#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৪
#আফনান_লারা
________
সজীব জানে সে এখন যাই বলবে সারথির কাছে সেটাই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।তাই চুপচাপ দরজা খুলে সে বের হয়ে গেছে জামাই আদর খেতে। সেটা খেয়ে যদি মনটা ভাল হয়,বউকে দিয়ে তো মন ভাল হয়নি।
বের হতেই দাদাজান এসে সামনে দাঁড়ায় সজীবের।দুহাত দিয়ে ওকে ধরে বলেন,’খাওয়া দাওয়া ঠিক ঠাক করোনা নাকি?আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছো’
‘খাই।তবে ওখানকার খাবার আর এখানকার খাবারের তো তফাৎ আছে’
‘সেটাও ঠিক।তা কতদিনের জন্য এসেছো? ‘
‘আসলে আমি ছুটিতে আসিনি।জরুরি একটা কাজে এসেছি।এক সপ্তাহ পর চলে যাব’
‘ততদিন আমাদের এখানেই থেকো।তোমার মা তো আসছেন এখানেই’
‘মা আসছে?ওহ!কেন?আমার কথা জানিয়েছেন?’
‘নাহ,সারথির তো সকাল থেকে শরীর খারাপ।বদহজম হয়েছে।তাই দেখতে আসতেছে’
‘সারথি এ নিয়ে আমায় কিছু বলেনি,দূর্বল দেখলাম অবশ্য’
‘জানোই তো, সারথি তার অসুখ নিয়ে কাউকে বলতে পছন্দ করেনা।বুঝে নিতে হয়।চলো বাগানের দিকে, তোমার সাথে গল্প করবো’
দাদাজান সজীবকে ধরে বাগানের দিকে নিয়ে গেছেন।নাতিন জামাই আলাদা ব্যাপার স্যাপার।এদের সাথে আড্ডাটাও দারুণ জমে।তার উপর একমাত্র নাতিন জামাই।যাই বলবেন তাতেই ভেতর থেকে ভাল লাগা কাজ করবে।কত বছর পর একসাথে হলো তারা।কথার তো শেষ খুঁজেই পাওয়া যাবেনা।
ফারাজ দূরে দূরে থাকছে।যেদিন থেকে শুনেছে সজীব সারথিকে মেনে নিতে পারেনি সেদিন থেকে সজীবকে ওর ভাল লাগেনা।তাছাড়া ও সারথিকে কতটা অবহেলা করতো তার সবই ফারাজ দেখতো। সে কারণে এখন সে সজীবের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেনা।এই বিষয়টা ভাল লাগেনি মানিক সাহেবের। তিনি রেগে আছেন ফারাজের উপর।তার কথা হলো ফারাজ একমাত্র শালা হিসেবে উচিত গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করা।সেটা না করে ফারাজ বিশ হাত দূরে দূরে থাকছে।তিনি পারছেন না ফারাজকে ঠেলে পাঠাচ্ছেন।কিন্তু ফারাজ হলো মহা ঘাড়ত্যাড়া। তাকে জোর করে কিছু করানো যায়না এই নিয়ে তিনি পরিচিত বলেই চুপ করে শুধু রাগে ফুঁসে যাচ্ছেন।এর বাইরে তার কিছুই করার নেই বলে সোনালীকে ডেকে বললেন তিনি যেন ফারাজকে বলে গিয়ে সজীবের সাথে কথা বলতে।
মিসেস সোনালীর নাক অবধি কাজে ডুবে আছে,একমাত্র মেয়ে জামাই বাড়িতে আসলে বুঝি সব শাশুড়ির এমন হয়।কি রেখে কি রাঁধবেন সেটা গুছাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।পূর্ণতা,সায়না আর মতিন ও কাজে লেগে আছে।
তাও যেন কাজের লোকের অভাব।বড় বাড়ির ছেলে,কত বছর পর এসেছে।তাও আবার একমাত্র মেয়ের জামাই।২০পদ করলেও কম মনে হবে।মানিক সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে মতিনকে কাজ থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন।ফারাজ গাল ফুলিয়ে বসে আছে তখনও।সজীবকে ঘিরে যত আয়োজন হচ্ছে সে একটাতেও সামিল হতে চায়না বলেই কাজের মধ্যিখানে মূর্তি হয়ে বসে আছে।
সিয়াম,অনন্ত অর্ক চকলেট নিয়ে হইচই করছে।সজীব মার্কেটে লোক পাঠিয়ে বিশাল বিশাল দুইটা বাক্স চকলেট এনেছে শুধুমাত্র বাড়ির বাচ্চাদের জন্য,আসার পথে বিদেশী চকলেট আনার কথা ভুলে গেছিল।
এখন যেগুলো এনেছে তার থেকে মাঝারি সাইজের একটা বাক্স সারথির রুমের দিকে গেছে।
সারথি দরজা বন্ধ করে বসেছিল।মিসেস সায়না চকলেট দেয়ার জন্য কয়েকবার করে দরজা ধাক্কিয়েও সারথির সাড়া না পেয়ে চলে এসেছেন।
সজীবের সামনে এক থালা পিঠা রেখে গেছে পূর্ণতা।সজীব তখন দাদার কাছে জানতে চাইলো ও কে।দাদাজান সোজা ভাষায় বলে দিলেন ফারাজের হবু বউ।
সজীব হেসে বললো,’শালাবাবুর জন্য তো ম্যাচিউর মেয়ে দরকার।ভাইয়ের পছন্দ তো সেরকমই জানি,তা এ কেমন?’
