প্রেমতরী পর্ব-১২

0
299

#প্রেমতরী
পর্ব :- ১২
.
–এদিকে আসবি?
–কেনো?
–একটু জড়িয়ে ধরতাম।
–এহ, সখ কত, আসবো না।
–একটু আগে নিশি আমাকে ডাকছিলো, আমি একটু আসি।
ওমনি মিষ্টি এসে মামুনকে জড়িয়ে ধরে।
–বাপরে, যেনো আমি হারিয়ে যাচ্ছি, এতো জোরে কেউ জড়িয়ে ধরে?
–তুই কোনো মেয়ের সাথে কথা বলবি না। তোর যত কথা সব আমার সাথে বলবি, আমি শুনবো সব।
–আমি কোন মেয়ের সাথে কথা বলি হ্যা?
–নিশির সাথে কেনো বলিস?
–ও আমাদের ফুফাতো বোন। ওর সাথে বললে কি হয়?
–না, বলবি না। ওকে আমার সহ্য হয় না।
–কেনো?
–ছোটবেলা থেকেই ও আমার জিনিসে ভাগ বসিয়ে এসেছে। তাই ওকে আমার একদম সহ্য হয় না। যদি আবার তোর দিকে হাত বাড়ায়।
–পাগল হয়ে গেলি? আমি বিবাহিত, আমার দিকে কেনো হাত বাড়াবে?
–তুই জানিস না, এখনকার ছেলে মেয়েরা বিবাহিতদের দিকেই বেশি হাত বাড়ায়, পরিস্থিতি ভালো না।
–আমার বউই আমার সব, যতদিন বেচে থাকবো, ততদিন মিষ্টির বর হয়েই থাকবো। আপনাকে আর ভয় পেতে হবে না।
–আমার জামাইটা কত্ত ভালো। একটা কথা শুনবি আমার?
–কি কথা?
–বাড়ি চল।
–২ দিন হল মাত্র, ১ সপ্তাহ থাকবো বলে আসলাম।
–জেঠিমাকে খুব মিস করছি, চল না।
–ফোনে কথা বলে নে না।
–না,আমি বাড়ি যাবো।
–কাল যাই?
–না, আজই।
–কি বলে মেয়েটা, দাদু বকবে।
–বকবে না, আমি বলে দিবো।
–তোর বলা লাগবে না, আমি বলে আসতেছি, কাপড় গোছা।
–জলদি আয়।.
মামুন ফুফুর কাছে আসে বিদায় নেওয়ার জন্য, কিন্তু কেউ বিদায় দিতে রাজি হয় না।
অনেক কষ্টে সবাইকে রাজি করায়,
এদিকে মামুনের দাদু বলে বসে সেও মামুনের সাথে নিজের বাড়িতে যাবে।
হঠ্যাৎ কোথা থেকে নিশিও এসে বায়না করে বসে, সে নানু বাড়ি বেড়াতে যাবে।
মামুন তাদের কাপড় গোছাতে বলে মিষ্টির কাছে ফিরে আসে।
–কিরে? ফুফু আর দাদু রাজি হলো?
–হুম, কিন্তু দাদুও আমাদের সাথে বাড়ি যাবে।
–তাই? তাহলেতো ভালোই, মজা হবে।
–কিন্তু…….
–কিন্তু কি?
–নিশিও যাবে বলতেছে।
–দেখেছিস, আমি তোকে বলেছিলাম না ওর কোনো একটা মতলব আছে।
–ধুর, কিসব বলিস। এমন কিছুই না।
–তাহলে আমাদের সাথে কেনো যাবে?
–ওর নানুর বাড়ি, ও যেতে পারে না?
–আমি ওতো কিছু জানি না বাবা, মেয়েটা আমার আশেপাশে না থাকলেই হয়।
–পাগলী একটা, চল।
.
মিষ্টি বাড়ি ফিরেই দৌড়ে গিয়ে জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
–কিরে মা, চলে এলি যে? আরো কয়দিন থেকে আসতে পারতি না?
