ভালোবাসি তারে
৭.
শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। কাঁদাযুক্ত রাস্তায় শাড়ির কুঁচি একহাতে ধরে আস্তে আস্তে জমিদার বাড়ির পথে আগাচ্ছে ঝুম। নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে তার। শুধু মাত্র নিঝুমের এটেন্সন পাওয়ার জন্য পায়ে ব্যথা নিয়েও শাড়ি পড়েছে সে। এটা কি পাগলের মতো কাজ নয়? অব্যশই! ঝুমের মা-ও তো ঝুমকে শ্রেষ্ট পাগলের উপাধি দিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। টিউশনে আসতেও মানা করেছিলেন তিনি। ঝুম শোনে নি। বরং অনেকটা চতুর বিড়ালের মতো পালিয়ে বের হয়েছে বাসা থেকে।
লোকে বলে, প্রেমে পড়লে মানুষ পাগলামি করে। তাই বলে ঝুমের মতো বাচ্চামো খুব কমই করে মানুষ। এতে অবশ্যক ঝুমের কিছু যায় আসে না। সে তাড়াতাড়ি জমিদার বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই বাঁচে। কিছুক্ষণের মাঝে পৌঁছেও যায়। বাড়ির গেটের কাছে যেতেই দারোয়ান করিম চাচা ঝুমকে দেখে বলে উঠলেন,
— “আরে মামনি? তুমি আইজকা আইলা যে? তোমার না পায়ে ব্যথা?”
নিশ্চয়ই নিধার কাজ এটা। নতুবা করিম চাচা জানলেন কিভাবে ঝুম পায়ে ব্যথা পেয়েছে? মনে মনে নিধাকে খুব করে বকলো ঝুম। তারপর মলিন হেসে বলল,
— “আসলে পায়ের ব্যথা কমে গেছে তো! তাই ভাবলাম চলে আসি।”
করিম চাচা মুচকি হেসে বললেন,
— “ওহ্! ভালা, ভালা।”
ঝুম আর কিছু না বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। শাড়ির নিচের দিকটা কেমন ভিঁজে, ভিঁজে গেছে। হাত দিয়ে সেটা ঝেরে নিলো ঝুম। ড্রইংরুমে যেতেই মিসেস সানজিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কাজের লোক মেঘলার সাথে সবজি কাটছিলেন তিনি। ঝুম বলল,
— “কেমন আছেন আন্টি?”
মিসেস সানজিদা চমকে উঠলেন। পরক্ষণে ঝুমকে দেখে হেসে বললেন,
— “ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
— “এইতো ভালো।”
— “তা আজকে কেন এলি পড়াতে? পায়ের ব্যথা কমেছে? তোকে না বললাম কয়েকদিন ছুটি নিতে?”
ঝুম হাসার চেষ্টা করে বলল,
— “পায়ের ব্যথা কমে গেছে তো আন্টি। তাই অযথা ছুটি নেই নি।”
মিসেস সানজিদা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “বুঝলাম। কিন্তু এই বৃষ্টির মৌসুমে শাড়ি পরে আসতে গেলি কেন? তোর তো পায়েও ব্যথা।”
ঝুম অপ্রস্তুত হয়ে পরল। কি বলা উচিত তার? তোতলিয়ে বলল,
— “ওই আরকি, ইচ্ছে করলো।”
মেঘলা দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল,
— “তোমার ইচ্ছা আসার আর সময় পাইলো না ঝুম দিদি। এখন বৃষ্টি হইলে তো পায়ের ব্যথার মইধ্যে আবার পিসলা খাইয়া ব্যথা পাইবা।”
বলতে বলতেই মেঘলা দম ফাটানো হাসিতে মেতে উঠল। মিসেস সানজিদাও মুখ টিপে হাসছেন। ঝুমের প্রচন্ড রাগ হলো মেঘলার উপর। ইচ্ছে করলো এখনি গিয়ে কান টেনে দিতে মেঘলার। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিলো ঝুম। অপ্রস্তুত হেসে মিসেস সানজিদাকে বলল,
— “আন্টি, নিধা কোথায়?”
— “পড়ার রুমে আছে হয়তো। গিয়ে দেখ!”
ঝুম মাথা নাড়ালো। সিড়ি বেয়ে পড়ার রুমে যাওয়ার পথে একবার উঁকি দিলো নিঝুমের রুমে। উহু! রুমে নেই নিঝুম। তাহলে কোথায় গেল? প্রশ্নটা মাথায় আসার পরপরই পেছন থেকে নিঝুমের কণ্ঠ শোনা গেল,
— “কে আপনি? আমার রুমে উঁকি দিচ্ছেন কেন?”
