বাড়িয়ে দাও তোমার হাত পর্ব-০৭

0
174

#বাড়িয়ে_দাও_তোমার_হাত
#সপ্তম_পর্ব
#হুমাইরা_হাসান
_____________________

সময়টা কাঠফাটা গরমের নয়,তবে রোদের তাপে চোখ মেলে তাকানো দায় হয়ে পড়েছে। মাসনুন হাতের ফাইলটা উঁচিয়ে কপালের কাছে ঠেকিয়ে পরীক্ষার সেন্টার থেকে বেরিয়ে এলো। তীব্র রোদের তাপেও যেনো একটা শীতল প্রশান্তির শ্বাস নির্গত হলো। আপাতত কয়েকদিনের জন্য চিন্তামুক্ত। মাস খানেকের চেয়েও বেশি সময় শেষে পরীক্ষা নামক দীর্ঘ প্রক্রিয়াটা শেষ হলো। আর বেশ ভালোও দিয়েছে পরীক্ষা গুলো। আশানুরূপ ফলাফল পাওয়ার প্রার্থনাটা মনে মনেই জপে গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা যেহেতু, সেন্টারের সামনের চওড়া রাস্তাটায় ভিড়ে মানুষ গিজগিজ করছে। গা বাঁচিয়ে কোনো রকমে ঠেলেঠুলে বড় ভিড় থেকে বেরিয়ে এলো মাসনুন। রাস্তার ধারে রিকশার জন্য দাঁড়ালেও সামনে উপস্থিত মানুষটাকে দেখে স্থিরনেত্রে তাকালো। সে চাহনির মেয়াদ একেবারেই ক্ষীণ। অতঃপর মুখাবয়বে কাঠিন্য চেপেই এগোতে লাগলে ছাতা হাতে মানুষটা এসে পাশাপাশি দাঁড়ালো। মাসনুনের মাথার উপর ছাতাটা ধরে নিঃশব্দে রাস্তা পার হলো সাথে মাসনুন ও। আপাতত যে জ্যামটা লেগেছে তাতে এখানে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করাটা বোকামি তাই কোনোরূপ বাক্যহীনাই দুজন ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। চলার পথে বার কয়েক আড়চোখে তাকালো মাসনুন। বাসন্তী রঙের একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে আছে মিহির। চিকন ফ্রেমের চশমাটার আড়ালের চোখ দু’টোর সদা সর্বদার সরল চাহনি সামনে স্থির। পকেটে গোঁজা ডান হাত আর বাঁ হাতখানায় চেপে রাখা ছাতার হ্যান্ডেল। মাসনুন হাতটা বাড়িয়ে ছাতাটা নিজের হাতে নিলো। মিহির তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো নিজের পাশাপাশি হাঁটতে থাকা কান সমান উচ্চতার মেয়েটির দিকে। প্রত্যুত্তরে পালটা চাহনিটা মিললো না। অবসন্ন মনটা আরও কুঞ্চিত হলো ওর।
সেদিনের করা ভুলটার জন্যেই হয়তো আজ এমনটা – এহেন চিন্তাভাবনা খুব দৃঢ়ভাবে আসন গেড়ে নিলো মস্তিষ্কে। সেদিন ঝোঁকের বসে করা ভুলটার জন্যে মাসনুনের কাছে ক্ষমা চেয়েছে একাধিক বার। মিহির নিতান্তই সহজ-সরল মন,মস্তিষ্কের মানুষ। সম্পর্কের বেরিবাঁধে জড়ানোর পূর্বপ্রস্তুতি বা মানসিকতা স্থির করবার আগেই খুব আকস্মিক ভাবে মা আর দাদী বিয়েটা ঠিক করে ফেলে। এতদিন বেশি কিছু না বললেও সন্তানের বয়স বত্রিশের কোঠা ছাড়াতেই বিয়ে করাবার চিন্তা টা দুঃশ্চিতায় পরিণত হয়। ফলস্বরূপ এই বিয়ে। শুরুতে মাসনুনকে নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধা,চিন্তায় ছিলো। যেখানে ও একজন স্বাধীনচেতী, শিক্ষিত, সুন্দরী মেয়ে তার ক্ষেত্রে এমন একটা সংসার আগাছাযুক্ত লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মাসনুনের ব্যবহার, আচরণ আর মানসিকতার প্রকাশ ক্রমেই সে দুঃশ্চিতা বাঁধ টা ভেঙেছে। মিহির অবিলম্বেই উপলব্ধি করে যে মাসনুন শুধু শিক্ষিত নয় বরং সুশিক্ষিত ও। তবে নিজেদের দাম্পত্য জীবন নামক সম্পর্কটায় এখনো ব্যপক জড়তা মিহিরের। মাসনুন এ বাড়িতে এসে থেকে ওকে সর্বদা সম্মান, শ্রদ্ধা আর বিনয়ী আচরণ পেশ করেছে মিহির। কিন্তু এতদিনের সে নিয়ম আর নিয়ন্ত্রণের বাঁধটা সেদিন ওভাবে ভেঙে যাবে তা কল্পনাতেও আসেনি। মেয়েটা একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। এই পরীক্ষার পুরো মাস জুড়ে হু, হা ছাড়া দুটো কথা ওদের মাঝে হয়নি। যার জন্য মিহির এখনো ভর্ৎসনা করে নিজেকে। ও কখনোই একটা মেয়ের কাছে ওমন পুরুষ হতে চায়না যে তার উগ্র চাহিদা দেখিয়ে স্ত্রী নামক মানুষটার কোমলমতি মনে আঁচড় কা-টবে।

এমন সব বিজড়িত, বিষন্ন চিন্তাভাবনায় বুদ হয়ে কখন রিকশাটা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলো তা ঠাওর করতে পারলো না মিহির। পাশের জায়গাটা শূন্য হওয়ার আভাস পেয়ে ঘুরে তাকালে সচকিত হয়। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে বাড়িতে ঢোকে। তারপর খুব স্বাভাবিক নিয়মেই গোসল, দুপুরের খাওয়া শেষ হয়। বিকেল গড়ায়। সন্ধ্যায় ডাইনিং এ বসে মা আর দাদীর সাথে গল্প করছিলো মিহির। বাচ্চাদের হৈচৈ শুনে ফিরে তাকায়। রুহি মাসনুনের কোলে ওর গলা জড়িয়ে আছে আর রোহান ওর হাত ধরে কথা বলতে বলতে নিচে নামছে। এরকম একটা দৃশ্যে নিজেদের অজান্তে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে তিনটে মুখে। মাসনুনের সাথে বাচ্চাদের সম্পর্ক দিনকে দিন আরও গভীর হচ্ছে। মাসনুনকে শুরুতে অপছন্দ করা রুহিটাও এখন মা বলতে পাগল। হয়তো এটাই মায়ের মমতা।

– তোমরা এখানে বোসো। আমি ঝট করে যাবো আর ফট করে নাস্তা বানিয়ে আনবো।

বলে রুহির গালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। রোকেয়া বেগম কোলের ওপর বিছানো নকশিকাঁথায় সূঁচ টা বিঁধিয়ে তা একপাশে রাখতে রাখতে বলল,

– তুমি বোসো ওদের সাথে। আমি করে আনছি।

– থাক মা। এতগুলো দিন তো আপনিই সবটা করেছেন। আজ আমি করবো। আর আমার ছানাপোনা দুটো আজ আমার হাতের পাস্তা খেতে চেয়েছে তো!

বলে মুচকি হেসে রান্নাঘরের দিকে গেলো। আছিয়া খাতুন নিরস মুখে চেয়ে রইলেন সেদিকে। ফোঁস করে দম ছেড়ে বললেন,

– মাস্টারনি গেছে। আজ তাহলে আমার চা খাওয়া হা.রাম।

বলে মুখটা বেজায় রকম কুঁচকালেন। আঙুলের ভাঁজে আঁটকানো তছবিহ গুলোও মেজাজের কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত চলতে শুরু করলো।
ঘাড় দোলাতে দোলাতে বললেন,

– তোর এই বউটার মনে কী কোনো রহম নেই মিহির। দস্যিপনা খাটাতে আর কাউকে পায়না?

বলে মুখটা ফিরিয়ে নিলো। এতদিন মাসনুনের পরীক্ষা থাকায় সন্ধেবেলা করে ও আর ঘটা করে নিচে এসে বসে চা-নাস্তা করতো না। তাই মনের সুখে বুড়ি চা গিলেছে চিনি ঢেলে। আজ তা সম্ভব না দেখে মেজাজ তুঙ্গে।
মাসনুন এলো ওর কাজ সেরে। বাচ্চাদের ওদের চাওয়া মতো পাস্তা আর বড়দের জন্য চা-বিস্কুট এনে দিলো। আছিয়া খাতুনের চোরা নজরে চায়ের দিকে বারংবার তাকাতে দেখে মাসনুন কড়া শব্দে বলল,

– এই যে বুড়ি। খুব তো রসিয়ে রসিয়ে ইচ্ছে মতো চিনি ঘুটে চা খেয়েছ এতদিন। আজকে তোমার কপালে আর তা জুটবে না।

– কী বেয়াদব! এই মাস্টারনি আমার বাড়ি আমার চা আমার মুখ। আমি খেলে তোর সমস্যা টা কোথায়?

– অবশ্যই সমস্যা। সেদিন যে সুগার বাড়িয়ে বিছানায় পড়েছিলে ডাক্তার তো আমার স্বামীটা আনলো টাকাও আমার স্বামীকেই দিতে হলো।

আছিয়া খাতুন বড় বড় চোখ করে। রোকেয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– দেখেছ রোকেয়া দেখেছ? এই মেয়ে এখনই টাকার খোটা দিচ্ছে। আর ক’দিন পর তো বাড়িতে থাকার খোটাও দিবে। কী মেয়ে আনলোরে বাবা। আমি তো বিয়ের পরের দিনই বুঝেছি এই মেয়ে ধানী লঙ্কা।

মাসনুন আড়চোখে কড়া নজরে তাকালো। একটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তাতে প্যাকেট ছিড়ে পাউডার গুলে আছিয়া খাতুনের সামনে ধরে বলল,

– হু, নাও তোমার প্রাণেশ্বর কে গেলো।

আছিয়া খাতুন বিস্ফারিত চোখে তাকালেন যেনো অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছে। আতঙ্কিত স্বরে বললেন,

– এ্যাই মিহির! তোর বউ দেখি দিনে দুপুরে আমাকে মে রে ফেলার ব্যবস্থা করছে। হায় খোদা আমি জলজ্যান্ত মানুষটা সামনে বসে আছি অথচ ও সবার সামনে চায়ে বি ষ মিশিয়ে আমাকে গিলতে বলছে। ও আল্লাহ্ তুমি আমার কপালে খু-ন হওয়ায় রেখেছিলে!

আছিয়া খাতুনের উচ্চরবে বিলাপে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হলো মিহির। রোকেয়া বেগম পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন,

– মা চুপ করুন। লোকে শুনলে কী ভাববে?

– কী ভাববে মানে? এই মেয়ে আমাকে মে রে ফেলছে আর তুমি লোকের কথা বলছ? শুনুক লোক, আসুক। পুলিশে দিক এই ছুরিকে।

– চুপ! বড্ড বেশি চ্যাঁচাচ্ছ কিন্তু বুড়ি। আমার মাথা গরম হলে খবর করে রেখে দেবো।

মাসনুনের ধমকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আছিয়া। মাসনুন প্লাস্টিকের বক্সটা হাতে তুলে আছিয়া খাতুনের চোখের সামনে ধরে বলল,

– এটাকে জিরোক্যাল বলে। অর্থাৎ তোমার মতো ডায়াবেটিসের রোগীদের চিনি এটা। এই চিনি খেলে সুগার বাড়বে না আর ক্ষতিও হবে না।

আছিয়া খাতুন মন্থর গলায় বললেন,

– এটাই মেশালে চায়ে?

– জ্বি।

যেনো প্রাণ ফিরে ফেলো। উচ্ছ্বসিত গলায় চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন,

– হ্যাঁ তো এটা আগে বললেই হয়। আমাকে ডর দেখানোর কামডা কী ছিলো?

কপট ধমক দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মাসনুনের ক্ষিপ্ত দৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে সকৌতুকে জিগ্যেস করলেন,

– এই চিনি খেতে তাহলে নিষেধ নেই?

– না দাদী। এটা তুমি খেতে পারো। জিরোক্যাল দিয়ে কোনো মিষ্টি জিনিস বানিয়ে খেলে তোমাকে আর বাঁধা দেবে না কেউ।

মিহিরের উত্তরে আনন্দে উথলে বৃদ্ধা বললেন,

– তাই নাকি! আলহামদুলিল্লাহ। আমারে আরও আগে এইডা দিলি না ক্যা।

বলে খুব আনন্দে চা গলাধঃকরণ করতে থাকলেন। মাসনুন ওপর ওপর চড়া মেজাজ দেখালেও ভেতর ভেতর খুশি হলো। জিনিসটা গতদিনই এনেছিলো নেহাৎ ভুলে বসেছিলো। মনে মনে ভাবলো, বুড়িটা হাসলে কিন্তু দারুণ দেখায়।

.

রজনীর মধ্যভাগ। সমস্ত কাজ মিটিয়ে যে যে শোবার ঘরে ঢুকেছে অনেক আগে। মাসনুন আজ আরামের ঘুম দেবে। বিয়ের ঝামেলায় যেহেতু পড়াশোনায় অনেকটা গ্যাপ পড়েছিলো তাই সেসব মিলিয়ে কভার করতে এই ক’দিনে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে। বিছানা ঠিকঠাক করে শুতে নিলে একটা ডাক এলো কানে,

– মাসনুন?

বেশ জড়তা ভরা কণ্ঠে ডাকলো মিহির। মাসনুন ঘুরে তাকালে মিহির এগিয়ে এলো। খাটের ওপাশটায় বসে বলল,

– আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে মাসনুন।

মাসনুন ছোট্ট শব্দে ‘হু’ বলল। মিহির খুব নাজুক নজর বুলালো মাসনুনের স্থির মুখাবয়বে। অনেক জড়তা, আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলে উঠলো,

– আপনি কী এখনো ওইদিনের ব্যাপারটা নিয়ে রেগে আছেন? আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। আর কখনো আপনার অনুমতি ছাড়া ছুঁয়ে দেখব না।

মাসনুন ক্ষিপ্ত চোখে তাকালো। চোখভর্তি ক্ষোভ দেখতে পেলো মিহির। বুকটা কেঁপে উঠলো। কোনো স্বামী তো চায়বে না তার স্ত্রীর এহেন ক্ষোভাত্মক চাহনির কারণ হতে। তবুও ভুলটা মেনে নেয় ও।

– আর এমন ভুল করবো না। তবুও আপনি স্বাভাবিক হোন প্লিজ!

– কীসের স্বাভাবিক হওয়ার কথা বলছেন আপনি?

মিহির আহত স্বরে বলল,

– আপনি ঠিকঠাক কথা বলেন না। একই ঘরে থাকি অথচ পাড়াপ্রতিবেশিরও আমাদের চেয়ে বেশি কথাবার্তা হয়।

– হ্যাঁ তো পাড়াপ্রতিবেশির থেকে বেশি কিছু তো নোই আমরা।

মাসনুনের কথায় থমকালো মিহির। ক্ষীণ শব্দে বলল,

– মানে?

– মানে আর কী হবে? যে স্বামী তার স্ত্রীকে একবার ছুঁয়ে দিলে একশো বার ক্ষমা চায় তাকে তো পাড়াপ্রতিবেশি বলাও বেশি কিছু হবে৷ আপনি সম্পর্কটাকে সময় দিতে চেয়েছেন, নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন আমি সবটা মেনেছি। কখনো কোনো অভিযোগ করিনি, নিজের দিকটা সবসময় দ্বায়িত্ব পূরণ করার চেষ্টা করেছি অথচ আপনি? আপনি কীসের স্বামী? যে কী না তার বউয়ের সাথে বসে দুদণ্ড কথা বলতেও পারেনা। তার অভিযোগ অভিমান কোনোটায় বোঝেনা। সেদিন একটা ইস্যু ক্রিয়েট হয়েছিলো, একটা ভুল হয়েছে। তবে সেটা নিয়ে এতটা হাইপার হওয়ার কী ছিলো মিহির আবসার? আপনার মতো আমিও অবাক হয়েছি,হতভম্ব হয়েছি৷ কিন্তু আপনি কী করলেন? সকাল হতেই গুটিয়ে গেলেন, ফরমালিটিস মেনে স্যরি স্যরি বলে সরে গেলেন! আমাকে এভাবে এড়িয়ে চললেন যেনো আমার সামনে পড়লে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। এতগুলো দিন গেলো অথচ আপনি নিজ থেকে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন না সেখানে আমার কী বলার থাকতে পারে? বরং আপনি যে লক্ষ্য করেছেন যে আমাদের ঠিকঠাক কথা হয়না এতেই আমি ধন্য।

একদমে কথাগুলো বলল মাসনুন। মিহির বিস্মিতের ন্যায় তাকিয়ে রইলো। একটা শব্দ অব্দি উচ্চারণ করতে পারলো না। এতদিন ভেবেছিলো মাসনুন হয়তো মনে মনে রাগ পুষে দূরে থাকছে অথচ ওর ভেতরে যে এতটা অভিযোগ চাপা ছিলো তার ছিটাফোঁটা আভাস পায়নি ও। মাসনুন টলমলে চোখ দু’টো সরিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো৷ মিহির স্থবির চোখে তাকিয়ে দেখলো মাসনুনকে। আজ সত্যিই ওর মনে হচ্ছে ভীষণ ভুল করে ফেলেছে। অহেতুক বিষয় নিয়ে জড়তা না টেনে বরং নিজ চেষ্টায় সহজতর করা উচিত ছিলো সম্পর্কটাকে। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো। স্মিত স্বরে ডাকলো মাসনুনকে।

– মাসনুন, একটু উঠবেন? আম্ আমার ভুল হয়েছে। আমার আচরণে আপনি কষ্ট পেয়েছেন আমি বুঝতে পারিনি।

মাসনুন ফিরলো না। মিহির উঠে খাট থেকে নেমে এপাশে এসে মাসনুনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,

– আমি আপনা..

মাসনুন কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তড়িৎ ওপাশ ফিরে পড়লো। মিহির উঠে এসে এবার খাটে বসে মাসনুনের সামনাসামনি কথা বলতে নিলে মাসনুন পুনরায় পাশ ফিরলো। হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিহির। কুঞ্চিত মনে হাতটা বাড়িয়ে মাসনুনের কাঁধে রাখলে মাসনুন এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,

– ধরবেন না! আমায় নিজেই ছুঁয়ে পরে একশো বার স্যরি বলতে আসবেন। ওসব আমি শুনতে চাইনা। আমি কে? আমি রাগ করলে আপনার কী!

– তুমি আমার বউ মাসনুন। আর রাগ কোরো না প্লিজ! আমায় একটু বলতে দাও।

– কারো কথা শুনবো না আমি। আদিক্ষেতা করবেন না। আপনি করে বলুন আমায়। খবরদার যদি তুমি বলেছেন। আমি কাল বাড়ি যাবো আপনার সাথে আর একদিন ও থাকতে চাইনা আমি।

বলে ধপ করে লাইট টা বন্ধ করে দিলো। কাঁথা দিয়ে মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে শুয়ে রইলো। নাইবা নিজে কিছু বলল আর না মিহিরকে বলতে দিলো। মিহির আশাহত চোখে মাসনুনের দিকে তাকিয়ে রইলো, বড়সড় গাফিলতি করে ফেলেছে এটুকু বুঝতে যেনো খুব বেশি দেরি করে ফেলেছে। রাগচটা মেয়েটার অভিমান ভাঙানো খুব সহজ হবেনা।

•••

সকালের নরম কমলা কিরণ চারিপাশে ছড়াতেই যথানিয়মে পরিবেশটা চাঞ্চল্যের সহিত দিনের শুরুটা করলো। আটটা বাজতেই মাসনুন নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে বেরোলো। ডাইনিং টেবিলে মাত্রই নাস্তা গুছিয়ে রাখছেন রোকেয়া। সিড়ির দিক থেকে ধুপধাপ শব্দ এলে সেদিকে তাকিয়ে বললেন,

– এত সকালে রেডি হয়েছো যে? এখনই বেরোবে নাকি?

– জ্বি।

রোকেয়া বেগম খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজের কাজ এগোতে এগোতে বললেন,

– তা ভালো করেছো। বেলা হলে রোদে জার্নি করলে মাথাব্যথা করবে। তা মিহির কোথায়?

– জানি না।

রোকেয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালে মাসনুন হাতের আঙুল চাপতে চাপতে বলল,

– আমি একাই বাড়ি যাবো মা। কাউকে লাগবে না।

– সে কী! একা যাবে মানে? বিয়ের পর এই প্রথম যাচ্ছো বাপের বাড়ি। জামাই যাবে না গেলে কেমন দেখায়। ঢেমনা টা কোথায়,যাবে না কেনো?

খোরাতে খোরাতে এসে বললেন কথাগুলো আছিয়া খাতুন। সোফায় বসলে মাসনুন বলল,

– আমি নিজেই একা যেতে চাই।

মাসনুনের কথায় হতবাক উপস্থিত দুজনে। মাসনুনের মুখখানা দেখে বোঝা যাচ্ছে মেজাজ টা তার একদমই ভালো নেই। আছিয়া হা করে চেয়ে থেকে কিছু জিগ্যেস করার আগে সিড়ি দিয়ে মিহির কে নামতে দেখে বললেন,

– ওই তো এসেছে। কিরে ঢেমনা! তোর বউ ক্ষেপেছে ক্যান? কী বলেছিস তুই ওকে?

মিহির নামতেই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে থমকালো। আমতা-আমতা করে বলল,

– আম্ মানে। তেমন কিছু না।

– তোতলানো বন্ধ করে সাফসাফ বল। বউকে ক্ষেপিয়েছিস ক্যান? তোর হাবভাব শুধু দেখি। নতুন বউয়ের মতো এ চিপায় ও চিপায় ভ্যাটকায় বেড়াস। বউকে নিয়ে একটু সময় কাটাতে, একটু বাইরে যেতেও দেখিনি। এখন বউটা বাপের বাড়ি যাবে তাও একা! তোরে কী মুখ দেখার জন্য রেখেছে?

মিহির হা করে তাকিয়ে রইলো। সকাল সকাল দাদীর এমন মাসনুনের সাইড নেওয়াটা খুব বিস্ময়কর না হলেও হতবাক হলো। এখন উত্তর দেবার মতো কিছু নেই তো!

– যা হয়েছে সেটা তোমাদের ব্যাপার। এখন এসে খেতে বসো। বউকে একা কোত্থাও ছাড়া যাবেনা। পথঘাট ভালো না এখনকার। তোমার কাজ ভাগাড়ে যাক।

মিহির বিবশ মুখে এগিয়ে এলো। রোকেয়া মাসনুনকে কীসব বুঝিয়ে-সুজিয়ে টেবিলে এনে বসালো। খাওয়া শেষ করে বের হওয়ার সময় মাসনুন অসংখ্য বার রাগী চোখ রাঙানী দিলেও শ্বাশুড়ির সামনে কিছু বলতে পারেনি। আর এই সুযোগের সৎ ব্যবহার করেই মিহির সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। রোহান আর রুহি এখনো ঘুমে, ওদেরকে সাথে আনার কথা কয়েকবার বলেছিল মাসনুন তবে রোকেয়া বা আছিয়া কেউ ই অনুমতি দেয়নি। যেহেতু দুজন প্রথম একা কোথাও একসাথে বেরোচ্ছে তাই আর সাথে দেননি। অন্তত দুজন একেলা সময় তো কাটাতে পারবে একটু এই ভেবে।

বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে দুজন। মিহিরের বাড়ি থেকে মাসনুনের বাড়ির দূরত্ব বাসে করে এক ঘন্টা। মিহির খানিক উশখুশ করে হাত বাড়িয়ে বলল,

– ব্যাগটা আমার হাতে দাও।

– আমার ব্যাগ আমিই নিতে পারবো।

মিহির এমন গরম চাহনি দেখে লোক সমাগমে আর কিছু বলল না। মিনিট খানেকের মাথায় বাস এসে দাঁড়ালে হাতের ব্যাগটা বক্সে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে আগে আগে উঠে বসলো মাসনুন। মিহির পিছু পিছু গেলেও পাশাপাশি বসার সুযোগ টা আর পেলো না। মাসনুন একটা বয়স্কা মহিলার পাশে বসে পড়েছে। অগত্যা শুকনো মুখে পাশের সাড়িতে বসলো মিহির। বাস চলতে শুরু করেছে, একটু পরপরই আড়চোখে মাসনুনের দিকে তাকিয়ে ওকে ডাকার চেষ্টা করলো মিহির। মাসনুন যে ওকে ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে পেরে ব্যর্থ মনে চুপ করে রইলো। খানিক পর আবারও তাকালে মাসনুনের পাশে বসা বৃদ্ধা মহিলার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখাচোখি হলে অপ্রস্তুত হাসলো মিহির। মহিলা কর্কশ স্বরে বললেন,

– এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো ছেলে। মেয়ে মানুষ দেখলে খুশখুশ করে নাকি?

মিহির বোকা হেসে বলল,

– না চাচী। আসলে আপনার পাশে যিনি বসেছেন তিনি আমার বউ সাহেবা। আসলে একটু ভুল করে ফেলেছি তো তাই ক্ষেপেছে।

বৃদ্ধার যেনো বিশ্বাস হলো না। তীক্ষ্ণ চোখে বলল,

– মিথ্যে বলছিস।

– না না। কসম করছি চাচী। এই যে আপনার মাথা ছুঁয়ে বলছি।

বলে হাতটা মহিলার মাথায় রাখার জন্য বাড়ালেই মহিলা তড়িঘড়ি করে সরে গেলো। এক পলক মাসনুর দিকে তাকিয়ে বলল,

– আমারে ধরে মিথ্যে বললে পরে মরেটরে গেলে! বস তুই তোর বউয়ের পাশে।

বলে উঠে এলে মিহির সোনায় সোহাগার ন্যায় চোখে মুখে ঝিলিক নিয়ে এসে বসলো মাসনুনের পাশে আর বৃদ্ধা বসলেন ওর সীটে। মাসনুন সীটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। যানবাহনের শব্দ আর কোলাহলে মিহির আর বৃদ্ধার কথা ওর কানে আসেনি। চোখে মুখে রোদ উপচে পড়ায় মুখ কুঁচকে নিলো বিরক্তির সাথে। হুট করেই মুখের ওপর একটা ছায়ার আভাস পেলে চোখ খুলে তাকালো। মিহির ওর বাঁ হাতটা খুব যত্নে মাসনুনের মুখের ওপর ধরে রেখেছে। মাসনুন ওর দিকে তাকালে এগিয়ে এসে পর্দাটা টেনে দিলো। মাসনুন এক মুহুর্তের জন্য থমকালেও পরমুহূর্তেই ধমকে বলল,

– আপনি এখানে কী করে এলেন? সরুন বলছি আমার পাশে কোন সাহসে বসেছেন?

– আরে আস্তে আস্তে কথা বলো। দ্যাখো লোকজন সাইড আই দিচ্ছে আমাদের। নির্ঘাত মেয়েঘটিত কেস ভেবে আমায় ইভটিজার ভেবে কেলানি দেবে।

– তুমি করে বলছেন কেনো? একদিনে দরদ উথলে পড়ছে? বাস থেকে নেমে সোজা উলটো পথে হাঁটা না ধরলে খবর করে রেখে দেবো।

.
.
.
চলমান

#Humu_❤️