ফেইরিটেল পর্ব-৩৬+৩৭ | বাংলা ধারাবাহিক গল্প

0
712
ফেইরিটেল
গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–36

” গ্রান্টেড” শব্দটা নোটে লিখে ওইদিকে পাঠিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইমান পর্দার এপাড়ে চলে আসল। যেন সে অধীর আগ্রহে ওপাশে অনুমতির জন্য অপেক্ষায় ছিল৷ সে হুড়মুড় করে আসায় সামান্য ইতস্তত হয়ে পড়ল মিরা। বেচারি মাত্র শোবার জন্য ওড়নাটা সরিয়ে রেখেছে৷ আজকে ওয়েস্টার্ন ড্রেসেও তার ভারী আনকম্ফোটেবল লাগছিল। এখনোও অস্বস্তি ভর করলো মনের কোণে৷ ইমান অবশ্য তার অস্বস্তি বা ইতস্ততবোধের কারণ ধরতে পারল না৷ বুঝতেও পারেনি। এতো বুঝ তার মধ্যে নেই৷

সে গলার স্বর উচিয়ে জোরে করে বলে, “থ্যাংক ইউ।”

এরপর শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। মিরার পুনরায় হাসি পাচ্ছে। আসলে হাসি এমন একটা ব্যাপার, একবার শুরু হলে থামতেই চায় না৷ ইমানের যে বাইরে কোন কাজ নাই এটা দিব্যি বুঝে ফেলেছে সে। কিছু বাচ্চা আছে, ওদের যদি ডেকে এনে বলা হয়, ” বাবু এই জিনিসটা ধরবা না৷” ব্যাস হলো কাজ। ওরা বেশি বেশি করে সেই জিনিসটা ধরবে। বারং করা হয়েছে বলে৷ ইমানও ওই সব বাবুর মতো। এদিকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে জন্যই, এখানে আসার জন্য তার যতো উতলা! মিরা ডিভানে গা এলিয়ে দিল। আজকে যা ধকল গেছে শরীরের উপর। চোখের নিচে ঘুম আপনা-আপনি ঢলে পড়ছে। জেগে থাকা দায়। মাকে ফোন করতে হবে৷ কিন্তু মনে হচ্ছে আজ আর সম্ভব না। কালকে সকালে মাস্ট কল করা লাগবে৷ ক্ষণে সে নিদ্রা রাজ্যের এক আদুরে সদস্য বনে গেল। ঘুম রাজ্যে প্রবেশ করে সে। তখন রাত বারোটা বাজে৷ ইমান কিছুক্ষণ রুমের বাইরে পায়চারি করে ফিরে আসে। রুমে এসে দেখল মিরা ঘুমাচ্ছে৷ গভীর ঘুম যাকে বলে। চারপাশ নিস্তব্ধতায় ঘেরা৷ পর্দা টেনে দেওয়ার কারণে সে নিজেই নিজের রুম চিনতে সামান্য সময় নিল এরপর মৃদ্যু হাসল মিরার দিকে তাকিয়ে। কালকে তাকে আবার টেক্সাস যেতে হবে তিনদিনের জন্য। রোজ রোজ শহরের বাইরে যাওয়াটা খুব বিরক্তির কারণ হয়ে পড়ছে৷ প্রথমবার ট্রিপের মতো আনন্দ করেছিল। এরপর এখন বাইরে যাওয়ার কথা শুনলেই মেজাজ চটে যায়৷ সারাদিন বাসায় বসে থাকতে ইচ্ছা করে৷

সে মিরার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই মুখমণ্ডলটা এতো নিষ্পাপ কেন? হুয়াই? দুমিনিট তার দিকে তাকিয়ে থেকে সে ডিভানের সামনে গিয়ে বেশ সাবধানে মিরাকে কোলে তুলে নিল৷ এরপর বেডে এসে আস্তে করে একপাশে শুইয়ে দিল৷ নরম তুলতুলে কম্বলটা গায়ে মুড়িয়ে দিল। বীনা শব্দ করে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে বেশ জোরে জোরে বাতাস বইছে। বৃষ্টির পূর্বাভাস। ইমানের একটা অদ্ভূত ক্ষমতা আছে। বৃষ্টি হওয়ার আগ মুহুর্তে বুঝে যায় বৃষ্টি পড়বে৷ যতোবারই মনে হয় বৃষ্টি পড়বে তার কিছুক্ষণ পর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামে৷ সিগারেট ধরিয়ে সে মনে মনে দোয়া করে যেন কালকে এতো বৃষ্টি হোক যে প্রাকৃতিক বিপর্যায়ের কারণে তাদের যাওয়া পিছাক বা ক্যান্সেল হোক৷ তার নিজেরও দুচোখে ঘুম নেমে আসলো। সকালে উঠেছে৷ আর ঘুমানো হয়নি৷ সে রুমে এসে বিছানার একপাশে এসে শুয়ে পরে। এরপর মিরার দিকে ঘুরে শুলো। দুইজন এই প্রথম একসঙ্গে ঘুমাচ্ছে কী? মনে আসছে না ইমানের। এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু তার মনে আসছে না? এতো মনভুলো কবে থেকে হলো সে?

