অতিরিক্ত চেয়েছি পূর্ণতায় পর্ব-০২

0
540

#অতিরিক্ত_চেয়েছি_পূর্ণতায়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০২

ইফতিয়াসের বাসররাত পূর্ণের চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। তারই মাঝে সকাল দশটায় পুলিশের দর্শন পেল সদ্য বিবাহিত দম্পতি।

‘দিজ ইজ ইউর এরেস্ট ওয়ারেন্ট। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট মিস্টার ইফতিয়াস আহমেদ।’

‘কি বলছেন এসব অফিসার আমার ছেলের অপরাধ কি? সে তো কিছুই করেনি। বরং গতকাল তাদের বিয়ে হয়েছে।’

‘আই ক্যান্ট ডু এনিথিংক স্যার। আপনার ছেলে একজন মহিলা অফিসারের সঙ্গে বেঈমানী করেছে। এর শাস্তি তো প্রাপ্য বটে।’

বাসার মধ্যে আগত বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে যাত্রীগণ তখনো রয়ে গিয়েছিল বউভাতের উদ্দেশ্য। ভোর থেকে বউভাতের আয়োজন চলছে। তারই মাঝে ইশিতাকে নতুন বউরুপে সকলের সামনে বসানো হয়েছে। পুলিশের সমাগমে যেন সকলের অবাকতা প্রকাশ পাচ্ছে। মিসেস রহমানা স্বামীর বাহু ধরে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,

‘ওগো এরা কি বলছে ইফতি বাবু কেনো কারো সঙ্গে বেঈমানী করবে। এ শিক্ষা আমরা দেয়নি। তাহলে…?’

স্ত্রীকে উত্তেজিত না হতে দিয়ে নাহিরউদ্দীন সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে অফিসারকে পাকড়াও করে বলে,

‘কি প্রমাণ দিয়েছে আপনাদের সেই মহিলা অফিসার! যে আমার ছেলে বেঈমানী করছে। কে ঐ মহিলা ডাকেন তাকে!’

‘ডাকতে হবে না আমি নিজেই আসছি।’

পরিচিত কণ্ঠস্বরে যেন ইফতিয়াস ও তার বউ ইশিতাসহ পরিবারের সকলের জ্ঞান উবে যাওয়ার উপক্রম। মাঝে নিরবে নিশ্চুপে মিটমিটিয়ে হাসে পুরুষ অফিসারটি। সেও আড়চোখে পিছে ঘুরে তাকায়। পরিপূর্ণ পুলিশের ইউনিফর্মে যাকে হেঁটে আসতে দেখল। সবাই যেন বাকরুদ্ধ। পুলিশের ইউনিফর্ম, মাথায় হিজাব, চেহারায় কোমল সাজে সজ্জিত হয়ে আসছে রাফিয়া। পুরুষ অফিসারের নিকট দাঁড়ায়। সে রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘মিট মাই পার্টনার ইন পজিশন মিস রাফিয়া বুহিয়ান। তার কাছ থেকে আসা এরেস্ট ওয়ারেন্টের গ্যারান্টি কেমন বিস্তারিত সেই বলবে।’

রাফিয়া অগ্নিদৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকায়। অথচ ইফতিয়াস ভয়ে ঢোক গিলে। ইশিতা তো ভাবেওনি তার বান্ধবী নিম্নপেশা স্বরুপ অফিসার পদে জয়েন করেছে। ভার্সিটি থাকাকালীন সময়ে বলে ছিল তার পেশাটি নিম্ন হলেও সর্বোচ্চ। ইশিতা অবাকের চেয়ে ঘাবড়ে যাচ্ছে বারংবার। কেননা যদি তার সত্য সামনে চলে আসে। তবে সে ইফতিয়াসকে হারিয়ে ফেলবে। ইশ! আজ বুঝতে পারল রাফিয়া কেনো কোনো ছোট পেশাকেও অমূল্যরত্ন বলে উপাধি দেয়। কারণ সে নিজেই উচ্চতে থেকে নিম্নের সম্মান করে বলে। ইফতিয়াস রাফিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোরাচুক্ষ করার চেষ্টা করে। রাফিয়া বাঁকা হেসে আনমনে আওড়ায়।

