ভালোবাসি তারে
৩৮.
ঝুমের বাসা থেকে সরাসরি হাসপাতালে গিয়েছিল নিঝুম। এখন রাত দশটা বেজে দুই মিনিট। ক্লান্তিতে চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে সে। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই হঠাৎ শাড়ি পড়া ঝুমের লজ্জা মাখা মুখটা ভেসে উঠে সামনে। নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসে। তার এখন ঝুমকে দেখতে ইচ্ছে করছে। প্রচন্ড ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেটাকে দমাতে পারছে না সে। গায়ের সাদা এপ্রোনের পকেট থেকে ফোনটা বের করল নিঝুম। সময়টা দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর দেড়ি না করে দ্রুত বেড়িয়ে গেল কেবিন থেকে।
ঝুম মাত্রই খেয়ে-দেয়ে রুমে এসেছে। বিছানায় আরাম করে বসে পায়ের উপর বালিশ রাখল ঝুম। হাতে ফোন নিলো নিঝুমকে কল করতে। তখনই জানালার কাছে কেমন ‘কচরমচর’ শব্দ শুনতে পেল সে। চমকে উঠলো। ভয় পেল খানিকটা। মৃদু স্বরে বললো,
— “কে?”
ওপাশ থেকে পাতার কচকচে শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ঝুম আবার বললো,
— “ক-কে? কে ওখানে?”
এবারো জানালার ওপাশের ব্যক্তি নিশ্চুপ। আধো আধো ভাবে জানালায় কোনো পুরুষের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে ভয় ক্রমশই বেড়ে গেল ঝুমের। ভয়ে চিৎকার করতেও ভুলে গেল যেন। ফোনের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেতেই দ্রুত ফোনের দিকে তাকালো সে। নিঝুম কল করেছে। তৎক্ষণাত ফোনটা রিসিভ করে, নিঝুমের আগে আগেই ঝুম বলে উঠলো,
— “ডাক্তার? আপনি কোথায়? তাড়াতাড়ি পুলিশ নিয়ে আসুন এখানে। আমার রুমের জানালার কাছে একটা চোর এসেছে। আমি স্পষ্ট ছাঁয়া দেখতে পাচ্ছি।”
নিঝুম বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তাকে চোর বানিয়ে দিল? আর কি কি হওয়া বাকি তার? এদিকে ভেঁজা পাতাগুলো বার বার মুখে লাগছে নিঝুমের। বিরক্ত অনুভূত হচ্ছে। হাত দিয়ে পাতাগুলো সরিয়ে বিরক্ত সহিত বললো নিঝুম,
— “তোমার জানালার কাছে আমি দাঁড়িয়ে আছি। জানালা খুলো।”
— “কিহ্?”
অবাকের রেশ ঝুমের কণ্ঠে।
নিঝুম শান্ত স্বরে বললো,
— “মশার কামড় খাচ্ছি অনেক্ষণ যাবত। ঝোপঝাড় গুলোও বিরক্ত করছে খুব। দাঁড়াতে পারছি না। জানালা খুলো।”
এটুকু বলেই কল কেটে দিল নিঝুম। বিছানায় কয়েক সেকেন্ড থম মেরে বসে রইল ঝুম। পরক্ষণেই উঠে জানালা খুলতেই নিঝুমকে দেখতে পেল। কিন্তু অদ্ভুদ বিষয়! ঝুমকে দেখেই চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছে নিঝুম। গম্ভীর ভাবে জড়ালো গলায় বলে,
— “ও-ওড়না পড়ো ঝুম।”
সঙ্গে সঙ্গে ভড়কে গেল ঝুম। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল, সে সত্যিই ওড়না পড়ে নেই। তড়িৎ গতিতে বিছানার কাছে গিয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো। কিছুক্ষণ পর নিঝুম খানিকটা কেঁশে বললো,
— “হয়েছে?”
ঝুমের ধীর গলা,
— “হুম।”
একটু থেমে আবার বললো,
— “এত রাতে আপনি এখানে কেন এসেছেন ডাক্তার? আপনার কি শরীর খারাপ করছে? কিছু হয়েছে?”
নিঝুম প্রথমেই উত্তর দিলো না। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই জানালার দু’পাশ ধরে এক লাফে ঢুকে পরল রুমে। ঝুম হকচকিয়ে যায়। বড় বড় চোখে তাকায়। ঠোঁট হালকা ফাঁক হয়ে গেছে তার। ঝুমের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে নিঝুম খানিকটা হেসে বললো,
— “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। কি করছিলে?”
ঝুম যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মাত্র। সামান্য দেখতে ইচ্ছে করছে বলে এখানে চলে আসবে? ঝুমকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিঝুম হাসলো। গাল টেনে ধরল ঝুমের। প্রশ্ন করল,
— “তোমার বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে?”
ঝুম মাথা দুলিয়ে বললো,
— “নিলয় আর আব্বা ঘুমিয়ে গেছে। আম্মা কাজ করছে রান্নাঘরে।”
— “ওহ্!”
নিঝুম বিছানায় গিয়ে বসল। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললো,
— “রুমের দরজা ভালোভাবে লাগিয়ে দাও। আমি এখানে কিছুক্ষণ থাকবো।”
ঝুম একবার দরজা লাগাতে উদ্যোগী হতে গিয়েও হলো না। উল্টো জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কিছু খেয়েছেন ডাক্তার?”
