি। ঝটপট বলে ফেল এখন উদ্দেশ্য কী?’
অঙ্কিতা বিছানায় শুয়ে পড়ল। ভাবলেশহীনভাবে বলল,’তোর বয়ফ্রেন্ড গতকাল রাতে ফোন করেছিল।’
‘বয়ফ্রেন্ড মানে? রায়হান?’
তৃধা বলল,’এমনভাবে বলছিস মনে হচ্ছে রায়হান ভাইয়া ছাড়াও তোর আরো পাঁচ, ছয়টা বয়ফ্রেন্ড আছে।’
তোয়ালে রেখে মুখে ফেস-পাউডার মাখতে মাখতে প্রাপ্তি উত্তর দিলো,’ওর সাথে এখন আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
ভূত দেখার মতো চমকে যায় অঙ্কিতা আর তৃধা। কত বাঁধা-বিপত্তি, কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই না রায়হান প্রাপ্তির মন পেয়েছিল। এ কথা তো বন্ধুমহলের সকলেই জানে। সেখানে ব্রেকাপ হয়েছে শুনে বিস্ময়েরও যে অন্ত থাকবে না এটাই তো স্বাভাবিক।
বিস্মিতকণ্ঠেই অঙ্কিতা বলল,’সেকি! কিন্তু কেন?’
প্রাপ্তি সব ঘটনা খুলে বলল দুই বান্ধবীকে। তৃধা রেগেমেগে বলল,’এভাবে ছেড়ে দিয়েছিস কেন শা’লাকে? দুইটা দুইটা করে মোট চারটা থা’প্পড় ঐ অ’স’ভ্যটাকে দেওয়া উচিত ছিল।’
‘ওর সামনে আর দাঁড়িয়েই থাকতে পারছিলাম না তৃধু। ঘেন্না লাগছিল ভীষণ।’
‘ব্যাটা ই’ত’র তো আমাকে এসব কিছুই বলেনি। ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলছে, তোর সাথে ঝগড়া হয়েছে। তাই নাকি কথা বলিস না, ব্লক করে রেখেছি। আমি আর তৃধা যেন তোকে বোঝাই। হাতে-পায়ে ধরাটা খালি বাকি ছিল রে ভাই! সকালেই যেন তোর কাছে আসি হ্যানত্যান।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল অঙ্কিতা।
প্রাপ্তি বিরক্ত হয়ে বলল,’বাদ দে এখন ওর কথা। আর কখনো ফোন বা ম্যাসেজ দিলে ব্লক দিয়ে দিস।’
তৃধা বলল,’ব্লক তো দেবোই। তার আগে ডিটারজেন্ট দিয়ে ওয়াশ করবো ই’ত’রটাকে।’
‘ঠিক আছে। এসব পরে হবে। আমি কিন্তু খেয়ে আসিনি। নাস্তা এখানেই করব।’ বলল অঙ্কিতা।
‘তোরা ডাইনিং-এ গিয়ে বোস। আমি আসছি।’
অঙ্কিতা আর তৃধা প্রাপ্তির রুম থেকে বের হতেই ড্রয়িংরুমে আদনানের সাথে দেখা হয়ে যায়। আদনানের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছে। কিন্তু ওদেরকে দেখেই আবার হাসল। হাসতে হাসতেই বলল,
‘আরে আরে সকাল হতে না হতেই সুন্দরীদের সঙ্গে দেখা। কেমন আছো তোমরা?’
অঙ্কিতা আর তৃধাও হাসল। বলল,’ভালো আছি ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন?’
‘আর ভালো থাকা! ঐ পেত্নীটা কোথায়? ফোন অফ কেন ওর?’
‘জানিনা তো! ঘরেই আছে এখন।’
‘বের হবে না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে ও নিজেই আসুক। আমি ততক্ষণে তোমাদের সাথে গল্প করি। খেয়ে এসেছ নাকি খাবে?’
‘খাইনি।’ বলল তৃধা।
‘গুড। আমিও খাইনি। চলো একসাথে খাওয়া যাক।’
ডাইনিংরুমে তিনজনে একসাথে বসে। আদনান সুমনা বেগমকে ডেকে নাস্তা দিতে বলে। বাড়ির আর সবাই এখনো ঘুমে। প্রাপ্তির বাবা তো আরো আগেই অফিসে চলে গেছে। সুমনা বেগম ওদেরকে নাস্তা দিয়ে পাশেই বসলেন।
আদনান খাওয়ার পূর্বে জিজ্ঞেস করল,’তুমি খেয়েছ আন্টি?’
‘আমি এত সকালে খাই নাকি? দশটার পরে খাব।’ হাই তুলতে তুলতে বললেন তিনি।
‘তাহলে অযথা এখানে কেন বসে আছো? বারবার হাই তুলছ, মানে এখনো তোমার ঘুম হয়নি।’ এরপর সে হাত ঘড়িতে সময় দেখে ফের বলল,
‘সাড়ে আটটা বাজে মাত্র। যাও গিয়ে ঘুমাও।’
‘আরে তোদের কিছু লাগলে এগিয়ে দেবে কে?’
‘আমরাই নিতে পারব। তুমি গিয়ে রেস্ট করো তো যাও।’
সুমনা বেগম হেসে বললেন,’পাগল ছেলে!’
তিনি চলে যাওয়ার পর আদনান ফিসফিস করে বলে,’কেন পাঠিয়ে দিয়েছি জানো?’
অঙ্কিতা বিরসমুখে বলল,’ফ্লার্ট যে করবেন না এতটুকু শিওর! কেন পাঠালেন তা জানিনা।’
‘তা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার মুখ বেলুনের মতো চুপসে আছে কেন?’