‘গেম আমি ওভার বলে ছিলাম। তাই গেম কন্টিনিউ করার সাধ্য তোর নেই ইফতি।’

মিসেস রহমানার কর্কশকণ্ঠে রাফিয়ার নজর তার খালার উপর পড়ে। তিনি বিলাপ করে তাকেই দোষী সাব্যস্ত করছে। যা রাফিয়া কর্ণপাত না করে। কান চুলকানোর ভান ধরে পকেট থেকে একটি সিডি বের করে। থেমে যায় মিসেস রহমানার বিলাপ। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

‘রাফু কি এটা?’

কথ্যহীন নিজ সামর্থ্যে সিডিটা টিভির সঙ্গে সংযুক্ত করে প্লে করল। বড় স্ক্রিনে ভেসে উঠে ইফতিয়াসের সঙ্গে এক মেয়ের কথোপকথনের দৃশ্য। ইফতিয়াস মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে আবেদনীয় কণ্ঠে বলছে।

‘শোনো জান বিয়ে আমার অনেক পরে। আগে তোমাকে আপন করে নেয়। বিশ্বাস কর পছন্দই করি না ইশিতাকে। আর না রাফিয়াকে। সে তো আমার খালাতো বোন। তার সঙ্গে টাইমপাস করছি।’

মেয়েটি খানিক চেপে ধরে বলে,

‘আমার সঙ্গে প্রতারণা করবে না তো! তোমাকে বিশ্বাস করে এসেছি রুমডেট করতে।’

ইফতিয়াস উত্তেজিতভরা গলায় মেয়েটিকে কোলে উঠিয়ে বলে,

‘আই লাভ ইউ সোনা।’

মেয়েটি লাজুক হেসে মুখ লুকায়। টিভিস্ক্রিন কালো হয়ে গেল। অর্থাৎ সিডি অফ হলো। নাহিরউদ্দীন সাহেব ও মিসেস রহমানার চোখজোড়ায় পানি এসে ভরপুর। তিনি ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। মাথায় হাত রেখে চোখ বুজে নেয়। মিসেস রহমানা ঘৃণ্য দৃষ্টিতে ইফতিয়াসের দিকে তাকিয়ে এগোয় গেল। কিছু বলার পূর্বে আরো একটি দৃশ্য ভাসমান হলো টিভির স্ক্রিনে। যেখানে ইশিতা হাতে টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে অসহায় কান্নামাখা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐ ইফতিয়াসের জালে বদ্ধ হয়ে ইজ্জত হারানো মেয়েটি। আকুতিভরা কণ্ঠে হাতজোড় করে ইশিতাকে সে বলছে।

‘আপু প্লিজ আমার গর্ভের সন্তানের দোহাই লাগি। আপনি বিয়েটা করবেন না। আমি ও আমার সন্তান যাবো কই?’

‘যাবে কই তারই ব্যবস্থা করতে টাকাগুলো দিচ্ছি। বহু বছরের প্রতিক্ষার পর ইফতিয়াসকে হাতে পাওয়ার পর্যায়ে এসেছি। এত সহজে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মেয়ে আমি নয়। ঐ রাফিয়াকে দেখেছিস তোর মতই সরল খালাতো বোন তার। কিন্তু আফসোস রিলেশনে থেকে তৃপ্তি পায়নি ইফতিয়াস। তাই তো রুমডেটের কথা বলতেই ইফতিয়াসকে সেদিন রাগে চ’ড় দিয়ে ছিল। ফলে রিলেশনশিপ ভঙ্গন হলেও পিছপা ছাড়েনি রাফিয়া। প্রিয় মানুষকে মানানোর চেষ্টা করে। সে তো জানতই না তার প্রিয় মানুষটি তারই বান্ধবীর সঙ্গে রঙতামাশায় মেতে আছে। বোকা মেয়ে একটা। যাই হোক বাচ্চার এর্বোশনের টাকা সহ তোমার ঘর পরিবারের খরচাও দিলাম। যদি ইফতিয়াসের সঙ্গে তোমাকে কথা বা দেখা করতে দেখি তবে তুমিসহ তোমার পরিবার সূর্যের কিরণ দেখার সুযোগ পাবে না।’