‘হুম।এই মেয়েটা বাচ্চার মধ্যে ম্যাচিউর’
সজীব খিলখিল করে হেসে ফেললো দাদাজানের কথা শুনে।
————
সারথি সব হইচই শুনছে রুমে বসে থেকে।তার ইচ্ছে করে!! হয় নিজের জীবনটা এই মূহুর্তে নিয়ে নিতে নাহয় গিয়ে সজীবকে মেরে ফেলতে।রাগে হাত বাড়িয়ে বালিশ ফেলতে গিয়ে দেখলো হাতের কাছে সজীবের ফোন।এটা সজীবের সে জানে কারণ তার ফোন তো ফারাজের রুমে।
ফোনটা আগের জায়গায় রেখে চুপ করে আছে সারথি।সে জানে সজীবের ফোন লক করা থাকে তাই আর এটা নিয়ে গবেষণা করে নাই।
দরজার কড়া নাড়ালেন মানিক সাহেব।গলার স্বরে বোঝা গেলো ফারাজের সাথে সাথে এবার তিনি সারথির উপরও রেগে আছেন।
রেগে রেগে বললেন,’জামাই এত বছর পর এসেছে তার কাছাকাছি না থেকে দরজা বন্ধ করে রেখে কি বুঝাতে চাস সারথি??দুই ভাই- বোন মিলে কি আমার মানসম্মান ডুবাবি??এটা কেমন বেয়াদবি?ছেলেটা কি এসেছে কেবল বাবার সাথে কথা বলার জন্য?তোরা কেউ ওকে সময় দিচ্ছিস না।ওর মা কিছুক্ষণ পর এসে পড়বেন,কি ভাববেন বুঝতে পেরেছিস??তুই তৈরি হয়ে এখন ওর কাছে যাবি।আমি কিছু শুনতে চাইনা’
এই কথা বলে মানিক সাহেব চলে গেছেন।
সারথি বিছানা ছেড়ে চোখ মুছে ধীর পায়ে এসে দরজা খোলে।খুলতেই কিসের যেন আওয়াজ হলো।নিচু হয়ে হাতিয়ে বুঝলো একটা চকলেটের বাক্স।
এই বাড়িতে চকলেট কেনা হয়না।মাঝে মাঝে ফারাজ হাতে করে দুই একটা আনে বাচ্চাদের জন্য।কেনা হয়না কারণ বত্রিশ বার দাঁতের ডাক্তার এসেছে এই বাসায়।তাই দাদাজানের কড়া নিষেধে এই বাড়ি থেকে চকলেট নিষিদ্ধ হয়ে ছিল এতদিন।এখন সজীব এনেছে বলে কেউ কিছু বলবেনা হয়ত।
বাক্সটা যেখানে ছিল ওখানে রেখেই সারথি দেয়ালে হাত রেখে সিঁড়ির দিকে গেলো।সিঁড়ি অবধি এসে নামতে যেতেই নিচ থেকে সজীব বললো,’আসতে হবেনা।আমি আসছি ওখানে’
‘আমি আপনার জন্য আসছিনা।’
‘তাও আসতে হবেনা।সিঁড়িতে পড়ে যেতে পারো’
‘ছোটবেলা থেকে অভ্যাস আছে।’
‘অসুখের সময় অভ্যাস কাজে দেয়না।’
ফারাজ সোফায় বসে সব শুনছে।সারথি যে রাগ দেখাচ্ছে তাতে সে খুশি হলো।সজীবের মতন ছেলের সাথে এমন ব্যবহারই করা উচিত বলে তার মনে হয়।
সজীব মন খারাপ করে পেছনে ফিরতেই ফারাজকে দেখে এক গাল হাসি দিয়ে ওর পাশে বসলো।তারপর বললো,’কি খবর শালাবাবু।শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক?’
‘নাহ’
‘দাদাজান বললো।তা বলো কি খবর?ফোন -টোন তো দাওনা’
‘আপনি দিতেন?’
‘আমি তো ব্যস্ত থাকতাম’
‘আমিও ব্যস্ত ‘
মানিক সাহেব সব শুনে গেলেন রেগে।এক ধমক দিয়ে বললেন,’দুলাভাইয়ের সাথে কেউ এমন করে কথা বলে ফারাজ?এটা কিরকম বেয়াদবি!!সুন্দর করে কথা বলবে!’
‘আঙ্কেল সমস্যা নাই।ফারাজ তো মজা করছে আমার সাথে।আপনি বসুন না এখানে’
সারথি এক সিঁড়ি এক সিঁড়ি করে নিচে নেমে মায়ের কাছে গেছে।সজীব তখন ডাইনিয়ের কাছে এসে এক গ্লাস পানি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকালো।সারথি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। নিচে বসে ওর মা আর কাকি মাছ,মাংস কাটছেন।সারথি এখন আর ঠিক আগেরমতন নেই,চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে,ঠোঁটে সেই রঙটা নেই।কেমন যেন মনে হয় গোলাপির উপর কালচে রঙ পড়ে গেছে।যে রুপ সজীব বিয়ের আগে দেখেছিল সেই রুপ এখন নেই।মনে হয় সব কিছুর উপর একটা ছাপ বসে গেছে। এত কিছুর পরেও সারথিকে দেখতে সজীবের ভালই লাগছিল।সাধারণের মাঝেও তাকে অসাধারণ লাগছিল আজ।নিজের স্ত্রী বলেই কি!!!
মিসেস সায়না সজীবকে দেখে লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে বললো,’ভাবী আপনার মেয়েরে বলেন জামাইর কাছে যাইতে।জামাই বেচারা তো দূর থেকে দেখছে উপায় না পেয়ে’
মিসেস সেনালী মুচকি হেসে সজীবের দিকে চেয়ে এবার সারথির আঁচল ধরে টান দিয়ে বললেন সজীবের কাছে যেতে।ওর কি লাগবে না লাগবে সেটা দেখতে।
সারথি যেন শুনলোইনা।যেভাবে ছিল ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
সোনালী এবার পূর্ণতাকো ইশারা করলেন।পূর্ণতা উঠে সারথির হাত ধরে সজীবের সামনে দিয়ে আসলো।
সজীব মুখে হাসি ফুটিয়ে সারথিকে দেখছিল,সারথি তখন রাগে ক্ষোভে বললো,’আপনার ভাল মানুষীর পেছনে যে রুপ আছে সেটা কবে সবাইকে জানাবেন?’
‘যখন আমি সই করবো তখন সবাই জানবে!’
‘আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এত প্রেম কেন দেখাচ্ছেন?সবাইকে বুঝাতে চাইছেন দোষটা আপনার না, দোষটা আমার?আমি নিজের ইচ্ছেতে সব করেছি?’
‘তা নয়।অনেকদিন পর আসলাম তো।বউয়ের প্রতি তাই দরদ উতলিয়ে পড়ছে’
‘আপনার সাথে কথা বলাই আমার ভুল’
এটা বলে সারথি হনহনিয়ে চলে গেলো।দ্রুত হাঁটতে গিয়ে টেবিলরে কোণার সাথে লেগে ব্যাথা পেয়ে থেমে গেছে।সজীব ওর হাঁটুতে হাত রেখে বললো,’আমি না থাকলেও কি এমন কোণায় কোণায় ব্যাথা পাও?নাকি আমি আসাতে নিজের খেয়াল রাখা কমিয়ে দিয়েছো??’
‘আমি কারোর উপর নির্ভরশীল না।হাত সরান।আপনি প্লিজ এই মিথ্যে আদর দেখাবেননা।আমার সহ্য হচ্ছেনা এইসব’
সজীব হাত সরিয়ে নিলো।সারথি চলে গেছে আবার।ফারাজ সব দেখছে তাও চুপ করে আছে।পূর্ণতা সজীবকে দেখলো সারথির পিছু পিছু লুকিয়ে যাচ্ছে যেন সে টের না পায়।এসব দেখে মিটমিট করে হাসছে পূর্ণা।তারপর পেছনে ফিরতেই ফারাজকে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বললো,’দুলাভাইকে ওমন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছেন কেন?’
‘আপনার কি তাতে?’
‘আচ্ছা আমি বুঝলাম না,আপনি আর সারথি আপু সজীব ভাইয়াকে পছন্দ করেন না কেন?’
‘মানুষকে অপছন্দ করার পেছনে যথাযথ কারণ থাকে।আমাদের সেই কারণ আছে এবং সেটা আপনাকে বলতে চাইতেছিনা’
সেসময় দাদাজান এসে ওদের দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন,’তোমাদের দুজনকে আলাদাই করতে পারিনা আবার বিয়েও দিতে পারিনা।তোমাদের আসলে কি সমস্যা বলতে পারো?’
‘আমি ওরে বলিনি আসতে।ও এসেছে সেধে সেধে কথা বলতে’
ফারাজের কথা শুনে পূর্ণতা একমাত্র দোষী হয়ে গেলো দাদার কাছে।ঢোক গিলে সে দাদার মুখের দিকে চেয়ে আছে।তিনি আঙুল তুলে বললেন,’এতবার মানা করতে পারবোনা।আমার নেহাত মনমানসিকতা ভাল।এরপর যদি মন খারাপের সময় তোমাদের একসাথে দেখি তো দেখিও কি করি।যাও সামনে থেকে।
সারাদিন কাছাকাছি থাকবে,বিয়ের কথা বললেই দুজনে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
কি আজব দুটি মানুষ!’
ফারাজ আছে সারথির চিন্তায় এর ভেতরে বয়স্ক দুজন এসে সারাদিন এক কথা বলে।বিয়ে বিয়ে!!পূর্ণতাকে বিয়ে বিয়ে বিয়ে!!
————
সারথি সিঁড়ি শেষ করে উপরে চলে এসেছে।উঠার সময় বারবার মনে হয়েছিল কেউ তার পাশে আছে।
সজীব বিয়ের পরে শুরুতে যেমন ব্যবহার করত এখনও একই ব্যবহার করছে।তফাৎ হলো বিয়ের পরে প্রথমে সারথি জানতোনা সজীব নাটক করছে।আর এখন জানে!!
রুমের কাছে এসে থামলো সারথি।পেছনে ফিরে বললো,’আপনি আর কি চান আমার থেকে?সই তো করে দিলাম।আর কি চাওয়ার থাকে?’
‘তুমি জানলে কি করে আমি এসেছি?’
‘সেটা যদি জানতেন তবে ডিভোর্স পেপার আনতেন না আসার সময়’
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৫
#আফনান_লারা
________
সজীবের হঠাৎ করে লেভেনের কথা মনে পড়লো।সারথিকে রেখে দিলো এক দৌড়।সোজা রুমে এসে ফোন অন করে মনে আসলো তার তো দেশের সিম নাই।
লেভেনকে কেমনে কল করবে।ভাবতে ভাবতে সারথির ফোনের কথা মনে আসায় সে সারথির কাছে ওর ফোন চাইলো।সারথি বলে তার ফোন হয়ত ফারাজের রুমে।সজীব যেন গিয়ে নিয়ে আসে।
ঝামেলা দেখে পরে কথা বলবে ঠিক করে ওখানেই বসে থাকে সজীব।
সারথি আর কথা বাড়ায়নি,
যেমন করে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন করেই দাঁড়িয়ে আছে।
আনাফের সকাল থেকে সারথির জন্য চিন্তা হচ্ছিল।এদিকে তার কাছে না আছে সারথির নাম্বার আর না আছে ওর বাড়ির নাম্বার।
ফারাজের নাম্বারটাও খুঁজে পাচ্ছেনা ফোনে।
তাই সে ঠিক করেছে সোজা হাবিজাবিতে যাবে বিকালের দিকে ঠিক করে হাসপাতালে বসে রুগী দেখছে সে।
সজীবের মা এসে যখন জানলেন সজীব দেশে ফিরেছে,তিনি তো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।বারবার সজীবের নাম নিয়ে ডাকছিলেন।সজীব রুমে থেকে তার ডাক শুনে বের হয়ে আসলো।মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় জানতে চাইলেন সে কেন আগে ওনার সাথে দেখা করেনি।সজীব বলছে সে কাজে এসেছে।তিনি সেটা কিছুতেই মানতে রাজি নন।সারথিকে আগে দেখতে এসেছে এটা মনে করেই তিনি রেগে আছেন।
