শৈবলিনী পর্ব-৩৫+৩৬

0
589

#শৈবলিনী—৩৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আজ আট মাস পর আবারও সেই পুরুষকে দেখে থমকিত হলো নূর। পারদের নিচে লুকিয়ে থাকা ক্ষতোটা আবারও তাজা হয়ে গেল। শক্ত পাথর হয়ে যাওয়া হৃদপিণ্ড টা আবারও নড়ে উঠলো। পীড়ন বৃহত্তর হলো।নিশ্চুপে ঘুম পাড়িয়ে রাখা অনুভূতি গুলো আবারও জেগে উঠে এলোমেলো দৌড়াতে লাগলো। বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে ইনভলভ না হওয়ার নূরের সিদ্ধান্তের ওপর এখন আক্ষেপ হচ্ছে তার। বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে আদিত্যকে সিলেক্ট করা হয়েছে তা আগে জানলে নূর আগেই মানা করে দিতো। কিন্তু এখনতো আর সেই পথ নেই। এক মুখে দুই কথা কীভাবে বলবে সে? নূরের চোখে বিস্ময় থাকলেও আদিত্যর চোখে কোনো বিস্ময় বা চমক দেখা গেলনা।যেন আজকের এই দেখা হওয়া টা তার কাছে মোটেও অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। সে জানতো আজ নূরের সাথে দেখা হবে। তাইতো তার চোখে কেবল তীব্র গভীরতা। তৃষ্ণার্ত নজরের প্রখর আকুলতা। সোহান এগিয়ে এসে হাসিমুখে আদিত্যর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–হ্যালো মিঃ আদিত্য। দ্য সুপারস্টার অফ বাংলাদেশ। ইটস প্লেজার টু মিট ইউ। আমার বোন আপনার অনেক বড়ো ফ্যান।

আদিত্য সোহানের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল,
–থ্যাংক ইউ, প্লেজার ইজ অল মাইন।

–আপনি আমাদের প্রজেক্টে কাজ করার জন্য রাজি হয়েছেন, তারজন্য কৃতজ্ঞ আমরা।

আদিত্য নূরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
–কৃতজ্ঞ তো আমি আপনার কাছে । আমাকে এই প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ দিয়ে যে আমার কতবড় উপকার করেছেন আপনি নিজেও জানেন না৷

–জি বুঝলাম না।

–আরে বাদ দেন। সবকিছুই যে বুঝতে হবে তারতো কোনো মানে নেই। কিছু জিনিস না বোঝার ওপরই ছেড়ে দিতে হয়।

সোহান মুচকি হেঁসে নূরকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–মিঃ আদিত্য উনি হচ্ছেন এই প্রজেক্টের ডিরেক্টর, মিস নূর।

তখনই পিয়ন এসে সোহানকে জানালো কেউ তার সাথে দেখা করতে এসেছে। সোহান আদিত্য আর নূরকে প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলতে বলে, বেড়িয়ে গেল। নূর এখনো ওখানেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য এগিয়ে গেল তার সামনে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–হ্যালো মিস নূর, গ্লাড টু মিট ইউ।

নূর এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিলো। লোকটার সামনে কোনোভাবেই দূর্বল পড়বেনা সে। এবার আর তার কোনো ষড়যন্ত্র সফল হতে দিবে না নূর। আদিত্য এখন শুধুই প্রফেশনাল একজন ব্যাক্তি। বাকি সবার মতোই তার সাথেও শুধু প্রফেশনাল বিহেভিয়ারই হবে। এর বাইরে আর কিছুই না। এই মনস্তাপ করে নূর নিজেকে দৃঢ় শক্ত করে আদিত্যর সাথে স্বাভাবিক ভাবে হাত মিলিয়ে বলল,
–সরি মিঃ আদিত্য, আপনার ব্যাপারেও একই কথা বলতে পারছিনা বলে। আম নট গ্লাড টু মিট ইউ।
আদিত্য স্মিথ হেঁসে বলল,
–আই নো দ্যাট। শুধু আমি কেন, এটাতো অলিখিত একটা ঘোষণা যা পুরো পৃথিবীই জানে। প্রকৃতির পরদে পরদে লেখা আছে, নূর আদিত্যকে দেখে কখনো খুশি না। নূর একবারের জন্য হয়তো নিজের শত্রুকে দেখেও খুশি হতে পারে তবে আদিত্যকে দেখে খুশি হবেনা। এনিওয়ে এই ফ্যাক্ট তো আর আমি বদলাতে পারবোনা। এটা তোমার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম। বাট তুমি যদি ভেবে থাকো আমি আমার ওয়াদা ভেঙে আবার তোমার সামনে এসেছি তাহলে তোমার এই ধারণাটা পাল্টাতে পারি। কারণ এতে আমার কোনো হাত নেই। আমি নিজে এখানে আসিনি। তুমি বা তোমার পার্টনার আমাকে ডেকেছে তাই এসেছি। তাও প্রফেশনাল ওয়েতে।

নূর স্বাভাবিক সুরে বলল,
–আপনার কাছ থেকে আমি কোনোরকম এক্সপ্লেনেশন চাচ্ছি বা মিঃ আদিত্য। এখানে আমরা প্রফেশনালী মিট করছি। তো পার্সোনাল টপিক না টানলে খুশি হবো।এমনিতেও ওই চ্যাপ্টার আমার জীবনে ক্লোজ হয়ে গেছে। তাই সেসব কথা না বলে আপনি আপনার কাজ করুন। আর আমি আমার কাজ করবো। দ্যটস ইট। আই হোপ এরথেকে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। প্লিজ হ্যাভ আ সিট। আপনাকে আমি প্রজেক্ট টা দেখিয়ে দিচ্ছি। যাতে আপনার কাজে সুবিধা হয়।

–ইয়া সিওর।

আদিত্য চেয়ার টেনে বসলো। নূর আবারও প্রজেক্টরে ওর গাড়ির ডিটেইলস দেখাতে লাগলো। আদিত্যতো শুধু ওর তৃষ্ণার্ত আঁখির পিপাসা মেটাচ্ছে। আজ কতদিন পর সে নূরকে চোখের সামনে দেখছে। শুধুমাত্র এই পিপাসা মেটানোর লোভেই তো আদিত্য এই অফারে রাজি হয়েছে। যখন ওর কাছে এই অফার এসেছিল নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারেনি। তাইতো রাজি হয়ে যায় সে। নিয়তি ওকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। এই সুযোগ ও বৃথা যেতে দিবেনা। তুমি ঠিকই বলেছ নূর। তুমি তোমার কাজ করো আর আমি আমার কাজ করবো। যে চ্যাপ্টার তুমি অসম্পূর্ণ রেখেছ সেটা এবার পূর্ণ হবে। তোমার মনের সব বিষাদের ছাপ আমি মুছে দিবো নূর।তুমি কী ভেবেছ নূর, আমি এতো সহজে তোমাকে দূরে যেতে দেবো? আমি আগেই বলেছি, চলে যাবার অধিকার আছে তোমার, দূরে যাবার নয়। যতো খুশি উঁচু আকাশে উড়ে বেড়াও। দিনশেষে আমার হৃদয়ই হবে তোমার একমাত্র নীড়। এবার আমি কিছুতেই দূরে যেতে দেবোনা তোমাকে।
প্রজেক্ট ডিটেইলস দেখানো শেষে নূর বলে উঠলো,
–এন্ড দ্যাটস ইট। আই হোপ আপনি সব বুঝতে পেরেছেন।

আদিত্য নূরের চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো ,
–আমিতো অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি। শুধু তুমিই বুঝতে পারলেনা।

–জিহ???

