#শৈবলিনী—-২৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★সারাদিনের ভাড়া শেষে টেক্সি জমা দিয়ে বাসায় যেতে নিলেই হঠাৎ রাস্তায় নূরের সামনে এক ব্লাক মার্সিডিজ এসে দাঁড়াল। আচমকা এমন হওয়ায় দাঁড়িয়ে গেল নূর। চেতে উঠে গাড়ি চালককে আচ্ছামতো কিছু বলতে চাইল।কিন্তু তার আগেই গাড়ি থেকে ড্রাইভার নেমে এলো। নূরের কাছে এসে বলল,
–আপনাকে আমাদের ম্যাম একটু ডাকছেন।
নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ম্যাম? কে ম্যাম? আর তার কথা বলার প্রয়োজন হলে সে বাইরে আসুক। আমি কেন যাবো? আমার এতো ঠ্যাকা পড়ে নাই।
–প্লিজ ম্যাম, একটু চলুন না। প্লিজ।
–আচ্ছা ঠিক আছে চলুন।
নূর ড্রাইভারের সাথে এগিয়ে গেল। গাড়ির কাছে আসতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো কেউ। নূর দেখতে পেল মধ্যবয়স্ক এক মহিলাকে। অতি দাম্ভিকতার সহিত বসে আছে সে। মহিলাটি হাতের ইশারায় নূরকে গাড়ির ভেতরে বসতে বলল। নূর ভেতরে বসে বলল,
–হ্যাঁ বলুন কি বলবেন? আর কে আপনি?
–আমি মিসেস রেহনুমা শাহরিয়ার। আদিত্যর মা।
আদিত্যর মা! নূর অনেক টা অবাক হলো। আদিত্যর মা এখানে কী করছে হঠাৎ। নূর জিজ্ঞেস করলো,
–আপনি আমার সাথে কী কথা বলতে চাইছেন?
–সবই জানতে পারবে। তবে এখানে নয়। চলো আমার সাথে। রফিক সামনের ***রেস্টুরেন্টে নিয়ে চলো।
একটু পরেই গাড়ি রেস্টুরেন্টের সামনে এলো। ড্রাইভার দরজা খুলে দিলে রেহনুমা নেমে দাঁড়াল। নূরও নামলো। নূরকে সাথে নিয়ে ভেতরে গিয়ে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে নূরকেও বসতে বলল। নূর বসে বলল,
–হ্যাঁ বলুন কী বলবেন?
–বলছি, আগে কিছু অর্ডার করো। বলো কী খাবে?
–কিছুই না। আমি এখানে খেতে আসিনি। এমনিতেও এখানে খাওয়ার না আমার সামর্থ্য আছে আর না ইচ্ছে। তাই সোজা কথায় আসুন।
–চিন্তা করোনা বিল আমি দিয়ে দিবো। যা খুশি তাই অর্ডার করো।
নূর স্মিথ হেঁসে বলল,
–অপরিচিত কারোর কাছ থেকে খাওয়ার মতো মনোভাব অন্তত আমার এখনো পর্যন্ত তৈরি হয়নি। যেদিন হবে সেদিন বলব, এসে ইচ্ছে মতো খাইয়ে যেয়েন। এখন কিছু বলার থাকলে বলুন। নাহলে আমি চললাম। সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য।
–ঠিক আছে তাহলে সোজা কথাতেই আসি। দেখ তুমি নিশ্চয় আন্দাজা করতে পেরেছ আমি কোন বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। আমি এখানে তোমার আর আমার ছেলের বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। সেদিন নিউজে তোমার ব্যাপারে জানতে পেরেছি আমি। আদি বলে সে নাকি তোমাকে ভালোবাসে। যাইহোক এটা কোনো ব্যাপার না। আজকালকার ছেলেদের কাছে ভালোবাসা হলো ফ্যান্টাসি। যখন যেকোনো সময় কারোর প্রতি একটু ইন্টারেস্ট জাগলেই মনে করে ভালোবাসা হয়ে গেছে। কিন্তু মা বাবাদের কাজ হলো সেটা সুধরে নেওয়া। ছেলে মেয়েকে সঠিক পথ দেখানো। জীবনসঙ্গি হিসেবে একজন সঠিক ব্যক্তি এনে দেওয়ার। যে ছেলের সাথে সাথে পরিবারের সাথেও ম্যাচ হবে। লোকে দেখে যাতে বলতে পারে মেড ফর ইচ আদার কাপল। কিন্তু ছেলের নাকি তোমাকে পছন্দ। এখন তুমিই বলো এটা কোনো ম্যাচ হলো? আমি খোঁজ নিয়ে সব জেনেছি। একজন সেলিব্রিটির সাথে তোমার মতো গ্যারেজ মেকানিক কম টেক্সি ড্রাইভারের কোনো মিল আছে? ভাবতেই কেমন অড লাগছে। লোকে কী বলবে। তিরস্কার করবে সবাই। তুমি কী বলবে! তোমাদের মতো মেয়েরা তো এমন ছেলেকে পাওয়ার জন্য দিনরাত দোয়া চাও। তাইতো নিজের জালে ফাঁসিয়েছ আমার ছেলেটাকে। কিন্তু তবুও আমি ছেলের খুশি চাই। তাই ওরজন্য একটা সুযোগ আমি তোমাকে দিতে চাই। কিন্তু তারজন্য তোমাকে পরিবর্তন হতে হবে। তোমাকে এসব লো ক্লাস কাজকর্ম ছাড়তে হবে। কাপড়চোপড়, চলাফেরা, কথাবার্তায় ক্লাসি আর মার্জিত হতে হবে। হ্যাঁ জানি তুমি তোমার পরিবার চালানোর জন্য কাজ করো। তবে চিন্তা নেই। এখন থেকে তোমার পরিবারের জন্য টাকাপয়সার খরচ আমি দেব। তোমাকে শুধু আমাদের পরিবারের বউ হওয়ার যোগ্য হয়ে দেখাতে হবে। আর যদি না পারো। তাহলে সরে যাও আমার ছেলের জীবন থেকে। তার পরিবর্তেও যতো চাও এমাউন্ট দিতে রাজি। তোমার সাত বংশধর বসে বসে খাবে এতো টাকাও দিতে পারবো আমি। এখন বলো কোন অপশনে যেতে চাও?
এতক্ষণ ধরে রেহনুমা বেগমের বয়ান শুনছিলো নূর। সব শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলো নূর। তারপর হঠাৎ হো হো করে হেঁসে উঠল সে। হাসতে হাসতে উল্টে পড়ার উপক্রম। রেহনুমা নূরের প্রতিক্রিয়ায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মেয়েটা কী পাগল নাকি? এভাবে পাগলের মতো হাসছে কেন? কতক্ষণ পর অনেক কষ্টে হাসি থামাল নূর। তারপর বলে উঠল,
–আমিতো ভেবেছিলাম শুধু আপনার ছেলেই বুঝি এই লাইনে আছে। এখনতো দেখছি এটা আপনাদের খানদানি পেশা।
রেহনুমা ভড়কে গিয়ে বলল,
–মানে? কী বলছ তুমি? কীসের পেশা?