সকালের স্নিগ্ধ আলো যখন নিউইয়র্কের বুকে ফুটতে শুরু করলো ঠিক ওই বেলায় মিরার ঘুম ভাঙ্গে। নিজেকে সে নরম তুলতুলে কম্বলের নিচে অনুভব করে। সঙ্গে আরো একটা বিষয় সে অনুভব করছে৷ কারো গরম নিশ্বাস তার গলায় এসে লাগছে। সে পিটপিট করে নেত্রপল্লব মেলে ধরতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বেডে শুয়ে আছে সে। শুধু তাই নয়, ইমানের গায়ে নিজের একটা পা তুলে দিয়েছে। সে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে৷ ইশ কী অবস্থা! সে কী আবারো স্লিপ ওয়াক করে নিজের বর্ডার লাইন ক্রস করে ইমানের সাইডে চলে এসেছে? ওহ নো! তাহলে তো মসিবত! ইমান কী জানে সে এখানে ঘুমের মধ্যে চলে এসেছে? দ্রুত ইমানের পানে তাকালো। নাহ! ও বড্ড আরামদায়ক এক ঘুমে আচ্ছন্ন। এমন ঘুমের মধ্যে টের পাওয়ার কথা৷ মিরা কম্বল সরিয়ে উঠে আসবে৷ তখনই ইমানের কণ্ঠ ভেসে আসে। সে ইতস্তত করে ঘার ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল, ইমান ঘুমের মধ্যে হাত ছোড়াছুড়ি করতে করতে কথা বলছে৷ অস্পষ্ট, জোড়ালো কথা৷ ঘুমের মধ্যে কেউ কথা বলে এটা মিরার জানা ছিল না৷ কিন্তু ইমানকে সে আগেও একটা ঘুমে বিড়বিড় করতে দেখেছে৷ সে আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করল কী বলছে। ইমান অগোছালো ভাবে বলছে, ” আমি আর চাকরিই করব না৷ এতো খাটায়। কামলা খাটতে আর মন চাচ্ছে না। কোথায় যাব না আমি।সারাদিন বাসায় থাকব আর ঘুমাবো।”

মিরার চোখ কপালে। ঘুমের মধ্যে একটা মানুষ এতো কথা বলতে পারে। সে আনমনে তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিল এবং ক্ষণেই তার মস্তিষ্ক স্মৃতিচারণ করে বিভীষিকাময় সেই রাত্রীর। দ্রুত সে কেটে পড়ে। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস। ওয়াশরুম থেকে সে এলার্মের আওয়াজ পেল। নিশ্চয়ই ইমান এখন ঘুম থেকে উঠবে। সে বের হতেই ইমানকে জাগ্রত অবস্থায় দেখল। ওর দেখে বোঝা ও ভারী বিরক্ত। মুখ শক্ত করে বসে ঝিমাচ্ছে।

মিরা চুপ থাকতে পারল না। জিজ্ঞাসা করেই বসে, ” কী হয়েছে আপনার? মুখটা কাকের মতো বানিয়ে রেখেছেন কেন?”

–” রোজ রোজ ছয়টায় উঠে অফিস গেলে কাকের মতো কাকা করতে মন চাইবে। ”

মিরা শব্দ করে হাসল৷ ইমান বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করে বলে, ” ব্রেকফাস্টে কী খাবে? ওর্টস?”

–” কালকে আন্টি গল্প করতে করতে বলছিল আজ আলুর পরোটা বানাবো হবে৷ সাদের আজ ভার্সিটি অফ।”

–” ভালোই খাতির জমিয়েছো দেখছি।”

–” আপনার মতো খাইশটা না যে কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখব না। কথা বলব না৷”

ইমান খুকখুক করে কেশে বলে, ” আজকে লেইট হয়ে গেছে। আমার আবার বেড কফি না খেলে চলে না। তুমি কী আমার জন্য এককাপ কফি বানাবে পারবে? ”

–” অবশ্যই পারব।”

–” সুগারের জায়গায় সল্ট দিও না।

মিরা কটমট করে তাকায় তার দিকে৷ ইমান উঠে দাড়িয়ে বলে, ” টেক্সাস থেকে ফিরে আসলে তোমাকে আমি ক্যাপেচুনা বানিয়ে খাওয়াব। আমার ক্যাপেচুনার প্রশংসা করে মানুষ।”

–” যাচ্ছেন কবে?”

–” আজকে রাতে।”

–” বিকেলে বাসায় আসবেন?”

–” সিউর না।”

সে ওয়াশরুমে গেলে মিরা একফাকে দু কাপ কফি বানিয়ে আনে কিচেন থেকে। এখনো এ বাসায় কেউ উঠেনি। তাই বলে নিউইয়র্ক কিন্তু ঘুমিয়ে নেই। এ শহর নাকী চব্বিশ ঘন্টা জেগে থাকে!

বাথরুমের দরজা খোলা দেখতে পেয়ে বুঝতে পারে ইমান বেরিয়েছে। বারান্দার দরজা খোলা। সারারাত বারান্দা বন্ধ ছিল। মাত্র খোলা হয়েছে৷ মুহুর্তে রুমটা হীম শীতলে রুপান্তর হলো। ইশ কী শান্ত, মোলায়েম বাতাস। সে বারান্দায় গিয়ে দেখে ইমান কেবল একটা স্যান্ডোগেঞ্জি পড়ে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মনোযোগ দিয়েছে। মিরা কাশি দিয়ে এটেনশন সিক করে বলে, “কফি।”

ইমান হাত বাড়িয়ে কফি নিল। দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কফি উপভোগ করছে৷ সকালটা কী আজ অতিরিক্ত সুন্দর? পাখির কলকলানি আওয়াজ ছাড়া অন্য বাড়তি কোন কোলাহল নেই৷ বরং মন ভুলানো প্রাকৃতিক শোভা ছড়াচ্ছে চারপাশ। নিচ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরপর একটা করে সাইকেল যাচ্ছে। সাইকেলের টুংটাং ধ্বনি শুনতে ভালো লাগছে৷ তারা দুইজনই খামোশ যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে।

মৌনতা ভেঙে ইমান বলে, ” নেক্সট ডে থেকে ডায়েট শুরু করতে হবে।”

–” আপনি ডায়েট করেন? ”

–” জি ম্যাডাম। আমি স্ট্রিক ডায়েটে থাকি। এক্সারসাইজ করি। ভোর পাঁচটায় উঠে মনিং ওয়াকে যাই।”

মিরা বলে, ” আমিও ফুলে যাচ্ছি দিন দিন৷ আমিও ডায়েট করব৷”

— তাহলে দুজন একসঙ্গে ডায়েট শুরু করব।”

–” ঠিক আছে।”

_____________________

দুপুর একটা। সূর্য একদম মাথার উপরে। এসি অন থাকায় গরমের গ ও অনুভব হয় না। লাঞ্চ আওয়ারে ইমান মাত্র কেবিনে গিয়ে নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে৷ মাথা ব্যথা করছে তার৷ কোমড় ব্যথাও সঙ্গে আছে। অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে তার কোমড় ব্যথা করে৷ মাত্র বসেছে ওমনি ফোনটা বিকট আওয়াজ তুলল। সে মনে মনে কলদাতাকে কঠিন একটা শব্দে গা*লি দিল৷ এরপর ফোন হাতে নিয়ে দেখে হাসনাহেনা কল করছে। সে সঙ্গে সঙ্গে জিভ কাটে। এরপর ফোন তুলে ভরাট কন্ঠে বলে, ” কী দরকার? ”

-” কোন দরকার নাই। তুমি বাসায় আসো।”

–” বিকেলে আসব তো।”

–” বিকেল না এখনই আসো।”

–” ইমার্জেন্সি?”

–“হ্যাঁ। ”

–” আসছি।”

হাসনাহেনার সঙ্গে যতোই মনোমলিন্য থাকুক ইমানের, উনি কিছু বলবে তা মানে সে৷ আজও তার কথা অনুযায়ী লাঞ্চ না করে বেরিয়ে পরে বাসার উদ্দেশ্য। এই অযুহাতে মিরার সঙ্গেও একবার দেখা হবে৷ ড্রাইভ করে বাসায় এসে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজালো৷ পর পর দুবার। কেউ গেইট খুলল না। বেশ চিন্তা হয়ে লাগে তার। হাসনাহেনার কিছু হলো নাকী? বা মিরা? ও ঠিক আছে তো? দরজার নব ঘুরিয়ে সে ভেতরে ঢুকতেই হাসাহাসির শব্দ কানে আসে। সম্পূর্ণ বাসা খাবারের গন্ধে মো মো করছে৷ এই সুস্বাদু খাদ্যের ঘ্রাণ সে চেনে। তার সবচেয়ে প্রিয় বিরিয়ানির গন্ধ। কয়েক কদম এগিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে দাড়ালো সে। সাদ, মিস হাসনাহেনা এবং মিরা কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে৷ অনেকদিন পর বাসায় এভাবে হাসাহাসি-মজা করতে দেখলো সে। নাহলে এ বাসা শশ্মানের চেয়েও নিস্তব্ধ থাকে৷ সে দু’কদম এগিয়ে এসে কড়া গলায় বলে, ” আপনার জরুরি কাজ কোনটা?”

