মৃণালিনী পর্ব-২২+২৩

0
312

#মৃণালিনী
#পর্ব ২২
গ্রাম ক্রমশ শহরের দিকে এগোচ্ছিল, ছেলেরা বাইরে থেকে শিক্ষিত হয়ে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের পরিবেশ বদলে যাচ্ছিলো। নতুন স্কুলের উদ্বোধনে সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের আগমন উপলক্ষ্যে গ্রামের মেঠো রাস্তায় পিচের আস্তরণ পড়লো। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবই এই সব উন্নতি কে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো।

সকাল থেকেই সাজো সাজো রব পড়ে গেলো বাড়িতে, স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাবেন শ্যাম সুন্দর। আশে পাশের কয়েক ঘর মানী গুণী মানুষ রাও নিমন্ত্রিত এখানে, তবে শ্যাম সুন্দরের কদরই আলাদা কারণ জমি তিনি দিয়েছেন এবং স্কুলের নামকরণ তাঁর বাবার নামেই। গর্বিত শ্যাম সুন্দর আত্মপ্রচারের কোনো সুযোগ কখনই ছাড়েন না, তিনি বাড়ির সবাইকেই সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য হুকুম জারি করলেন। পারুল বালা এসব ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী কোনো দিনই ছিলেন না, কুমুদও তাঁরই সঙ্গ ধরলেন, তাই শেষ পর্যন্ত সরমা এবং মৃণালিনী তাঁর সহযাত্রী হলো।

ওখানে সপরিবারে শ্যাম সুন্দর উপস্থিত হতেই হৈ চৈ পড়ে গেলো, সুরেশ নিজে এগিয়ে এলো তাঁর অভ্যর্থনার জন্যে, সরকারি কর্তাব্যক্তিরা উঠে এসে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলেন। চারিদিকে উপস্থিত গ্রাম্য মহিলাদের মধ্যে আধুনিকা মৃণালিনী সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগলো, দু একজন কৌতূহলী সরকারি কর্তার কৌতুহল নিবারণের উদ্যেশ্যে সৌম্য তাঁদের নিজের স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। আলাপ আলোচনা চলছিলো, স্বাধীনতার এতো বছর পরেও গ্রামে নূন্যতম সুযোগ সুবিধার অভাব নিয়েই সৌম্য এবং সুরেশ সরব ছিল। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নতুন, তিনি যথেষ্টই উৎসাহ ভরেই সমস্ত শুনছিলেন, তাঁকে গ্রামবাসীদের চাহিদা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে হাসপাতাল, বিদ্যুতের সঙ্গে মেয়েদের স্কুলের প্রসঙ্গ উঠলো। মৃণালিনী এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো,

আমি এখানে একটা মেয়েদের স্কুল খুলতে চাই, আপনি সাহায্য করলে হতে পারে,

খুব ভালো প্রস্তাব! আপনাদের মতো মহিলারা এগিয়ে এলে তো এগুলো অনেক সহজ হয়ে যায়!

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এককথায় সম্মত হলেন, উনি নিজের সাধ্যমত সরকারি সাহায্যের চেষ্টা করবেন কথা দিলেন। সমস্যা ছিলো জমির, সে জমি বাবার কাছ থেকে জোগাড় করে দেবে বলে জানালো সৌম্য, এ ব্যাপারে সে মোটামুটি সিদ্ধহস্ত।

নির্দিষ্ট সময়ে সব সম্পন্ন হলো, গ্রামের অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যাপারেও আলোচনা করলেন শ্যাম সুন্দর, তাঁদের সকলের এগিয়ে আসায় শরিকী জমি নিয়ে হওয়া গন্ডগোল তাঁদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি করেছিলো তা কিছুটা হলেও কমলো।

তুমি একটু দাঁড়িয়ে যেও সৌম্য, কথা আছে,

বাবার সঙ্গে ফিরে আসতে গিয়েও সুরেশের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌম্য, সে একটু পরে আসছে জানিয়ে ওদেরকে চলে যেতে বললো। মাঠের কোণে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিলো সে, হাতের কাজ সেরে, কর্তা ব্যক্তিদের বিদায় করে সুরেশ ওর পাশেই চেয়ার নিয়ে বসলো।

তোমাকে একটা কথা জানানোর ছিলো ভাই, তুমি আমার যা উপকার করেছো এর পরে এটা না জানালে আমি শান্তি পাবো না। তোমাদের পুকুরের পাশে একটা জমি আছে জানোতো? যেটা নিয়ে কিছু গোলমাল চলছে?