অসহায় মেয়েটি নিরুপায় হয়ে টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায়। টিভির স্ক্রিন পুনরায় কালো হয়ে গেল। মিসেস রহমানা অগ্নিশর্মার দৃষ্টিতে ইশিতার দিকে তাকায়। ইফতিয়াস ভাবেওনি তার সন্তান মেয়েটার গর্ভে ছিল। অজান্তেই তার চোখজোড়া হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আকস্মিক ঠাস করে চ’ড় পরার শব্দে সকলের রসিকতার কেন্দ্রবিন্দু হলো ইফতিয়াস। মিসেস রহমানা ছেলের গালে এক চ’ড় মে’রে ক্ষান্ত হয়নি। পরপর তিনবার চ’ড়ে গালের নকশা বদল করে দেয়। ইশিতাকে তো তার বাবা এসে চ’ড় লাগায়। ঘাড় ধরে তার স্ত্রীর নিকট নিয়ে গিয়ে বলে,

‘এই অসভ্য ন’ষ্টা মেয়ে কেমনে তোমার গর্ভ থেকে বের হলো? মে’রে ফেলতে পারলে না।’

ইশিতার পুরু পৃথিবী থমকে গেল বাবার কাছ থেকে ঘৃণ্য মন্তব্য শুনে। তার মাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। ধাক্কা দিয়ে মেঝের দিকে ছুঁড়ে দেয় তাকে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আমার কোনো ইশিতা নামের মেয়ে নেই। আমার শুধু একটাই ছেলে ইশরাক। ওগো চলো এখান থেকে মেয়েটার চেহারা অব্দি দেখতে মন চাইছে না।’

স্বামীকে ধরে বেরিয়ে পড়ে আহমেদ বাড়ি থেকে ইশিতার পরিবার। নাহিরউদ্দীন সাহেব ধীরস্থির শরীর নিয়ে উঠে রাফিয়ার সঙ্গে থাকা পুরুষ অফিসারের নিকটস্থ হলো। হাত বিনতি করে বলে,

‘স্যার আমাদের মুখ দেখানোর কোনো পথ নেই। তবে যে সন্তান তার বাবা-মায়ের মাথা নিচু করে সে সন্তান কখনো রক্তের হয় না। বরং শয়তানের বংশধর বলে তাদের। আপনি চাইলে নিয়ে যান ইফতিয়াসকে। কড়া শাস্তি মওকুফ করেন।’

তিনি আর কথা না বলে সোজা রুমে চলে গেল। মিসেস রহমানা করুণ দৃষ্টিতে রাফিয়ার দিকে তাকায়। কিন্তু রাফিয়া রোবটের মত অন্যদিক চেয়ে রইল। তার ভেতরের তোলপাড় কেউ দেখতে পাচ্ছে না। সে নিরুপায়। আজ সে মুখবন্ধ করে সহে গেলে সত্যটার মুখোমুখি হতে বহু দেরি হয়ে যেতো। সে তাকাতে পারবে না তার আপন খালা ও খালুর মুখের দিকে। তার কারণেই তাদের ছেলের সংসার এক নিমিত্তে উজার হলো। শান্ত দৃষ্টিতে পুরুষ অফিসারের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘দোস্ত কাজটা তুই সেরে ফেল প্লিজ।’

‘চিন্তা নেই তুই যাহ্ গাড়িতে গিয়ে বস। আমি আসছি।’

