#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_৪
আচমকা ফোন বেজে উঠলো নয়তো আমার মুখে এমন কথা শোনার পর তার অবাক হওয়ার কথা ছিল। এতক্ষণ বুকে আগলে আমার হাত জোড়া তিনি ছেড়ে দিলেন। ফোনের অস্তিত্বের সন্ধানে চোখও সরিয়ে নিলেন। উঠে গেলেন ফোনের কাছে। তিনি চলে যেতে আমিও উঠে পড়লাম। বিছানার এক কোণে বসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলাম‚ “এত রাতেও আপনার কল আসে তাও আবার বিয়ের দিনে!”
ফোনের টোন অনেক আগেই থেমে গিয়েছিল। তিনি বন্ধ করে ফেলেছিলেন। তবে ফোনে যেন কী করছিলেন। আমার কথা শুনে একটু অন্য চোখেই তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন‚ “স্বামী হিসাবে মানতে আপত্তি তাহলে রাতে কল আসে কি আসে না তা নিয়ে সমস্যা কেন হচ্ছে?”
“মানি কি মানি না তা নিয়ে আমি কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলিনি।” একটু ভাব যেন ভেসে উঠলো আমার গলার স্বরে। নিজেই খানিকটা চমকে উঠলাম এমন বাক্য খরচ করে।
“তা কেন স্পষ্ট করবে? তোমরা মেয়েরা বরাবরই ভণিতা করতে পছন্দ করো। আবার দোষ হয় আমরা নাকি ভণিতা করি। মনে মনে একটা ছেলেকে স্বামী মেনে বসে থাকলেও এমন একটা ভাব করো যেন তাকে চেনোই না। আর এই যে শোনো‚ আমাকে কেউ কল করেনি। এটা আমার ঘুমানোর সময়। তাই এলার্ম বেজেছে। না জেনে অহেতুক মন্তব্য করা যে আল্লাহ পছন্দ করেন না তা কি জানো না?” একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কিছুই বললাম না; চোখ নামিয়ে নিলাম। তিনি আরও একটু সময় নিয়ে কী কী সব করলেন এরপর বিছানায় বসে চট করে আমার দু’খানা হাত টেনে নিয়ে কিছু চুড়ি পড়িয়ে বললেন‚ “আপাতত এগুলো দিলাম। দেনমোহরের হিসাব নিকাশ পরে করতে হবে। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে তোমার সাথে বৈঠক হবে ইন শা আল্লাহ। আমাকে স্বামী না মেনে কই যাও সেটাই দেখবো সকালে।”
জায়নামাজে বসে যেমন আমার মাথা টেনে নিয়েছিলেন‚ তেমন আবারও মাথা টেনে নিলেন পরম যত্নে। কপালে আরও একবার পবিত্র স্পর্শ এঁকে দিয়ে কাতর গলায় বললেন‚ “আল্লাহ তাআলার করে দেওয়া এই হালাল সম্পর্কে আপত্তি করো না মিষ্টি। আমি তোমাকে আমার বুকে আগলে রাখবো। তোমার জান এবং ইজ্জতের হেফাজত করবো ইন শা আল্লাহ। দুই হাত ভরে আল্লাহ তাআলার কাছে দুজনের জন্য জান্নাত কামনা করবো যেন ইহকাল এবং পরকাল দুই জায়গাতেই আমাদের মিলন হয়।………. আমার চার বছরের চাওয়াকে অন্য পাওয়ায় রূপ দিয়ো না মিষ্টি। সারারাত ভেবে আমাকে এমন কথা শুনিও না যা আমার অন্তর সইতে পারবে না।………. ভালোবাসে বউ; আকাশ তোমাকে আকাশের মতোই ভালোবাসে।”
স্তম্ভিত আমি আমার মতোই বসে রইলাম। প্রতিবার তার কথায় কেমন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তিনি আমার থেকে উত্তরের আশা করলেন না হয়তো বুঝতে পেরেছেন কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে আমি আর নেই।
আমাকে একা বসিয়ে নিজের মতো করে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লেন। তবে আমার উদ্দেশ্যে একবার বললেন‚ “বসে থেকো না। ঘুমিয়ে পড়ো। ফজরের নামায কাযা করলে কিন্তু কাল থেকেই যু*দ্ধ শুরু করে দিবো।” আমি কোনো জবাব দিলাম না তেমনই চুপ করে বসে রইলাম।
কতক্ষণ বসে রইলাম জানি না। তবে একা একা আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। এদিকে ঘুমানোর ইচ্ছেটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি শুয়ে পড়লাম। জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের পাশে একই বিছানায় মাথা রাখলাম যার সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই আমার।
ঘরের নিভু নিভু আলোতে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার মুখখানা দেখলাম; ঘুমিয়ে গেছেন। বড়ো শান্ত আর মায়াভরা মুখ; মাশাআল্লাহ! এই মুখটা দেখতে গিয়েই তো চার বছর আগে হাঁটুতে খুব চোট পেয়েছিলাম।
চার বছর আগে……….
