মৃণালিনী পর্ব-১৯+২০

0
308

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৯
দিন কাটছিলো, আই এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, কিন্তু ভালো ফলের জন্য কোনো উচ্ছাস প্রকাশের জায়গা ছিলো না মৃণালিনীর। যাকে পড়াশুনাই এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় গোপনে, তার কাছে ফল প্রকাশের আনন্দের প্রকাশ মানেই তো মূর্খামি। শুধু সৌম্য যখন শনিবারে বাড়ি ফিরলো তখন হাতে করে নিয়ে এলো বাড়ির জন্যে বড়ো হাঁড়ি ভর্তি এক হাঁড়ি রসগোল্লা আর মৃণালের জন্যে রবীন্দ্র রচনাবলী।

রসগোল্লার হাঁড়ি দেখে সবাই খুশী হলেও এর পেছনের রহস্য জানার উৎসাহ কারোরই ছিলো না, কলকাতার মিষ্টির সুখ্যাতি করতেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রাতে ঘরে এসে বউয়ের হাতে বই এর সঙ্গে শ্বশুর মশাইয়ের চিঠিও তুলে দিলো সৌম্য। বাবার চিঠি পেয়ে মৃণাল যারপরনাই উচ্ছসিত হলো, চেপে রাখা আবেগ বাবার চিঠি দেখে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো।

এবার পরবর্তী পদক্ষেপ ছিলো আরও উচ্চতর শিক্ষা। সৌম্য তার প্রস্তুতির প্রথম ধাপ যে বই পত্র, তা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলো। স্বামীর সহযোগিতায় বি এ পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি শুরু হলো এরপর। বিয়ের পরে প্রায় মাস ছয়েক কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বউয়ের তকমা ছেড়ে আস্তে আস্তে বাড়ির একজন সদস্য হিসাবে জায়গা করে নিচ্ছিলো মৃণালিনী।

রাতে শাশুড়ির ঘরে থাকার সুবিধে নিয়ে নিজের পড়াশুনার সঙ্গে শ্বশুরের সম্পত্তির হিসাব নিকাশ ও নিজের আয়ত্বে এনে ফেলছিলো সে। ক্রমশই আলোকের হিসাবে করা গোলমালের মাত্রা বাড়লেও, সেটা মৃণালিনীর দৌলতে শ্যাম সুন্দরের কানেও পৌঁছে যাচ্ছিলো দ্রুত। হিসাবে দক্ষ হয়ে ওঠা বৌমার ওপর আরো বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন শ্বশুর মশাই, কিন্তু সবটাই পারুল বালার অজান্তে।

পারুল বালা যার যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চলতেন, তাঁর মূল পরামর্শ দাত্রী সেই হারুর মায়ের ক্ষমতাই ছিলো না মৃণালিনীর মতো মেয়েকে জব্দ করার। কুমুদের ক্ষেত্রে যে নিয়ম নীতি পারুল বালা প্রয়োগ করেছিলেন সেগুলি তিনি মৃণালের ক্ষেত্রেও চেষ্টা করতেন। কিন্তু মৃণালিনী কুমুদ ছিলো না, তাই সে কোনোদিনও তার শাশুড়ির মতো স্বামীর কাছে অভিযোগের চেষ্টাই করে নি। পারুল বালা তাকে পুজো দেওয়া, ফুল তোলা, হেঁসেলের রান্নায় সাহায্য, ইত্যাদি সংসারের কাজের মধ্যে আটকে রেখে, বিভিন্ন রকমের কটু কথায় উঠতে বসতে অপমান করে, নিজেকে গিন্নি দেখানোর চেষ্টা করতেন।

কিন্তু মৃণালিনী সেগুলো গায়ে মাখতো না, তার আসল উদ্যেশ্য ছিলো, বড়ো মা কে জানতে না দিয়ে নিজের কাজগুলো সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করা, সেগুলো যে নির্বিঘ্নে হয়ে যাচ্ছিলো তাতেই সে খুশি ছিলো। প্রতি মুহূর্তে যেকোনো কটু কথা শোনার সময় সে শুধুই সৌম্যর বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করতো, সংসারে সব কিছু গায়ে মাখতে নেই।কিন্তু মৃণালিনীর এই যে গায়ে কথা না মেখে কাজ করে যাওয়া এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না পারুল বালা, ছোটো জা যেমন তাঁর কথায় ওঠে আর বসে, ঠিক সেই জিনিস তিনি মৃণালের কাছেও আসা করতেন।

