শৈবলিনী পর্ব-২৬+২৭

0
432

#শৈবলিনী—২৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আদিত্যর ভালোবাসার রঙ নূরের ওপরও লেগেছে। মাত্রই নিজেকে সেই রঙে পুরোপুরি রাঙাতেই নিয়েছিল নূর। ঠিক তখনই ঘটে গেল অনাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যারজন্য নূর মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। আদিত্যকে নামিয়ে দিয়ে হাসিখুশি মুখেই বাড়ি ফিরলো নূর। তখনও সব ঠিকই ছিলো। খাবার টেবিলে যখন অমালিয়াকে দেখতে পেলনা নূর। তখন সে মায়ের কাছে জানতে চাইলো অমালিয়া কোথায়? লতিকা বেগম জানালো অমালিয়া নাকি সন্ধ্যার আগে বান্ধবীর বাসার কথা বলে বের হয়েছে। সেখানে কোনো দরকারী নোট নিতে গেছে সে। এমনটাই বলে গেছে সে। নূর বলল,
–তো এতক্ষণে তো চলে আসার কথা। এখনো আসেনি কেন?

ইভান বলল,
–আরে ওর কথা বলো নাতো। ও কি করে না করে ঠিক করে বলে নাকি। দেখ গিয়ে নোটের নাম করে ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। ওর দায়িত্ব জ্ঞান বলতে কিছু আছে নাকি। ওকে দরকার ইচ্ছেমত থাপড়ানো। তবেই ওর মগজ ঠিক জায়গায় আসবে।

নূর ফোন বের করে ফোন দিলো অমালিয়ার নাম্বারে। কিন্তু ফোন ধরছেনা সে। নূর ভাবলো হয়তো একটু পরে চলে আসবে। তাই আর বেশি ঘাটলোনা। তবে রাত দশটার পরও যখন অমালিয়া ফিরলোনা তখন ঘাটতে বাধ্য হলো নূর। ফোন করলো আবারও। কিন্তু এখন ফোন বন্ধ আসছে। এবার প্রচুর চিন্তা হতে লাগলো নূরের। অমালিয়ার বান্ধবীর নাম্বারও জানে না। তাই সেই নাম্বারেও ফোন দিতে পারছেনা। আপাতত বসে অমালিয়ার ফেরার অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করতে পারছেনা সে। লতিকা বেগম আর ইভানও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। দেখতে দেখতে রাত এগারোটা তারপর বারোটাও বেজে গেল। এখনো অমালিয়ার কোনো খবর নেই। এবার নূরসহ পুরো পরিবার ভয় পেয়ে যাচ্ছে। অমালিয়ার ফোন এখনো বন্ধ আসছে।টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে নূরের। আর বসে থাকতে পারলোনা সে। বাইরে বেড়িয়ে অমালিয়ার সেসব ফ্রেন্ডের বাসা চেনে সেখানে গিয়ে খোজ নিয়ে দেখলো । এদিকে ইভানও খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। যতোই রাগ দেখাক, বোনের জন্য চিন্তাতো ঠিকই হচ্ছে। লতিকা বেগম এতক্ষণে ভয় দুশ্চিন্তায় কলিজা কাঁপছে। দিনকাল ভালোনা, মেয়েটা কোনো বিপদে না পড়লে হয়।এমনিতেই মেয়েটা একটু বেয়ারী স্বভাবের। এত করে শাসন করার পরও বুদ্ধি হলোনা ওর।

ভয় আর দুশ্চিন্তার মাঝে একসময় রাত গড়িয়ে মধ্য রাত হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা দুই এর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল। এবার নূরসহ পুরো পরিবার রীতিমতো আতঙ্কে পড়ে গেল। লতিকা বেগম কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। নূর আর ইভান অমালিয়ার সব পরিচিত বন্ধু বান্ধবের বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখলো। কিন্তু কোনো খবর পেলনা। ভয়ে হাত পা কাঁপছে নূরের। তার বোনটা কী সত্যি করে কোনো বিপদে পড়ে গেল? এখন কী করবে সে? কী করে খুঁজে বের করবে বোনটাকে? শেষমেশ পুলিশের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু লতিকা বেগম তাতে বাঁধা দিতে চাইলো। তারমতে এতে করে লোক জানাজানি হবে আর মেয়ের বদনামি হবে। কিন্তু সেসবের ধার ধারলোনা। সে তার মাকে বুঝিয়ে বলল,এই মুহুর্তে অমালিয়াকে খুঁজে বের করাটাই সবচেয়ে জরুরি। জানই যদি না থাকে তাহলে কীসের বদনাম আর সুনাম। তাই এখন পুলিশের সাহায্য নেওয়াই সবচেয়ে জরুরি। মাকে বুঝিয়ে সে ইভানকে সাথে নিয়ে পুলিশের কাছে গেল মিসিং রিপোর্ট লেখাতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আরেক ঝামেলা হলো। চব্বিশ ঘণ্টার আগে নাকি মিসিং রিপোর্ট নেয়না তাঁরা। তবুও নূর অনেক রিকুয়েষ্ট করলো তাদের যেন অমালিয়াকে খুঁজে বের করার জন্য একটু সাহায্য করে তাঁরা। কিন্তু পুলিশ সাহায্য তো করলই না বরং উল্টো আরও বিদ্রুপমূলক কথা বলতে লাগলো। বলল, অমালিয়া হয়তো কোনো ছেলের সাথে ভেগে টেগে গেছে। নাহলে কারোর সাথে ডেটিংয়ে গেছে। সকাল হলেই চলে আসবে। দুশ্চিন্তার সময় এমন বিদ্রুপমূলক কথা শুনে নূরের মাথা গরম হয়ে গেল। নূর রাগের বশে উল্টো পাল্টা কিছু করতে যাবে তা বুঝতে পেরেই ইভান নূরের হাত চেপে ধরে শান্ত হতে বলল। এখন উত্তেজিত হলে চলবেনা। বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতে হবে। আশাহত হয়ে ফিরে এলো নূর। বাড়িতে এসে ধপ করে বসে পড়লো সে। মাথা গোলগোল ঘুড়ছে তার। কী করবে? কোথায় যাবে সে? কিছুই বুঝতে পারছেনা। মেয়েটাকে কতবার করে সে মানা করলো এমন বেপরোয়া ভাবে না চলতে। অথচ সে শুনলোই না। একবার পাই ওকে। তারপর বুঝাবো আমি কী জিনিস। অনেক ভালো করে বলে দেখেছি। এবারতো ওকে আসল শাসন দেখাতেই হবে। ব্যাস ভালোভাবে যেন পাই ওকে।

অনেক চেষ্টা করেও যখন অমালিয়ার কোনো খোঁজ পেলনা তখন হতাশ হয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলোনা নূর।নিজেকে এমুহূর্তে সবচেয়ে অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে ওর।ভয়,দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের মাঝে রাতটা যেন ভারী হয়ে গেল পুরো পরিবারের ওপর। কালো রাতটা যখন ভোরের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই সেটাকে আমাবস্যার রাতে পরিবর্তন করে বাসায় ফিরলো অমালিয়া। ছেঁড়া ফাটা কাপড় আর র,ক্তা,ক্ত অবস্থায় কাতরাতে কাতরাতে কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলো সে। তার এই বিধ্বংস অবস্থা দেখে আৎকে উঠল পুরো পরিবার। তার সাথে ঠিক কী ঘটেছে তা বুঝতে বাকি রইলনা কারোর। আর বুঝতে পেরেই রুহ কেঁপে উঠল নূরের। হাত পা অবশ হয়ে আসছে তার।তবে কী সে যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হলো শেষমেশ। লতিকা বেগম মুখে হাত চেপে ধরে ঠাস করে মাটিতে বসে পড়লো। অমালিয়া কোনোরকমে বাসার ভেতর আসতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। নূর নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে গেল বোনের কাছে। গায়ের ওড়নাটা বোনের গায়ে পেঁচিয়ে দিলো।ইভানও দৌড়ে এলো। অমালিয়াকে কোলে নিয়ে ভেতরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলো। ইভানকে বের করে দিয়ে নিজেই কাপড়চোপড় পাল্টে দিলো তার। হাত পা থরথর করে কাঁপছে নূরের। বোনকে এই অবস্থায় দেখে তার কলিজা চিপে ধরছে।

এদিকে বাইরে লতিকা বেগম কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ায় চলে গেছে। মিছরি বেচারি এসব দেখে সেও ভয়ে কাঁপছে। ইভান কোনোরকমে সামলানোর চেষ্টা করছে তাদের। মিনিট বিশেক পর জ্ঞান ফিরলো অমালিয়ার। নূর ওর পাশেই বসে ছিলো। জ্ঞান ফিরেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অমালিয়া। নূর ওকে সামলানোর চেষ্টা করছে। কান্নার শব্দ শুনে লতিকা বেগম আর ইভানও ছুটে এলো। কাঁদতে কাঁদতে মুচড়ে যাচ্ছে অমালিয়া। কান্নারত অবস্থায় বলছে,
–আমার সব শেষ হয়ে গেল আপু। আমার সব শেষ। এসব কেন হলো আমার সাথে…

ইভান বলে উঠল,
–এইজন্যই আপু তোকে বারবার এসব বেপরোয়া ভাবে ঘোরাফেরা করতে মানা করতো। কিন্তু তুই বুঝতে পারলেতো। এখন দেখ তোর জিদের ফল কী হলো।

নূর ইভানের উদ্দেশ্যে বলল,
–ইভান, চুপ কর। এখন এসব বলার সময় না।

অমালিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–ও ঠিকই বলেছে আপু। তোমার কথা না শুনেই আজ আমার এই অবস্থা হয়েছে। তোমার কথা মানলে এমন হতোনা। তোমার কথা অমান্য করার শাস্তিই পেয়েছি আমি। আমি আর বাঁচতে চাইনা। মরে যেতে চাই আমি।

এবার আর রাগ দমাতে পারলোনা নূর। ঠাস করে অমালিয়ার গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–মরে যাবি? এতোই সহজ মরে যাওয়া? মরলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল? আরে এসব হলো ভীতু ব্যাক্তির কথা। সমস্যা দেখে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে না গিয়ে সাহস থাকলে সমস্যার সামনা করে দেখা। এখন কান্না বন্ধ কর, আর বল এসব কীভাবে হলো?

অমালিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
–আমার কলেজে কিছু নতুন ফ্রেন্ড হয়েছিল। আর আজ ওরা ডিসকো ক্লাবে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো। আমারও যাওয়ার খুব শখ ছিলো। কিন্তু তোমাদের বললে কখনো যেতে দিবেনা। তাই মিথ্যে বলে গিয়েছিলাম আমি। ওখানে ক্লাবে গিয়ে মজা করছিলাম আমরা। কিন্তু হঠাৎ ছেলেদের একটা গ্রুপ এসে আমাদের সাথে ফ্লার্টিং করা শুরু করে।ছেলেগুলো সব ম,দ খেয়ে মাতাল ছিলো। প্রথম প্রথমে মানা করলেও ওরা শোনেনা। আমাদের ডিস্টার্ব করতে থাকে। পরে রাগ হয়ে আমি একটা ছেলেকে থাপ্পড় মেরে দেই। সিকিউরিটি তখন ওদের সরিয়ে নিয়ে যায়। পার্টি শেষে আমরা বের হই। আমার ফ্রেন্ডগুলো যারা যার বাড়ে দিকে চলে যায়। আর আমিও আমার বাসায় আসার জন্য রওয়ানা হই। ঠিক তখনই একটা হাইস গাড়ি এসে আমার সামনে থামে। আর গাড়ির ভেতর থেকে সেই ছেলেগুলো নামে। আর আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তারপর কোনো এক বাসায় নিয়ে যায়। আর সেখানে গিয়ে যাকে আমি চড় মেরেছিলাম ওই ছেলেটা আমার সাথে……

আর বলতে পারেনা অমালিয়া। চাদরে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে সে। নূর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ বুজে নেয়। অতি কষ্টে সে নিজের কান্নাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাকে যে ভেঙে পড়লে চলবেনা। নাহলে সবাইকে সামলাবে কে। ইভানের চোখেও পানি চলে আসে ছোট বোনের এই করুন অবস্থা দেখে। আর লতিকা বেগম আহাজারি করেই যাচ্ছে। নূর নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে আবার জিজ্ঞেস করলো অমালিয়াকে,
–তারপর? শুধু ওই ছেলেটাই? নাকি…

অমালিয়া বলল,
–না। শুধু একজনই। অতিরিক্ত নেশা করায় সবগুলো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে। সেই সুযোগে আমি পালিয়ে আসি ওখান থেকে।

–হুমম,বুঝেছি।

নূর অমালিয়াকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে ভালো করে গোসল করিয়ে দেয়। গোসল শেষে পরিস্কার কাপড় পড়িয়ে ওকে আবার বিছানায় শুইয়ে দেয়। ওকে আরাম করতে দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে নূর। এতক্ষণ নিজেকে অনেক কষ্টে শক্ত রাখলেও আর পারলোনা সে। রুমে এসে মুখ চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে গুমরে কেঁদে উঠলো নূর। চোখের সামনে ছোট বোনের এই নির্মম পরিণতি কীভাবে সহ্য করবে সে। নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে চরমভাবে অক্ষম হয়ে গেল সে। দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হয়ে গেল। ও যদি বোনের প্রতি আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করতো তাহলে আজ এই দিন আসতো না। এতো বাহাদুর হয়ে কী লাভ হলো যখন নিজের বোনকেই সুরক্ষিত রাখতে পারলোনা এই অপারগতার দায়ে নিজেকে কী শাস্তি দিবে সে?

বেলা দশটার দিকে নিজেকে আবার শক্ত করে ড্রয়িং রুমে এসে ইভানের উদ্দেশ্যে বলল,
–ইভান চল,বের হতে হবে এখন। মা,যাও লিয়াকে নিয়ে এসো।

লতিকা বেগম হকচকিয়ে উঠে বলল,
–কিন্তু যাবি কোথায়?

–পুলিশ স্টেশন।

–পুলিশ স্টেশন? তুই কী লিয়ার ঘটনা পুলিশকে জানাতে চাচ্ছিস? দেখ এটা ভুলেও করিসনা। নাহলে বাকি মানসম্মানও ধুলোয় মিশে যাবে। এখন তাও যে কথা চার দেয়ালের মাঝে আছে তা সবাই জেনে যাবে। বদনামী হবে আমাদের। কোথাও বিয়ে দিতে পারবোনা ওকে। আর ওরজন্য তোরও ভালো কোথাও বিয়ে হবে না। তাই এসব কেস কাহিনির চিন্তা বাদ দে। যা হবার হয়ে গেছে। কেস করে কী সেসব ফেরত আসবে? ও যেমন অবাধ্য হয়ে উচ্ছনে গিয়েছিল তেমন তার ফলও পেয়েছে। তাই ওরজন্য পুরো পরিবার বদনাম করার দরকার নেই।