ঘাড় হেলালো সৌম্য, সে কিছুদিন ধরেই শুনছে এই কথাটা,

সেখানে এই গন্ডগোলের সুযোগে দখল নিয়ে একটা ক্লাব তৈরির চেষ্টা চলছে, আর তার পেছনে মাথা হচ্ছে তোমাদের আলোক দা!

সৌম্য অবাক হয়ে গেলো, ক্লাব! এখানে স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, অথচ ক্লাব! তাও আবার আলোকদার উস্কানি তে! কিন্তু সুরেশের সামনে এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাইলো না ও,

ঠিক আছে, আমি বাবার সঙ্গে কথা বলবো!

সুরেশ কে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি চলে এলো ও, মনের মধ্যেকার অশান্তি টা কিছুতেই গেলো না। এক্ষুনি কোনো প্রমাণ ছাড়াই এই কথাগুলো বাবা কে বলা উচিত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারছিলো না। আলোকদা বড়ো মার ভাইপো, বড়ো মা এই কথাগুলো কে কিভাবে নেবেন সেটাও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।

পরের দিন ফিরে যাওয়া, রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না সৌম্যর। কারণ বুঝতে না পারলেও স্বামীর অস্থিরতা নজরে আসছিলো মৃণালের,

কিছু হয়েছে তোমার? খুব অস্থির লাগছে তোমাকে!

আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললো মৃণালিনী,

সুরেশ বলছিলো আমাদের শরিকি জমিতে ক্লাব করার জন্য উস্কানি দিচ্ছেন আলোক দা!

সৌম্যর কথায় খুব বেশি অবাক হলো না মৃণাল, সেতো হিসাব মেলাতে গিয়ে আগেই আলোকের অসততা লক্ষ্য করেছিলো।

হতেই পারে! এরকম অনেক গোলমাল তিনি হিসাবেও করেছেন! তাই তো বাবা আমার হিসেব দেখা বন্ধ করতে চাননি।

বউয়ের শান্ত গলার কথায় অবাক হয়ে গেলো সৌম্য,

তুমি জানতে! বাবাও জানেন! তাহলে কিছু করছেন না কেনো!

করতে গেলে বড় প্রমাণ লাগে, সেরকম প্রমাণ কই! আর বাবা তো সব কিছু দেখে উঠতে পারেন না, তাই আমাকে ডাকেন! তবে ক্লাবের কথাটা তিনি জানেন না।

সৌম্য চিন্তিত হলো, বাবাকে ক্লাবের ব্যাপারে কিভাবে জানাবে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো।

বাবা যদি জানতে পারেন আমি মেয়েদের স্কুল করতে চাই, তাহলে খুব সমস্যা হবে তাইনা?

একটু দ্বিধা জড়ানো গলায় বললো মৃণালিনী, সৌম্য মাথা নাড়লো,

সে তো হবেই! তবে সেসব এখন থেকে ভেবে লাভ নেই! আগে একটু এগোক তারপর না হয় দেখা যাবে ভেবে। এখন বরং বিমল আর সরমার ব্যাপারটা ভাবি একটু! বিমল কে কিভাবে জিজ্ঞেস করবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না,

হেসে বললো সৌম্য, মৃণালিনীর মজা লাগলো। সৌম্যর মতো বুদ্ধিমান ছেলের পক্ষে বিমল কে বোনের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা যে এতটাই কঠিন কাজ সেটা তার মনে হচ্ছিলো না।