কিন্তু সৌম্য বা দেওরের কাছে অভিযোগ করার জন্যে কিছু প্রমাণ দরকার, সেই ধরনের কোনো প্রমাণ তিনি পাচ্ছিলেন না। মৃণাল মুখরা নয়, সে বড়ো মার মুখে মুখে জবাব দেয় না, কোনো কাজ যা তাকে বলা হয় সে কোনো প্রতিবাদ না করেই করে, কিন্তু তার সব কাজের পরেও যে সে পারুল বালার হাতের পুতুল নয়, এটা তার হাবে ভাবে ফুটে ওঠে। কিন্তু হাবে ভাবে ফুটে ওঠা তো আর কাউকে দেখানো যায় না! সেটা শুধু তিনিই অনুভব করেন, প্রমাণ হিসেবে সেটা গ্রাহ্য হয়না কোনোদিনও।

তাই নিজের অসহায়তা, ক্ষোভ তাঁকে আরও বেশি করে মৃণালের ওপর ক্ষুব্ধ করে তোলে, তিনি আরো নতুন নতুন বুদ্ধি বার করার চেষ্টা করেন। করুণা আসার পরে বউ কে সৌম্যর কাছ থেকে দূরে রাখার এক সুবর্ন সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, কিছুতেই সারা দিনেও তিনি মৃণাল কে ওপরে ওঠার সুযোগ দিতেন না। কিন্তু মৃণালিনী কোনো দিনও তাঁর কোনো প্রতিবাদ করেনি, বড়মার কথার সে একটুও অবাধ্য হয়নি কখনো।

শনিবার দিন সৌম্য বাড়িতে আসার পর থেকে সোমবার সকালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত, সে রাতে শুতে যাওয়া ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যেও দোতলায় স্বামীর ঘরে যেতনা। কিন্তু তার ফরমাশ এর ঠ্যালায় করুণার জীবন ওষ্ঠাগত হতো, এক মুহূর্তের জন্যেও সে দুদণ্ড শান্তি তে বসতে পারতোনা কোথাও। কখনো তার চিরুনি, চুলের ফিতে, কখনো শাড়ি কাপড়, এসব ঘর থেকে বয়ে নিয়ে আসতে আর রাখতে যেতে গিয়ে পায়ে ব্যথা হয়ে যেতো করুণার। তার পরে তো সৌম্যর ফরমাশ ছিলোই, যেগুলোর জন্যেই বড়ো মা তাকে দোতলার দাদার ঘরের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।

শেষে আর না পেরে একদিন পারুল বালার কাছে কেঁদে পড়েছিলো করুণা, আর সে এতবার দোতলায় যেতে পারছেনা! প্রচণ্ড রেগে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন বউ কে,

হ্যাঁ গো বউমা, বলি এবার কি করুণা তোমার জন্যেই ছুটে মরবে সারাদিন! ওর কি আর কোনো কাজ কম্ম নেই গা! নিজের জিনিসগুলো তো একটু নিজে গিয়েই নিয়ে আসতে পারো নাকি!

কোনো উত্তর না দিয়েই আস্তে করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলো মৃণালিনী, আর কোনো ফরমাশ সে করুণা কে করেনি এরপরে। শুধু সারাদিনে যে নিজের জিনিস আনতে কতবার তার পর থেকে সে ওপরে যায়, পারুল বালা গুনে ওঠাও ছেড়ে দিয়েছেন আজকাল। বিশেষ করে রবিবার দিন যেনো তার ওপরে নিজের কাজ শেষই হয়না আর। কিন্তু এসব তো আর অভিযোগ জানানোর বিষয় হতে পারেনা, তিনি তো নিজেই বউমা কে নিজের কাজ নিজে করে নিতে বলেছেন, তাই চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার আছে তাঁর!

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে একবার একটা সুযোগ তিনি পেলেন। সেদিন ছিলো শুক্রবার, রাতে যথারীতি শ্বশুরের ঘরে বসে হিসেব নিকেশ দেখার পরে লন্ঠন শাশুড়ির ঘরে নিয়ে এসে গল্পের বই পড়ার অছিলায় পড়ার বই খুলে বসেছিলো মৃণালিনী, এমন সময় পুকুরে জাল ফেলার আওয়াজ হলো। গ্রামে থেকে থেকে এতদিনে বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে মৃণাল, সে হাতের লন্ঠন কে কমিয়ে নিয়ে পা টিপে টিপে এসে পুকুরের ধারের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় পুকুর ধারের নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে ঢোকা আলোয় সে বেশ কয়েকজন লোককে নিঃশব্দে জাল ফেলতে দেখলো।

তার প্রবল চিৎকারে আশে পাশের বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এলো, এ বাড়িতেও সবাই উঠে পড়লো, চোর ধরতে না পারলেও তাদের ফেলে যাওয়া মাছ যা ছিলো তাতে আগামী দুদিন গোটা গ্রামের লোক খেতে পারতো। সেই মাছ তুলে আনা, ভাগ করা, পুকুরের পাড় এবার ঘিরে দেওয়া হবে কিনা এইসব বিভিন্ন কথা তে যে কখন সকাল হয়ে গেলো কেউ বুঝতে পারলো না।

সব পর্ব মিটে যাওয়ার পর সেদিন সবাই দুপুরে খেয়ে ঘুমোতে গেলেন, ছাদের মজলিশ সেদিন বন্ধ রইলো। সন্ধ্যে বেলায় সৌম্য কলকাতা থেকে ফিরলো, রাস্তায় আসতে আসতে বউয়ের চোর ধরার গল্প সে ড্রাইভারের কাছে শুনেছিল ইতিমধ্যেই, তাই সেদিনের সান্ধ্যকালীন চায়ের আসরে একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। কিন্তু পারুল বালা গম্ভীর হয়ে রইলেন, রাতে তিনি মৃণালের হাতে জ্বলন্ত লন্ঠন দেখেছিলেন, এমনকি তার ঘরে খোলা বই রাখা ছিলো সেও তাঁর নজর এড়ায়নি।

কি হলো বড়মা? তুমি গম্ভীর কেনো?

সৌম্যর প্রশ্নের উত্তরে আচমকাই দুচোখে জল এলো পারুল বালার,

আমি কে বাছা! তোমাদের সংসার, তোমাদের বাড়ি, আমি এখানে গলগ্রহ বই তো নই! কবে আমাকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়, সেই অপেক্ষাতেই আছি!

দৌদন্ডপ্রতাপ বড়ো মার চোখে জল, মুহূর্তের মধ্যেই সৌম্যকে নরম করে ফেললো, আজ পর্যন্ত সে কোনোদিনই কাঁদতে দেখেনি পারুল বালা কে।

কি হয়েছে বড়ো মা? কে তোমায় অপমান করেছে? বলো আমাকে!

এর অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি, তাঁর চোখের জল যে সৌম্যর খারাপ লাগবে, মনে মনে বিলক্ষণ জানতেন,

তোমার বউ গো! একটা কথাই তো অনুরোধ করেছিলে তুমি, মাথা যেনো সে না ঘামায় এসব জমি জমায়, তা সেতো স্বামীর কথায়ও কান দেয়না দেখলাম। যে বউ তার স্বামীকেই সম্মান করে না, সে যে আমাকে করবে, সে আশা আমি রাখিনা বাছা। কাল নেহাত চোরের খবর পেয়ে তাকে দেখলুম, না হলে তো জানতেই পারতুম নে বাবা!

সৌম্য সত্যি অবাক হয়ে গেলো, সে বাবা কে গিয়েও বারণ করে এসেছিলো, তারপরেও মৃণাল আবার এসবের মধ্যে ঢুকেছে! সে তো তার কোনো আবদার ফেরায় না, যথা সাধ্য চেষ্টা করে সব ইচ্ছে পূরণ করার, আর তার একটা কথা মৃণাল রাখতে পারলো না! এতো বার কলকাতায় থাকার সময়ে এই সব ছোট খাট বিরোধ গুলো সে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলো মৃণাল কে তার পরেও মৃণালের এইরকম নির্বুদ্ধিতা তাকে বিরক্ত করে তুললো।

তুমি আবার এসবের মধ্যে ঢুকেছো! তোমাকে আমি তো বারণ করেছিলাম, তাই না?

আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে ওখানে সবার সামনেই চিৎকার করে উঠলো সৌম্য, মৃণালিনী তাকে সম্মান করে না, তার বলা কথার কোনো দাম নেই তার স্ত্রীর কাছে, বড়ো মার বলা এই কথাগুলোই তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলার জন্যে যথেষ্ট ছিল। মৃণাল মাথা নিচু করে বসে রইলো, এই মুহূর্তে যে সৌম্য কে কোনো কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা, তা স্বামীর রাগ দেখেই বুঝতে পারছিলো সে।

সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে শুকনো মুখে নিজের কাজ করছে মৃণালিনী, এ দৃশ্য পারুল বালা কে বড়ই তৃপ্তি দিলো। অনেকদিন থেকে এই মুখটি দেখার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সান্ধ্যকালীন চায়ের আসর ছেড়ে সৌম্য কাল উঠে গিয়েছিলো তৎক্ষণাৎ, রাতে কোনো রকমে বড়ো মার সাধাসাধি তে খেতে নেমেছিলো শুধু।

হেঁসেল মিটিয়ে ঘরে ঢুকেই মৃণাল স্বামীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো, বার বার বলেছিলো সে নিজের ইচ্ছেই যায় নি, শ্বশুর মশাই তাকে ডেকেছিলেন।

তুমি বোধহয় আমার বলা কথাগুলো বোঝনি মৃণাল, তুমি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছো! বাবার যদি প্রয়োজন থাকে তাহলে সেটা তাঁকেই বড়ো মা কে বলতে দাও! আমার বাবা কে আমি চিনি, তিনি তাঁর প্রয়োজনের জন্য সব কিছুই করতে পারেন।

বাবার ঘরের লণ্ঠনে তেল বেশি থাকে, আমার পড়তে সুবিধে হয়! আমাদের লণ্ঠনের তেল তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়!

স্বামীর বিরক্ত গলায় বলা কথার উত্তরে বলেছিলো মৃণালিনী, সৌম্য আরও বিরক্ত হয়েছিলো।

তুমি কি মনে করো, তুমি লুকিয়ে হিসেব দেখছো এটা জানার পর আর বড়ো মা তোমাকে ওই ঘরে যাবার সুযোগ দেবেন?

এবার সত্যিই ভয় পেয়েছিলো মৃণাল, এরপর কিভাবে চলবে তার পড়াশোনা!

বউয়ের ভীত মুখ দেখে এতক্ষনে একটু হলেও মাথা ঠান্ডা হয়েছিলো সৌম্যর,

সব ব্যাপারেই এত সহজে ভেঙে পড়তে নেই! সমস্যা থাকলেই তার সমাধানও থাকবে, তোমাকে আগেই বলেছি। আপাতত আমার বড়ো টর্চটা থাকলো, সামনের সপ্তাহে আরও কিছু ব্যাটারি এনে দেবো। কিন্তু এসব ব্যাপারে আর মাথা ঘামিও না, তাতে তুমি তোমার নিজের কাজ করতে পারবে না ঠিক মতো। অকারণে শত্রু বাড়াতে নেই!

স্বামীর সঙ্গে গোলমাল মিটে গেলেও মনের ভেতরের খুঁত খুঁত ভাবটা যাচ্ছিলো না তার, আলোকের হিসাবের ওপর আর তার কোনো আস্থা ছিলো না। কিন্তু এবার সে কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু সৌম্যর কথায় যুক্তি আছে, নিজের কাজ নিশ্চিন্তে করতে গেলে তাকে বড়ো মার বিরাগভাজন হওয়া চলবে না কিছুতেই।

পরের দিন কলকাতা ফিরে যাবার সময়, সবাই নিচের বারান্দায় সৌম্য কে বিদায় জানানোর জন্যে দাঁড়িয়েছিলো, মৃণালিনী যথারীতি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো, করুণা তাকে এসে ডাকলো,

বউ দিদি, শিগগির নিচে চলো, তোমাকে দাদা ডাকছেন,

আজ পর্যন্ত বড়ো মার নির্দেশ মেনেই স্বামীর ফেরার সময় সে নিচে নামেনা, আজ এমন কি হলো! একটু অবাক হয়েই নিচে নেমে এলো মৃণাল।

আমি বড়ো মা কে কথা দিয়েছি, তুমি আর কখনো জমি জমার বিষয়ে মাথা ঘামাবে না, আজ ওনার সামনেই আবার তোমাকে বলে দিলাম, মনে রেখো,

স্বামীর কথায় ঘাড় নাড়লো মৃণাল, বড়ো মার মুখের উৎফুল্ল ভাব তার নজর এড়ালো না, তার দিকে ঘুরলেন পারুল বালা,

আজ থেকে আবার আগের মতো তুমি আর সরমা তোমার ঘরেই থেকো, শাউড়ির ঘরে থাকার আর দরকার নেই কো! ওই রাতে শোয়াই আসলে যত নষ্টের গোড়া! আর একজন তো দু চোক মুদেই থাকেন, ঘরের মধ্যে যে কি হয়, তিনি কিছুই নাকি জানতে পারেন নে!

