স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৮

0
462

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

৮.

সে রাতে শিমুল বা তুলি কেউই ঘুমাতে পারেনি। পরদিন সকালে আদিব, রাদিব এবং নাতাশা ঘুম থেকে জাগার পর শিমুল তুলিসহ সবাই শিমুলদের বাড়িতে ফিরে যায়।

সে রাতের ঘটনার পর থেকে তুলি নিজেকে শিমুলের কাছ থেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছে। বাকি সবার সাথে যেরকম আচরণ করছে শিমুলের সাথেও ঠিক সেরকমই কিন্তু পরিমাণে অল্প।

দেখতে দেখতে নাতাশার হলুদের দিন চলে এলো। সকাল দশটায় বাড়ির গেটের কাছে একটি সিএনজি এসে থামলো।সিএনজি থেকে নেমে এলো তুলির বড়ো বোন কণা আর ওর স্বামী সুমন।

এতক্ষণ ছাঁদে দাঁড়িয়ে ছিল শিমুল কিন্তু যখন দেখতে পেলো কণা আর ওর স্বামী এসেছে ঠিক তখনি ছাঁদ থেকে নেমে গেলো।

কণা আর সুমন বাড়িতে প্রবেশ করে পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। বাড়ির গুরুজনেরা সুমনের ব্যবহার দেখে অনেক খুশি। ড্রইংরুমের এককোণায় দাঁড়িয়ে আছে তুলি।কারণ, ও সুমনের সামনে পরতে চায় না। তুলি যখন নিজের গাঁ বাঁচানোর জন্য সুমনের সামনে যাচ্ছে না ঠিক তখনি শিমুল এসে তুলির হাত ধরে ড্রইংরুমে বসে থাকা কণার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

শিমুলকে দেখে কণা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,

-কি রে কেমন আছিস?

-ভালো আছি তোর কি অবস্থা?

-আছি ভালো তোর এখনও এই অভ্যাসটা গেলো না।

শিমুলের হাতের মুঠোয় রাখা তুলির হাতের দিকে তাকিয়ে কথাটি বললো কণা।

-তোর ও তো স্বভাবটা গেলো না আমি কি করি না করি সেখানে তোর কথা বলতেই হবে।

শিমুলের এমন উত্তর শুনে কণা জোর করে মুচকি হেঁসে উঠলো। শিমুল তুলির হাত ধরে সোফায় পাশাপাশি বসে পড়লো। তুলি সুমনের মুখোমুখি বসায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। সুমনের লোলুভ দৃষ্টি তুলির পুরো শরীরে বিচরণ করছে। শিমুল বুঝলো কি না জানা গেলো না কিন্তু শিমুল ফের কণাকে প্রশ্ন করলো,

-তুলির সাথে তোর কি এমন হয়েছিল যার কারণে তুই ওর হাতের আঙ্গুল কেটে নিয়েছিস?

-ওহ্, আমার নামে বিচার দেয়া হয়ে গেছে!আঙ্গুল কেটেছি বেশ করেছি ও কেন তোর দেয়া আংটি পড়বে?তুই কি ওর প্রেমিক নাকি স্বামী?

তুলির দিকে কথাটি বললো কণা। কণার কথা শুনে শিমুলের কপালের শিরা ফুলে উঠেছে।

-তুলি আমার কি হয় সেটা পরে জানবি তার আগে এটা বল তুলির সাথে এরকম একটা কাজ তুই কিভাবে করলি তোর হাত কাঁপলো না?

-না হাত কাঁপেনি। কারণ তুলির জন্য আমার মা’কে তোর নানীর কাছে অপমানিত হতে হয়েছে।

-মামীকে নানীর জন্য অপমানিত হতে হয়েছে মানে?নানী, নানী?

শিমুলের ডাক শুনে হালিমা বেগম ঘর থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

-কি রে ডাকছ ক্যান,শিমুল?

-কণা কি বলছে?তুলির জন্য না-কি তুমি বড়ো মামীকে অপমান করেছো আর এই জন্যই নাকি কণা তুলির এতবড়ো একটা ক্ষতি করেছে ?তুলি কি করেছে?

শিমুলের জোর গলায় কথা শুনতে পেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো শিউলি,নিলুফা এবং তুলির ছোট চাচী।

-আমি বড়ো বৌমা’রে অপমান করমু ক্যান?আমি তো খালি ওরে বুঝাইছি যে, তুলিরে যেন তোর থেইক্যা দূরে রাখে। এই কথা হুইন্না এই কালনাগিনী ওর বইনডার আঙ্গুল কাইট্টা হালায় দিছে।

হালিমা বেগমের কথা শুনে কণা ফুঁসে ওঠেছে। শিউলি এসে উনার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

-মা,তুমি কেন বলেছো তুলি শিমুলের কাছ থেকে দূরে থাকবে?

-কারণ, তোর পোলায় তুলিরে ভালোবাসে। ওর মতো মাইয়ারে আমার নাতী ভালোবাসবো ক্যান? বাপ নাই ভাই নাই শাদীর পর আমার নাতি শ্বশুরবাড়ির আদর পাইবো?এহন তো এই মাইয়া বিয়ের রাতে জামাইরে খাইয়া বইয়া রইছে। দেখছোস আমি বারণ করছি দেইখ্যা নয়তো আমার নাতিডারে খাইয়া ফেলাইতো এই পোড়াকপালি।

-মা, কি বলছো তুমি এইসব!ভাইয়া আমাদের কি না করে দিয়েছে?তোমার ছোট ছেলেকে চাকরির টাকা দিয়েছে। আমার শিমুলের চাকরির জন্য যত টাকা লেগেছে সবই তো বড়ো ভাইয়া দিয়েছে। আর তুমি কি-না বলছো আমার শিমুল শ্বশুর বাড়ির আদর পাবে না। তুলি না তোমার বড়ো ছেলের মেয়ে ওকে নিয়ে কিভাবে তোমরা এতটা অন্যায় করতে পারো? আমার শিমুল যদি তুলিকে ভালোবাসে এরচেয়ে খুশির সংবাদ আর কি বা হতে পারে। আমি তো খুশি খুশি তুলিকে আমার শিমুলের বৌ হিসেবে মেনে নিব।

শিউলির কথা শুনে উপস্থিত সকলেই লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলেছে।

-মামী, আপনার বড়ো মেয়ে আপনার ছোট মেয়ের আঙ্গুল কেটে দিয়েছে আর আপনি কিনা সবার কাছ থেকে গোপন করেছেন, কিন্তু কেন?

নিলুফা বেগম চোখের পানি মুছে শিমুলকে বললেন,

-তখন কণার বিয়ে ঠিক হয়েছে এমনসময় যদি ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ওর নিষ্ঠুরতার খবর জানতো তবে ওর বিয়ে ভেঙে যেতো। তাই বুকে পাথর চেপে সবার কাছ থেকে এই ঘটনা গোপন রেখেছি। তুমি ছাড়া সবাই জানতো যে তুলির আঙ্গুল এক্সিডেন্টে কাটা গিয়েছে। ইশফাক তো এইসব কিছু জেনে তুলিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে কেন ইশফাক তোমায় কিছু বলেনি?

-হয়তো নিজের হবু স্ত্রীর কমতি নিয়ে কারো সামনে আলোচনা করতে চায়নি।

শিমুল কথাটি বলে কণার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো এরপর, সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-বাবা আর মা তোমরা চাইতে না আমি বিয়ে করি। আজ বলছি আমি তুলিকে বিয়ে করতে চাই তোমাদের অনুমতি নিয়ে। আমাকে বিয়ে করবি তো তুলি?

শিমুলের কাছ থেকে হুট করে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে তুলি কিছু বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে।
শিমুলের কাছ থেকে এমন সংবাদ শুনে শিমুলের বাবা-মা খুশি হয়ে গেলেন। কণা আর হালিমা বেগমের মুখে আকাশের কালো মেঘ দেখা দিয়েছে।

-আমি শিমুল ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারব না। আমি উনার যোগ্য না, কি আছে আমার? লেখাপড়া খুব বেশি নেই, হাতের আঙ্গুল নেই, তাছাড়া,সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আমি বিধবা। আমি শিমুল ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারব না।

কথাটি বলে একদৌঁড় উপরের ঘরে চলে যায় তুলি। শিমুলসহ উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তুলির যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে।

-এখন কি হবে শিমুল তুলি তো রাজি হবে না? চিন্তিত ভঙ্গিতে কথাটি বললেন শিউলি।

-আমি জানি কি করে তুলিকে রাজি করাতে হবে.তোমরা কাজিকে কল করো আজই তুলির সাথে আমার বিয়ে হবে।

কথাটি বলে শিমুল সিঁড়ি বেয়ে তুলির পিছু পিছু চলে গেলো।

তুলি নাতাশার ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে এমন সময় শিমুল এই ঘরে এসে দরজার খিল এঁটে দিলো।তুলি ব্যাগ গুছানো বাদ দিয়ে শিমুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

-তোমাকে আমি কি বলেছি তুমি শুনতে পাওনি, শিমুল ভাইয়া? আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।

-কেন আমার মধ্যে খারাপ কি আছে?

-তোমার মধ্যে খারাপ কিছুই নেই কিন্তু আমি তোমাকে যতবার দেখি ঠিক ততবার মনে পড়ে যায় শুধুমাত্র তোমার কারণে ইশফাক মারা গেছে। যদি তুমি একটিবার আমার কল ধরতে তাহলে ইশফাক হয়তো বেঁচে থাকতো আর আমি সমাজের কাছ থেকে এতটা লাঞ্চনা পেতাম না।

-আমার কারণে ইশফাক কেন মারা যাবে?হ্যা আমি মানছি সেদিন আমি তোর কল রিসিভ করতে পারিনি। কিন্তু, আমি যদি তোর কল রিসিভ করতাম তবুও আমি ইশফাককে রক্ত দিতে পারতাম না কারণ আমি যশোর ছিলাম আর তোরা চট্টগ্রামে। এতদূর থেকে রওনা হলেও আমি সঠিক সময়ে পৌঁছেতে পারতাম না। ইশফাক আমার বন্ধু ছিল। আমিও মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছি কিন্তু তাই বলে ওর মৃত্যুর জন্য তুই আমাকে দায়ী করতে পারিস না তুলি।

-আমি কিছু জানতে চাই না শুধু এটা জানি আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।

-তুই যদি আমাকে না করিস তবে আমি আমার লাইসেন্স করা পিস্তলের দুটো গুলি নিজের মাথায় চালিয়ে সুইসাইড করবো,তুলি।

শিমুলের মুখ থেকে সুইসাইডের কথা শুনে তুলি শিমুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো শিমুল ওর পকেট থেকে পিস্তল বের করে নিজের কপালে একপাশে ঠেকিয়ে তুলিকে কথাগুলো বলে।

-তুমি উল্টাপাল্টা কিছু করবে না।

-আমি করব। কারণ, তোরা কেউই আমার মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করিস না।এখন তুই বল তুই কি করবি? আমি তোর কাছে কিছুই চাই না তুই শুধু নামেমাত্র আমার স্ত্রী হয়ে থাকিস তুলি। তুই যদি আজ আমায় ফিরিয়ে দিস তবে আমি সত্যি সত্যি সুইসাইড করবো।

তুলি জানে শিমুল যেহেতু বলেছে তার মানে ও এই কাজটা করবে। ওর একটা না হয়তো শিমুলের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তুলি নিরুপায় হয়ে শিমুলকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো।
সেদিন দুপুর বারোটা নাগাদ তুলির সাথে শিমুলের বিয়ে হয়ে যায় পরিবারের সকলের উপস্থিতিতে।

সন্ধ্যায় নাতাশার হলুদের অনুষ্ঠান নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত ঠিক তখনি নাতাশা এসে জানায় তুলি ওর ঘরে নেই। শিমুল একদৌঁড়ে নাতাশার ঘরে গিয়ে দেখে তুলি সেখানে নেই। শিমুল ধীরপায়ে খাটের উপরে গিয়ে বসলো, এমনসময় শিমুলের মোবাইলে একটি মেসেজ এলো।শিমুল ঝাপসা নয়নে মোবাইলের স্ক্রীণে তাকিয়ে দেখলো,

“তুমি বলেছিলে না তোমার নামেমাত্র স্ত্রীর দরকার। এই দেখো আমি তোমার নামে মাত্র স্ত্রী হয়ে চলে এলাম বহুদূরে। কখনো আমাকে খুঁজে পাবে না। ভালো থেকো আর ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও কারণ আমি কখনো তোমার কাছে ফিরে আসব না”

#চলবে।