–” মিরা আজ সবার জন্য নিজ হাতে বিরিয়ানি বানিয়েছে। বিরিয়ানি খাওয়াই তোমার জরুরি কাজ৷”

সে রাগী চোখে একবার প্রতিটা সদস্যের দিকে তাকালো। সাদ-মিরা দুজনই তাকে দেখে খাওয়ায় মনোযোগ দিল যেন তারা ইমানকে দেখেইনি৷

ইমানের হাতে একটা ফাইল ছিল।সে ফাইল ফেলে দিয়ে টাই লুজ করে উপরে উঠে যায়৷

ও যাওয়ার পর মিরা বলে উঠে, ” উনি বোধহয় খাবেন না।”

–” খাবে। বিরিয়ানির গন্ধ পেলে ওর মাথা ঠিক থাকবে না৷ একটু পর নিজ থেকে আসবে।”

হলেও তাই ইমান দোতলা থেকে জোরে চেচিয়ে বলে উঠে, ” আমি কী না খেয়ে থাকব? আমার লাঞ্চ উপরে পাঠিয়ে দাও।”

ইমান কথাটা কাকে বলল মিরা তা বুঝল না। তবে হাসনাহেনা খাবার প্লেটে বেড়ে মিরার হাতে ধরিয়ে দিল৷

সে বলে, ” আমি দিয়ে আসব?”

–” আমি দিলে আরো রেগে যাবে। তুমি যাও।”

অগত্যা মিরা দোতলায় যায়। ইমান বেডে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে৷

মিরা বলে, ” আপনার লাঞ্চ। কই রাখব?”

–” আমার মাথায় রাখো। দেখছো কাজ করছি। এছাড়া আমার হাত ব্যথা। নিজ হাতে খেতে পারব না। খাইয়ে দাও।”

— এতো বড় ছেলেকে খাইয়ে দিব? বুড়ো মানুষ আপনি।”

— ” আমি বুড়া না। যথেষ্ট ইয়ং আমি।”

–” আমি পারব না আপনাকে খাইয়ে দিতে৷”

ইমান ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকালো এবং শীতল কন্ঠে বলে, ” তাহলে তোমাকে আমি বারান্দা থেকে উষ্টা মেরে নিচে ফেলে দিব।”

–” আশ্চর্য! ”

–” আমাকে মিথ্যা বলে কেন বাসায় আনলে? বিরিয়ানি খাওয়া জরুরি কাজের মধ্যে পরে? পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে কী বিরিয়ানি খাওয়া অন্যতম? এম আই এ জোক টু ইউ ওল? তোমাদের কী মনে হয় আমি অফিসে ঘাস কাটি?যখন-তখন কল দিবে আর আমি ঘাস কাটা বাদ দিয়ে বাসায় আসব? বল? ঘাস কাটতে যাই আমি? আমি কী গরু? স্পিক আপ!

মিরার তার বেসুরা গলার কথা মাথা ধরে যায়। সে বিরিয়ানির দলা বানিয়ে আচমকা ইমানের মুখে পুড়ে দেয়।মুখে খাবার পুড়ে দেওয়ার জন্য ইমান কথা বলতে পারল না। মুখের বুলি সব থেমে গেল এবং বিষ্মিত চোখে মিরার পানে তাকালো। অনেকদিন পর এতো মজাদার খাবারের স্বাদ পেল সে!