–ড্রামাবাজি করার পেশা।কথায় কথায় ফিল্মি ডায়লগ ঝাড়া। আই সোয়্যার আন্টি, আপনি ট্রাই করলে আদিত্যর থেকেও বেশি পপুলার হতে পারবেন। আমি জীবনেও ভাবিনি এসব ফিল্মি ড্রামা আমার সাথেও হবে।
নূর রেহনুমার মতো করে এক্টিং করে বলল,
— “কত টাকা নিয়ে আমার ছেলেকে ছাড়বে?” লাইক সিরিয়াসলি!
বলেই আবার হাসলো নূর। তারপর বলল,
–এখন নিশ্চয় আপনি ভাবছেন আমি দুঃখীয়ারি নারীর মতো বলব, চৌধুরীনি সাহেবা,আমার ভালোবাসা এতো সস্তা নয় যে আপনার সামান্য টাকার সামনে বিক্রি হয়ে যাবে। ভালোবাসা টাকা দিয়ে কেনা যায় না ব্লা ব্লা..। ওয়েল দেন, সরি টু ডিসিপয়েন্ট ইউ আন্টি। আমি এই ক্যাটাগরিতে পরিনা। এক্সুয়ালি আপনি ভুল জায়গায় আপনার প্রতিভার প্রদর্শন করছেন। এসব ডায়লগ আমাকে বলে চার পয়সার লাভও নেই। কারণ আপনার ছেলের সাথে আমার কোনো সীন চলছেনা। হ্যাঁ উনি আমাকে ভালোবাসে তা জানিয়েছে। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে রেসপন্স শূন্য। কারণ এসব ক্যাচাল আমার জন্য না। এবং আমি তাকে এটা হাজার বার বলেছি। তবুও সে জেদ ধরে আছে। তো এতে আমি কী করতে পারি বলুন? তো যখন আমি তাকে ধরেই রাখিনি তাহলে ছাড়ার প্রশ্ন কোথাথেকে আসছে। তাই আমাকে না বলে আপনার এসব আকর্ষণীয় অফার বরং আপনার ছেলেকে গিয়ে দিন। হতে পারে আপনার সাথে সাথে আমার জন্যেও সুবিধা হলো একটু। ওকে আন্টি? এখন তাহলে আসি আমি।
বলেই উঠে চলে যেতে নিলো নূর। এক কদম এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে রেহনুমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
–আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা না বললেই নয়। আমার পরিবারের জন্য এতটা ভেবেছেন তারজন্য ধন্যবাদ। তবে নূর একাই তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট। নূর কখনো কারও জন্য নিজেকে বদলাবে না। নূর নিজের শর্তে চলে। অন্যের শর্তে নয়। আসি। ভালো থাকবেন।
বলেই বেড়িয়ে গেল নূর। নূরের ব্যবহার মোটেও ভালো লাগলোনা রেহনুমার কাছে। ছেলের জন্য সে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে তারও যোগ্য না। অভদ্র আর অসামাজিক মেয়ে। নাহ এই মেয়েকে সে তার বাড়ির বউ কখনোই করবেনা। ছেলেকে বোঝাতে হবে তার। আদিত্য মায়ের কথা ফেলবেনা সে বিশ্বাস আছে তার।
রেস্টুরেন্টের বাইরে আসতে আসতে নূরের অদ্ভুত এক অস্থিরতা অনুভব হতে লাগলো। বুকের মাঝে কেমন অশান্তি হচ্ছে ওর। যেন ঘূর্ণিঝড় চলছে প্রবল বেগে। এমন কেন লাগছে তার? ভেতরে তো সত্যিই বলেছে সে? সেতো ভালোবাসেনা আদিত্যকে। তাহলে কেন খারাপ লাগছে তার? কেন মনে হচ্ছে তার মন তার মস্তিষ্কের সাথে সহমত হচ্ছে না? নাহলেও কিছু করার নেই। যে কাহিনি শুরু হবার নয় তা নিয়ে ভেবে কী লাভ? এটাই হয়তো দুজনের জন্যই ভালো হবে।
___
অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে আদিত্য। জ্বরের কারণে দুদিন শুটে যেতে পারেনি। বলতে গেলে যেতে দেওয়া হয়নি তাকে। মা জননী কোনোমতেই এই অবস্থায় যেতে দেয়নি তাকে। নাহলে আদিত্য অসুস্থ শরীরেই চলে যেত। অসুস্থ হয়েই তো সেদিন নূরের এতটা কেয়ার পেয়েছিল। নূরকে ওভাবে কাছে পাওার জন্য আদিত্য রোজ অসুস্থ হতে রাজি। নূরের মনে যে সে একটু হলেও জায়গা করতে পেরেছে তার আভাস পাচ্ছে সে। আগের মতো হলে নূর কখনোই তার এতে খেয়াল করতোনা। সেদিন দূর নেই যেদিন নূরের মনে সে পুরোপুরি জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে। ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠল আদিত্যর। ওর গ্যাং এর লোক ফোন করেছে। যাকে সে নূরের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেছিল। আদিত্য রিসিভ করলে ওপাশ থেকে বলল,
–স্যার, ম্যামের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছি।
–বলো কী জেনেছ।
–স্যার, ম্যামের যে গ্যারেজ আছে সেটা নাকি তার চাচার জায়গা। উনার বাবা গ্যারেজ দেওয়ার সময় জায়গা বদল দিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু ম্যামের চাচা এখন তার জায়গা বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে। যার কারণে ম্যামের গ্যারেজ বন্ধ হয়ে গেছে।
–বিক্রি কী হয়ে গেছে?
–না এখনো হয়নি। তবে ওখানে বিক্রির জন্য বোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সময় হয়ে যেতে পারে।
–হুম, ঠিক আছে। এখন আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো। এবং অনুযায়ীই কাজ করবে।
আদিত্য সব প্ল্যান বুঝিয়ে দিলো লোকটাকে। তারপর ফোন রেখে দিলো। নূরের স্বপ্নকে হারাতে দিবেনা সে। এখনতো ওই গ্যারেজ আমার জন্যেও স্পেশাল। ওখানেই তো পেয়েছি তোমাকে।
__
আহানা কলেজ থেকে ফ্রেন্ডসদের সাথে রেস্টুরেন্টে এসেছে একটু আড্ডা দিতে। কিন্তু কে জানতো এখানেও আড্ডায় বালি মেশাতে ওই লোকটাও থাকবে। ফ্রেন্ডদের সাথে একটা টেবিলে বসতেই ওর এক বান্ধবী পাশের টেবিলে ইশারা করে বলল,
–আহানা এটা সেই ফেমাস ফ্যাশন ডিজাইনার আবির না? তোর ভাইয়ের ফ্রেন্ডও নাকি?
ঝট করে পাশে ফিরে তাকালো আহানা।হ্যাঁ আবিরই বসে আছে ওখানে। বরাবরের মতোই গোপিদের সাথে বসে কৃষ্ণ সেজে রাসলীলা করছে সে। উফফ, কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। সবখানে এই অসহ্য লোকটা কোথাথেকে এসে টপকে? আহানা ভাবলো ফ্রেন্ডসদের সাথে নিয়ে আবির দেখার আগেই চলে যাবে। কিন্তু আবারও ধরাশায়ী হয়ে গেল সে। আবির দেখে ফেললো ওদের। আর এদিকে ওর এক বান্ধবী আবিরের উপর ক্রাশ টাইপ কিছু খেয়ে হজম করতে করতে বলল,
–ওয়াও ইয়ার, এটাও কিন্তু হ্যান্ডসাম কম না। আদিত্যর চেয়ে বেশি না হলেও প্রায় সমান সমানই এট্রাক্টিভ। শুনেছি ক্যাসানোভা ইমেজ উনার। ইয়ার একটু ইন্ট্রো করিয়ে দেনা।
অসহ্য বিরক্তিতে হাত পায়ের রগ শিনশিন করে উঠল আহানার। ওর বান্ধবীও যে এতো টপ লেভেলের লুচ্চি তা জানা ছিলোনা। মানে এই সিনেমার মিশা সওদাগরের মতো চরিত্রের লোকের ওপর আবার কেউ ক্রাশ কীভাবে খেতে পারে? এর চাইতেতো হিরো আলমও ভালো আছে। আহানা ওর বান্ধবীকে রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই আবির এসে হাজির হলো ওদের সামনে। এসেই তার বিখ্যাত বাঁকা হাসিটা দিয়ে বলল,
–কিরে আন্নি কলেজ ফাঁকি দিয়ে এখানে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে?
আহানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–ফাঁকি দেইনি। ক্লাস হবেনা আজ। তাই এসেছি।
আবির এবার তার ধ্যান পরিবর্তন করলো আহানার বান্ধবীদের উপর। হাস্যজ্বল মুখে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
–হেই বিউটিফুল গার্লস হোয়াটস আপ। বান্দাকে আবির রায়হান বলে। নামতো সুনা হি হোগা।
আহানার বান্ধবী গদগদ হয়ে বলল,
–ইয়া সিওর, শুনেছি তো অবশ্যই। আহানাকে আপনার কথাই জিজ্ঞেস করছিলাম মাত্র। বসুন না ভাইয়া।
আবির আহত হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
–আহ,দিলেতো আমাকে অসুস্থ করে?
–মানে?
আবির চেয়ার টান আয়েশ করে বসে বলল,
–মানে আমার এই ভাইয়া ডাকে ম্যাসিভ এলার্জি আছে। একেবারে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যায় আমি। নিঃশ্বাস নিতে পারিনা আমি।
আহানার বান্ধবী নেকামি করে বলল,
–অঁওও..সো সরি। তাহলে এখন আপনার এলার্জির অ্যান্টিডোট কী হবে?
আদিত্য টেবিলে হাত রেখে মেয়েদের দিকে হালকা এগিয়ে গিয়ে ফ্লার্টিংএর আন্দাজে বলল,
–আছে তো,তোমাদের এই সুন্দর মাধুর্য ভরা কন্ঠে শুধু একবার ডার্লিং বলে ডাকো। ব্যাস এতেই আমার এলার্জি উল্টো পায়ে দৌড়াবে।
মেয়েগুলো হেঁসে দিয়ে বলল,
–আপনি সত্যিই অনেক ফানি। তা এমন অ্যান্টিডোট আরও কতজনের কাছ থেকে নিয়েছেন শুনি।
আদিত্য মহান ব্যাক্তিত্বর মতো করে বলল,
–আমারতো জীবনের একটাই মোটো, সবার মাঝে ভালোবাসা বিলিয়ে যাও। দুনিয়াতে কী নিয়ে এসেছিলে আর কী নিয়ে যাবে। খালি হাতে এসেছিলে আর খালি হাতেই যেতে হবে। তাইতো যতো পারো প্রেম নিবেদন করে যাও। যেমন আমি নিজেকে জনকল্যাণে উৎসর্গ করে দিয়েছি। নিজের কথা না ভেবে রাত দিন প্রেম বিতরণ করে নারীজাতির মাঝে খুশির বর্ষণ করে যাচ্ছি । আমার কথা একটাই। যতো পারো পূন্য করে যাও, ফলের আশা করোনা। ফলতো বাজার থেকেও কেনা যায়।
আবিরের মহান প্রবচন শুনে মেয়েগুলো খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আহানা এসবে প্রো লেভেলের বিরক্তি হয়ে যাচ্ছে। অসহ্য বিরক্তিতে দাঁতে কিড়মিড় করে বলল,
–আপনি এখানেও শুরু হয় গেছেন? আমার বান্ধবীদের তো কমছে কম রক্ষা দিন। এই বাজে স্বভাব কী কখনো যাবে না আপনার?
আবির ঘাড় কাত করে তাকালো আহানার পানে। চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে আহানার পানে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–না যাবে না।
আবির বাঁকা হেসে গেয়ে উঠলো,
♬ কথা হবে,দেখা হবে, প্রেমে প্রেমে মেলা হবে
♬ কাছে আসা আসি আর হবেনা
♬ চোখে চোখে কথা হবে,ঠোঁটে ঠোঁটে নাড়া দিবে
♬ ভালো বাসাবাসি আর হবে না
♬ শত রাত জাগা হবে, থালে ভাত জমা রবে
♬ খাওয়া-দাওয়া কিছু মজা হবে না
♬ হুট করে ফিরে আসে, লুট করে নিয়ে যাবে
♬ এই মন ভেঙে যাবে জানো না
♬ আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না
♬ আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না।
♬ ভুলভাল ভালোবাসি, কান্নায় কাছে আসি
♬ ঘৃণা হয়ে চলে যাই, থাকি না
♬ কথা বলি একা একা,সেধে এসে খেয়ে ছ্যাঁকা
♬ কেনো আবার গাল দাও, বুঝি না
♬ খুব কালো কোনো কোণে,গান শোনাব গোপনে
♬ দেখো যেন আর কেউ শোনে না
♬ গান গেয়ে চলে যাবো,বদনাম হয়ে যাবো
♬ সুনাম তোমার হয় হোক না
♬ আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না
♬ আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না
♬ যদি তুমি ভালোবাসো, ভালো করে ভেসে এসো
♬ খেলে ধরা কোনোখানে রবে না
♬ আমি ছুঁয়ে দিলে পরে অকালেই যাবে ঝড়ে
♬ গলে যাবে যে বরফ গলে না
♬ আমি গলা বেচে খাবো,কানের আশেপাশে রবো
♬ ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কথা কভু হবে না
♬ কারো এক দিন হবো,কারো এক রাত হবো
♬ এর বেশি কারো রুচি হবে না
♬ আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না
♬ আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না
দুজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুখোড়। যেন চোখে চোখেই ওয়ার্ল্ড ওয়ার চলছে। আহানার নজরে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট হলেও আবিরের দৃষ্টি রহস্যময়। যার স্পষ্টিরুপ শুধু তার মাঝেই আবদ্ধ। আপাতত সে আহানার ঘৃণিত দৃষ্টির আনন্দ নিচ্ছে। গান শুনে হাতের করতালিতে দৃষ্টি পরিবর্তন হলো। আবির হাসিমুখে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল,
–ওকে গার্লস সি ইউ লেটার। লাভ ইউ, দুয়াওমে নাহলেও উম্মাহ-ওমে ইয়াদ রাখনা। বাই গার্লস।
সানগ্লাস চোখে দিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল আবির। রাগ আর কষ্টে আবারও তিক্ত হয়ে গেল আহানার মন। দুনিয়াতে সে এই লোকটাকে সবচেয়ে ঘৃণা। হ্যাঁ ঘৃণাই করে, আর কিছু না। আর কিছু থাকলেও তা ঘৃণার উপরে ভারী হতে দিবোনা আমি।
আবিরও যেতে যেতে মনে মনে বলল,
–আমিও সেটা কখনো হতে দিবোনা। এই ঘৃণার সম্পর্ক যে আমার কাছে সবচেয়ে স্পেশাল। এটাকে সবার মতো সাধারণ হতে দিবোনা।তুই শুধু ঘৃণা করবি আমাকে। এই ছাড়া আর কোনো অনুভূতির অধিকার নেই তোর। আমি তোকে সেই অনুমতি দিবোনা।
__
রোজকার সময় অনুযায়ী আদিত্যর ভ্যানের দিকে যাচ্ছিলো নূর। হঠাৎ নজর গেল তার পাশের শুটিংয়ের স্থানে। না চাইতেও কদম চলা বন্ধ হয়ে গেল তার। গানের শুটিং করছে আদিত্য।সাদা শার্ট প্যান্ট তার পরনে। শার্টের সব বোতাম খোলা। হয়তো দর্জি লাগাতে ভুলে গেছে।ব্যাকরাউন্ডে মিউজিক চলছে, সেই তালে তাল মিলিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে স্টাইল নিয়ে হেঁটে আসছে আদিত্য। সামনে বিশাল বিশাল দুটো স্টান্ট ফ্যানের তীব্র বাতাসে শার্টের দুই পার্ট উড়িয়ে দিয়ে সম্মুখভাগ পুরো খোলা ময়দানে পরিণত হলো। ফর্সা সুঠাম দেহটা এবার দৃশ্যমান। নূরের চোখের দৃষ্টি আকর্ষিত করছে আদিত্যর এই চার্ম। চেয়েও দৃষ্টি সরাতে পারছেনা সে। যেন দৃষ্টি তার চরম অবাধ্য হয়ে গেছে। ঘোর লেগে যাচ্ছে তার। তবে হঠাৎই নূরের চেহারার রঙ বদলে গেল। যখন এই সুদর্শন পুরুষের হাত ধরলো অন্য একটা মেয়ে। শুধু হাত ধরে চুপ রইলো না। হাত ধরে আদিত্যর সাথে ঘুরে ঘুরে নাচা শুরু করে দিলো। মেয়েটা নায়িকা সামাইরা। নূরের ঘোর কেটে গেল ঝটকা মেরে।মুগ্ধতা এবার তিক্ততায় রুপ নিলো। হঠাৎ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো নূরের। মনে হচ্ছে শরীরে কেমন জ্বলন ধরলো। গলায় যেন কিছু আটকে আসছে। বুকের ভেতর কেমন জ্বলন অনুভব হচ্ছে। পরিবেশ হঠাৎ যেন তপ্ততায় ভরে উঠল। এমন লাগছে কেন আমার? আমি কী কোনোভাবে জেলাস ফীল করছি? না না অসম্ভব। আমি আর জেলাস? নো ওয়ে। একদমই না। মনে হয় এসিডিটি হয়েছে। সকালে পরোটা খাওয়া হয়তে বেশি হয়ে গেছে তাই এমন লাগছে। হ্যাঁ তাই হবে। একটা সেকলো খেলেই সেরে যাবে। নিজের মতো যুক্তি দিয়ে মনের অন্য অনুভূতিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালালো নূর। এখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত সরে গেল।
নূর যেতেই আদিত্য হাত উঠিয়ে শুটিং বন্ধ করে দিলো। আজকের মতো প্যাকআপ ঘোষণা করে নিজের ভ্যানিটির দিকে এগুলো সে। নূরকে তখন দেখেছিলো সে। তার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাও দেখেছে। আবার হঠাৎ তার চেহারার রুপ পরিবর্তন হওয়াও খেয়াল করেছে। সামাইরাকে ওর সাথে দেখে নূরের যে মনোভাবের প্রতিক্রিয়া ছিলো তা চেহারায় ঠিকই ফুটে উঠেছিলে। তারমানে নূর জেলাস ফীল হচ্ছে। আর এটা আদিত্যর জন্য পজিটিভ সাইন। ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে আদিত্যর। সেই খুশি মনেই ভেতরে গেল সে। ভেতরে এসে নূরের পাশে বসলো সে। নূর আরচোখে তাকালো আদিত্যর দিকে। আদিত্যের পরনে এখনো সেই পোশাক। যা এখন সূচের ন্যায় বিঁধছে নূরের চোখে। দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্রী পোশাক মনে হচ্ছে এটা। আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো মনকামনাও জাগছে মনে। নূর তিক্ত স্বরে বলল,
–এখানে কী শুটিং চলছে? তো এখনো এই অসহ্য পোশাক পড়ে বসে আছেন কেন?
আদিত্য বাঁকা হেঁসে বলল,
–কেন? কী খারাপ আছে এই পোশাকে? ডোন্ট আই লুক এট্রাক্টিভ ইন দিস আউটফিট?
নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–এট্রাক্টিভ না ছাই। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স লাগছে পুরো। আর শার্টের বোতাম গুলো ডিজাইনের জন্য লাগিয়ে রাখা হয়না। এটার একটা কাজ আছে। পোশাক ঠিকমতো পরিধান করতে না পারলে, না পরাই শ্রেয়।
আদিত্য দুষ্টু সুরে বলল,
–তারমানে তুমি বলতে চাইছ আমি তোমার সামনে বিনা কাপড়ে আসি! আঃ নটি গার্ল। ভেতরে ভেতরে এতো বোল্ড তুমি জানা ছিলো নাতো। বাইদাওয়ে কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। কোনোকিছু পুড়ছে মনে হয় তাইনা?
আদিত্য নাক টেনে টেনে গন্ধের উৎস খোঁজার মতো করে নূরের কাছে শুঁকে শুঁকে বলল,
–হুম, গন্ধটা এখান থেকেই আসছে। মনে হয় তোমার কলিজা পুড়ছে।
আদিত্যর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে নূর চোখ গরম তাকালো আদিত্যর পানে। আদিত্য ফিচেল হেঁসে বলল,
–আরে রাগছ কেন? জেলাস ইজ গুড ফর হেল্থ। যখন কাছের কাউকে অন্য কারও সাথে দেখে রাগ হবে। তখনই বুঝতে হবে তুমি তার প্রতি দূর্বল।
–আপনার যদি এসব অবান্তর কথা বলাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে যাচ্ছি আমি।
–আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কাম ডাউন। চলো কাজ করা যাক।
নূর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মনোযোগ দিলো। তবে আদিত্যর কথা ঠিকই তার মস্তিষ্কে ঘুরছে। ঘুরুক, তাতে পাত্তা দিবেনা নূর। ভালোবাসা হাঁহ্, কতো সহজে বলে দেয় উনি। সবকিছু কী এতই সোজা? কালকে তার মায়ের মনোভাব শুনলে আর এতো সহজে বলতে পারতো না। কিন্তু নূর আদিত্যকে কিছু বলবেনা। কী দরকার আছে? এমনিতেও তাদের একসাথে কোনো ভবিষ্যত নেই। তাহলে কেন শুধু শুধু এসব কথা বলে মা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট করবে। সে তার জায়গায় ঠিকই আছে। ছেলের মেয়ের জন্য সবাই ভালোটাই আশা করে। আর আদিত্যের মাও সেটাই চাইছে। আদিত্য হয়তো এখন বুঝতে পারছে না। কিন্তু একসময় সেও ঠিকই বুঝে যাবে। আমাদের মঞ্জিল আলাদা। আর মঞ্জিলের পথও আলাদা।
চলবে…..