–না কিছুনা। আসলে বলতে চাইছিলাম আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি একদিন অবশ্যই সফল হবে। ইউ ডিজার্ভ ইট অল। আম রিয়েলি হ্যাপি ফর ইউ, নূর।

নূরের মাঝে আবারও আন্দোলন শুরু হলো। নিজেকে সামলাতে দ্রুত নিজের ল্যাপটপ গুছিয়ে মিটিং রুম থেকে বেড়িয়ে এলো সে। অন্য একটা কেবিনে এসে ধপ করে বসে মাথা চেপে ধরলো সে। এতক্ষণ আদিত্যর সামনে কীভাবে নিজেকে শক্ত রেখেছিল তা কেবল ওই জানে। উপরে উপরে নিজেকে যতোই শক্ত দেখাক কিন্তু ওই পুরুষকে চোখের সামনে দেখে তার ভেতরে যে প্রলয়ঙ্কর ঝড় উঠেছে তা কীভাবে সামলাবে? আদিত্যর ওই বিষন্নতার আঁধারে ঢাকা চেহারা, ওই আকুতি ভরা চোখের চাহুনি, দেখে মনে হচ্ছিল কতশত অবহেলায় পড়ে ছিলো সে।এসব দেখে ভেতর টা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল তার। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছিল সে। এসব অনুভূতির মায়াজাল থেকে নিজেকে বের করে নিয়েছিল। সবতো ঠিকই চলছিল। তবে উনি কেন আবার এলো আমার সামনে? পুরনো ক্ষত আবার কেন তাজা করে দিলো। লোকটাকে ঘিরে তার অনুভূতি গুলো যে বড়োই বেয়ারা। না পারে তাকে পুরোপুরি ঘৃণা করতে, আর তার দেওয়া ধোঁকার পর না পারে তাকে ভালোবাসতে। মন মস্তিষ্কের এই লড়াইয়ে প্রতিবার আহত হতে নূরকেই। উনি কেন এলো আবার আমার জীবনে? কেন? কেন? কেন?

তখনই সেখানে সোহানের আগমন ঘটলো। নূরকে এভাবে মাথা চেপে ধরে বসে থাকতে দেখে সোহান বলে উঠলো,
–কী হলো মিস নূর?আপনার কী শরীর খারাপ করছে?

নূর মাথা তুলে জোরপূর্বক সৌজন্যমূলক হেঁসে বলল,
–না না তেমন কিছু না। ওই একটু মাথা ব্যাথা করছিল।

–ও আচ্ছা। বেশি খারাপ লাগলে বলুন আমি ডক্টর ডেকে নিচ্ছি।

–না না তার দরকার নেই। এমনিতেও কাজ শেষ। আমি এখন বাসায়ই যাচ্ছি। বাসায় গিয়ে রেস্ট করলে ঠিক হয়ে যাবো।

–আর ইউ সিওর?

–ইয়া ইয়া।

–আচ্ছা আপনি একটু পানি খান আপাতত।
সোহান টেবিলের ওপর থেকে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নূরের দিকে এগিয়ে দিলো। নূরের ইচ্ছে না হলেও ভদ্রতার খাতিরে সে সোহানের হাত থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দুই ঢোক খেয়ে নিলো। কেবিনের বাইরে থেকে এসব কিছু দেখতে পেল আদিত্য। মিটিং রুম থেকে বের হয়ে নূরকে খোঁজার জন্যই এদিকে এসেছিল সে। তখনই কাচের দেয়ালের কেবিনে চোখ যেতেই এই দৃশ্য দেখতে পায় সে। এতদিন পর নূরকে দেখার যে খুশি তার চোখে মুখে ভাসছিল তা হঠাৎই উড়ে গেল। তার স্থানে জায়গা পেল তীব্র ক্রোধের অগ্নিশিখা।নূরের প্রতি ওই সোহান নামের লোকটার চাহুনি এখান থেকেও ঠিক টের পাচ্ছে আদিত্য। আর তাতেই তার প্রতিটি র,ক্ত,কনা ভলকে উঠছে। হাতের মুঠো হলো শক্ত দৃঢ়। ব্যস, এই ভুলটাই করা উচিত হয়নি মিঃ সোহান। দুনিয়াতে সবকিছুর উপর নজর দেওয়ার অনুমতি আছে। শুধু আমার নূরের উপর নজর দেওয়ার অধিকার নেই কারোর । এই দুঃসহ অপরাধ অমার্জনীয় আমার কাছে।নূর আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারে,আমাকে অসহনীয় যন্ত্রণায় পোড়াতে পারে, চাইলে জানও নিয়ে নিতে পারে। তবে সে অন্য কারোর কখনো হবে না। আদিত্যর অস্তিত্ব থাকতে তা কখনোই সম্ভব না। আদিত্য কিঞ্চিৎ রহস্যময় হেঁসে মনে মনে বলল,
–পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবারো তরে।
___

আদিত্য ফ্ল্যাটে এসে দেখলো আবির আগে থেকেই বসে আছে। আদিত্য ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো,
–কীরে আজকাল নারী কল্যাণের কাজ ছেড়ে এখানে কেন পড়ে থাকিস? নারীজাতি কি শেষমেশ বয়কট করে দিলো তোকে?

আবির আৎকে উঠার ভঙ্গিতে বলল,
–লাহোল বিল্লালের পুত, কি কস এইসব! এমন অলক্ষুণে, কুলক্ষুণে, বিচক্ষণে, ঝাউবনে, কাশবনে, বান্দরবনে টাইপ কথা ভুলেও কইতে নাই। আরে বয়কট হোক ওইসব রেইড দেওয়া পুলিশদের যারা প্রেমবিলাসে বাঁধা ঘটাতে চলে আসে। অসভ্য,আটকালচারড লোকের মতো দুজন প্রেমিক প্রেমিকার কল্যাণমূলক কাজের প্রগতি ঠেকিয়ে বসে থাকে। আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও বান্দা স্বাীনভাবে একটু প্রেমও করতে পারে না। মানবতা আজ কোথায়! একারণেই এই দেশের উন্নতি হয়না। যুবক সমাজের প্রগতিকে এভাবে দাবানো হলে উন্নতি হবে কীভাবে? অথচ বাইরের দেশ গুলোতে দেখ, রাস্তা ঘাটে যেখানে সেখানে জনগণ তাদের মঙ্গলসাধন করছে। কেউ কোনো বাঁধা দেয়না। একারণেই সেসব দেশ আজ উন্নত। আর আমাদের দেশের অবনতি হচ্ছে। হাঁহ, নাজানি এই দেশের কী হবে?

