অনান পর্ব-০১

0
648

#অনান
#পর্ব-১

“কি রে কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? খুব তো নাক সিটকেছিলি যে আমায় বিয়ে করবি না? এখন, এখন কি করবি? বল, বল না?”
“নাআআআআআআ”
নীরা চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে বসলো। ঘেমে নেয়ে একাকার। কি দেখলো এটা? উফফ, হারামি মোর্শেদটা স্বপ্নের মধ্যেও পিছু ছাড়ছে না। জোর করে দু’দিকে মাথা নাড়ে নীরা। নাহ, কিছুতেই না। কাল কিছুতেই মোর্শেদ নামক বাদরটাকে সে বিয়ে করবে না, কিছুতেই না। কিন্তু কি করবো নীরা? বিয়েটা ভাঙার বহু চেষ্টা করেছে নীরা তবুও কিছুতেই কিছু হয়নি। বাবা মা চাচু চাচি সবাই একপায়ে খাড়া হয়ে আছে তার আর মোর্শেদের বিয়ে দেওয়ার জন্য। নীরা ছটফট করতে করতে উঠে দাড়ালো। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলো। কি করবে এখন? ভাবতে ভাবতে মনেহলো এখনই মাথার সব চুল পরে গেলো। নীরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। কতো রাত হয়েছে কে জানে। সন্ধ্যার সময় বিয়ে নিয়ে মায়ের সাথে বচসা করে দরজায় খিল দিয়েছিলো। মা আচ্ছা মতো বকছিলো তাকে আর মায়ের বকা শুনে ছোট ভাই রাতুল দাঁত কেলিয়ে হাসছিলো দেখে প্রচন্ড রাগ হয়ে রাতুল কে জোরে সোরে একটা চর দিয়ে দৌড়ে এসে রুমের ভেতর পালিয়েছিলো। পুরো বাড়িতে লোকজন গিজগিজ করছিলো। অবশ্য তাদের বাসায় লোকজনের ভীড় নতুন কিছু নয়। যৌথ পরিবার বলে সবসময়ই লোকজনের কোলাহল লেগেই থাকে তাদের এই আহমেদ ভিলাতে।

