লাল_গোলাপ
#লেখিকা_মিতু
পর্বঃ ০৭(শেষ পর্ব)
নিশান স্তব্ধ হয়ে যায় ওর বাবার কথা শুনে। এতো দূর এসে শেষমেশ ঘাটের কাছে নিশানের নৌকা ডুবে গেল!! নিশানের বাবা যেতে নিলে রুমির বাবা নিশানের বাবার হাতটা ধরে ভিতরে তাদের বাসায় নিয়ে আসে৷ নিশান কিছুই বুঝতে পারছে না এসব কি হচ্ছে। নিশানের বাবা রাগীভাবে রুমির বাবাকে বলে,
– আফজাল আমাকে ছাড়৷ আমি এখানে থাকব না। তোর মুখও আমি দেখতে চাই না। এখন আমি চাইলে এরকম ১০০ টা বাড়ি কিনার ক্ষমতা রাখি।
রুমির বাবা খুব মায়া জড়িত কণ্ঠে বলে,
– বন্ধু হাবিব…
নিশানের বাবা রুমির বাবার দিকে তাকায়। রুমির বাবা নিশানের বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– বন্ধু মাফ করে দে সেদিনের জন্য। আমার ভুলের শাস্তি আমার মেয়েকে দিস না। দয়া কর বন্ধু।
– তুই আমাকে সেদিন কী কষ্ট দিয়েছিস জানিস?? তোর সেই কষ্ট থেকে আমার ভিতর এমন জেদ হয় যে আজ আমি নিজেকে এই পর্যায়ে এনেছি। (নিশানের বাবা)
– বন্ধু ধন-সম্পত্তি দিয়ে আর কি হবে?? তোর ছেলেটা আমার মেয়েটাকে খুব ভালোবাসে। আমার মেয়েটাও তোর ছেলেকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তুইও তো চেয়েছিলি ওরা ছোট থাকতে ওদের বিয়ে হোক। কিন্তু আমি হয়তো তখন মেনে নেই নি। কিন্তু বন্ধু ওদের কথা ভেবে সব ভুলে যা না। এটা বাংলা সিনেমা?? যে তুই রাগ করে পুরনো ক্ষোভ দেখিয়ে ওদের আলাদা করে দিবি। মেনে নে বন্ধু। তোকে আমাদের সেই বন্ধুত্বের প্রমিজ। মাফ করে দে আমায়।
– নিশানের বাবা, উনি মেয়ের বাবা..তোমার সেই পুরনো জানের বন্ধু। মাফ করে দেও না। নিশান আর রুমি মাকে আলাদা করো না। (নিশানের মা)
– বাবা আঙ্কেলকে মাফ করে দেও প্লিজ। (নিশানের বোন)
রুমি এতক্ষণ উপরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। ও বুঝতে পেরেছে কি হয়েছে। রুমিকে আজ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। কারণ নিশানরা ওকে দেখতে আসবে বলে। রুমি সেই সাজেই নিচে নেমে আসে। নিশান, নিশানের মা ওর বোন আর রুমির মা রুমির দিকে তাকিয়ে আছে। রুমি নিচে এসে নিশানের বাবার কাছে গিয়ে অসহায় ভাবে বলে,
– আঙ্কেল আব্বুকে দয়া করে মাফ করে দিন। আমি ওনার হয়ে মাফ চাচ্ছি। প্লিজজজ…
নিশানের বাবা রুমির দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে না। সবার বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। তারপর হঠাৎই নিশামের বাবা রুমির কাছে গিয়ে রুমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
– আঙ্কেল না আজ থেকে বাবা বলবে।
– ইয়েএএএ….ভাবি বাবাকে মানিয়ে ফেলেছে। ইয়েএএএ….(মিলা)
– আফজাল, শুধুমাত্র তোর লক্ষ্ণী মেয়েটা এভাবে এসে বলল বলে তোকে আজ মাফ করে দিলাম। এই মেয়েটাকেই সেই ছোটবেলায় আমার ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম। কত্তো বড় হয়ে গিয়েছে নিশানের মা দেখেছ??
