অতিরিক্ত চেয়েছি পূর্ণতায় পর্ব-০৫

0
340

#অতিরিক্ত_চেয়েছি_পূর্ণতায়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৫

রাফিয়ার প্লাজু র’ক্তে ভেজে যাওয়ার কারণে তার শুয়ে থাকা স্থানেও স্যাঁত স্যাঁতে পিছলা হয়ে গিয়েছে। চোখে ঝাপসা দেখছে সে। ঘুট্ঘুটে অন্ধকারময় স্থান। শরীর অসহ্য যন্ত্রণার কারণে স্তদ্ধ হয়ে পড়ে রইল। আকস্মিক ড্রিল মেশিনের উচ্চশব্দে কেঁপে উঠল রাফিয়া। চোখ পিটপিটিয়ে খুলার চেষ্টা করে । তবুও পারল না শুধু অনুভব করতে পারল কে যেন তাকে কোলে উঠিয়েছে। পরিপূর্ণ নিস্তেজ হয়ে গেল তার শরীর। ভর ছেড়ে দেয় সেই ব্যক্তির।
রাফিয়ার ভারহীন শরীরের কাতরায় ব্যক্তির বুক ধুক করে উঠল। চোয়াল শক্ত করে নিজের প্রেয়সীর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘রুজহানের জানের উপর হা’মলা করার দায়ে তাকে কঠিনতম শাস্তি দেব আমি। ব্যস তুই সুস্থ হয়ে যাহ্। তোর জানার অনেক কিছু আছে রে জান।’

‘মিস্টার রুজহান আপনার মিসেস এর দূরাবস্থা হওয়ার পূর্বেই মেডিক্যালে চলেন।’

নাবিলের কথায় রুজহান ভাবলেশনহীন দাঁড়িয়ে রইল। চোখের ইশারায় নাবিলকে ধুরে যেতে বলে। ব্যাপারটায় ভ্রু কুঁচকায় সে। বন্ধুর মতিগতি বোঝতে না পেরে সে কদম এগোতে নিলেই, রুজহান তার ঠ্যাং দেখিয়ে থামিয়ে দেয়।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘তোকে দূরে যেতে বলছি। আর তুই মিয়াবিবির মাঝে আসছিস। বলি অফিসার হয়ে কি মগজ গোবর বানিয়েছিস।’

হকচকানো দৃষ্টিতে চেয়ে নাবিল চলে গেল তার জিপের কাছে। রুজহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাফিয়ার প্লাজুর দিকে। লাল বর্ণের ভেজা স্থান দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হালকা করে ভর ছেড়ে রাফিয়াকে দাঁড় করায়। আনমনে বলে,

‘মেয়েটা খালি উড়নচুন্ডী চুন্নির মত বিহেভ করে। নিজের শরীরের অসুস্থতার দিন তারিখও খেয়াল রাখে না।’

নিজ গায়ে জড়ানো জ্যাকেটটি রাফিয়ার কোমরে বেঁধে দেয় রুজহান। যাতে কারো অশুভ দৃষ্টি রাফিয়ার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে না পড়ে। পুনরায় তাকে কোলে উঠিয়ে নাবিলের দিকে এগিয়ে গেল। জিপে অপেক্ষারত নাবিল বউয়ের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিল। একপর্যায়ে নাবিলকে ‘বদ’মাইশ জামাই তোর নামে আব্বুকে নালিশ দেব’ কথাটি তার বউ বলে উঠায়। দমে যায় নাবিল। ঢোক গিলে বলে,

‘আ আচ্ছা হইছে মানছি সরি।’

তার বউ শয়তানি হেসে বলে, ‘দ্যাটস লাইক এ গুড হাজবেন্ড উম্মাহ্।’

ফোনের মধ্যে চুমু দেওয়ায় নাবিল মুখ ফুলিয়ে কল কাট করে। অপরপাশ্বে তার বউ হিহি করে হেসে কল রেখে দেয়। কারো ‘আহেম আহেম’ কণ্ঠ শুনে নাবিল থতমত খেল। রুজহানকে দেখে শান্তশিষ্ঠ বাচ্চার মত মুখ করে বসার আক্ষেপ প্রকাশ করে। রুজহানও কিছু শুনেনি এমন ভাব নিয়ে রাফিয়াকে নিয়ে পেছনে বসল। নাবিল গাড়ি চালু করবে তার পূর্বেই রুজহান ঠাট্টার কণ্ঠে বলে,

‘আজকাল শ্বশুড়ের ভয়েও কেউ ভেজাবিড়াল হয় দেখছি। সেখানে যদি শ্বশুড় কমিশনার হয় তাহলে তো খাইছে কপাল!’