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–37

নীল রঙের মতো রঙিন বিকেল৷ আকাশে ধূসর মেঘের আধিপত্য আজ যেন চড়া। প্রকৃতি ঘিরে বিশুদ্ধ বাতাস সঙ্গে আর্দ্রতার ছোয়া। নির্বিশেষে আজকের আবহাওয়া আর প্রাকৃতিক রুপ স্মৃতির মানসপটে আটকে রাখার ন্যায় অধিকতর সুন্দর। আলো ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় মিরার গোছালো চুল এলোমেলো হয়ে গেল। চুলের গাছি মুখে এসে আছাড় খেল। সে বিন্দুমাত্র বিরক্ত হলো না। তার দৃষ্টি সামনের রোডের দিকে। পরিষ্কার ফকফকা পিচঢালা রাস্তার ধারে বেশ যত্ন নিয়ে ছেটে অচেনা গাছ উঁকি মারছে। পাশেই ইয়া বড় একটা রেড ম্যাপেল ট্রি। ম্যাপল গাছটার শেপও খুব গোছালো যেন এটার জন্ম থেকেই কেউ খুব আদর-যত্ন নিয়ে এসেছে৷ অথচ এটা বেওয়ারিশ রাস্তার ধারের গাছ। কারো বাড়ির বাউন্ডারির মধ্যে পড়ে না। তবুও এই এরিয়ার সৌন্দর্য যেন রেড ম্যাপেল ট্রিটার জন্য শতগুণ বেড়ে গেছে৷ খুব অদ্ভুত লেগেছে গাছটাকে। লালে ভরা সম্পূর্ণ গাছটা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আগুন লেগেছে। বেশি আর্কষনীয় হচ্ছে, গাছের চারপাশে সাদা সিমেন্ট দিয়ে বাধাই করা। গাছের নিচে সবুজ রংয়ের একটা বেঞ্চ৷ বেঞ্চটা লাল পাতায় ভরে গেছে। সবুজ-লাল দেখেই তার বাংলাদেশের পতাকার কথা মনে হলো৷ বাতাসে উড়ে উড়ে রাস্তায়ও ম্যাপেল ট্রির পাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। এমন কী প্রচন্ড বাতাস প্রবাহিত হলে, এ বারান্দা অব্দি পাতা উড়ে আসে। চকচক করা পাতা গুলোর দিকে তাকিয়ে সে আনমনে গভীর ভাবনায় ডুব দিল৷ আজ মায়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হলো। মিরার কেন যেন মনটা ছটফট করছে৷ মায়ের ভয়েজ শুনে মনে হলো সে অসুস্থ। ইরার সঙ্গে কথা হয়নি। বাসায় ছিল না ও৷ কিন্তু মা খুব খারাপ একটা সংবাদ দিয়েছে। ইরা নাকী ইয়ার লস দিবে৷ এবছর এসএসসি এক্সামে সে বসছে না। পরেরবার দিবে৷ হুট করে সে এমন কেন সিদ্ধান্ত নিল কে জানে? মাও তাকে জোর করছে না। সে বোধহয় আপাতত মানসিকভাবে এতো স্ট্যাবেল নেই যে ইরাকে কিছু বলবে বা বুঝাবে। নাহলে মা পড়াশোনার ব্যাপারে যে স্ট্রিক! মিরা মায়ের শাসনেই এসএসসিতে এপ্লাস পেয়েছিল। নাহলে তার মতো গাধী স্টুডেন্ট কোনকালেই এপ্লাস পেত না। ইরা অবশ্য মেধাবী। তাদের ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে থাকে সবসময়। কথা হলো, মা বারবার তাকে একটা জব করার কথা বলছে। তার ভাষ্যমতে, বিদেশে জব খুব এভেইলেবেল।জব সেক্টর বৃহৎ। স্টুডেন্টরা আনায়াসে কাজ করে স্ট্যাডির পাশাপাশি। একটু খুঁজলেই বা চেষ্টা করলেই কাজ পাওয়া যায়৷ মিরা ভেবে পাচ্ছে না, মা আচমকা জব নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা কেন করছে? মামা কী কোন সমস্যা করছেন? কী জানি?তবে তারা নানাবাড়ি ফিরে যাওয়ায় মামা-মামী কিঞ্চিৎ বিরক্তই হয়েছিল। মামী তো বলে দিয়েছেই, এই বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর শ্বাশুড়ি কখনো নিজের ঘর ছাড়ে? এসব পাগলামী ছাড়া কিছু না৷ কিন্তু মা যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে আর ফিরবে না৷ নিউইয়র্ক আসার যাত্রা তার জন্য মোটেও সুখকর নয়। বরং হাজারো বেদনা বুকে চেপে সফর করেছে সে। আচ্ছা দূরে সরে এলে কী যন্ত্রণা কমে? মিরার মনে হলো যন্ত্রণা কমে না, বরঙ দূরত্ব যন্ত্রণার স্থিতিস্থাপকতা আরো বাড়িয়ে দেয় আপন হারে, আপন মাত্রায়। যন্ত্রণা পিছু ছাড়ে না, সুখ হারিয়ে যায়৷ অদ্ভুত জীবনের সব নিয়মাবলি! এতোকিছুর পরও মা ফোন কাটার আগে আবেগী গলায় বললেন, ” হাসি-খুশি থাকবি রে মা। তোরা হাসলে আমার কষ্ট নাই হয়ে যায়৷”

মায়ের কথা সে রাখবে। কষ্টের মধ্যে কেঁদে কেঁদে দিন পাড় করা জীবন না। বরং বুক ভার করা কষ্টেও মুচকি হেসে দিন অতিবাহিত করার নাম জীবন।

কিছু ছুড়ে ফেলার শব্দে মিরার ভাবনার সুতো কেটে যায়। সে ঘার ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো। কাচের থাই গ্লাস দিয়ে দেখা গেল, ওপাশে অর্থাৎ রুমের ভেতরে ইমান মুখ থমথমে করে একটা বেগুনি রঙের শার্ট মেঝেতে ফেলে দিল। ফ্লোরে আরো ছয়টা শার্ট পরে আছে। মিরা তার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। এই যে ইমান! ওর কী নিশ্চিত জীবন, সিকিউরড লাইফ। তাও সে কী ভীষণ বিরক্ত। কথায় আছে তো, সুখে থাকতে ভূতে কি*লা*য়, সুখের মর্যাদা মানুষ সুখে থাকতে দেয় না৷