হঠাৎই মাথায় বুদ্ধি খেলে গেলো। নীরা দোতলায় বারান্দা দিয়ে মাথা বের করে ভালোমতো দেখে নিলো নিচে। টুলে বসা হাশেম চাচাকে ঝিমাতে দেখা গেলো। ইয়েস, কাজটা এখনই করতে হবে।
তাড়াতাড়ি রুমে ফেরত এসে নিজের পিঠের ব্যাগটাতে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে পরনের কাপড় পাল্টে নিয়ে বারান্দায় ফেরত এলো। নতুন শাড়ী দুটো নষ্ট করতে খারাপ লাগছিলো নীরার। আজই চাচাীমা এসে দিয়ে গেছিলো তাকে। ধুর, কিসব ইমোশন জাগছে? নীরা ভাবনাগুলো পাত্তা দিলো না। দ্রুত হাতে শাড়ী দুটো গিট দিয়ে গ্রিলের সাথে বেঁধে বার দুয়েক ভালোমতো পরীক্ষা করে খোলা বারান্দা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো। তারপর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সাবধানে শাড়ীতে ঝুলে ঝুলে নিচে নেমে এলো। ভাগ্যিস পুরো বারান্দা গ্রিল দিয়ে ঘেরা নয় আর নীরারা দোতলায় থাকে। তা না হলে হারামি মোর্শেদের হাত থেকে বাঁচা যেতো না কিছুতেই। শয়তান, খবিশ কোথাকার, খুব শখ না আমাকে বিয়ে করার? কাল বুঝবি আমি কি জিনিস! হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ভিলেন মার্কা হাসি দিলো নীরা। ব্যাগ থেকে বড় একটা চাদর বের করে নিজেকে ভালো মতো মুড়ে নিলো। পা টিপে টিপে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। গেটের সামনে হাশেম চাচা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর ই ডাক এলো হাশেম চাচার। সে গেট থেকে সরতেই নীরা টুপ করে বেড়িয়ে এলো। নীরা দ্রুত পা চালালো, যে ভাবেই হোক তাড়াতাড়ি এলাকার বাইরে যেতে হবে। বাই এনি চান্স কেউ দেখে নিলেই বিপদ।
“আরে এতো দৌড়াচ্ছিস কেন? উস্টা খেয়ে দাঁত ভাঙতে চাস নাকি?”
পেছন থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর নীরাকে জমিয়ে দিলো। ইশশশ, এভাবে ধরা খেয়ে গেলো নীরা? নিজের উপরই রাগ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে পেছন ফিরলো নীরা।
“ট্রেনের টিকেট কেটেছিস নাকি বাসের? ভালোই হলো, আমারও ইচ্ছে ছিল পালিয়ে বিয়ে করার কিন্তু তোকে বলার সাহস হয়নি। এমনিতেই আমাকে দেখতে পারিস না তারউপর পালিয়ে বিয়ে? এতটা তো কল্পনা করাও উচিত না, কি বলিস?”
বলে চব্বিশ পাটি ঝকঝকে দাঁত বের করলো মোর্শেদ।
“তুই কি করে টের পেলি?”
চিবিয়ে চিবিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো নীরা।
“উফফ নীরু, তুইও না কেমন বোকার মতো প্রশ্ন করিস? সেই ছোটর থেকে চিনি তোকে। তোর মনে কখন কি চলবে সেটা আমার থেকে ভালো কে জানবে? তবে একটা জিনিস খারাপ করেছিস। নতুন শাড়ী দুটো এভাবে নষ্ট করাটা ঠিক হয়নি। মা এতো পচ্ছন্দ করে শাড়ী দুটো কিনেছিলো তোর জন্য।”
আবারও সেই চিরচেনা খোঁচা দেয়া হাসি দিলো মোর্শেদ।
“সবচেয়ে ভালো হতো তোকে দড়ি হিসেবে ইউজ করতে পারলে।”
“কি বললি এটা? আমি তো ধন্য হয়ে গেলাম। তুই আমাকে একবার বললেই আমি দাঁড়িয়ে যেতাম। ভাবতেই কেমন থ্রিল লাগছে, তুই আমার গা বেয়ে ঝুলে ঝুলে নামছিস!”
“চুপ কর। যতসব ন্যাস্টি ভাবনা তোর।”
নীরা চিৎকার করে। মোর্শেদ হাসতে হাসতে বললো-
“নিজে বললে কিছু না আমি বললেই দোষ। ন্যাকা!”
মোর্শেদ আড়চোখে নীরাকে দেখে নিয়ে কথা ঘুড়ায়-
“শোন আমি জানতাম বিয়ে না করার জন্য তুই কিছুনা কিছু ঘোল অবশ্যই পাকাবি। তাই বেশি কিছু না শুধু তোর দিকে একটু কড়া নজরদারি করতে হয়েছে। হাশেম চাচাকেও তো আমিই ডাকলাম। আফটারঅল তুই আমার হবু বউ তোর এতটুকু ইচ্ছে পূরণ করতে না পারলে আমার মান থাকবে বল?”
“তুই আসলেও খবিশ একটা। দুবছর বিদেশে পড়ালেখা করে নিজেকে খুব চালাক ভাবছিস না?”
আবারও হাটতে শুরু করলো নীরা। মোর্শেদ কোনো কথা না বলে নীরার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো।
“সে আমি আগে থেকেই ছিলাম। তবুও তোর কমপ্লিমেন্ট শুনে গর্ব হচ্ছে। এখন বল যাচ্ছিস কোথায়? বড় আব্বুকে বলতে হবে তো, না হলে আবার তার প্রেশার বেড়ে যাবে। এমনিতেই তোর টেনশনে তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ঢাকায় যেয়ে কি করেছিস কে জানে?”
“আব্বু জানে?”
নীরা আবার দাঁড়িয়ে গেলো। যেন আকাশ থেকে পড়লো এমন ভাবে মোর্শেদের দিকে তাকালো নীরা।
“হ্যা, জানবে না কেন? আমি বলেছি। দাদীমা যে ঘন্টায় ঘন্টায় তোর খবর জানতে চায়। না বললে তো এতোক্ষণে কুরুক্ষেত্র বেধে যেতো। বাড়ি ভর্তি লোকজন এর সামনে দাদীমাকে ছোট হতে হতো না?”
“উহহহহ।”
নীরা দু’হাতে গলা টিপতে এলো মোর্শেদের। মোর্শেদ ভয় পাওয়ার ভান করে লাফিয়ে দূরে সরে গেলো।
“তুই একটা কুফা আমার জন্য। আমি তোকে বিয়ে করতে চাই না শয়তান। তবুও কেন পিছনে পরে আছিস? তোর জন্য ঠিকঠাক মতো পড়াশোনাটা করতে পারছি না। সামনে আমার সেমিস্টার ফাইনাল আর এই সময় আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা জোর করে ঢাকা থেকে ধরে আনলো আমায়।”
“কি যে বলিস না তুই? সেই ছোটর থেকে তোকে বউ জেনেছি। এজন্য লন্ডনে থাকাকালীন কতো সুন্দরী মেয়ের প্রপোজাল ডিনাই করলাম। আর তুই কিনা বলছিস এই কথা? তুই আমায় চ্যালেন্জ করেছিলি যে আমায় বিয়ে করবি না জীবনেও। আমি কি করে তোর এই ইচ্ছা পূরন হতে দেই বল?”
মোর্শেদের জবাব নীরার রাগকে বাড়িয়ে দিলো শতগুন। সে রাগে গরগর করতে করতে আবারও হাঁটতে শুরু করলো।
“আরে আরে যাচ্ছিস কোথায় তা তো বলবি?”
“জাহান্নামে, যাবি?”
“তুই যেতে বললে যাবো। সাথে তুই থাকলে জাহান্নামও স্বর্গ আমার কাছে। তবে ইয়ে মানে বলছিলাম কি সকালে আবার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে। রাতে ঘুম না হলে তো তোকে আবার পেত্নীদের সর্দারনী লাগবে কাল বউ সাজে। তাই বলছিলাম কি চল বাসায় ফিরে যাই।”
“তুই যা। আমি ঢাকায় যাবো।”
“নীরু, তুই আসলেই একটা বোকা। তোর কি মনেহয়, বড় আব্বু সব জেনেশুনে তোকে আমার সাথে এমনি এমনি ছাড়লো? এখন বাজে বারোটা সাইত্রিশ, আমি যদি তোকে নিয়ে একটার ভেতর বাসায় না ফিরি তবে বড় আব্বু নিজে এসে তোকে ঘাড় ধরে বাসায় নিয়ে যাবে। আর বড় আব্বুর রাগ তো তুই জানিসই।”
নীরা হাঁটা থামিয়ে লাল চোখে একবার মোর্শেদের আপাদমস্তক দেখলো। মনেহচ্ছে, মোর্শেদকে ঠাটিয়ে একটা চর দিতে। নিজেকে সামলে নিলো বাপের কথা মনে করে। ওর পালানোর প্ল্যান বাবা আগেই বুঝতে পেরেছিলো এইজন্যই বুঝি এতো শান্ত হয়ে বসে আছে। নীরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে হাটা ধরলো। এই মোর্শেদের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই কোনোভাবেই।
“এই তো, গুড গার্ল। তুই সবকিছু সহজে বুঝে যাস বলেই তোকে এতো ভালো লাগে। যাই বলিস, তোর আমার ক্যামিস্ট্রি জমবে ভালো। কি বলিস?”
“হ্যা, খুব ভালো জমবে। বিয়েটা আগে হতে দে তারপরে বুঝতে পারবি নিজেই।”
নীরা বাঘের মতো হিসহিসিয়ে কথাগুলো বললো। ওকে দেখা মাত্রই হাশেম চাচা মুচকি হেঁসে গেট খুলে দিলো। নীচতলার বড় হলরুম পেড়িয়ে দোতলার সিঁড়ি। নীরা ঘরে ঢুকেই দেখলো বাবা আর তিন চাচা বসে আছে। নীরার বাবা হাসনাত নীরাকে দেখে কিছু বললেন না। বরং পেছনে থাকা মোর্শেদকে দেখে বললেন, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। নীরা দুপদাপ আওয়াজে দোতলায় এলো। তার ভীষণ রাগ হচ্ছে বাবার উপর। কেন? কেন? কেন বাবা এরকম জোর করছে তাকে? মোর্শেদের সাথেই কেন বিয়েটা দিতে হবে তার? যোগ্য ছেলে কি আর একটাও নেই এ তল্লাটে? কতো শখ ছিলো প্রেম করে বিয়ে করবে, পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সব স্বপ্ন ভেস্তে যাবে এই উজবুক এর জন্য। এই যুগে এসে এমনটা করে কেউ? এখনো সেই আদিম যুগের মতো নিয়ম চলছে তাদের বাড়িতে। তাদের পরিবারে অন্তত একটা বিয়ে নাকি হতে হবে নিজেদের ভেতর। এটাই বলে এ বাড়ির নিয়ম। বংশ আর ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য নাকি এটাই করতে হবে। দাদারও বিয়ে করতে হয়েছিলো চাচাতো বোনকে যাকে তারা দাদী বলে। সেই নিয়মে সেজো চাচার বিয়ে হয়েছে তার চাচাতো বোনের সাথে। এখন নীরার বিয়ে তার চাচাতো ভাই মোর্শেদের সাথে। নীরার খুব অসহ্য লেগেছে এই নিয়ম। কেন এমন নিয়ম মানতে হবে? ভাই বোনের মতো বড় হয়ে এখন স্বামী স্ত্রীর মতো জীবন কাটাতে হবে এটা নীরা কিছুতেই মানতে পারে না। তার চেয়েও বড় কথা মোর্শেদটাকে ছোটর থেকেই নীরার সহ্য হয় না। কোনো ব্যাপারেই মোর্শেদের সাথে তার মিল হয় না। নীরা ডান বললে মোর্শেদ বলে বাম। এরকম একজনের সাথে সারাজীবন কিভাবে কাটবে তার? নীরা প্রচন্ড মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আকাশের মেঘে ঢাকা চাঁদ টাকে দেখে। ঠান্ডা বাতাস ছুয়ে দিলো নীরাকে। তবুও তার গরম লাগছে ভীষণ। বৃষ্টি হবে নাকি? নীরা অধীর আগ্রহে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে।

চলবে—–

©Farhana_Yesmin।