‘ডুড ঠ্যাং না মে’রে নিজের বউয়ের দিকে খেয়াল দেয়।’

‘হুম হুম চলেন মিয়া গাড়ি চালান।’

নাবিলও কথার ছলে গাড়ি টান দিয়ে মেডিক্যালের উদ্দেশ্য প্রস্থান করে।

___

মিসেস আরজিয়া অবাক সহিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাহিরের দরজার সামনে অপেক্ষারত ব্যক্তিকে দেখে।

‘ভাবী ঢুকতে তো দেবেন নাকি খালি দেখে যাবেন।’

মিসেস আরজিয়া মেকি হেসে মিসেস রহমানাকে বাসার ভেতর নিয়ে এলো। জনাব দিবায়েত সাহেব নাহিরউদ্দীনের বউ মিসেস রহমানাকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। তিনি বেশ আশ্চর্য হলো। এত বছরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় আজ হঠাৎ বাসায় আসল। ব্যাপারটি কোনো চার’টি খানি কথা নয়। মৃদু খুশির আমেজ দুজন নিজেদের মুখে ফুটিয়ে মিসেস রহমানাকে সোফার রুমে বসায়। তিনি বসে নাক ছিটায় বাসার পরিবেশ দেখে। টিনের ঘরে থাকে দিবায়েত সাহেবের পরিবার। ব্যারিষ্টার তাওসীফ রুজহানের বাড়ি কিনা টিনের কথাটা আশ্চর্যের হলেও সত্য! তিনি বিনা দ্বিধায় জনাব দিবায়েত সাহেবকে বলে,

‘দেখেন ভাইজান আমার ঘরের লক্ষ্মীকে নিয়ে যেতে এসেছি। তাকে যদি একটু ডেকে দিতেন। তাহলে খুশি হতাম।’

এতক্ষণ যে খুশির আমেজ জনাব দিবায়েত সাহেবের মুখশ্রীতে বিরাজিত ছিল। তা নিমিত্তে মিটে গেল। প্রকাশ পেল একরাশ গম্ভীরতা। ঠোঁট চেপে স্ত্রীর দিকে তাকায় তিনি। মিসেস রহমানা তার বোন নিঝুমের জামাইয়ের পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে মোটেও পছন্দ করে না। তবুও আজ তার থেকে রাফিয়াকে লাগবে। সে বিহীন কোনো ধাপ নেওয়া সম্ভব নয়। মিসেস আরজিয়া হাসার চেষ্টা করে রাফিয়ার খালাকে বলে,

‘ভাবী আসলে হলো কি মেয়ে তো এখন বাসায় নেই। তাই আপনি যদি পরে….।’

‘দেখুন বুঝতে পেরেছি সে বাসায় নেই। তবে তার আসা অব্দি আমি অপেক্ষা করতেই পারি। কিন্তু…।’

মিসেস আরজিয়া ‘কিন্তু’ শব্দে উজবুক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

‘কিন্তু কি ভাবী!’

নাক ছিটিয়ে তিনি সোফার থেকে উঠে দাঁড়ায়। দিবায়েত সাহেবের সোফার রুম হেঁটে দেখতে থেকে চৌপাশ শৌখিন দেখেও তার কাছে সেগুলো লোক দেখানোর মত মনে হচ্ছে। অহং কণ্ঠে তিনি বলে,

‘টিনের ঘরের দেখি শৌখিন করে সাজিয়ে রাখছেন। এর চেয়ে ভালো হতো বড় বিল্ডিং করে বাচ্চাকাচ্চা বিয়ে দিয়ে বিল্ডিং বাড়িতে উঠতেন। যাই হোক আপনাদের কাছে এত টাকা কই ! ভাইজানই তো কাপড়ের ব্যবসা করে চলে। সেখানে ছেলে ব্যারিষ্টার হয়েও কি লাভ হাহ!’

