ভুলিনি তোমায় পর্ব-০৩

0
4817

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :৩

—ছিঃ,ছিঃ, ছিঃ!!মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলাফেরা করে এমন কান্ড ঘটাইবো যে আমি তো ভাবতেই পারি নি।

—আরে ভাবি এসব পর্দার আড়ালে আসল শয়তান লুকিয়ে থাকে।

—হ,ঠিক কইছো।যেমন মা তার তেমন মেয়ে, এলাকার পোলাপান নষ্ট করে বেড়ায়।

—আরে ভাবি কইয়েন না,এদের দেইখা দেইখা আমার আর আপনার মেয়েরাও খারাপ হয়ে যাইবো।

—মা তো গেছে জোয়ান পোলার লগে ভাইগা,না জানি এই মাইয়া আবার কী করে।

—বলি ও আশরাফ ভাই,মাইয়া তো এলাকা নষ্ট করবো।আপনার মুখে চুন কালি দেওয়ার আগে বিদায় করেন।

—এই মাইয়ারে নিবোই বা কেডা?মাইয়ার যে বিষ দেখছেন নি হাত,পা কাটে।না জানি আবার কার সংসারে গিয়া সংসার নষ্ট করবো।

পাড়ার আন্টিদের কথা শুনে আমি নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলাম আর বাবা উনাদের সাথে তর্ক করছিলেন।উনাদের বিদায় করার সময় সবাই বলে উঠলো,,,”সত্য কথা কইলে গায়ে ফোসকা পড়ে যায়,যেদিন আপনার বউয়ের মত মাইয়াও ভাইগা যাইবো সেদিন বুঝবেন।”
বাবা তাদের সবাইকে উল্টাপাল্টা বলতে লাগলেন কিন্তুু আমি চুপ করে রইলাম। ওরা তো মিথ্যা বলেনি ঠিকই তো বলেছে।বাবা কয়জনের মুখ বন্ধ করবে?সবাই তো বলবেই,তাছাড়া বিষয়টা পুরো এলাকা হয়ে গেছে।যেই আমাকে দেখেছে সেই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে নানা কথা বলেছে।
আমাদের সমাজের মানুষই এমন, কারো একটু দোষ দেখলে সেটা নিয়ে তাকে কথা শুনাতে একটুও ছাড় দেয় না।হয়তো আজ আমার জায়গা অন্য কোনো মেয়ে হলে আমিও বলতাম,এটা তো অস্বীকার করতে পারবো না।

সব বুঝি তাও মানতে পারি না,খুব খারাপ লাগে যখন এসব কথা শুনি।’কসম আল্লাহর, এত কষ্ট লাগে যা বলে বুঝাতে পারবো না।’কলিজার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যায়,মনে হয় এ অশান্তি থেকে এক মাত্র মৃত্যুই মুক্তি দিতে পারবে।

চুপচাপ বসা থেকে উঠে রুমে চলে আসলাম।দরজাটা চাপিয়ে বিছানায় গিয়ে বালিশ মুখে চাপা দিয়ে জোরে জোরে কান্না করতে লাগলাম।যদি এ কান্নার মধ্যে সব দুঃখ চলে যেতো।আচ্ছা,প্রেম করাটা কী খারাপ?আর প্রেম কী ইচ্ছে করে করে নাকী?এটা তো হয়ে যায়। যেমনটা আমার সাথে হয়েছে।আমি তো সৌরভকে ইচ্ছা করে ভালোবাসি নি।

হঠাৎ বাবা জোরে জোরে নায়লা বলে চিৎকার দিয়ে আমার রুমে আসলেন,বাবাকে দেখে আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম।বাবা দৌড়ে এসে আমার মুখের সামনে থেকে বালিশ ছুড়ে ফেলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলেন,,”মা গো মা,কেনো এমন করতেছো?তুই ছাড়া আমার কে আছে বল?তুই কেনো মানুষের কথা শুনে সুইসাইড করবি?ওদের কথায় কান দিবি না।আমি আছি তোর সাথে, আমার জন্য হলেও অন্তত এ পাপ করিস না।”
প্রথমে বাবার কথা শুনে অবাক লাগলেও পরে বুঝলাম হয়তো বাবা মনে করেছে আমি বালিশ চাপা দিয়ে মরে যেতে চাইছিলাম।আমি এবার শব্দ করে কেঁদে দিলাম।বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

