#স্মৃতির_আড়ালে
#৪র্থ_পর্ব
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আমাকে জেলে রাখা হলো বেশ কয়েকটা দিন। এই সময় আমি বুঝতে পারলাম নিহানের কাছে আমি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। আসলেই ছেলেটার জীবনে আমি অনেক বিশাল একটা যায়গা জুড়ে আছি। যার বিশালতা হয়তো খুব সহজে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমার জন্য এদিক থেকে ওদিক ছোটাছুটি করে ও আমাকে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্য সবরকম চেষ্টা করতে লাগল।
আজ আমাকে কোর্টে নেওয়া হলো। আমার পক্ষে একজন উকিল ঠিক করেছে নিহান। অপরদিকে আমার বিপক্ষেও একজন উকিল আছেন।
বিচারকার্য শুরু হলো। বিপক্ষের উকিল প্রশ্ন করার সুযোগ পেতেই আমাকে নিজের কথার জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। আমিও সচেতন ভাবেই উত্তর দিতে লাগলাম। এরইমধ্যে তিনি মনগড়া ভিত্তিহীন কাহিনি বলতে শুরু করে দিলেন। তিনি বললেন,“আপনি মিস্টার আকাশ মির্জার জীবনে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই এর কারণ ছিল তার অর্থ প্রতিপত্তি তাই নয় কি? আর এজন্য আপনি ওনাকে নানাভাবে সিডিউস করতে লাগলেন। আপনার মতো একজন লাস্যময়ী নারীর থেকে ইঙ্গিত পেলে মহাপুরুষ বাদে কোন ছেলেই চুপ থাকতে পারবে না। আকাশ মির্জাও পারে নি। আপনার মতো চরিত্রহীন নারী যা পারেন তাই করলেন। নিজের শরীর বিলিয়ে..”
ওনার কথা শুনে চিৎকার করে উঠল নিহান। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“ওর নামে আর একটাও বাজে কথা বলবেন না। এখানে একটা কেইসের বিচার কাজ চলছে। কারো ক্যারেক্টর নিয়ে নয়।”
বিচারক নিহানকে বসতে বললেন এবং বিপরীত পক্ষের উকিলকেও এমন কথা বলতে নিষেধ করলেন। তবুও উনি দমলেন না। বলতে লাগলেন,“আকাশ মির্জাকে সিডিউস করে বিয়ে করার পর অমিতা আপনার জীবনে সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। তাই আপনি ওনাকে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাই তো রাতে যখন উনি ঘুমিয়ে যান তখন আপনি ওনাকে বালিশ চা*পা দিয়ে হ*ত্যা করেন।”
আমি বললাম,“এসব সত্য নয়। অমিতাকে আমি মা*রিনি।”
“কোন অপরাধীই নিজের অপরাধ নিজের মুখে স্বীকার করে নেয় না। তবে আমার কাছে প্রমাণ আছে যে খু*ন আপনিই করেছেন।”
বলেই তিনি তার সহকর্মীকে ইশারা করেন৷ তার সহকর্মী একটি ফরেনসিক রিপোর্ট এনে বিচারককে দেখান। তারপর আমার বিপরীত পক্ষের উকিল আলমগীর ইসলাম বলেন,“এই ফরেনসিক রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট যে মিসেস অমিতাকে শ্বাসরোধ করে হ*ত্যা করা হয়েছে। সাথে সাথে আপনি এর সাথে সংযুক্ত ফিংগারফ্রিন্ট রিপোর্ট টাও দেখে নিতে পারেন৷ মিস অমিতার লা*শের পাশে যেই বালিশটা পাওয়া গেছে সেখানে মিসেস আহ্নিকার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। যা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে খু*নি উনি নিজেই।”
আমি সূক্ষচোখে খেয়াল করলাম আকাশ মির্জা ও শেফালি মির্জার দিকে। তাদের দুজনের চোখই চকচক করছে। মুখে লেগে আছে হাসির রেখা। তাদের শয়তানী বেশ বুঝলাম আমি। ওনারাই যে অমিতার খু*নি এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু আমি এই কেসে বাজেভাবে ফেঁসে যাচ্ছি। আমার পক্ষের উকিল রফিকুল ইসলাম বলেন,“এই ফরেনসিক রিপোর্ট বা ফিংগারফ্রিন্ট রিপোর্ট থেকেই কিছু প্রমাণিত হয়না। এমনও তো হতে পারে অন্য কেউ ওনাকে খু-* করার পর কৌশলে এই বালিশে ফিংগারফ্রিন্ট নিয়ে সেটা লা** শ এর পাশে রেখে এসেছে।”
রফিকুল ইসলাম এর কথা শুনেই আমার মনে পড়ল যখন আমি আর আকাশ মির্জা ঘনিষ্ঠ হতে যাচ্ছিলাম তখন আমি একটি বালিশ খামচে ধরেছিলাম। তাই সেখানেও আমার ফিংগারফ্রিন্ট পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আমার কাছে ধীরে ধীরে এবার সব পরিস্কার হতে লাগল। সেদিন কেন আকাশ মির্জা বলেছিলেন অমিতা উচিৎ শিক্ষা পাবে, কেন সেদিন তারা দুজনে আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিলো সব এবার আমার কাছে জলের মতো পরিস্কার। নিজের পক্ষে প্রমাণ পেতেই আমি বলে উঠলাম,“মাননীয় আদালত, ফরেনসিক রিপোর্টে নিশ্চয়ই রোগীর মৃ*ত্যুর সময়ও বলা আছে।”
বিচারক সম্মতি জানালেন। আমি মৃদু হেসে প্রশ্ন করলাম,“সময়টা জানতে পারি?”
