রাগে অনুরাগে পর্ব-০২

0
4185

#রাগে_অনুরাগে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০২
.

সকাল থেকেই টেনশনে আমি অস্থির। সানাফ ভাই পড়াবেন; তার মানে একটুও ফাঁকি দেওয়া যাবে না পড়ায়। এদিকে ফিজিক্স পড়তে আমার মোটেও ভালো লাগে না।

যথাসময়ে কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরলাম। বেলা এগারোটা। সানাফ ভাই আসবেন আর পনেরো মিনিট পরেই। আমি একটু রেস্ট নিয়ে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলাম। সাথে ফিজিক্স বই।

একটু পর আম্মু তড়িঘড়ি করে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
‘এখানে বসেছিস কেন? তোর আপুর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক আসবে কিছুক্ষন পর। যা গিয়ে নিজের ঘরে বস।’

‘কিন্তু সানাফ ভাই তো পড়াতে আসবেন। এখন আমি নিজের ঘরে যেতে পারবো না। এখানেই বসবো।’
ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাটা বললাম আম্মুকে।

‘সানাফ পড়াতে আসবে দেখেই তোকে বললাম, নিজের ঘরে গিয়ে বসতে। বেশি বকবক না করে চুপচাপ ঘরে যা।’

‘আজব! তুমি সবসময় আমাকে এমন বকাঝকা করো কেন আম্মু? আব্বু এবার আসুক সব বলবো। কীভাবে তোমার নিজের মেয়ের থেকে বেশি প্রিয় হয়ে গেছে ঐ দু’দিনের ছেলেটা। সব বলবো।’

আম্মুর সাথে কথা কাটাকাটির মাঝেই সানাফ ভাই এসে উপস্থিত হলেন। আমি আর কথা না বাড়িয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। সানাফ ভাই নিজেও আম্মুকে সালাম দিয়ে আমার পিছু পিছু আসলেন। আমি পড়ার টেবিলে বইটা রেখে বেডের সাইডে গিয়ে বসলাম। উনি চেয়ার টেনে সোজা আমার বরাবর বসলেন। হঠাৎ কেন জানি খুব রাগ হচ্ছে উনার উপর। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।

সানাফ ভাই একবার আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। আমিও সেটা আড়চোখেই দেখলাম। কিছুক্ষণ পর বই উলটাতে উলটাতে উনি বললেন,
‘রাশেদের কাছে কোন চ্যাপ্টার পড়ছিস?’

উনার কন্ঠ শুনে আমি চমকে তাকালাম। এতোটা গম্ভীর কন্ঠে তো উনি আমার সাথে কথা বলেন না। তাহলে আজ কী হলো? মনে মনে আওড়ালাম কথাখানা।

আমার কথার কোনো উত্তর না পেয়ে উনি আমার দিকে তাকালেন। উনার সাথে এভাবে হঠাৎ করে চোখাচোখি হওয়াতে খানিকটা লজ্জা পেলাম আমি। সচরাচর আমাদের এভাবে চোখাচোখি হয় না। আর এমন নীরব পরিস্থিতিও আমাদের মাঝে কখনো বিরাজ করে না। আমার সব কিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কী হয়েছে আপনার?’

প্রশ্নের জবাব পেলাম না। আবারও শুনশান নীরবতা। আমার এক প্রকার ভয় লাগতে শুরু করছে। উনি কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছেন? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে লাগলাম। কিন্তু উত্তর মেলাতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে সানাফ ভাই বললেন,

‘একটু পানি খাওয়াবি? খুব জল তেষ্টা পেয়েছে।’

উনার কথাশুনেই আমার টেবিলের দিকে তাকালাম। পানির বোতলটা খালি পড়ে আছে। আমি বোতলটা নিয়ে কিচেনে চলে গেলাম। মিনিট দু’য়েকের মধ্যে পানি নিয়েও ফিরে আসলাম। কিন্তু রুমে সানাফ ভাইকে দেখতে পেলাম না।

বেলকনিতে গিয়ে নিঃশব্দে উনার পিছনে দাঁড়ালাম। আমি কিছু বলার পূর্বেই উনি ঘুরে দাঁড়ালেন। উনার দিকে তাকাতেই আমি কেঁপে উঠলাম। চশমা নেই চোখে। চোখ দু’টো টকটকে লাল বর্ণ ধারন করেছে। এমনটা তো হয় সাধারণত দু’টো কারণে। মানুষ যখন প্রচন্ড রেগে যায় তখন। তা নাহলে কান্না করলে। কিংবা এলার্জী বা কোনো সমস্যা থাকলে। কিন্তু সানাফ ভাইয়ের এই মুহুর্তে কোন কারণে চোখ এমন লাল হয়ে আছে? ভাবতে লাগলাম। আমার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে সানাফ ভাই বললেন,
‘কীরে, পানি এনেছিস?’

আমি কাঁপা গলায় বললাম,
‘এ-এ-এনেছি। টেবিলের উপর রাখা আছে।’

‘ওহ আচ্ছা।’

কথাটা বলেই সানাফ আমার দিকে এগোতে লাগলেন। লাল বর্ণের চোখ দু’টো অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে আমার হাঁত পা কাঁপছে। আমি পেছাতে লাগলাম। এক সময় টেবিলের পাশের দেয়ালটায় পিঠ ঠেকে গেলো আমার। সানাফ ভাই আমার থেকে দুই ইঞ্চি দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি উনার ডান হাতটা দেয়ালে রেখে আরেক হাত দিয়ে আমার বাহু চেপে ধরলেন। উনার গরম নিঃশ্বাস আমার কপালে পড়তেই অদ্ভুত শিহরণে আমি আঁতকে উঠলাম। কপালে এক গাছি চুল এসে পড়েছে আমার। সানাফ ভাই ফুঁ দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিলেন। আমি আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

উনি শীতল গলায় বললেন,
‘অর্ণবের সাথে তোর কী সম্পর্ক?’

আমি আবারও চমকালাম। স্বাভাবিক গলায় বললাম,
‘অর্ণব শুধুই আমার বন্ধু সানাফ ভাই।’

আমার কথায় উনি সন্তুষ্ট হলেন না। তা উনার মুখ ভঙ্গি দেখেই বুঝলাম আমি। হঠাৎ উনার ডান হাতটা সজোরে দেয়ালের সাথে আঘাত করলেন। আমি আকস্মিক ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ব্যথায় উনি ‘উঃ’ জাতীয় শব্দ করলেন। আমি তাড়াতাড়ি উনার হাতটা দেখার জন্য হাত বাড়ালাম। কিন্তু উনি এক ঝটকায় আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে আমার বাহু আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,

‘নিধি তুই শুধুই আমার। এর বাইরে অন্য কেউ তোর দিকে চোখ তুলে তাকালেও তার সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটে যাবে।’

‘সানাফ ভাই, লাগছে আমার।’

‘লাগুক। এর থেকেও বেশি আমার লেগেছে। যখন রাস্তা দিয়ে আসার সময় শুনতে পেলাম তোর আর অর্ণবের নাকি রিলেশন চলছে।’

উনার কথা শুনে আমি বিস্ময়ের সপ্তম আকাশ থেকে ধপাস করে পড়লাম। বললাম,

‘কে বলেছে আপনাকে এসব? মিলি না কি অথৈ?’

‘এসব বাতাসের আগে ছড়ায় বুঝলি। কেউ বলা লাগে না। আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি এরপর যেন অর্ণবের সাথে তোকে না দেখি।’

উনার হাতটা বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিলাম ঝটকা মেরে। তারপর কর্কশ গলায় বললাম,

‘আন্দাজে একটা কথা শুনে এসে আমার উপর অত্যাচার শুরু করলেন? বাহ! অথচ আমি যে এতোবার করে বলছি আমার সাথে অর্ণবের বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কিছুই নেই। সেই বেলায় বিশ্বাস কর‍তে খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না?
তো এতোই যদি সন্দেহ আমার উপর তা হলে আমায় বিয়ে করছেন কেন? ভেঙে দিন বিয়েটা।’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলাম। রাগে শরীর জ্বালা করছে আমার। ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে লোকটাকে বের করে দিতে বাসা থেকে। কিন্তু আমি নিরুপায়।

সানাফ ভাই এবার আমার মুখ চেপে ধরলেন। তারপর বললেন,
‘চুপ একদম চুপ। দুনিয়াতে যদি তোর বিয়ে হয়, তাহলে একমাত্র আমার সাথেই হবে। এই তুই বুঝিস না আমি তোকে কতোটা ভালোবাসি? আমার ভালোবাসা তোর চোখে লাগে না?’

উনার বলা শেষ দু’টো কথা আমার বুকের ভেতর তোলপাড় করা শুরু করলো। বরফের মতো কিছু একটা যেনো আমার শিরা-উপশিরায় বেয়ে গেলো। চোখ দিয়ে আচমকা পানি গড়িয়ে চিবুক বেয়ে পড়লো। আমার কান্না দেখে সানাফ ভাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। মুহুর্তের মধ্যে চোখের পানি মুছে দিয়ে আমায় উনার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন।

উনার এমন কান্ডে এক ঝাঁক লজ্জা এসে ভিড় করলো আমার চোখেমুখে। এদিকে অন্যরকম এক ভালো লাগায় নিজেকে জড়িয়ে নিলাম। কোনো পুরুষের ছোঁয়া এতোটা ভয়ংকর হয়, জানা ছিলো না আমার।
আমি কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর কেঁপে কেঁপে উঠছি। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের বুকে মাথা রেখেছি। আর সেই পুরুষ লোকটাই কি না আমার ভবিষ্যৎ স্বামী। আমার অর্ধাঙ্গ!

________
রাতের ঘুম যেনো একেবারেই উবে গেছে আজ। চোখ বন্ধ করলেই ভয়ংকর শেই মুহুর্তটা চোখে ভেসে উঠছে।
কী ভয়ংকর! উনি আমায় স্পর্শ করতেই মনে হলো আমার পৃথিবী থমকে গেছে।

এসব ভাবনার মাঝেই অন্য এক ভাবনা আমার মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরতে লাগলো। অর্ণবের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক এমন উদ্ভট কথা উনাকে কে বললেন?
রাত একটা। সবাই যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন আমি গভীর ভাবনায় মগ্ন। এমন সময় ফোন ক্রিং করে বেজে উঠলো।

তাকিয়ে দেখলাম সানাফ ভাই মেসেজ পাঠিয়েছেন,
‘আজ পড়া হয়নি কাল কিন্তু দ্বিগুণ সময় নিয়ে পড়াবো।’

উনার মেসেজটা দেখে আমার মনের লাড্ডু ফোটা বন্ধ হয়ে গেলো। ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিলাম। আজ বুকে জড়িয়ে নিয়েছে, কাল পড়া না পারলে নির্ঘাত বেত্রাঘাত করবেন। উনাকে ভরসা নেই। সানাফ ভাই সব পারেন।

.
(চলবে…)