— “না।” নিঝুমের স্পষ্ট উত্তর।
ঝুম ঠোঁট কামড়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু বলতে পারছে না। কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছে। তা দেখে নিঝুম ভ্রু কুঁচকিয়ে বললো,
— “কি হয়েছে?”
ঝুম যেন একটু সাহস পেল। তরতর করে বলে উঠলো,
— “আম্মা আজকে ইলিশ মাছের তরকারি রেঁধেছেন। আমি আপনার জন্য ভাত নিয়ে আসি? খাবেন?”
নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “তুমি খাইয়ে দিবে?”
ঝুম মাথা নাড়ায়। নিঝুম হেসে দেয়। বলে,
— “নিয়ে আসো।”
____________________
দরজাটা হালকা ভিড়িয়ে ঝুম চলে যায় রান্নাঘরে। মিসেস শ্রেয়া থালা-বাসন ধুঁচ্ছিলেন। ঝুম ভয়ে ভয়ে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিঝুমকে বলে তো দিল খাবারের কথা, কিন্তু এখন খাবার নিবে কিভাবে? সে তো মাত্রই খেয়ে রুমে গিয়েছে। ঝুমকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস শ্রেয়া ভ্রু কিঞ্চিত করে তাকালেন। বললেন,
— “কি হয়েছে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
ঝুম হাসার চেষ্টা করে বললো,
— “আম্মা, ক্ষুধা লাগছে।”
— “এই মাত্র না খেয়ে গেলি?”
— “হ্যাঁ, কিন্তু আমার আবার খেতে ইচ্ছে করছে।”
মিসেস শ্রেয়া প্লেটে সাবান লাগাতে লাগাতে বললেন,
— “তাকে দেখ বিস্কুট আছে। কয়েকটা নিয়ে খেয়ে নেয়।”
সঙ্গে সঙ্গে ঝুম নাকচ করে বললো,
— “না! আমি আবার ভাত খাবো।”
মিসেস শ্রেয়া ভ্রুটা আরো কুঁচকে তাকান। অবাক হন খানিকটা। মেয়েটা তাঁর দু’চামচের বেশি ভাত খায় না। অনেক সময় তো খাবারের নামই মুখে আনে না। আজকে কি হলো এর? প্রশ্নগুলো মনে মনেই রাখলেন মিসেস শ্রেয়া। কিছু বললেন না।
_____________________
রুমে ঢুকেই দরজা ভালোভাবে আটকে দিলো ঝুম। বিছানার দিকে নজর যেতেই দেখলো, নিঝুম বিছানায় আধ-শোয়া ভাবে বসে ফোন চাপছে। ঝুম এগিয়ে গেল সেদিকে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
— “ডাক্তার? উঠে বসুন জলদি। খাইয়ে দিচ্ছি।”
নিঝুম একপলক তাকালো ঝুমের দিকে। আলসেমী করে সময় নিয়ে উঠে বসল। ফোন চাপতে চাপতে ঠোঁটা হালকা ফাঁক করে ‘আ’ ভঙ্গিমা করল। এবং সাথে সাথেই এক লোকমা ভাত খাইয়ে দিলো ঝুম। নিঝুম চুপচাপ খাচ্ছে। ঝুম বলে,
— “কেমন হয়েছে রান্না, ডাক্তার?”
নিঝুম ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো,
— “ভালো হয়েছে।”
— “খেতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
— “না।”
কেমন গা ছাড়া উত্তর দিচ্ছে নিঝুম। ফোনের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। ব্যাপারটা ভালো লাগল না ঝুমের। বিরক্তি আর রাগ অনুভূত হচ্ছে। ফোনটা আঁছাড় মারতে ইচ্ছে করছে। হাতের প্লেটটা রেখে এক ঝটকায় ফোনটা নিয়ে নিলো ঝুম। টেবিলের এক কোণে ফোনটা রেখে দিলো। পরক্ষণেই আবারো ভাত খাইয়ে দিতে লাগল নিঝুমকে।
নিঝুম চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। ভ্রু উঁচিয়ে ডাকলো,
— “ঝুম?”
— “হু।”
— “ফোন নিলে কেন?”
তৎক্ষণাত ঝুম মৃদু ধমক দিয়ে উঠলো,
— “খাওয়ার সময় কিসের ফোন দেখা-দেখি? চুপচাপ খাবার খান।”
ঝুমের ধমক শুনে নিঝুম হাসলো বৈ রাগলো না। নাক টেনে ধরল ঝুমের। হঠাৎ-ই নরম স্বরে বলে উঠলো,
— “ঝুম? আমি তোমাকে আমার বুকের সঙ্গে পিষে ফেলতে চাই। আমার প্রতিটা নিশ্বাসে তোমার সঙ্গ চাই। আমি… আমি তোমার প্রেমিক পুরুষ হতে চাই ঝুম। আমাকে সে অধিকার দেবে?”
ঝুম লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে মুহুর্তেই। লাজুক হেসে বলে,
— “আপনি আমারই প্রেমিক পুরুষ ডাক্তার। শুধুমাত্র আমার।”
_____________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia