সৎ মা পর্ব-২৩+২৪

0
359

#সৎ_মা
#পর্বঃ২৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছি এ বাড়িতে। গেইটে প্রবেশ করা মাত্রই আমার সারা শরীরের শক্তি যেন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকলো। পরিচিত অপরিচিত অনেক মুখ। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম ড্রয়িং রুমে মায়ের নিথর প্রাণহীন দেহটা সাদা কাফনের কাপড়ে আবৃত। হাত পা আমার অসার হয়ে এলো।যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। এলোমেলো পায়ে হেঁটে বাবার সামনে গেলাম। বাবা মূর্তির ন্যায় মায়ের লা’শ’টা’র দিকে তাকিয়ে আছে। বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। বাবা শব্দ পেয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখে মুখে একরাশ অসহায়ত্ব। বাবা নির্লিপ্ত কণ্ঠে আমাকে বললেন,

“তোর মা যে আমাকে একা ফেলে চলে গেলো। দেখনা কিভাবে শুয়ে আছে। শেষ বার যখন নিজেকে অসহায় মনে করেছিলাম তোর মাকে হারিয়ে। আজ আমি আবারও অসহায় হয়ে গেলাম। নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম আমি। সবাই আমাকে একা করে কেন চলে যায় বলতো? আমি কি এতো বড় পাপী?”

বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে। অবাধ্য চোখের পানি কেমন গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বাবার বুকে মাথা রেখে বললাম,

“বিশ্বাস করো বাবা আমি মায়ের এমন পরিণতি কখনো চাইনি। আমি সব সময় দোয়া করেছি মা যেন আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।আবার আগের মতো বকাবকি করুক। সম্পর্ক টা যখন একটু একটু করে ঠিক হচ্ছিলো মা কেন ফেলে চলে গেলো বাবা?”

সোফায় পাপেটের ন্যায় বসে আছে ইরফান।কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই ওর। ইরফানকে দেখে মনে হচ্ছে হাতে গড়া কোনো মূর্তি। পাশে হাবিবা বসে আছে। বাবার বুক থেকে মাথা তুলে পা বাড়াতে ইকরা “ও আম্মুগো” বলেই মায়ের কাফনে মোড়ানো লা’শ’টা’র কাছ এসেই হুমড়ি খেয়ে পড়লো।মায়ের নিস্তেজ মুখখানা দেখেই মূর্ছা গেলো ইকরা। বোনটা যে আমার বড্ড আবেগী আর দূর্বল চিত্তের। নিজের ভেতরের সকল কষ্টকে দূরে ঠেলে তড়িৎ গতিতে আগলে নিলাম বুকে। ওর জা মেঝেতে বসেই বললেন,

“আবারও জ্ঞান হারিয়েছে? খবরটা শুনার পর থেকেই একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে পানি আনছি।”

বার কয়েক চোখে মুখে পানির ছিটে দিতেই চোখ মেলে তাকালো। চোখ খুলে আমাকে দেখেই শক্ত করে ঝাপটে ধরলো। বুকে মুখ গুঁজেই বলল,

“মা আমাদের সারাজীবনের মতো ফেলে চলে গেলো আপু। আমার মাকে এনে দে না আপু আমার মাকে এনে দে।আর কিচ্ছু চাই না আমি। যখন মালাকুল মউত আমার মায়ের জান কবজ করছিলো তখন নিশ্চয়ই মায়ের কষ্ট হচ্ছিলো? ও আপু মাকে এনে দে না। আমি কাকে মা বলে ডাকবো আপু?”

অনুভব করলাম কেউ একজন এসে আমার কাঁধে মাথা রাখলো।আঁড়চোখে দেখি ইরফান। আরজার বাবাকে ডেকে বললাম,

“আরজার আব্বু, আপনি আর ফাইয়াদ প্লিজ বাবার কাছে যান। আমার বাবা ওখানে একা।”

____________________________________________

মাকে শেষ গোসল দেওয়া হয়েছে। পুরুষরা এখনই খাটিয়া নিয়ে যাবে জানাজার জন্য। ড্রয়িং রুমের মেঝেতে উন্মাদের মতো বসে আছি। ইকরা ইকরার জায়ের বুকে মাথা রেখে বিরবির করে যাচ্ছে। খানিক বাদেই আরজার আব্বু এসে বলল,

“ইনসিয়া আর ইকরা মাকে এখনি নিয়ে যাওয়া হবে। জানাজার সময় হয়ে এসেছে। বিদ্যুতের গতিতে বসা থেকে উঠে বাইরে গেলাম। আরজার আব্বুর হাতটা ধরে বললাম,

” আরজার আব্বু, আমি শেষবারের মতো মায়ের কপালে একটা চুমু দেই?”

ইকরা পিছন থেকে বললো,

“ভাইয়া আমিও আমার মাকে শেষবারের মতো একটা চুমু দিবো।”

উনি আমাদের দু’জনের দিকে অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর সবাইকে বললেন,

“আপনারা পুরুষ মানুষরা দয়া করে একটু দূরে যান।”

মায়ের খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি ধপ করে সেখানেই বসে পড়লাম। ইকরা “মা” বলে চিৎকার করে কাঁদছে। ইকরার চিৎকারে ভারি হয়ে আসছে চারপাশের পরিবেশ। খেয়াল করলাম আমার চারপাশ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগলো।লুটিয়ে পড়লাম সেখানেই।

____________________________________________

চোখ মেলে দেখি আরজা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ইকরা আমার হাতে কপাল ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে চলেছে। অশ্রুসিক্ত হলো আমার চোখ। আধশোয়া হয়ে বসতেই ইকরা আমার পেটে মুখ গুঁজলো। নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম। আরজা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

“কান্না কলে না আম্মু। তুমি আল খালামনি না আমাকে আম্মু বলো। তাহলে কাঁদো কেন?”

কান্নার মাত্রা যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো।

ড্রয়িংরুমে বসে আছেন সবাই। ইকরা আমার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। অন্যপাশে আরজা চুপটি করে বসে আছে। যারা যারা আছেন সবাই যে যার মতো করে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের। দাফনকাজ শেষ করে পুরুষরা এক এক করে বাড়িতে আসছেন। ইরফান ড্রয়িং রুমে এসেই আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো। আমার কোলে মাথা রাখলো ওর। মিনিট পাঁচেক ওভাবেই থাকার পর মাথা তুলে তাকালো। চোখ দুইটা টকটকে লাল। এখনি ভারি বর্ষন হবে। নিজের হাতের দিকে ইশারা করে বললো,

“জানিস আপু, এই দুইটা হাতে আমি মাকে ওই সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে রেখে এসেছি। আমার অবস্থাটা বোঝ আপু। আমি সারাজীবনের মতো ওই অন্ধকার ক’ব’রে রেখে এসেছি মাকে। ইচ্ছে করছিলো মায়ের সাথে আমিও থেকে যাই। আমি আমার কলিজাটা সেখানে রেখে আসছি আপু। আমি আর কাকে মা ডাকবো আপু? আর যে চাইলেও মায়ের মুখটা দেখতে পারবো না। মায়ের কাছে আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসবো না। বাড়িটা যে প্রাণহীন হয়ে গেলো আপু। জানিস আপু দুইদিন আগে আমাকে ডেকে নিয়ে মা কি বললো? বলে,

” তোরা তোদের বড়বোনের অবাধ্য কখনো হবি না। আমি মারা গেলে মনে ওই তোদের আরেক মা। বিপদে সবাই তোদের ছেড়ে গেলেও ইনসিয়া কখনো যাবে না। ওর কথার অবাধ্য আর ওর সাথে কখনো বেইমানি করবি না।”

“আপু, মা নিশ্চয়ই বুঝেছিলো মা আর বাঁচবে না তাই না? এখন থেকে মাকে ছাড়াই আমাদের বাঁচতে হবে তাই না রে, আপু? বাস্তবতা এতো কঠিন কেন আপু? এই নির্মম সত্য গুলো মানতে এতো কষ্ট কেন হয়?”

বাবা সামনে এসে দাঁড়ালেন আমাদের। চোখে বিষন্নতা আর ক্লান্তি৷ যেন এতো বছরের ক্লান্তি আজ জেঁকে বসেছে। চোখ মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। বাবাকে দেখা মাত্র তিন ভাইবোন বাবাকে একসাথে জড়িয়ে ধরলাম। নিরবে কেঁদে চলেছি আমরা। বাবা আমাদের সবাইকে আগলে ধরে বললেন,

“এই বুড়ো মানুষটার সকল সাহস আর শক্তি যে তোরা তিন ভাইবোন। এখন তোরাই যদি এভাবে ভেঙে পড়িস আমি নিজেকে সামলাবো কি করে?”

মা বাবার কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনলেন আমাকে। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

“ওরা তো তোর থেকে ছোট। তুই বড় হয়ে এমন করলে ওদেরকে কে সামলাবে বল। ওরা তো তোর কাছে এসে আশ্রয় চাইবে। মারে আশ্রয়স্থলকে শক্তপোক্ত হতে হয়। সে নিজেই যদি ভেঙে পড়ে তো হয়?”

____________________________________________

পরিচিত অপরিচিত মোটামুটি সবাই সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চলে গেছে। বাড়িতে শুধু তিন ভাইবোনের শ্বশুর বাড়ির লোক। উনারাও রাত পোহালে চলে যাবে।

রাত বাড়ার সাথে সাথে মা আমাদের দু’বোনের কাছে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“এভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকলে কি তোদের মা ফিরে আসবে? আসবে না তো। সারাদিনে তো পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। আয় কিছু একটা খেয়ে নিবি।”

মায়ের হাতটা ধরে বললাম,

“আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না মা। নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আপনি প্লিজ সবকিছু সামলে নেন না।”

“আমিও খাবো না আন্টি।” মাকে উদ্দেশ্য করে ইকরা বললো।

মা প্রস্থান করার সাথে সাথে ফাইয়াদ এসে দাঁড়ালো দরজায়। ইকরার চোখে চোখ পড়তেই ইকরা বললো,

“আজকের রাতটা আমি আপুর সাথে থাকি প্লিজ?”

তপ্ত শ্বাস ফেললো ফাইয়াদ। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওকে বললাম, যেন আরজার বাবাকে এখানে আসতে বলে। মিনিটের মাথায় আরজার বাবা এসে হাজির হলো। উনাকে বললাম,

“আমি আর ইকরা আজকের রাতটা একসাথে থাকবো। আপনি কি বাবার সাথে থাকবেন? বাবা কিন্তু হুট করে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।”

উনি মাথা নেড়ে চলে গেলেন।

____________________________________________

মায়ের মৃ’ত্যু’র বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখনো মৃ’ত্যু’র শোক রয়ে গিয়েছে। কোথাও আনন্দ নেই। সবকিছুতেই নিস্তব্ধতা। মায়ের হুইলচেয়ারটা আছে অথচ মা নেই। কি অদ্ভুত নিয়ম। মায়ের মৃ’ত্যু শোক কাটিয়ে উঠতে পারলাম না এর মধ্যেই নতুন ঝড়ের আগমন ঘটলো।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ২৪
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

সারারাত জ্বালিয়ে এখন আরজা ঘুমোচ্ছে। মা উনার রুমে বসে তজবি পড়ছেন। আরজার আব্বু সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। আজ শুক্রবার বিধেয় আরজার আব্বু বাসায়ই আছেন। রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছি আর মায়ের কথা ভাবছি। আজ কতদিন হয়ে গেলো মা নেই। বাহ্যিক দৃষ্টিতে সবাই স্বাভাবিক থাকলে ভেতর ভেতর মায়ের জন্য হাহাকার আর মায়ের শূন্যতা। যে যায় সে আর ফিরে আসে না দুনিয়ায়। দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো এটা। তপ্ত শ্বাস ফেলে ডিম পোঁচের জন্য ডিমটা কড়াইয়ে দিতেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। আরজার বাবাকে ডেকে বললাম,

“আরজার আব্বু দেখেন তো সাঝঁ-সকালে কে এলো। আমি কড়াইয়ে ডিম দিয়েছি।ওদিকে গেলে ডিমটা পুড়ে যাবে।”

ড্রয়িংরুম থেকে আরজার বাবার গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনা গেল,

“ইনসিয়া গুরুত্বপূর্ণ একটা নিউজ পড়ছি। বিরক্ত করো না প্লিজ। তুমিই কষ্ট করে এসে দেখে যাও কে এসেছে।”

অগত্যা চুলোর আঁচটা কমিয়ে আমিই অগ্রসর হলাম দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখতে পেলাম একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করার পর জিজ্ঞেস করলাম,

“জ্বি আপনাকে তো চিনলাম না।কাকে চাই?”

মহিলা চোখ মুখ শক্ত করে গম্ভীর গলায় বললেন,

“আপনি আমাকে চিনবেন না। সোলাইমানকে ডাকুন সে আমাকে দেখলেই চিনবে।”

আরজার বাবার নাম এই মহিলার মুখে চোখ মুখ কুঁচকে এলো আমার। ঘাড় বাঁকিয়ে আরজার বাবাকে বললাম,

“আরজার আব্বু, আপনার সাথে কে যেন দেখা করতে এসেছে। এদিকে আসুন তো।”

উনি বিরক্তিতে “চ” উচ্চারণ করলেন।খবরের কাগজ ভাজ করে বললেন,

“এই সাঝঁ সকালে আমার সাথে কে দেখা করতে আসবে?”

বলেই এগিয়ে এলেন দরজার দিকে। দরজার বাহিরে ওই মহিলাকে দেখেই চিৎকার করে বললেন,

“তুমি? তুমি এখানে কি করছো? আর আমার ঠিকানা পেলে কোথায়?”

হুট করে আরজার বাবার এমন চিৎকার শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। উনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“আরজার আব্বু কে এই মহিলা?”

উনি চোখ মুখ শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

“রিংকি।”

নামটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র দু’কদম পিছিয়ে গেলাম আমি। কানে শুধু এই নামটাই বাজতে লাগলো।৷ আমার মাথা কেমন ভঁনভঁন করতে লাগলো। এই মহিলা নিশ্চয়ই আমার আরজারকে নিতে এসেছে। না হলে এতো বছর পরে ঠিকানা বের করে আসবে কেন?

“ইনসিয়া চুলোয় কি বসিয়েছিস? পোড়া গন্ধ আসছে।” রুম থেকে মায়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলেও আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আরজার বাবা দ্রুত গিয়ে চুলা বন্ধ করলেন। চুলা বন্ধ করে আবার দ্রুত ফিরে এলেন। তারপর ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি চাই এখানে তোমার? কেন এসেছো এখানে?”

দরজার ওইপাশ থেকে মহিলা জবাব দিলো,

“আমার সন্তান এখানে। সে আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন। আমি তার কাছে এসেছি। তাকে নিয়ে যাবো বলে।”

সাশ্রু নয়নে আরজার বাবার হাত খাঁমচে ধরে বললাম,

“এই মহিলাকে এখান থেকে যেতে বলেন আরজার আব্বু। আমি আমার মেয়েকে কখনো এই মহিলার কাছে দিবো না। এই মহিলাকে আমার মেয়ের কাছে আসতে দিবেন না।”

বলে যেই না দরজা বন্ধ করতে যাবো মহিলা তড়িৎ গতিতে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। আরজার বাবা উচ্চস্বরে মাকে ডাকতে লাগলেন। আরজার বাবার চিৎকারে মা হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। কিছু বলতে নিবে তখনই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটিকে দেখে মা বিস্মিত হলেন। রাগান্বিত স্বরে মা বললেন,

“এখানে কি করতে এসেছো।”

রিংকি ভাবলেশহীন ভাবে বললেন,

“আমি আমার মেয়েকে দেখতে এবং একেবারের জন্য নিয়ে যেতে এসেছি।”

“এতো সোজা? দেশে কি আইন বলে কিছু নেই?” গম্ভীর গলায় বললেন মা।

“আমি সেই আইনের সাহায্যে আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো।” সোফায় বসতে বসতে বললো রিংকি।

রিংকির উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মা আমাকে বললেন,

“বাড়িতে মেহমান এসেছে কোথায় আপ্যায়ন করবি তা না করে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছিস। যা অতিথি আপ্যায়ন কর।”

টলমলে চোখে মাকে বললাম,

“এই মহিলা আমার মেয়েকে নিয়ে যাবে মা।”

মা ধমকে বললেন, “তোকে যা বললাম তাই কর।”

____________________________________________

ড্রয়িংরুমে রিংকির মা-বাবা, ভাই-মা, আমার বাবা আর ইরফান, আরজা দাদি আর বাবা বসে আছেন। আরজা আমার কোলে একেবারে গুটি-শুটি হয়ে বসে আছে। পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। গলা খাঁকারি দিয়ে মা বললেন,

“ভাই সাহেব কয়েক বছর আগে আপনার মেয়ে আমাদের দুই পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলেছে। তখন আমার ছেলেকে অপরাধী মনে হলেও কিন্তু মেইন কার্লপ্রিট আপনার মেয়ে ছিলো। এতো বছরে নিশ্চয়ই সবকিছু খোলাসা হয়েছে।”

মায়ের কথা শুনে ভদ্রলোক মাথা নত করে ফেললেন। মা আবার দম নিয়ে বললেন,

“এমনকি চার দেয়ালের আড়ালে আপনার মেয়ে আমার নাতনিকে ভ্রূণ অবস্থায় শেষ করে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো সোলাইমানকে।তাহলে আজ কেন সেই সন্তানকে নিতে এসেছে। কোন মুখে এলো। আবার আইনের ভয় দেখায়? বাড়ি বয়ে এসে এভাবে হেনস্তা করার জন্য কিন্তু আপনার মেয়েকে পুলিশে দিতে বাধ্য হবো।”

লজ্জিত মুখশ্রী ভদ্রলোকের। কিন্তু মেয়ের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন উনি।

“আর কত অপমানিত আর অসম্মানিত করবে বলতে পারো? তোমাকে জন্ম দেওয়া কি আমার অপরাধ ছিলো? ওই নেশাখোরের পাল্লায় পড়ে নিজের জীবনটা একেবারে শেষ করলেই সাথে আমাদের জীবনটাকেও দূর্বিষহ করে তুলেছো। ওই ব’দ’মা’য়ে’শ এর হাত থেকে বাঁচাতে তোমাকে সোনার টুকরো ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম। যেন সবকিছু ভুলে সংসার করতে পারো। কিন্তু না তুমি কি করলে আবার সেই আগুনে ঝাপ দিলে। এখন কেন আবার এই সুন্দর সংসারে নজর দিচ্ছো। ওই নেশাখোর ছেলে তোমায় রোজ নেশা করে এসে গাঁয়ে হাত তু’লে। এটা কার দোষে? তোমার ভাগের সম্পত্তি দেওয়ার জন্য পায়ে পড়লে। সেটাও দিলাম আর কি চাও বলতে পারো? নেশাখোরকে ছেড়ে আবার আমার কাছে ফিরে এসেছো।সাদরে গ্রহণ করে নিলাম। সবটাই তুমি তোমার ইচ্ছেমতো করেছো এবং হয়েছেও। তাহলে এভাবে উনাদের কেন বিরক্ত করছো আর আমাকে অপমানিত করছো?”

রাগান্বিত গলায় ভদ্রলোকের ছেলে বললেন,

“তোমাকে সেদিন বলেছিলাম না একে মে’রে ফেলো। এই মেয়ে যতদিন বেঁ’চে থাকবে আমাদের সম্মান নিয়ে খেলবে। শান্তি মতো বাঁচতে দিবে না।”

সে তার বাবার পা ধরে বললো,

“বাবা আমি ভুল করে ফেলেছি আমাকে মাফ করে দাও। আমি আমার আগের সংসার আর মেয়েকে ফিরে পেতে চাই।”

ভদ্রলোক নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

“এই ভুলটা তোমার আরো আগে বোঝা উচিৎ ছিলো। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।”

ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে ইরফান বললো,

“আংকেল,,,,”

বাবা ইশারায় ইরফানকে চুপ থাকতে বললো। ইরফান বাবাকে আশস্ত করে উনাকে পুনশ্চ বললো,

“আংকেল আমার আপু শুধু আরজার মা হওয়ার জন্য সোলাইমান ভাইকে বিয়ে করেছে। এটার জন্য সমাজের নানা মানুষের নানা কথা শুনেছে। আপনি বিবেকবান মানুষ। আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। আপনার মেয়েকে বুঝান আংকেল।”

রিংকির ভাই একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

“আন্টি আর যদি কখনো আমার বোন আপনাদেরকে বিরক্ত করার জন্য আসে তাহলে আমাদেরকে আর খবর দিবেন না। ডিরেক্ট পুলিশের হাতে তুলে দিবেন।”

বলেই উঠে দাঁড়ালেন উনারা। ভদ্রলোক আমার কাছে এলেন। উনাকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই আরজা আমার সাথে একেবারে মিশে রইলো। আরজাকে কোলে নিতে চাইলেও নিতে পারলোনা । পরে উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“তোমার বাবার অনেক ভাগ্য মা। তোমার মতো মেয়ে জন্ম দিয়েছেন। আমার মতো পোড়া কপাল যেন কোনো পিতার না হয়।” বলেই সামনের দিকে উদ্যত হতেই আমি আরজাকে বললাম,

“আরজা উনি তোমার নানুভাই। ডাকো উনাকে।তুমি না আম্মুর সব কথা শুনো।”

আরজা ভীত-সন্ত্রস্ত গলায় ডাকলো,

“নানুবাই?”

ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরেই আরজাকে ছোঁ মে’রে আমার কোল থেকে নিয়ে গেলো।নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলেন। দরদর করে গাল বেয়ে চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পিছন থেকে এগিয়ে এলেন উনার স্ত্রীও। দু’জনে সমান তালে আরজাকে আদর করতে লাগলেন। নিজের চোখের পানি মুছে বললেন,

“আমার মেয়েটা এমন সোনার সংসার পেয়েও নিজের দোষে হারিয়ে ফেললো।”

উনার ছেলে আর ছেলেও বউও কাছে আসলেন। আরজার কপালে চুমু দিয়ে দু’টো চকচকে এক হাজার টাকার নোট দিলেন। আরজাকে বললেন,

“এই পুচকি আমাকে একবার মামা বলে ডাকবি?”

আরজা আমার দিকে তাকালো। আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আরজা “মামা” বলে ডাকতেই উনার চোখও ছলছল করতে লাগলো। উনি রিংকির কাছে গিয়ে বললেন,

“শুধু তোর কারণে আজকে তোর মেয়েটার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। নিজের করা সকল পাপের শাস্তি ভোগ করছিস না? সামনে আরো করবি।”

নিরবে চোখের পানি ফেলছে রিংকি। সবাই বেরিয়ে গেলেও শুধু আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো রিংকি। অশ্রিুসিক্ত নয়নে আরজার বাবাকে বললো,

“সোলাইমান আমি যে নাই তোমার মন কেমন করে না?”

আরজার বাবা রিংকির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“করে তো খুব করে মন কেমন করে।”

চকিত হলাম আমি। শুধু আমি না ড্রয়িংরুমে যারা যারা আছেন সবাই বিস্মিত উনার কথা শুনে। আমি উনার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলাম। তারমানে কি এখনো উনি এখনো রিংকিকে ভালোবাসে? এখনো ভুলতে পারেননি?”

#চলবে।

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।