–“বাবা আমাকে একটু একা থাকতে দিবে,টেনশন নিও না আমি এমন কিছু করবো না।”

বাবা কিছু বলতে চেয়েও বলেনি, মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন।বাবা যেতেই আমি বিছানার বেড তুলে ফেললাম।অপলক দৃষ্টিতে বিছানার বেডের নিচের জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এগুলো সৌরভের দেওয়া কিছু অমূল্য উপহার,,বেশি দামি কিছু নয়।জিনিসগুলো হলো সেন্টারফুটের প্যাকেট, চকলেটের প্যাকেট যা সৌরভ আমাকে দিয়েছিলো।কত না মজা করে খেয়েছিলাম।প্যাকেটগুলো ফেলতে মন চায় নি, তাই রেখে দিয়েছিলাম।(ও মা টুরু লাভ)এগুলোর দেখে আবারো কষ্ট হতে লাগলো।আবার কান্না করতে লাগলাম। রিলেশনের শুরুটা যতটা না আনন্দের হয় শেষটা ততটা কষ্টের হয়।
.
.

ফুফির বাসা থেকে দুইদিন পরেই চলে এসেছিলাম।ওই দুইদিন আমার ভেতর দদিয়ে কী গিয়েছিলো সেটা শুধু আমিই জানি।বাবার অফিস থেকে ফোন এসেছিলো তো তাই, আর বাবার চাকরী তো জরুরী নাহলে ফুফির টাকা দিবে কীভাবে?না হলে ফুফি আবার খোঁটা দিতে থাকবে।বাড়ীতে আসতে না আসতেই আশেপাশের মানুষজন চলে এসেছিলো আমাকে দেখতে।একচুয়েলী দেখতে নয় কথা শুনাতে।যার যেভাবে ইচ্ছা হয়েছে সে ওভাবে শুনাইছে। কারো কথার জবাব দেয় নি,,কী বলবো আমি?কাকে বলবো?কে শুনবে আমার কথা,কে বুঝবে আমাকে?কেউই বুঝবে না।নিষ্ঠুর এ পৃথিবীতে সাপোর্টারের অভাব পরলেও নিন্দুকের অভাব পড়বে না।

নিজেকে কিছু সময় দিয়ে মনে মনে অনেক কথা ঠিক করে বাবার রুমের দিকে যাচ্ছিলাম,ঠিক তখনই কেউ আমার চুলের মুঠি ধরে ঠাসস ঠাসস করে দুই থাপ্পর দিয়ে দিলো।গালে হাত দিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম আমার দাদী।দাদীকে দেখে আমি চমকে গেলাম,দাদী তো আমাদের বাড়ীতে আসে না চাচীর বাড়ী থাকে।দাদীর সাথে দেখি চাচীও আছে।

উনাদের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাদী হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,,” পুরো এলাকায় তো মুখ দেখানোর মত অবস্থা রাখলি না..!!মায়ের মত তুইও বেইশ্যা হইলি,,তোগো লাইগা আর কত হেনস্তা হইমু।আমার আর নাতিনরে তো বিয়াও দিতে পারুম না..!!”

দাদীর চিল্লাচিল্লি শুনে বাবা দৌড়ে আসলেন।দাদীকে আমার চুলের মুঠি ধরে রাখতে দেখে বাবা এসে আমাকে ছাড়ানোর সময় দাদীকে বলতে লাগলেন,,,”আম্মা,কি করতেছেন?ছেড়ে দেন,,, ও অসুস্থ।”

বাবা এক প্রকার জোর করেই দাদীর কাছ থেকে ছাড়ালো।আমি বাবার বুকে মাথা লুকালাম, এটা দেখে দাদী ফুসতে লাগলেন।আগের মত তেজ দেখিয়ে বলতে লাগলেন,,,”মাইয়ারে যে কলিজায় রাখতেছোস, মাইয়া কী করাবার করছে হেইডা কী জানোস না?এলাকায় তো মুখ দেখাইবার পারতাছি না।তোরে কইছিলাম,, এই মাইয়ারে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আবার বিয়া কইরা সংসার কর,না হেইডা তো হুনলি না উল্টা আমাগো লগে সম্পর্ক নষ্ট করলি।এখন দেখ মাইয়া কী কারবার করছে..!!”

