এক ফালি সুখ পর্ব-৩০

0
325

#এক_ফালি_সুখ🌼 |৩০| [বোনাস পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
মৌরিন নাহিদকে সামনাসামনি দেখেছিল প্রায় পাঁচবছর আগে, এরপর কেবলই ফোনকলে দেখেছে। তবে মানুষটা তার চেনা, বলা যায় অতি পরিচিত। এক্স হাসবেন্ড বলে কথা!
নাহিদ বেশ ভালো ফটোগ্রাফার,ছবি তোলার শখ তার ছোটবেলা থেকেই। আজও এসেছিল ছবি তুলতেই, নাটকের শুটিং চলবে বলে ক্যামেরা নিয়ে চলে যাওয়ার জন্যই উদ্যত হয়েছিল সে। তবে এরই মাঝে মৌরিনকে দেখে চমকে যায় সে, ওষ্ঠদ্বয় প্রশস্ত হলো তার। ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে পা বাড়ালো মৌরিন এর দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
মৌরিন নিজ স্থানেই স্থির রইলো, পালানোর কোনো কারণ তো নেই। কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যেই নাহিদ এসে দাড়ালো মৌরিনের সম্মুখে। অবাক হয়ে বললো,
_”আমি কি ঠিক দেখছি? তুমি সত্যিই এসেছো?”

মৃদু হাসলো মৌরিন,উত্তরে বললো,
_”না আসার কি আছে? এই দেশের নাগরিক হিসেবে যেকোনো জায়গায় আসতে পারি আমি। নাকি শহরটাও নিজেদের নামে করে নিয়েছো?”

দৃষ্টি নামিয়ে নেয় নাহিদ। অপরাধীর সুরে বলে,
_”তুমি বিশ্বাস করবেনা তাসনিম,এতগুলো দিন আমি কিভাবে কাটিয়েছি। প্রতি মুহুর্তে আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছি। আমি কি করে এতটা নিচে নেমে গেলাম বুঝতেই পারছি না।”

_”কি আর করার, নিচে নামাটা খুব সহজ তবে উপরে ওঠাটা ভীষণ কঠিন।”

_”উপরে উঠতে চাইনা তো। আমিতো কেবল ভুল শুধরে নিতে চাই।”

মৌরিন না বোঝার ভঙ্গিতে বলে,
_”আচ্ছা,সেটা কি করে?”

মৌরিন এর দিকে তাকায় নাহিদ। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
_”সেটা তুমিও জানো তাসনিম, আমি তোমাকে আবার বিয়ে করতে চাই।”

হাসলো মৌরিন, দুদিকে মাথা নাড়িয়ে কিছুটা পাশে এগোলো। নাহিদ তার পিছনে এসে বললো,
_”আমি মজা করছিনা তাসনিম, সত্যি বলছি।”

_”ইউ নো হোয়াট নাহিদ, আমার দাম কিন্তু অনেক। হ্যা মানুষটা কালো হতেই পারি, তবে নিজের কাছে আমি খুবই মূল্যবান। একটা ভুল আমার বাবা করেছিল,ভাবছো কি করে একই ভুল আমি দ্বিতীয়বার করবো? নিজেকে এতটা সস্তা বানিয়ে ফেলবো? উম হু, সেটা ভেবে থাকলে ভুল করছো।”

_”তুমি একটু বোঝো, আমি মানুষটা ততটাও খারাপ নই যতটা তুমি ভাবছো। এতটুকুতো তুমি চেনো আমায় তাসনিম।”

অসহায় কণ্ঠ নাহিদের। মৌরিন সেটাকে তামাশা হিসেবে নিয়ে বললো,
_”কতটা চিনি? আরে তোমায় ০.১ পার্সেন্ট ও তো আমি চিনতে পারিনি, চিনতে চাই ই নি।”

_”কিন্তু আমিতো তোমাকে বুঝতে চেয়েছিলাম শুরুতে। তোমার গায়ের রঙ নিয়ে আমি কখনো প্রশ্ন তুলেছি তাসনিম? তুলিনি তো, আমি তো তোমার সঙ্গে সংসার টাই করতে চেয়েছিলাম।”

_”আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া, তোমার সঙ্গে সো কলড সংসার করতে হয়নি আমায়।”

একরাশ ঘৃণা নিয়ে কথাটা বললো মৌরিন। শুটিং এর জায়গা থেকে অন্যদিকে ছিলো তারা। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। মৌরিন বিরক্তিসূচক কণ্ঠে বললো,
_”কথা শেষ? এবার যাও এখান থেকে, কিছু মানুষকে চোখে দেখতেও ঘৃণা লাগে। তোমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হয়। ওহ, তোমার শহর তো, আমিই তো অতিথি এখন। থাকো তুমি, আমিই চলে যাচ্ছি।”

মৌরিন উল্টোদিকে ঘুরে চলে যেতে নিলেই নাহিদ তার হাত ধরে তাকে আটকাতে চায়। তবে তা সম্ভব হলোনা, তার আগেই অন্য এক পুরুষালি হাত এসে আটকে দেয় তাকে। কিছু একটা বুঝে পিছনে ঘুরতেই সেখানে তূর্যকে দেখতে পায় মৌরিন।
নাহিদ বিরক্ত হয়ে বলে,
_”আজব তো, আটকাচ্ছেন কেন আমাকে?”

হাত ছেড়ে দিয়ে নাহিদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তূর্য বলে ওঠে,
_”আপনার সমস্যা কি ভাই? বলছে তো ও কথা বলতে চায়না আপনার সাথে,তারপর ও আটকাচ্ছেন কেন ওকে?”

_”ও আমার পরিচিত,একটু রেগে আছে আমার উপর তাই। আর আপনি কে? আমাদের মধ্যে আসছেন কেন?”

মৌরিন শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
_”স্যার আপনার শুটিং চলছিল আই থিংক।”

তূর্য ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
_”তো? উনি তোমায় ডিসটার্ব করছেন কেন?”

_”আমার ব্যাপারে কথা বলতে হবেনা আপনাকে।”

রাগী চোখে মৌরিনের দিকে তাকায় তূর্য। নাহিদ তূর্যকে পাশ কাটিয়ে এসে মৌরিন এর হাত ধরে বলে,
_”শুনেছেন? আপনি যান তো ভাই নিজের কাজে। আর তাসনিম তুমি..”

কথা শেষ করতে পারেনা নাহিদ। তার আগেই বেশ জোরেশোরে একটা চ’র এসে পরে তার গালে। গালে হাত দিয়ে মৌরিন এর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় নাহিদ। মৌরিন স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে,
_”ভালোভাবে কথা বলছি মানে এই না তুমি যা খুশি তাই করতে পারো। বিনা অনুমতিতে একটা মেয়ের হাত ধরার আগে দশবার ভেবে নিও। আর আমার মনে হয় তুমি কানে কম শুনতে পাও, ডাক্তার দেখিয়ে নিও। মেয়ে বলে আমার হাতের জোর কিন্তু কম নয় নাহিদ শেখ, আশা করি বুঝতে পারছো। হুম?”

কিছুক্ষন হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নাহিদ,এরপর ক্যামেরার ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। একটা জিনিস বুঝে গেছে সে, এ জীবনে অন্তত তার মৌরিন কে পাওয়া হবেনা।

এতক্ষন মৌরিন এর দিকেই দৃষ্টি স্থির ছিলো তূর্যের। মৌরিন তাকালোনা তার দিকে,তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলো শুটিং এর দিকে। পারলোনা, আটকে দিলো তূর্য। চোয়াল শক্ত করেই মৌরিন এর হাত টেনে ধরলো সে। মৌরিন চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
_”আপনার ক্ষেত্রে আমি আলাদা আচরণ করবো তেমনটা ভাবার কিন্তু কোনো কারণ নেই স্যার।”

_”মারবে? তো মারো না, নিষেধ করছে কে?”

কথা শেষ হতে দেরি তবে গালে থা’প্প’র দিতে দেরি হলোনা মৌরিন এর। পাশে মাথা নুইয়েই সামান্য হাসলো তূর্য। মৌরিন এর হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বললো,
_”বললে তো তোমার হাতের জোর অনেক। কোথায়? খুব একটা ব্যাথা পেলাম না তো। এমন আরো দশ বারোটা থা’প্প’র তো খুশিখুশি খেতে রাজি।”

_”ভালোয় ভালোয় বলছি তূর্য,হাতটা ছেড়ে দিন। আপনি চেনেন না আমায়।”

_”চিনতেই তো চাইছি মৌরিফুল, তুমিতো সুযোগটাই দিচ্ছো না।”

হাত মোচড়াতে লাগলো মৌরিন। তবে তূর্য ছাড়লোনা তাকে। একদৃষ্টিতে মৌরিন এর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”অ্যাওয়ার্ড টা পেলাম না, হেরে গেলাম। কিন্তু তার সামান্যতম কষ্ট আমার মনে নেই। ছবিগুলো নিয়ে কতকিছু হলো,কানও দিলাম না সেদিকে। প্রেস্টিজ নষ্ট হলো আমার, সেদিকেও তাকালাম না। হাজারটা প্রশ্ন করলো মানুষ,তারও উত্তর দিলাম না। একটা ছেলে তোমার জন্য এতটা পরিবর্তন হলো মৌরিন, অথচ তোমার একটুও মায়া হয়না?”

_”পরিবর্তন জগতের একটা নিয়মের মধ্যে পরে। একজন মানুষ হিসেবে আপনি খারাপ অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারলে, তাতে আমি অবশ্যই খুশি হবো। তবে এরচেয়ে বেশি মায়া দেখানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

_”কেন সম্ভব নয়? তুমি চাইলেই সম্ভব।”

_”হয়তো সম্ভব, তবে আমিই চাইছিনা।”

_”কারণটা কি শুধুই আমি?”

_”হতেও পারে, নাও হতে পারে।”

_”আমার কথা একবারো ভাবতে ইচ্ছে করছেনা? লাইক একবারো না? সত্যি বলছি,এটা মোহ নয়। এত দিনে অন্তত মোহ কাটিয়ে উঠতে পারতাম আমি। তবে আমি ফেঁসে গেছি মৌরিন, বাজেভাবে ফেঁসে গেছি তোমাতে। একটাবার আমাকে সুযোগ দেওয়া যায়না, তোমার জীবনে সুখ বইকি দুঃখের পালা ভারি করবোনা আমি।”

_”নিজের সুখ আমি নিজেই খুজে নিতে চাই তূর্য,শুধু আপনি কেন, কারোর সাহায্যের প্রয়োজন মনে করছিনা আমি।”

মৌরিন এর দিকে এগিয়ে এলো তূর্য, করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_”ঝুম বর্ষায় তোমার মাথার উপর ছাতা হওয়ার অনুমতি টা দাও না আমায় মৌরিফুল,কথা দিচ্ছি তোমায় একটুও ভিজতে দেবোনা।”

তূর্যের হাত আলগা হলো কিছুটা,সেই সুযোগে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো মৌরিন। দু কদম এগিয়ে আবারো ঘাড় ঘুরালো সে। তূর্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো, মৌরিন ও এবার তূর্যের চোখে চোখ রেখে বললো,
_”কিন্তু আমার যে বৃষ্টিবিলাশ পছন্দ তূর্য। বৃষ্টিতে সর্বদা ছাতা নিয়ে চলাটা আমার খুব একটা পছন্দের নয়। তাই সেই ছাতা’টা না হলেও চলবে।”

#চলবে?