রাফিয়া দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। ইফতিয়াস নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাসার মধ্যে থাকা মেহমানগুলো রাফিয়ার যে কুৎসিত দৃশ্য গতরাতে দেখেছিল। তা তাদের মাথা থেকেই বেরিয়ে গেল মেয়েটার কর্ম ও সাহসী রুপ দেখে। একে একে বেরিয়ে গাড়িতে বসারত রাফিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে প্রস্থান করছে। কাতির জম্মাচ্ছে নিজেদের। সকলের মুখে রাফিয়ার সুনাম ও ইফতিয়াসের বদনাম মুখরোচিত হচ্ছে। আড়ালে গুপ্তচরের ন্যায় বাঁকা হেসে রাফিয়া। কাল থেকে যে কালবৈশাখী দুনার্ম রটবে এই পরিবারের তা বেশ জানা আছে মিসেস রহমানার। মুখ দেখানোর কোনো পথ রাখল না তাদের ছেলে। ইফতিয়াসকে অফিসার এসে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। ইশিতাকে কয়েকজন মহিলা সংস্থার নারীরা এসে অকথ্য ভাষায় গালি’গালাজ করে মুখে কালি লেপে দেয়। ইশিতা কান্নারত চেহারায় ছুটাছুটি করতে চাইলে দু এক ঘা খেতে হয় তার। মহিলা সংস্থার নারীগণ চলে গেলে মিসেস রহমানা ইশিতাকে ধরে ছিটকায় রান্নাঘরের মেঝেতে ফেলে। তার চুলের মুঠি ধরে বলে,

‘তোর মত কালনাগিনীকে বিশ্বাস করে ফুলের মত নিষ্পাপ রাফিয়াকে ঘর থেকে বের করেছিলাম। হায় আল্লাহ তোর হায়াত কম হোক। কালনাগিনী কোথাকার! এখন থেকে তুই এ বাসার বউ নয় একজন কাজের মহিলার পরিচিতি পাবি। যদি কথার খেলাফ যাস তাহলে খুন্তি ও লাঠির ঘা বেশি করে খাবি।’

ভয়ে ছিটিয়ে উঠে ইশিতা। পুরু দিন কান্নায় পাড় হয় তার।

_______

পার্কের মধ্যে নিরবে বসে আছে রাফিয়া। পরণে নীল রঙের সুতির থ্রিপিচ, চুলগুলো বাতাসের ন্যায় উড়ছে। চোখজোড়ায় জলের ছড়াছড়ি। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মিনি সাইজের আয়না বের করে নিজের কপাল পরোখ করে। কপাল ও ঠোঁটের মাঝে ক্ষতচিহ্নের দাগ। তার প্রিয় মানুষটিকে নিজ হাতে শাস্তি দিলেও রাতশেষে তাকেই স্মরণ করে। এখনো তার অবস্থা স্মরণে ব্যস্ত। খুব কি কম ভালোবেসে ছিল? তাও নয় বরং ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসাও দিয়ে ছিল। ইফতিয়াস তার আপন খালাতো ভাই। একসঙ্গে ছোট থেকে খেলেমেতে বড় হয়েছে। কখনো প্রিয় মানুষের নজরে দেখেনি। তবুও ছেলে মানুষ সে গড়নের সঙ্গে শারীরিক চাহিদাও প্রখর হচ্ছিল তার, নানান বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশায় নানান অসৎ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করল। কিন্তু রাফিয়া কখনো অসৎ সঙ্গের দিকে পা বাড়ায়নি। সৎ সঙ্গরুপে বান্ধবী জুটিয়েছে। তবুও কোথাও এক খুঁত ছিল বলে সৎয়ের মাঝেও অসৎ রুপী প্রতারক ঢুকে পড়েছিল। সে যে ইশিতা। তপ্ত শ্বাস ফেলে উম্মুক্ত কণ্ঠে বলে,

‘বেঈমানদের বিশ্বাস করব না। ভালোবাসা বলতে নেই কোনো অর্থ, শব্দ। মেয়েখেলা হলো তাদের স্বভাব।’

আকস্মিক কারো আহট অনুভব করে চমকে উঠে রাফিয়া। তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কেউ নেই। দৃষ্টিজোড়া বুলিয়ে যেই না সামনে ফিরবে তখনি কেউ ‘ভাউ’ করে ভয় লাগিয়ে দেয় রাফিয়া। সে তো ভয়ের চটে টাস্কি খেয়ে ঘাসের উপর ধপ করে পড়ল। চেয়ারে বসা ছিল আনমনে ভয়ের চটে পড়ল সোজা ঘাসের উপর। সামনের ব্যক্তি হা হা করে হেসে বলে,

‘ভীতুনি দেখি এক ভাউতে সোজা ঘাসে পড়ল। ইশ! কি গন্ধ বের হলো তোর পিছ থেকে। গন্ধে থাকা যাচ্ছে না। ঘাসও মনে হয় তোর গন্ধের কারণে রঙিন হয়ে গেছে।’

রাফিয়া বেকুব দৃষ্টিতে মুখ হা করে তাকিয়ে বলে,

‘ছিঃ হারামীর লেজ কোনখান আমার অসুস্থতার ফায়দা তুলছিস তাই না?’

