বুক পিঞ্জরায় পর্ব-০১

0
181

#বুক_পিঞ্জরায় (০১)
ফাতেমা তুজ জোহরা

এক.

মাথায় ভালো করে হিজাবটা পড়ে আয়নায় আরেকবার ভালো করে দেখে নিলো মেহের। আজকে হবু বরের সাথে সাক্ষাৎ আছে। বলতে গেলে প্রথম সাক্ষাৎ। মেহেরকে না জানিয়েই পাত্র ঠিক করে রেখেছেন মেহেরের বাবা মাহফুজ। বন্ধুর ছেলে বলে বিনা বাক্যে নিজের জেষ্ঠ্য কন্যার সহিত বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু মেহের চায় নিজের ভবিষ্যৎ স্বামী সম্পর্কে বিয়ের আগে অবগত হতে। হিসেবে না মিললে এই বিয়েতে সে কোনোভাবেই মত দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। সেই দরুন আজকে যাবে সেই ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে। দেখা করার ব্যবস্থা মাহফুজ নিজেই করে রেখেছেন। কাছের একটা রেস্টুরেন্টেই হবে সাক্ষাৎ। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে এসে তৈরি হয়ে নিলো বের হওয়ার জন্য। ছেলেটার সাথে আগে কখনো দেখা হয়নি মেহেরের। সে সচারাচর ছেলেমানুষ থেকে দূরেই থাকে। বলতে গেলে, দূরে থাকাটা সে পছন্দ করে।

বাহিরের আবহাওয়া কিছুটা মন খারাপের মতো। মানে মেঘ করে গুমোট হয়ে আছে। এই বুঝি বৃষ্টি এলো। এমন সময় বাহিরে বের হতে ইচ্ছা হয় না মেহেরের। কিন্তু বাবার এতটুকু কথাতো মানতেই হবে। কাছাকাছি ভালো একটা রেস্টুরেন্টে সিট বুকিং করা হয়েছিল। মেহের এখন সেখানে উপস্থিত। তাকিয়ে আছে থাই গ্লাসের বাহির পানে। অপেক্ষা করছে মেহরাবের। মেহরাব সেই ব্যক্তি, যার সঙ্গে মেহেরের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। লোকটার সময় জ্ঞান খুব সম্ভবত কমই আছে। প্রায় আধ ঘন্টা যাবত মেহের বসে আছে। কিন্তু মেহরাবের দেখা নেই। ছেলেটার কাণ্ডজ্ঞান আসলেই নেই। ইতোমধ্যে ওয়েটার এসে খাবার অর্ডার করবে কিনা জিজ্ঞেস করে গিয়েছে দু’বার। কেমন একটা লজ্জাজনক ব্যাপার। মেহের ধৈর্য নিয়ে বসে আছে। আগামী দশ মিনিটের মধ্যে লোকটা না এলে নিজেই খাবার অর্ডার করে খেয়ে চলে যাবে বলে ভেবে ফেলেছে।

মেহরাব এলো ঠিক চল্লিশ মিনিটের মাথায়। কেউ কাউকে আগে দেখেনি। তবে দুজনার ফোন নম্বর দু’জনকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। মেহের চাইলেই মেহরাবকে কল করতে পারতো। কিন্তু তা সে করেনি। লোকটার সময়জ্ঞান হিসেব করার জন্য কল করেনি। মেহরাব রেস্টুরেন্টের কিছুটা ভেতরে এসে কল করতে নেয় মেহের এর নম্বরে। কল করতে নিয়েও কল করলো না। চলে গেলো রিসিপশনে। জিজ্ঞেস করলো বুকিং করা সাত নম্বর টেবিলের কথা। রিসিপশনিস্ট দেখিয়ে দিলো সাত নম্বর টেবিল। মেহরাব টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে দেখলো একটা মেয়ে বসে আছে। পড়নে গাউন জাতীয় কিছু আর মাথায় হিজাব। যথাসম্ভব চুপচাপ বসে আছে মেয়েটা। আশেপাশে সম্ভবত তার নজর নেই।

মেহরাব এগিয়ে গিয়ে মেহেরের বিপরীত পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “হ্যালো, আপনি কি মেহের ?”