দুপুরে সে মিরার হাতে দু’প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে আরাম করে নাক ডেকে পাঁচটা পর্যন্ত ঘুমালো। এখন সাড়ে ছয়টা বাজে। জনাবের গোছ-গাছ শেষ নেই৷ লাগেজ গুছাচ্ছে দেড় ঘন্টা ধরে। নিজের আলমারি থেকে প্রতিটা শার্ট বের করে ওয়াশরুমের আয়নায় গায়ের সঙ্গে মেলে ধরে দেখছে। যেটা ভালো লাগছে না সেটার স্থান সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে হচ্ছে। যেটা পছন্দ হচ্ছে, উনি সেই সার্ট ট্রায়াল দিয়ে দেখছে। এরপর সেকেন্ড রাউন্ডে কিছু শার্ট রিজেক্ট খেল৷

মিরা বারান্দা থেকে বের হয়ে এসে বলে, “আপনি কী এবার মিষ্টার ওলান্ডের জন্য নাম লিখিয়েছেন?”

ইমান ভ্রু কুচকে তাকালো৷ মিরা হেসে বলে, ” এতো সাজ-সরঞ্জাম করে লাভ নেই৷ আপনার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখবে না।”

–” আর যদি কেউ তাকায়?”

–” আমার বিশ্বাস আপনার মতো বুড়ো মানুষের দিকে কেউ তাকাবে না। এদেশের মেয়েরা তো নয়ই।”

ইমানের মুখ কালো হয়ে আসল৷ সে মোটেও বুড়ো না। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করার একমাসের মধ্যে জব পেয়েছে।নাহলে তার বয়সী ফ্রেন্ডরা এখনো বেকার আছে। ব্যাচেলর লাইফ ইঞ্জয় করছে। ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে না৷ বিয়ে কেউ করেইনি। এ থেকে বোঝা যায়, বয়স তার বেশি না৷ হ্যাঁ মিরার চেয়ে সে সামান্য বয়সে বড়। কিন্তু এটা তো তার দোষ না। বরং মিরার দোষ। ওকে কে দেরিতে জন্মাতে বলেছে? আগে জন্মগ্রহণ করলেই পারত। খামোখা তাকে বয়স্ক বলছে। নিজে দেরি জন্ম নিয়ে তাকে বুড়ো বলে। আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে তো!

সে বলে উঠে, ” খবরদার আমাকে বুড়ো বলবে না৷”

— তাহলে কী খোকাবাবু বলবো?”

–” আশ্চর্য!”

–” সাতটা বাজতে চলল৷ আপনার কী যাওয়ার ইচ্ছা নাই?”

–” আমাকে তাড়ানোর এতো ব্যস্ততা কেন?”

–” আপনাকে সহ্য হয় না৷ অসহ্য।”

ইমান বিজয়ের হাসি হাসল। এরপর বলে, ” তিনদিন আরামে থাকবে৷”

এরপর দুটো শার্ট মিরার সামনে ধরে বলে, “কোনটা পরব?”

–” যেকোন একটা পরলেই হলো।”

–” না না। চুজ এনি ওয়ান।”

মিরা শার্ট দুটোর দিকে তাকালো। একটা কফি রঙের আর আরেকটা কচুপাতা রঙের। সে কচুপাতা রঙের শার্টটা পরতে বললো৷ ইমান সঙ্গে সঙ্গে কচুপাতা রঙেরটা বিছানায় রাখল এরপর কফি রঙের শার্ট হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা দেয়৷

মিরা অবাক হয়ে বলে, ” আরে আমি গ্রীন কালারেরটা চুজ করে দিয়েছি। কফি কালারেরটা কেন পরতে যাচ্ছেন?”

ইমান নিজের চুল ঠিক করে বলে, “এজন্যই এটা পরছি৷”

মিরা ভেংচি কাটলো। কতো হাড় বেয়াদব। তার পছন্দে পরবে না তাইলে আস্ক কেন করল?

খানিক বাদে ইমান কফি রঙের শার্ট পরে বের হলো। হাতা ফোল্ড করতে করতে সে জিজ্ঞেস করে, ” হাউ এম আই লুকিং? বল? বল? কটা ললনা পটবে? দুজন নাকী চারজন?”

মিরা আরেকবার ভেংচি কেটে বলে, ” আপনাকে কেমন লাগছে বলব?”

ইমান তখন পারফিউম মাখছিল। সে হেসে বলে, ” হলিউড হিরোর মতো?”