নূর দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–মা,তুমি পাগল হয়ে গেছ? তুমি চাইছ এতবড় একটা অন্যায় আমি মুখ বুঁজে সহ্য করবো? যেই আমি একজন অপরিচিত মানুষের সাথে অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াই, সেই আমি নিজের বোনের সাথে হওয়া অন্যায় চুপচাপ মেনে নিবো। শুধুমাত্র মানসম্মানের ভয়ে এতবড় একটা অন্যায় মেনো নিবো? সরি মা, এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। মানলাম লিয়া অবাধ্য হয়ে গিয়েছিল, তাই বলে কোনো ব্যক্তিই এতবড় অন্যায় ডিজার্ভ করে না। শুধু ও কেন, একজন দেহকর্মীর সাথেও যদি এমনটা হয় তবুও সেটা অন্যায়। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে কারোর সাথে এমন কাজ হলে তার শতভাগ অধিকার আছে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার। সমাজে তোমাদের মতো মানুষের জন্যই এসব অন্যায়কারী পার পেয়ে যায়। মানসম্মানের ভয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়না। আর এভাবেই তারা বাহবা পেয়ে যায়। পরবর্তীতে তারা আরও অনেকের সাথে নির্দ্বিধায় এসব করে বেড়ায়। হাজার হাজার মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যায় শুধু এই চুপ থাকার কারণে। তবে আমি তা হতে দিবোনা মা। যারা আমার বোনের সাথে এই ঘৃণিত কাজ করেছে তাদের আমি তাদের আমি ফাঁ,সি,র দড়িতে ঝুলিয়ে ছাড়বো। অপরাধীকে চিহ্নিত করে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি ক্ষ্যান্ত হবোনা।

নূর অমালিয়ার সামনে এসে বলল,
–তুই আমাকে অনেক নিরাশ করেছিস। তবুও তোকে আমি আরেকটা সুযোগ দিতে চাই। আমি তোর অন্যায়কারীদের যথাযথ শাস্তি দিতে চাই। তবে তারজন্য তোকে আমার সহযোগিতা করতে হবে। বিছানায় মুখ না লুকিয়ে অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হবে। বল মানবি আমার কথা?

অমালিয়া মাথা ঝাকিয়ে বলল,
–হ্যাঁ আপু, তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি তোমার কোনো কথার আর অবাধ্য হবোনা।

–হুম ঠিক আছে। তাহলে এখুনি রেডি হয়ে চল আমার সাথে।

নূর, ইভান আর অমালিয়া পুলিশ স্টেশনে এলো ধ,র্ষ,ণ কেস করতে। কিন্তু আবারও পুলিশ কাজের কাজ না করে বিব্রতকর কথাবার্তা বলতে লাগলো। নূর তবুও রাগ হজম করে নিলো। এই মুহুর্তে সিন ক্রিয়েট করলে হিতে বিপরীত হবে। পুলিশের স্বভাব জানা আছে নূরের। তাই আর বেশি কথা না বাড়িয়ে শুধু কেস ফাইল করে চলে এলো। পুলিশ দায়সারাভাবে বলল,তারা অপরাধীকে খোঁজার চেষ্টা করবে। কোনো জানকারী পেলে জানাবে তাদের। তবে নূর জানে পুলিশ টাকা না খাওয়া পর্যন্ত চেয়ার থেকে নড়ে না। তাই এখন যা করার নিজেরই করতে হবে। অপরাধীদের ও নিজেই খুঁজে বের করবে। ওই বা,স্টা,র্ড,কে ফাঁ,সি,র দড়িতে ঝুলিয়েই ছাড়বে নূর। তার আগে ক্ষ্যান্ত হবেনা সে।

চলবে….

#শৈবলিনী—-২৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আদিত্যর অবস্থা পাগল প্রায়। আজ দুদিন হলো সে নূরের দেখা পাচ্ছে না। দুদিন হলো ভার্সিটিতে আসছেনা নূর। তার থেকে বড় কথা তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না । শিখার কাছেও জিজ্ঞেস করেছে। শিখাও তেমন কিছু বলতে পারেনি। শিখার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কাল থেকে ফোন করে যাচ্ছে নূরের নাম্বারে। কিন্তু ফোন প্রথমেতো রিসিভ হলোনা, এখন আবার বন্ধ আসছে। কাল গ্যারেজে গিয়েও পায়নি তাকে। টেনশনে মাথার রগ ফেটে যাচ্ছে আদিত্যর। অস্থিরতায় ছটফট করছে সারা শরীর। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। সব ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। এতো কেন নিষ্ঠুর ওই নারী? কেন এতটা অশান্তি দেয় আমাকে সে? একটুও কী আমার জন্য মায়া হয়না তার? সেকি জানেনা তার অনুপস্থিতি কতটা পোড়ায় আমাকে? তার চিন্তায় পাগল হয়ে যাই আমি। একবারও কী ফোনটা ধরে নিজের ঠিক থাকার খবরটা আমাকে দিতে পারতোনা? তাহলে তো এই অস্থিরতা দম বন্ধ করে দিতোনা আমার। শুধু ও ঠিক আছে কিনা এটাইতো জানতে চাইছি। মেয়েটার কিছু হলো নাতো? এই একটা খেয়ালই আদিত্যকে বারবার অশান্ত করে দিচ্ছে। এক সেকেন্ডর জন্যেও শান্তি পাচ্ছেনা সে। শুটিংয়েও মন বসাতে পারছেনা আদিত্য। না পেরে আজকের শুটিং সে ক্যান্সেলই করে দিয়েছে।