– শুধু বড়?? বলো কত্তো সুন্দরীও হয়ে গিয়েছে। একদম পরীর মতো। (মা)
নিশান হতবাক হয়ে শুধু সব দেখছে। তবে বেচারা খুব ভয়ে ছিল যে আবার বিয়েটাই ভেঙে না যায়। এখন একটু ভালো লাগছে। রুমির মা নিশানের কাছে এসে বলে,
– আমিও তো বলি এমন হীরারটুকরা ছেলেটা হলো কীভাবে। এতো সেই নিশান, যাকে ছোটবেলায় কত্তো আদর করেছি। একদম বাবা-মার মতো হয়েছে। ভাই জানেন আপনার নিশান আমার ছেলেকে বাচিঁয়েছে। ও রক্ত না দিলে হয়তো আজ…
– আহ থাক না রুমির মা। এখন আনন্দের সময়। (রুমির বাবা)
– জি বেয়াই সাব। আজ দীর্ঘ অনেক বছর পুরনো বন্ধুরা মিলিত হলো। কি বলেন বেয়াইন সাব। (নিশানের মা)
– জি বেয়াইন সাব। হাহা।(রুমির মা)
নিশানে বাবা রুমির বাবাকে ধরে বলে,
– বন্ধু আমাকেও মাফ করে দিস। আমিও তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি।
– না বন্ধু তুই মাফ চাস না। সেদিন যদি তোকে ছোট না করতাম তাহলে হয়তো এতো দিন দূরে থাকা লাগত না। বরং তুই আমাকে মাফ করে দিস।
– আচ্ছা হয়েছে। এবার বুকে আয় বেটা।
এরপর ধুমধাম করে নিশান আর রুমির বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। বিশাল বড় একটা হোটেলে গ্রান্ড ওয়েডিং হয় নিশান আর রুমির। অনেক অনেক লোক আসে ওদের বিয়েতে। সব মিলিয়ে খুব সুন্দরভাবেই ওদের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়।
নিশানদের বাসাটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মরিচ বাতি দিয়ে আলোকিত করা হয়েছে নিশানদের বাসা। নিশানের রুমটা আজ স্পেশাল ভাবে সাজানো হয়েছে। নিশানের কথা মতো ওর রুমটা সাজানো হয়েছে। অনেক গুলো লাল গোলাপ দিয়ে নিশানের রুমটা সাজানো হয়েছে। বিছানায় নিশান আর রুমির নাম লেখা। হালকা মিষ্টি আলোর বাতি। আর লাল গোলাপের মিষ্টি মধুর ঘ্রাণতো আছেই। নিশানের কথা ছিল নিশান রুমিকে নিয়ে একসাথে ওর রুমে যাবে। যাতে নিশানের রুম দেখে রুমির উৎফুল্ল মুখখানা নিশান দেখতে পারে। সবাইকে বিদায় দিয়ে নিশান আর রুমি ওদের বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মানে নিশানের রুম আরকি। রুমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
– কি হলো চলুন দাঁড়িয়ে আছেন কেন??
নিশান রসিকতার ঢংয়ে বলে,
– ওরে বাবা…বউ দেখি আমার ফুল মুডে আছো মনে হয়। বিড়াল তো মনে হয় তুমি নিজেই মারবা। আমি।আর কি মারব। হাহা।
নিশানের কথা শুনে রুমি যেন লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। গলে পরে যাচ্ছে এমন অবস্থা। নিশান রুমিকে বলে,
– ইসসস কি লজ্জা…হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। এখন চোখটা সুন্দর করে বন্ধ করো। আমি বললে তখন খুলবে। তার আগে না।
– আচ্ছা করলাম।
রুমি চোখ বন্ধ করে আছে। নিশান অপলক দৃষ্টিতে রুমিকে দেখছে। আহ!! কি সুন্দর অপ্সরাই না লাগছে ওকে। রুমিকে এভাবে দেখে নিশান ভুলেই গিয়েছে যে ও রুমিকে নিয়ে ভিতরে যাবে। নিশান আর না পেরে টুস করে রুমির গালে একটা কিস করে দেয়। রুমি চমকে গিয়ে চোখ খুলে নিশানের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আর বলে,
– যাহ দুষ্ট এখানে এসব কি করছেন?? ভিতরে যাবেন না??
– হ্যাঁ হ্যাঁ যাবো তো। আচ্ছা চোখ বন্ধ করো। এবার সত্যিইই ভিতরে যাবো।
– আচ্ছা করেছি।
এরপর নিশান রুমির হাত ধরে ওদের বাসর ঘরে নিয়ে যায়। রুমি ভিতরে ঢুকতেই গোলাপের কড়া মিষ্টি ঘ্রাণ এসে ওর নাকে লাগে। রুমি অস্থির হয়ে বলে,
– কিগো খুলবো??
– হ্যাঁ এখন খুলতে পারো।
রুমি দ্রুত চোখ খুলে তাকিয়ে যেন অবাক। অসম্ভব সুন্দর করে ওদের বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। রুমির পছন্দের লাল গোলাপ দিয়ে পুরো রুম মুখরিত। রুমি গোলাপের কাছে গিয়ে তার সুবাস নিচ্ছে আর কেমন জানি নেশা ধরে যাচ্ছে ওর ঘ্রাণে।
হঠাৎই নিশান পিছন থেকে রুমিকে ডাক দেয়। রুমি ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিশান হাটু গিরে বসে আছে। নিশান রুমির দিকে একটা টুকটুকে লাল গোলাপ এগিয়ে দিয়ে ওর একটা হাত ধরে বলে,
– আমাদের মিলটা হয়তো উপরওয়ালা ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু খুব কঠিন ভাবে৷ আজ এতো সংগ্রাম-যুদ্ধ করে তোমায় পেয়েছি প্রিয়। কখনো সুন্দর করে বলতেই পারিনি৷ আজ বলছি,
প্রিয়, তোমায় খুব খুব ভালোবাসি। এই লাল গোলাপের সুবাস তোমায় বলে দিবে আমার ভালোবাসাটা কত মিষ্টি আর কড়া।
রুমি গোলাপটা নিয়ে কড়া সুবাসে একদম অচেতন হবার মতো অবস্থা। রুমি নিশানকে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরে। আর বলে,
– সারাটা জীবন এভাবে ভালোবাসবেন তো??