— পেঁচার মতো লাগছে। তিন রাত জাগা পেঁচার মতো।”

ইমান চোখ-মুখ কুচকে বলে, ” ইউ আর জেলাস।”

তখনই ইমানের ফোন বেজে উঠল। সে ফোন হাতে নিয়ে দেখল জুইয়ের কল। সে রিসিভ করে। তাকে ফোন রিসিভ করতে দেখে মিরা সরে যায়।

ইমান ফোন রিসিভ করে বলে, ” আমি দশ মিনিটের মধ্যে বের হচ্ছি। আচ্ছা জুই আমাকে কী পেঁচার তো দেখতে লাগে?”

— কী বললে? পেচ? আই এম নট গেটিং ইউ।”

ইমান আমতাআমতা করে বলে, ” নাথিং। ”

উফ! এই মেয়েটার কথা সে সিরিয়াসলি কেন নেয়?

সে লাগেজ নিয়ে বের হওয়ার সময় রুমে চোখ বুলালো। আশ্চর্য মিরা কোথাও নেই। বারান্দা চেক দিল। সেখানেও নেই। সেকেন্ডের মধ্যে কই গেল? নিচে গেছে মনে হয়? মিসের চৌধুরীর সঙ্গে তার আবার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু এখনই যেতে হবে? সে জানত না ইমান একটু পর বের হবে৷ গুডবাই পর্যন্ত বলে। সে কী এখন তার সঙ্গে কথা না বলেই যাবে? গুডবাই না বলেই যাবে? মুহূর্তে ইমান চকিতে উঠে। মিরার কাছ থেকে সি অফ করলে তার লাভ কী? মনটা এমন অবাধ্য হচ্ছে কেন? সে নিজের মনকে একটা গা*লি দিল৷ সে লাগেজ হাতে নিয়ে নিচে নামলো। নাহ হলরুমেও মিরা নেই। আনমনে তার মেজাজ চটে গেল। নিশ্চয়ই মিসেস চৌধুরীর রুমে আছে সে। অগত্যা ওনার রুমের সামনে গিয়ে ইমান দরজা নক করে৷ উনি দরজা খুলে হয়তোবা সামান্য চমকে উঠে।

ইমান বেশ সাবধানে সম্পূর্ণ রুম পরখ করে নেয়ব।সে আরেকবার হতাশ হলো। রুম তো পুরা খালি।

হাসনাহেনা বলে, “কিছু বলবে? তুমি কোথায় যাও?”

ইমান হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বলে, ” তিনদিনের জন্য টেক্সাস যাচ্ছি। এটা জানাতে এসেছি।”

হাসনাহেনা আকাশ থেকে পরল। ইমান কোনদিন তাকে বলেও যায়না কোথায় যাচ্ছে। শহরের বাইরে গেলেও বলে না৷ তাদের পরবর্তীতে অফিসে খোঁজ লাগিয়ে জানতে হয় সে কোথায় আছে৷ সেই ছেলে পায়ে হেঁটে তার রুমে এসে বলছে টেক্সাস যাচ্ছি। ভূতে ধরল নাকী?

ইমান দ্রুত কেটে পরে৷ কিন্তু হাসনাহেনা রুমের বাইরে এসে ইমানের পিছু নেয়৷ সাদ বাসায় নেই। তার রুম খোলা। লাইট নিভানো। বাকী রইল কিচেন। হাসনাহেনা সামনে থাকায় ইমানকে অভিনয় করতে হলো। সে কিচেনে গিয়ে এমন ভান ধরে যেন পানি খাচ্ছে৷ কিন্তু আফসোস মিরা কিচেনেও নেই৷ একটা মানুষ মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া হয় কেমনে? হাউ?

হাসনাহেনাকে দেখিয়ে সে এক গ্লাস পানি খেল। এরপর মেকি হেসে বলে, ” যা গরম পরেছে।”

এখন স্টোররুম বাকি। স্টোররুমে গেলে মিসেস চৌধুরী সিউর তাকে পাগল বলবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কোন দরকার নেই মিরার সঙ্গে কথা বলার। ওর কাছ থেকে সি অফ না নিলে সে মরে যাবে না৷

ইমান লাগেজ হাতে বেরিয়ে পরে৷

________________

জুইয়ের কল আসায় মিরা নিচে নেমে আসে৷ কিন্তু নিচেও ভালো লাগছিল না তার। তাই বাসার বাইরে বের হয়ে বারান্দা থেকে দেখা ম্যাপেল ট্রির কাছে এসে বেঞ্চে এসে বসেছে। তখন থেকেই সে বসে আছে। এতো সুন্দর লাগছে গাছটাকে মাথার উপর থেকে দেখতে। বেঞ্চে বসে সে একধ্যানে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আচমকা পিছন থেকে বেশ জোরে কেউ তার নাম ধরে ডাকে। সে পিছনে ঘুরে দেখে ইমান বাসা থেকে বেরিয়েছে৷ লাগেজ হাতে। কফি রঙের শার্টে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে তাকে৷ আজ সত্যি সত্যি দু-চারজন ললনা তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে পারে৷

মিরা হাতের ইশারায় তাকে বলে, কী হয়েছে?