লোকটা শয়তানি হেসে বলে,

‘চাকরাণীর ফায়দা যখন তখন তুলা যায়।’

রাফিয়া মুখ খুলবে তার পূর্বেই সামনের ব্যক্তি গেয়ে উঠে।
‘এই যে মিস শুনেন প্লিজ!
সিগনাল আছে কি?
বলতে চাই একটি কথা
আপনি মানবেন কি?
আমার ঘরের থালাবাসন মাজার
চাকরাণী হইবেন কি?
ভালোবাসার ওয়াশরুমটা আপনি
ইউজ করবেন কি?
আমার পিছে ঘুরে ঘুরে আপনি
বলবেন অর্ডার আছে কি?
বুঝতে গিয়া এই আপনারে
বুইঝাও বুঝি না।’

আকাশে প্লেন উড়ার শব্দে ধ্যান ফিরে রাফিয়ার। সে আবুলমার্কা চেহারায় তাকিয়ে রইল সামনের ব্যক্তির দিকে। যার মুখশ্রী জুড়ে প্রাণচাঞ্চল্য হাসি বিরাজমান,ভ্রুজোড়া রসিক ব্যক্তির ন্যায় সাময়িক বাঁকানো,গালে একটা ছোটখাটো টুল পড়ছে,চোখের মাঝে যেন নেশাবুদ এক দৃশ্য সুস্পষ্ট দেখতে পেল সে। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে থতমত খায় রাফিয়া। সামনে বসা ব্যক্তি হা হা করে হেসে দেয়। ঠাস করে রাফিয়ার পিঠে মৃদু হাত চালিয়ে চাপ্পড় দেয়। এতেই আর্তনাদের শব্দ বের করে সে। থেমে যায় হাসি তার। মৃদু কণ্ঠে রাফিয়ার হাত ধরে বলে,

‘সরি রে বেশি জোরে লেগেছে কি?’

পরম স্নেহের ন্যায় কথাটি যেন রাফিয়ার বুকপিঞ্জরে গিয়ে লাগল। নিশ্চুপে মাথা ডানে-বামে নাড়ায়। সামনের ব্যক্তি আড়চোখে রাফিয়ার দিকে চেয়ে আকস্মিক বলে উঠে।

‘বাই দ্যা ওয়ে আমার গানটা কেমন লাগল তোর বলিস নাই যে?’

গানের কথা মাথায় আসতেই রাফিয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। ফলে মুখটা গম্ভীরতায় ছন্নছাড়া হলো সামনের ব্যক্তির। মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘এত হাসার কি হলো? চাকরাণী বানানোর অফার দিছি তোকে। রাজি না হয়ে উল্টো হেহেহে করে হাসছিস লজ্জা করে না তোর। ‘

‘গানের সর্বনাশ করে আমাকে অফার দিলি! তোর নিজের লজ্জা করছে না তাশরীফ খানের গানের বারোটা বাজাতে?’

‘না সে তাশরীফ খান সোজা ক্যারেক্টার হলে, আমি তাওসীফ রুজহান ঘাড়বাঁকা ক্যারেক্টার হাহ্। এন্ড ইউ আর মাই ডেসন্টি।’

শেষের কথায় রাফিয়া চকিত দৃষ্টিতে তাকায় তাওসীফের বলে,

‘ডাস্ট সরি মাই ডাস্ট বলতে গিয়ে মুখ ফসকে ডেসন্টি বেরিয়ে গেল। তোর মত পেত্নীকে ডাস্টে না পানিতে নাকানিচুবানি খাওয়ানো উচিৎ। পেত্নী কোনখান!’

