সম্পর্কের দেয়াল পর্ব-২০

0
424

#সম্পর্কের__দেয়াল
#Writer_AnaHita_Ayat_SumaiYa
#পর্ব__২০
অন্যদিকে পাভেল লাগাতার ভাবে রিমির ফোনের কল করেই যাচ্ছে কিন্তু বার বার ওপাশ থেকে বলছে ফোন বিজি। ও ভেবে পায় না এতো কথা কার সাথে বলছে সে? এক পর্যায়ে পাভেল ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে তাড়াহুড়ো করে দৌড়াতে নেয় তো মেইন রোডে চলে আসে। শুধু মেইন রোডে ই নয় পাভেল একেবারে রাস্তার মাঝখানে চলে যায়। আর হঠাৎ করেই কোথা থেকে একটা মালবাহী ট্রাক ক্রমশ তার দিকে এগোতে থাকে। সে এটা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে ঘাবড়ে যায় আর কি করবে ভেবে না পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিচে পড়ে যায়। আর ভুলবশত ট্রাক টা চলে যায় পাভেলের দুই পায়ের উপর দিয়ে। সে জোড়ে ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। চিৎকার শুনে সারা রাস্তায় ক্ষণিকের মধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। প্রচন্ড লোকের ভীড়। ট্রাকের চাকা পাভেলের পা পিষে দিয়ে চলে গেছে। রক্তে রাস্তা ভিজে আছে। ট্রাক ওয়ালা কে কেউ ধরার আগেই বেটা সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায়। তবে এখানে দোষ তার নয় দোষ পাভেলের। সেই ই তার বিপদ নিজে টেনে নিয়ে এসেছে।

লোকজনের হৈচৈ পড়ে যায়। অনেকে খুব আফসোস করছে তার জন্য। পাভেল নিচে পড়ে জবাই করা মুরগির মতো বিশ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে লাফাতে থাকে। ভিড় ঠেলে কয়েক জন লোক বললো,

‘আরে আপনারা চেয়ে দেখছেন কি? উনার অবস্থা গুরুতর! উনাকে হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন প্লিজ কেউ হেল্প করুন!’

অনেক লোক জন এগিয়ে আসলে পাভেল কে হাসপাতালে পাঠাতে সক্ষম হয়। পাভেলের ফোন রাস্তার পাশেই ছিটকে পড়ে ছিলো একজন লোক সেটা পেয়ে ভালো করে সেটি দেখলো।

নাহ ফোন টা ঠিকঠাক ই আছে। শুধু উপরের গ্লাস টা ফেটে গেছে। লোকটি আর দেরি না ডায়ালে চলে যায়। সবার উপরে ‘রিমি মাই ওয়াল্ড’ লিখা নাম্বার টি। এক্সিডেন্ট করার আগে ঐ নাম্বারে ৮ বার কল করা হয়েছে। লোকটি এবার দ্রুত ঐ নাম্বারে আবার পুনরায় কল দেওয়ার চেষ্টা করে।
কল যাচ্ছে কিন্তু ফোন কেউ তুলছে তো না। লোকটি তাও কল দিতে থাকে।

এদিকে রিমি দিশার ক্যান্সার হয়েছে শোনার পর ঠাস করে নিচে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। এই শক টা হজম হলো না তার। ভাবতেই অবাক লাগে এই কিছুদিন আগেও তারা কতো হাসি খুশি লাইফ ইনজয় করেছে একসাথে আর আজ শুনলো ওর ক্যান্সার? নাহ এরকম টা তো হওয়ার কথা ছিলো না। রিমি মাথা হাটুতে চেপে ধরে এসব ভাবছিলো ওদিকে ফোন বার বার বেজেই চলেছে। এক পর্যায়ে মাথা উঠিয়ে সে কল টা রিসিভ করলো। ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসলো কিছু কথা। কথা গুলো ঠিক এমন,

‘জ্বি আপনি কে বলছেন? আপনি কি এই ফোনের মালিকের কিছু হন?’