–জানো, তোমায় কত মিস করছিলাম। ও বাড়িতে আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না।
–আমিও তো আমার মেয়েটাকে মিস করছি। ঘরটা কেমন যেনো ফাকা ফাকা লাগছিলো।
–তাই বুঝি?
–হুম।
–আম্মাজান, আপনার একটা ছেলেও আছে, তারে কি একটুও মনে পড়ে নাই?(মামুন)
–ধুর হতচ্ছারা, যা ভেতরে যা।
–আরে দেখো না, আমাদের সাথে কে কে আসছে।
শাশুড়িকে দেখে মামুনের মা গিয়ে সালাম করে। পেছন থেকে নিশি এসে মামুনের মাকে সালাম করে।
–ওমা, নিশিও তো এসেছে। কেমন আছিস নিশি?
–আমি তো ভালো আছি, তুমি আর মামা আমাদের বাড়িতে গেলে না। তাই তোমাদের দেখতে আমিই চলে আসছি।
–খুব ভালো করেছিস, আয় ভেতরে আয়।
এই দুইদিন বাড়িটা কেমন যেনো থমথমে হয়ে গেছিলো।
আজ যেনো বাড়িটার মধ্যে আবার প্রান এলো।
জেঠিমা আজ খুব খুশি, মিষ্টি নিজেকে আবার আগের রুপে ফিরিয়ে এনেছে, সবার সাথে কথা বলছে, নিজের সংসারটা আবার বুঝে নিয়েছে।
এমনিতেই মিষ্টি এই বাড়ির সবার চোখের মনি, মিষ্টির এমন পরিবর্তনে সবারই খুব কষ্ট হয়েছিলো।
ওরই বা কি দোষ, মেয়েটার ওপর দিয়ে কি কম ধকল গেছে?
একদিনের ব্যবধানে নিজের গর্ভের সন্তান, এরপর বাবা এবং শেষে মা, সবাইকেই হারিয়েছে মিষ্টি।
এমন পরিস্থিতিতে যে কেউই শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার কথা।
তবুও মিষ্টিকে নিজের চেনা রুপে ফিরে পেয়ে সবাই বেশ খুশি।
.
–মিষ্টি আপু, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।(নিশি)
–কি?(মিষ্টি)
–আমি কি এমন অন্যায় করেছি যে তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করো।
–কি ব্যবহার করলাম আমি?
–আমাকে দেখলেই তোমার মুখটা ওমন হয়ে যায় কেনো? আমাকে জানতেই হবে।
–কাউকে দেখলে আমার মুখ চেইন্জ হয় না, তোর দেখার ভুল।
–আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলো না কেনো? কি করেছি আমি?
–দেখ নিশি, আমার মন মানসিকতা ভালো নেই, পরে কথা বলি আমরা।
–বছরে একবার তোমার সাথে আমার দেখা হয়। জানিনা আমি কি এমন অপরাধ করলাম।
–দেখ, তোর সাথে আমার কোনো সমস্যা নেই। কোনো অপরাধও তুই করিস নি। আমার ভালো লাগছিলো না বিধায় তোর সাথে আমি কথা বলিনি। শুধু তুই কেনো, কারো সাথেই কথা বলার অবস্থায় আমি ছিলাম না।
–সেটা আমি বুঝতে পারছি, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আর কিছু বলবো না। যদি তোমার আমার সাথে কথা বলতে মন চায় তাহলে আমি বলবো, না হয় আগ বাড়িয়ে আমি আর তোমার সাথে কথা বলতে আসবো না।
এই কথা বলেই নিশি উল্টো পথে হাটা দেয়।
–কিরে? নিশির সাথে কি তোর ঝগড়া হয়েছে?(জেঠিমা পেছন থেকে এসে)
–নাতো, ঝগড়া কেনো হবে?
–তাহলে ওর সাথে কথা বলিস না যে?
–কি করবো জেঠিমা? ওকে আমার সহ্য হয় না।
–ও আবার কি করলো?
