দোটানা ২ পর্ব-০৮

0
554

#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_০৮

আয়ান একটি লোক পাঠালো কিন্তু লোকটা সেখানে গিয়ে আরুশিকে না পেয়ে ফিরে এলো।খবরটা আয়ানের মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে পরক্ষণেই নিজে বেড়োলো আরুশির খোঁজে।

না জানি এই মেয়েটা কোথায় আছে।আজ যদি আমার জন্য ওর কিছু হয়ে যায় তবে নিজেকে কি পারবো ক্ষমা করতে।হ্যাঁ আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই।ওকে ওর অবস্থান দেখিয়ে দিতে চাই কিন্তু আমি কখনো ওর প্রাণ নিতে বা ওর বড় কোনো সর্বনাশ করার কথা ভাবতেও পারি না।না জানি কোথায় আছে।
আয়ান এলো সেই স্থানে তবে আরুশি নেই সেখানে।

ও মাই গড।এই মেয়েটা কোথায় গেলো?ওর কোনো ক্ষতি হলো না তো।না ওকে আমার খোঁজতে হবে।

এদিকে আরুশি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আয়ানকে দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে।

এখন কেমন লাগে মি.স্যার।খোঁজেন খোঁজেন।সারাদিন অনেক রোদে দাড় করিয়েছেন, এখন রাতের অন্ধকারে দৌড়ে দৌড়ে খোঁজেন আমায়।উফ এই মশাগুলো আমাকে না আবার উঠিয়ে নিয়ে যায়।বাবাগো কি কামড়াচ্ছে।

আরুশি। আরুশি।কোথায় তুমি।আরুশি।

আয়ান চারিদিকে অনেকটা অস্থির হয়ে আরুশিকে খোঁজছে।আরুশি মশা মারছে আর হাসছে।আরুশি জানতো ও যদি ফোন না ধরে আর লুকিয়ে যায় তখন আয়ান ওকে ঠিকই খোঁজতে আসবে বাড়ি গিয়ে জবাবদিহি করার ভয়ে।সুযোগটা আয়ানকে পেরেশান করার কাজে কিভাবে না লাগাতো।আয়ান হঠাৎ ঝোপের দিকে আসতেই আরুশি ভঙ্গি ধরে সেখানে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকার ভান করলো।আয়ান অনেকটা অস্থির হয়ে ওর পাশে এসে ওর গালে হাত দিয়ে ওকে ডাকতে লাগলো।

আরুশি।এই আরুশি কি হয়েছে তোমার?আরুশি কথা বলো।ও মাই গড এর তো জ্ঞান নেই।কি হয়ে গেলো ওর!আয়ান আর কোনোদিক না ভেবে আরুশিকে পাজকোলে তুলে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে উঠালো।ওর মুখে পানি দিলো তবে তার জ্ঞান ফিরার কোনো খবর নাই।আয়ান পেরেশান হয়ে ডাকছে।তার অনুশোচনা হচ্ছে এবার,আজ ওর জন্য আরুশির না জানি কি হয়ে গেলো।

না এভাবে এখানে বসে থাকলে হবে না।আমি বরং আরুশিকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।

আয়ান হাসপাতালের উদ্দেশ্য গাড়ি ছাড়বে তখনি আরুশি হু হু করে হেসে উঠে বসলো।আয়ান বাকরুদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে।

কি হলো মি.স্যার।বানালাম না বোকা।

ইউ স্টুপিড গার্ল, তুমি এসব নাটক করছিলে?জানো আমি কতো ভয় পেয়ে গেছিলাম? রাগে আরুশির বাজু চেপে ধরে বললো আয়ান।

আপনি ভিতু আমি অনেক আগে থেকে জানতাম।আয়ানকে ঝাটকা দিয়ে ছাড়িয়ে মুখ বাকিয়ে বললো আরুশি।

কি আমি ভিতু।সস্তা মেয়ে এক্ষুনি নামো আমার গাড়ি থেকে।তোমাকে ওই রাস্তায় ভালো মানায়।

হুহ।আমি নিজে থেকে আপনার গাড়িতে চড়ি নি।আপনি নিজে কেনো আমাকে চড়াতে গেলেন এতোই যখন দামী কার আপনার?যান যান আপনার কার নিয়ে আমারও শখ নাই আপনার কারে চড়ার।

কথাটা বলে নেমে গেলো আরুশি।
আয়ান গাড়ি ছেড়ে দিলো,কিন্তু অল্প জায়গা গিয়ে থেমে গেলো।