কোনো কিছু করেও মাকে সজীব মানাতে পারছেনা।তিনি রেগে আছেন সজীবের এমন উদ্ভট কাজে।
তাই সারথির কাছে এসে শুরুতে জানতে চাইলেন সে জানতো কিনা সজীব আসার কথা।তারপর যখন জানলেন সেও জানতোনা তারপর তার রাগ কমলো।
হাসি মুখে বললেন সারথি যেন ভাল শাড়ী পরে একটু সেজে নেয়।সারথি মাথা নাড়ালো কিন্তু কিছুই করলোনা।এরপর তিনি কথাটা পূর্ণতাকে বললেন।এটাও বললেন সে যেন জোর করে সারথিকে সাজিয়ে দেয়।
মিসেস সোনালীর থেকে একটা শাড়ী নিয়ে পূর্ণতা গেলো ওকে সাজাতে।জোরজবরদস্তি করতে হয়নি।সারথি কেমন যেন মনমরা হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।সজীবের চেহারা বর্ণনা দিতে দিতে পূর্ণতা ওকে শাড়ী পরিয়ে দিয়েছে,চুল বেঁধে দিয়েছে,বাগান থেকে ফুল এনে চুলে গুজেও দিয়েছে।হাতে বালা পরিয়ে দিয়েছে,ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়েছে।তার মতে সজীব যেমন সারথিকে পেয়ে জিতেছে তেমনি সারথিও জিতেছে।কারণ সজীব সব দিক মিলিয়ে একেবারে সুদর্শন পুরুষ।হাইট,ওয়েট,ব্যবহারের বর্ণনা দিতে দিতে শেষ পূর্ণা।সারথির কাছে সব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।কারণ মানুষের বাহ্যিক কোনো কিছু দেখে আসলেই জাজ করা উচিত না।সে ভেতরে খুব ভাল হতে পারে আবার খুব খারাপ ও হতে পারে।
সারথির চোখে সে প্রচণ্ড খারাপ।
পূর্ণতা সারথিকে সাজিয়ে চলে গেছে সজীবকে ডাকতে।
সারথি জানে সজীব এখন রুমে আসবে তাই সে বের হয়ে গেলো।বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বাগানে নেমে গেছে সে।পায়ে জুতা নেই।তাড়াহুড়া তে নিতে ভুলে গেছে।
আগে সজীব আসার কথা শুনলে সারথির কত আয়োজন থাকতো আর আজ সে নিজে পালাচ্ছে সজীবের কাছ থেকে।খালি পায়ে কঙ্করে পাড়ি জমিয়ে হাঁটছে সে।
শুরুতে সব ঠিক ছিল কিন্তু হঠাৎ পায়ের ব্যাথাটা তীব্র হয়ে গেলো।মনে হয় কিছু একটা ফুটেছে।তা না খেয়াল করেই সারথি পথ চলছে।যেদিকে পা চলবে সেদিকে যেতেই থাকবে।বাড়ি থেকে অনেকটা পথ সে এসে গেছে।কোলাহল কমে যাওয়ায় হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো সে।
দম ফেলে মুচকি হাসলো।যাকে সে চায়না তার থেকে দূরে আসতে পেরে ওর ভাল লাগা কাজ করছে মনের ভেতর।হাসি মুখে এক কদম ফেলতেই টের পেলো তার পায়ে অসহনীয় ব্যাথা।
হাত নিয়ে পা ধরে ভেজা ভেজা কিছু বুঝতে পেরে নিচে রাস্তায় বসলো সে।তারপর হাত দিয়ে ধরে দেখার চেষ্টা করলো কি হয়েছে।ব্যাথা করছে তার মানে এগুলো রক্ত।
রাস্তায় পা ডলে সারথি আবার উঠে দাঁড়ায়।আরও দূর যেতে হবে ভেবে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করলো সে।ওমনি একটি মিষ্টি গন্ধ এসে লাগলো নাকে।নাকটা ডুবে গেছে এক নরম শীতল জায়গায়।এই জায়গার সুবাস তার অনেক চেনা।চোখ বন্ধ করে এক আলাদা দুনিয়ায় চলে গিয়েছিল সে।পরে হুশ ফিরায় হাত বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করেই পিছিয়ে গেলো সারথি।ওটা আনাফ!
আনাফ কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আর এক মিনিট আমার বুকে মাথা রাখলে কি এমন হতো?জানেন আমি নিজেও আলাদা জগতে চলে গেছিলাম?’
‘সেই জগতে কি সবুজ গাছ ছিল?’
‘নাহ,শুকনো পাতার শহর ছিল।কেন বলুন তো?’
‘আমারও। ভাল!আপনি এখানে কি করেন?আমি যেখানে যাই আপনাকে খবর কে দেয়?’
‘তার নাম মিঃ মন’
‘সে কে?’
‘বুঝবেননা।পায়ে কি হয়েছে দেখি’
কথাটা বলে আনাফ নিচে বসে সারথির পা ধরতেই সে সরে যাবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা,আনাফ শক্ত করে ধরে রেখেছে।মাথা তুলে সে আবার বললো,’বলতে বাধ্য হচ্ছি,যারা চোখে দেখেনা তদের ভুলেও যে কাজটা করা উচিত না সেটা হলো জুতা ছাড়া বের হওয়া।পায়ের হাল কি করেছেন জানেন?দেখে মনে হয় অগ্নি পথ পাড়ি দিয়ে আসছেন’
সারথি চুপ করে আছে।আনাফ পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,’আমি ডাক্তার বলেই কি আপনার এত অসুখ?’