তার এই অস্থিরতার মাঝে রেহনুমা বেগম এলো ছেলের ঘরে। ছেলেকে এমন অন্যমনস্ক দেখে তিনি আদিত্যর পাশে এসে বসে শুধালেন,
–কীরে আদি, আজ শুটিংয়ে গেলিনা যে! শরীর খারাপ লাগছে?

আদিত্য জোরপূর্বক ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বলল,
–না না মা,আমি ঠিক আছি। এমনি আজ যেতে ইচ্ছে করছিল না।

–আচ্ছা ঠিক আছে। আয় ব্রেকফাস্ট করে নে।

–মা আমার ক্ষিদে নেই। খেতে ইচ্ছে করছেনা এখন।

–তা বললে হয়! অল্প করে কিছু খেয়ে নাও চলো।

–মা প্লিজ, আমি পরে খেয়ে নিবো।

–পরে টরে কিছু না। এখুনি খেতে হবে, চলো।

আদিত্য এবার একটু বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,
–মা,বললাম তো খাবোনা এখন। কেন জেদ করছ? একবেলা না খেলে মরে যাবোনা আমি।

রেহনুমা ছেলের কথায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে কড়া গলায় বললেন,
–আদি! মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছ তুমি? ওই থার্ড ক্লাস গুন্ডি মেয়েটার সংস্পর্শে এসে তুমিও আদবকায়দা ভুলে যাচ্ছো? এইজন্য, ঠিক এইজন্যই আমি মানা করছি তোমাকে। সময় থাকতে সরে আসো ওই পথ থেকে। নাহলে ধীরে ধীরে সব শেষ হয়ে যাবে।

কথাগুলো বলেই রেহনুমা উঠে চলে গেল। এমনিতেই অশান্তি আর অস্থিরতায় মাথা কাজ করছে না। তারওপর মায়ের এই তিক্ত কথাগুলো আদিত্যর ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিলো। রাগের বহিঃপ্রকাশ করলো পাশের ফুলদানিটা সজোরে ফ্লোরে সজোরে আছাড় মেরে। ভেতরের অশান্তি বের করতে দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে ছোট্ট করে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করলো,
–আআআ….

ফোন বের করে ওর গ্যাং এর লোককে ফোন করলো আদিত্য। নূরের বর্তমান অবস্থার খোঁজ নিতে বললো সে। তার সাথে কিছু ঘটেছে কিনা খবর নিতে বলল। দুপুরের পর সেই লোক ফোন করে জানাল,
–স্যার ম্যামকে কয়েকবার পুলিশ স্টেশনে যেতে দেখলাম। পুলিশ স্টেশনে খবর নিয়ে জানতে পেরেছি উনি নাকি রে,প কেস করেছে। কেসের দরকারেই বারবার যাওয়া আসা করছে

রে,প শব্দটা কর্ণ গুহায় পৌঁছাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেল আদিত্য। মস্তিষ্ক মুহুর্তেই যেন প্রচন্ড বেগে বারি খেতে লাগলো। র,ক্ত,কণা জমে গেল যেন। কম্পিত স্বরে সে বলে উঠলো,
–রে রেরে,প? কার সাথে হয়েছে?

–ম্যামের বোনের সাথে।

থমকে যাওয়া নিঃশ্বাসটা ছাড়ল যেন আদিত্য। এইটুকু সময়ের ভেতরে জান গলায় আঁটকে গিয়েছিল ওর। কিন্তু পুরোপুরি স্বস্তি পেলনা সে নূর না হলেও, ওর বোনের সাথে এমন অঘটন ঘটেছে এটা জানতে পেরে সে স্বস্তি কীভাবে পেতে পারে। যেকোনো নারীর সাথে এমন অমানবিক কাজ মেনে নিতে পারা আদিত্যর স্বভাব না। সমাজের এসব কীট গুলোকে নিধন করতেই তো আদিত্য ওর গ্যাং তৈরি করেছে। কিন্তু নূরের বোনের সাথে এসব কীভাবে হলো? একারণেই নূর ভার্সিটিতে আসেনি। বোনের এই অবস্থায় নাজানি মেয়েটার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে। যে পরিবারের জন্য ও জান দিয়ে দেয় আজ তাদের এমন বিপদে মেয়েটা নিশ্চয় কতো কষ্ট পাচ্ছে। একা এতসব কীভাবে সামলাবে ও। এসব ভাবতেই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে আদিত্যর। নূরকে এখন দেখাটা তার জন্য আরও বেশি জরুরি হয়ে গেল। নূরকে এই মুশকিলে একা ছাড়বে না সে।কিছুতেই না। আর এক মুহুর্তও দেরি না করে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে গেল আদিত্য । আদিত্যকে এভাবে বের হতে দেখে রেহনুমা পেছন থেকে কয়েকবার করে ডাকলো। কিন্তু আদিত্যর কানে তা পৌঁছাল কিনা জানা নেই। সে সোজা বেড়িয়ে গেল। আদিত্যর এই বেপরোয়া ভাব রেহনুমার মোটেও ভালো লাগছে না। খুব দ্রুতই তাকে কোনো কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে ওই মেয়ের কবল থেকে নিস্তার পাবেনা তার ছেলে।
__

ক্লান্ত আর হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজের রুমে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে নূর। নিজেকে আজ কেমন অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে ওর। এই দুইদিনে অনেক চেষ্টা করেও সে তেমন কিছু খুঁজে বের করতে পারেনি। পুলিশও তেমন আশানুরূপ কিছু জানায়নি।প্রথমে সে অমালিয়ার যেসব বান্ধবী ওর সাথে সেদিন ছিলো। তাদের কাছে গিয়ে তাদের পুলিশের কাছে গিয়ে বয়ান দিতে বলেছিল। কিন্তু তারা সাফ মানা করে দিয়েছে। তারা নাকি এসব পুলিশের ঝামেলায় নিজেদের জড়াতে চায়না। কারণ তাদের সাথে তো আর কিছু হয়নি। তারা কেন শুধু শুধু নিজেদের ঝামেলায় ফেলবে। এরাই নাকি আবার লিয়ার বন্ধু। বিপদ দেখেই সব কেটে পড়েছে। অমালিয়ার কথামত নূর ওই ডিসকো ক্লাবেও গিয়েছিল। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বিনা কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া ক্লাবের ম্যানেজার তাকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দেয়নি। নূর অনেক চেষ্টা করেও পারেনি দেখতে। পুলিশকে গিয়ে দেখতে বললে তারা জানাল কোন সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া এভাবে সার্চ ওয়ারেন্ট চাইলেই পাওয়া যায় না নাকি। আসল কথা হলো সব টাকা খাওয়ার ফন্দি। এখুনি পকেট গরম করে দিলে সব হয়ে যাবে। কিন্তু নূর অন্যায়ের প্রতিবাদ আরেকটা অন্যায় কাজ দিয়ে করবেনা। সৎ পথে চলতে হয়তো অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। তবে একদিম ঠিকই সেটা সফলতা এনে দেয়। দুদিন আগে হোক বা পরে, অপরাধীকে সে ঠিকই খুঁজে বের করবে। কিন্তু মুশকিল শুধু এই একটা না। অমালিয়ার এই কথা লোক জানাজানি হওয়ায়, নানানজন নানানরকম কথা বলছে। আত্মীয় স্বজন এমনিতেতো বারো জনমেও খোঁজ নেয়না কেউ। কিন্তু এই কথা শোনার পর হঠাৎ করেই যেন সবার দরদ উথলায় পড়ছে। কেউ বাসায় এসে আবার কেউ ফোন করে শান্তনার নামে বিদ্রুপ করছে তাদের। নূরতো অসহ্য হয়ে ফোনই বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু ওর মা লতিকা বেগম এসবের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঘরে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাঁকে। আর এসবকিছু দেখে অমালিয়া নিজেকে অপরাধী মনে করে বারবার সু,ই,সা,ই,ড করতে যাচ্ছে। তাকে নিয়ে আরেক বিপদ হয়েছে। সবসময় নজর রাখতে হচ্ছে তার ওপর। কখন কী করে বসে কে জানে। সব বিপদ যেন একসাথে ঝেঁপে পড়েছে নূরের ওপর। নূর পেরে উঠছে না আর। নিজেকে সবার সামনে শক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠছে সে। তার কষ্টের পাহাড় টা কারোর সাথে শেয়ারও করতে পারছেনা সে। মন চাইছে কারোর কাঁধে মাথা রেখে নিজের কষ্টগুলোকে একটু শেয়ার করতে। নিজের মনটাকে একটু হালকা করতে বোধহয় ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারতো সে। আজকাল নিঃশ্বাস টাও নেওয়া ভারী হয়ে গেছে।

হঠাৎ তখনই পেছন থেকে খুব পরিচিত কন্ঠে কেউ ডাকলো,
–নূর..