#শৈবলিনী—২৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★দিনের শেষে বাসায় পা রাখতেই চাচাকে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে চমকে গেল নূর। ভয় হতে লাগলো তার। তবে কী সত্যিই চাচা গ্যারেজের জমি বিক্রি করে দিয়েছে? সেটাই কী বলতে এসেছে আজ? শেষমেশ আমি পারলাম না আমার বাবার স্মৃতিকে বাঁচাতে? ভাবতেই অন্তর ভারী হয়ে এলো নূরের। ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। কম্পিত পায়ে এগুলো সে ভেতরে। নূরকে দেখে লতিকা বেগম খুবই খুশিখুশি মনে বলল,
–এসেছিস মা, আয় বয়। একটা খুশির খবর আছে। আল্লাহ মেহেরবানী করেছে আমাদের ওপর।
নূর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–মানে? কী খুশির সংবাদ?
নূরের চাচা তখন বলে উঠল,
–আমি বলছি। আসলে তোর বাবার সাথে জমি বদল করে আমি যেটা নিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ সেই জমির এক বড়ো গায়েক এসেছিল। আর ওই জমির জন্য আমাকে তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনে নিয়েছে। যা তোমাদের গ্যারেজের ওই জমির চেয়েও অনেক বেশি। আর এই টাকায় আমার সব ঋণও শোধ হয়ে যাবে। তাই আর এখন তোমাদের গ্যারেজের জমিন টা বিক্রি করছিনা আমি। যেহেতু আমার ভাগের জমিনটা আমি বিক্রি করে দিয়েছি তাই এই জমিন এখন তোমাদের। তোমরা চাইলে নিজের নামে রেজিষ্ট্রেশনও করে নিতে পারো।
নূরের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। সেকি ঠিক শুনছে? তারমানে ওর বাবার স্মৃতিটা সহিসালামত থাকবে! অনাবিল আনন্দে নূরের চোখে পানি চলে এলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে নূর বলল,
–সত্যিই বলছেন চাচা? সত্যিই এই জমিন আর নিবেন না আপনি?
–নারে মা,আমি ইচ্ছে করে এমনটা করতে চাইনি। আসলে বিপদে পড়ে এমন করছিলাম। এখন যখন অন্য উপায়ে আমার বিপদ কেটে যাচ্ছে তাহলে আর তোদের কেন ক্ষতি করবো? আমিতো আর দুশমন না তোদের।
–আমি কী বলে যে আপনার শুকরিয়া জানাব বুঝতে পারছিনা। এই জমিন আমাদের ফিরিয়ে দিয়ে কতবড় উপকার করলেন তা বলে বুঝাতে পারবোনা। ওটা শুধু গ্যারেজ না। আমার বাবার শেষ স্মৃতি। ওটা খোয়া গেলে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারতাম না আমি। অনেক অনেক ধন্যবাদ চাচা। আপনার এই উপকার আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
–আরে আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কী আছে? ধন্যবাদ তো ওই কাস্টোমারকে দেওয়া উচিত। যে দূত হয়ে এসে আমাদের সবার বিপদ উদ্ধার করলো।
ইভান পাশ থেকে বলল,
–কিন্তু কে ছিলেন উনি? আর এতটাকা বেশি দিয়ে জমিন নিলেন কেন?
–কী জানি চিনিনা তাদের। আসল মালিক আসেনি। শুধু তার লোক এসে টাকা দিয়ে জমি কিনে নিয়েছে। উনারা নাকি ওই জমিনে কোনো ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান করবেন। জায়গাটা নাকি তাদের জন্য পারফেক্ট। তাই বেশি দাম দিয়ে কিনেছে। আমিও আর ওসব বেশি ঘাটতে যায়নি। আমার টাকা আসলেই হলো।
নূর মনে মনে সেই ব্যাক্তির জন্য দোয়া করলো। আল্লাহ যেন তাকে ভালো রাখে। আজ তার জন্যই আমাদের উপর থেকে এতবড় বিপদ কেটে গেল। তার সব মনকামনা যেন আল্লাহ পূরণ করেন।
একটু পরে ফ্রেশ হতে রুমে এলো নূর। খুশি যেন ধরছেনা তার। কারো সাথে খুশি শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। হঠাৎ আদিত্যর চেহারা সামনে ভেসে উঠল নূরের। কেন যেন তার সাথে এই খুশি শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। নূর মাথা ঝাকিয়ে নিজের খেয়ালটাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো। আজকাল মগজে তার ভাইরাস ধরে গেছে। যখন যা খুশি খেয়াল নিয়ে আসে।
___
আদিত্য নিজের রুমে বসে বসে ভাবসে, নূর নিশ্চয় এতক্ষণে খুশির সংবাদ টা জেনে গেছে। ওর লোকগুলো তো দুপুরেই জানাল কাজ হয়ে গেছে। তাহলে এতক্ষণে নূর নিশ্চয় খবর পেয়ে গেছে। আচ্ছা নূর কী এটা শুনে অনেক খুশি হয়েছে? ইশশ,আমি যদি তার ওই খুশিভরা মুখটা দেখতে পেতাম একবার। আমার নূর খুশি হলে পুরো পৃথিবীটাই যেন খুশিতে ভরে ওঠে। তার খুশিতে নেচে উঠে প্রকৃতি। একদিন তার খুশির কারণ আমি হবো। তার অনুভূতি জুড়ে শুধুই আমি হবো। সেইদিন হবে এই অপেক্ষার অবসান। সুখের প্রলয়ে ভেসে যাবো আমরা। সেইদিন খুব বেশি আর দূরে নেই। আমাদের প্রণয়ের সময় জলদিই আসবে।
আদিত্যর ভাবনার মাঝেই কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে পাশে ফিরে তাকালো আদিত্য। রেহনুমা এসেছেন ছেলের কাছে। আদিত্যর পাশে বেডের ওপর এসে পা ঝুলিয়ে বসলেন তিনি। আদিত্য মুচকি হেসে বলল,
–মা তুমি! কিছু বলবে?
রেহনুমা নরম সুরে বলল,
–কেন? দরকার ছাড়া বুঝি আসতে পারি না?
–কেন আসতে পারোনা। আরে তোমার অধিকারতো আমার উপর সবচেয়ে বেশি। তুমি যা চাও তাই আমার জন্য সবকিছুর উর্ধ্বে।
রেহনুমা আদিত্যর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেঁসে বললেন।
–সত্যিই? আমি যাই বলবো তা রাখবি তুই?
–অবশ্যই। তুমি চাইলে জানও দিয়ে দিবো।
–জান দিতে হবেনা। শুধু আমার একটা কথা মানলেই হবে।
–বলোনা মা।
–তোকে ওই মেয়ের খেয়াল মাথা থেকে বের করতে হবে।
চমকে উঠল আদিত্য। তীব্র বেগে ঝটকা খেল সে। মনে হলো যেন ভুল কিছু শুনলো সে। ওর মা কী নূরের কথা বলছে? আদিত্য চকিত নজরে তাকিয়ে বলল,
–মানে? কী বলছ তুমি মা? ওই মেয়ে বলতে কী তুমি নূরকে বুঝাতে চাইছ?