শেষের কথাগুলো তিনি ছোটো জা কে লক্ষ্য করে বললেন, শাশুড়ির সাহায্য ছাড়া যে এগুলো মৃণালের পক্ষে সম্ভব ছিলনা, তা তিনি ভালোই জানেন।

মৃণাল অবাক হয়ে গেলো, বড়ো মা তাকে আর ওই ঘরে যেতে দেবেন না, সৌম্যর এই ধারণা যে কতো টা সঠিক ছিলো, এই মুহূর্তে সেটা বুঝতে পারছিলো সে, আর টর্চ রেখে যাবার জন্যে মনে মনেই কৃতজ্ঞ হচ্ছিলো স্বামীর কাছে।

সৌম্য কে বিদায় দেবার জন্যে শ্যাম সুন্দর ও ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর ছেলে কে বলা কঠিন গলার স্বরে এবার সবাই চমকে গেলো,

এবার থেকে তাহলে শনিবার করে বাড়ি ফিরে তুমিই আমার সঙ্গে বসবে! শুধু আলোকের ভরসায় তো এসব ছাড়া সম্ভব নয়! ঘরের ভেতরে বসে বউমা হিসাব দেখেন তাতে তোমারই বা অসুবিধা কি?

শেষের কথাগুলো বৌদির উদ্যেশ্যে বললেন তিনি, সৌম্যর তো নিজের কোনো আপত্তি ছিল না তাই সে বড়ো মার মুখের দিকে তাকালো।

যে সব বোঝনা সেসব জায়গায় মাথা গলাও কেনো! তোমাকে তো আমি এসব কথায় কথা বলতে বলিনি বৌদি! সংসার তোমার, তুমি সেটা নিয়েই থাকো না!

পারুল বালা চুপ করে গেলেন, শ্যাম সুন্দর এক কথায় তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করলেন। আসল কর্তা যে তিনিই, তাঁর ঠিক করা সীমানার মধ্যেই যে পারুল বালা কে থাকতে হবে এটা বুঝিয়ে দিয়েই কথা শেষ করলেন তিনি।

তুমি এখন এসো, আর দেরি করলে ট্রেন পাবে না, এসব বিষয়ে তোমার কিছু বলার দরকার নেই!

বাবার কথার উত্তরে আর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না সৌম্য, গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসে বউয়ের দিকে তাকালো,

আমার টর্চটা টেবিলের ওপর ফেলে এসেছি বোধ হয়,

আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি,

দৌড়ে দোতলার নিজের ঘর থেকে সৌম্যর কালকে রেখে যাওয়া টর্চটা নিয়ে এলো মৃণাল, ওটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তার, হাসি চেপে রাখা কষ্টকর হচ্ছিলো তার পক্ষে। স্বামীর হাতে টর্চটা তুলে দিয়ে তার দিকে তাকালো মৃণালিনী, এখানে সামান্য টর্চের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যে দৃশ্য সংগঠিত হলো তা বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের স্বামী, স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির ছিলো না।

মৃণালের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো, মনে মনেই হাসলো সৌম্য, তার বাবা কে তার থেকে বেশি আর কেই বা চেনে! নিজের স্বার্থের বাইরে তিনি কিছুই বোঝেন না। তিনি যে আবার বউমা কে ডেকে নেবেন, এতো তার জানাই ছিলো। নিজের অতি সরল, সংসার অনভিজ্ঞ বউয়ের জন্য করুণা হতে লাগলো তার। মৃণাল ক্রমশ বিস্মিত হতেও ভুলে যাচ্ছিলো, সৌম্যর প্রতিটা কথা মিলে যেতে দেখে তার মুখে কথা সরছিল না।

পারুল বালা মনে মনে আফসোস করতে লাগলেন, সৌম্য তাঁকে কথা দিয়েছিলো আগেই যে তার বউ আর এসব বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। তিনিই তাকে সামনে ডেকে এনে নতুন করে কথা দেওয়ার জন্যে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন সৌম্যর নাম করে, কিন্তু সেটা যে এই মুহূর্তে তাঁর দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে সেটা তিনি একটুও বুঝতে পারেন নি।
ক্রমশ

#মৃণালিনী
#পর্ব ২০
সেদিনের ঘটনায় মৃণালিনীর আরও সুবিধা হলো, যে সব কাজ এতদিন সে বড়ো মার অগোচরে লুকিয়ে করছিলো সেগুলো প্রকাশ্যেই করতে লাগলো। আসতে আসতে জমি জমা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য তার নখ দর্পণে চলে এলো। মাঝে মাঝেই সে বড়ো মার বারণ সত্তেও বিভিন্ন প্রয়োজনে আলোকের সঙ্গেও কথা বার্তা বলতে লাগলো। পারুল বালা ক্রমশই তাকে বশে রাখার চেষ্টা ছেড়ে দিতে লাগলেন। কিন্তু সংসার বশে রাখতে গেলে একদম সব কিছু ছেড়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না, তাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে লাগলেন তিনি।

সেদিন ছিলো বুধবার, সকাল থেকেই পুকুরে জাল ফেলা চলছিলো, আবার বিভাকে পাত্র দেখতে আসবে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পাত্র তাকে দেখে গিয়েছে, আর প্রতিবারই পড়াশুনা না জানার জন্যেই সে সম্বন্ধ ভেস্তে গিয়েছে। শুধু বিভা নয়, এই সমস্যার মুখোমুখি এই গ্রামের বেশ কয়েকটি মেয়েই হয়েছে ইদানিং, সব পাত্র পক্ষই আজকাল শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে দিয়ে চায়।

তবে, এই ছেলেটি কাছকাছি গ্রামের, আশা করা যাচ্ছে, বিভার পড়াশুনা না জানা এক্ষেত্রে খুব বেশি অন্তরায় হয়ে উঠবে না!