পরের দিন সকালে সৌম্য চলে যাওয়ার পরে তার কাজ ফুল তোলা সেরে এসে মৃণাল নিচে রান্না ঘরের দাওয়ায় বসেছিলো, এমন সময় গ্রামের এক মাত্র ঘটক শিব বাবু এসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখেই পারুল বালা এগিয়ে এলেন, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েই যে ঘটক মশাইয়ের আগমন সেটা সবাই বুঝতে পারলো।

মৃণাল এই ভয়টাই পাচ্ছিলো, কবে বড়ো মা শিবু ঘটক কে ডেকে পাঠান, সেই চিন্তা তাকে কদিন ধরেই চিন্তিত করে রেখেছিলো। ননদ আর বৌদি তে দৃষ্টি বিনিময় হলো, মুখ শুকনো করে ওখান থেকে উঠে গেলো সরমা। সবে মাত্র সৌম্য কলকাতায় ফিরে গিয়েছে, সেদিন রাতেই সে সময় চেয়ে নিয়েছে মৃণালের কাছে, তাই এতো তাড়াতাড়ি যে কিছু হবার নয় সেটা মৃণাল বুঝতেই পারছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে বেশিদিন সময় তাদের হাতে আছে কিনা সে বিষয়ে মৃণালিনী যথেষ্টই চিন্তিত হয়ে পড়লো।

মেয়ে শিক্ষিত না হলে বড়ো সমস্যা হয়ে যাচ্ছে কর্তা মা, এই দেখুন না, আপনাদেরই জ্ঞাতি ওই অবনি বাবুর মেয়ে কে! কম সম্বন্ধ তো আনলাম না! হচ্ছে কই! সবাই আজকাল পড়া শুনা জানা মেয়েই চায়!

ঘটকের কথায় প্রায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন পারুল বালা, দেওর কে তিনি বড়ো মুখ করে বলেছেন কদিন আগেই, এখন যদি সেই শিক্ষাই আবার তাঁর পথের কাঁটা হয়ে ওঠে!

ওই বাড়ির বিভার সঙ্গে তুমি আমাদের মেয়ের তুলনা কর শিবু! দুটো এক হলো! আমাদের মেয়ে কত সুন্দর!

সুন্দর হলেই হয় না কর্তা মা, এই তো দেখুন না, আপনাদের ছেলেই কি আর অশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করেছে! সব ছেলেই আজকাল এমন ধারা! আমি কি করি বলুন তো!

অসহায় গলায় বলে উঠলেন শিবু ঘটক, যিনি নিজেই আজকাল এখানকার মেয়েদের পাত্র খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন। মৃণালিনী মনে মনে যথেষ্টই পুলকিত হচ্ছিলো, সরমার অশিক্ষিত হওয়াকে তার এই মুহূর্তে শাপে বর বলেই মনে হচ্ছিলো। একে পাত্রের সন্ধান না পাওয়া, তার সঙ্গে সৌম্যর শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করার প্রসঙ্গ টেনে আনা, দুই মিলিয়ে পারুল বালা কে আরো ক্রুদ্ধ করে তুললো,

তা তুমি কি একানে মুক দেকাতে এয়েচো বাছা! খবর না নিয়ে আর আমার দোরে পা দিও না কোনোদিন!

শিবু ঘটক খুব ভালো করেই চেনেন পারুল বালা কে, তাই কোনো তর্কে না গিয়ে এরপরের বার সৎ পাত্রের খবর নিয়েই তবে আসবেন কথা দিয়ে আপাতত পালিয়ে বাঁচলেন। এই খবরে আর কেউ খুশি না হলেও সরমার মুখের উজ্জ্বলতা নজর এড়ালো না মৃণালিনীর, বেচারা কদিন থেকেই বড্ড মন মরা হয়ে আছে।
ক্রমশ

#মৃণালিনী
#পর্ব ২৩
কদিন ধরেই সন্ধায় একটা হালকা ঠান্ডা ভাব অনুভূত হচ্ছে, তুলসী তলায় সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে এসে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো মৃণালিনী। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু শীত শীত করছিলো, গায়ে শাড়ির আঁচলটা জড়িয়ে নিয়ে দূরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো মৃণাল, হটাৎ করেই বড়ো মার প্রবল চিৎকারে চমকে উঠে নিচের দিকে তাকালো।

কানের মাতা কি খেয়েছো বাছা! চিৎকার করে করে মুকে ব্যতা হয়ে গেলো, কোন দিকে মন থাকে মা গো!