রেহনুমা গম্ভীর স্বরে বলল,
–হ্যাঁ ওই মেয়ের কথাই বলছি। দেখো এখন হয়তো আমার কথা তোমার কাছে ভালো লাগবেনা। মনে হতে পারে আমি তোমার খুশি চাইনা। কিন্তু আসলে তানা। মা সবসময় তার সন্তানের মঙ্গলই চায়। তুমি এখন হয়তো বুঝতে পারছনা। তবে পরে ঠিকই বুঝতে পারবে আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। প্রেম আর বিয়ে এক জিনিস না। প্রেম আজ আছে তো কাল ব্রেকআপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিয়ে অন্য জিনিস। এটা সারাজীবনের ব্যাপার। বিয়ে শুধু তোমার সাথে হবেনা, সমাজে তাকে এই বংশের বউ হিসেবে জানা যাবে।তাই অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখন ফ্লো ফ্লোতে তোমার ওই মেয়েকে বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু পরে সারাজীবন তোমার এই সিদ্ধান্তে পস্তাতে হবে।যখন এমন জীবনসঙ্গিনী নিয়ে তোমাকে সমাজে লজ্জিত হতে হবে। জীবন হেল হয়ে যাবে তোমার।আর আমি মা হয়ে তা কীভাবে হতে দিবো। ছেলেমেয়ে ভুল করলে মা বাবার দায়িত্ব তাদের সঠিক পথ দেখানো। তাই বলছি,আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো। ওই মেয়ে কোন দিক দিয়েই তোমার আর এই পরিবারের যোগ্য না। বউ হওয়া তো দূরে থাক। তাকে পুরোপুরি নারীই মনে হয়না। আর এমন গুন্ডি টাইপ মেয়ে কখনো এবাড়ির বউ হতে পারে না। তাই ওই মেয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তোমার হয়তো মনে হতে পারে আমি কোনো সুযোগ দিচ্ছি না তোমাকে। কিন্তু এমন না। সবকিছু জেনেও তোমার কথা ভেবে আমি নিজে ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওকে সুযোগ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম সে যদি নিজেকে বদলাতে পারে তাহলে আমি মেনে নিবো তাকে। কিন্তু ওই বেয়াদব মেয়ে উল্টো আমাকেই শুনিয়ে চলে গেল। ভাবো কতবড় উশৃংখল মেয়ে।
রেহনুমার এতক্ষণ ধরে সব চুপচাপ শুনলেও শেষের দিকে এসে আর চুপ থাকতে পারলোনা আদিত্য। সে কপাল কুঁচকে বলে উঠল,
–এক মিনিট, এক মিনিট! মা তুমি নূরের সাথে দেখে করতে গিয়েছিলে? তাও আবার আমার জন্য ওকে বদলাতে হবে এটা বলার জন্য? লাইক রিয়েলী! হাউ কুড ইউ মা! মা তোমার কাছ থেকে অন্তত এটা আশা করিনি আমি। আমিতো তোমাকে উন্নত চিন্তাধারার মানুষ ভেবেছিলাম। শেষমেশ তুমিও বাকিদের মতোই একই মনমানসিকতার পরিচয় দিলে? তুমি কাকে বদলাতে বলছ মা, নূরকে? কিন্তু ও যদি বদলে যায় তাহলে আমার নিজের কাছেই তো সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগবে। কারণ ও এমন বলেই ওকে আমি ভালোবাসি। ওর এই ইউনিক চরিত্রই আমার পছন্দ। তাহলে ও কেন নিজেকে বদলাবে? জাস্ট বিকজ ও মেয়ে বলে ওকে অন্যের জন্য নিজেকে বদলাতে হবে? কেন? আমি জেনে অবাক হচ্ছি তুমিও বাকিদের মতো বাহ্যিক সৌন্দর্য আর দেখানোতে বিশ্বাস করো। তাইতো তুমি আজ খাটি হিরাকে হলফ করতে ব্যার্থ হলে। নূর শুধু নামেই নূর না। ও সত্যিকারের নূরের আলো।
–আমার থেকে তুমি বেশি মানুষ চেনোনা আদিত্য। এসব মেয়েদের আমার ভালো করেই চেনা আছে। ওই মেয়ে…
আদিত্য এবার শক্ত গলায় বলল,
–প্রথমত ওর একটা নাম আছে। ওই মেয়ে না,ওর নাম নূর। তো নূর বলেই ডাকো। আর হ্যাঁ তুমি যতোই যুক্তি দাও তবে সরি টু সে, তুমি নূরকেও একবিন্দুও চিনতে পারোনি, মা। দুনিয়ার সব কৃত্রিমতার মাঝে ও প্রকৃতির এক অনন্য রুপ। ও কিন্তু চাইলে তোমার কথা আমাকে বলতে পারতো। কিন্তু ও বলেনি। কারণ ও চায়নি তোমার সাথে আমার মনমালিন্য হোক। আর এটাই হলো আমার নূর। যে ওকে চিনতে পারবেনা আমার মতে তারচেয়ে বড় অন্ধ আর কেউ নেই। আমি তোমার কোনো কথার কখনো অবাধ্য হইনি, মা। তবে তোমার এই কথা আমি মানতে পারবোনা। এটা আমার হাতেই নেই। আমি একবার আমার নিঃশ্বাস নেওয়া ভুলতে পারি। তবে নূরকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভবের চাইতেও অসম্ভব।
রেহনুমা এবার কড়া গলায় বলল,
–দেখ তোমার চোখে এখন মায়াজাল পরে আছে তাই ভালো মন্দ বুঝতে পারছনা। ব্যাপার না,সময় নাও। দেখ ফ্যান্টাসী পূরণ করতে চাইলে কিছুদিন প্রেম করতে পারো। তবে সারাজীবন ওই মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যত চিন্তা করার কথা ভুলে যাও।
বলেই উঠে চলে গেলেন রেহনুমা। আদিত্য স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো। তার বিশ্বাসই হচ্ছে এটা তারই মা। এতটা অযাচিত উপদেশ কীভাবে দিতে পারলো ওর মা? কিন্তু মাকে কীভাবে বুঝাবে যে, তার উপরে যে এখন তার কোনো আয়ত্ত নেই। সবটা দখল করে বসে আছে নূর। নূরকে ছাড়া বেঁচে থাকার ভাবনাটাও যে মৃ,ত্যু সমান। দুই হাতে মাথার চুল টেনে মাথা চেপে ধরলো আদিত্য। অনেক বড় চিন্তায় পড়ে গেল সে। এমনিতেই নূর এখনো পর্যন্ত ওর ভালোবাসায় ধরা দেয়নি। তারওপর মায়ের কথা শুনেতো নিশ্চয় আরও শক্ত হয়ে যাবে ও। এসব কী হচ্ছে। এখন সব সামলাবে কী করে ও?