কী বললো দাদী?আমাকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে বলেছে?বাট অনাথ আশ্রমে তো তারা থাকে যাদের মা,বাবা মারা গেছে বা নেই।কিন্তুু আমার মা বাবা দুজনই তো বেঁচে আছে।

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দাদীকে বলতে লাগলেন,,”মা,আপনি ওইসব কথা কেনো বলছেন?আমি ওসব একদমই শুনতে চায় না।আর এলাকার কে কী বললো না বললো সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই,আমার মেয়েই আমার কাছে বড়।”

দাদী হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগলেন,,,”এইসব কথা আমারে কইতে আইয়ো না।তোমার বউ, মেয়ে এলাকায় নষ্টামি করে বেড়াইবো আর মানুষে আমাগোরে কথা শুনাইবো এইডা তো হইবো না।আগে বউরেও এমন কিছু কইলে তুমি জবাব দিতা দেখছো তো বউ কী করছে?এখন মাইয়ারেও এমন করতেছো দেইখো মাইয়া এমন করবো।”

বাবা দাদীকে কিছু বলবে তখন দেখলো আমি কান্না করতেছি,তাই বাবা চুপ হয়ে গেলেন।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমাকে রুমে যেতে বললেন।আমিও চুপচাপ রুমে চলে আসলাম আর পিছন থেকে দাদী অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলেন।আমি নিঃশব্দে কান্না করতে লাগলাম।

হলরুমে দাদী তুমুল ঝগড়া করতেছেন বাবার সাথে আর বাবা উনাকে বারবার বুঝাতে লাগলেন।কিন্তুু উনারা বুঝতে নারাজ, আমাকে আর আমার মাকে গালিগালাজ করতেই লাগলেন।

আল্লাহ গো,,আমার কী কষ্ট কম ছিলো যে তুমি আরো কষ্ট দিতেছো?কী দোষ করেছি যে ছোট থেকেই আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন।

আচ্ছা, বিষয়টা পুরো এলাকা জানলো কীভাবে??সৌরভ আর আমার বিষয়ে তো শুধু আমি সৌরভ আর মুমু জানে তাহলে সবাই জানলো কীভাবে??ও তার মানে সবাইকে বলে বেড়িয়েছে,,সৌরভ কী সত্যি এমন করেছে?আমার লাইফে সব থেকে বেশি বিশ্বাস ওকেই করেছি আর ও সে বিশ্বাসের এভাবে মর্যাদা দিলো?আসলে তুমি ঠিকই বলেছো আমি আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম না হলে কেনো তোমাকে চিনতে পারি নি?আমি এত বোকা কীভাবে হয়েছিলাম যে তোমার ছলনা বুঝতে পারি নি।
.
.
.
সারাদিন এত ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে গেলাম যে শরীর টা আর ভালো লাগছে না।ভেতরটা খুব অস্থির অস্থির করতেছে।অসুস্থ শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই সৌরভকে জানালার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম,সাথে সাথে আমি চমকে বলে উঠলাম,,, “সৌরভভভ তুমি এখানে কেনো এসেছো??কীভাবে এসেছো?”

সোরভ জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো আমাকে ছোয়ার জন্য, কিন্তুু আমি সাথে সাথে সরে গেলাম।সোরভ অবাক হয়ে গেলো।

সৌরভ অস্থির হওয়ার ভান করে বলতে লাগলো,,”নায়লা, তুমি ঠিক আছো তো?তুমি এসব কী করেছো?আমার জন্য এমন কেনো করলে?আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবাসি,আমরা আবার রিলেশনে যাবো।আমি তোমাকে কত ভালোবাসি তুমি জানো না?”

আমি কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে সৌরভের দিকে তাকিয়ে রইলাম।ওর কথাগুলো ঠিক হজম হচ্ছিলো না।ওর অভিনয় দেখে আমি হু হা করে জোরে জোরে হাসতে লাগলাম।

সৌরভ আমাকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে গেলো।আমি চোখ মুখ শক্ত করে উল্টো ফিরে ওকে বলতে লাগলাম,,,”আপনি যে কারনে এমন অভিনয় করতেছেন, চিন্তা করবেন না আমি এমন কিছুই করবো না।আপনি এখান থেকে এক্ষুনি চলে যান না হলে আমি বাবাকে ডাকবো।”

চলবে,,,