কি হয়েছে বড়ো মা?

শশব্যস্ত হয়ে উত্তর দিলো মৃণালিনী।

কি আর হবে মা! আমার হয়েছে যত জ্বালা! মাতায় যে হিম পড়চে, সে দিকে খেয়াল নেই কো! তারপর জ্বর বাদালে কি হবে?

তাড়াতাড়ি বড়ো মার চিৎকার শেষ হবার আগেই ঘরে ঢুকে পড়লো মৃণাল। সত্যিই তার বেশ ঠাণ্ডা লাগছিলো।

সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকে পড়লেও শেষ রক্ষা হলো না, ভোরের দিকে পারুল বালার আশঙ্কা সত্যি করেই প্রবল জ্বর এলো তার। বেলা যত বাড়তে লাগলো, পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো জ্বরের প্রকোপও। আর তার সঙ্গেই বাড়তে লাগলো পারুল বালার বকুনি।

করুণা কে দিয়ে মাথা ধুইয়ে, কপালে জল পট্টি দিতে লাগলেন। কুমুদ এসে পায়ের তলায় রসুন তেল গরম করে মালিশ করতে লাগলেন, আস্তে আস্তে সবাই মৃণালের পেছনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শ্যাম সুন্দর সদরে গিয়েছেন সকালে, তাঁকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আলোক গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে। বেচারা সবে খেয়ে উঠে একটু বিশ্রাম নিতে বসে ছিলো, পারুল বালা তাকে চিৎকার করে উঠিয়ে দিলেন।

একন কি বসে তাকার সময় বাছা! যাও, গাড়ি বের কর, রতন ডাক্তার কে ডেকে নে এসো গে! বউ টা যে বিনি চিকিচ্ছেয় মরতে বসেছে!

পিসির প্রবল বাক্যবাণে আর বসে থেকে সময় নষ্ট না করে গাড়ি নিয়ে পাশের গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক মাত্র ডাক্তার বাবু কে আনতে রওনা হলো আলোক। আলোকের অপেক্ষায় ঘর বার করতে করতেই ঠাকুর ঘরে বৌমার জন্যে মানসিক রেখে ফেললেন পারুল বালা। কিছুক্ষন পরেই রতন ডাক্তার এলেন, রোগী দেখে ওষুধ পত্র দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় কর্তা মা কে আশ্বস্ত করলেন।

বউমা সুস্থ হয়ে যাওয়ার আশ্বাস পেয়ে খুশি হলেন পারুল বালা, যাবার সময় গাড়িতে হারু কে দিয়ে চার খানা গাছের ডাব আর নারকেল তুলে দিলেন। ডাক্তারের ওষুধের জোরই হোক বা পারুল বালার মানসিক এর, পরের দিন সকাল থেকেই জ্বর নেমে গেলো, দুর্বল শরীরে নিজের ঘরের পালঙ্কে শুয়ে ছিলো মৃণাল, করুণা ঘরে এসে ঢুকলো।

বউ দিদি, বড়ো মা পাইঠে দিলেন,

তার হাতে দুধ সাবুর বাটি দেখেই মুখ বিকৃত করে,চোখ বন্ধ করলো মৃণাল, এ তার বড়ো অপছন্দের জিনিস, কোনো দিনই খেতে পারেনা, দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। করুণা বোধ হয় বউ দিদির মুখভঙ্গি থেকেই অনুমান করলো ব্যাপারটা, বাটি ওখানে নামিয়ে রেখেই ছুটে নিচে চলে গেলো। একটু পরেই হাঁটুর ব্যথা নিয়ে কাতরাতে কাতরাতেই ওপরে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলেন পারুল বালা, বড়ো মার রণং দেহি মূর্তি দেখেই মনে মনে প্রমাদ গুনলো মৃণালিনী।

কোনো দিনও কি কোনো কতা শুনতে নেই বাছা! এই হিমে বারান্দায় দাড়িয়ে জ্বর বাদালে, একন পথ্যি দেকেও মুক বাঁকা! নাও! খাও, খেয়ে আমায় উদ্ধার কর দিকি! রাজ্যির কাজ ফেলে এই সাত সকালে তোমার পেছনে ঘোরার সময় আমার নেই মা গো!