__
পরদিন অনেক খুশিমনে ভার্সিটিতে পৌঁছাল নূর। নূরের প্রাণবন্ত চেহারা দেখে গিয়াস তার বিশেষ টিপুনির ঝুলি থেকে একটা আইটেম পেশ করে বলল,
–কীরে ডাইনোসরদের দাদাী আম্মা, এমন ফেয়ার এন্ড লাভলীর অ্যাডের মতো চকচক করতাছস কেন? কোনো ডাকাত গ্যাং জয়েন করছস নাকি? যাক শেষমেশ তোর প্রতিভার প্রদর্শন করতে এক্কেরে ঠিক প্রফেশনে গেছস। এই প্রফেশনে ফিউচার অনেক ব্রাইট তোর। দেশ বিদেশে তোর সুনাম ছড়িয়ে পরবে। আম সো প্রাউড অফ ইউ ইয়ার।
শিখা হেঁসে উঠে বলল,
–হ্যাঁ ইয়ার,তোকে আজ খুশি খুশি লাগছে। ঘটনা কী?
নূর হাসিমুখে বলল,
–ঠিকই বলেছিস আজ সত্যিই অনেক খুশি আমি। আসলে বাবার গ্যারেজ টা বেচে গেছে। সেটা আর খোয়া যাবেনা।
নূর ওদের সবটা বলল।সব শুনে শিখা খুশি হয়ে বলল,
–ওয়াও ইয়ার এটাতো সত্যিই অনেক খুশির খবর।আম সো ফর ইউ।
গিয়াসও সানন্দে বলল,
–আরে খুশি মানে, জব্বর খুশি। খুশিতে আয় একটু হাগাহাগি করি।
শিখা নাকমুখ শিটকে বলল,
–সালা গ্যাসের বাচ্চা গ্যাস,মুখের ঢাকনা খুললে শুধু দুর্গন্ধই বের করবি নাকি?
–ওমা,এখানে দুর্গন্ধের কী দেখলি তুই? কোলাকুলির ইংলিশ হাগাহাগিই তো হয়। ক্রিয়েটিভির কোনো কদরই দিতে জানিস না তোরা।
নূর হেঁসে দিয়ে বলল,
–আচ্ছা মন খারাপ করিসনা, আজ আমি অনেক খুশি। আয় তোর ভাষায়, হাগাহাগি করি।
নূর,শিখা আর গিয়াস তিনজন একসাথে আলতো করে ফ্রেন্ডলি ভাবে জড়িয়ে ধরলো। আর ঠিক আদিত্যর প্রবেশ ঘটলো ভার্সিটিতে। গাড়ির ভেতর থেকে সে এই হাগাহাগির দৃশ্য দেখতে পেল। কাল রাতে মায়ের কথায় এমনিতেই মুড অফ ছিলো আদিত্যর। ভেবেছিল এখানে এসে নূরকে দেখলে তার মুড ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে তার মুড ঠিক হওয়ার বদলে আরও হাজার ডিগ্রি হাই হয়ে গেল। চোয়াল কটমটে হয়ে এলো তার। যদিও সে জানে এটা কেবলই ফ্রেন্ডলি হাগ। তবুও সহ্য হচ্ছে না আদিত্যর। কথা যখন নূরের আসে তখন আদিত্য দুনিয়ার সবচেয়ে হিংসুটে ব্যক্তি হয়ে যায়। কারোর সাথে শেয়ার করতে পারে না সে নূরকে। আমার কাছে আসলে তো যেন কাটাপ্পা মামা হয়ে যান উনি। যেন আমি তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। একটু ভালো করে কথা বলাও তারজন্য দায় হয়ে যায়। অথচ বাকি দুনিয়ার সাথে তার কতো খাতির। এক আমিই শুধু তার চোখের কাটা। মনে মনে ভীষণ রাগ জন্মালো নূরের প্রতি। সাথে রাগের পাহাড় জন্মালো ওই গিয়াসের ওপর। এর একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে।
ক্লাস শেষে যথারীতি আদিত্যর ভ্যানিটিতে এলো নূর। তারমাঝে এখনো খুশির প্রসন্নতা বিরাজ কর ভেতরে এসে দেখলো আদিত্য সোফায় দুই হাত ছড়িয়ে হেলান দিয়ে মাথা উপরের দিকে রেখে চোখ বুজে বসে আছে। নূর আদিত্যর সামনে এগিয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতির জানান দিলো। আদিত্য সেই অবস্থাতেই চোখ খুলে তাকালো। নূরকে দেখে ছোট্ট করে বলল,
–বসো।
নূর সোফায় গিয়ে বসলো। আদিত্য আবারও চোখ বুজলো।নূর খেয়াল করলো আদিত্যকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে আজ। এমনিতেতো ওকে আসতে দেখলেই তার চেহারায় প্রফুল্লতা ছেয়ে যায়। নানান দুষ্টুমী ভরা কথায় নূরকে বিরক্ত করে ফেলে। তো এমন চুপচাপ রয়েছে কেন? শরীর কী খারাপ করেছে উনার? নূর আস্তে করে বলল,
–শরীর খারাপ নাকি আপনার? এভাবে বসে আছেন কেন?
ধীর গতিতে চোখ মেললো আদিত্য। নূরের দিকে ঘাড় কাত করে শান্ত তবে ভারী গলায় বলল,
–কেন? আমার কোনো কিছুতে তোমার যায় আসে বুঝি?
নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–মানে?
আদিত্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেঁসে বলল,
–বাদ দাও তুমি বুঝলে তো কথাই কী ছিলো।
আদিত্যর কথার মাঝে একরাশ অভিমান, অভিযোগ আর হতাশা প্রকাশ পেল। নূরের কেন যেন ভালো লাগছেনা আদিত্যকে এভাবে দেখে। কোথাও কিছু খচখচ করে বিঁধছে। আজ সে এতো খুশি কিন্তু উনার কী হয়েছে? লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? তার কী কোনো কারণে মন খারাপ? নূর না পেরে বলেই উঠল,
–কী হয়েছে বলুন তো? মন খারাপ আপনার?
আদিত্য এবার সোজা হয়ে বসলো। তারপর নূরের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ইনটেন্স নজরে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–হলেই বা কী করবে? তুমিতো আমার মনটাকে জুতোর নিচে থেঁতলে ফেলো। তখন কী একবারও মায়া হয় তোমার? তাহলে ভালো মন্দ জেনে কী করবে তুমি?
আদিত্যর এভাবে কথা বলা নূরের কেমন সহ্য হচ্ছে না। খারাপ লাগার পাহাড় জমছে যেন। বুকের মাঝে হু হু করছে। নূর জিজ্ঞেস করলো,
–হয়েছে কী আপনার? এভাবে কথা বলছেন কেন?
আদিত্য এবার ক্ষিপ্ত হয়ে নূরের দুই বাহু চেপে ধরে নিজের কাছে এনে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–তো কীভাবে বলবো বলো? কীভাবে বললে তুমি বুঝতে পারবে আমার ভেতরের অস্থিরতা? কীভাবে বললে আমার মনের আওয়াজ শুনতে পাবে তুমি? বলোনা কীভাবে? দুনিয়ার সবার সাথেই তোমার ভাব। শুধু আমার সাথেই যতো তোমার তিক্ততা। আমাকে দেখলেই তোমার চোখে যেন রাজ্যের যতো বিতৃষ্ণা এসে হাজির হয়। অথচ তোমার ওই হ্যাবলা বন্ধুকে যখন তখন জড়িয়ে ধরে গলায় গলায় ভাব করছ। কেন? আমার শরীরে ঘাঁ পঁচাড়ি আছে? তাহলে আমাকে এতো কেন উপেক্ষা করো তুমি? বলো? কেন, ড্যাম ইট কেন?