আরে না এই স্টুপিডকে একা ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না।এতো রাতে এই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়িও আসবে না।ধূর ইচ্ছে না থাকলেও ওকে নিয়েই যেতে হবে এবার।
কথাটা ভেবে আরুশির পাশে গেলো গাড়ি নিয়ে আয়ান,আরুশি মনের সুখে গুটিশুটি পা ফেলে হাটছে,গাড়ি থামিয়ে বললো আয়ান।

এই সস্তা মেয়ে আসো গাড়িতে আমার সাথে যাবে।আরুশি যেনো কথাটা শুনলোই না সে তার মতো হাঁটছে।

এই মেয়ে শুনো না?আরুশির এবারও কোনো উত্তর নেই।আয়ান এবার অনেকটা তেজি কন্ঠে বললো।

ওই সস্তা মেয়ে শুনতে পাও না কি বলছি?

আমার নাম সস্তা মেয়ে না।আমার সুন্দর একটা নাম আছে ওটা বলে ডাকেন।

অসহ্য সস্তা মেয়েটা আমার ভালো মানুষির সুযোগ উঠাচ্ছে। দেখে নিবো সস্তা মেয়ে তোমায়।
ওই মিস আরুশি আসো গাড়িতে আমি তোমায় নিয়ে যাবো।

আরুশি এবার হাটা থামিয়ে আলতো হেসে পিছন তাকিয়ে বললো।ভালো মতে গাড়ি থেকে নামেন তারপর ভদ্রভাবে গাড়ির দরজাটা খুলে বলেন। প্লিজ আরুশি গাড়িতে উঠো আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।

হোয়াট?তোমাকে আমি রিকুয়েষ্ট করে গাড়িতে উঠাবো।নো ওয়ে আয়ান চৌধুরীর এতো খারাপ দিন আসে নি যে তোমার মতো রাস্তার মেয়েকে রিকুয়েষ্ট করে গাড়িতে উঠাবে সে।

ওকে ঠিক আছে তবে খোঁজতে থাকেন আমায়।

বলেই আরুশি আবারও ভৌ-দৌড় দিলো।আয়ান আশ্চর্যের সাথে বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামলো আরুশি আসে পাশে কোথাও নেই উদাও মুহুর্তেই।

ওই মেয়ে আমাকে কেনো বিরক্ত করছো তুমি?কোথায় গেছো বের হও।ধরতে পারলে তোমাকে ছাড়বো না।

আরুশি আবারও লুকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।আয়ান ওকে চারপাশে খুঁজছে তবে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না।এখন ইচ্ছে করছে নিজের চুল ওর নিজেই টেনে ছিড়তে।

ইশ কেনো যে একে এখানে পাঠাতে গেলাম,আমাকে সুখে থাকতে ভুত ঘুষি দিচ্ছিলো।মাথা চাপড়ে বললো আয়ান।

ওকে অনেক হয়েছে বের হও আরুশি।ওকে ফাইন প্লিজ মিস আরুশি চলো আমার সাথে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।গাড়ির দরজা খুলে দাঁত কটমট করে বললো আয়ান।আরুশি কোথা থেকে দৌড়ে এসেই গাড়িতে চড়লো।

এইতো ভালো ছেলে।ঠিক মতো কথা শুনলে এতোসময়ে বাড়ি পৌঁছে যেতাম এবার চলুন।

আয়ান আর কিছু না বলে অনেক কষ্টে রাগ দমিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলো।
_______________

বারান্দার দোলনায় বসে নিহানের বুকে মাথা রেখে আকাশের তারা দেখতে ব্যস্ত নিধী।ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো নিহান।

আরুশিকে ঠিক আমাদের আরুর মতো দেখতে লাগে তাই না।বড় হলে হয়তো ওর মতোই হতো।

নিধী মাথা তুলে নিহানের দিকে তাকিয়ে বললো।

তুমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো নিহান।আরুশি শুধু দেখতে আমাদের আরুশির মতো না।ওর স্বাভাবগুলোও আমাদের আরুশিরই মতো।আর বড় কথা হলো আমাদের আরুশির মতো ওরও শ্বাসকষ্টের সমস্যা।তোমার কি মনে হয় না ও আমাদের আরুশি হতে পারে।চলো না ওর সাথে আমাদের ডিএনএ টেস্ট করিয়ে নেই।