কোমরে হাত রেখে দাঁড়ানো বড়ো মার দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়েই নাক টিপে ধরে সেই অখাদ্য কোনো রকমে গিলে ফেললো মৃণাল, করুণার হাতে খালি বাটি দেখে তবেই ঘর থেকে বেরোলেন পারুল বালা। এই প্রথম বার বড়ো মার বকুনি কে ঠিক বকুনি বলে মনে হচ্ছিলো না মৃণালের, এই প্রবল বকুনির আড়ালে লুকিয়ে থাকা যে উৎকণ্ঠা সেটাও তার নজর এড়ালো না।

নিজের অজান্তেই চোখে জল আসছিলো তার, ছোটো থেকেই মাতৃহারা মেয়েটি কে অসুস্থতায় মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ানোর মত কেউ ছিলো না কোনো দিনও। বাবার অত্যন্ত প্রিয় হলেও অধ্যাপক রমণী বাবুর পক্ষে নিজের কাজ কর্ম ছেড়ে মেয়ের অসুস্থতায় পাশে বসে থাকা কোনো দিনও সম্ভব হয়নি। এখানে এসে প্রথম বার অসুস্থ হয়ে পড়ে যে সহানুভূতি বাড়ির সবার কাছ থেকে সে পাচ্ছিলো তা মৃণাল কে অবাক করছিলো।

কিছুক্ষন পরেই কুমুদ পুজোর প্রসাদি ফুল নিয়ে ঢুকলেন, বৌমার কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে সে ফুল মাথার ওপরে রেখে দিলেন। মা বেরিয়ে যাবার একটু পরেই সরমা ঘরে ঢুকে এলো, মৃণাল তখন সবে মাত্র চোখ বন্ধ করে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ছিলো, সরমার গলা শুনে চোখ খুলে উঠে বসলো খাটের গায়ে হেলান দিয়ে।

বউ দিদি তেঁতুল খাবে? জ্বর মুখে ভালো লাগবে গো!

মৃণাল মাথা নাড়লো, সত্যিই তার মুখের কোনো স্বাদ ছিলো না। বিশেষ করে বড়ো মার দেওয়া দুধ সাবুর জঘন্য স্বাদ যেনো কিছুতেই মুখের ভেতর থেকে যাচ্ছিলো না তার। ননদ, বৌদি তে তেঁতুল নিয়ে বসে খেতে খেতে দুর্বল শরীরেই টুক টাক গল্প হলো তাদের। সেই গল্পের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই বিমলের কথা ছিলো। আস্তে আস্তে সবার সাহচর্যে শনিবারে সৌম্য বাড়ি আসার অনেক আগেই মৃণাল সুস্থ হয়ে উঠলো।

বেশ কিছুদিন ধরেই বাবা কে দেখার জন্যে মন একদম ছট ফট করছিলো মৃণালের, কতো দিন বাবার সঙ্গে দেখা হয় নি! জ্বর হবার পর থেকেই তার আরও বেশি করে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছিলো।ঘুমের মধ্যেও বাবার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো ঘুরে ফিরে আসছে শুধু, আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না একদম। শেষ পর্যন্ত রাতে হটাৎ করেই ঘুমের মধ্যেই যেনো বাবার গলা শুনতে পেয়ে ঘুমটা ভাঙলো। আর কিছুতেই ঘুম এলোনা। শুক্রবার সকালে উঠে যখন বাসি কাপড় ছেড়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে ও বড়ো মার ঘরের সামনে ফুলের সাজি নিতে দাঁড়ালো, তখনও পারুল বালা ঘুম থেকে ওঠেন নি।

ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে, দূর থেকে এক আধটা মুরগির ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। হারুর মা সবে মাত্র সদর দরজার খিল খুলে গোবর জলের ছিটে দিচ্ছে, বাড়ির অন্য কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই দেখে ফুলের সাজি নেবার জন্যে বড়ো মা কে ঘুম থেকে ডেকে তোলা উচিত হবে কি না মনস্থির করতে পারছিলো না মৃণালিনী।

বউমা ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো গো? কিছু চাই?