আদিত্যকে আজ কেমন অন্যরকম লাগছে। কেমন উন্মাদের মতো লাগছে তাকে। আর হ্যাবলা বলতে কী গিয়াসের বলছেন উনি? এবারে নূর যেন একটু একটু বুঝতে পারলো। লোকটা হয়তো আমাকে তখন গিয়াসকে হাগ করতে দেখেছে। সেকারণেই এমন পাগলামি করছে। কিন্তু এতে রাগার কী হলো তাই বুঝতে পারছেনা নূর। তবে লোকটার এমন অস্থিরতা নূরের ভালো লাগছে না। বুকের মাঝে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। ভেতরের স্বত্তাটা যেন বলছে, সেকি কোনোভাবে লোকটাকে শান্ত করতে পারে না?
নূরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য হঠাৎ নূরের মাথাটা তার বুকের বাম পাশে চেপে ধরে আবেগী কন্ঠে বলল,
–জানতে চাইলে, শোনো নূর,কান পেতে শোনো। শোনো কী বলে আমার প্রতিটা হৃদয়স্পন্দন। শুনতে পারছ হৃদপিণ্ডের কোলাহল? দেখ কেমন প্রতিটি ক্ষণে তোমার নামের মালা জপছে ওরা। প্রতিটি নিঃশ্বাস শুধু তোমার নামেই বের হচ্ছে।
হঠাৎ এমন হওয়ায় থমকে গেল নূর। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার কেন যেন এবার রাগ হলোনা। আদিত্যর কথা অনুযায়ী সত্যিই সে কান পেতে শুনতে পেল আদিত্যর হৃৎস্পন্দন। কী সুন্দর সুরে সুরে ধাবিত হচ্ছে। যেন বীণার সুর বাজছে। নূর মোহিত হয়ে যাচ্ছে এই মধুর ধ্বনিতে। হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। আদিত্যর হৃদয়ের সুর তার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। অজান্তেই নূরের হাত দুটো চলে গেল আদিত্যর পিঠে। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আবেশে লুকালো যেন আদিত্যের বুকে। চোখ বুজে বিমোহিত হয়ে আদিত্যর বুকে লেপ্টে থেকে তার হৃৎস্পন্দনের আলোড়ন শুনতে লাগলো। আদিত্যও সুখের আবেশে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিলো নূরকে। হাজার বছরের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে যেন শ্রাবণের ঘোর বর্ষা নামলো। সব রাগ ক্ষোভ মুহুর্তেই গলে পানি হয়ে গেল। প্রিয়তমার আলিঙ্গনে হৃদয় হলো সিক্ত,প্রশান্তিময়। মুহুর্তটা এখানেই থেমে যাক। নূর এভাবেই ওর বুকে ঘর করে থাক। আর কোনো চাওয়া নেই আদিত্যর।
হঠাৎ দরজায় কড়া পড়লো। ঘোর কাটলো নূরের। চোখ খুলে ছিটকে সরে এলো সে। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে । কী হয়ে গিয়েছিল আমার? কী করছিলাম আমি এসব? নূর তাকাতে পারছেনা আদিত্যর দিকে।অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো সে। কেমন যেন লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। আদিত্য যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের খোঁজ পেল। তা হলো নূরের লজ্জা রাঙা মুখ। এই মেয়ে লজ্জাও পায়? আদিত্য বাঁকা হেসে নূরের মুখের কাছে ঝুঁকে গিয়ে বলল,
–ওয়াও, তো মিস নূর লজ্জাও পেতে জানে। এটাতো চমৎকার হয়ে গেল। বাট আই লাভ দিস অলসো।
নূর অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
–হোয়াট রাবিশ, এমন কিছুই না। মনে হচ্ছে আজ কোনো কাজ নেই। তাই গেলাম আমি।
বলেই তড়িঘড়ি করে উঠে চলে যেতে নিলো নূর। কিন্তু পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো আদিত্য। হাত ধরে বলল,
–কোথায় যাচ্ছো? ভুলে গেছ আমি না তোমার প্যাসেঞ্জার? তো আমাকে না নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
নূর পেছনে না ঘুরেই বলল,
–কিন্তু আমিতো আজকেই শেষ টেক্সি এনেছি। আজকের পর আর চালাবোনা।
আদিত্য শুনে খুশি হলো। তারমানে নূর তার গ্যারেজ পেয়ে গেছে। আদিত্য উঠে গিয়ে নূরের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
–তো আজকেই শেষবার আমাকে তোমার প্যাসেঞ্জার হতে দাও।
মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বুঝালো নূর। দুজন বেড়িয়ে গেল। টেক্সিতে পুরো রাস্তা আদিত্য অপলক তাকিয়ে রইলো নূরের পানে। সেটা বুঝতে পেরে নূরের কেমন যেন লজ্জা লাগছিলো।তাকাতে পারছিলনা আদিত্যর পানে।আর নিজের এই অদ্ভুত কাজের জন্য নিজের ওপরই বিরক্ত হচ্ছে নূর। ইচ্ছে হচ্ছে নিজের দুই গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারতে। আজাইরা হুদাই এমন লজ্জার মতো ন্যাকামো মার্কা জিনিস ওর সাথে কেন হচ্ছে? এভাবেই একসময় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল ওরা। আদিত্য নামার একটা চকলেট বের নূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–এটা মিছরি কিউটিপাই-এর জন্য। ওকে দিও প্লিজ।
নূর সৌজন্যমূলক হেঁসে চকলেট টা হাতে নিলো। আদিত্য নামার জন্য এক পা নিচে নামিয়ে হঠাৎ আবার ঘুরে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–আচ্ছা শোনো,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও ভালো কথা। তবে বেশি ঘেঁষাঘেঁষি করতে যেওনা। না মানে দিনকাল তো ভালো না। দেখা গেল কখন কার কু নজর পরে গেল। আর তোমার বন্ধুই গুম হয়ে গেল। আর তুমি নিশ্চয় এটা চাইবেনা তাইনা? ওকে বাই দেন।
বলেই নেমে গেল আদিত্য। আদিত্যর হুমকি বুঝতে বেগ পেতে হলোনা নূরকে। বেচারা গিয়াস যে ভীতু এটা শুনলেই ও তিনবার করে কোমায় চলে যাবে।আর এই লোক কিনা এমন ছেলেকে নিয়েও হিংসে করছে। ভাবতেই হাসি পাঁচ্ছে নূরের। নিজে নিজেই হাসলো নূর। লোকটা সত্যিই পাগল। এই পাগল লোকটা ধীরে ধীরে আমাকেও পাগল করে দিচ্ছে। বশিভূত করছে যেন আমাকে। এসব ভাবনা চিন্তা আর ভালো কিছু অনুভূতির আলিঙ্গন নিয়ে বাড়ি ফিরলো নূর। কিন্তু সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আজ তার জীবনে কতবড় বিপদ আসতে চলেছে। ভয়াবহ এক অঘটন হতে চলেছে। যা তার রুহ কাঁপিয়ে দিবে।
চলবে……