‘মানে কে আপনি? এই নাম্বার থেকে কল দিলেন কিভাবে?’ (পাভেলের নাম্বার থেকে অচেনা কেউ কল দিয়েছে দেখে কিছু টা অবাক হয়ে)

‘এই মুহুর্তে আমি কে সেটা জানা একদমি জরুরি নয়। আপনি জরুরী ইউ.এস.এম এই হসপিটালে চলে আসুন। এই ফোনের মালিক রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছেন। আমরা তাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছি। উনার অবস্থা খুব খারাপ ট্রাক উনার দু পায়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। প্লিজ আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসুন!’

লোকটার কন্ঠ শুনে বুঝা যাচ্ছে সত্যি ই সিরিয়াস কিছু। এবার রিমির হাত থেকে ফোন টা পড়ে যায়। এই দ্বিতীয় নাম্বার ঝটকা টা ঠিক মানতে পারলো না সে। কান্না করে মা বলে চিৎকার করতে করতে নিচে নামে সে। পাভেলের মা তো খুব অবাক। আবার ওর উপর বিরক্ত ও হন যে এতো চিৎকার চেঁচামেচি কিসের জন্য! একে তো উনি বুঝেছেন পাবেল মূলত অসুস্থ না সব নাটক। তার উপর এখন এই সব জাস্ট বিরক্তিকর!

রিমি নিচে এসে হতভম্বের মতো বলতে থাকে,

‘মা পাভেল নাকি হাসপাতালে! প..পা..ভেল নাকি এক্সিডেন্ট করেছে মা এসব কি শুনছি! আমদের এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে আসুন মা!’

পাভেল এক্সিডেন্ট করেছে শুনে ওর মা শক্ড।

‘এসব কি বলছিস রিমি? দেখ আমার ছেলের নামে এমন অলক্ষুনে কথা বলবি না বলে দিচ্ছি!’

‘মা আমি সত্যি বলছি। আমি যাচ্ছি আমাদের পাভেল কে দেখা প্রয়োজন!’

রিমি আর কিছু না বলে দিক বেদিক শূন্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। এবার পাভেলের মায়ের খটকা লাগে। কিছু তো গড়বার আছেই! তাই তিনি ও পেছন পেছন আসেন। রিমি কাঁদতে কাঁদতে একটা সিএনজি কে ডাকে,

‘ইউ.এস.এম হাসপাতালে চলুন প্লিজ!’

‘ঠিক আছে।!’

পাভেলের মা ও এসে বসে। তিনি ও এবার কাঁদতে শুরু করেছেন। পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতেই গেছে দুজনের। পাভেলের মা শুধু বলছেন,

‘ভাই একটু তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও না আমাকে আমার ছেলের কাছে! জোড়ে চালাও না ভাই!’

উনি যত দ্রুত সম্ভব চালাচ্ছেন ই কিন্তু এই রাস্তা যেনো ফুরোবে না কখনো। অবশেষে দুজন হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। সিএনজি চালক কে তার ভাড়া না মিটিয়েই দুজন হাসপাতালের দিকে দৌড়াতে থাকে। এটা দেখে সিএনজি চালক বুঝলেন কোনো খারাপ কিছু হয়েছে হয়তো উনাদের আপন জনের সাথে। তাই তিনি আর বেক্কলের মতো ভাড়া চাইতে গেলেন না। চলে যান অন্য কোনো যাত্রীর খোঁজে।

———————-

কবিরের ফোনে তার মা কল দেয়। সে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে কল টা রিসিভ করে। তবে তার আগে নিজেকে কোনো দুঃখের সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুত করে নিলো। কেননা সে জানে না তার পাপের ক্ষমা চাওয়ার রাস্তা টা আল্লাহর পছন্দ হয়েছে কিনা! তিনি মাফ করেছেন কিনা! কারণ পাভেল তো তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে চলে গেছে বলেও যায় নি ক্ষমা করেছে। তাই কবির নিজেকে শক্ত করলো।

‘মা ইরিন (কবিরের বউ) কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয় নাই তো?’