ঝুম চমকে উঠে। ইশ! ধরা পরে গেছে সে। এখন কি হবে? ভীতু মন নিয়ে পেছন ফিরে তাকায় ঝুম৷ সঙ্গে সঙ্গে নিঝুম বলে উঠে,
— “ঝুম? তুমি এখানে? সরি তোমাকে চিনতে পারি নি। আসলে শাড়ি পড়েছো তো!”
ঝুম জবাব দিলো না। নিঝুম এবার ঝুমের মাথা থেকে পা অব্দি পর্যবেক্ষণ করলো একবার। ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “তোমার না পায়ে ব্যথা ঝুম? শাড়ি পড়েছো কেন?”
ঝুমের ভীষণ লজ্জা লাগে। পরপর দু’জন কথাটা বলল তাকে। সে কি শাড়ি পড়ে ভুল করেছে? না পড়ে আসলেই বোধ হয় ভালো হতো। মনে মনে আফসোস করলো ঝুম। উঁচু কণ্ঠে নিঝুম বলল,
— “উত্তর কোথায়?”
ঝুম হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
— “এমনি। ইচ্ছে হলো।”
— “ওহ্! কিন্তু আজকে আসতে গেলে কেন? পা-কে একটু রেস্ট দিতে।”
ঝুম এবারো কিছু বলল না। নিঝুম জোড় গলায় আবারো বলল,
— “কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ থাকবে না ঝুম। আমার পছন্দ না।”
ঝুম ম্নাল কণ্ঠে বলল,
— “ঠিকাছে।”
বলেই নিঝুমকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো ঝুম। পেছন থেকে নিঝুম শান্ত স্বরে বলে উঠল,
— “তোমাকে কিন্তু শাড়িতে সুন্দর লাগছে ঝুম।”
ঝুম থমকে দাঁড়ায়। বুক কেঁপে উঠে তার। অদ্ভুদ অনুভূতি ছেয়ে যায় পুরো শরীরে। ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকায় ঝুম। নিঝুমের দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলে তৎক্ষনাৎ। নিঝুম হেসে বলে,
— “কারো অনুপস্থিতিতে তার রুমে উঁকি ঝুঁকি করা ব্যাড মেনার্স। মনে থাকবে তো মিস শিক্ষিকা?”
ঝুম ভেবেছিলো, নিঝুম এ বিষয়ে কিছু বলবে না। মনে মনে শান্তি বয়ে গিয়েছিল তার মস্তিষ্কে। অথচ নিঝুমের কথায় সেই শান্তিটা মুহুর্তেই চলে গেছে। তীব্র লজ্জায় মাথা আরো নত করে ফেলল ঝুম। পরপরই নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো মাথা নাড়ালো। নিঝুম নিঃশব্দে হেসে উঠে। বলে,
— “বুঝলে তো ভালোই। এখন যাও! নাহলে দেড়ি হয়ে যাবে।”
আবারো মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় ঝুম। দ্রুত সেখান থেকে চলে আসে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন। নাহলে নির্ঘাত নিঝুম তাকে নিয়ে আরো মজা করতো। যা ঝুম চায় না। মোটেও না!
পড়ার রুমে প্রবেশ করে চেয়ারে ধপ করে বসে পরে ঝুম। নিধা হোমওয়ার্ক করছিল। ঝুম সেদিকে তাকালো। লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “আমাকে একটু পানি খাওয়া-ও তো নিধা!”
নিধা তাই করে। এক দৌঁড়ে নিচে গিয়ে পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে ফেরত আসে। এক নিশ্বাসে সেই পানি পান করে ঝুম। গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই নিধা প্রশ্ন করে,
— “ম্যাম? আজকে আপনি শাড়ি পড়ে এলেন যে?”
আবার সেই প্রশ্ন! দুনিয়াতে আর কোনো প্রশ্ন কি নেই? সবার এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞেস করতে হবে? ঝুমের রাগ হতে লাগলো হঠাৎ। মিসেস সানজিদা, নিঝুম আর মেঘলার প্রতি রাগটা ঝেড়ে দিলো নিধার ওপর।
— “কেন? শাড়ি পড়ে আসতে পারবো না আমি?”
ঝুমের রাগী আওয়াজ শুনে নিধা থতমত খেয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে না, সে এমন কি ভুল বলল? মিনমিয়ে নিধা বলে,
— “আপনি তো শাড়ি পড়ে আসেন নি কখনো ম্যাম। তাই বললাম।”
— “কখনো আসি নি বলে কি এখনো আসতে পারবো না? যা করছিলে তা করো চুপচাপ! আর একটাও প্রশ্ন না।”
কুঁকড়ে যাওয়া মন নিয়ে নিজের হোমওয়ার্ক করতে লাগলো নিধা। এদিকে ঝুমেরও ভালো লাগলো না নিধাকে বকে। কিন্তু সে কি করবে? রাগ-টা হঠাৎ-ই মাথা চড়া হয়ে গিয়েছিল তার। মেঘলার ওসব আজে-বাজে কথাই এ রাগের মূল কারণ। তবে যা-ই হোক! নিঝুম তো ঝুমের প্রশংসা করলো! এতেই ঝুম সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে। তার আর কিচ্ছু লাগবে না। কিচ্ছু না!