মেজাজ বিগড়ে গেল রাফিয়ার। তাওসীফের চুল ধরে নেড়েচেড়ে পাগল বানাতে তৎপর হলো। গলা উচিঁয়ে বলে,

‘ওই শিয়ালের এক নাম্বার প্র’স্রা’ব, চিপাগলির দু’নাম্বার মাল,বিড়ালের লেজ তোর সাহস দেখে আমি অবাক ! লাপাঙ্গাগিরি একদম আমার সামনে দেখাবি না। পেত্নী বলছিস না আমাকে। তুই হলি একটা পেত্না বুঝছিস। তোর ঠ্যাং ভেঙ্গে সিংহকে খাওয়ায় দেব। চোরের ঘর চোর কোনখান।’

ঠাস করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাকে। ধপাস করে মেঝেতে পড়ে ‘আহ্ মে’রে দিল রে শাকচুন্নী রাফানী!’ রাফিয়া মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল। তাওসীফ রাফিয়ার হাসি দেখে ব্যঙ্গ কণ্ঠে উচ্চ স্বরে বলে,

‘ও জনগণ এসে দেখে যাও। তোমাদের আগামী প্রজম্মের ব্যারিষ্টার তাওসীফ রুজহানের উপর এটুকুন মেয়ে চুল টেনে পুরুষ নিযার্তন চালিয়েছে। এই হামলার উচিৎ শাস্তি দায় করা হোক পেত্নীর উপর।’

রাফিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

‘ঢপ মা’রা শেষ হলে এই রোগীর উপর একটু মেহেরবানী করবেন কি ভাইসাহেব?’

সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তাওসীফ। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,

‘বলেন বেয়াইন ম্যাডাম!’

রাফিয়া আহাম্মক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

‘বেয়াইন ম্যাডাম মানে? তুই কি আমার কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে করেছিস।’

‘মাথাভরা গোবররাণী। তুই আসলেই একটা মাথামুটি। তাই ভাবী ইফতিয়াস তোর মত সুন্দরী স্টুপিড ললনাকে হুদাই কেন ছাড়ল! ভালো করছে বোঝা নামল তার ঘাড় থেকে।’

কথাগুলো বলা সহজ হলেও এর প্রভাব ব্যতিক্রমে পড়ল রাফিয়ার উপর। দৃষ্টি লুকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘হুম আমি আসলেই মাথামুটি। তাই হয়ত কপালে একটুখানি সুখ পেতে যেয়েই অভাগী হয়ে গেলাম।’

তাওসীফ রাফিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে সোজা টেনে কোলে উঠিয়ে নেয়। আকস্মিক কাজে ভেবাচ্যাকা খেল সে। ঘু’ষি-মা’ই’র হাত দিয়ে যতখানি পারল দিল। এতে তাওসীফ বিন্দুমাত্র আঘাত পায়নি। বরং দাঁত চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে সামনে এগিয়ে গেল। ক্লান্ত হয়ে রাফিয়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছুটাছুটি করতে নিলে ক্ষিপ্ত হয়ে তাওসীফ ধ’ম’কে উঠে।

‘ওই রাফানী আরেকবার নড়চড় করে দেখ। মেজাজ খারাপে গেলে তোকে সোজা আছাড় মা’র’ব ঐ যে বটগাছ বরাবর। শরীরটাও বানিয়েছিস মোটা চালের বস্তার মত। এত ঘা আমাকে দিয়েছিস তাই বাঁচলি। আমি যদি তোকে একই ঘা দেয় তবে বিশ্বাস কর ফিট খেয়ে পড়ে থাকবি। সো নো মোর ধস্তাধস্তি।’