মেহের চোখ তুলে তাকালো সেদিকে। তারপর বলল, “আসসালামু আলাইকুম, আমি মেহের তুবা।”

মেহরাব কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর আস্তে করে বলল, “ওয়া আলাইকুম আসসালাম।”

মেহের স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “চল্লিশ মিনিট লেট।”

মেহরাব হাসলো। এমন ভাবে হাসলো যে তার দাঁতকপাটি দেখা গেলো। হাসতে হাসতে বলল, “আরো লেট হতো। কোনোরকমে ছুটে এসেছি। কি আর করবো বলুন, ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিতে দিতে আপনার সাথে মিটিং এর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়তেই ছুটে এলাম। তা কি খাবেন বলুন ?”

মেহরাবের কথা শুনে মেহেরের বেশ রাগ হলো মনে। হয়তো লোকটার আক্কেল-জ্ঞান সম্ভবত একেবারেই নেই, নয়তো ইচ্ছে করেই এমন করেছে। বিয়ে সাবজেক্টটা বেশ সিরিয়াস ম্যাটার। পাত্র-পাত্রীর সাক্ষাৎ বেশ জরুরি একটা বিষয়কে এই লোকটা এত হালকা ভাবে কিভাবে নিয়েছে ? তার তো আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার কথা। আরো কতরকম প্রশ্ন মেহেরের মাথায় খেলে বেড়াচ্ছে। যে কারণে মেহরাবের বলা শেষ প্রশ্নে তার খেয়াল নেই। তাকিয়ে রইলো মধ্য টেবিলে রাখা ফুলদানির ফুলের দিকে। মেহরাবও যেন পাত্তা দিলো না। নিজের মতো করেই সব খাবার অর্ডার করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে এলো। মাঝখানে চলে যাওয়া সময়টুকুতে দু’জন দুজনার সাথে খুব স্বল্প কথা বলেছে। খাবার অর্ডার দিয়েই মেহরাব ফোন বের করে টেপাটেপি শুরু করে। যেন তার সামনে কেউই উপস্থিত নেই। মেহরাবের সব কিছুই যেন মেহেরের বিরক্ত লাগছে। লোকটার দর্শনকে শূন্য মান দেয়া যায় না, কিন্তু তার ব্যাবহারকে অনায়াসেই শূন্যের কোঠায় দাঁড় করানোর মতো মান দেয়া যায়। মেহের খাবার আসার পূর্বে একটা প্রশ্নই শুধু করেছে, “বিয়ে নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?”

মেহরাব গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলেছিল, “পরিকল্পনা আর কি হবে। জাস্ট বাপের টাকা খরচ করে বিয়ে করবো, বাচ্চাকাচ্চা হবে ইত্যাদি। এইতো, এতটুকুই।”

মেহরাবের এই কথা শুনে মেহের আর কোনো প্রশ্ন করেনি। যা বুঝার সে বুঝি গিয়েছে। এমন খাপছাড়া ব্যক্তির সাথে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আজকে বাসায় ফিরে এর ব্যবস্থা করতেই হবে। নয়তো নিজেকে সাগরে স্বইচ্ছায় ভাসিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা হবে। খাবার পরিবেশন করে দিয়ে গেলো ওয়েটার। মেহের লক্ষ করলো এখানে যা খাবার দেয়া হয়েছে সেগুলো তার পছন্দ হচ্ছে না। খাবারগুলো দেখে মনে হচ্ছে বেশ ঝাল হবে। এই খাবার গলদকরণ করলে পেটে সমস্যা হবে নিশ্চিত। মেহের ওয়েটারকে আবার ডাক দিয়ে স্যুপ অর্ডার করলো।

মেহরাব খাওয়া শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। খাবার খেতে খেতে মেহেরকে বলল, “সে-কি আপনি এগুলো খাবেন না ? খাবার কিন্তু বেশ সুস্বাদু।”

মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সুস্বাদু হতে পারে। তবে আমার জন্য নয়। ঝাল আমার অপছন্দের জিনিস।”

মেহরাব বলল, “ওহো সরি। এখন তাহলে শুধু স্যুপটাই খেতে হবে আপনার। আচ্ছা আপনি এরকম আদিকালের মেয়েদের মতো কেন ?”

মেহের দ্রুত বলল, “আদিকালের মেয়ে বলতে আপনি কি বুঝাতে চাইছেন ?”

মেহরাব গ্লাস থেকে এক ঢোক পানি পান করার পর বলল, “এই যে লম্বা লম্বা জামা পড়েছেন। তার উপর পুরো মাথা পেঁচিয়ে রেখেছেন কাপড়ে। হিজাব না কি জানি বলে এটাকে। আপনার কি অস্বস্তি হয় না এতে ?”

মেহের বলল, “এতে অস্বস্তি হবার কি আছে ? একটা শৃঙ্খল পোশাককে আপনার আদিকালীন পোশাক কেন মনে হচ্ছে ?”

মেহরাব মুখের খাবারটুকু শেষ করে সামনের দিকে হালকা ঝুঁকে বলল, “মেয়েদের কত সুন্দর সুন্দর ড্রেস আছে। খোলা চুল বা ডিজাইন করে বাঁধা চুল দেখতে সুন্দর। সাথে সাজগোছ। মেয়েদেরতো এমনিতেই সুন্দর দেখায়। তার সৌন্দর্য কি দেখাবে না নাকি ? এভাবে প্যাকেট হয়ে থাকলে সৌন্দর্য প্রকাশ পায় নাকি ?”

স্যুপ চলে আসাতে মেহের আর কথা বাড়ালো না। মেহরাব ভাবলো মেয়েটাকে যথাযথ হেনস্তা করতে পেরেছে। বাবার পছন্দে এমন একটা মেয়েকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। এদিকে মেহের ভাবছে, গাধার সাথে তর্কে জড়িয়ে লাভ নেই। চুপচাপ নিজের খাওয়াতে মনোযোগী হলো। খাওয়া শেষ করে ডাকলো ওয়েটারকে। শুধু স্যুপের মূল্য দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এখানে মেহরাবকে এক প্রকার অপমান করা হয়ে গেলো। মেহরাব বিষয়টা বুঝতে পারলো। পরিস্থিতি ভিন্ন করার লক্ষ্যে মেহরাব হেসে বলল, “আরেহ বিল আপনি দিতে গেলেন কেন ? ওটাতো আমিই দিয়ে দিতাম।”

মেহের তার হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, “আমার খাবারের বিল আমি পরিশোধ করতে পারি। অতটুকু সামর্থ্য আমার আছে।”

মেহরাব বলল, “আমি সামর্থ্য নিয়ে কিছু বলিনি। বেশিরভাগ সময় মেয়েদের খাবার বিলতো ছেলেরাই দেয়।”

মেহের বলল, “কে কার বিল দেয় তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপনার সাথে সাক্ষাৎ করা জরুরি ছিল তাই সাক্ষাৎ করতে এসেছি। এর থেকে বেশি এক্সেপটেশন নেই। এবার যা বুঝার বাসায় পৌঁছে বুঝবো। আর হ্যা মিস্টার মেহরাব, আপনার যে ইসলামিক জ্ঞান শূন্যের কোঠায় তা স্পষ্ট। তাই মেয়েদের বাহিরে খোলামেলা দেখতে পছন্দ করেন। আসছি এখন।”

এই বলে মেহের বের হয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। মেহরাব তাকালো না সেদিকে। নিজের মতো করে খাবার খেতে লাগলো যেন এখানে কিছুই ঘটেনি।

দু’জন উলটো স্বভাব ও মানসিকতার মানুষের মধ্য কি আসলেই বিয়ে সম্ভব ?

চলবে…