বিকেলের শেষ আলো পর্ব-০৫

0
331

#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_৫

নিপার কথা শেষ হতেই আমি মনমরা হয়ে সামনে তাকালাম। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আনমনে বলে উঠলাম‚ “ধ্যুৎ! এটা কিছু হলো!” এরমাঝে সামনে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু আচমকা মনে হলো কী যেন দেখলাম। নিজের মনকে নিশ্চিন্ত করতে আবার তাকালাম। দেখলাম‚ একজোড়া শান্ত চোখ আমাকে দেখছে। কিন্তু দেখার এই সময়টা দীর্ঘ হলো না। হয়তো বা লজ্জায় কাবু হয়ে চোখজোড়া নেমে গেল নয়তো অন্য কোনো কারণ। তবে আমি নির্লজ্জের মতো দেখতে লাগলাম। দূরত্ব থাকলেও মুখোমুখি একটা ছেলের সামনের বসে আমার মাঝে জড়তা কাজ করলো না। আমি নিভৃতে যেন একটা মায়াময় মুখ অবলোকন করলাম। এটাই সেই ছেলে যাকে দেখতে গিয়ে একটু আগে ব্যথায় জান বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায়‚ এটাই সেই ছেলে যাকে আমার ডান পাশে বসতে দেখে অবাক হয়েছিলাম।

“ছেলেটা আমার দিকে তাকালো কেন?” এমন প্রশ্ন মনে কতবার করলাম কিন্তু উত্তর পেলাম। কারণ এমন হুজুর টাইপের ছেলে যে আমাকে অন্য চোখে দেখবে না তা আমার জানা আছে। তাছাড়া আমি সুন্দরীও নই; শ্যাম বর্ণের মেয়ে। মানুষ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে কত কিছু করে। কিন্তু আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার দেওয়ার সৌন্দর্য নিয়েই সন্তুষ্ট আছি‚ অন্য কোনো চেষ্টা আমার মাঝে আদোও নেই।

যেমন তেমন করেই হোক গ্রুপ ওয়ার্ক জমা দেওয়া হলো। মেডাম সবার রোল নম্বর অনুযায়ী নাম ধরে ডাকতে লাগলেন গ্রুপ ওয়ার্ক চেক করার জন্য। এই অছিলায়ই জানতে পারলাম ওই ছেলের নাম আকাশ হোসেন আর রোল নম্বরও ঠিক আমার পরেই।

“কিন্তু হলেই বা কী?” এভাবে হাজারও প্রশ্নের ভীড়ে দিন চলতে থাকে। আমিও ক্লাস করি আর আকাশও ক্লাস করে। আমি তাকে মাঝেমধ্যে চোখের দেখা দেখে থাকি। কিন্তু সে আমাকে আর কখনো দেখেছে বলে আমার নজরে আসেনি। এদিকে ধীরে ধীরে আচমকা আমার মাঝে অজানা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আমি হিজাব ছেড়ে নিকাব পরা শুরু করি‚ হাত পাও কালো মোজার আড়ালে ঢেকে ফেলি। আকাশকে নিয়ে আমার মাঝে আর চিন্তা আসে না। এমনকি তাকে আর দেখতামও না কারণ পর্দার আড়ালে পুরোপুরি চলে গিয়েছিলাম আমি। আর পর্দার কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার প্রতি আমার ভালোবাসা গাঢ় হচ্ছিল। ফলে ইহলৌকিক সংযোগ যেন কমে এসেছে।

বর্তমান সময়ে……….

“মিষ্টি? অ্যাই মিষ্টি?” কেউ আমাকে ডাকছে। কিন্তু কে ডাকছে তা বুঝতে পারছি না। ঘুমটা এত ভালো লাগছিল‚ কিন্তু ডাকাডাকিতে আর তো ঘুমানো যাচ্ছে না। আমাকে বরাবরই আম্মু ঘুম থেকে তোলে। তাই আন্দাজের ওপর আম্মুকেই প্রশ্ন করলাম‚ “কী আম্মু?”

“আম্মু না। ‘কী গো’ বলো। আর এখন থেকে ‘কী গো’‚ ‘হ্যাঁ গো’‚ ‘ওগো’ বলার অভ্যাস করো।” এমন কথা শুনে আমি বিরক্তি নিয়েই চোখ খুললাম। পুরোপুরি তাকাতে গিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। পাঞ্জাবি আর টুপি পরা একটা পুরুষকে আচমকা ঘরের মধ্যে দেখে একটু চমকাতেই হলো। ঘুম ভাঙলে আমার সব কিছু মনে পড়তে একটু সময় লাগে। যেমন এখনও সময় লাগছে এই পুরুষ আর এই অচেনা ঘরকে চিনতে।

“ডেকে তোলার জন্য এখন আর আম্মু নেই। শ্বাশুড়ি মা এখন সেই দায়িত্ব আমার ঘাড়ে বর্তে দিয়েছেন। শীগগির উঠো। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে এসো। আমাদের প্রথম ফজরের নামাযটা একসাথে পড়বো ইন শা আল্লাহ।” আমাকে নিজের মস্তিষ্কে জোর কোনো তথ্য আনাতে হলো না। এই মানুষটাই আমাকে সব মনে করিয়ে দিলেন। গতকাল আমার বিয়ে হয়েছে আর আমি বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে আছি— এই কথা মনে পড়তেই একটু যেন মন খারাপ হওয়ার অনুভূতি আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। কিন্তু সদ্য ঘুম ভাঙা আমার মন খুব একটা অনুভূতির ভার বইতে পারলো না; নির্জীব হয়েই রইলো।