মৃণাল দোতলার তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়েই পাত্র কে বিভাদের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখলো, বেরোনোর সময়ে ছেলেটি তার দিকে মুখ তুলে তাকালো, মুখ টি যেনো খুব চেনা লাগলো মৃণালের! কয়েক মুহূর্ত দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে, উচ্ছসিত হয়ে উঠলো মৃণালিনী, সুভাষ! কলেজের সহপাঠী সুভাষ কে এখানে দেখে এতটাই খুশি হলো মৃণাল, যে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেলো এটা তার শ্বশুর বাড়ি এবং পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলা বড়ো মা কিছুতেই মেনে নেবেন না!

দোতলা থেকে ছুটে নেমে এসে বাইরের দরজায় পৌঁছে গেলো মৃণালিনী, কেমন দেখলো সে বিভাকে জানতে চাইলো। সবই ভালো শুধু পড়া শোনা না জানার জন্যেই যে সমস্যা, জানালো সুভাষ।

বিভা কিন্তু খুব ভালো মেয়ে, পড়া শোনা তো যেকোনো সময় শিখে নেওয়া যায় তাইনা? সে তুমি নিজেই বিয়ের পরেও শিখিয়ে নিতে পারো,

বন্ধু মৃণালিনীর কথায় একটু থমকালো সুভাষ,

হ্যাঁ, আমার খারাপ লাগেনি তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। আসলে মেয়েটির বাবা একটু অহংকারী, উনি ওনার অশিক্ষিত মেয়ের বিকল্প হিসেবে আমাকে প্রচুর পণের প্রস্তাব রেখেছেন। তুমি তো জানো আমি এর ঘোর বিরোধী। আমার বাবার এতে আপত্তি নেই, উনি এখনও পুরনো ধ্যান ধারণা গুলোকেই আঁকড়ে আছেন। কিন্তু আপত্তি আমার, যদি উনি বলতেন যে মেয়েকে শিক্ষিত করে নিতে হবে তাতে আমার আপত্তি হতো না। কিন্তু উনি মেয়ের মূল্য নির্ধারণ করেছেন পণ দিয়ে, সেটা আমি চাই না!

সুভাষের কথায় যুক্তি ছিলো, মৃণালিনী চুপ করে রইলো,

তবে তুমি যখন বলেছো ভেবে দেখবো একবার,

মৃণাল কে চুপ করে থাকতে দেখে নিজেই বললো সুভাষ, একটু হলেও শান্তি পেলো মৃণাল, বিভা বাস্তবিকই ভালো মেয়ে!

দুজনের উচ্ছসিত কথার আওয়াজে আশে পাশের বাড়ির লোকজনও বেরিয়ে এলো দেখতে। তাদের দেখেই লজ্জিত হলো মৃণাল, এই খবর এক্ষুনি বাড়িতে পৌঁছে যাবে, এবার দ্রুত সুভাষ কে বিদায় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে এলো সে। কিন্তু ততোক্ষনে যা হবার তাই হয়ে গেছে, বাড়ির মধ্যে দক্ষ যজ্ঞ বাধিয়ে দিলেন পারুল বালা।

সেই ঘটনার রেশ চললো শনিবারও, সৌম্যর শুধু বাড়িতে ঢোকার অপেক্ষা ছিলো, পারুল বালা তার কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বউয়ের অপরাধের ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন।

কোনো লজ্জা সরম নেই গা! অন্য বাড়ির মেয়ে কে দেখতে আসা পর পুরুষের সামনে, ঘোমটা ছাড়াই ছুটে বেরিয়ে গেলো! এই নাকি শিককিত! অমন শিক্কের মুকে আগুন! গোটা পাড়ায় ছি ছি পড়ে গেছে গা! চৌধুরী বাড়ির সম্মান বলতে আর কিছুই রইলো নে!