নিধীর দুই গাল নিহান নিজের দুই হাতের মাঝে আবদ্ধ করে বললো।আরুশির মতো হলেও ও আমাদের আরুশি না এটাই সত্য।ও তো নিজে থেকেই ওর সব পরিচয় আমাদের বলেছে।ও ছুটোবেলা থেকেই একটা গ্রামে বড় হয়েছে।যে গ্রামে আমাদের কেউ কখনো যায় নি বা থাকেও নি।ও মাত্র এখানে এসেছে এখন হুট করে আমরা যদি বলি ওর সাথে ডিএনএ টেস্ট করাবো বিষয়টা কেমন দেখাবে না?কয়েকদিন যাক যদি আমারও এমন কিছু মনে হয় তবে ডিএনএ টেস্টের কথা ভাবা যাবে।

কথাগুলো কানে যেতেই নিধীর চোখ দিয়ে আবার জল গড়ালো।নিহান তা মুছলো পরম যত্নে,অতঃপর নিধীর কপালে নিজের অধর ছুঁইয়ে ওকে বুকে টেনে নিলো আর শান্তনার স্বরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।

আমাদের আরুশি একদিন ফিরবে দেখে নিও।

সায়ান মনে মনে অনেক কিছু ভেবে নিয়েছে আরুশিকে কিভাবে তার প্রাপ্য সাজা দিবে। এবার আর ওকে প্রাণে মারবে না, মনে ক্ষত দিয়ে বেঁচে থাকা মুশকিল করবে।

জানালা খুলেন আমার বাতাস চাই।

এসি আছে তো।

আমার এসি চাই না,প্রাকৃতিক বাতাস চাই। খুলেন ওটা।

খুলবে না ওটা।

আরে খুলেন না।

আয়ান কিছু বললো না।ড্রাইবিং এ মন মাতিয়ে রেখেছে।আরুশির কথা যেনো কানে যায় নি।

কি হলো খুলেন আমার কথা কানে যাচ্ছে না?

আয়ান এখনও নিশ্চুপ।

আমার বমি পাচ্ছে। ওয়ে ওয়ে।আয়ানের উপর বমি করার ভান করে।

ছিঃ ছিঃ লোংরা মেয়ে।

বলেই আয়ান জানালা খুলে গাড়ি দার করালো।

যাও নেমে গিয়ে বমি করে আসো।

না নেমে বমি করতে হবে না।জানালা খোলা থাকলে আর বমি আসবে না।

তো এটা জানালা খোলার ধান্দা ছিলো!এসব ধান্দা কোথা থেকে আসে মাথায়!বিরক্ত হয়ে বললো আয়ান।

সেটা আপনার জানা লাগবে না।আপনি যেমন ভুতুম পেঁচার মতো মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তেমনই চালান।

কি আমি ভুতুম পেঁচা?

না ওরও নানু।হু হু।

না জানি আজ কার মুখ দেখে এসেছিলাম যে এর চক্করে পরতে হয়েছে।

অসীম বিরক্তি নিয়ে আবারও ড্রাইব করতে লাগলো আয়ান।

একটু পথ যেতে না যেতেই।থামান বলে চিৎকার করে উঠলো আরুশি আয়ান হতভম্ব হয়ে গাড়ি থামালো।আয়ান কিছু জিজ্ঞেস করবে এর আগেই দরজা খুলে আরুশি দৌঁড় দিলো।

এই মেয়ে কোথায় যাচ্ছো কথা শুনো এই মেয়ে।

কে শুনে কার কথা।আরুশি দৌঁড় দিয়ে গিয়ে ফুচকার দোকানের সামনে থামলো।তারপর ফুচকা নিয়ে একের পর এক গিলতে শুরু করলো।আয়ান এগিয়ে গেলো।নাক মুখ কুচকে।

ছিঃ এসব ময়লা জায়গায় দাঁড়িয়ে রাস্তার খাবার খাচ্ছো কেমনে? বাড়িতে চলো ভালো খাবার পাবে।

আপনাকে কে বলেছে আমার সাথে ময়লা জায়গায় ঘোরাফিরা করতে।যান যান আপনি গিয়ে বাড়ির ভালো খাবার খান। আমার খিদে পেয়েছে আর আমি এসবই খেয়ে আসবো।জলদি এসো আমি অপেক্ষা করতে পারবো না কথাটা বলে রেগেমেখে গাড়িতে গিয়ে বসলো আয়ান।