চকিত নজরে পেছনে ঘুরে তাকালো নূর। মায়াবী চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সেই প্রেমিক পুরুষকে। নূরের হঠাৎ কী হলো জানা নেই। আবেগের এক প্রলয় যেন উপচে এলো তার ভেতরে। চোখে জমলো নোনাজল। করুন চোখে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে দৌড়ে গিয়ে হামলে পড়লো আদিত্যর বুকে। আদিত্যর বুকের শার্ট খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। এই বুকটাই যেন পরম ভরসার জায়গা হয়ে উঠল। যেখানে সে নির্দ্বিধায় নিজের সকল দুঃখ-কষ্ট, অভিযোগের ঝুলি খুলে বসতে পারবে। নূরের এই করুণ কান্না আদিত্যর বুকের ভেতর-বাহির দুইখানেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তমাকে আরও শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে সামিয়ে নিলো।প্রচেষ্টা এই,যেন নূরের সকল যাতনা,সকল বিষ নিজের মাঝে শুষে নিতে পারে সে। প্রিয়তমার চোখের পানির চাইতে যন্ত্রণাদায়ক এমুহূর্তে কোনোকিছুই মনে হচ্ছে না তার। নূর কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট সুরে বলল,
–আমার লিয়া….মিঃ নায়ক, আমার লিয়া।

আদিত্য নূরকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়াবী কন্ঠে বলল,
–হুঁশশ…এভাবে ভেঙে পড়লে চলবেনা নূর। তুমি জানো, তুমি আমার দেখা সবচেয়ে বাহাদুর নারী । এভাবে মানায়না তোমাকে। ইউ আর আ ফাইটার। সকল সমস্যার সম্মুখীন করতে পারো তুমি। এই লড়াইয়েও তোমারই জিত হবে নূর। সব ঠিক হয়ে যাবে।

হঠাৎ হুঁশ এলো নূরের। কান্নার সুর থমকে গেল তার। ছিটকে সরে এলো সে আদিত্যর বুক থেকে। এটা কী করছিলাম আমি? হঠাৎ কী হয়ে গিয়েছিল আমার? উনার সামনে এমন দূর্বল কীভাবে হয়ে পরলাম আমি? যেই আমি হাজার কষ্টেও কারোর সামনে নিজের চোখের একফোঁটা পানি দেখাইনা। এমনকি নিজের পরিবারের সামনেও কখনো কাঁদিনা। সেই আমি এই লোকটার সামনে এভাবে কেমন করে কাঁদতে পারলাম? তাও এমন করে তাকে জড়িয়ে ধরে। কেন করলাম এমন আমি? নূরের মনোভাব শান্ত করতে আদিত্য বলে উঠলো,
–ইটস ওকে নূর, ডোন্ট প্যানিক। তুমি বসো, রিল্যাক্স করো।
আদিত্য নূরের হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। টেবিলের ওপর থাকা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নূরের সামনে ধরে বলল,
–নাও, পানি খাও।

নূর পানির গ্লাসটা নিয়ে একটুখানি পানি খেল।নিজেকে সামলে নিয়ে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–আপনি এখানে? এখানে কীভাবে এলেন আপনি?

আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
–ডোন্ট ওয়ারি, ফিল্মি হিরোদের মতো পাইপ বেয়ে ব্যালকনি বা জানালা দিয়ে আসিনি। ভদ্রলোকের মতো দরজা দিয়ে এসেছি। ড্রয়িং রুমে ইভান বসা ছিলো। ওকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে ও তোমার রুম দেখিয়ে দিলো।

নূর মলিন সুরে বলল,
–ওহ,আপনার কাজেতো দুদিন যাওয়া হয়নি। আম সরি, আপনার কাছে আমি ঋণী আছি। তাই আপনাকে না বলে কাজে যাওয়া বন্ধ করা ঠিক হয়নি আমার। আপনি চাইলে এরজন্য বাড়তি ফাইন ধরতে পারেন।

আদিত্য আহত কন্ঠে বলল,
–নূর,প্লিজ! এতটাও ছোট করোনা আমাকে যে,নিজেই নিজের কাছে ঘৃণিত হয়ে যাই। তোমার সত্যিই মনে হয়, আমি এখানে তোমার কাজে না যাওয়ার জন্য বলতে এসেছি? তুমি জানো, কাল থেকে আমি ততবার নিঃশ্বাস নেইনি যতবার তোমার চিন্তায় ব্যাকুল হয়েছি। একেক টা সেকেন্ড কাঁটার মতো বিঁধছিলো। তুমি ঠিক আছ কিনা সেটা ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তাইতো আজ আর কোনোকিছু না ভেবে সোজা চলে এসেছি। তোমাকে এই অবস্থায় আমি একা কীভাবে ফেলতে পারি।

নূর কপাল কুঁচকে বলল,
–এই অবস্থায় মানে? আপনি কি তাহলে লিয়ার ব্যাপারে…

–হ্যাঁ, জানি আমি। জিজ্ঞেস করোনা কীভাবে। ব্যাস জেনেছি আমি। জানার পর আর একমুহূর্তের জন্য তোমাকে না দেখে থাকতে পারিনি আমি। তুমি চিন্তা করোনা নূর। সব ঠিক হয়ে যাবে।

নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–কী ঠিক হয়ে যাবে। বললেই কী সব ঠিক হয়ে যায়? আমার বোনটার যে ক্ষতি হলো সেটা ফেরত আসবে? ওর জীবনে যে একটা ভয়ানক স্মৃতি হলো সেটা কী কখনো ভুলতে পারবে ও? আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারবে ও? আর এসব করে যে আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে এখনো পর্যন্ত কিনা সনাক্তই করা গেলনা। তাহলে এখানে কোনটা ঠিক দেখলেন আপনি? এসব বলা সহজ। যার সাথে ঘটে সেই বুঝতে পারে কেমন লাগে। আজ আমি বেঁচে থাকতেও আমার বোনের সম্মান রক্ষা করতে পারলাম না। এটাযে কতবড় গ্লানিদায়ক তা আপনি বুঝবেন না।

বলতে বলতে গলা আবার ধরে এলো নূরের। নিজের কান্না চেপে নিতে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। আদিত্য উঠে এসে নূরের সামনে নিচে হাঁটু গেড়ে বসলো। নূরের হাত দুটো জোরা করে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। নূর তাকালো আদিত্যর পানে। আদিত্য নূরের পানে মায়াময় নজর মেলে বলতে লাগলো,
–তুমি জানো নূর, তোমাকে আমি কী নামে ডাকি? শৈবলিনী (নদী), হ্যাঁ তুমি হলে সেই শৈবলিনী যে সকল পরিস্থিতিতে নিরন্তর বহমান। নদী যেমন তার গভীরে সকলকিছু সামিল করে নিয়েও, থেমে না গিয়ে অনবরত বয়ে চলে যায়। তুমিও ঠিক তেমনি । সাহসী সৈনিকের ন্যায় সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যাও। তাই আমি জানি, এই পরিস্থিতিও তুমি ঠিকই জয় করে নিবে।

নূরের থমকিত নজর স্থির হয়ে রইল আদিত্যর মুখপানে। মায়াজালে আবদ্ধ হলো যেন সে। আজপর্যন্ত এতটা গভীরভাবেতো নূর নিজেকেউ কখনো পর্যবেক্ষণ করে দেখেনি। আর এই লোকটা কীভাবে তার ব্যক্তিত্বর এতো সুন্দর, অর্থবোধক একটা সংজ্ঞা দিয়ে দিলো! সত্যিই কী সে এতটাই বোঝে আমাকে? এতটা মায়াময় কেন লাগছে তার কথাগুলো। যেন এত কষ্টের মাঝে প্রশান্তির এক শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার কথায়। অজানা এক ভরসা খুঁজে পাচ্ছে তার মাঝে।
হঠাৎ ঘোর কাটলো নূরের। সে আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নজর সরিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–কী জয় করবো? এখনও পর্যন্ত ওই অপরাধীকেই ধরতে পারলাম না। যে আমার বোনের ক্ষতি করে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

–তো কী হয়েছে? তুমি চিন্তা করোনা। আমরা দুজন মিলে অপরাধীকে খুঁজবো। দেখবে খুব শীঘ্রই ধরে ফেলবো ওই রা,স্কে,ল টাকে।

নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–এক মিনিট! আমরা মানে? দেখুন এটা আমার লড়াই। আমাকে একাই এই কাজ করতে হবে। আপনাকে এসবে পড়ার কোনে দরকার নেই। আর তাছাড়া এসব পুলিশি ঝামেলায় জড়ালে আপনাকে নিয়ে শুধু শুধু নিউজ তৈরি হবে। তাই প্লিজ আপনি এসব থেকে দূরে থাকুন। আমারটা আমি দেখে নিবো।

আদিত্য এবার একটু শক্ত গলায় বলল,
–দেখ নূর, ইন্ডিপেন্ডেন্ট হওয়া ভালো। তাই বলে কারোর সাহায্য নিলে তুমি ছোট হয়ে যাবে এই ধারণা পোষণ করা নেহাৎই বোকামী। কারো সাহায্য নেওয়ার অর্থ এই না যে,তুমি সেই কাজে অক্ষম। আমি জানি তুমি পারবে। কিন্তু আমরা দুজন মিলে করলে কাজটা আরও দ্রুত হয়ে যাবে। এমনিতেও তোমাকে অশান্তিতে দেখে আমি চাইলেও কোনো কাজে মন বসাতে পারবোনা। তাই আমি তোমার সাহায্য করছি। অ্যান্ড দ্যাট ইজ ফাইনাল। নো মোর আরগুমেন্ট অন দিস টপিক।

নূর আর কোনো প্রতিত্তোর করতে পারলোনা। সে উপরে উপরে না বললেও, সে নিজেও বুঝতে পারছে তার এমুহূর্তে একটা ভরসাজনক সাপোর্ট দরকার। যে মেন্টালি আর প্রাক্টিক্যালি তাকে একটু সাহায্য করতে পারবে। আর এরজন্য আদিত্যর চেয়ে ভালো কেউ তার চোখে পড়ছেনা।এই প্রথম মনে হচ্ছে কোনো পুরুষকে সে চোখ বুজে ভরসা করতে পারবে। যে তার ভরসাকে অক্ষুণ্ণ রাখবে। কখনো তার বিশ্বাস ভাঙবে না। যার হাত ধরে সে অজানা পথে নিরন্তর পথচলতে পারবে। হারাতে পারবে কোন এক অচিন মায়াপুরিতে।

চলবে……