ঘুরে তাকিয়ে হারুর মা কে গোবর জলের বালতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু ইতস্তত করলো ও, কিছু বলবে কিনা ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে পারুল বালা বেরিয়ে এলেন। মৃণাল কে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু বিস্মিত হলেন তিনি, এতো ভোরে ফুল তুলতে আসতে তাকে তিনি দেখেন নি আগে।

কি হলো বাছা! রাতে ঘুম হয়নি নাকি! সাত সকালে সাজি নিতে এয়েছো যে বড়ো!

একটু মলিন মুখে হাসলো মৃণালিনী, বাবার জন্যে মনটা বড্ড অস্থির লাগছিলো তার। বউ এর মুখের মলিনতা পারুল বালার নজর না এড়িয়ে গেলেও এই সাত সকালে এ নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না তিনি, গামছা কাঁধে ফেলে পুকুর ঘাটে রওনা হলেন। ফুল তুলে নিজের কাজ সেরে রেখে দোতলায় নিজের ঘর গোছাতে গোছাতে নিচের থেকে শাশুড়ির ডাক শুনতে পেলো মৃণালিনী। একটু পরেই করুণা হন্ত দন্ত হয়ে ওপরে এলো।

বউ দিদি তোমায় বড়ো মা নিচে ডাকছে গো!

বড়ো মার ডাক মানেই প্রথম দিন থেকেই বড়ো ভয়ের ব্যাপার মৃণালের কাছে, বুকের কাছটা যেনো শুকিয়ে গেলো। খানিকটা দুরু দুরু বুকে নিচে নেমে এলো সে।

এসো বাছা! বসো একানে!

ইশারায় সামনে রাখা ছোটো পিঁড়িটা দেখিয়ে বললেন পারুল বালা। বৌমার ভীত মুখ দেখে হেসে ফেললেন কুমুদ, পারুল বালাও যে নজর করেননি তা নয়,

আ মোলো যা! আমি কি বাঘ না ভাল্লুক মা গো! অমন সিঁটিয়ে তাকো কেনো!

লজ্জিত হলো মৃণালিনী,

না না বড় মা! সে সব কিছু নয়!

মৃদু স্বরে বলতে চেষ্টা করা বউ মা কে এক ধমকে থামিয়ে দিলেন পারুল বালা,

থামো বাছা! আমাকে ওসব বোজাতে এসো নে! বাপের জন্যে মন কেমন করছে নাকি! তা সে মুকে বললেই হয়। তার জন্যে মুক কালো করে ঘুরে বেড়ানোর দরকার কি!

মৃণাল একটু চমকে উঠলো, বড়ো মা কি করে বুঝলেন সেটা বোঝার আগেই শাশুড়ির গলা কানে এলো,

কদিন ধরেই তোমাকে বলছি না দিদি! রাতের বেলায় বাবার জন্যে মন খারাপ করে বোধ হয়।

তা কদিন ঘুরে এলেই তো হয়! এ হপ্তায় ছেলে বাড়ি এলে তার সঙ্গেই না হয় চলে যেও! যাও গোছ গাছ করে নাও গে!

মৃণাল এর চোখ জলে ভরে আসছিলো, বড়ো মার এই রূপটা তার অজানা ছিলো। তাকে উঠতে দেখেই করুণা কে ডাকলেন পারুল বালা,

বউ দিদির সঙ্গে যা, তোরঙ্গ গুছিয়ে দে গিয়ে! সবে জ্বর থেকে উঠেছে, একা একা এসব পারবে না সে!

শনিবারে সৌম্য যথারীতি বাড়ি ফিরলো, রাতে খেতে বসার সময় তাকে বউমা কে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন পারুল বালা।

তার বাপের জন্যে মন কেমন করচে, যাও তোমার সঙ্গে করে নে গে ঘুরিয়ে নে এসো কদিন!