শেষের কথাটা খুবই আপসোসের সহিত বলল আবির। আদিত্য সোফায় বসে শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,
–ওই মহাত্মা বাবা বদনাদেব, বস্তা পঁচা প্রবচন শেষ হলে কাহিনি কী ক।

–কাহিনি আমার না, আজকের কাহিনির নায়ক জনাব জিদান মিঞা। সেই আসতে বলেছে। কি নাকি বলবে।

–জিদান? কিন্তু ওতো আজ কাজে আসলোনা। কালই ছুটি নিয়েছিল।

–কি জানি, তোর ওই নমুনার কথা ওই ভালো জানে।

ওদের কথার মাঝেই জিদান এসে উপস্থিত হলো। হাসিমুখে এসে বসলো সোফায়। আদিত্য জিজ্ঞেস করলো,
–কি হয়েছে জিদান? কি নাকি বলবে তুমি?

–জি স্যার। আসলে একটা গুড নিউজ ছিলো। আপনাদের আজ ইনভাইট করতে এসেছি আমি। আসলে দুইদিন পর আমার আর শিখার বিয়ে। সেটারই ইনভিটেশন কার্ড দিতে এসেছি। বিয়েতে অবশ্যই আসতে হবে আপনাদের। আপনিতো জানেনই স্যার আপনি আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আপনাকে ছাড়া বিয়ে কীভাবে করতে পারি।

আবির বলে উঠলো,
–কেন আদি কী তোমার বিয়ের শেরওয়ানি সেলাই করবে নাকি যে তাকে ছাড়া বিয়ে হবেনা? আরে বিয়ের জন্য মেয়ের দরকার হয় স্যারের না। কিন্তু জিদান মিঞা তুমিও শেষমেশ শহিদদের দলে নাম লেখাইলা? পরাজিত সৈনিক হয়ে এক নারীর সামনে হার মেনে নিলে? ওই পুরুষ পীড়িত সমাজে যোগদান করতে যাচ্ছো? আই ফিল ভেরি স্যাড ফর ইউ জিদান মিঞা। শোকে পাথর হয়ে যাচ্ছি আমি। এতো জলদি কী ছিলো নিজেকে শহীদ করার। কী-বা বয়স হয়েছিল তোমার। এই বয়সেই আ,ত্মা,হু,তি দিয়ে দিলে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা তুমি তোমার স্যারের আগে কীভাবে বিয়ে করতে পারো। আদির আগে ওর সেক্রেটারির বিয়ে হয়ে গেলে আদির কী সম্মান থাকবে? বেচারা আদি, ওর এই হ্যান্ডসাম মুখ মানুষকে দেখাবে কীভাবে?

জিদান বলে উঠলো,
–আসলে স্যার এখুনি বিয়ে করা জরুরি ছিলো।নাহলে সমস্যা হয়ে যেত।

আবির এক ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হেঁসে বলল,
–কও কী মিঞা, তাইলে কী বিয়ের আগেই বাপ হওয়ার কাজ সেরেছ? সেকারণেই এতো জলদি বিয়ে করছ? উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট?উপরে উপরে তো এমন আলাভোলা সাজো যে, দুনিয়াতে আসার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তুমি কিছু জানোই না। আর তলে তলে টেম্পু না পুরো ট্রাক চালিয়ে ফেলছ? নট ব্যাড জিদান মিঞা। আমার সাথে থেকে থেকে তুমিও অনেক প্রগ্রেস করেছ দেখছি।

জিদান চোখ বড়সড় করে বলল,
–অসতাগফিরুল্লা, কী কন স্যার এইসব। এসব শোনাও পাপ। এমন কিছুই হয়নি স্যার। আসলে শিখার পরিবার ওকে বিয়ের জন্য জোর দিচ্ছিল। আমি বিয়ে না করলে ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিতো। তাই এখুনি বিয়ে করা জরুরি ছিলো।

–ঠিক আছে জিদান মিঞা, কী আর করার। তোমার পরাধীন জীবনের জন্য অভিনন্দন।

আদিত্যর মনে চলছে অন্য খেয়াল। জিদান আর শিখার বিয়ে। আর বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েতে নূরতো অবশ্যই আসবে। আর এমন সুযোগ আদিত্য কিছুতেই হাত ছাড়া করবেনা। মনে মনে খুশিই হলো সে।

আদিত্যর বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসতেই আবিরের ফোন বেজে উঠল। আবির ফোন বের করে দেখলো রেহনুমা ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে বলে উঠলো,
–হ্যাঁ আন্টি বলুন।

রেহনুমা কাতর কন্ঠে বললেন,
–আদির ওখানে গিয়েছিলে তুমি? কেমন আছে ও? ওকে একটু বুঝিয়ে বাড়িতে আসতে বলোনা। তোমার কথা নিশ্চয় শুনবে ও। এক তোমাকেই তো ওই বাসায় যাওয়ার অনুমতি আছে।

আবির ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–এখন আর আদির ভালো মন্দ জেনে কী করবেন আন্টি। জানেন আন্টি আপনাকে আমি শুধু মুখে না, সত্যি সত্যিই একজন আদর্শ নারী মানতাম। নিজের মায়ের মতো ভাবতাম আপনাকে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম, আপনিতো আপনার নিজের সন্তানেরই আপন হলেন না। যে নিজের সন্তানের খুশিই চিনতে পারে না সে অন্যের আপন কী করে হবে? আপনিতো আদিকে বেঁচে থাকতেই মৃ,ত করে দিয়েছেন। রাখছি আন্টি।

ফোন রাখতেই কেঁদে উঠলেন রেহনুমা। নিজের কাছেই আজ নিচু হয়ে যাচ্ছে সে। সে আসলেই একজন ভালো মা হতে পারেনি।
__

পরদিন বিজ্ঞাপনের শুটিং আরম্ভ হলো। সোহান আর নূরও এসেছে শুটিং স্পটে। যদিও নূরের একবিন্দুও এখানে আসার ছিলোনা। ওতো পারলে এই লোকের ছায়াও মারায় না।কিন্তু বিজ্ঞাপনে ওর গাড়ির উপস্থাপনা যথাযথ ভাবে হচ্ছে কিনা সেটা দেখার জন্যই সোহান তাকে আসতে বলেছে। তাই না চাইতেও আসতে হয়েছে তাকে। শুটিংএর অপেক্ষায় চেয়ারে বসে আছে নূর আর সোহান। কড়া মেজাজে বসে আছে সে। বারবার এই লোকটার সামনেই কেন তাকে পরতে হয়? যাক ব্যাপার না, এই বিজ্ঞাপনের ক্যাচাল শেষ হলে তো আর কোন কারণ থাকবেনা ওনার সাথে দেখা করার। একটু পরেই আদিত্য ওর ভ্যানিটি থেকে শুটের জন্য রেডি হয়ে বের হলো। স্বাভাবিক ভাবেই সেদিকে চোখ গেল নূরের। আবারও অবাধ্য নজর আঁটকে গেল ওই মন্ত্রকারী পুরুষে। ব্লাক শার্ট আর ব্লাক প্যান্ট পড়েছে সে,যথারীতি তার শার্টের বোতামের কাজ অসম্পূর্ণই রেখে দিয়েছে। বুকটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। নূর ভেবে পায়না হিরোদের কী শার্টের বোতাম খোলা রাখা কম্পালসারি! এদের শার্টে তাহলে বোতাম লাগানোর দরকারই কী? শুধু শুধু বোতাম গুলোর অপমান করা হয়। বোতামগুলো কোনো গরীর মানুষকে দান করে দিলেও তো পারে। আদিত্য চোখে ব্লাক সানগ্লাস আর হাতে একটা জ্যাকেট কাঁধে ওপর ধরে রেখে হেঁটে আসছে। ওই আকর্ষিত সুদর্শন যুবকের থেকে বেহায়া চোখদুটো সরাতে আবারও অক্ষম হচ্ছে নূর। বেঈমান লোকটা আবারও তার মোহে ডোবাতে চাচ্ছে নূরকে। কিন্তু না, এবার আর তার ষড়যন্ত্র সফল হতে দিবেনা নূর। চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। কিন্তু নজর বিদ্রোহ আরম্ভ করলো তার সাথে। বারবার না চাইতেও আরচোখে তাকাচ্ছে আদিত্যর পানে। আর তা দেখে মনে মনে হাসছে আদিত্য।