সৌম্য চুপ করে থাকলো, সে যথেষ্টই প্রগতিশীল, এইসব ব্যাপারে বউয়ের বিচার করার কোনো ইচ্ছেই তার ছিলো না। সেও তো নিজেই একসময় মৃণালিনী কে দেখার জন্যেই স্যারের বাড়িতে প্রতিদিন যেতো! সেখানে স্যারের যত ছাত্র আসতো তারা সবাই তো কোনো না কোনো অজুহাতে মৃণালের সঙ্গেই কথা বলতে চাইতো, সেও তো বিভিন্ন অজুহাতে কম কথা বলেনি তখন। সেই সময় পুরুষের সাথে কথা বলায় যদি আপত্তি না থেকে থাকে, তাহলে এখন সহপাঠীর ক্ষেত্রে থাকবে কেনো!

এতো কথা বলা সত্বেও সৌম্যর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে, রেগে আগুন হলেন পারুল বালা, এবার তাঁর সব রাগ দেওর পো র উপরেই পড়লো!

বলি, তোমাকে কি এসব কতা আমি গল্প কওয়ার জন্যে কয়েছি বাছা! আর কতো কাল বউ এর আঁচল ধরা হয়ে থাকবে! শিক্কিত হয়ে যে তোমার বউ ধরা কে সরা জ্ঞান করছেন! এর কিছু একটা ব্যবস্তা আজ তোমায় করতেই হবে, এই কয়ে দিলুম।

বড়ো মা! একসঙ্গে কলেজে পড়াশুনা করেছে, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে তো কথা বলবেই, তাই না! এতে এতো হৈ চৈ করারই বা কি আছে? তুমি সব সময় বড্ড রাগ দেখিয়ে ফেলো!

বিরক্ত গলায় বললো সৌম্য। এই প্রথম বার পারুল বালার কথার বিরুদ্ধে কথা বললো সৌম্য সুন্দর, দেওর পো র এই ধৃষ্টতায় অবাক হয়ে গেলেন পারুল বালা। প্রথম রাতেই বিড়াল বধ করতে হবে, না হলেই সংসার তাঁর হাতের মুঠোর বাইরে বেরিয়ে যাবে বুঝেই, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি, ঘোষণা করলেন বউ এর শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি জল টুকুও মুখে তুলবেন না।

অসহায় সৌম্য চুপ করে বসে রইলো, বউ এর শাস্তির ব্যবস্থা করা কোনো মতেই সম্ভব ছিল না তার পক্ষে, এই তুচ্ছ ব্যাপারে মৃণাল কে কিছু বলার ইচ্ছে, একটুও তার ছিলো না। রাত বাড়ছিলো, পারুল বালা খান নি বলে বাড়িতে সবাই না খেয়েই বসে ছিলো, শেষ পর্যন্ত মৃণালিনী নিজেই তাঁর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো।

আমায় কি শাস্তি দিতে চান বলুন? বাড়িতে সবাই আপনার জন্যে না খেয়ে বসে রয়েছে, যা শাস্তি দেবার তাড়াতাড়ি দিন, সবার খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে!

দয়া করে শাস্তি নিতে এয়েচো! যাও বাছা, তোমাকে মুক্তি দিলেম! আর কোনো দিনও তোমার কতায় কতা কইতে যাবনে! এবার থেকে তুমি নিজের ইচ্ছেতেই চলবে। পারুল বালা কারুর দয়ার পাত্রী নয়! কেউ আমাকে দয়া করবে এ আমি বেঁচে থাকতে সহ্য করতে পারবো নে!

শেষের কথাগুলো একটু যেনো অন্য রকম শোনালো, কেমন যেনো অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো তাঁর গলায়। পারুল বালা তার পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কোনো কথা আর না বলেই খেতে বসলেন, মৃণালের দিকে ফিরেও তাকালেন না আর। কুমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকেও হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। অত মানুষ এক সঙ্গে খেতে বসা সত্বেও ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো।

রাতে ঘরে শুয়ে মৃণালিনীর ঘুম আসছিলো না, বড়ো মার কথাগুলো যেনো মনের ভেতরে তোলপাড় করছিলো। সে কি অনিচ্ছাকৃত ভাবেই খুব আঘাত সত্যিই দিয়ে ফেললো বড়ো মা কে! তার কথার মধ্যে কি সত্যিই দয়া দেখানো প্রকাশ পাচ্ছিলো? দাপুটে বড়ো মা কে যেনো অনেক অসহায় লাগলো আজ!

বড়ো মা একটু কড়া কথা বলেন, সেতো তুমি এতদিনে জেনে গেছো মৃণাল! এখনও কেনো ভাবছো সে সব নিয়ে!