সৌম্য অবাক হলো, কিছুদিন আগেই সে মৃণালের প্রতি যথেষ্টই কড়া মনোভাব দেখে ছিলো বড়ো মার। সুভাষের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে বউ কে কিছু না বলার জন্যে তার ওপরেও বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যেই এই পরিবর্তনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলো সে। কিন্তু সে যথেষ্টই বুদ্ধিমান তাই তার মনোভাব একটুও প্রকাশ করতে না দিয়ে বড়ো মার কথার উত্তরে শুধুই ঘাড় নাড়লো। মৃণাল কে কলকাতা নিয়ে যাবার সুযোগে সে অন্য পরিকল্পনা করতে লাগলো।

বাড়িতে দুদিন কাটিয়ে মৃণালিনী কে নিয়ে ফেরার জন্যে তৈরি হলো সৌম্য। যাবার সময় বেয়াই মশাইয়ের জন্যে বাড়িতে তৈরি নাড়ু, মুড়কি গুছিয়ে দিলেন কুমুদ, পারুল বালা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নারকোল পাড়ালেন হারু কে দিয়ে। সব কিছু নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে কলকাতা ফেরার জন্যে রওনা হলো মৃণালিনী।

বাড়ি পৌঁছে বাবা কে দেখে কিছুটা হলেও শান্তি ফিরলো মৃণালের, তার মন খারাপের কথা শুনে রমণী বাবুও দুঃখিত হলেন। তাঁর আদুরে কন্যার এতদূরে বিবাহ দিয়ে তিনিও খুব কষ্টে থাকেন, ইচ্ছে থাকলেও বারবার সেখানে ছুটে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয় না।

দুপুরে সৌম্য কলেজে বেরিয়ে যাওয়ার পরে দোতলায় নিজের ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল মৃণালিনী। তার শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতার দূরত্ব খুব কম নয়। সেই কোন ভোর বেলায় সে বাড়ি থেকে ট্রেন ধরার জন্যে বেরিয়েছিল, যথেষ্টই ক্লান্ত হয়েছিলো সে, স্বামীর গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলো,

দেখো মৃণাল, কাকে ধরে এনেছি!

বিমল কে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে উচ্ছসিত গলায় বললো সৌম্য। আগের বার তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে বন্ধু কে বাড়িতে আনতে পারেনি পাছে সরমার মাধ্যমে বড়ো মার কাছে খবর চলে যায় সেই ভয়ে! তারপরে বিমলের সঙ্গে তার বোনের সম্পর্কের কথা জানতে পারার পর থেকেই সে নিজের বোকামির জন্যে নিজের মনেই হেসেছে বার বার।

বিমল কে নিয়ে সৌম্য কে ঘরে ঢুকতে দেখে নিজের কাপড় একটু গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো মৃণালিনী। বামুন মাসীকে রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রাতের খাবারের জন্যেও বললো। আগের বার সৌম্যর জন্যে বিমল কে একটু ভালো করে খাওয়াতেও পারেনি সে। সব গুছিয়ে ব্রজ দাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বলে খাটে এসে স্বামীর পাশে গুছিয়ে বসলো সে।

ভাই, আমার বউ তোমাকে কি চিঠি লিখেছিলো সেগুলো আমাকে ফেরত দিয়ে দাও দেখি!

সৌম্যর গম্ভীর গলায় বিমল চমকে তাকালো, চিঠির কথা সৌম্য কিভাবে জানলো, সেটা খানিকটা আতঙ্কিত মুখে বুঝতে চেষ্টা করছিলো সে। বিমল কে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃণালিনী হেসে ফেললো, সে সৌম্যর এই তৈরি করা গাম্ভীর্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো এতদিনে। মৃণাল এর মুখের হাসি বিমল কে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছিলো কিন্তু তার বন্ধু ঠিক এই ব্যাপারে কতোটা জানে সেটা সৌম্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলো সে।

কই দাও চিঠিগুলো?