অপমানে মাথানত হলো রুজহানের বাবা-মার। কিন্তু এ অপমান সহ্য করেনি রুজহান। সে রাফিয়াকে মেডিক্যালে চিকিৎসারত রেখে বাসায় এসেছিল বাবা-মাকে নিতে। এসে যে রাফিয়ার অহংকারী খালার সম্মুখীন হবে কল্পনায় আসেনি তার। তবুও রাফিয়ার খালার অহংকারকে অপমান করতে তার বেশ মজা লাগবে ভেবে সেও বাঁকা হেসে বলে উঠে।

‘ওহ আমাদের বাড়ি টিনের হলেও ভদ্রতা ও প্রতারণাহীন মানুষ বাস করে এখানে। কিন্তু যার বাসার ছেলেই প্রতারক এবং এক নাম্বারের কু’কু’রের লেজ। তার পরিবারের শিক্ষা কিরুপ হবে সেটা বোঝাই যায়।’

মিসেস রহমানার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল অপমানে। এই প্রথম তার দিকে কেউ চোখ উচিঁয়ে কথা বলেছে। এর অপমান সহ্য করার মত মহিলা সে নয়। রাফিয়া না থাকায় একদিক থেকে ভালো হলো ভেবে তিনিও আনমনে বাঁকা হাসে। রুজহান ভ্রু কুঁচকে বলে দুহাত পকেটে রেখে ভাবপূর্ণ কণ্ঠে বলে,

‘আপনার লাজহায়াও দেখি উধাও হয়ে গেল। কি টিনের ঘরের শৌখিন সভ্যতা কখনো পাননি বলে এই অবস্থা আপনার সংসারের! ওয়েট মা তুমি এক কাজ করিও। আন্টিকে কখনো কখনো সংসারের সভ্যতা গড়ার টিপস দিও। না হলে সংসার তো বানের জলে ভেসেই যাবে উনার।’

‘চুপ বে’য়া’দব ছেলে! এসেছো থেকে কটু কথা বলেই যাচ্ছো। বাবা-মা কি ভদ্রতা শিখান নি!’

‘সে কি আন্টি ভদ্র বলেই এখন সহিসালামতে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। না হলে বাসার এপার ওপার আপনার দৌড়াদৌড়ি করা লাগতো।’

‘মানে!’

জনাব দিবায়েত সাহেব ও মিসেস আরজিয়া ছেলের কথার উল্টোপিঠে মিসেস রহমানার প্রশ্নে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল। এতে তিনজনের মাঝে রসিকতার রেশ পেলেও মিসেস রহমানা রাগের চটে টেবিলের উপর রাখা তিনটি গ্লাস সজোরে মেঝেতে ফেলে দেয়। তার করা কাজে রুজহান বাদে দুজনে চমকে গেল। তিনি রুজহানের সন্নিকটে এসে নিজের তর্জনী আঙুল দেখিয়ে শাঁসায়।

‘ছেলে ছোট বলে বেঁচে গেছো। না হলে গ্লাস মেঝেতে নয় তোমার মাথায় পড়তো।’

কথাটা শুনে ভয়ের চিহ্নটুকু দেখা গেল না রুজহানের মুখশ্রীতে। বরং সে উল্টো মিসেস রহমানার মুখ বরাবর খানিক এসে বাঁকা হেসে বলে,

‘আপনার কল্পিত দৃশ্যপট বাস্তবে হলে উল্টোটা হতো।’

কথার প্রেক্ষিতে নিজের ভাব প্রকাশ করে শার্টের হাতা সটান করে বাহিরে চলে যায় রুজহান। মিসেস রহমানা হাত মুঠোবদ্ধ করে অপমানগুলো বিরক্তির ন্যায় হজম করে বেরিয়ে যায়। ছোট’লোকের বা’রোভা’তারদের সঙ্গে কথা বলতে তার রুচিতে বাঁধে এমন হাবভাব তার। দিবায়েত সাহেব তৎক্ষণাৎ ফোন বের করে রুজহানের ফোনে কল দেয়। বাইকের উপর হেলমেট পরে বারংবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে সে। যখনি মিসেস রহমানা প্রস্থান করবে তখনি সে তার বাবা-মাকে রাফিয়ার খবর দেবে। মিসেস রহমানাকে তার নিজের গাড়ির কাছে যেতে দেখে হেলমেট পরিহিত অবস্থায় তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রুজহান।

মিসেস রহমানা প্রস্থান করতেই রুজহান তার বুকপকেট থেকে ফোন বের করে দেখল। তার বাবা ইতিমধ্যে তিনটি মিসড কল দিয়ে ফেলেছে । বিধেয় সে নিজ ফোন থেকে কল লাগায়। কল আসায় জনাব দিবায়েত ফোন উঠিয়ে বলে,

‘বাবা তুই খোঁজ পাইছিস রাফু মামুনির! কোথায় আছে সে এখন!’