এতে সামান্য বিব্রত দেখালো তাকে। এতো জোরে কেন ডাকল সে?

মিরা উঠে দাঁড়ায়৷ ইমান তার দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” তুমি এখানে? আর আমি সারা বাড়ি হন্ন হয়ে খুঁজছি তোমায়।

মিরা ভারি অবাক হয়ে গেল এবং মিহি কণ্ঠে বলে, “আমাকে খুঁজছেন কেন? ইউ হ্যাভ নো বিজনেস উইথ মি।”

ইমান মনে মনে বলে আমাকে বিজনেস দেখাবা না৷ আমি লাভ-ক্ষতির ধার ধরি না৷ মুখ বলে, ” যাওয়ার আগে দেখা করে যেতে চাইছিলাম। তুমি সাবধানে থেকো৷ কোন দরকার হলে কল দিও।”

মিরা সামান্য হাসল৷ ততোক্ষণে নিউইয়র্কের বুক থেকে সূর্য বিদায় নিয়েছে৷ ল্যাম্পপোস্ট মাত্র জ্বলে উঠে। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় আশপাশ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে কিছু ছোট পোকা উড়াউড়ি করতে লাগলো। ম্যাপেল ট্রির ডালে দুটো পাখি এসে বসেছে। মনে হিয় আজ রাত্রীযাবত এ গাছের ডালে করবে৷ ওরা দুষ্টুমি করে ডানা ঝাপ্টাচ্ছে৷ দূর থেকে মেঘের গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ কানে আসছে৷ আকাশের এক পাশে বিদ্যুৎ তেড়ছাভাবে বয়ে গেল৷ দমজা বাতাস আবারো বইতে লাগল। ম্যাপেল ট্রিও নিজের পাতা বিলিয়ে দিচ্ছে৷ ঝরে ঝরে পরছে অসংখ্য লালচে বর্ণের পাতা। আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ নীরবতার জন্য পরিবেশটা ভারিক্কি লাগছে৷

ইমান বলে উঠে, ” যাই তাহলে। মেইনরোডে অফিসের মাইক্রো এসে থেমেছে।”

–” যান।”

ইমানের মন বিষিয়ে উঠে৷ তার কেন মনে হয়েছে,মিরা বলেবে আপনি যাবেন না৷ আপনি না থাকলে এবাসায় আমি একা কেন থাকব? কী জন্য থাকব? হয় আপনি থাকবেন নাহলে আমাকেও সঙ্গে নিবেন। ইমান নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা কান্ড করেছে। মিরার দু’সেট জামা লাগেনে নিয়েছে৷ কাজটা বড্ড বোকামী।

ইমান আবারো বলে, “মনে হয় বৃষ্টি হবে৷”

মিরা কিছু বলল না৷ ম্যাপেল ট্রির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। তিরতির করে গাছের পাতা নড়ছে৷ আচানক একটা পাতা মিরার মাথায় এসে পরল। চুলে আটকা পরে। ইমান সঙ্গে সঙ্গে চুল থেকে পাতা সরিয়ে দেয়। এরপর পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে বলে, ” এটা কাছে রেখো।”

জোর করে মিরার হাতে কার্ড ধরিয়ে দেওয়ার সময় সে ইচ্ছা করে ওর হাত স্পর্শ করে৷ মিরা সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের দিকে তাকালো। ইমান হাসি দিল৷

মিরার সর্বাঙ্গে শীতল শিহরণ বয়ে যায়৷ লজ্জাবতী গাছকে ছুঁয়ে দিল যেমন সে মিইয়ে যায়৷ সেও এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে নতজানু হয়৷ বুকটা কাপছে তার। বুকের ভেতর খাচা বদ্ধ হৃদপাখিটা খাচা ভেঙে উড়াল দিতে চাইছে৷ সে পিটপিট করে চেয়ে রইল৷

ইমান এলোমেলো পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল৷

মিরা পিছু ডেকে বলে, ” ফিরবেন কবে?”

ইমান পিছনে না ফিরে হাক পেড়ে উচু আওয়াজে আকাশ-পাতাল কাপিয়ে স্পষ্ট বাংলায় বলে, ” তুমি যদি বল এখনই ফিরব৷ তুমি যদি থেকে যেতে বল, আর ঘরছাড়া হবো না৷”

মিরা ভ্রু কুচকে বলে, ” পাগল কোথাকার।”

চলবে৷