_______________
নিধাকে পড়ানো শেষে ঝুম যখন যাওয়ার জন্য উদ্যোগ হলো, তখন বুঝতে পারলো তার পায়ের ব্যথা বেড়ে গেছে। হাঁটতে পারছে না সে। ড্রইংরুমে আসতে না আসতেই পড়ে যাচ্ছিলো ঝুম। মেঘলা তাকে ধরে ফেলে। তারপর আস্তে ধীরে সোফাতে বসায়। মিসেস সানজিদা উঁচু গলায় নিঝুমকে ডাকেন কয়েকবার। পরপরই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— “কি হয়েছে ঝুম মা? শরীর খারাপ করছে?”
ঝুম মিহি গলায় বলে,
— “পা ব্যথা বেড়ে গেছে হঠাৎ। হাঁটতে পারছি না।”
মুহুর্তেই মিসেস সানজিদার মুখে কাঠিন্য ভাব ফুটে উঠে। শাসনের সুরে বলেন,
— “বলেছিলাম না কয়েকদিন ছুটি নিতে? তবুও জেদ করে এসেছিস কেন? যদি রাস্তায় এভাবে পড়ে যেতি তখন কি হতো? বেশি বাড়াবাড়ি না? যা হয়েছে একদম ভালো হয়েছে।”
ঝুম অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে রাখে। কিছু বলে না। এর মধ্যে নিঝুমও চলে আসে নিচে। সোফায় বসে থাকা ঝুমের মুখে কাতরতা আর মিসেস সানজিদার রাগী ভাব দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “মা, কিছু কি হয়েছে? ডেকেছো কেন?”
মিসেস সানজিদা রাগী চোখে ঝুমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “আমাদের মানা করা সত্ত্বেও মেয়েটা আজকে পড়াতে এসেছে। এখন নাকি পায়ের ব্যথা বেড়ে গেছে। দেখ তো একটু!”
সঙ্গে সঙ্গে নিঝুমের জবাব,
— “পারবো না মা।”
ঝুম অবাক চোখে নিঝুমের দিকে তাকায়। নিঝুম অন্যদিকে ফিরে আবার বলে,
— “যে আমাদের কথা অমান্য করেছে, তার চিকিৎসা আমি করতে পারবো না মা। সরি!”
ঝুম অসহায় ভাবে তাকায় এবার। চোখ জলে ভরে গেছে তার। পারলে এখনি কেঁদে দেয়। মিসেস সানজিদা তা দেখে বলেন,
— “এসব বাদ দেয় এখন নিঝুম। রাগ করিস না। দেখ, মেয়েটা কেমন কাঁদো মুখ করে বসে আছে।”
নিঝুমের কাঠকাঠ কণ্ঠ,
— “কাঁদুক! তাতে আমার কি?”
— “নিঝুম! মেয়েটাকে শুধু শুধু কাঁদাস না।”
নিঝুম আড়চোখে তাকালো ঝুমের দিকে। ঝুনের নিভে যাওয়া মুখ দেখে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। গম্ভীর কণ্ঠে মেঘলাকে বলল,
— “ফাস্টএইড বক্স নিয়ে আয় মেঘলা।”
আদেশ মতে মেঘলাও ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এলো। নিঝুম হাঁটু গেড়ে বসে ঝুমের পায়ের কাছে। ঝুমের ব্যান্ডেজ খুলে আবারো নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়। তারপর একটা কাগজে কিছু ঔষধের নাম লিখে উঠে দাঁড়ায়। মিসেস সানজিদার হাতে সেই কাগজটি ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— “ঔধুষ গুলো পাঁচদিন খেতে বলবে ওকে। একদিনও যেন মিস না যায়। আর হ্যাঁ, পাঁচদিনের পাঁচদিনই যেন ওকে এ বাড়ির তৃ-সিমানায়ও না দেখি। এর দায়িত্ব কিন্তু তোমার মা।”
ঝুমের দিকে একবারও তাকায় না নিঝুম। ঝুমের প্রচন্ড খারাপ লাগে। কান্না পায়। যদি কেউ না থাকতো, তাহলে সে ঠিকই কাঁদতো! সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে নিঝুম আবারো বলে উঠে,
— “মা? ড্রাইভার চাচাকে বলে দিও ওকে বাসায় পৌঁছে দিতে।”
ঝুম নিঝুমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মাত্র।
_________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা