বাড়িয়ে দাও তোমার হাত পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
353

#বাড়িয়ে_দাও_তোমার_হাত
#দশম_অন্তিম
#হুমাইরা_হাসান
_____________________

পরিবার, বাচ্চা আর অন্যান্য ব্যস্ততা নিয়ে মাসনুনের তিনটে দিন দেদারসে কেটে গেলো। আর এই ব্যস্ততার মূখ্য অংশটা জুড়ে ছিলো মিহির। অ্যাক্সিডেন্টে খুব বেশি লাগেনি। হাতের কনুই আর পায়ের গোড়ালির চোট আর কপালে ছোট্ট একটা ক্ষত। তবে এটুকুই যেন অনেক বেশি মর্মবেদনাযুক্ত ছিলো রোকেয়া এবং আছিয়া খাতুনের জন্য। স্বামী সন্তান দুজনকে হারিয়ে একমাত্র আদরের সন্তান মিহির। ওকে ঘিরেই জীবন্ত চারটে প্রাণ। শান্তশিষ্ট চুপচাপ, নীরব স্বভাবী মহিলাটার যেমন হৃদয়ের সিংহভাগ জুড়ে সন্তানের জন্য মমতা মায়া ভালোবাসা তেমনই দস্যি স্বভাবের, জেদি, রাগচটা বৃদ্ধার ভালোবাসার খণিটুকু হলো মিহির। চোখের সামনে ছেলে,বড় নাতি-নাতবউয়ের প্রাণহীন মুখখানা দেখবার মতো বিধ্বংসী অভিজ্ঞতা আছে যার তার কাছে মিহিরের মূল্য হীরে মানিকের চেয়েও বহুগুণ। এই তিনটে দিন আলমারিতে তুলে রাখা নতুন শাড়িটির মত করেই যত্ন করেছে, দেখভাল করেছে। দুই পা হাঁটতে যে তিনবার দম নেয় সেই মানুষটা রোজ নিয়ম করে তিন চারবার সিড়ি বয়ে উপরে আসে মিহিরকে দেখতে। মিহির চাইলেও ওদের বোঝাতে পারেনা যে, ‘ এত চিন্তা কেনো করছো তোমরা? ছোট্ট একটা ক্ষত। একটু অ্যান্টিসেপ্টিকের ছোঁয়া দিলেই সেরে যাবে। অথচ তোমরা কাম ধাম ছেড়ে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছো আমায়! ’
কিন্তু বলতে পারেনা। মা দাদী আর বাচ্চা দুটো যেভাবে ওকে ঘিরে থাকে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্পর্শে বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসার স্বচ্ছতা, গভীরত্বটা। সেখানে আর মুখ খুলে অহেতুক তাদের পাংসুটে মুখাবয়বের কারণ হতে চায় না। তিনটে দিনই তো, ব্যবসা না দেখলে কী হবে! এই যে মানুষ গুলোর ভালোবাসা, মমতা, আদর – এগুলো যে একটা দুনিয়া সমান ভারি। মিহির ওদের মুখে চোখ বুলিয়ে শান্তি পায়, তৃপ্তির প্রশ্বাস ছাড়ে বুক ভরে।

রান্না, খাওয়া, গোছগাছ সহ বাচ্চাদের পড়া করিয়ে ঘুম পারানো – সবটা শেষ করে ঘরের দিকে এগোতে রাত এগারোটা বেজে যায় মাসনুনের। এখন ও পরিপূর্ণ সংসারী বউ। দাদীর প্রত্যেক বেলার ওষুধ থেকে শুরু করে রোহান-রুহির দৈনন্দিন রুটির টা পর্যন্ত ওর আয়ত্তে। রান্না টাও যতটা সম্ভব নিজ হাতে সামলে নিতে চায় । কিন্তু রোকেয়া বেগম ওর একার ওপর কাজের ভার চাপাতে একেবারেই একমত নন। তাই রান্নার কাজটুকু নিজেই সারেন। মাসনুন পাশে পাশে সবটা সহায়তা করলেও ওকে হাত লাগাতে দেয়না। মাসনুন শান্তচিত্তে লক্ষ্য করে মানুষটা কত নিশ্চুপতায় যত্ন করে সকলের। একজন ছেলেবউ, মা, দাদী সবটা পেরিয়ে শ্বাশুড়ি যে মায়ের মতন মমতাময়ী হতে পারেন এই জায়গা টুকুনও বাদ রাখেননা। এইতো যখন পরীক্ষা চলল একটু কিচ্ছু করতে দেননি মাসনুনকে। আবার এখন মিহিরের খেয়াল রাখা, ও অসুস্থ বলে রোজ বাচ্চাগুলোকে স্কুলে নিয়া যাওয়া আসা সবটা মাসনুন জোর করে নিজেই করে। মাছ ভাজতে গিয়ে সেই যে একদিন তেলের ছিটায় ফর্সা হাতের চামড়াটায় ছোট্ট দাগ পড়লো সেই থেকে খুন্তি ধরার অধিকারটাও খুইয়েছে। রোকেয়া বেগমের কাটকাট আদেশ, ‘এই সুন্দর হাতটায় দাগ মানায় না। যে হাতে তুমি আমার ছেলের বউ এর দ্বায়িত্ব আমার নাতি-নাতনীদের মায়ের ভার বইছো সেই হাতটায় দাগ লাগলে আমার খুব কষ্ট হবে। যতদিন সামর্থ্য আছে এই কাজটা আমিই করবো। ’ তাই এমন নির্মল স্বচ্ছ মমতার বিপরীতে যুক্তি বা জোর খাটিয়ে নিজের অধিকার টা হাতিয়ে নিতে পারেনি মাসনুন।

– এত দেরি করলে কেনো?

ঘরে ঢুকে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলে মিহির হাতের বইটা নামিয়ে প্রশ্ন করলো। মাসনুন ক্লান্ত চোখে তাকালো। এগিয়ে এসে বলল,

– এই তো শুধু আজই। কাল ওদের ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হলে চিন্তামুক্ত। বসে না থাকলে একটুও পড়তে চায়না দুটো। ওষুধ খেয়েছেন?

মিহির ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি সূচক জবাব দিলো। মাসনুন ব্যস্ত হয়ে বলল,

– ক্লান্ত লাগছে। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি আপনি শুয়ে পড়ুন।

বলে বাথরুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে বেরোলো। ঘরের লাইট ততক্ষণে নিভিয়েছে মিহির। টিমটিমে আলোয় স্পষ্ট খাটের দিকে চোখ বুলিয়ে হাত থেকে তোয়ালে টা নামিয়ে রাখলো মাসনুন। খাটের ওপর বসতেই অকস্মাৎ কোনো দমকা হাওয়ার মতো একটা পুরুষালী হাতের বেরিবাঁধ ঝাপটে ধরলো ওকে পেছন থেকে। একটা হাতের কোমর জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো নির্বিঘ্নে, নিঃসংকোচে। স্বামী নামক সুহৃত্তম মানুষটার এমন আবেদনময়ী স্পর্শে সমস্ত শরীরে শিহরনের জোয়ার বইয়ে দিলো। শক্তপোক্ত খোলসে আবৃত মনটার নরম জায়গাটুকুর প্রবল উন্মত্ততা বেপরোয়া করে দিলো সমস্ত চিত্ত। পিছু ঘুরে মিহিরের চোখে তাকালো আধো আলো আধো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটায়। সেই আবছা আলোতে যেন একজোড়া চোখে দেখতে পেলো জ্বলজ্বল করা উন্মাদনা, অবাধ্য অনুভূতির ঢেউ। কিছু নিষিদ্ধ সংগোপিত ইচ্ছের প্রবলতা। মাসনুন প্রবল তৃষ্ণায় শুকিয়ে আসা ঠোঁট টা জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও তা আঁটকে গেলো সস্থানে। নরম ঠোঁট দুটোর ওপর একটা প্রগাঢ় স্পর্শ দখল করে নিলো ওর সুখদুখমাখা অনুভূতি গুলো। ওষ্ঠের ভাঁজে মিশে থাকা ওষ্ঠের দংশনের স্থায়িত্ব ঠিক কতগুলো মুহুর্ত অব্দি রইলো তা হয়তো দুজনেরই বেহিসেবী। ঠোঁট দুটো ছাড়লেও আলাদা হলো না দুটো শরীর বরং মিহির এক হাতের চাপের টান দিয়ে মাসনুনের শরীর টা নিজের বুকের ওপর ফেলে বিছানায় পিঠ ঠেকালো। ফোঁসফাঁস নিঃশ্বাসের সুগভীর ফিসফিসানির সাথে একজোড়া হৃদয়ের উথাল পাথাল, দূর্লভ ইচ্ছে, নিষিদ্ধ আবেগ স্পষ্ট কানের পর্দায় আঁচড় কাট’লো। মাসনুন বহুকষ্টে জিহ্ব ঠেলে ছোট্ট-ক্ষীণ স্বরে বলল,

– ছ্ ছাড়ুন্। আপনি অসুস্থ…

কিন্তু বাকিটুকু বলার আগেই মিহির মুখটা এগিয়ে এনে ওর গালে নাক ডোবাল। স্পর্শের উন্মাদনায় বিভোর হলো সত্ত্বা। সেই সাথে পুরুষোচিত কণ্ঠের চাপা স্বর,

– হুঁশশ… একদম সুস্থ আমি। আপাতত বউকে দরকার পুরোটা।

তীব্র ভাবে খা’মচে ধরলো মাসনুন মিহিরের পরনের শার্ট। অকস্মাৎ এক ধাক্কায় নিজের স্থান পরিবর্তন হয়ে বিছানায় শরীর ঠেকলে আঁতকে ওঠে আকস্মিকতায়। কিন্তু সেই খেয়ালটুকুও একটা হাতের স্পর্শে হারিয়ে যায়। সারা পিঠময় জামার ভেতর দিয়ে পাঁচ পাঁচটা আঙুলের স্পর্শের আঁকিবুঁকির বিস্তরে শিউরে উঠলো মেয়েলী শরীর। কী তপ্ত সে স্পর্শে! কালক্রমে অবাক,বিবশ হওয়াও ভুলে বসেছে মাসনুন। বুক ভরে বড় শ্বাস নিলো ঠান্ডা বাতাসের সাথে একটা উষ্ণ স্পষ্ট আর তার প্রখরতা ছেয়ে গেলো সারা শরীরে দেহে , চিত্তে। ফর্সা মুখের টুকটুকে আভা টা যেন হলদেটে আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পেলো মিহির। সে আদলে বিভ্রম হলো ওর। বেসামাল, বেপরোয়া হলো। মাসনুনের গলায় মুখ ডুবিয়ে শুষে নিলো সমস্ত ঘ্রাণ, মায়া। স্পর্শে স্পর্শে মিশিয়ে দিলো স্বর্গীয় অনুভূতি। নিয়ন্ত্রণ হারা হলো দুটি মনের কামনা-বাসনা। বদ্ধ ঘর আবিষ্ট হলো তপ্ত শ্বাস, উত্তপ্ত আর্তনাদ আর সুখমিশ্রিত জোয়ার। প্রথমবারের মতো মিলিত হলো দুটি মন-শরীর।
.
.
.
সময়ের কাটা নির্দ্বিধায়, নিরুদ্বেগ, বেসামাল গতিতে এগিয়ে চলে। নিজের ঘূর্ণন গতি বহাল রেখে মাড়িয়ে চলে কতশত মাস-দিন-ঘণ্টা- সেকেন্ড। মিহির আবসার নামক ব্যক্তিটার দোতালা বাড়িটার সুরতহাল বেশ পাল্টেছে। রংচটা বাড়ির গা টা অন্যরঙে রঙিন। বাড়ির সামনের ছোট্ট লতার মতো মিইয়ে থাকা উদ্ভিদ গুলো বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাথা উঁচিয়ে। একেবারে সাদামাটা বাড়িটার আবহে আজ বেশ চাকচিক্যতা।
হেলতে দুলতে এক মোটাসোটা মহিলা ঢুকলো বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে। ভেতরে এসেই হাঁক ছেড়ে ডাকলো,

– কী গো মিহিরের মা! কোথায় সবাই?

মুহূর্ত কয়েকের মাঝে বেরিয়ে এলেন চশমা পরিহিত মাঝবয়েসী নারী। কাচাপাকা চুলগুলো খোঁপা করা। হাস্যজ্বল মুখে বলল,

– ভাবি! আসুন, বসুন।

এগিয়ে এলেন। রান্নাঘরের দিকে ফিরে খানিক উঁচু স্বরে বললেন,

– কইরে সীমা চা নাস্তা করে আন তো ভাবি এসেছেন।

বলে পাশটায় বসলে আগন্তুক মহিলা বেশ হাসি হাসি ভাব করে বললেন,

– ওমা এসবের কী দরকার ছিলো!

– কে এসেছে রোকেয়া?

খুব ধীরে, মন্থর পায়ে এগিয়ে এলেন আছিয়া খাতুন। খানিক এক ভাবে তাকিয়ে মানুষটার চেহারাটা চিনতে বেশ সময় লাগলো। খাটো স্বরে বললেন,

– ও রুবি। তা এই সময়ে এলি যে।

– দেখতে এলাম চাচী। কতদিন দেখা হয় না।

– বেশ। ভালো করেছিস। এমনেও কেউ নেই তোর সাথে গল্প করা যাবে।

আছিয়া বেগম এই বলে সামনাসামনি বসলে রুবি নামক মহিলাটি এদিকে ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন,

– ওমা কেনো! বাচ্চারা, মিহিরের বউ কোথায় নেই সে?

– রোহানদের স্কুল বিকেলে শেষ হয়। আর নাতবউয়ের কলজে আজ কিসব অনুষ্ঠান নাকি বলল। সেসবের জন্য সকালে বেরিয়েছে কখন ফিরবে ঠিক নেই।

মহিলাটি কেমন ফ্যাকাসে মুখ করে বললেন,

– সেসব নাহয় মানলাম। কিন্তু চাচী এখনকার যে যুগ জামানা বাড়ির বউকে এত ছেড়ে রেখেছেন আমারতো ভয় ই হয়। সকালে বের হয় ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায় এসব কী ভালো কথা চাচী! দেখুন আমি আপনাদের ভালো চাই বলেই বলছি। ওই যে সৈয়দ বাড়ির বউ? সে চাকরির নাম করে এই ছেলে ওই ছেলের সাথে ঘুরতো। ভেগে গেছে। এখন বসে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে ওরা৷ আমি কত বলেছিলাম আগে তখন কানে নেয়নি। এখন বুঝুক ঠেলা। কিন্তু আমি আপনাদের ভালো চাই চাচী তাই বলছি বাড়ির বউকে বউ এর মতো রাখুন। মিহিরের তো কম নেই মাশাল্লাহ ওর আবার চাকরির কী দরকার!

কথার মাঝেই রোকেয়ার আদেশমতে সীমা চা নাস্তা ভরা ট্রে এনে রাখলো সামনে সেন্টার টেবিলে। রুবি নামক মহিলাটি নিজ দ্বায়িত্বে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিলো। রোকেয়া বেগম চুপ থাকলেও আছিয়া খাতুন রয়েসয়ে বললেন,

– রুবি। তুমি যে আমাদের নিয়ে এত ভেবেছ এই অনেক। কিন্তু তোমার তো উঠতি বয়সী দুটো ছেলে আছে তুমি বরং ওদের নিয়েই ভাবো। আমার বাড়ির বউ কি করলো সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না কেমন?

– মাথা ঘামানো আর কোথায় চাচী। আমি তো সত্যি…

– সত্য জানার দরকার নেই। আমার বউ কেমন আমরা জানি। যখন আমাদের খুব কম ছিলো ও তখনও ছিলো এখন যখন আমাদের সব আছে ও তখনও থাকবে। আসলে এসব শিক্ষার ব্যাপার বুঝলে তো? সৈয়দ বাড়ির বউ এর সাথে আমার বউ কে তুলনা কোরো না। আমার বাড়ির বউ এর সাথে তুলনা করার যোগ্যতা ওদের নেই। রূপে, গুনে, শিক্ষায় কোনো দিকেই ওর সমান না ঐ বাড়ির বউ।

রুবি কেমন চুপসানো মুখে কটাক্ষ করে বললেন,

– বউ কে নিয়ে এত গৌরব ভালো না চাচী। যখন মুখে ঝামা ঘষে পালাবে তখন বুঝবেন আমার কথায় ঠিক ছিলো।

– সে অপেক্ষায় তুমি থাকো। আমরা না। নিজের গর্ভের না হওয়া সত্ত্বেও মায়ের মতো করে মানুষ করছে ছেলেমেয়ে দুটোকে। মিহিরের এত বড় ত্রুটি নিয়ে আজ অব্দি একটা টু শব্দটি করেনি। আমার ওষুধ রোকেয়ার ডাক্তার দেখানো বাড়ি ঘর স্বামী সব সামলে কলেজের মাস্টারগিরিও করে। আর তার সাথে তুলনা দিচ্ছ কোন না কোন ছোকরার সাথে পালিয়ে যাওয়া ওই অশিক্ষিত মেয়ের? আমার মাসনুনই তো এ বাড়ির সব। ওই তো এক হাতে আমাদের সবাই কে আগলে রেখেছে। আর এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে তাহলে কেনো নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? নিজের কষ্টের শিক্ষার মর্যাদা পাওয়ার অধিকার ওর অবশ্যই আছে।

রুবি চরম অপমানিত বোধ করলো। ধপ করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যস্ত সুরে বলল,

– আজ যাই চাচী। আমার ছেলেটার ফেরার সময় হয়েছে।

– হ্যাঁ যাও। এদিন এসো কিন্তু আমার বউমার হাতের রান্না খেয়ে যাবে। দারুণ রান্না করে মাসনুন।

– জ্বি।

এটুকু বলে থমথমে মুখে বেড়িয়ে গেলো সে। শুধু রুবি একা নয় রুবির মতন মুখোশী আরও বহু মানুষ আছে আমাদের সমাজে যারা প্রতিনিয়ত কূ’টনৈতিক কথাবার্তা আর আচরণ দ্বারা অন্যকে দমিয়ে রাখে। তাদের সাফল্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে আছিয়া খাতুন এসব ভুলেও কানে নেবেন না। চার বছর আগে বউ করে আনা ধানী লঙ্কাটা এখন তার চোখের মণি।
দুজনের বসে থাকা অবস্থায় আগমন ঘটলো মাসনুনের। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি জড়িয়ে লম্বা শরীর টা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলে আছিয়া খাতুন তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,

– এই যে মাস্টারনি? এতক্ষণে ফেরার সময় হলো? বলি বাড়ি ঘর নিয়ে কোনো চিন্তা নেই তোর? মাস্টারনি করে তোর কী হবে রে? আমার নাতনির তো কম টাকা নেই।

মাসনুন আছিয়া খাতুনের এহেন কটাক্ষবাণী পুরোদমে অগ্রাহ্য করে বলল,

– বিকেল হয়েছে। তোমাকে তো বলেছিলাম খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করবে৷ তা না করে গেড়ে বসেছ পানের বাটা নিয়ে?

আছিয়া খাতুনের ফ্যাকাসে মুখটায় তাকিয়ে মুচকি হাসলেন রোকেয়া। মাসনুন ওপরে উঠে গেলে শ্বাশুড়িকে বলে,

– মেয়েটার সাথে লাগতে যান কেনো বলুন তো?

আছিয়া খাতুন পান খাওয়া লাল টকটকে দাঁত বের করে গা দুলিয়ে হেসে বললেন,

– ধানী লঙ্কা টার হম্বিতম্বি না দেখলে আমার ভাল্লাগে না রে। তাই ওকে একটু জ্বালায়। এই তো আর কয়দিন, মরে গেলে আর জ্বালনোর লোক নেই তো। তখন চিপায় চিপায় বসে কাঁদবে দেখিস। এমনি দস্যিপনা করলেও আমাকে মায়া করে আমি জানি।

রোকেয়া বেগম উঠে হাসতে হাসতে চলে গেলেন নিজের কাজে। মাসনুন গোসল করে আবারও রেডি হয়ে নিচে নেমে এলে রোকেয়া বেগম খাওয়ার কথা বললেন। মাসনুন ব্যস্ত পায়ে এগোতে এগোতে বলল,

– মা আজ বাচ্চারা ঘুরতে যেতে চেয়েছিলো। ওদেরকে নিয়ে কোথাও খেয়ে নিবো। আপনি দরজা লাগিয়ে দিবেন আমাদের ফিরতে দেরি হতে পারে।

বলে বেরিয়ে গেলো। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে একটা সাদা রঙের গাড়ি। গাড়িটা গতমাসে নেওয়া। মাসনুনের পঁচিশতম জন্মদিনে এটা কিনেছিলো মিহির। চারটে বছর ধরে অল্প অল্প করে গুছিয়ে রাখা টাকায় প্রিয়তমার জন্য গাড়িটা নিয়েছিলো। মাসনুন মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিসিএস পরীক্ষায় বসেছিলো। ওর অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা আর সৃষ্টিকর্তার কাছে করা দোয়া,তার রহমতে প্রথম বারেই টিকে গেছে। এখানকার স্থানীয় সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের লেকচারার এখন। মিহির ও নিজের স্থানের উন্নতি করেছে। ছোট্ট ব্যবসাটা আজ অনেকটা বিস্তর। সততা আর পরিশ্রমের সাথে নিজের নাম ব্যবসাটাকে সমাজে মাথা উঁচু করবার মতন স্থানে নিতে পেরেছে। মিহিরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাসনুন এসে বসলো গাড়িতে। মিহির স্নিগ্ধ হেসে বলল,

– তাহলে চলি ম্যাডাম?

– ড্রাইভার?

মিহিরের চোখ দু’টোয় যেনো উত্তর খুঁজে নিলো মাসনুন। স্মিত হেসে ড্রাইভিং সীটে বসে সীটবেল্ট লাগিয়ে নিয়ে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বলল।

– শিওর স্যার!

কিছুক্ষণের মাঝেই গাড়িটা এসে দাঁড়ালো স্কুলের সামনে। ছুটির সময় হয়ে এসেছে। বাচ্চাদুটো এখনই বেরোবে। ঠিক কয়েক মিনিটের মাথায় ছুটির ঘণ্টা বাজলো। রোহান রুহির হাতটা ধরে বেরিয়ে এলে গাড়িটা দেখে ছুটে এলো। মাসনুন আর মিহিরের কাছে দৌড়ে এসে বলল,

– আমরা গাড়িতে করে ঘুরতে যাবো মা?

– হ্যাঁ।

রোহান রুহি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। দুজন পাড়াপারি করে উঠে বসে। এই ঘুরতে যাওয়া নিয়ে দুজনের কত উচ্ছ্বাসতা । তাই তো বাড়িতেও ফিরতে চায়নি। ছুটি হলেই ঘুরতে যাবে বলে বায়না ধরেছে। মাসনুন বা মিহির ও দ্বিরুক্তি করেনি। আজ ওদের চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী। একসাথে চারটে বসন্তের সমাপ্তি। একত্রে পথচলার আজ এক হাজার চারশো ষাটোর্ধ দিন। তবুও যেন আজও সবটা নতুন সেই প্রথম দিনের মতো। মাসনুন আজও ছোট ছোট ব্যাপারে রেগে ফর্সা নাকের ডগা লাল করে ফেলে আর সে রাগের সামনে মিহির সদা সর্বদার ন্যায় শান্ত। নীরবে মেনে নেয় সহধর্মিণীর সব রাগ, জেদ, একগুঁয়ে স্বভাব। ঠিক সেভাবে মাসনুন ও মানিয়ে নেয় মিহিরের বোকামি ভরা আচরণ, কথা গুলো। ওর আহাম্মক বলা স্বামীটার সকল ত্রুটির নির্বিশেষে মাসনুন ওকে ভালোবাসে। ওর এক জীবনের সমস্তটুকু দিয়ে ভালোবাসে মানুষটাকে। এখনো মনে পড়ে সুবহান কবিরের বলা কথাটা, ‘ জীবনে চলার পথে পাশে একটা বড়োলোক ছেলের চেয়ে একটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভালো মানুষ খুব দরকার। মিহির নিজেই একটা সম্পদ আর কোনো কিছুর দরকার নেই ভালো থাকতে ’। বাবার কথাটার যথার্থতা মিহির বহাল রেখেছে। একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উত্তম চরিত্রের পুরুষ যে এক জীবন সুখে থাকার ভালো থাকার চাবিকাঠি হতে পারে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। সবসময় সফল মানুষকে বিয়ে করে তার বিলাসিতা ভোগ করতে হবে এমনটা তো নয়! বরং দুজনে একসাথে সফল হয়েও সুখের ঝুড়ি পরিপূর্ণ করা যায়। ঠিক তেমনটাই বুঝিয়ে দিলো মাসহির।

ধূলো উড়িয়ে গায়েব হয়ে গেলো সাদা রঙের গাড়িটা আর তার সাথে সেই গাড়িতে থাকা মানুষ গুলোর হাসির রঙিন কলধ্বনি। সে দৃশ্যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো একজোড়া বিষাদময় চোখ। যে চোখের চাহনিতে এক আকাশ ব্যর্থতা, আফসোস, গ্লাণি, নিজের প্রতি ধিক্কার। মাসহিরের নির্মল স্নিগ্ধ ভালোবাসা, আদর আর ওদের ছোট্ট সংসার টা সূঁচের মতো বিদ্ধ করে নিহার বুক। বারংবার ওকে প্রবল ধিক্কার জানিয়ে মনে করিয়ে দেয় আজ এই জীবনটা তোর হওয়ার কথা ছিলো। যাকে ঝামেলা, আগাছা ভেবে ছেড়ে এসে অন্য পুরুষের হাত ধরেছিলি সেই তোকে আজ ব্যবহার শেষে ছুড়ে ফেলেছে। দৃষ্টি নত হয় নিহার, চোখ ছাপিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো। বছর দুয়েক তিনেক আগে ডিভোর্স হয়েছে নিহার আর রায়হানের। নিজেদের পছন্দে বিয়ে করলেও দুটো বছর পেরোতে না পেরোতে শুধু হয় কলহ, রেষারেষি, বিদ্বেষ। একে অপরের প্রতি অভিযোগ, দোষ ধরা সবটা বাড়তে বাড়তে এক সময় রায়হান বলেই দেয়, ‘তুমি টাকার লোভে যদি তিন বছরের সম্পর্কটা ভেঙে আমার সাথে চলে আসতে পারো তাহলে আরও টাকা দেখলে আমাদের দুই বছরের সম্পর্ক ও ভাঙতে পারো। তার চেয়ে বরং আমি শেষ করে দিই। ’ ব্যস্ ওখানেই শেষ। যার জন্য মিহিরকে ছেড়ে এসেছিল সেই ওকে ছেড়ে দিলো। জীবন ওকে আবারও বুঝিয়ে দিলো প্রকৃতি তার হিসেব চুকিয়ে দেয়। যে যেমনটা আচরণ করবে তাকেও ঠিক সেটাই ভোগ করতে হবে, সহ্য করতে হবে। হোক আজ কিংবা কাল। দুনিয়ায় যে প্রান্তেই তুমি থাকো না কেনো, তোমার কৃতকাজ তোমার তোমার যোগ্যস্থানটা একদিন ঠিক বুঝিয়ে দিয়ে যাবে। বুকভর্তি নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে চলতে শুরু করে নিহা, গন্তব্য এক রুমের লেডিস মেসটা।

গাড়ি চলেছে তার আপন গতিতে। পেছনে বসা দুটো প্রাণোচ্ছল হাসির খিলখিলানির ঝংকার। আর সামনে বসা দুটি হাত আর তাদের দৃঢ় বন্ধন। যে হাতটা নির্জীব চিত্তে পড়ে আছে তাকে সযত্নে সুদৃঢ়ভাবে আগলে রেখেছে একটা মেয়েলী হাত। যে হাতের মুঠোয় চেপে রাখা ভালোবাসা বুঝিয়ে দেয় – সুন্দর ভাবে বাঁচতে পারফেক্ট হওয়াটা মূখ্য নয়, মূখ্য হলো অন্তরের স্বচ্ছতা একে অপরের প্রতি একটু সম্মান আরেকটু আস্থা আর অনেকটা ভালোবাসা। ব্যস্, আর কী লাগে!
সুন্দর মুহুর্তটাকে আরেকটু হৃদয়গ্রাহী করে গাড়িতে বাজতে থাকা রেডিও টুডে ৮৯.৬ এফএম এ বেজে উঠলো চিরচেনা একটা বাংলা সুর –

“ বাড়িয়ে দাও তোমার হাত,
আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই”

______ সমাপ্ত।

#সংক্ষিপ্তসার : শান্তশিষ্ট চুপচাপ, চাপা স্বভাবের ছেলে মিহির আবসার। আর চঞ্চল স্পষ্টভাষী দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মেয়ে মাসনুন কবির। বিয়েটা সম্পূর্ণ পারিবারিক ভাবে হলেও তাতে ছিলো সমাজের একঝাঁক কটাক্ষ। তার কারণ মাসনুনের সৌন্দর্য, উচ্চশিক্ষা আর অন্যদিকে মিহিরের একটা হাত অচল বলে তাকে পঙ্গু দেওয়া উপাধি; যার সাথে দুই সন্তানের পিতা নামক তকমা। তবুও একে অপরের ত্রুটি, খামতি সবটা মিলিয়ে চলা মাসহিরের গল্প হলো ‘ বাড়িয়ে দাও তোমার হাত ‘। যে হাত শুধু আঙ্গিক নয় বরং – দ্বায়িত্বের,মায়ার,বন্ধনের,ভালোবাসার।

#হীডিং : ইচ্ছে ছিলো ছোট গল্প লিখবো। কিন্তু এক পর্বে শেষ করবার মতো দক্ষতা আমার নেই। অনুগল্প একেবারেই লিখিনা। একেবারে অনভিজ্ঞ বলা চলে। খুব আকস্মিক ভাবে কোনোরূপ পূর্বপ্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছাড়া শুরু করেছিলাম মাসহিরের গল্পটা। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী যে সকলের এত এত ভালোবাসা, শুভকামনা আর দোয়া পেয়েছি। পাঠকমহল সদা সর্বদার মতোই আমায় অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহ জুগিয়েছে, ভালোবাসা দিয়েছে। আজও তাদের প্রাণপ্রফুল্লকর মন্তব্যের অপেক্ষায়। গল্পতে হওয়া সকল ভুল ত্রুটি গুলোর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। সকলের জন্য আমার অন্তর থেকে শুভকামনা-স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। সালাম।

#হুমাইরা_হাসান
#৪ঠা_নভেম্বর_২০২৩ |

#Humu_❤️