“২৮ অক্টোবর রাত ১২ টায়।”
আমি বুঝলাম অমিতা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পরই অমিতাকে খু* ন করা হয়েছে। রফিকুল ইসলাম বললেন,“এত তাড়াতাড়ি আমার মক্কেলকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। আগে এই বিষয় নিয়ে আরো অনেক তদন্তের প্রয়োজন।”
বিচারক আজকের মতো এখানেই বিচারকার্য শেষ করলেন। পরবর্তী শুনানি ঠিক হলো ৫ দিন পর।
——-
সেদিন কারাগারে নিহান আমার সাথে দেখা করতে এলো। নিহানের সাথে আমি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করলাম। আমি ওকে জানালাম,“আমার মনে হয়, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ওরা অমিতাকে খু//*ন করে।”
নিহান আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,“তুই কোন চিন্তা করিস না আহ্নিকা। আমি যে করেই হোক তোকে নির্দোষ প্রমাণ করবোই।”
ভরসা পেলাম আমি। নিহানের উপর যে অনেক ভরসা করি আমি।
এরপর ৩ দিন নিহানের কোন খোঁজই পেলাম না। ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্নতা বাড়ল বৈ কমল না। ৩ দিন পর হঠাৎ করে নিহানের মা নূর মির্জা আমার সাথে দেখা করতে এলেন। ওনার আরো একটা পরিচয় হলো উনি আকাশ মির্জার বাবা আজিজুল মির্জার চাচাতো বোন তথা তার সন্তানের মা। যতদূর জানি বিয়ের আগে ওনাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শেফালি মির্জার সাথে বিয়ের পরেও নাকি সেই অবৈধ সম্পর্ক চলতে থাকে।
নূর মির্জা প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে নিজের সন্তানের পিতৃ পরিচয় দাবি করেন সবার সামনে। তখন তাকে মির্জা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তারপর তিনি একাই নিহানকে বড় করে তোলেন।
নূর মির্জা আমায় বললেন,“তোমাকে কিছু জরুরি কথা বলার আছে। জানো তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ আমার ছেলেটা বিপদে পড়ে গেছে। ওরা ওকে বন্দি করে রেখেছে। বলেছে যদি তুমি আদালতে তুমি এই খু/ নের দায় স্বীকার করে না নেও তাহলে আমার ছেলেটাকে…আমি একজন মা হয়ে তোমার কাছে আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা চাচ্ছি আহ্নিকা। এই মায়ের অনুরোধ তুমি রাখো। তাছাড়া এটাও ভেবে দেখো নিহান তোমার জন্য কি কি করেছে। তোমার কি উচিৎ নয় ওকে সাহায্য করা? ও যাতে বাঁচতে পারে সেই ব্যবস্থা করা?”
—-
আমি মানুষটা যেমনই হই বিবেকহীন নই। নিহান আমার জন্য অনেক করেছে। আজ আমি ওর সব উপকারের প্রতিদান দিলাম। আদালতে সবার সামনে যেই অন্যায়টা করিনি তা স্বীকার করে নিলাম। দিলাম সেই মিথ্যা জবানবন্দি যে,“আমিই অমিতাকে বালিশ চা*পা দিয়ে খু* ন করেছি। কারণ আমি ওকে আকাশ মির্জার জীবন থেকে যেতে বললে ও রাজি হয়না। যাতে আমার স্বার্থে আঘাত লাগে।”
আদালত আমার মৃত্যু**দণ্ডের শাস্তি ধার্য করে। আমার চোখে জল চলে এলো।
To be continue…