এবার বিমল হেসে ফেললো নিজেও,

তোমার কি মনে হয়, সেসব চিঠি আমি রেখে দিয়েছি? বৌদি আমার এতো উপকার করেছেন, আর আমি তাঁকে জেনে শুনে বিপদে ফেলবো! সেসব আমি কবেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি!

কি এমন উপকার তোমার করেছে মৃণাল শুনি! আমি তো কিছুই জানলাম না!

গম্ভীর মুখে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো সৌম্য, বিমল লজ্জায় পড়লো,

তোমাকে জানানোর মতো সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি ঠিক, বেশ কয়েকবার বলবো ভেবেও বলে উঠতে পারিনি! তবে এখন যে তুমি সবটাই জানো, এবং জেনে শুনেই শুধু কৌতুক করছো, সে তোমার মুখভঙ্গি থেকেই পরিষ্কার!

কিন্তু তুমি নিজে থেকে না বললে আমিই বা বুঝবো কি করে বলো! তোমার আমার মধ্যে যা সম্পর্ক, সেক্ষেত্রে এটা আমি তোমার নিজের মুখে শুনবো এমন আশাই করেছিলাম।

আসলে আমার সব সময় মনে হয়েছে যে তোমাদের পরিবারের একজন হবার যোগ্যতা বোধ হয় আমার নেই! বিশেষ করে কাকাবাবু আমাকে তাঁর পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নেবেন না বলেই আমার ধারণা ছিলো, তাই সাহস করে বলে ওঠা হয়নি কোনোদিনও।

কুণ্ঠিত গলায় বললো বিমল, সৌম্য মনে মনেই একটু লজ্জিত হলো। বিমলের তার বাবার সম্পর্কে ধারণা যে খুব ভুল নয়, সেটা তো সে নিজেও জানে। বাবা রাজি হবেন না এটা তো তারও জানা ছিলো, নেহাত সরমার পাত্র পাওয়া ইদানিং একটু মুশকিল হয়ে উঠেছে তাই এই সুযোগে যদি কিছু এগোনো যায় সে সেই চেষ্টাই করছে। শিবু ঘটকের ফিরে যাওয়া কিছুটা হলেও তার আর মৃণালের দুজনের মনেই আশার সঞ্চার করেছে।

সৌম্য কে চুপ করে থাকতে দেখে বোধ হয় বিমলও হতাশ হলো, এই সম্পর্কের আদৌ কোনো পরিণতি আছে কিনা সে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো। দুই বন্ধুই মুখোমুখি চুপ করে বসে আছে, দুজনেরই বোধ হয় আশাব্যঞ্জক বলার মতো নতুন কিছু নেই, ঘর জুড়ে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে দেখে মৃণাল নিজেই এবার পরিবেশ হালকা করে দিতে চাইলো,

বিমল দা আবার নিজে কি বলবেন! ওনার হয়ে তোমাকে বলার দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম, এবার বাবা কে বলার দায়িত্ব তুমি নেবে!

বিমলও হেসে ফেললো এবার,

হ্যাঁ ভাই, আমি সব দায়িত্ব বৌদির ওপরে দিয়েই নিশ্চিন্ত আছি! বাকিটা তুমি দেখো এবার!

এইসব কথার মাঝেই ব্রজ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো, তাকে দেখেই আপাতত এইসব প্রসঙ্গ চাপা পড়লো। আড্ডা চলতে চলতেই সৌম্য বন্ধুর জন্যে অবশ্যই কিছু করার চেষ্টা করবে বলে জানালো, বিমল অনেকটাই নিশ্চিন্ত হলো। বিমলের নিজের ওপর খুব বেশি আস্থা না থাকলেও সৌম্যর ওপর ছিলো, কিন্তু সৌম্য মুখে বন্ধু কে কথা দিলেও সে কথা কাজে করে দেখাবে কি করে, সে চিন্তাই তাকে সারাটা সময় চিন্তিত করে রাখলো। স্বামীর চিন্তিত মুখ মৃণালিনীর দৃষ্টি এড়ালো না, শ্বশুর মশাই এবং বড়ো মা দুজনকে রাজি করানো যে যথেষ্টই দূরহ ব্যাপার সেটা সে সৌম্যর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলো।
ক্রমশ