কবিরের মা ছেলের ব্যাকুলতা দেখে সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,

‘আল্লাহ শেষ রক্ষা করেছেন কবির। আল্লাহ অসীম দয়ালু। উনার দয়ার শেষ নেই। ডাক্তার বলেছে ইরিন এখন ঠিক আছে সুস্থ ও আছে। কোথায় তুই?’

মায়ের কথা শোনার পর কবির আকাশের দিকে তাকিয়ে শুকরিয়া আদায় করলো। এটা ভেবে সে স্বস্তিবোধ করছে যে ক্ষমা সে পেয়েছে। সন্তানের জীবন তো সে বাঁচাতে পারে নি তবে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে সন্তানের জননী কে বাঁচাতে পেরেছে এর জন্যই আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। কবির বললো,

‘মা আমি এক্ষুনি আসছি!’

‘হ্যাঁ কিন্তু কবির ইরিন আর বাচ্চা টার হঠাৎ হয়েছিলো কি? ডাক্তার রাও কিছু বুঝতে পারছেন না। ইরিন এর অবস্থা ও খুব খারাপ ছিলো। ডাক্তার রা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু পরক্ষণেই কিভাবে যেনো আচমকা ম্যাজিকের মতো সব ঠিক কি করে হয়ে গেলো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

‘সব ই আল্লাহর লিলা খেলা মা!’

এই বলে কবির আরো একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির হাসি হাসলো। তার সন্তান মারা গেছে এজন্য তার আফসোস নেই কারণ তার পাপের জন্য ই তার সন্তান কে আল্লাহ কেড়ে নিয়েছেন। তবে আল্লাহ ইরিন কে তো মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এটাই বড় পাওয়া। এটাই কোনো ইঙ্গিত ছিলো! কেননা ইরিন ও যদি মারা যেতো তাহলে কবির নিজেকে কোনো দিন ও ক্ষমা করতে পারতো না! কক্ষনো না!

তবে কবির আজ থেকে তওবা করলো আর কোনো দিন কোনো খারাপ মাধ্যম থেকে টাকা আয় করতে চাইবে না। আর কখনো আল্লাহর সৃষ্টির জীবন নিয়ে নিতে চাওয়ার মতো মস্ত বড় পাপ করবে না। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ এবং এটাই শিক্ষা!

———————-

ডাক্তার ১ ঘন্টা পর বেরিয়ে আসেন। রিমি আর পাভেলের মা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে ডাক্তারের কেবিনে যায়। চশমা টা খুলে টেবিলের উপর রেখে উনি বসলো। দুজন ই নিজেদের পরিচয় দিলো। কান্না করায় উনার সামনে থাকা দুজন ব্যক্তির ই চোখ মুখ লাল ও ফুলে আছে। মা ব্যাকুল হয়ে বললো,

‘ডাক্তার আমার ছেলে ঠিক আছে তো? খারাপ কিছু হবে না তো ওর?’

‘দেখুন আপনারা নিজেদের সামলান।’

‘তার মানে কি খারাপ কিছু ডাক্তার? প্লিজ চুপ করে থাকবেন না বলুন আমাদের!’

‘দেখুন এক্সিডেন্ট এর ফলে উনার পায়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে। উনার দুই পায়ে ফ্রাকচার ধরা পড়ে। ফ্রাকচার হচ্ছে হাড়ের একটি অব্যাহত ধারাবাহিকতা এবং এর ধরণ এবং পরিমান অনুযায়ী একে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এখন…

‘এখন কি?’

দুই জোড়া চোখ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে ডাক্তারের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। ডাক্তার কিছুক্ষণ থেমে বললেন,

‘ফ্রাকচার এর যথাযথ উন্নত চিকিৎসা এই খানে নেই। এবং কি দেশের বাহিরে গিয়েও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয়। তাছাড়া এতে প্রায় কয়েক লাখ টাকার প্রয়োজন। টাকা খরচ ও শেষে বিফলে যাবে!’

‘তার মানে?’

ডাক্তার এবার সোজাসাপ্টা বললেন,

‘পেশেন্টের দুই পা হাটুর সামান্য উপর পর্যন্ত কেটে ফেলতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই!’

চলবে________________