ধ’মক খেয়ে বাচ্চাদের মত মুখ করে ফেলে রাফিয়া। ঢোক গিলল সে জানে জম্মগত বদ’মেজা’জী ছেলে তাওসীফ। তবে অন্তঃস্থল লুকিয়ে রাখে তার রাগ,হিঃস্রতা। কথায় কথায় হাসে সেই তাওসীফ কথার নড়বড় পেলে চেঁতে উঠে। যার উপর চেঁতে উঠবে তার চৌদ্দ গৌষ্ঠিকেও ধুয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে এই মানব। রিকশার মধ্যে বসিয়ে তাওসীফ স্বয়ং গা ঘেঁষে বসল রাফিয়ার। ভ্রু কুঁচকে চোখের ইশারায় কিঞ্চিৎ দূরত্ব বজায় নেওয়ার আহ্বান জানায় সে। তাওসীফ আড়চোখে ইশারা বুঝেও অবুঝের মত মাথা নেড়ে রাফিয়াকে চেপে ধরে বসল। বেচারী হা হয়ে যায়। নিশ্চিত ফাজলামি পেয়েছে গাধাটা!
ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলবে তার পূর্বেই তাওসীফ হামি দিয়ে বলে,

‘ঐ চাকরাণী শুন তো। কাহিনী খুলে বল। গতরাতে তুই মেডিক্যালে কেমনে পৌঁছেছিলি, আমাকেও বা কল কে দিল, তোর শরীরেও এসব কিসের দাগ, কে তোর গায়ে হাত উঠিয়েছে?’

শেষের কথায় কিছু একটা ছিল তাওসীফের কণ্ঠস্বরে। রাফিয়া শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। প্রত্যত্তুর করেনি। তাওসীফও আগ বাড়িয়ে মেয়েটার হৃদয় ক্ষরণ করতে চাইনি। ফলে বাচ্চাদের মত রাফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

‘ভাবে না মামুনি ভাবো না অতীতের কথা। ভবিষ্যতে আমার মত ব্যারিষ্টার বাবুর ঘরের চাকরাণী হওয়ার স্বপ্ন দেখো। ইশ! আজ যদি প্রধানমন্ত্রীর আসন দখল করতে পারতাম। তবে সংবিধানে একটি নোট অবশ্যই যোগ করতাম যে,’মিস রাফিয়া নামের ব্যক্তিদের কেউ সহজে বিশ্বাস করবেন না। এরা পুরুষ নিযার্তনের দক্ষতা ও চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার সক্ষমতা রাখে। ওয়াও সংবিধানে এই লেখা থাকলে নিশ্চিত তোর মত রাফিয়া নামের মেয়েদের থেকে ছেলে, ছেলের চৌদ্দগ্রাম দূরে থাকবে।’

সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে রাফিয়া সত্যিকার অর্থে তাওসীফের চুল টেনে ছিঁড়েই দিল। বেচারা ‘আহ্ চুন্নী একটা’ বলে অসহায় দৃষ্টিতে রাফিয়ার হাত থেকে ছুঁ মে’রে কালো চুলের টুকরোটা নিয়ে আফসোসের সুরে বলে,

‘বা’ল তুই কাঁদিস না। সাদা হয়ে পেকে যাবি কেমন! পরের জম্মে তোকে অবশ্যই মাথায় লাগিয়ে নেবো। না হলে কারো চুলে ফ্যাভিকল দিয়ে লাগিয়ে দেব। কিছু কিছু চুন্নী বা’ল খেয়ে, টেনে মজা পায়। তাই তোকেও নিযার্তনের শিকার হতে হলো বা’ল ভাই। মাফ করিস আমাকে বা’ল ভাই উম্মাহ্।’

চুলকে চুমু খাওয়ার পূর্বেই রাফিয়া হাতের ঝাকুনি দেয় তাওসীফের। তার হাত থেকে চুলটা বাতাসের তালে উড়ে ছুঁ মন্থর হলো। রিকশা থেমে যাওয়ায় রাফিয়াকেও আর কে পায়! ভৌ-দৌড়ে তাওসীফদের বাসার ভেতর ঢুকে পড়ে। তাওসীফ পেছন থেকে রাগী গলায় বলে,

‘চু’ন্নী তোকে আমি খাইছি।’

রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দৌড় লাগানোর পূর্বেই কল এলো তার ফোনে। পা থামিয়ে ফোনটি বের করে একপলক দেখল। নাম দেখে সে আড়চোখে চর্তুপাশ্ব দৃষ্টি বুলিয়ে কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরল। অপরপাশ্বের ব্যক্তি কিছু কথা বলল। তার কথা শুনে তাওসীফ ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি চওড়া করে।

চলবে…..