– যদি আল্লাহ তায়ালা সুযোগ দেয় অবশ্যই বাসবো। বাবা-মা, বোন আর তুমিই তো এখন আমার সব। অবশ্য কদিন পর এই ভালোবাসাটা আবার ভাগ করতে হবে।
নিশানের কথা শুনে রুমি আচমকা মাথা তুলে রাগী ভাবে বলে,
– কিহহ!! ভাগ করতে হবে মানে!!!
– আহহা!! আমাদের বাবু হবে না সুন্দর সুন্দর কয়টা?? তাদেরকেও তো ভালোবাসতে হবে। পাগলি।
– এহহ কয়টা কি?? মাত্র দুইটা বাবু হবে আমাদের। একটা আপনার একটা আমার। (লজ্জাসিক্ত হয়ে বলে)
– হাহা। আচ্ছা। চলো বাবুদের নিয়া আসি। (মজা করে)
– কি বলেন?? কোথা থেকে বাবু আনবেন আবার??(অবাক হয়ে)
– কেন এখান থেকে। (রুমির পেট দেখিয়ে)
– যাহ দুষ্ট। আপনি অনেক দুষ্ট। আমাকে খুব লজ্জা দেন।
– দিব না কেন বল?? লজ্জায় যে তোমায় খুব মিষ্টি লাগে।
– তাই বুঝি??
– হুম।
নিশান রুমিকে ওর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে আছে সাথে রুমিও। দুজন দুজনের চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিশানের যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। নিশান রুমির ঠোঁটের কোণায় ছোট তিলটার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব টানছে এই তিলটা। নিশানের নিঃশ্বাস কেমন গরম হয়ে আসছে রুমির স্পর্শে৷ সেই গরম নিঃশ্বাস রুমির মুখের উপর পড়ছে। রুমির শ্বাসও ঘন হয়ে আসছে। রুমি কেমন জানি ঘোরে পড়ে যাচ্ছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। নিশান আস্তে আস্তে ওর মুখটা রুমির খুব কাছে নিয়ে যাচ্ছে। রুমির চোখ আস্তে করে বন্ধ হয়ে যায়। নিশান রুমিকে খুব কাছ থেকে দেখছে। কত্তো মায়া ওর মধ্যে। নিশান আলতো করে রুমির কপালে ওর মধুর স্পর্শ বুলিয়ে দেয়। রুমি কেঁপে উঠে। এরপর ওর দুগালে স্পর্শ বুলিয়ে দেয়। রুমি বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ও যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে স্বামীর স্পর্শে। রুমি চোখ বন্ধ করে শুধু অপেক্ষা করছে সেই স্পর্শের যা সেদিন বাকি ছিল। নিশান দেখে, রুমির ঠোঁট সমানে কাঁপছে। ওর মুখে এক অন্যরকম আভা পেয়েছে। রুমে এখন আরো বেশি সুন্দরী লাগছে। নিশান আর রুমিকে কষ্ট না দিয়ে সেই বহুল অপেক্ষার স্পর্শটা বুলিয়ে দেয় ওর স্ত্রী রুমির ঠোঁটে। রুমি নিশানের স্পর্শ পেয়ে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। এ অনুভব বলার বাইরে। চারদিক কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। মিষ্টি ঘ্রাণ আর ঠান্ডা বাতাস ওদেরকে আরো নেশাকাতর করে দিচ্ছে। এরপর কি হয়েছে তা আর না বলি। আপনারাই ভালো জানেন। হাহা।
—-> আমরা সবসময় ভাবি প্রথম ভালোবাসাটা হয়তো সত্যিকারের ছিল। কারণ সেটা আমরা নিজেরা খুঁজে বানিয়ে ছিলাম। কিন্তু সেটা যখন ভেঙে যায় তখন আমরা আর ভালোবাসাকে বিশ্বাস করি না। কিন্তু বাস্তবে সত্যিকারের ভালোবাসাটা হঠাৎ করে আপনার জীবনে আসে। কিন্তু আপনি তা বুঝতে পারেন না। আপনি তাকে আগের জনের মতো মনে করে ফিরিয়ে দিন। ফলে সে হারিয়ে গেলে আপনি বুঝেন আপনি কি হারিয়েছেন। ভালোবাসাটা ঠিক তখনই গভীর আর সারাজীবনের জন্য হয় যখন বিয়েটা হয়। তাই যদি মনে হয় সত্যিকারের ভালোবাসাটা পেয়েছেন তাহলে খুব তাড়াতাড়ি তাকে বিয়ে করে ফেলুন। তাহলে আর হারানোর ভয় থাকবে না। আর সত্যিকারের ভালোবাসা পেতে সবসময়ই কষ্ট করতে হয়। সবশেষে, সবাই সত্যিকারের ভালোবাসা পাক আর তা পূর্ণতাও পাক।
– সমাপ্ত।