নূরের তৈরি গাড়ির সামনে এসে প্রথমে বিভিন্ন পোজে ফটোশুট করলো আদিত্য। তারপর আসল বিজ্ঞানের অভিনয় শুরু হলো। এই পর্যায়ে বিজ্ঞাপনের ফিমেল মডেল চলে এলো। সেও ব্লাক শার্ট আর শর্ট জিন্স পড়েছে। চিকন পেনসিল সুজ পরে সে হেলেদুলে এসে আদিত্যর পাশে দাঁড়াল। নূরের তীক্ষ্ণ মেজাজ টা যেন এবার হঠাৎই প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। চরম পরিমান রাগ হচ্ছে তার। যদিও সে নিজেকে এটা বোঝানোর চেষ্টায় নিয়োজিত যে, তার এসবে কিছু যায় আসে না। তার নিক(উকুনের ডিম) পরিমানও যায় আসে না। ওই বদ লোকটা যার সাথে খুশি তার সাথে থাকুক তাতে আমার কি? আমার মোটেও রাগ হচ্ছে না। এক ছটাকও না। হ্যাঁ ওই মেয়েটার খেজুরের কাঁটার মতো সু দিয়ে ওর গাড়িতে না ঘষা লাগায়। সেটারই যা একটু চিন্তা হচ্ছে। তাছাড়া আর কিছু না। মনের আসল মনোভাবকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো লুকানোর চেষ্টা করলেও তা খুব একটা কাজে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ নূরের রাগ ক্রমাগত বাড়ছেই শুধু। আদিত্য যখন মেয়েটাকে ধরে ওর গাড়ির সামনে পোজ দিচ্ছিল তখন নূরের এতটাই রাগ লাগছিলো যে, তার হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানটা সজোরে পাশের টেবিলের ওপর ঠাস করে রাখে। টেবিলের ওপর সোহানের হাত রাখা ছিলো। নূর রাগের মাথায় না দেখেই তার হাতের ওপরেই মারে ক্যানটা। আচমকা এমন হওয়ায় বেচারা সোহান হাতে ব্যাথা পেয়ে হালকা আর্তনাদ করে হাত ছিটকে নিয়ে ঝাড়তে থাকে। এটা দেখে নূরও একটু থতমত খেয়ে যায়। লজ্জিত হয়ে সরি বলে সোহানকে। সোহান বেচারা হাতে ব্যাথা নিয়েও মুখে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে বলে,ইটস ওকে। দূর থেকে এসব দেখে মনে মনে বাঁকা হাসে আদিত্য।

শুটিং এর এক পর্যায়ে ফিমেল মডেল কে গাড়ির ডিকির ওপর চড়ে বসতে বলে ডিরেক্টর। নির্দেশনা অনুযায়ী মেয়েটা আদিত্যর হাত ধরে গাড়ির ডিকির ওপর উঠতে ন্যায়। ব্যাস এবার নূরের থার্মোমিটার হাই হয়ে ব্লাস্ট পর্যায়ে চলে যায়। আর চুপ থাকতে পারে না সে। ঝট করে উঠে একরকম ওদের দিকে তেড়ে যেতে যেতে বলে,
–এক মিনিট, এক মিনিট, কী হচ্ছে এসব হ্যাঁ! আপনারা কি বিজ্ঞাপনের নামে আমার গাড়ির রফাদফা করতে চাচ্ছেন। উনার এই খেজুরের কাঁটার মতো হিল পড়ে আমার গাড়িতে চড়লে আমার গাড়ি থাকবে?

ডিরেক্টর বলে উঠলো,
–কিছু হবেনা ম্যাম, বিজ্ঞাপনের জন্যেতো এসব করতেই হয়।

–কেন করতে হবে? গাড়ি কী মানুষ উপরে চড়ে বসে থাকার জন্য কেনে? গাড়ি মানুষ ভেতরে বসার জন্য কেনে।

সুযোগ সন্ধানী আদিত্য ফট করে বলে উঠলো,
–তাহলে আপনিই দেখিয়ে দিন না ম্যম কীভাবে করতে হবে। এক্সুয়ালি বিজ্ঞাপনে ফিমেল মডেলের জায়গায় আপনারই থাকা উচিত। আফটার অল, গাড়ি আপনি বানিয়েছেন তাই আপনিই ভালো এটাকে জাস্টিফাই করতে পারবেন। কী বলেন ডিরেক্টর সাহেব?

ডিরেক্টরের দিকে অগোচরে চোখ মেরে দিলো আদিত্য। ডিরেক্টর আদিত্যর ইশারা বুঝতে পেরে ওর সাথে সায় দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। ইট উইল বি গ্রেট। প্লিজ ম্যম?

নূর মানা করে দিলো। সে মোটেও এসব করবেনা জানিয়ে দিলো। অতঃপর আদিত্য নূরের উইক পয়েন্ট চেপে বলে উঠলো,
–বাদ দেন ডিরেক্টর সাহেব, আসলে কিছু লোক শুধু অন্যের ভুল ধরতে পারে। নিজেকে করতে দিলে আর পারেনা। অন্যের সমালোচনা করতে পারে। কাজের বেলায় ঠনঠন। সবার দ্বারা সবকিছুতো আর সম্ভব না তাইনা। মিস নূরের দ্বারাও এটা সম্ভব না। সি ইজ নট ক্যাপাবল ফর দিস।

নূর এমনিতেই রেগে ছিলো। তারওপর আদিত্যর খোঁচা মারা কথায় তার রাগ আরও বেড়ে গেল। আর যথারীতি রাগের বশে সে আদিত্যর জালে ফেঁসে গিয়ে বলল,
–নূর পারেনা এমন কোনো কাজ নেই মিঃ আদিত্য। চলুন আজ আরও একবার আপনাকে সেটার প্রমাণ দেখিয়ে দেবো।