–সেই ছোটবেলা থেকেই মামুনের পিছে লেগে আছে। মামুনের সাথে ওকে কথা বলতে দেখলে আমার মাথাটা গরম হয়ে যায়। যতবার ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে, ততবারই ও আমার কোনো না কোনো জিনিসে ভাগ বসিয়েছে। কিন্তু এবার আমি সেই সুযোগ ওকে দিবো না। না মামুনকে ওর কাছে যেতে দিবো, না আমি ওর কাছে যাবো।
–দেখো পাগলি মেয়ে কি বলে।
–আমি ঠিকই বলছি, আর যেনো নিশি এই বাড়িতে না আসে।
–ওমা, এটা কেমন কথা?
–যদি আসে তাহলে আমি দেখে নেবো ওকে।
বলেই মিষ্টি হনহন করে নিজের ঘরের দিকে হাটা দেয়।
জেঠিমা ভালে করেই বুঝতে পারে, মিষ্টি মামুনের জন্য কতটা সিরিয়াস।
এরপর মিষ্টির সাথে নিশির আর কোনো কথা হয়নি। এর কিছুদিন পরই নিশি আবার কানাডায় বাবার কাছে চলে যায়।
এদিকে মিষ্টি এই পরিবারে রাজকন্যার মতো হয়ে আছে।
এই পরিবারটা মিষ্টিকে কখনো বাবা মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি।
জেঠু-জেঠিমা মিষ্টিকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসে। আর মামুনতো মিষ্টি ছাড়া কিছুই বোঝে না।
খুব সুখেই দিন কাটছিলো সবার।
এভাবে প্রায় দুইবছর পার হয়ে যায়।
–মিষ্টি, তোরা বাচ্চা নিয়ে কোনো প্ল্যান করেছিস?(দাদু)
–হ্যা দাদু, দেখছি ব্যাপারটা।
–আমি আর কয়দিন বাচবো, আমার বংশের বাতিটা যদি দেখে যেতে পারতাম।
–কিযে বলো না দাদু, আমার বাচ্চার বিয়ে খেয়ে যেতে পারবে তুমি। এত তাড়া কিসের?
–সেটা না হয় বুঝলাম, বাচ্চা নিবি না? অনেক বছরতো হয়ে গেলো।
–নিবো তো। দেখি যত তাড়াতাড়ি নেওয়া যায়।
–হুম।
.
রাতে মামুন কাজ থেকে ফিরে এসে দেখে মিষ্টি মন মরা হয়ে বিছানার এক কোনায় বসে আছে।
–মিষ্টি…
–হ্যা আসতেছি।
–আসতে হবে না, আমিই চলে আসছি।
–যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো, আমি খাবার দিচ্ছি।
–আব্বু আম্মু খেয়েছে?
–হ্যা, ওনারা খেয়ে শুয়ে গেছেন।
–আমার কলিজার কি মন খারাপ?
–নাতো।
–তাহলে মুখটা মলিন হয়ে আছে যে?
–কিছু হয়নি, এমনিতেই।
–কিছুতো হয়েছে। কি হয়েছে বলো।
–আজ দাদু বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করছে। কেনো আমরা বাচ্চা নিচ্ছিনা।
–ওমা, এর জন্য মন খারাপ করতে হয়?
–আমার কি আর বাচ্চা হবে না?
–কি আবোলতাবোল বলতেছো? হবে না কেনো? অবশ্যই হবে।
–আমরা তো সেই কবে থেকে চেষ্টা করছি, কেনো হচ্ছে না?
–পাগলি, আল্লাহ যখন চাইবে, তখনই আমাদের বাচ্চা আসবে। এতো চিন্তা করার কিছু নেই। চলো খুদা লেগেছে।
–বলি কি, একবার ডাক্তারের কাছে গেলে কেমন হয়?
–শুনো, বাচ্চা নিয়ে এত চিন্তা করার কিছু নেই। বাচ্চা হলে হবে, না হলে নেই। আমরা চাইলেই বাচ্চা হবে না।
–আমি কি তাহলে কখনো মা ডাক শুনতে পাবো না?