অঙ্কিতা অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে আদনানকে সে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু ভাগ্য এতই করুণ যে, পছন্দ করার কথাটিও সে কখনো আদনানকে জানাতে পারবে না। বলবেই বা কী করে? ধর্ম যে আলাদা! এছাড়া আদনান কখনোই ওদেরকে সেভাবে ট্রিট করেনি। সেখানে সে যদি পছন্দের কথা বলে তাহলে ঠাস করে থা’প্পড় দিতেও দু’বার ভাববে না।
গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অঙ্কিতা বলল,’আপনি বুঝবেন না আদনান ভাই।’
‘আচ্ছা বাদ দাও। আমরা টপিকে আসি।’
এর মাঝে প্রাপ্তিও রেডি হয়ে চলে বসে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,’আজ সকাল সকাল এই বাড়িতে? তোমাকেও ফোন করেছিল নাকি?’
আদনান ভ্রুঁ কুঁচকে জানতে চাইল,’আমায় ফোন করবে মানে? কে ফোন করবে?’
‘রায়হান। তৃধা আর অঙ্কিতাকে ফোন করেছিল বলেই তো আজ সকাল সকাল বাড়িতে চলে এসেছে। তুমিও এসেছ দেখছি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
‘মাথা খারাপ! ও আমাকে ফোন দিলে হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আসব।’
ওরা তিনজনে আসল। পরোটার টুকরা মুখে তুলে আদনান বলল,’এজন্যই কি রাতে ফোন অফ ছিল তোর?’
‘হুম।’
‘যাক,বেঁচে গেলি। আমি এসেছিলাম তোকে দুইটা চ’ট’কা’না দিতে।’
‘আজব! কেন?’
‘জরুরী কাজে ফোন দিয়েছিলাম রাতে অনেকবার। ফোন অফ ছিল, তাই মেজাজও খারাপ হয়ে গেছিল।’
‘আজাইরা রাগ শুধু।’
‘তুই চুপ থাক। আমি তৃধা আর অঙ্কিতাকে একটা গল্প শোনাব।’
তৃধা, অঙ্কিতা দুজনই দুজনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সমস্বরে বলে উঠল,’গল্প?’
‘হ্যাঁ। হূরপরীর গল্প। আমার একটা হূরপরী আছে।’
প্রাপ্তি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলল,’আমি যাচ্ছি। তোদের যদি ওর গল্প শুনতে মনে চায় তাহলে শুনতে পারিস।’
‘আরে! আমরা পরে একা যাব নাকি?’
প্রাপ্তি উত্তর না দিয়েই হাঁটা শুরু করে। এই হূরপরীর গল্প শুনতে শুনতে বিরক্ত সে। বাধ্য হয়ে তৃধা আর অঙ্কিতাও উঠে পড়ে। যাওয়ার আগে বলে যায়, অন্যদিন এসে হূরপরীর গল্পটা শুনে যাবে। আদনান তখন কিছু না বললেও ওরা চলে যাওয়ার পর মুচকি মুচকি হাসে।
সে আরামসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখে। আপাতত তার কোনো কাজ নেই। এগারোটা নাগাদ বের হয়ে বন্ধুদের সাথে বাইরে আড্ডা দিতে যাবে। সুমনা বেগম ঘুম থেকে উঠে আদনানকে ড্রয়িংরুমেই পায়।
‘আয় নাস্তা করে যা।’ বললেন তিনি।
‘উঁহু! পেট ভরে খেয়েছি। আর জায়গা নেই। তুমি খাও।’
‘তোর মা একা একা বাড়িতে কী করে?’
‘আব্বু অফিসে যায়নি আজ। তাই আসতে পারেনি।’
‘ওহহ।’
তিনি প্লেটে পরোটা, ডিম ভাজা আর আলু ভাজি নিয়ে এসে আদনানের পাশে বসলেন। হাসতে হাসতে বলেন,
‘টম এন্ড জেরী দেখতেছিস!’
‘হুম। ভালো লাগে। ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আমি আর প্রাপ্তি তো আগে এরকমই ছিলাম।’
সুমনা বেগম কিছু বলার পূর্বেই বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠে। আদনান নিজেই উঠে যায় দরজা খুলতে এবং রীতিমতো সে অবাকও হয়। দরজা খুলে রায়হান ও মধ্য বয়স্ক দম্পতিকে দেখতে পায়। রায়হান বেশ ভদ্রভাবেই জিজ্ঞেস করে,
‘বাড়িতে কেউ নেই?’
আদনান কোনো উত্তর না দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। রায়হান এসেছে ওর বাবা-মাকে নিয়ে। ওরা ভেতরে ঢোকার পর আদনান দরজা লাগিয়ে দিয়ে পিছু পিছু আসে। সুমনা বেগম রায়হানকে দেখে উঠে আসেন। হাসিমুখেই বলেন,
‘আরে বাবা তুমি! এসো এসো, বসো।’
‘ব্যস্ত হবেন না আন্টি। আপনি খাওয়া শেষ করুন।’ বলল রায়হান।
‘তোমরা আগে বসো তো।’
সবাই বসার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’উনারা কারা? তোমার বাবা-মা?’
‘জি, আন্টি।’
‘একটু বসো। আমি আসছি।’
সুমনা বেগমের সঙ্গে সঙ্গে আদনানও কিচেনে চলে যায়। রায়হানকে একদম সহ্য হচ্ছে না তার। ড্রয়িংরুম ফাঁকা হতেই রায়হান ওর বাবা-মাকে ফিসফিস করে বলে,
‘যেভাবেই হোক বিয়েতে ওদের রাজি করাবে প্লিজ! আমার প্রাপ্তিকে লাগবেই।’
চলবে…