আদিত্য মনে মনে বিশ্ব জয়ের হাসি দিলো। এটাই তো সে চাচ্ছিল। নূরের তৈরি গাড়িতে আদিত্য অন্য কারোর সাথে কীভাবে বসবে? নূরের গাড়িতে প্রথম নূরের সাথেই বসবে সে। শুটের জন্য নূরের মেকআপ করতে চাইলে নূর সাফ মানা করে দিলো। সে যেভাবে যেমন আছে সেরা করবে বলে দিলো। আদিত্যও সবাইকে ইশারায় মানা করলো। সেও চায়না নূরের ওপর কোনো কৃত্রিমতার ব্যবহার হোক। নূর যেমন আছে সেটাই সবচেয়ে পারফেক্ট। শুটিং আবারও শুরু হলো। নূর আর আদিত্য গাড়ির ভেতরে বসে কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার সীন করলো। তারপর অন্য একটা স্পটে গেল। নদীর কিনারায় আরেক টা সেট লাগানো হয়েছে। গাড়ি সেখানে এসে থামলো।শুটিং এখনো চলছে। আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে নূরের হাত ধরে ওকে বের করলো। এবং শুটিংয়ের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী গাড়ির পাশেই আদিত্য নূরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নূরকে শুন্যে উঁচু করে ধরলো। নূরের মুখ এখন আদিত্যর মুখের ওপরে। খুব নিকটে এলো দুজনের নজর। চোখে চোখ পড়লো।আদিত্যর ওই মায়াবী নজরে থমকে গেল সে। কম্পিত হলো নূরের অন্তর্দেশ। কম্পিত হলো অঙ্গ। মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো আদিত্যর পানে।হৃদয়ের সব অনুভূতি উপচে পড়তে চাইলো। সব অনুভূতি বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো এই পুরুষে। সব অভিযোগের ঝুলি তাকে শোনাতে মন চাইলো। আশেপাশের সব ধোঁয়াসা এই মুহুর্তে। শুধু দুজনের আঁখি যুগলে অনুভূতির মেলা জমছে।

হঠাৎ ডিরেক্টরের কাট বলাতে ঘোর কাটলো নূরের। হকচকিয়ে দ্রুত নেমে গেল সে। আর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো সে। এই লোকের সামনে দূর্বল পড়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু এবার আর তা হতে দিবেনা নূর। এবার আর আদিত্যর ষড়যন্ত্রে পা দিবেনা সে।
আদিত্য নূরের যাওয়ার পানে মায়াবী চোখে তাকিয়ে রইলো।
“তোমার সব অভিযোগ, সব অভিমান,সব ঘৃণা আমাকে ঘিরে হোক। নাহয় সে অনুভূতি যাতনাদায়ক হোক তবুও জঘন্য স্বার্থপরের মতো চাইবো, আমিহীনা তোমার অনুভূতির শহর শূন্য অকেজো হোক।”

চলবে…..

#শৈবলিনী—৩৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আজ জিদান আর শিখার বিয়ে।রঙবেরঙের লাইটিং আর জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে। মেহমান একে একে আসা শুরু করেছে।জিদান আর শিখা বর বঁধুর আসনে বসে আছে। জিদান আর শিখা দুজন তাদের নিজ নিজ প্রিয় ব্যাক্তির অপেক্ষা করছে। জিদান অপেক্ষা করছে তার আদিত্য স্যারের আর শিখা অপেক্ষা করছে ওর প্রিয় বান্ধবী নূরের। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এলো সবাই। প্রথমে নূর এলো ওর পরিবারের সাথে। শিখা খুশি হয়ে নূরকে ডাকলো কাছে। গিয়াস আগেই এসেছিল। বন্ধুদের সাথে ছবি তোলার জন্য গিয়াসকেউ ডাকলো শিখা। গিয়াস ওদের কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে শিখার দিকে ঝুঁকে বলল,
–কিরে শিখাইয়া,শেষমেশ জদু মিঞার কদু হইয়াই গেলি। কি ঝাক্কাস জুটি হইছে তোগো। হাফ আবালের বর হবে ফুল আবাল।রতনে রতন চেনে,আর আবালে চেনে আবাল। বাহ! নজর না লাগে আমগো জাতীয় আবাল জুটির। জদু মিঞা আর কদু মিইল্লা যেইডা পয়দা করবি ওইটা হইবো আলু মিঞা।

বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো গিয়াস। শিখা ওর দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলল,
–খালি সামনে ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে আছে দেখে বেঁচে গেলি। নেহাৎ ছবি খারাপ হওয়ার ভয় না থাকলে আজকে তোকে ওই খাবারের বোরহানির ভেতর ঢেলে মিক্সড করে ফেলতাম। এখন এই গু মার্কা দাঁত বের করে হাস। ছবি উঠবো আমরা।
এদের কান্ড দেখে হাসলো নূর। এরা আর সুধরালো না। ছবি তোলা শেষে গিয়াস এবার নূরের দিকে তার স্পেশাল কমেন্ট ছুড়লো। নূরের পোশাকআশাক দেখে সে বলল,
–কীরে ডাইনোসরের শাশুড়ী, তুই কী ডাব্লিউ ডাব্লিউ রেসলিং ম্যাচ থেকে সোজা এইখানে টপকালি? বিয়ে বাড়িতে তো কমছে কম একটু মাইয়া সাইজা আইতি। নাকি মাইয়া সাজতে তোরে ডাক্তারে মানা করছে? আরে অন্য মাইয়াগো দেখ। বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা শুনলে হয়। একবছর আগ থেকে সাজা শুরু করে। পারলে মেকআপের ফ্যাক্টরিতে ঢুইকা পড়ে। যেন এইডা বিয়া বাড়ি না, মিস ইউনিভার্সের প্রতিযোগিতা হইতাছে। আর এক তুই। জিন্স আর কুর্তিতে চইলা আইছোস। আরে এহনতো তোর টাকাও আছে তাও এতো কিপ্টামি করস ক্যা? সত্যি বলছি, নারীজাতি তোকে তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করে দিবে।

নূর বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলল,
–তুই কি টায়ার্ড হসনা? সবসময় এতো ফালতু কথা কীভাবে বলতে করিস?

গিয়াস গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
–এটাতো আমার ট্যালেন্ট। এসব নিয়ে কখনো অহংকার করিনি।

গিয়াসের বলার ভঙ্গি দেখে নূর না হেসে পারলোনা। আর বরাবরের মতোই এই ভুল সময়েই এন্ট্রি আদিত্যর। আদিত্য আর আবির একই গাড়িতে এসে পৌঁছাল। আর আসতেই নূর আর গিয়াসের ওই হাসাহাসির সীন দেখে ফুরফুরে মেজাজটা বিগড়ে গেল। বাহ! এতকিছুর পরিবর্তন হলো, শুধু এই আইটেমটার কোনো পরিবর্তন হলোনা। এটার তো আজ একটা উপায় করতেই হবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্টেজে উঠে এলো আদিত্য আর আবির। নূর গিয়াসের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত ছিলো, আদিত্যকে খেয়াল করেনি সে। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে আদিত্যকে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। নূর জানতো আজ আদিত্য আসতে পারে, তাইতো সে আসতে চাইছিলোনা এখানে। কিন্তু না আসলে শিখা মনে কষ্ট পেত। তাছাড়া ওই লোকের জন্য আমি নিজেকে কেন আঁটকে রাখবো? তার থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না আমার। এমনটাই বলে নিজের মনকে বুঝ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে নূর। কারণ তার মন তার যুক্তির সাথে সহমত হচ্ছে না। আদিত্যর উপস্থিতি তার ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। বারবার আরচোখে তাকাচ্ছে নূর। আদিত্য আজ রয়াল ব্লু কালারের কোট প্যান্ট পড়েছে। না চাইতেও ওই সুদর্শন পুরুষের দিকে বেহায়া নজর চলে যাচ্ছে।

আদিত্য জিদান আর শিখাকে অভিনন্দন জানিয়ে পাশে নূর আর গিয়াসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গিয়াসের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
–তুমি গিয়াস না?