–পাগলি একটা, এত অধৈর্য হলে হবে? সব হবে আমাদের, চিন্তা করো না তুমি। খাবার দাও, খুদা লেগেছে।
–যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো।
.
ইদানীং মিষ্টি কেমন যেনো আবার মন মরা হয়ে থাকে।
এতদিন কেউ বাচ্চার ব্যাপারে কিছু না বললেও দাদু জিজ্ঞেস করে ফেলেছে।
এবার ধীরেধীরে সবাই জিজ্ঞেস করবে।
–মিষ্টি।
–হ্যা মা.।
(মিষ্টি তার জেঠিমা আর জেঠুকে মা আর বাবা বলে ডাকে, আর মামুনকে তুমি করে বলে)
–কিছু হয়েছে?
–কই নাতো।
–এভাবে গালে হাত দিয়ে মন মরা হয়ে বসে আছিস যে।
–আচ্ছা মা, একটা কথা বলি?
–কি কথা?
–তোমার কি নাতিনাতনির মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না?
–ওমা, করবে না কেনো?
–প্রায় ২ বছর হয়ে গেলো, আমার বাবু হচ্ছে না কেনো?
–পাগলি মেয়ে, এভাবে তো চাইলেই হয় না। আল্লাহর কাছে চা, উনি চাইলে সব হবে।
–বিয়ের ২মাসের মধ্যেই আমার গর্ভে বাবু চলে আসে। আর এখন ২ বছরেও হচ্ছে না, কোনো সমস্যা হয়নি তো?
–আমার মনে হয় না কোনো ডাক্তারি সমস্যা আছে, থাকলে তো আর ১ম সন্তান তোর গর্ভে আসতো না। দেখ মা, বাচ্চা নিয়ে আমাদের এতো তাড়া নেই। আল্লাহর রহমতে এটা আমাদের একটা সুখের সংসার, এই সংসারে আবার কোনো অশান্তি নামুক তা আমি চাই না। বাচ্চা হলে হবে, না হলে নেই। এতে মন খারাপ করার কিছু নেই।
–আমার যে মন খারাপ হয়ে যায়।
–না, একদম মন খারাপ করা চলবে না। তুই তো জানিস, তোর হাসি মুখটা না দেখলে আমরা কেউই ভালো থাকি না। এক কথায় আমাদের খুশির উৎস আমার এই পাগলি মেয়েটা।
মিষ্টির শাশুড়ি মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
মিষ্টিও শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে।
–জানো মা, আমি কখনো ভাবি নি আমার কপালে এত সুখ আছে। নিজের ভুলের জন্য আপন বাবা মাকে হারিয়েছি। তবুও কখনো এই বাবা মায়ের অভাব আমায় বুঝতে দাওনি। আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী তোমাদের পেয়ে।
–দেখো পাগলি মেয়ে কি বলে। তুই তো আমারই মেয়ে। সেই ছোট বেলা থেকে তোকে আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। জানিস, মামুনের জন্মের পর আমরা চেয়েছিলাম আরেকটা সন্তান নিতে, বিশেষ করে তোর জেঠু চেয়েছিলো যেনো একটা মেয়ে হয়। আমাদের আর কোনো সন্তানই হয়নি। কিন্তু মেয়ে হয়নি তো কি হয়েছে, আল্লাহ তো ঠিকই আমাকে একটা মেয়ে দিয়ে দিলো। সেই ছোট থেকেই তুই আমার মেয়ে। তাই বলি কি, এতো অধৈর্য হোস না। আল্লাহ ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।।
–তাই যেনো হয় মা। আমারও তো ইচ্ছা করে মা ডাক শুনতে।
–এত ভাবিস না, আয় রান্না শুরু করতে হবে।
–আচ্ছা চলো।
যেন সব সুখই মিষ্টির জন্য বরাদ্দ ছিলো, শুধু একটা বাবু ছাড়া।
যার জন্য মিষ্টি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায় সময় কান্না করতো।।
.
.
.
চলবে……….
.
লেখক #A_Al_Mamun