আরুশি মন ভরে ফুচকা খাচ্ছে। আয়ান প্রথমে ওর দিকে তাকাচ্ছিলো না কিন্তু হঠাৎ প্রবল বেগে হাওয়া বইতে শুরু হয়,যাতে আরুশির উন্মুক্ত চুল মুক্ত বিহঙ্গে উড়তে শুরু করে।আয়ানের চোখ পরে আরুশির উপর,আটকে যায় সেখানেই।যেনো সেই ছুট্টো আরুশিকে দেখছে সে।যার বসবাস তার হৃদয়ে।সেই চোখ, সেই মুখ,সেই হাসি।সেই চঞ্চলতা। যেনো ঠিক তার আরুশি।চোখ সরাতেই মন চাইছে না সেই রূপসী রমণীর উপর থেকে।মনের ভিতর এক আচমকা অনুভুতি খেলা করতে শুরু করলো আয়ানের।হঠাৎই আরুশির কথায় ধ্যান ভাঙে তার।

এই যে মি.স্যার কোথায় হারালেন?

এতো চেঁচাও কেনো তুমি?চলো গাড়িতে উঠো।

এতো স্বাভাবিক ডাক যদি কারো কানে না যায় তবে কেউ চেঁচাবে নয়তো কি করবে।হুহ।যত্তসব।

অতঃপর গাড়িতে উঠে গেলো আরুশি।
_____________________

সায়ান ক্লাবে বসে ড্রিংক করছে তার কোলে বসে আছে সুইটি।তখনি পাশের চেয়ারে এসে বসলো মিরাজ। ড্রিংক করতে করতে বলতে লাগলো।

আরে ইয়ার সায়ান। ওই তোর একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো না।কি নাম যেনো ওর?ও হ্যাঁ মনে পরেছে আরুশি।কি হলো রে মালটার?

আরুশিকে মাল বলেছে অন্য ছেলে কথাটা শুনে কেনো যেনো বড্ড খারাপ লাগলো সায়ানের। কপাল কুঁচকে বললো সায়ান।

ওকে দিয়ে তুই কি করবি?

আরে ব্রো তুই তো আর কোনো মালের সাথে বেশিদিন থাকিস না।ওরও কাম তামাম করে ছেড়ে দিয়েছিস হয়তো।কিন্তু মালটা সেই।একটু আমারও তো খেতে মন চায়।সেটিং করে দিবি।

মিরাজের বলা কথাগুলো শ্রবণইন্দ্রিয় অতিক্রম করতেই রাগে গা ঝলসে যাবে এমন হাল হলো সায়ানের।সহ্য করতে পারলো না।হুট করে উঠে মিরাজের নাক বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো,আচমকা উঠায় সুইটি ওর কোল থেকে ছিটকে পরলো আর ঘুষির তেজে মিরাজ চেয়ার থেকে নিচে গিয়ে উল্টে পরলো।

গর্জে বললো সায়ান।

আরুশি কোনো মাল না।না তো কোনো ভোগপণ্য। তাই সামনে থেকে তোকে ওর দিকে যেনো চোখ তুলেও তাকাতে না দেখি নয়তো চোখ উপড়ে ফেলবো।

কথাগুলো বলে হন হন করে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো সায়ান।সেখানে উপস্থিত সবাই হতবাক সায়ানের এহেন কান্ডে,আরুশিকে নিয়ে সায়ানের চেহারায় জেলাসি আর অধিকারত্ব স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারলো সুইটি আর রিফাত।কোনো মেয়েকে নিয়ে কখনো পজেজিব হয় নি সায়ান।তার সাথে যেসব মেয়ের সম্পর্ক তাদের সাথে আরো অনেক ছেলের মেলামেশা যা জানা থাকা সত্ত্বেও কখনো কারো এমন বিষয় নিয়ে কিছু যায় আসে নি সায়ানের আর আজ আরুশিকে নিয়ে সামান্য এসব কথা অন্য ছেলের মুখে শুনে মেনে নিতে পারলো না সায়ান।বিষয়টি সুইটির মোটেও সুবিদার মনে হলো না।এদিকে ঘুষিটার প্রবল তেজে মিরাজের নাক দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে এলো,মিরাজ তা মুছে নিয়ে আগুন চোখে তাকিয়ে রইলো সায়ানের যাওয়ার পানে।

সায়ান জানে না কেনো সে এমন অদ্ভুত আচরন করলো।কেনো আরুশিকে নিয়ে এমন কথা অন্য ছেলের মুখে শুনে তার খারাপ লাগলো।না সে তা জানে আর না সে তা জানতে চায়।সায়ানের তো শুধু তার প্রতিশোধ চাই যা ও নিয়ে ছাড়বে।

চলবে……….