গিয়াস খুশিতে আটখান হয়ে নিজেকে পরিবেশন করে বলল,
–আপনি আমাকে চেনেন? ওয়াও, এটাতো ড্রিম কাম ট্রু ওয়ালা ব্যাপার হয়ে গেল।

আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
–হোয়াই নট,তোমাকে না চিনলে কি হয়? হায় মিঃ গিয়াস, নাইস টু মিট ইউ।

মিঃ গিয়াস!! এতো সম্মান! বেচারা গিয়াসের এতো সম্মানের ওভারডোজ পেয়ে ডায়রিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আদিত্য হাত এগিয়ে দিলো গিয়াসের সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য। গিয়াসও উৎফুল্ল হয়ে হাত এগিয়ে দিলো আদিত্যর হাতের সাথে মিলানোর জন্য। যেই আদিত্য ওর হাত ধরে হ্যান্ডশেক করলো ওমনি ওর জান গলা দিয়ে ফুড়ুৎ করে বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আদিত্য এতো জোরে হাত চেপে ধরেছে যে বেচারা গিয়াসের হাত ক্রাশ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাথায় বেচারা চিৎকার করতে চেয়েও পারছেনা। ইজ্জতের মামলা বলে কথা। তবে গিয়াসের মুখভঙ্গি আর আদিত্যর মনোভাব দেখে নূর ঠিকই বুঝতে পারছে কি করতে চাইছেন উনি। নূর সিচুয়েশন সামলাতে বলে উঠলো,
–শিখা আপনাকে ছবি ওঠার জন্য ডাকছে। যান ওদিকে দাঁড়ান।

আদিত্য নূরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেড়ে দিলো গিয়াসের হাত। বেচারা গিয়াসের হাত একটুর জন্য শহিদ হয়নি। জীবনে আর কারোর সাথে হ্যান্ডশেক করবেনা সে। আদিত্য শিখার সাথে ছবি ওঠার জন্য ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অন্যপাশে আবিরও আছে। নূর স্টেজ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বাঁধা পেল সে। হঠাৎ আদিত্য নূরের হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
–কোথায় যাচ্ছ নূর! ফটো সেশন এখনো বাদ আছে যে। এতক্ষণ তো খুব হেঁসে হেঁসে ছবি তুলছিলে। এখন কি হলো?

নূর ভড়কে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–কি করছেন এসব? ছাড়ুন আমাকে।

নূর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে নিলে আদিত্য এবার এক হাতে নূরের কোমড় শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
–আঃ আঃ, নড়ে না নূরসোনা। ছবি খারাপ হয়ে যাবে।
নূর কটমটে চোখে তাকালো আদিত্যর পানে। ঠিক সেই সময়ই ফটোগ্রাফার ছবি ক্লিক করে নিলো। দুজনের এই ছোট্ট খুনসুটি মুহুর্ত ক্যামেরায় আবদ্ধ হলো। নূর আদিত্যর হাত ছাড়িয়ে দ্রুত নেমে এলো স্টেজ থেকে। আদিত্য সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।

আজতো আবিরের লটারি লেগে যাওয়ার উপায়। চারিদিকে বাহারি রমনীর মেলা আজ। স্টার্টার,মেইন কোর্স,ডিজার্ট সব ধরনের নারীর ছড়াছড়ি। আজ জিদানের কিছু হোক না হোক আবিরের সময় রঙিন হবে এটা নিশ্চিত। সময় রঙিন করার উদ্দেশ্যে সে সিলেক্ট করলো একজনকে। ম্যাক্স প্রো আল্ট্রা লেভেলের স্টাইলিশ এক রমনীকে দেখলো সে। মিষ্টি কালারের শিফন জর্জেটের শাড়ি পড়েছে সে। ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো স্লিম কোমড়ের অংশ বের করে শাড়ি পড়েছে। সাথে স্লিভলেস ব্লাউজ তার হটনেসে আরও আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। সেই আগুনে হাত ছেঁকতে এগিয়ে গেল আবির। চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটার পাশে গিয়ে বসে বলে উঠলো,
–হ্যালো মিস, আপনি কী হার্টের ডাক্তার?

মেয়েটি থতমত খেয়ে বলল,
–নাতো,কেন?

আবির তার ফ্লার্টিং আন্দাজে বলে উঠলো,
–তাহলে আপনাকে দেখে আমার হার্টবিট থেমে গেল কেন? এইযে দেখুন না হার্ট চলছেনা।

আবির মেয়েটির হাত ধরে তার বুকের বামপাশে রেখে দেখালো। মেয়েটি হেঁসে দিয়ে বলল,
–আচ্ছা তাই? তো হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেলে আপনি এখনো বেঁচে আছেন কীভাবে?

–এটাতো আপনার কামাল। আপনার মতো মহীয়সী নারীর একটু সান্নিধ্য পাওয়ার অদম্য আশায় এই নির্জীব দেহে এখনো প্রাণ চলছে। এইযে আপনার হাত আমার বুকে ছুঁয়ে দিলো। এখন আমার সব ঠিক হয়ে গেছে। এমনি এমনিই কী আপনাকে হার্টের ডাক্তার বললাম।

মেয়েটি আহ্লাদী ভঙ্গিতে হেঁসে বলল,
–আপনি সত্যিই অনেক মজার লোক।

আবির দুষ্টু স্বরে বলল,
–এটাতো কিছুই না বিউটিফুল, একবার এই পেশেন্টের ডাক্তার হয়েই দেখোনা। তারপর দেখবে আরও কতো মজা দিতে পারি আমি। বাইদাওয়ে, বান্দাকে আবির রায়হান বলে। আর আপনার বিউটিফুল নামটা?

মেয়েটি মুচকি হেঁসে বলল,
–আমি রিয়ানা। মডেলিং এ চেষ্টা করছি। আর আপনি?

–এমনিতেতো ফ্যাশান ডিজাইনিং করি। তবে পার্ট টাইম মেয়েদের জন্য টিস্যু পেপারের কাজও করি। আপনি চাইলে আমাকে ইউজ করতে পারেন। আমাকে ইউজ ফেলে দিন। আমি মাইন্ড করবো না। নারীর সেবায় আমার জীবন উৎসর্গ।

মেয়েটি আবারও হাসলো। আবির বাঁকা হেসে বলল,
–হাসি তো, ফাসি। ♬ মেরে পেয়ার কা রাস জারা চাখনা,ওই মাখনা ওই মাখনা…..

আহানা ওর পরিবারের সাথে মাত্রই এসেছিল। ভারী লেহেঙ্গা পড়ে হাঁটতে সময় লাগছিল ওর। বাকিরা আগে চলে গেছে। আর ও দুই হাতে লেহেঙ্গা ধরে আস্তে আস্তে আসছে। ভেতরে ঢুকতেই সর্বপ্রথম আবিরের এই রাসলীলাই চোখে পড়লো তার। বিরক্তিতে মন মেজাজ তিক্ত হয়ে গেল। সব জায়গায় কেন এই লোকটাই সামনে পড়তে হয়? জাস্ট অসহ্যকর। বিরক্ত হয়ে আহানা চলে যেতে নিলেই আবির দেখে ফেললো তাকে। রিয়ানার কাছে এক মিনিট সময় নিয়ে, এসে দাঁড়াল আহানার সামনে। ভ্রু নাচিয়ে বিদ্রুপের সুরে বলল,
–কিরে ফ্রী খাবার খেতে এখানেও চলে এসেছিস? এতো হাবাতে কেনরে তুই? দেশের বাজারের এই মূল্য বৃদ্ধি আজ নির্ঘাত তোর কারণেই হয়েছে। খেতে খেতে দেশকে খালি করে দিয়েছিস একদম।

আহানা বিরক্তির সপ্তমে উঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–আমিতো নাহয় খেয়ে খেয়ে দেশ খালি করেছি। কমছে কম আপনার মতো তো না, নিজের আর অন্যের ইজ্জত খালি করছি।

–বাহ! ডায়লগবাজি এন অল। নট ব্যাড। তা এমন সার্কাসের জোকার সেজেছিস কোন দুঃখে? যাত্রাপালা ছেড়ে কী এখন সার্কাস দল জয়েন করেছিস নাকি? ভালোই উন্নতি হচ্ছে তোর। জরিনা বানু থেকে প্রমোশন হয়ে এবার জোকার।
বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো আবির। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে আহানার। রাগের বহিঃপ্রকাশ করে সে বলল,
–একটা খু,ন যদি মাফ হতো তাহলে আই সোয়্যার, আমার হাতে আপনার খু,ন নিশ্চিত ছিলো।

আবিরের নজর স্থির আহানার পানে। ইনটেন্স নজরে তাকিয়ে আহানার মুখের সামনে হালকা ঝুঁকে সে আমোদিত কন্ঠে বলে উঠলো,
–সত্যিই? তুই সত্যিই খু,ন করবি আমাকে? জানিস এটা হবে আমার লাইফের বেস্ট গিফট।অন্যদের কথা জানিনা তবে আমি তোকে এই খু,নের অনুমতি দিলাম। তুই যখন যেখানে মারতে চাস আমি চলে আসবো। আই প্রমিজ কেউ জানবেনা এই খবর। বল তাহলে কবে এই শুভ কাজ করতে চাস? কান্ট ওয়েট ফর দিস।

আহানা বুঝতে পারলো এই লোকের সাথে কথা বলা মানে নিজের মাথায় নিজে বারি মারা। তাই রাগে কড়মড় করতে করতে ধুপধাপ পা ফেলে সরে গেল সে। আবির বাঁকা হেসে মনে মনে বলল,
–আই উইশ তুই এমন করতি আন্নি। আই সোয়্যার, জন্ম নেওয়া সার্থক হয়ে যেত আমার।

গিয়াসও এই সুবর্ণ সুযোগ মিস করতে চাচ্ছে না। লেগে আছে কাউকে না কাউকে পটানোর ধান্দায়। একটা মেয়েকে একা একপাশে বসে থাকতে দেখে নিজের লাক ট্রাই করতে লেগে পড়লো সে। মেয়েটির কাছে গিয়ে হাসিমুখে নিজেকে প্রেজেন্ট করে বলল,
–হ্যালো মিস,আমি গিয়াস। কনের বন্ধু। আর আপনি?

মেয়েটিও সৌজন্যতার খাতিরে বলল,
–জি ইরিন।

গিয়াস বেকুবের মতো দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
–ওয়াও, জি ইরিন। নাইস নেম। ভেরি আনকমন।

মেয়েটি বলল,
–না না জি ইরিন না, শুধু ইরিন।

–আচ্ছা, শুধু ইরিন। এটাও সুন্দর নাম।

–আরেহ, শুধু ইরিন মানে অনলি ইরিন।

–নাইস টু মিট ইউ, অনলি ইরিন।

মেয়েটা এবার ভীষণ বিরক্ত হয়ে আর নিজের নাম ঠিক করার প্রয়াস ছেড়ে দিলো। গিয়াস বলে উঠলো,
–বাইদাওয়ে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এ ফাইনাল ইয়ারে। আর আপনি?

–আমি মাসাজ পার্লারে কাজ করি।

–ওয়াও,দ্যাটস গ্রেট। মাসাজ তো আমারও নেওয়া দরকার। আমিও আসবো মাসাজ নিতে।

–জি না, এটা শুধু মেয়েদের জন্য। মেনস আর নট এলাউড।

–কেন? কেন? ছেলেরা আসতে পারবেনা কেন? সব জায়গায় ছেলেদের সাথে কেন এই অবিচার হয়? ছেলেরা গার্লস টয়লেটে যেতে পারবেনা, ছেলেরা মাসাজ নিতে পারবেনা তো যাবে কোথায় ছেলেরা?সরকার বলে ছেলে মেয়ে সমান অধিকার। অথচ ছেলেরা সব জায়গায় অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন কি দুনিয়া ছেড়ে দেবো আমরা? এ কেমন বিচার?

মেয়েটা এবার চরম বিরক্ত হয়ে বলল,
–আপনি কি পাগল?

গিয়াস সিনেমাটিক ভঙ্গিতে মাথা হেলিয়ে মেলোড্রামা করে বলল,
–আজকাল কেউ সরল মনে হাসিমুখে দুই কথা বললেই লোক তাকে পাগলি বলে ম্যাডাম।

মেয়েটা এবার বিরক্ত হয়ে উঠেই গেল ওখান থেকে। গিয়াস ভাঙা মনে নূরের পাশে এসে বসে নূরের ওড়নার কোণা দিয়ে মিথ্যে চোখ মোছার অভিনয় করে নেকামো করে বলল,
–ইয়ার, সবসময় আমার সাথেই কেন এমন হয়? কি কমতি আছে আমার মাঝে?

গিয়াসের এই ড্রামা দেখে নূর হেঁসে পারলোনা। গিয়াস আরও দুঃখীয়ারি হয়ে নূরের কাঁধে মাথা হালকা করে এলিয়ে দিয়ে বলল,
–তুইও হাসছিস? তুইও আমার কষ্ট বুঝলিনা। আব মেরা কেয়া হোগা?

দূর থেকে এই দৃশ্য দেখতে পেল আদিত্য। এবারে তার রাগ সপ্তম আসমানে পৌঁছে গেল।কতবড় সাহস,আমার নূরের কাঁধে মাথা দেয়! আজতো এই নমুনাটার একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়বেই সে। শরীরের মাঝে রাগের তুফান জমিয়ে নিয়ে নূর আর গিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল সে। মুখে ফেক হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–আরে গিয়াস তোমার সাথে একটু কথা ছিলো আমার সাথে এসোতো।

নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ওর সাথে আবার কি কথা? যা বলার এখানেই বলুন।

–আরে এটা আমাদের ম্যান টু ম্যান টক। তোমার সামনে বলা যাবে না। চল গিয়াস।
বলেই এক হাতে গিয়াসের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে নিয়ে যেতে লাগলো। গিয়াসও বেকুবের মতো খুশি খুশি আদিত্যর সাথে গেল। ভাবছে আদিত্য বুঝি ওকে বন্ধু ভাবছে। কিন্তু নূরের কাছে আদিত্যর ভাবসাব ঠিক মনে হচ্ছে না। আদিত্য কি করতে চাইছে তা বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে না ওর। তাই সেও ওদের দিকে এগিয়ে গেল। আদিত্য গিয়াসকে নিয়ে ছাঁদে চলে এলো। ছাঁদের কিনারায় নিয়ে যেতে যেতে শান্ত সুরে বলল,
–তুমি জানো গিয়াস, আমার না একটা বাজে অসুখ আছে। আমার প্রিয় জিনিস কারোর সাথে শেয়ার করতে পারিনা। সে যতোই আপন লোক হোকনা কেন। আমার ভীষণ রাগ হয়। রাগে মাথা ফেটে যায় আমার। আর আমার রাগ অনেক ভয়ানক। রাগ উঠলে আমি মানুষকে ছাঁদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেই। আর এখন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো নূর। তো বাকিটা তো তুমি বুঝতেই পারছ। তো বলো তুমি কী এই কম বয়সে ছাঁদ থেকে পড়ার অভিজ্ঞতা করতে চাও?

বেচারা গিয়াস আদিত্যর হুমকি বুঝতে পেরে আতঙ্কে অর্ধেক জান এমনিতেই বেড়িয়ে গেল ওর। ভয়ে আৎকে উঠে হঠাৎ গলা ছেড়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করে দিলো। গিয়াসের এহেন কান্ডে আদিত্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। গিয়াস মরা কান্না করতে করতে বলল,
–এ্যাঁ…….মাম্মি……খেলমু না আমি। স্যার প্লিজ মাইরেন না আমারে। এখনোতো বিয়েই হলোনা আমার।
এসব আবোলতাবোল বলে কাঁদতে লাগলো সে। তখনই নূর ওখানে দৌড়ে এলো। গিয়াসকে কাঁদতে দেখে বলল,
–কী হচ্ছে এখানে? কি করেছেন আপনি ওর সাথে? শুধু শুধু ওকে কেন ভয় দেখাচ্ছেন আপনি?

নূরকে দেখে গিয়াস উঠে নূরের পেছনে লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–নূর প্লিজ বাঁচা আমারে। স্যারকে বলনা তুই আমার সাত জনমের বোইন লাগোস। চাইলে এখুনি রাখি বান্ধাই নে। দরকার হলে জাতির ভাই বানায় দে। তাও বাঁচা আমারে।

নূর গিয়াসকে বলল,
–তুই যা এখান থেকে। আমি দেখছি।

গিয়াস জান হাতে নিয়ে ছুটে পালালো ওখান থেকে। নূর আদিত্যর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–দেখুন নিজের পাওয়ার দেখানোর ইচ্ছে হলে গিয়ে রেসলিং ম্যাচে যোগ দিন। বেচারা বোকাসোকা গিয়াসের ওপর নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার দরকার নেই।

বলেই উল্টো ঘুরে চলে যেতে লাগলো নূর। কিন্তু তা হতে দিলোনা আদিত্য। আদিত্য নূরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ছাঁদের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।নূরের দুই হাত দেয়ালের সাথে আঁটকে ধরে নূরের মুখের সামনে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–কেন?খুব মায়া হচ্ছে বুঝি ওর জন্য? একদম উতলে পড়ছে মায়া। এতো মায়া ওর জন্য? দুনিয়ার সবার জন্যই তোমার মায়া উতলে পড়ে। শুধু এই আমিটাই তোমার চোখের কাটা তাইনা? আমার জন্য কোনো মায়া হয়না তাইনা?

নূর তপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–মায়া ভালো মানুষের জন্য হয়। বেঈমান ব্যাক্তির জন্য না।

–আচ্ছা আমি নাহয় বেঈমান। তাহলে তুমি কি? তুমিতো সৎ মানুষ। তাহলে তুমি কেন মিথ্যে বললে? কেন সেদিন বললে আমাকে ভালোবাসনা? ছেড়ে যাওয়ার আগে অন্তত সত্যিটা বলারতো সাহস দেখাতে। তোমার কাছ থেকে মিথ্যের আশা করিনি।

নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–আশা নিরাশার কথা আপনার মুখে মানায় না। আর আমি আপনাকে কোনো মিথ্যে বলিনি। যা বলেছি সেটাই সত্যি।

আদিত্য নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কন্ঠে বলল,
–মিথ্যে,আবারও মিথ্যে বলছ তুমি। বাসো, অনেক বেশি ভালোবাসো। প্লিজ আজতো মনের কথাটা সত্যি করে বলো। জানি তোমাকে অনেক আঘাত করেছি। কিন্তু তারজন্য শাস্তিও তো কম দাওনি। আজ আটটা মাস হলো বিনা হৃদয়ে বেঁচে আছি আমি। এবারতো মাফ করে দাও আমাকে। মাফ না হয় নাই করলে। অন্তত সেই সত্যিটা তো বলো। যা শোনার পর মরে গেলেও আপসোস থাকবেনা।

নূরের বুকের মাঝে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চেপে রাখা অনুভূতিগুলো কান্না হয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু না,আরও একবার এই লোকের মায়াজালে আবদ্ধ হবেনা সে। নূর নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে শক্ত গলায় বলল,
–মনে হচ্ছে আপনি অনেক ভুল ধারণা পোষণ করছেন। আমি আজ আবারও বলছি, আপনি নিজেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাববেন না। আপনি না আগে আমার জীবনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি ছিলেন আর না এখন আছেন। আপনি আমার জন্য শুধুই একজন সাধারণ ব্যক্তি। যার প্রতি কোনরকম অনুভূতিই কাজ করেনা। তাই না রাগ,না ঘৃণা আর না ভালোবাসার মতো কোনো অনুভূতি আছে আপনার জন্য। তাই এসব ভুল ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসুন। আর বারবার নিজেকে আমার সামনে ছোট করতে আসবেন না। আপনি হয়তো বিবেকহীন হতে পারেন। তবে আমার বিবেকে বাঁধে।

বলেই আদিত্যর হাত ছাড়িয়ে আদিত্যকে হালকা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলো নূর।কিন্তু তার আগেই আদিত্য পেছন থেকে নূরের হাত টেনে ধরে নূরের পানে তাকিয়ে থেকে মায়াবী কন্ঠে বলল,
“আমি হয়তো এতটাও ভালো হতে পারনি যতটা তুমি চেয়েছ,
তবে এতটাও খারাপ না,যতটা তুমি নিজের মনে বানিয়ে নিয়েছ।”

আবারও সেই অসহনীয় কম্পন ঘটলো নূরের বুকের মাঝে। সে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল নূর।এই লোকের সামনে বেশিক্ষণ থাকলে সে আবারও নিজেকে ধরে রাখতে পারবেনা। ভেঙে গলে পড়বে। যা নূর কোনমতেই করতে চায়না।ছেড়ে এসেছি সেই গলি,যেখানে কখনো আপনার ছায়া ছিলো। ফেলে আসা গলিতে আর ফিরে যাবেনা নূর।

চলবে….