অক্টোবর মাস; ভুল বললাম। বলতে হবে অক্টোবর রেইন। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি টানা দুই বছর পড়াশোনায় বিরতি দিয়েছিলাম। দেড় মাস আগে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করলেও আমার অসুখে অসুখে ইউনিভার্সিটিতে আর যাওয়া হয়নি। আম্মু অবশ্য এরজন্য কিছুটা দায়ী। তার কথা হলো‚ “বেঁচে থাকলে সারাজীবন পড়াশোনা করতে পারবে। আগে সুস্থ হও। এরপর ক্লাসে যাবে। হাসপাতাল আর ফার্মেসি করে করে তো জানটা বের করে নিলে। আর ছোটাছুটি করতে পারবো না বাবা। এবার আমাকে রেহাই দাও।”
আমার জ্বর; সাধারণ জ্বর নয়। কী হয়েছে তা স্পষ্ট করে কেউ আমাকে বলেনি। ফাইলপত্তরও দেখতে দেয়নি। তাই আমি জানি না আমার কী হয়েছিল। তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার মেহেরবানিতে এখন সুস্থ আছি। তাই তো বৃষ্টি ভেজা পথ মাড়িয়ে ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারছি।
ক্লাসে পৌঁছাতে গিয়ে আমার বোরকা নীচের দিকে একদম ভিজে গেছে। ছয় মাস হয়নি আমি বোরকা পরা শুরু করেছি। এখনো পুরোপুরি পর্দার আড়ালে যেতে পারিনি। অল্পস্বল্প করে নিজেকে ফিরিয়ে নিচ্ছি আল্লাহর পথে। আসলে অসুস্থ হওয়ার পর আমার মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন নিয়মিত নামাযও পড়ার চেষ্টা করি‚ কোরআন তেলাওয়াত করি। তবে পর্দায় খামতি আছে এখনো। বোরকা পরলেও হিজাব পরে মুখ মাস্ক দিয়ে ঢেকে রাখি। এভাবে পর্দা হয়! এমন প্রশ্ন আমার মনে এলেও খুব একটা ভাবা হয়নি।
ক্লাসে ঢুকে ব্যাগপত্র রেখে ওয়াশরুমে চলে এলাম। নিজেকে ভদ্রস্থ করতে মিনিট পাঁচেক সময় নিলাম। এরপর বের হতেই একটু থেমে গেলাম। পায়জামা‚ পাঞ্জাবি আর টুপি পরা একটা ছেলে চোখ নামিয়ে খুব শান্ত মেজাজ হেঁটে আসছে। আমাদের ইউনিভার্সিটি জেলার মধ্যে মোটামুটি সবচেয়ে দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমন জায়গায় এত সাধারণ আর ধার্মিক ছেলে দেখে একটু চমকাতেই হলো। তাকে দেখে হাঁটতে গিয়ে বারান্দায় অনিয়মে রাখা টেবিল খেয়াল করিনি। যা হওয়ার তাই হলো। এমন জোরে আঘাত লাগলো হাঁটুতে ব্যথায় একদম কুঁকিয়ে উঠলাম।
হাঁটুতে হাত বুলিয়ে যখন উপরে তাকালাম‚ তখন অন্য ছাত্রছাত্রীদের ভীড়ে তাকে আর দেখতে পেলাম না। কী জানি কেন? তবে কয়েক সেকেন্ড তাকে একটু খোঁজাখুঁজি করলাম; পেলাম না। মাস্কের আড়ালে একটু বিষাদের হাসিতে মত্ত হয়ে ভাবলাম‚ “ধ্যুৎ! কোথাকার কে তাকে খুঁজে আমার কী লাভ?”
ক্লাসে অন্যমনস্ক হয়ে ঢুকলাম। নিজের আসনে বসার পর মন কেমন যেন উসখুস করে উঠলো। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে গিয়ে প্রায় আঁতকে উঠলাম। মনে মনে বললাম‚ “এ কি! এই ছেলে এখানে কী করছে?”
আমার ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগলো। বরাবরই চমকে উঠলে নিজেকে সামলাতে একটু সময় লাগে। আমার ডান দিকের দুটো আসন পরেই ছেলেটা চুপচাপ বসে ফোনে কী যেন করছে। মনে মনে একটু হেসে উঠলাম‚ “যাকে আমি খোঁজলাম সারা দুনিয়ায়‚ সে এসে বসে আছে আমার আঙিনায়।”
আমাদের ক্লাস চলছে। আচমকা মেডাম ঘোষণা করলেন‚ “এখন সবাইকে গ্রুপ ওয়ার্ক করতে হবে। চারজন মিলে একটা করে গ্রুপ করে গোল হয়ে বসে যাও।”
আমাদের ক্লাসরুমের চেয়ারের সাথে একটুখানি টেবিলের মতো জোড়া দেওয়া। ফলে সহজেই নাড়াচাড়া করা যায়। সবাই আমরা গ্রুপ করে বসে পড়লাম। আমার গ্রুপে আমরা দুইজন মেয়ে আর দুইজন ছেলে। আমি জানতাম এই সাবজেক্টে গ্রুপ ওয়ার্ক করতে হয়। তবে আজকেই করতে হবে তা জানা ছিল না। আমার কোনো প্রিপারেশনও নেই যেহেতু ক্লাসে আসা হয়নি।
আমার পাশে বসা মেয়ে যার নাম নিপা‚ তাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম‚ “মেডাম কি আগের ক্লাসে গ্রুপ ওয়ার্ক নিয়ে কিছু বলেছিল?”
আমার মতো ফিসফিসিয়েই নিপা জবাব দিলো‚ “না। হুট করেই আজকে করতে বললেন। অবশ্য প্রথম ক্লাসে বলেছিলেন একটা সারপ্রাইজ গ্রুপ ওয়ার্ক থাকবে। কিন্তু আজকেই সেটা আমার কোনো আইডিয়া ছিল না।”
……….চলবে ইন শা আল্লাহ