“বসে আছো কেন? বললাম না যেতে?” আমার থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি জানতে চাইলেন। তবে তার করা দুটো প্রশ্নের ভীড়ে শাসনের ছোঁয়া পেতে আচম্বিতে আমার মেজাজ একটু খিটখিটে হয়ে গেল।

“ধমকাচ্ছেন কেন? একটু ভালো করে বললে হয় না? ঘুম ভাঙলে আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করে না। সব ঠিকঠাক হতেই আধঘন্টা লেগে যায়। আর আপনি আমাকে ধমকেই চলেছেন। বিয়ে করেছেন তো কী হয়েছে? ভুলে যাবেন না আমি আপনার বড়ো।” এসব বলে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। এরপর একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলাম‚ “সরুন সামনে থেকে। কলাগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?” হনহন করে ওয়াশরুমে চলে এলাম। কেউ আমার ঘুম ভাঙালে একটু বেশিই রাগ হয় আমার। কী বলি আর না বলি— তার কোনো ঠিক থাকে না।

ওয়াশরুমে না চাইতেও একটু বেশি সময় কেটে গেল। আসলে তার সাথে সাতসকালে টিপিক্যাল বউদের মতো খিটখিট করে সামনে দাঁড়াতে লজ্জা হচ্ছিল। আমি সামান্য দ্বিধা নিয়ে ভারী পায়ে বের হতে দেখলাম‚ তিনি জায়নামাজে বসে তবজি পড়ছেন। আমাকে দেখে পড়া শেষ করে খুব সুন্দর করে হাসলেন। চার বছর চোখের সামনে প্রায় প্রতিদিন এই মানুষটাকে সামনে থাকলেও আমি কখনো তাকে হাসতে দেখিনি। অথচ কত সুন্দর তার মায়াময় মুখের শান্ত হাসি! মাশাআল্লাহ।

মুখের হাসি ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করলেন‚ “এত দেরি করলে! ফজরের নামাযের সময়টা কত গুরুত্বপূর্ণ জানো? এত দেরি করলে কি চলবে?” উত্তরে কী বলবো বুঝতে পারছি না। কাজের সময় আমার মুখ যেন অনশন করতে বসে। হাজার চেষ্টা করলেও নাড়াচাড়া করতে চায় না; শব্দ খরচ করে না।

“ওয়াশরুমে কি ঘুমাচ্ছিলে?” প্রশ্নটা তাচ্ছিল্যের হলেও তার গলায় কোনো তাচ্ছিল্যের ছায়া মাত্র টের পেলাম না। আর মুখে? সারা মুখ জুড়ে তো পবিত্র দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

আমি অপরাধী স্বরে বললাম‚ “ঘুম ভেঙেই আপনার সাথে রাগারাগি করলাম। তাই……….” আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। তার আগেই হাত ধরে টেনে জায়নামাজে দাঁড় করিয়ে বললেন‚ “আমি কিছু মনে করিনি গো। স্বামীর সাথে যদি টুকটাক রাগারাগি না করো তবে কি বউ বউ লাগবে? তাছাড়া বিয়ে করেছি বলে আমার তো ভুলে গেলে চলবে না‚ তুমি আমার বড়ো।” আমি অবাক হলাম আর আনমনে ভীষণ লজ্জায় পতিত হলাম। আমার কথা তিনি আমাকেই ফিরিয়ে দিলেন! লজ্জায় আড়ষ্ট হয়েও আমি সাহস করে তাকালাম তার দিকে। দেখলাম‚ গত রাতের দুষ্ট সমুদ্র আবার তার চোখের কোলে খেলা করছে। চেনা এই পুরুষের চোখে দুষ্ট সমুদ্রের খেলা করা আমাকে প্রতিবার বিস্মিত করে তোলে।

নামায শেষ হলো আর গতকালের মতোই নামায শেষ হতে তিনি আমার মাথা টেনে নিলেন। পবিত্র ভালোবাসা আমার ঈষৎ তপ্ত ললাটে এঁকে দিয়ে বললেন‚ “আল্লাহ তাআলা আমাদের হালাল জীবনযাপন কবুল করে নিক।”

আমার ইচ্ছে ছিল না‚ কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আপনমনে প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠলাম‚ “আমিন।”

আমার মাথা ছেড়ে দিয়ে আলতো করে আমার হাত দু’খানি নিজের বুকে আগলে বললেন‚ “নামায কখনো কাযা করো না মিষ্টি। বিনাকারণে নামায কাযা হোক আমি চাই না। আর শোনো‚ মনোযোগ দিয়ে শুনবে। এখন আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো।”

আমি মনোযোগ দিয়েই শুনতে লাগলাম। তিনি বললেন‚ “পৃথিবীতে একমাত্র মা ছাড়া এতদিন কেউ ছিল না। তবে এখন আর একজন হয়েছে‚ সেটা হলে তুমি। শরীয়তে স্বামীকে তুষ্ট করা নিয়ে অনেক নির্দেশ আছে তা তো তুমি জানো। আমাকে সন্তুষ্ট করতে তোমাকে ২৪ ঘন্টাই ব্যয় করতে হবে না বউ। আমি চাইবো আমার চেয়ে বেশি যেন তুমি আল্লাহ তাআলাকে মনে করো‚ তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করো। এছাড়া স্বামী হিসাবে আমাকে রেঁধেবেড়ে খাওয়ানো‚ ঘরের টুকটাক কাজ‚ আমার মায়ের খেয়াল রাখা আর নিয়ম করে সাড়ে তেইশ ঘন্টা ঝ*গড়া করা— এতেই হবে।” এই মানুষটার মুখে হুটহাট বউ ডাক শুনলে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা এই মানুষটার সবকিছুতে এত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছেন। বিমোহিত না হয়ে উপায় যে নেই।

……….চলবে ইন শা আল্লাহ