অসহায় গলায় বললো সৌম্য,বউ কে চুপ করে থাকতে দেখে মনে মনেই নিজের অসহায়তার জন্যে লজ্জিত হচ্ছিলো সে। বড়ো মার এই সব প্রাচীন ধ্যান ধারণা কে সে একটুও সমর্থন করে না, কিন্তু সামান্য প্রতিবাদ করার পরই বড়ো মা যে এতোটা প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সে সেটা একটুও ভাবে নি। বউ বড়ো মার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে, এটা অন্তত আজকের দিনে সে একটুও চায় নি। তারপরেও নিজের ইচ্ছেই মৃণালিনী গিয়েছে, এখন তার শুকনো মুখ তাকে কষ্ট দিচ্ছিলো।

আচমকাই স্বামী কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো মৃণালিনী, তার আসল কারণটা বোঝা সৌম্যর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সে বউয়ের অপমানের কথা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছিলো, কিন্তু মৃণালের কষ্টের কারণ অন্য ছিলো। দাপুটে বড়ো মার বলা শেষের কথাগুলো তাকে পীড়া দিচ্ছিলো। একজন মাতৃসমা মানুষ কে নিজের অজান্তে অপমান করে ফেলে তার মনের ভেতরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো। তার শিক্ষা, তার রুচি এই অন্যায্য কাজটা করে ফেলার জন্য মনে মনে তাকেই দায়ী করছিলো প্রতিক্ষনে আর নিজের কাছে নিজেই ছোটো হয়ে যাচ্ছিলো সে।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বড়ো মার ঘরের দরজায় উপস্থিত হলো মৃণালিনী,

আমি কাল খুব খারাপ ভাবে আপনার সঙ্গে কথা বলে ফেলেছি বড়ো মা, আমাকে ক্ষমা করে দিন!

পারুল বালা জপ করছিলেন, হাতের মালা ঘোরাতে ঘোরাতে তাকে ঘর থেকে চলে যেতে ইশারা করলেও ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো মৃণালিনী, জপ শেষে তাকালেন পারুল বালা,

মাফ আমি তোমায় কালই করেচি বাছা! আর নতুন করে কোনো কতা কবার নেই!

না, বড়ো মা, এ আপনার রাগের কথা! অন্যায় করলে নিশ্চয়ই বকবেন, কিন্তু এভাবে দূরে সরিয়ে দেবেন না!

অন্যায় করেচো যে মানো তালে!

মৃণাল ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, বড়ো মা, মানি! সুভাষের সঙ্গে কথা বলেছি বলে অন্যায় করেছি, এটা মানিনা, তবে আপনার সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলা আমার উচিত হয়নি, এটা মানি! তাই সারারাত ঘুমোতে পারিনি, সকালেই আপনার কাছে ছুটে এলাম।

গিন্নী হতে চাও? আমার সংসারের দখল নিতে চাও?

না, বড় মা, সংসার আপনারই, তার দখল নিতে চাই না, আমি শুধু আমার অধিকারটুকুর কথা বলতে চাই। আপনিও এ বাড়ির বউ, আমিও তাই, আপনি বাইরের কারোর সঙ্গে কথা বললে দোষ যদি না হয়, তাহলে আমার ক্ষেত্রে হবে কেনো? আমি জানি আপনিও মনে মনেই সেটা মানেন, হয়ত মুখে বলেন না। ছোটো থেকে আমার মা ছিলোনা তাই আপনাদের নিজের মায়ের জায়গাই দিয়ে এসেছি সব সময়। আপনার বকুনি তে আমি রাগ করি না বড় মা, কিন্তু অন্যায় না করেও বকুনি খেলে কষ্ট পাই। আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই তো বাইরের লোকের সমালোচনা সহ্য করেন না। সুভাষের সাথে কথা বলেছি বলে যদি পাড়ায় সমালোচনা হয় তবে যে আপনিই সবার আগে প্রতিবাদ করবেন সেটাও জানি। তাই আপনাকে কোনো সময় ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করতে চাইনি, তবু কালকের আমার করা ব্যবহারে আপনি কষ্ট পেয়েছেন সেটা আমাকেও খুব কষ্ট দিয়েছে বড়ো মা।

এই প্রথম কোনো কথা না বলেই মৃণালের মুখের দিকে, পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন পারুল বালা, তাঁর বজ্র কঠিন, অজস্র আঁকিবুকি কাটা মুখ আস্তে আস্তে নরম হয়ে এলো। খাটের নিচে রাখা ফুলের সাজি হাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মৃণালিনী, ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার পর থেকেই, বুকের ভেতরের জমে থাকা চাপ ব্যথাটা একটু একটু করে হালকা হয়ে যাচ্ছিলো।
ক্রমশ