‘রোগীর রোগ হলেই তো ডাক্তাররা খুশি হয়’
‘সেক্ষেত্রে আমি ব্যাতিক্রম।কারণ আমি নিজের খরচ দিয়ে রোগী দেখি।যেমন ধরুন এখন আমার রোগী দেখার সময়।৪০টা রোগী রেখে আমি আপনার সাথে দেখা করতে হাবিজাবি এলাকাতে ঢুকেছি।ভাবতে পারছেন কত খরচা গেলো?একটা রোগীর থেকে ভিজিট ৭০০টাকা নিই।৪০জন থেকে কত আসে হিসেব করেন দেখি।ফারাজ বলেছে আপনার হিসেবের মাথা কড়া’
‘মুড নেই।আপনার রুমাল সরান।আমার হাঁটতে অসুবিধা আরও বেশি হবে’
‘আপনাকে হাঁটতে দেবে কে?আমি এখন সিনেমার নায়কদের মতন আপনাকে কোলে তুলে গাড়ীতে নিয়ে বসাবো।সবাইকে দেখিয়ে দিব ডাক্তাররাও নায়কের রোল করতে পারে’
‘খবরদার বলছি!’
‘আপনাকে এর আগেও কোলে নিয়েছিলাম।হয়ত ভুলে গেছেন।মনে করিয়ে দিচ্ছি।শেষবার নদীতে ডুবে মরতে গেছিলেন না?তখন আমি আপনাকে পানি থেকে তুলে সোজা হাসপাতালে নিছিলাম।দেখতে যতটা মোটা লাগে আসলে আপনি তা নন।মনে হচ্ছিল পেঁপে গাছ তুলেছি।’
‘আমি হেঁটে যেখানে যাবার যাব,আপনাকে সঙ্গ দিতে হবেনা।সরুন সামনে থেকে’
‘আনাফ যতদিন আছে ততদিন সারথির কপালের ঘাম,আর চোখের পানি নিচে পড়ার আগেই মুছে যাবে’
‘আপনার আসলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়াই উচিত ছিল।আপনাকে ডাক্তার বলতে গেলে আমার মনে হয় ঠাট্টা করছি’
‘আসলেই!!অধরা আপনাকে এই ইতিহাস বলে দিয়েছে?আজকালকার ননদ গুলা এমন কেন!’
সারথি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে ছিল।আনাফ হাসতে হাসতে হঠাৎ ওর চোখ গেলো সারথির দিকে।সারথি আজ সেজেছে এটা সে খেয়ালই করেনি এতক্ষণ।সেজেছে বলতে একেবারে ভীষণ সুন্দর করে সেজেছে।লাল পাড়ের সাদা শাড়ী,খোঁপায় ফুল
গলায় হার,হাতে বালা।আনাফ হা করে শুধু দেখে যাচ্ছে,সেসময় সারথি নড়ে দাঁড়াতেই ওর মাথায় আটকানো মাধবীলতা ফুলগুলো নিচে ঝরে পড়ে গেলো।আনাফ সেগুলো তুলে ওর মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে ছিল।
———
সজীব এসে দেখে রুমটা খালি পড়ে আছে।সারথি কোথাও নেই।তাই সে রুমে না ঢুকে বাহিরে এসে পূর্ণতার কাছে জানতে চাইলো সে কোথায়।পূর্ণতা বললো সে জানেনা।
তাই সজীব নিজেই বের হয় সারথিকে খোঁজার জন্য।
——–
ওদিকে আনাফ সারথিকে নিয়ে যাবার জন্য ওর সাথে কথা কাটাকাটি করছিল ঠিক সেসময় দূর থেকে শোনা গেলো ডাক।
আনাফ দেখে সেই দূর থেকে সারথির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একটা মানুষ ছুটে আসছে।
আনাফ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো।সজীব কাছে এসে সারথির সামনে গিয়ে বললো,’এটা কি সারথি??না বলে চলে আসলে?আমার জন্য সাজলে আর আমায় দেখালে না?’
এই কথা বলে সজীব আনাফকে দেখে মুচকি হেসে বললো,’আমার স্ত্রী। নিশ্চয় রোডে এক্সিডেন্ট করতে নিছিলো?ও এমনই করে।আপনি বাঁচিয়েছেন?অনেক ধন্যবাদ।ওহ পরিচয় তো দিলাম না।আমি সজীব!!এন্ড ইউ??’
আনাফ সজীব নাম শুনে তব্দা খেয়ে গেছে।কোনোমতে হাত উঠিয়ে হাত মিলিয়ে বললো সে আনাফ।
সারথি যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে আছে।সজীব ওর হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য টান দিতেই সারথি পায়ের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।আনাফ কিছু চেয়েও করতে পারেনি।চুপ করে সব দেখছে শুধু।
‘কি হয়েছে সারথি?কোথাও ব্যাথা পেয়েছো?’
‘নাহ।আপনি চলে যান।আমি যাব না’
‘কেন যাবেনা?’
‘কি দরকার যাওয়ার?জোর করবেন না।আমাকে একা থাকতে দিন’
সজীব এগোলো কোলে নেয়ার জন্য।আনাফ হাত মুঠো করে এসব তাকিয়ে দেখছে শুধু।ভেতরে যেন কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে কেউ।সহ্যই হচ্ছেনা ওর।
————-
ফারাজ একটা পথ খুঁজছিল পূর্ণাকে ধরার জন্য।সে সারথিকে সাজিয়ে তৈরি করেছে এটা নিয়ে ফারাজ ওর উপর ভীষণ ভাবে রেগে আছে।এতই রাগ যে পারছেনা দাদাজানের সামনে দিয়ে গিয়ে ওকে ধরতে।
অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে সে ছিল পূর্ণতাকে একান্তে পাবার।কিন্তু কাজের এতই চাপ যে সে ওকে একাই পাচ্ছেনা।একবার একজন থাকছে পাশে।
পরে যখন সবাই কাজ শেষ করে বাগানের দিকে গেলো তখন ফারাজ ঠিক করলো এবার ধরবে ওকে।
পূর্ণা হাত ধুয়ে সেও যাচ্ছিল বাগানের দিকে,তখনই পথ আটকে দাঁড়ায় ফারাজ।
চোখ মুখ ফুলা দেখেই পূর্ণা আন্দাজ করে ফেলেছে কিছু একটা বলবে,করতেও পারে।
পরিস্থিতি সামলে পূর্ণতা জানতে চায় কি হয়েছে।এভাবে পথ আটকানোর মানে কি।
‘আপনি আমার বোনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ আর করবেন না’
‘কি করেছি?’
‘ও চায়না সাজতে,আপনি তাও সাজালেন কেন?’
‘আমাকে ওনার শাশুড়ি বলেছিল’
‘তো?? বলছে তো কি হয়েছে?আমার বোন যেটাতে সহজবোধ করবে সেটাই করবে।জোর কেন করবেন?’
‘করিনি।আপু চুপ ছিল।মানা করলে আমি করতাম না’
‘আর কখনও এমন আরেকজনের কথা ধরে কিছু করবেননা।ভেতরের খবর সবাই জানেনা। ‘
পূর্ণতা ঠিক আছে বলে আসা ধরতেই ফারাজ আবারও ওর পথ আটকালো।
কি ভেবে বললো,’সরি’
‘সরি কেন?’
‘জানিনা।এমনি মনে হলো বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছি’
‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,এবার ঘুঘু তোমার বধিবো পরাণ’
এই কথা শুনে ফারাজ আর পূর্ণতা একসাথে তাকায়।আজিজ খান কোমড়ে হাত রেখে চেয়ে আছেন।মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।
‘তোমাদের তো একসাথে একা বাসায় ধরেই ফেললাম।এবার বলো বিয়ে আজ করবা নাকি কাল সকালে?’
ফারাজ আর পূর্ণতা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে বারবার।শেষে বাধ্য হয়ে ফারাজ বললো,’আপনি ভুল দেখেছেন দাদা’
‘আমি ভুল হতেই পারিনা।আমার চোখের স্পষ্টতা জানো??আমি এক দেখায় বলে দিতে পারি মানুষটা কিরকম!আর সেখানে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কাহিনী বুঝবোনা??এখনই আমি বেলায়েতকে ডাকবো।ডেকে বলবো তোমাদের একসাথে একা বাড়িতে আমি পেয়েছি।এটাই ছিল শেষবার।এবার তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেবার পালা’
———–
সজীব কোলে নিতে চাইছে কিন্তু সারথির কারণে পারছেনা।সে ধমক দিয়ে বলে দিলো তাকে যেন সজীব ছোঁয়ার চেষ্টা না করে।আনাফ সব দেখছিল,একটা সময়ে সারথির মাথা ঘুরে উঠলো,সে শেষবারের মতন মৃদু স্বরে বললো তাকে যেন সজীব না ধরে।
সজীব ওকে দূর্বল হতে দেখে আরও আগলে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু এবার সারথি নিজ থেকেই সরে গেছে।
আনাফের ইচ্ছে করছে সজীবকে সরিয়ে সারথিকে নিজের কাছে নিয়ে আনতে কিন্তু সে পারছেনা।
“একবার যদি সারথি বলতো সে আমায় চেনে তাহলে এই অধিকারবোধটা দেখাতে আমার সময় নিতে হতোনা।”
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৬
#আফনান_লারা
________
আজিজ খান মস্ত বড় নাছোড়বান্দা লোক।ফারাজ আর পূর্ণতাকে কথা দিয়ে আটকে রেখেছেন।পারছেননা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়েটা পরিয়ে দিতে।বারবার তিনি বেলায়েত হোসেনকে স্মরণ করছিলেন।একবার যদি দেখা পাইতেন তাহলে হাতেনাতে দেখিয়ে দিতে পারতেন।কিন্তু এদের একা রেখে গেলেই এরা দুজন দুদিকে পালাবে, এমনও হতে পারে তাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করলো।
মনে মনে ভাবছিলেন কি করে সাপ ও মরবে,লাঠিও ভাঙ্গবেনা।
ফারাজ পূর্ণাকে ইশারা করে বলতে চাইছিল তাদের দৌড় দেয়া উচিত।
আজিজ খানের চোখে ধুলা দেয়া সহজ কথা না।কিন্তু এখন পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওদের দুজনের কাছে।
এক দুই তিন বলে দুজনেই ঝড়ের গতিতে দৌড় দিয়ে দিছে।আজিজ খান সেসময় চশমা খুলে গায়ের শার্ট দিয়ে পরিষ্কার করছিলেন।চশমাটা পরে দেখলেন সামনে ফারাজ পূর্ণতা দুজনের একজনও নেই।কেমন বোকা বানিয়ে দিলো তাকে।রেগে মেগে তিনি চললেন বেলায়েত হোসেনের কাছে।কড়া করে বিচার বসাবেন।
ওদিকে ফারাজ আর পূর্ণতা ছুটতে ছুটতে ছাদে চলে এসেছে।সেখানে এসে চিলেকোঠার দরজা লাগিয়ে দুজনে ধপ করে নিচে বসে গেলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
শেষে দুজনে একত্র হয়ে হেসে ফেললো।হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার মতন অবস্থা। ফারাজ পূর্ণাকে হাসতে দেখে বললো,’জানেন হাসলে আপনাকে কেমন লাগে?’
‘জানি,অসম্ভব সুন্দরী। ক্লাস সেভেনে থাকতে একটা ছেলে কথাটি আমায় বলেছিল।সে কাদায় পিছলে পড়ে যাওয়ায় আমি খুব হেসেছিলাম।তখন সে কাদায় মেখে থেকে এই কথাটা বলেছে।ছেলেটির নাম ছিল ‘অজিত দাস’ আমার বাবার বন্ধুর ছেলে।আমার জন্য খুব পাগল ছিল।কতবার যে ফুলের মালা এনে দিতো।কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেলো!!তার বাবার অফিসের বদলি হয়ে যাওয়ায় সে অনেকদূর চলে গেলো এরপর আর খবর জানিনা’
‘ছেলেটি লাইন মারতে চেয়েছিল বলেই এত বড় মিথ্যা বলেছে।আসলে কিন্তু আপনার হাসি দেখতে ডাইনির মতন।যেন এক ডাইনি হাসছে’
‘আপনি যে আমায় সহ্য করতে পারেননা তা জানি আমি।তাই গায়ে মাখলাম না কথাটা’
‘সহ্য করবেন কি করে?সত্যি কথা তো টক হয়’
পূর্ণতা গেলো রেগে।উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে বললো,’আমি কম সুন্দরী হতে পারি কিন্তু অতোটাও খারাপ দেখতে না।আমার পেছনে অনেক ছেলে পড়ে থাকতো’
‘মরে?’
‘আপনি এমন করে কথা বলছেন কেন?আপনার ভুটকি বিবাহিত গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আমি কিছু বলতাম?তাহলে আপনার কোনো রাইট নাই আমাকে নিয়ে কিছু বলার।’
—-
আজিজ খান সব বেলায়েত হোসেনের কানে তুলেছেন।সব শুনে তিনি অর্ককে দিয়ে ফারাজকে ডেকে পাঠিয়ে নিজের পাশে বসিয়ে রাখলেন।কোনো কিছু বললেন না করলেন ও না।
———–
সজীব অতিরিক্ত করছিল।সারথিকে সে সাথে নিয়েই যাবে এটা তার শেষ কথা।এদিকে সারথি কথা বলার শক্তি টুকু পাচ্ছিল না,আস্তে আস্তে শুধু বলে যাচ্ছে সে সজীবের সাথে যাবেনা।একটা সময়ে সজীব রেগে বললো বাইরের মানুষের সামনে সারথি এরকম কেন করছে।
সারথি হাত ছাড়িয়ে যেদিকে পথ পেলো সেদিকে ছুটলো। আনাফ চুপ করে সব দেখছিল।সারথি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে বলে সজীব রাগ দেখিয়ে ওর সামনে এসে পথ আটকে হাতটা খুব শক্ত করে ধরে বললো,’আমি এখন যেটা বলবো সেটাই হবে,এবং তোমাকে সেটা শুনতে হবে’
আনাফের সামনে দিয়ে সজীব সারথিকে নিয়ে গেছে।আনাফ না পারলো কিছু বলতে আর না পারলো কিছু করতে।চুপ করে দেখা ছাড়া তার আর কিছু করার ছিলনা।
বাড়ির গেইট অবধি এসেই সারথি নিজে নিজে মাটিতে বসে গেছে।কাঁদো স্বরে আরও একবার বললো সে যাবেনা,একা থাকতে চায়’
সজীব এবার ওর হাত ছেড়ে দিয়েছে।যেহেতু সারথি একেবারেই চায়না ফিরতে সেহেতু সে আর জোর করবেনা।ওর যেভাবে থাকতে চায় থাকুক ভেবে সজীব একাই গেট দিয়ে চলে গেলো। সারথি সেই আবার আগের জায়গায় ফিরছে।
ছুটতে ছুটতে এবার নিজের সব শক্তি দিয়ে আনাফের নাম ধরে ডাকে সারথি।
আনাফ সেসময় গাড়ীতে ঢুকছিল।সারথির ডাক শুনে থেমে মাথা তুলে চেয়ে দেখলো সারথি এদিকেই আসছে,এদিক সেদিক ফিরে বারবার আনাফের নাম নিচ্ছে।একেবারে এদিকটায় এসে আনাফের গায়ের গন্ধটা তীব্র মনে হলো ওর কাছে তখনই সে নাম ধরে ডাকা থামিয়ে দেয়।
আনাফ মুচকি হেসে বলে,’এতক্ষণে আনাফের কথা মনে হলো?’
‘আগেও ছিল।’
‘গিয়ে আবার ফিরে আসার কারণ কি?’
‘আমি চাইনা ওখানে থাকতে,তাই ফিরলাম’
‘আর আমাকে কেন ডাকছিলেন শুনি?’
‘কোলে নিতে হবেনা,এমনিতেই নিয়ে যান।যেখানে সজীব নামের পুরুষটার কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা,আমার পরিবার তার পরিবারের কেউ থাকবেনা। যেখানে আমি স্বস্তিতে দম ফেলতে পারবো, সেই জায়গায় যেতে চাই।নিয়ে যাবেন?’
আনাফ সারথির হাত ধরতে গিয়েও ধরলো না।একবার জানতে চাইলো ধরবে কিনা।সারথি হাতটা বাড়িয়ে ধরে তখনই।আনাফ ওর হাত ধরে গাড়ীর কাছে এনে থামে।সারথি নিজে নিজে গাড়ীতে বসলো এবার।
আনাফ ও নিজের সিটে বসে একটু ঝুঁকে সারথিকে সিট বেল্টটা লাগিয়ে দিলো।
একটা গান প্লে করে সে গাড়ী ঘুরিয়ে অন্য পথে চলছে।গানটা ছিল তামিলের একটা গান।লিরিক্স বোঝা না গেলোও সুরে খুব ভাল লাগছিল শুনতে,যেনো আমাদেরই দেশের চেনাপরিচিত একটি গান। খুব সহজ কিছু বলছে কিন্তু ভাষা অজানা বলে বোঝা গেলোনা।
গানটা মূহুর্তটাকে খুব সুন্দর করে ফেলছিল।এটাই হয়ত সারথির বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।রাগ করে সে বলে দিলো গানটা বন্ধ করতে।
আনাফ কথাটা শুনেছে কিন্তু কাজটা করে নাই,বরং সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো।
সারথি এবার প্রচণ্ড রকম ভাবে রেগে গেলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’কি বললাম শুনতে পারছেন না?গানটা বন্ধ করেন’
‘আপনার ইচ্ছা করেনা ভাল মূহুর্ত কাটাতে?’
‘আমার কাছে ভাল মূহুর্ত মানেই গান শোনা না।আরও অনেক কিছু আছে যেটা দিয়ে মূহুর্তটাকে সুন্দর করা যায়’
‘যেমন?’
‘যেমন নিজের গলায় গান গাইলে মূহুর্তটা একটু বেশি সুন্দর হয়ে যায়।এখন বলবেন না যে আমি গাইতাম।আমাকে দিয়ে গান হয়না।ফারাজ খুব ভাল গান করে কিন্তু আমি ওর মতন হইনি।আমার গানের গলা বাজে’
‘আমি গাই?’
‘নাহ।আপনার যে কন্ঠ,আমার মনে হয় গান গাইলে গাড়ীর পার্টস খুলে পড়ে যাবে’
আনাফ মুখ বাঁকিয়ে গাড়ীটা একটু স্লো করে গান ধরলো।
গানটা ছিল পুরোনো দিনের।তোমার খোলা হাওয়া গানটি।শুধু চার লাইন গেয়েছিল সে।সারথি কল্পনাও করতে পারেনি এত ভাল শুনাবে।
এতটাই বিভোর হয়ে গেছিলো সে যে আনাফের গান থেমে যেতেই সে বলে উঠলো বাকি লাইনগুলোও যেন সে গায়।আনাফ খুশি হয়ে তাই করলো।পুরো গানটাই শেষ করলো সে।
আনাফ ভাল গান গাইতে পারে অথচ সে কত অপমান করলো এটা নিয়ে ভেবে সারথি লজ্জায় পড়ে গেলো।নিজের মনের ভেতর ছোটখাটো একটা যুদ্ধ করে বলেই ফেললো সে দুঃখিত।আনাফ বিষয়টাকে এতটা সিরিয়াস নেয়নি কিন্তু সারথি সিরিয়াস নিয়েছে দেখে সে হাসলো,তার হাসিটা সারথি জানতেও পারলোনা,দেখতেও পারলোনা।গোপনের হাসি গোপনই রয়ে গেলো।আনাফ কিছু বলছেনা দেখে সারথি বললো,’আমার উচিত হয়নি আপনাকে নিয়ে মজা করা।’
‘হয়েছে!আর বলতে হবেনা।আমরা কোথায় যাচ্ছি বলতে পারেন?দেখি আমার সাথে মিশে আপনার কেমন উন্নতি হলো?’
সারথি অনেক ভেবে বললো,’কোনো রিসোর্ট? ‘
‘নাহ’
‘পার্ক?’
‘নাহ’
‘তবে কি?’
‘এমন একটা জায়গা যেখানে দূর দূরান্তে কেউ থাকবেনা।যেখানে সজীবের দন্ত স থাকবেনা।পরিবারের প থাকবেনা।থাকবে শুধু সারথি আর আনাফ।হতে পারে বিশাল আকারের সেই জায়গা।সাদা ধুসুর রঙে রাঙায়িত।উপর নীল আকাশ আর নিচে ধুসুর রঙের মেলা।বলুন সেটা কি?’
‘নদী’
‘বাহ!ভালই।তাও ক্লু দেয়ার পর বুঝতে পারলেন’
‘আপনার কি মনে হয়না আমি আরও একবার ঝাঁপ দিতে পারি?’
‘হয়।অনেকবার মনে হয় কিন্তু আমি তো আছি তাইনা?আমার সামনে আপনি মরতে পারবেন না।আমি ঠিক বাঁচিয়ে আনবো’
‘কতদিন পারবেন এটা?’
‘যতদিন আছি’
———
সজীবকে গাল ফুলিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ওর মা এসে জানতে চাইলেন সারথি কোথায়।
‘আছে ওর রুমে হয়ত’
‘তাহলে তুই এখানে কি করছিস?যা ওর কাছে’
‘না আসলে!!থাকিনা তোমাদের সাথে।ও রেস্ট নিক’
মায়ের সন্দেহ হলো।সজীবের হাত ধরে সবার থেকে একটু দূরে নিয়ে এসে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কি আসলে।সজীব ধামাচাপা দিয়ে দিচ্ছে তাও মা আরও জোর করছেন জানার জন্য।কারণ তার মনে সন্দেহ জাগলো লেভেনকে নিয়ে।সজীব যে বিয়ের আগে একটা মেয়েকে ভালবাসতো এটা তিনি জানেন।
এবং তার সন্দেহ হয় ঐ মেয়ের সাথে সজীবের এখনও সম্পর্ক আছে কিনা।
সজীব কিছুতেই স্বীকার করে নাই লেভেনের কথা।এটাও বলে নাই সারথি যে বাসাতে নেই।সে ঝামেলা চাইছিল না।
ওদিকে পূর্ণতা দেখে এসেছে রুমে সারথি নেই।সবে সে বাগান থেকে এসেছিল তার মানে সারথি বাসাতেই নেই??এই কথা ফারাজকে জানাতেই হবে।কিন্তু দুই দাদুর চোখে ফাঁকি দিয়ে কি করে সে ফারাজের কাছে কথাটা পৌঁছাবে!!
ফারাজ গিয়ে সবার মাঝে বরাবর বসে আছে।পূর্ণতা অনেক ইশারা করলো কিন্তু সে দেখলোই না।পরে অর্কর রুম থেকে একটা খাতা নিয়ে কাগজ ছিঁড়ে সেটাকে গোল করে চেপে ধরে খোসা বানিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারে পূর্ণ।সেটা গিয়ে পড়েছে একেবারে ফারাজের কপাল বরাবর। এটা দেখে ফেলেছেন জনাব বেলায়েত হোসেন।ফারাজ কাগজ খুলে কিছু না দেখে সেটা ফেলে সামনে চেয়ে দেখলো পূর্ণতা হাত দিয়ে ওকে ডাকছে বাড়ির ভেতের আসার জন্য।
ফারাজ উঠে সেদিকেই গেলো ওমনি পিছু পিছু আসছেন বেলায়েত হোসেন,সাথে তিনি আজিজ খানকেও ইশারা ইঙ্গিতে নিজের সাথে আসতে বললেন।
ফারাজ বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে।তা নাহলে পূর্ণতা ওকে ডাকার মেয়ে না।এর পেছনে যথাযথ কারণ আছে।
তাই সে দ্রুত গেলো ঐদিকে।
চলবে♥