‘বাবা মেহেরপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চলে আসো। রাফিয়াকে ইমাজেন্সি ভর্তি করানো হয়েছে।’

‘মানে রাফু মামুনিকে মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে কিন্তু কেনো!’

‘এখন কিছুই বলতে পারব না বাবা। তোমরা চলে আসো।’

দিবায়েত সাহেব সময় বিলম্ব না করে নিজের ওয়ালেট ও ফোন পকেটে নিয়ে স্ত্রীর সহিত বেরিয়ে পড়ে। একটা সিএনজি ভাড়া করে উঠে মেডিক্যালের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। বাবা-মা যেতেই রুজহান তড়িঘড়ি বাইক থেকে নেমে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। নিজের রুমে গিয়ে আলমারী খুলে কিছু কাগজপত্র ঘেঁটে ঘুটে দেখার পর তার মন শান্ত হলো। হাতঘড়িতে সময় দেখার পর সেও রওনা দেয় তার প্রেয়সীকে দেখার আক্ষেপে।

____

শ্বাস নিচ্ছে অক্সিজেন মাস্কে রাফিয়া। অক্সিজেন গ্রহণও করছে ও শ্বাসও ফেলছে। তবে ধীরগতিতে তার প্রশ্বাস কার্য চলছে। বিনিময়ে চোখ বুজে রইল রাফিয়া। শরীর দূর্বলতায় মেঝমেঝ করছে যা ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে সে। আশপাশে কাউকে না দেখে হতাশ হলো। পরক্ষণে তার মস্তিষ্কের টনক নড়ে এক দৃশ্যের কথা ভেবে। তাকে কোলে উঠিয়ে কেউ তো মেডিক্যালে এনেছে। কে সে ব্যক্তি! কেমনে তাকে পেল!
অক্সিজেন মাস্ক খুলতে নিলে ‘স্টপ’ বলে থামিয়ে দেয় পুরুষেলী গম্ভীর কণ্ঠের এক মানব। তাকে দেখে বাচ্চাদের মত চোখ পাঁকিয়ে তাকায় রাফিয়া। রুজহান এসে রাফিয়ার কান মলে দেয়। দূর্বল শরীরে হালকা ব্যথাও মারাত্মক লাগছে রাফিয়ার। ‘উহ উহ’ করে মৃদু শব্দ করে উঠে সে। রুজহান ছেড়ে দিয়ে ভাবলেশনহীন গলায় বলে,

‘দেখ ছাড় দিচ্ছি মানে এই নয় তুই উড়ে উড়ে পাখা গজাবি। ছাড় ততটুকু যতটুকু তোর স্বপ্নের প্রাসাদে থাকা প্রিন্স চাইবে। প্রিন্স যদি একবার পাখা কাটতে উদ্ধত হয়। বিশ্বাস কর তোর পাখা কেটে সোজা কাজি অফিসে গিয়ে হাজির হবে।’

অক্সিজেন মাস্কে শ্বাস ফেলে স্বল্পস্বরে রাফিয়া বলে উঠে।

‘কি বল বলছেন!’

‘তোর অসুস্থতা বাড়ানোর লক্ষণ বলতেছি।’

রাফিয়া চোখ পিটপিটিয়ে চাইল। ব্যাপারটায় অস্থির হয়ে রুজহান এক অপরিকল্পিত কান্ড করে বসে। তার করা কাজে চোখ বড় বড় হয়ে যায় রাফিয়ার। মিসেস আরজিয়া ও তার স্বামী ছেলে ও মেয়ের মধ্যকার প্যাঁচ দেখে হতবাক হলো। হা করে তাকিয়ে রইল তারা।

চলবে…..